#সিন্ধুর_নীল(পর্ব-৩১)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৫৩.
রিকশা থেকে নেমে ব্যাগ গুলো ধীরে সুস্থে নামিয়ে কিছুক্ষণ বাড়ির নেইমপ্লেটের দিকে তাকিয়ে রইল নিদ্রা। বড় বড় করে লিখা আছে ‘খান বাড়ি’। ক্ষাণিক সময় চুপ করে চেয়েই রইল সে। একজন বৃদ্ধ গেইট খুলে বেরিয়ে এসেছে কখন খেয়াল করেনি। বৃদ্ধ এগিয়ে এলো নম্র গলায় বলল,
-‘কে মা তুমি? কাকে চাইছ?’
নিদ্রা ভড়কে গেল আকস্মিক। সালাম দিয়ে বলল,
-‘আমি আদাহ্ এর খালাতো বোন। নিদ্রা।’
লোকটি বিচলিত হয়ে উঠল। ব্যস্ত হয়ে নিদ্রাকে বলল,
-‘আরে মামণি বলবা না তুমি আদাহ্ বুর বোন।’
-‘ব্যস্ত হবেন না। কেবল বাড়ির ভেতর ঢোকার ব্যবস্থা করে দিলেই হবে।’
-‘আসো আসো।’
বৃদ্ধ লোকটির নাম হেমায়েত খান। আদাহ্ এর দাদার ছোট ভাই। অত্যন্ত শান্ত লোক। আদাহ্ এর দাদা হলো গম্ভীর রাগী আর তার ভাই একদম তার বিপরীত।
বাড়ির ভেতরে ঢুকে নিদ্রা পুরো থ বনে গেল। একেবারে রাজকীয় অবস্থা! নিদ্রা প্রথম বারই এসেছে। না না! বুঝ অবস্থায় প্রথম বার। এর আগে ছোট বেলায় এসেছিল চার বা পাঁচ বছর বয়সে।
নিদ্রাকে বাড়ির ভেতর প্রথমে দেখেন তার খালামণি অর্থাৎ ইসরাত আরা। তিনি ছুটে এসে জড়িয়ে ধরেন নিদ্রাকে। খুশির চোটে আবেগে কেঁদেই দেন। বলেন,
-‘কী মনে করে? হ্যাঁ! এতদিন পর মনে পড়েছে যে তোর একটা খালামণি আছে?’
-‘আমার সবসময়ই মনে পড়ে খালামণি। তবে ব্যস্ততার জন্য সম্ভব হয়ে ওঠে না।’
-‘থাক! আর ওসব অযুহাত নয়! খেয়েছিস কিছু! কত দূরের পথ। যা যা ফ্রেশ হয়ে নে।’
তিনি জোরে হাঁক ছাড়লেন,
-‘আদাহ্? এদিকে আয়। দেখ কে এসেছে!’
আদাহ্ মনে হয় বসেই ছিল কারো আসার প্রতিক্ষায় এমন ভাবে দৌড়ে এলো! নিদ্রা আপু বলেই নিদ্রার উপর ঝাপিয়ে পড়ল। নিদ্রা হেসে ফেলে।
————–
এহসান চুপ করে বসে আছে নিদ্রার বেডরুমে। সে এসেছিল নিদ্রাকে নিয়ে যেতে। এখানে এসে জানতে পারলো যে নিদ্রা নাকি বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গেছে। এহসানের রাগ হলো তারই সাথে হলো অভিমান। নিদ্রা কখনো নিজ থেকে তার সাথে যোগাযোগ করেনি। বরং এহসান নিজেই কল দিতো নিদ্রা বিরক্ত হতো। প্রথম প্রথম অনেক বিরক্ত করেছে পরে তার মনে হয়েছে নিদ্রাকে স্পেস দেওয়া দরকার। নিদ্রা নিজেও কিছু একটা ফিল করুক। তবে নিদ্রার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এহসান ভেবেছিল রাজশাহী থেকে আসার পর নিদ্রা নিজেই যোগাযোগ করবে কিন্তু করেনি। এহসানের মনে কোথাও আশার আলো জেগেছিল যে নিদ্রা নিজ থেকে আসবে। আসেনি!
এহসান যখন এসেছিল তখন নিদ্রার মা আপ্যায়ন করে বাসায় ঢোকায়। তবে বেশ কিছুক্ষণ পরেও যখন নিদ্রার দেখা মিলল না তখন আর না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসল ‘নিদ্রা কোথায়?’ নিদ্রার মা আমতা আমতা করেই জানালো তাকে যে নিদ্রা ট্যুরে গিয়েছে। তখন এহসান লজ্জাও পেয়েছে কারণ সে স্বামী হয়ে কিছুই জানেনা। এভাবে শ্বাশুড়ির সামনে লজ্জিত হতে কার ভালো লাগবে? সে চলেই আসতো তবে নিদ্রার মায়ের অনুরোধে তাকে বসতে হলো। কারণ তিনি রান্না করেছেন আর এহসানকে না খেয়ে যেতে দিবেন না। তাই ফ্রেশ হওয়ার জন্যই পাঠিয়েছে নিদ্রার রুমে।
এহসান উঠে দাঁড়ায়। সারা রুমে পা চালিয়ে ঘুরঘুর করে। তখনিই তার চোখ যায় নিদ্রার ড্রেসিংটেবিল এর দিকে একটি ছোট্ট নোটবুকের উপর। কৌতূহল বশত সে খুলে প্রথমেই দেখল ‘Nidras Secret’ লেখা। এহসান হেসে দিল। কিছু পৃষ্ঠা পড়ল যেখানে নিদ্রা খুব খুব গোপন কথা লিখেছে। কিছু দেখে এহসান হাসলো আবার লজ্জা পেল। তাই আর সব না দেখে সে নোটবুক বন্ধ করতে গিয়েই দেখে পেছনের দিকে লাল কলমে লিখা ‘অ+ন’। এহসান স্তব্ধ হয়ে চেয়ে থাকে। এই ‘অ’ কে? কোনো ছেলে? হতেই পারে। তবে পুরো নামটা কী? অনিন্দিতা? আরে তার নাম এভাবে লিখবে কেন? তাহলে মুনতাহার ম কোথায়? সে কেন বাদ যাবে!
এহসান হঠাৎ করেই মনে করল সেই দৃশ্যটি! তার বিয়ের সময় রিসোর্টে অভ্রকে দেখে নিদ্রার দেওয়া সেই মুঁচকি হাসি। অভ্রর দিকে তাকিয়ে থেকে এহসানের হাতে নখ বসিয়ে দেওয়া! এহসানের মস্তিষ্ক খালি লাগছে। যদি এটা সত্যি হয় তবে তার কী হবে! সে নিদ্রাকে ভালোবাসে। সে চায়না নিদ্রা তারই প্রিয় বন্ধুকে পছন্দ করুক। আচ্ছা? অভ্রর মনেও এমন কিছু নেই তো! মানসিকভাবে এহসান ভেঙে পড়ছে। দ্রুত নিদ্রার রুম ত্যাগ করে। নিদ্রার বাবা-মা দুইজনকে যাওয়ার সময় নানা অযুহাত দিয়ে বের হয়ে যায় বাড়ি থেকে। তার দম বন্ধ লাগছে। অস্বস্তি হচ্ছে।
৫৪.
ল্যাপটপে ব্যস্ত হয়ে কাজ করছে নির্ঝর। পাশেই চুপচাপ এহসান বসে আছে। অভ্র দুইজনকে অনেকক্ষণ যাবৎ পর্যবেক্ষণ করে চলেছে। নির্ঝর কাজ শেষ হলে ল্যাপটপ বন্ধ করে পাশে রেখে দিল। এহসানকে বলল,
-‘হেই ড্যুড! হোয়াট’স আপ! ম্যুড অফ যে?’
-‘ভালো লাগছেনা।’
-‘কেন?’
-‘এমনিতেই।’
-‘আচ্ছা?’
-‘তো আর কী হবে?’
-‘কত কিছুই তো হওয়ার আছে।’
নির্ঝরের চোখে মুখে দুষ্টুমি। এহসান বিরক্ত হলো। অভ্র হঠাৎ করেই বলল,
-‘ইজ এভরিথিং ওকে এহসান? নিদ্রা ঠিক আছে তো!’
এহসান চমকে উঠল। অভ্র নিদ্রার কথা কেন বলছে? কেন বলছে! এহসান একবারও ভাবলো না যে এটা একটা স্বাভাবিক প্রশ্ন ছিল। সে আরো বেশি সন্দেহের জ্বালে পা মাড়িয়ে দিল। অভ্রকে কিছুই বলল না। নিজেকে যথেষ্ট নরম রেখে বলল,
-‘কী হবে? ও ঠিক-ই আছে।’
-‘যাক ভালো।’
নির্ঝর বলল,
-‘চল না ঘুরতে যাই কোথাও।’
-‘না। ঘুরতে যাওয়ার সময় নেই।’-অভ্র বলল।
-‘কেন নেই?’
-‘আমার হবে না। তুই আমার প্রফেশন সম্পর্কে জানিস। হুটহাট ইমার্জেন্সী এসে যায়।’
-‘ছুটি নে।’
-‘তবুও এভাবে পেশেন্টকে ফেলে যেতে মন মানবেনা।’
-‘উফফ! পেশেন্ট দেখার জন্য আরো অনেক ডাক্তার আর নার্স আছে। তুই ছুটি নিবি ব্যাস।’
-‘কিন্তু!’
-‘প্লিজ না করিস না। আমি শহরের বাহিরে ঘুরতে যেতে চাইছি। আর তোরা বলছিলি না যে একদিন আমার নানাবাড়ি যাবি! তাই প্ল্যান করেছি সেখানেই যাব। মা আর ছোটরা গতকাল গিয়েছে। আদাহ্ এর নাকি বিয়ে লাগছে।’
-‘মানে? আদাহ্! ও কত ছোট!’
-‘গ্রামে এসব ফ্যাক্ট না। আদাহ্ তো তাও সতেরো পার করেছে। ওখানে তেরোর ঘরেই দিয়ে দেয় অনেক কে।’
-‘এখনও বা’ল্য’বিবাহ চলে নাকি?’
-‘চলে রে! সবই চলে তাও আবার তলে তলে।’
-‘ডিজগাস্টিং!’
-‘নোপ! ডিজগাস্টিং এর কী আছে? তুই এমন বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করতে পারবি?’
-‘করলে করব সমস্যা কোথায়? আর তুই এমন ছিঃ ছিঃ করছিস দেখা গেল তোর কপালে কোনো বাচ্চা জুটবে একদম আদাহ্ এর মতোন। অবশ্য আদাহ্কে দেখতে এডাল্ট লাগে। শি ইজ সো মাচ্ হেভি!’
-‘বডি শেমিং করবি না একদম। ও তোর বোন হয়।’
-‘আমি সেটা বলছিনা। কিন্তু ও ..
-‘বাদ দে। এহসান তুই বল কিছু। যাবি?’
এহসান হঠাৎ নিজের নাম শুনে ভড়কে গেল। কারণ এতক্ষণ সে নিদ্রাকে নিয়ে ভাবছিল। তাই সে মিনমিন করে বলল,
-‘কী বলব?’
-‘যাবি? রূপনগর?’
-‘এখন এভাবে হঠাৎ?’
-‘আরে এখন না। কাল বা পরশু।’
-‘আমার মন ভালো নেই। তোরা যা।’
-‘মন ভালো থাকবেনা কেন? আর আমরা যাব মানে? তোকে ছেড়ে কখনো কোথাও গিয়েছি আমরা?’
-‘আমার ইচ্ছে নেইরে।’
নির্ঝর চেঁচিয়ে উঠল, বলল,
-‘কীসের ইচ্ছা নেই? মজা পাইছিস? যাব বলছি তো যাব। আর কোনো কথা। ছুটি নিয়ে নে। আমি অলরেডি নিয়ে ফেলেছি। এখন জমা থাকা কাজ গুলোও কমপ্লিট করে নিয়েছি। নাও আই আ’ম ফ্রী!’
বন্ধুদের জোরাজুরিতে এহসান হ্যাঁ বলে দিল। মন থেকে অভ্রকে ঝেরে ফেলতে গিয়েও পারল না। তবুও মানিয়ে নিচ্ছিল। অভ্র তার বন্ধু। এমন কাজ সে করবেনা কখনো। আর তাছাড়া নিদ্রা ঘুরতে যেতে পারলে সে কেন পারবেনা? সে ও পারবে। নিদ্রা থাক তার মতোন। এহসান আসলেই নিদ্রার জীবনে জোর জবরদস্তি ঢুকে পড়েছে। এটা একদমই উচিত ছিল না! একদমই না!
—————
পরদিন রাত আটটায় নির্ঝর বাস টার্মিনালের সামনে গিয়ে বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। বাসে যাওয়ার প্ল্যানই করেছে কারণ এত বড় রাস্তা কেউ ড্রাইভ করতে পারবেনা। সেই এনার্জি তাদের মধ্যে নেই। তাছাড়া এবার বাস জার্নির ইচ্ছাও ছিল। তাই আর অপূর্ণ রাখেনি ইচ্ছেটা। ধীরে ধীরে অভ্র আর এহসান এলো। অভ্র একটি নেভি ব্লু টি-শার্ট পড়া আর সাথে কালো জিন্স প্যান্ট, এহসান পড়েছে কালো শার্ট আর সাদা জিন্স। নির্ঝর পড়েছে একটা হাতা কাটা সবুজ গেঞ্জি সাথে লাল হাফ প্যান্ট আর গলায় হেডফোন ঝুলিয়ে রেখেছে। এহসান আর অভ্র নির্ঝরের গেট আপ দেখে হাসতে হাসতে কাহিল হয়ে গেছে। কিন্তু নির্ঝর তো নির্ঝরই! তার এত মাথা ব্যাথা নেই ওদের হাসি তামাশায়। সে রিল্যাক্সে যেতে পারলেই হলো। বাসে উঠতে নিলেই বাসের সামনে নির্ঝর মৃত্যুঞ্জয়ের দেখা পায়। হাত মিলিয়ে বলে,
-‘আরে আপনি? কোথায় যাচ্ছেন?’
-‘আপনি কোথায় যাচ্ছেন ভাই সেটা বলুন।’
-‘রূপ নগর।’
-‘আমিও।’
-‘বাহ! ভালো তো। তা ঘুরতেই যাচ্ছেন?’
-‘হ্যাঁ। সেরকমই।’
-‘উঠবেন কোথায়?’
-‘আপাতত জানিনা। গিয়ে দেখি কী ব্যবস্থা করা যায়।’
-‘এটা কেমন কথা? এখনও ব্যবস্থা হলো না কোনো? আচ্ছা বেশ! আপনি আমার বন্ধুর মতো। চেনা জানা মানুষ। আপনি আমার নানাবাড়িতেই উঠবেন। তাছাড়া আপনার তো শখ ছিল খান বাড়ি দেখার! সেটাও পূরণ হবে।’
-‘না না। তা হয় না। আপনাদের উপর আমি কোনো চাপ ফেলতে চাইনা।’
-‘ছিঃ এমন ভাবে বলবেন না। চাপের কিছুই নেই। আপনি আমাদের কী ভাবেন আসলে? আমি বলছি কোনো সমস্যা নেই। আপনি চলুন।’
-‘আসলে আমি তো একা নেই।’
-‘ সাথে আরো কয়জন আছে? সমস্যা নেই। হবে। দশ জন হলেও হবে।’
-‘না না একজনই।’
-‘বাহ! তাই নাকি? কে?’
-‘আপনি চিনবেন তাকে। নিহারীকা এমদাদ।’
নিহারীকার নাম শুনে নির্ঝরের মুখ কুঁচকে গেল। নিহারীকা! আগে জানলে সে মৃত্যুঞ্জয়কে অফার করত না খান বাড়িতে ওঠার জন্য। এখন তো আর কিছু করার ও নেই। আর তাছাড়া তার বোঝা দরকার ছিল নিহারীকার বয়ফ্রেন্ড মৃত্যুঞ্জয়। সে তো থাকবেই তার সাথে। বাস ছেড়ে দিবে দেখে আর দাঁড়ালো না দুজনেই উঠে পড়ল। সামনের সারিতে মৃত্যুঞ্জয় বসেছে। এহসান গিয়ে দেখে অভ্র আর এহসান বসে পড়েছে পেছনের দিকের সিটে। তাদের পাশে জায়গা নেই। সে আশেপাশে তাঁকিয়ে একটি সিট পেল। জানালার কাছে না পেয়ে মন খারাপ হলেও কিছু করার নেই। ভবিতব্য যে! সে বিরস মুখে বসে পড়ে। পাশে কে বসেছে দেখতেই দেখে নিহারীকা বসে আছে। নির্ঝরের চোখ গরম হয়ে যায়। আবারও নিহারীকা! নিহারীকাও তখন তার দিকে তাঁকায়। নির্ঝরকে দেখে সে নিজেও ভীষণ অবাক হয়। কিছুক্ষণ কে’টে যায় তাদের দৃষ্টি বিনিময়ে।
#চলবে।