সিন্ধুর_নীল (পর্ব-২৯) লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-২৯)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৪৯.
ঠক ঠক শব্দ শুনে নিদ্রার মাত্র চোখে লেগে আসা ঘুমটা ভঙ্গ হলো। কিছুটা বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলতেই এহসানকে দেখা গেল। এহসানের পেছনেই আছে একজন হোটেল সার্ভিস বয়। নিদ্রা সরে দাঁড়ালো দরজা থেকে। কক্ষে প্রবেশ করল এহসান এবং তার পরই সার্ভিস বয়টি। সে খাবার পরিপাটি করে রেখেই চলে গেল। দরজা টা পুনরায় লক করে নিদ্রা এহসানের দিকে তাঁকালো। বেশ গম্ভীর তার চোখ মুখের অবস্থা। কিছু হলো নাকি? নিদ্রা একটু এগিয়ে এলো বিছানার কাছে। কারণ এহসান বিছানায় বসে আছে আর খুব মনোযোগ সহকারে মোবাইলে কী দেখছে। নিদ্রার এবার রাগ হলো। সেই কখন বেরিয়েছিল লোকটা ফেরার নাম গন্ধই ছিল না কোনো। এখন রাতে নয়টা বাজে। এতক্ষণ সে তাকে এভাবে একা ফেলে কই কই ঘুরছিল? নিদ্রা বেশ গম্ভীর হয়েই বলল,
-‘কোথায় ছিলেন এতক্ষণ?’
এহসানের কোনো জবাব নেই। সে এখনও ব্যস্ত আছে ফোনের ভেতর। এবার তাই নিদ্রা বেশ চেঁচিয়ে উঠল,
-‘কোথায় ছিলেন আপনি! আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করছি আমি উত্তর দিচ্ছেন না কেন?’

এহসান ক্ষাণিকটা ভড়কে গেল। তারপর মৃদু হেসে বলল,
-‘ভার্সিটির কয়েকটা ফ্রেন্ডস্ এর সাথে দেখা হয়েছিল। অবশ্য, ওদের নিজস্ব বাড়ি এখানে নয় তবে চাকরী সূত্রে এখানে আছে। তো সবার সাথে আড্ডা দিতে দিতে রাত হয়ে গেল খুব।’
-‘এতক্ষণ কীসের আড্ডা? আমি একা এইখানে আর আপনি বাহিরে আড্ডা দিচ্ছেন?’
-‘না আসলে তা নয়। বাড়িতে তো কোনো কোনো রাত ফেরাই হয় না। আজ তো জলদিই আসলাম। ওরা তো আসতে দিচ্ছিল না। জোর করছিল খুব তাদের বাসায় যাওয়ার জন্য। আমি তোমার কথা বলেই চলে আসলাম। তবে খুব করে বলছিল তোমায় নিয়ে যেতে একদিন। সবার সাথে আলাপ করিয়ে দিতে।’
-‘আমি কারো সাথে আলাপ করতে ইন্টারেস্টেড নই।’
-‘জানি।’
-‘কী জানেন?’
-‘এই যে তুমি ইন্ট্রোভার্ট।’
-‘আমি ইন্ট্রোভার্ট! কী বলতে চাইছেন কী আপনি! কোন এঙ্গেল থেকে আমাকে এমন মনে হয়? আমি অসামাজিক জীব!’
-‘দেখো আমি তোমাকে অসামাজিক জীব বলিনি। তুমি নিজেই বলেছ। তবে মন্দও বলনি। ভালোই বলেছ।’
নিদ্রা চরম রেগে গেল। তারপর খেয়াল করল এহসান তার সাথে কথা বললেও তার একটা ধ্যান কেবল তার মোবাইলেই। ব্যাপারটা অদ্ভুর ঠেকল তার কাছে। সে বলল,
-‘আপনি আমার সাথে কথা বলছেন সেটা আমার মুখের দিকে না তাঁকিয়ে মোবাইলের দিকে তাঁকিয়ে বলছেন কেন? মোবাইলটা আমি নাকি!’
এহসান এবার সরাসরি নিদ্রার দিকে তাঁকায়। হালকা হেসে বলে,
-‘সে তো মোবাইলে তুমি আছোই। তবে এখন আমি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি।’

নিদ্রার আচানক মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে বলল,
-‘কীসের গুরুত্বপূর্ণ কাজ?’
-‘যে বন্ধুদের সাথে দেখা করেছি তাদের মধ্যে একজনের একটা বাড়ির ডিজাইন নিয়ে সমস্যা। সেইটাই ঠিক করার জন্য অনুরোধ করল খুব করে। ক্লায়েন্ট নাকি প্রেশার ক্রিয়েট করছে আর বেচারাও কাজটা একা হাতে সামলাতে পারছেনা। সো হি নিডস্ মাই হেল্প। এন্ড এজ এ ফ্রেন্ড আই আম হেল্পিং হিম এজ মাচ্ আই ক্যান।’
-‘ওকে। করুন হেল্প।’
-‘আপাতত ছবিগুলো দেখে নিলাম বাকিটা ঢাকা গিয়েও করতে পারব। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি নামাযটা পড়ে খাবার খেয়ে নিব। ঠিক আছে?’
-‘আচ্ছা।’
-‘তুমি পড়েছ?’
-‘হুম।’

এহসান নামায পড়ে নিলে দুজনে একসাথে ডিনার করে। রুম সার্ভিসকে কল দিলে তারা এঁটো প্লেট নিয়ে যায়। নিদ্রা ঘুমানোর সময় বলল,
-‘আপনি রাজশাহী এসেছেন কেন?’
-‘আমার দরকার ছিল তাই।’
-‘দরকারটা কী?’
-‘তুমি বুঝবেনা। ঘুমাও।’
-‘আপনি আমাকে মিস করছিলেন খুব?’
-‘হয়তো।’
-‘আপনি খুব বদলে গেছেন। আগে তো এমন ছিলেন না।’
-‘কেমন ছিলাম আগে?’
-‘আগ বাড়িয়ে কথা বলতেন আমার সাথে। আমি বিরক্ত হলেও বারণ শুনতেন না।’
-‘কখনো কখনো ইগনোর করাটা যে খুবই কাজে দেয় ব্যাপারটা সত্যিই বুঝতে পারলাম।’
-‘ইগনোর করছেন আমায়?’
-‘আসলে সেইরকম কিছু নয়। ঢাকা থেকে আসার আগেই তোমাকে বলেছিলাম তোমার অনুমতি ব্যতীত আমাদের মধ্যে আর কিছু হবে না।’
-‘তাই বলে কথাও বলবেন না?’
-‘কথা বলছি তো।’
-‘একদমই বলছেন না। আমিই আগ বাড়িয়ে বলছি। আপনি পাত্তাই দিচ্ছেন না।’
-‘এবার বুঝতে পেরেছ তো যখন আমি কল দিলে এভোয়েড করতে তখন আমার কেমন লাগত?’
-‘আপনি প্রতিশোধ নিচ্ছেন?’
-‘বলতে পারো সেটাই।’

নিদ্রার গলা ধরে এলো। ছোট ছোট কুশন দিয়ে এহসানকে মারতে থাকে। এহসান কিছু বলেনা। হাসতে হাসতে নিদ্রাকে একটানে নিজের বুকে ফেলে। আর জড়িয়ে রাখে পরম আদরে। এদিকে অতি রাগ আর ক্ষোভে নিদ্রার কান্না এসে যায় সে রীতিমত ফোঁপাতে থাকে। আজ তার কী হলো? এহসান এত টা প্রভাব ফেলছে কীভাবে আজ তার উপর?

৫০.
অভ্র এখন দাঁড়িয়ে আছে নির্ঝরের আপার্টম্যান্টের নিচে। গেইটে এন্ট্রি ফর্ম সাইন করে উপরে যখন উঠতে নেয় তখনিই একটা পরিচিত মুখ দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে। মুখটা পরিচিত ঠেকলেও নামটা মনে পড়ছিল না। সে এগিয়ে যায় এবং ব্যক্তির উদ্দেশ্যে বলে,
-‘আপনি?’

মৃত্যুঞ্জয় অভ্রকে এখানে দেখে একদমই অবাক হলো না। বরং সে এটাকে স্বাভাবিক ভাবেই নিল। হেসে বলল,
-‘আরে ডক্টর অভ্র যে! কী খবর?’
-‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি নিহারীকার ফ্রেন্ড না? নামটা আসলে ঠিক মনে করতে পারছিনা।’
-‘হুম নিহারীকার বন্ধু আমি। আমার নাম মৃত্যুঞ্জয় সরকার।’
-‘ওহ। আই আম এক্সট্রিমলি স্যরি নামটা আসলে আমার মাথা থেকেই বের হয়ে গেছিল।’
-‘কোনো ব্যাপার নয়। এখানে কি আপনার বাসা?’
-‘না। নির্ঝরের ফ্ল্যাট এখানেই। চলুন না। চা কফি খাওয়া হবে। ডিনারটাও না হয় করলেন। তিনজন বেশ ভালোই মজ মাস্তি করব।’
-‘আসলে সময় যদি থাকত আমি অবশ্যই এই সুযোগ মিস করতাম না। কিন্তু আমার খুব তাড়া আছে। আমাকে নিজের কর্মস্থলে যেতে হবে আর্জেন্ট।’
-‘ওহ। এইখানে আপনি..’
-‘আমার রিলেটিভস্ এর বাসা। দরকারি কাজে আসতে হলো। আচ্ছা ডক্টর অন্য কোনো দিন না হয় বসে গল্প করা যাবে। আজ আসছি।’
-‘হ্যাঁ। আসুন। ভালো থাকবেন।’
-‘আপনিও।’

মৃত্যুঞ্জয় চলে গেলে অভ্রও নির্ঝরের ফ্ল্যাটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এদিকে এত বড় বড় ফ্যামিলি বাসাগুলোর মধ্যে নির্ঝরের একা থাকাটা তার কাছে কেমন যেন লাগে। চাইলে ছোট বাসাও নিতে পারত কিন্তু ছোট বাসায় নবাবজাদা থাকতে পারবেন না। তার ছোট বাসায় দম বন্ধ লাগে। অভ্র বর্তমানে স্বচ্ছল হলেও একসময় তার বড্ড অস্বচ্ছলতায় কাটে। বই কেনার টাকাও খুব কষ্টে যোগাড় করত। এই দুইটা বন্ধুই তো কত বিপদে আপদে সাহায্য করেছে। আর্থিকভাবেও এবং মানসিক ভাবেও। অভ্রর বাবার বংশ নিচু শ্রেণীর নয়, তবে তার বাবা তার চাচাদের মত কম পড়ালেখা করে বিদেশ গিয়ে অঢেল পয়সা কামাতে পারেনি। পেশায় তিনি একজন হাই স্কুল শিক্ষক। তিনি ভাইদের ভালো ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে নিজের জীবনের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সময় নষ্ট করেছেন। অবশ্য নষ্ট বলা চলে না। তিনি কখনোই দায়িত্ব এড়িয়ে চলেনি। বাবার এই জিনিসটাই অভ্র বেশি ভালোবাসে এবং অনেক মান্য করে। যদি চাচারা অন্তত তার বাবাকে একটু দেখে রাখত তবুও নিজের মনকে সে বুঝ দিতে পারত। তবে চাচারা বিয়ে শাদি করে অতি দ্রুতই নিজেদের সফলতার পেছনের বড় ভাইকে ভুলে গেছেন। অবশ্য অভ্রর বাবা কোনোদিন নিজের এইসব শ্রমের ব্যাপারে কাউকে কিছু বলেন নি। অভ্রর ফুপিই তাকে সব জানিয়েছেন। এমনকি বেঁচে থাকা কালীন অভ্রর দাদিও কষ্ট পেয়েছেন ছোট ছেলেদের বড় ছেলের প্রতি করা অন্যায় দেখে। দিন রাত কাঁদত আর তাদের হেদায়াতের কথা বলত। অভ্র ভেবে হেসে দেয়। দাদি তার খুব প্রিয় মানুষ ছিলেন। শুধু প্রিয় যে তাও না। একদম খুব কাছের মানুষ যার সাথে সুখ দুঃখের গল্প করলে বুকের ভার কমত। দাদি নেই আজ ছয় বছর হতে চলল। দাদি চাইত অভ্র একদিন খুব কামাই করুক।আজ সে তা করছেও তবে তা চোখ জুড়িয়ে দেখার জন্য দাদি নেই। দাদা দাদিরা সারা জীবন সফল হওয়ার জন্য দোয়া করে আর যখনই সফলতা এসে যায় তখন তা দেখে যেতে পারেন না। অভ্রও হয়তো পারবেনা। হঠাৎ করেই এটা ভেবে সে হাসে। একদিন সেও দাদা হবে। কী অদ্ভুত ব্যাপার!

লিভিংরুমে গল্প গুজবে ব্যস্ত অভ্র আর নির্ঝর। তখন কলিং বেল বেজে ওঠে। বুয়া এসেছিল রাতের রান্না করে দিতে তো রান্না করার আগে সে একটু চা নাস্তা বানিয়ে দিয়েছিল অভ্র আর নির্ঝরকে। এখন ঘরটা একটু সাফ সাফাই করছিল। কলিং বেলের শব্দ শুনে সে নিজেই দরজা খুলে। কিছুক্ষণ পরে ভেতরে হাতে একটা ট্রে নিয়ে ঢুকে পড়ে। নির্ঝর বলল,
-‘কে এসেছে বুয়া?’
-‘পাশের বাসার মালিকে।’
-‘পাশের বাসা বলতে? ওহ যেইটাতে নতুন মানুষ উঠেছেন!’
-‘জ্বে। খানা দিয়া গেছে। তয় রাতে খাবারই। মুরগার রোস্ট, গরুর ভুনা আর পোলাও। আমিও ভাত রাঁধছি। মনে তো হয় না এখন আর কিছু রাঁধা লাগব!’
-‘স্ট্রেঞ্জ! আমাদের হঠাৎ এসব খাবার পাঠালো কেন?’
-‘ওত কিছু বলেনাই। বলছে যে নতুন আইছে তো এর লাগি এই ফোলোরের সক্কলের বাসা বাসায় খানা দিসে।’
অভ্র হেসে দিল বুয়ার মুখে ‘ফোলোর’ শুনে। নির্ঝরের মতো ছেলে প্রতিদিন বুয়ার এসব কথা শুনে! তার তো শুদ্ধ বাসা ছাড়া কথা বলা মানুষ পছন্দ না। আর সেখানে বুয়ার ভাষা তো একেবারে হ জ ব র ল।

-‘আচ্ছা রাখেন। তাহলে আপনি চলে যান। আর খাবার তো বেশিই আছে। কিছুটা নিয়ে যান আপনি। নাহলে নষ্ট হবে। এত খাবার দিল মনে হয় আয়োজন করে কেবল আমাদের জন্যই রান্না করছে। হা হা।’

নির্ঝরের কথা মত বুয়া কিছুটা নিল। আর বাকিটা টেবিলে সাজিয়ে দিল। খেতে বসে নির্ঝর আর অভ্র একদম ঘাপুস ঘুপুস খেল। নির্ঝরের শান্তিটা বেশি লাগছিল। কেন না অনেকদিন পর সে একটু ঘরোয়া ভালো খাবার খাচ্ছে। মা বলেছিল বাড়ি যেতে কাজের চাপে এই কয়দিন যাওয়া হয়নি। তাই খাওয়া দাওয়াও কোনো রকমে কেটেছে।

৫১.
বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। নিদ্রার পরীক্ষাও চলছে। একদিন বান্ধবীরা মিলে ঠিক করল পরীক্ষা শেষে খাবারের হোটেলে যাবে। ভাত, ডাল আর ভর্তা খাবে। সেই অনুযায়ী হোটেলে গেল। খাবার এসে গেল সবাই খাচ্ছে হঠাৎ করেই টিভিতে ব্রেকিং নিউজ আসে। কিছুদিন আগে রাজশাহীর নাম করা পাঁচ তারকা হোটেলে একটি ম’র’দে’হ উদ্ধার করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে আজ থেকে সাত আটদিন আগের ঘটনা এটি। হোটেলের নাম আর সব বিবরণ শুনে নিদ্রার গা কাটা দিয়ে উঠল। যেই তারিখ ধারণা করা হচ্ছে সেই তারিখে নিদ্রা আর এহসানও সেখানেই উপস্থিত ছিল। ক্ষাণিক বাদেই একটা সিসিটিভি ফুটেজ দেখানো হলো। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে খু’ন হওয়া মেয়েটি দৌঁড়ে একটি রুমে ঢুকে গেল তার পেছন পেছন একটি লোক। লোকটিকে দেখেই নিদ্রার চোখ মুখ উল্টে যাওয়ার মত। বিড়বিড়িয়ে বলল,
-‘এহসান!’

তবে পু’লিশ ধারণা করছেন পুরুষ এর ছদ্মবেশে খু’নি ছিল মূলত মহিলা। কারণ জুম করে তারা দেখতে পাচ্ছিল স্পষ্ট তার হাত, চুল, চোখ মুখের একাংশ। বড় কথা জুতোটি ছিল লেডিস সুজ্। তবে এই একাংশ দেখেও ঠিক ঠাওর করতে পারল আসল চেহারাটি। অনিন্দিতা বলল,
-‘এই তোরা না ঐ হোটেলে উঠেছিলি? কী সাংঘাতিক কান্ড। যদি তোদের কোনো ক্ষতি হয়ে যেত! আল্লাহ বাঁচাইছে।’

নিদ্রার মাথা ভনভন করছে। বারবার এহসান নামটি এসে মাথায় বাড়ি খাচ্ছে। এমনটা এর আগে শপিংমলেও হয়েছিল। সে যেখানেই যায় সেইখানেই এমন কাহিনি ঘটে যায় পরমুহূর্তেই। কেমন যেন ব্যাপারটা।

#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here