সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৩০)

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৩০)
লেখক— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

———————
রাতে অভ্র আর নিজের বাসায় ফিরল না। নির্ঝর আর সে সারারাত মুভি দেখার প্ল্যান করল। এহসানকে আসতে বলা হলেও সে এলো না। তাই দুই বন্ধু মিলে সেটআপ করে এখন টিভির সামনে বসে আছে। তখনিই ক্রিং ক্রিং করে কলিং বেল টা বেজে উঠল। নির্ঝর হেসে বলল,
-‘দ্যাখ! বললাম না না এসে পারবেনা।’ দেওয়াল ঘড়িতে তাঁকিয়ে বলল,
-‘যদিও ইটস্ ওয়ান এ এম। আমাদের জন্য তেমন কিছুই না।’
-‘আর ইউ সিউর এহসানই এসেছে?’
-‘ও ছাড়া কে হবে?’
-‘এত রাতে! রিসিপশনের থেকে তো কল করার কথা।’
-‘আরে ও তো আগেও এসেছে। চিনে গেছে হয়তো। তাই আর ঝামেলা করেনি।’
-‘তাও,’
-‘অভ্র তুই ভয় পাচ্ছিস?’
-‘একদমই না। তবে দেশের কী পরিস্থিতি জানিসই তো? সিরিয়াল কি’লা’র এর উপদ্রব বাড়ছে কেমন। দেখছিস না?’
-‘হুম সেটাও কথা। আরে বাদ দে ওতো ভয় পাওয়ার কিছুও নেই।’

নির্ঝর ধপাধপ পা ফেলে ড্রয়িং রুম পেরিয়ে গেল। অভ্রও পিছু নিল তার। নির্ঝর প্রথমে দরজা খুলেই নিতে চাইছিল কিন্তু অভ্র তাকে সরিয়ে বলল,
-‘চেক কর আগে।’
গ্লাসের ফাঁক থেকে দেখল একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নির্ঝর হেসে বলল,
-‘ভাই মেয়ে একটা তো।’
-‘কোন মেয়ে?’
-‘ওইদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। দেখা যায় না তো।’
-‘আচ্ছা খোল।’
-‘বাহ! মেয়ের কথা শুনেই? হ্যাঁ!’
-‘ফালতু।’
অভ্র দরজা খুলে দিল নিজেই। ওপাশে থাকা মেয়েটিও এদিকে ফিরল। চোখে চোখ পড়ল। অভ্র কিছুটা বিস্মিত হয়েও গেল।
-‘মিস. নিহারীকা? আপনি?’
নামটা শুনেই নির্ঝরের চোখ মুখের অবস্থা অন্যরকম হয়ে গেল। অভ্রকে দরজা থেকে একটু সরিয়ে নিজে সামনে এসে দাঁড়ালো। নিহারীকাকে দেখে বরাবরের মতো প্রচন্ড রেগে গেল। বলল,
-‘এই মেয়ে? কী চাই এখানে?’
-‘আপনাকে।’
-‘কী! এত বড় কথা!’
-‘না ছোট্ট একটা শব্দ কেবল। অর্থটা বড় করে নিলে বড়।’
-‘আপনি এখানে কী করছেন হ্যাঁ!’
-‘জ্বি আমার বাটি গুলো নিতে। আপনাদের বুয়া’কে বলেছিলাম বাটি গুলো ফেরত পাঠাতে কিন্তু পাঠায়নি। তাই নিজেই এলাম।’
-‘মানে কী? কীসের বাটি?’
-‘নিহারীকা আপনি এখানে কীভাবে!’
অভ্রর কথার জবাবে নিহারীকা বলল-‘জ্বি এই ফ্ল্যাটটা’ পেছন বরবার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, ‘এখানে আমি থাকি। কিনে রেখেছিলাম আরো আগেই। এখন এক সপ্তাহ হলো উঠেছি।’
-‘ওহ ভালো তো। আসুন না ভেতরে আসুন।’
-‘কী ভেতরে আসবে? এই না বাহিরে থাকুন।’
নির্ঝরের দিকে অভ্র এবার রক্তচুক্ষ নিয়ে তাঁকালো। ব্যাটা বিটলা এসব পাগল ছাগলের মতো বিহেইভ কেন করছে? অভ্র শক্ত এবং কঠিন গলায় নির্ঝরকে বলল,
-‘ডোন্ট এক্ট লাইক আ চাইল্ড!’
নিহারীকা বলল,
-‘আমি কিন্তু এমনিতেও এত রাতে দুইটা পুরুষের ঘরে ঢুকছিনা মি. নির্ঝর! সো জাস্ট রিল্যাক্স!’

নির্ঝর রাগ করে দরজা থেকে সরেই গেল। অভ্র নিহারীকাকে বলল,
-‘একটু অপেক্ষা করুন। আপনার বাটি গুলো আমি নিয়ে আসছি।’
বাটি গুলো যেহেতু ধুয়ে রাখা ছিল তাই আর বেশি একটা সময় লাগল না। তবে খালি বাটি দেওয়া ঠিক নয়। তাই নির্ঝরের কিছক্ষণ আগে বানানো স্যুপ নুডুলস্ ও দিল সাথে করে। নিহারীকা বলল,
-‘এটা কেন?’
-‘আমার মা, দাদুরা সবসময় কারো প্লেট বা বাটি খালি ফেরত না দিয়ে সাথে করে খাবার পাঠায়। এটা একটা সুন্দর লোকাচার।’
-‘সাউন্ডস্ গ্রেট! আমি কখনো এমন কিছুর সাথে পরিচিত ছিলাম না। ফার্স্ট টাইম একা থাকছি তাই এখন অনেক কিছুই শিখছি।’
-‘একা?’
-‘আমি তো একা-ই। আমার একূল ওকূল সবকূলে আপনজন থাকা স্বত্তেও আমি একা। ভীষণ একা!’
নিহারীকা চলে গেল। অভ্র দাঁড়িয়ে দেখল নিহারীকার একরাশ কষ্ট জমা দীর্ঘশ্বাস ফেলার কঠিন মুহূর্তটি।

৫২.
নিদ্রা ঢাকা এসেছে আজ দুইদিন। এহসানদের বাড়ির কাউকে সেই খবর জানাতে মানা করেছে। বিশেষ করে এহসানকে। এহসান রাজশাহী থেকে ফেরার পরে নিদ্রাকে একবারও কল করেনি, কোনো খোঁজ খবর নেয়নি। নিদ্রার মনে হচ্ছে এহসানের মোহ কেটে গেছে। নতুন নতুন বিয়ে করলে সব পুরুষেরই বউয়ের প্রতি একটু দরদ উতলে পড়ে। কিছুদিন যেতেই সেটা বদলে যায় তিক্ততায়। তাছাড়া হোটেলের সেই রহস্যজনক খু’নটাও নিদ্রাকে এহসানের বিরুদ্ধে কেন যেন খুব ভাবিয়ে তুলছে। নিদ্রা নিজেই জানে না এমন কেন। সে চাইছে সব কিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে কিন্তু পারছেনা। সব কিছুই ধোঁয়াশা লাগছে।

নিদ্রা নিজের টেবিলটা একটু গুছিয়ে নিল। বেশ কিছুদিনের বন্ধ এখন। পরীক্ষা শেষ হয়েছে। ওই বাড়িতে তার আসার খবর না জানালেও তাদের এটা জানার কথা যে নিদ্রার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। অবশ্য তারা যদি জানতে চাইতো তবে জানতে পারতো। জানতেই চায়নি হয়তো। এহসানের মা’য়ের প্রতি নিদ্রার একটা অন্যরকম ধারণা ছিল। সে ভেবেছিল এই মানুষটা খুবই আন্তরিক, মিশুক। আর দেখো! ওনার কোনো ফোনকল আজ পর্যন্ত নিদ্রা পায়নি। এই দুনিয়াটা কত অদ্ভুত? তাদের সম্মানের কথা চিন্তা করেই তো সে সেদিন বিয়েটা করেছিল। আর এখন! তারা নিদ্রাকে ভুলেই গিয়েছে? দুনিয়াটা এমন কেন? নিদ্রার মনটা শক্ত ঠিক তবে সবক্ষেত্রে কাঠিন্য এনে রাখাও তো যায়না। তারও মন পুঁড়ে যায়। কষ্ট হয়। নিজের নিয়তি নিয়ে মাঝে মাঝে আফসোস হয়। মনের কোথাও একটু কষ্ট ভেসে আসে, নিরবে বলে যায়,
-‘অভ্র কেন আমায় একটু ভালোবাসলো না?’

নিদ্রার চোখ ছলছল করে। অসহায় লাগে নিজেকে। মন খারাপ করে বসে থাকে বিছানার এক কোণায়। তখনিই ক্রিং ক্রিং করে ফোনটা রিং হতে থাকে। নিদ্রা চোখ মুছে ফোনটা হাতে নেয় স্ক্রিনে ভেসে উঠছে ‘আদাহ্’ নামটি। নিদ্রার এই এত কষ্টেও ঠোঁটে হাসি ফুঁটলো। যাক! কেউ তো খবর রাখে নিদ্রার! নিদ্রা জানে তার এই আদরের বোনটি এখন কী বলবে। সে মুঁচকি হেসেই কল রিসিভ করল তাৎক্ষণিক ওপাশ থেকে উচ্ছ্বাসিত গলায় আদাহ্ বলল,
-‘নিদ্রাপু? আমাদের বাড়ি আসছো কবে?’
নিদ্রা খিলখিলিয়ে হেসে দেয়। দীর্ঘদিন পরে কথা হচ্ছে আর প্রথমেই সে এমন কথা বলছে! নিদ্রা বলল-
-‘কেন? আদাহ্ রানীর কী বিয়ে লেগেছে নাকি!’
-‘তা আর বলতে! পা’গ’ল হয়ে যাচ্ছি আমি! দাদাজান উঠে পড়ে লেগেছে আমায় বিয়ে দেওয়ার জন্য। আমার কথা কেউ শুনছেই না। তোমাকে তো এত বছর ধরে বলে আসছি একটু বেড়াতে আসো। তুমি তো তখন ফ্রী থাকোনি, আসার ইচ্ছাও পোষণ করোনি তাই আসোনি। তবে আজ আমার তোমাকে বড্ড প্রয়োজন। আমাকে বাঁচাও এই পরিস্থিতি থেকে।’
-‘কী বলছিস! তোর দাদাজানের মাথা নষ্ট হলো নাকি? তোর বয়স এখনো আঠারোও তো হয়নি।’
-‘দাদাজান পারেনা আট বছর থেকেই বিয়ের ব্যবস্থা করে। আঠারো তো দূরের কথা।’
-‘খালামণি কিছু বলছেনা?’
-‘মা? আমাদের বাড়িতে বউদের কথার দাম আছে?’
-‘আঙ্কেল?’
-‘বাবা তো দাদাজানের কথা ফেলতে পারেনা। দাদাজানের হ্যাঁ তার জন্যও হ্যাঁ হয়।’
-‘কী করবি তবে?’
-‘জানিনা আমি। তুমি প্লিজ আসো। কিছু একটা করতে হবে। আমি একা একা পারছিনা আর।’
-‘আচ্ছা আমি দেখছি কী করা যায়।’
-‘শুধুই দেখবে? আমি তো তোমার আপন বোন না তাই শুধু দেখছি বলছো। আপন বোন হলে কী আর এটা বলতে?’
-‘একটা চড় দিব অসভ্য। আমি কালকেই আসছি।’
-‘কালকে আসলে হবে না। আজকেই আসো। আজকেই মানে এক্ষুণি রওনা দাও। কালকে আমাকে দেখতে আসবে। কানা ঘুষায় শুনেছি কালকেই বিয়ে পড়িয়ে দিতে পারে পছন্দ হলে।’
-‘আচ্ছা বেশ। আমি আসছি তুই চিন্তা করিস।’
-‘সাবধানে এসো। আমি যে তোমাকে এইজন্য আসতে বলেছি তা কাউকে বলো না প্লিজ। বলবে বন্ধ পড়েছে ঘুরতে এসেছো।’
-‘জানি জানি। আমাকে আর শেখাতে হবে না। পাঁজি মেয়ে!”

নিদ্রা কল কেটে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইল। এহসানদের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলল খুব কষ্টে। বর্তমানে তার ছোট্ট বোনটির চিন্তা হচ্ছে। তার মতো তার বোনটারও এমন করুণ পরিণতি হোক তা সে চায় না। একটুও না! তাকে এক্ষুণি বেরিয়ে পড়তে হবে রূপনগরের উদ্দেশ্যে। ব্যাগপত্র গোঁছানোর সময়ে সিন্ধুর নীল বইটিও নিয়ে নিল। হঠাৎ করেই বইটি ভীষণ টানছিল যে!

#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here