সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৩৪) লেখক— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৩৪)
লেখক— ইনশিয়াহ্ ইসলাম।

৫৯.
গ্রামের এক হতদরিদ্র চাষার কন্যার বিবাহ হয়েছে মোড়লের ছেলের সাথে। সেই কন্যা ছয় মাসের গর্ভবতী ছিল। তার নাম আঞ্জুমান। আঞ্জুমানের পিতা দিন এনে দিন খায়। সন্তানদের ভরণ পোষনের দায়িত্ব বেশিদিন নিতে পারেনি। তাই একে একে চার কন্যাকেই অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে মুক্ত হোন। বড় দুই কন্যার বিয়েটা ভালো ঘরে হয়েছে বিধায় তার চিন্তা রইল না। তবে সেজো জনের বিয়ে হয়েছে মোড়লের অস’ভ্য, বেয়া’দব, ল’ম্পট ছেলের সাথে। দরিদ্র চাষা হামিদ মিয়া চাইছিল না এই বিয়ে দিতে তবে মোড়লের চাপে দিতেই হলো। মোড়লের ছেলে সিদ্দিক আঞ্জুমানের নজরকাড়া রূপে মুগ্ধ হয়েই তাকে বিয়ে করেছে। ওই মুগ্ধতায় তখন এটা খেয়াল ছিল না যে আঞ্জুমান গরীব চাষার মেয়ে। পরবর্তীতে যখন বিয়ে হলো, সংসার চলছিল তখনই তার এটা মনে হতো লাগল কিছু পণ, যৌ’তুকের প্রয়োজন আছে। শুরু হলো অ’ত্যা’চার! চাষা নিজের শেষ সম্ভল তার সেই ছোট ভিটে মাটি পর্যন্ত ব’ন্ধক রাখে। সেই টাকা সিদ্দিকের ব্যবসার জন্য দিয়ে দেয়। ব্যবসার নাম করে দিনরাত ম’দ্য’প হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকত। যখনই শেষ হলো তখন আবারও টাকা চাইল। এবার আর না দিতে পারায় শুরু হলো প্রথমবারের চেয়েও বেশি অমা’নবিক অ’ত্যা’চার। দিন রাত মারধোর করা শুরু করে। গত পরশু নাকি গলা’য় কাপড় পেঁচিয়ে মারতে নেয় তখন মাওলানার বউ এসে দেখে ফেলে। চিৎকার চেঁচামেচি শুরু হয়। ধীরে ধীরে গ্রামবাসী জড়ো হয়। পরবর্তীতে কবিরাজের কাছে নিলে সেখান থেকে আঞ্জুমানকে তার বড় বোন নিজের বাড়িতে নিয়ে যায়। এই এত কিছুর পরেও যে গর্ভের সন্তান বেঁচে আছে তা উপরওয়ালার শুকরিয়া। যেহেতু মোড়লের ছেলে তাই সঠিক বিচার পাওয়া গেল না। তাই জমিদারের কাছে বিচার নিয়ে গেলে জমিদার নিজে আসেন। বর্তমানে জমিদার শাহনেওয়াজ বসে আছেন তার জন্য আনা আসনে। বিচার শুরু হতেই আরো মানুষের দেখা মিলল। হঠাৎ ঘোড়ার পিঠে চড়ে সেখানে উপস্থিত হয় শেখ মৃত্যুঞ্জয়। সবাই সেই গুরুগম্ভীর, দীর্ঘাকার পুরুষকে চোখ বড় করে দেখে। মৃত্যুঞ্জয় গিয়ে শাহনেওয়াজ এর পাশেই দাঁড়ায়। এবার শাহনেওয়াজ বলল,
-‘বলুন মোড়ল সাহেব! আপনার পুত্রর এই জঘন্য অপরাধের সাথে আপনি কী যুক্ত ছিলেন?’

মোড়ল আচানক এমন প্রশ্নে থতমত খেয়ে গেল। সে আমতা আমতা করে বলল,
-‘আজ্ঞে না। আমি এই ব্যাপারে জানতাম না কিছুই।’
-‘যখন জানলেন তখন কী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন?’
-‘মাননীয়, আমি আমার পুত্রকে বারণ করেছি ভবিষ্যৎ এ যেন এমন না করে।’
-‘কেবল এতটুকুই? আর কিছু করেন নি? সে যে অপরাধ করেছে তার শাস্তি কী দিয়েছেন?’
-‘নিজের সন্তানকে আমি আর কী শাস্তি দিব?’
-‘আপনার সন্তান কাউকে খু’ন করতে যাচ্ছিল আপনি বলছেন কী শাস্তি দিব! আপনার উচিত ছিল তার সেই হাতটি কে’টে ফেলা।’

মোড়লের বুক ধড়ফড় করে উঠল। কথাটা বেশ উচ্চবাক্যেই বলা হয়েছে। শাহনেওয়াজ বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। আঞ্জুমানকে তলব করা হয়। অতি কষ্টে সে এসে উপস্থিত হয়। শাহনেওয়াজ জানতে চায়,
-‘আপনি বলুন! এই অপরাধের কী শাস্তি হওয়া উচিত?’
আঞ্জুমান চুপ করে রইল। শাহনেওয়াজ পুনরায় জিজ্ঞেস করলে আঞ্জুমান বলল,
-‘আপনি যাহা বলিবেন তাহাই হোক।’
-‘বেশ! আমি এর কারাদন্ডের ব্যবস্থা করছি। তারই সাথে গ্রামবাসীর সামনেই তাকে একশ ঘা বেত্রাঘাত করা হবে। যা শেখ মৃত্যুঞ্জয় প্রদান করবে।’

গ্রামবাসী এবার হৈ হৈ করে উঠলেন। আঞ্জুমানের চোখের কোণে জল। শত হোক স্বামী তো! সে কেঁদে দিল শব্দ করে, বলল,
-‘দোহাই লাগে! আমার স্বামীকে মারবেন না। তার সন্তান আমার পেটে। সেই সন্তানের কাছে আমি অপ’রা’ধী হতে চাইনে। আপনি তাকে মুক্তি দিন। কেবল তাকে আদেশ করুন সে যেন আমার পিতার ভিটে মাটি ফিরিয়ে দেয় এবং আমাকে নি’র্যা’তন না করার কথা দেয়। তবেই হবে।’
-‘আপনি কী এই কথা কোনো ভ’য় থেকে বলছেন? কেউ শিখিয়ে দিয়েছে!’
-‘না। আমি নিজ থেকে বলছি।’

শাহনেওয়াজ সিদ্দিকের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বলল,
-‘যেই স্ত্রীকে এতটা অ’ত্যা’চার করলে সেই স্ত্রী বলছে তোমাকে মুক্ত করতে। আর তুমি কীনা তাকে এই অবস্থায় ..
সিদ্দিক শাহনেওয়াজ এর পা ধরে কেঁদে দিল। বলল,
-‘মাফ করুন হুজুর। আমি আমার ভুল বুঝতে পারছি। আমি অন্যায় করেছি। এও জানি আমি ক্ষমার অযোগ্য। তবুও আমাকে ক্ষমা করুন।’
-‘আমার কাছে নয়। নিজের স্ত্রী এর কাছে গিয়ে ক্ষমা চাও। অপরাধ টা তুমি আমার সাথে নয় তার সাথে করেছ।’
সিদ্দিক আঞ্জুমানের পায়ে পড়ে। বিলাপ করে কাঁদতে থাকে। ক্ষমা প্রার্থনা করে বারংবার। অবশেষে নিজের কষ্ট বুকে চেপে আঞ্জুমান তাকে তুলে ধরে বলল-
-‘আপনাকে আমি ক্ষমা করলাম।’
সিদ্দিক এবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার মনে সত্যিই অপরাধবোধ জাগ্রত হয়েছে। তবে হামিদ মিয়া এগিয়ে এসে শাহনেওয়াজকে বললেন,
-‘হুজুর! আজ্ঞে আমার কিছু বলার আছে। আপনি হুকুম দিলেই..
-‘বলুন।’
-‘আমার আঞ্জুর লেখাপড়ার ভীষণ সখ ছিল। আমি ওরে যতটুক পারছি পড়াইছি। তবে এই জা’নো’য়া’র আমার মাইয়ার জীবন ধ্বংস করছে। তারে বাকিটা পড়বার দেয় নাই। তাগো কথা এই গেরামের কোনো মাইয়ার এত পড়ালেখার নিয়ম নাই। তাই আর পড়তে দেয় নাই। আমি চাই এখন এ যেন আমার আঞ্জুরে বিদ্যালয়ে পুনরায় পাঠায়।’
-‘বেশ তাই হবে। আর যেহেতু এই গ্রামের মেয়েদের এত পড়ার নিয়ম নেই তবে সেই নিয়ম চালু হোক। আমি জমিদার শাহনেওয়াজ সরকার ঘোষণা দিচ্ছি আগামীকাল থেকে প্রতিটি মেয়ে ছেলেদের মতই সমানতালে বিদ্যালয়ে যাবে। এবং তাদের পড়ালেখায় কোনোরূপ বাধা যেন না দেওয়া হয়। আর মেধাবী দশজনকে শহরে পড়ানোরও অঙ্গীকার দিলাম। কেউ এই কথার অমান্য করলে চরম শা’স্তি তাকে ভোগ করতে হবে। এবং স্ত্রীলোকের উপর পুরুষরা জু’লু’ম করলে তারা কঠিন তম সাজা ভোগ করবে। সকলে এ বিষয়ে সাবধান থাকবেন। অন্যায় আমি কখনো মানিনি, আজও মানছিনা ভবিষ্যতেও মানবো না ইন শা আল্লাহ্!

চারিদিকে জয় জয়কার পড়ে গেল। দূরে কলা গাছটার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে সিন্ধু। জমিদারের প্রত্যেকটা কথা শুনেছে। এই তো সেই জমিদার বাবু! যার কথা এতদিন সে শুনে এসেছে। যাকে নিয়ে সে এতদিন ভেবেছে। তার সেই চিরচেনা জমিদার স্বত্তা। সিন্ধুর মনে হলো তার হয়তো কোথাও ভুল হয়েছে। জমিদার তার সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করেনি। সবই হয়তো পরিস্থিতির দোষ। সেদিন যখন তাকে নিয়ে গিয়েছিল তখনও কোনো ক্ষতি করেনি। সিন্ধুর মুখে হাসি ফুঁটে। একটু আগে জমিদার কী বলল? শহরে গিয়ে পড়তে পারবে মেয়েরা? মেধাবী মেয়েদের শহরে গিয়ে পড়ার নিয়ম চালু করবে? তবে সে কী পারবে! শহরে গিয়ে পড়া তার হবে? মাস্টারমশাই বলেছিলেন তার যখন প্রয়োজন হবে তখন তিনি সুপারিশ করবে যেকোনো সময়, যেকোনো দিন। তবে কী মাস্টারমশাই সুপারিশ করলে তারও পড়া হবে? ওই বুড়োকে বিয়ে করা থেকে সে বেঁচে যাবে! তার পিতা রাজি হবে তো! সিন্ধু একসাথে কত কিছু ভেবে চলেছে। তার খেয়াল নেই যে সভা শেষ হয়েছে। জমিদার ফিরে যাচ্ছে। ঘোড়ার আওয়াজে তার হুশ আসে। সে সামনে তাকায়। জমিদার চলে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে জমিদারকে কিছু বলতে হবে। তার কিছু বলার আছে! সে ছুটতে থাকে সামনের দিকে। ততক্ষণে জমিদারের ঘোড়ার গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে। সিন্ধু দৌঁড় দেয় প্রাণপনে। একটু কাছে যেতেই জোরে ডাকে, ‘জমিদার বাবু!’
শাহনেওয়াজ আকস্মিক নারী কন্ঠটি কী করে যেন চিনে গেল। মনে হলো বহুদিন যাবৎ এই গলার স্বর সে শুনতে চেয়েছিল। আজ হঠাৎ শুনতে পাওয়ার পর তার যেন তৃষ্ণা মিটল। সে পেছন ফিরে তাকায়। সিন্ধু হাটুতে ভর দিয়ে মাথা নিচু করে হাঁপাচ্ছে। মাথা উঁচু করার পর সেও দেখতে পেল জমিদার তার দিকেই তাকিয়ে আছে। দুজনের চোখে চোখ পড়ে। ঘোড়া তীব্র বেগে ছুটে চলেছে। সেই সাথে দুজনের দূরত্ব বাড়ছে। তবুও একদৃষ্টে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকাই বোধ হয় তাদের জন্য বাধ্যতামূলক।

৬০.
বাগান বাড়িতে খাবার খাওয়ার পর শাহনেওয়াজ এবং শেখ মৃত্যুঞ্জয় পায়চারি করছিল। শাহনেওয়াজের চোখে মুখে এক ধরনের উজ্জ্বলতা। তা দেখে মৃত্যুঞ্জয় হাসে। বলে,
-‘তবে এই কী সেই কারণ?’
শাহনেওয়াজ অবাক হলো। জানতে চাইল,
-‘কী কারণ! কীসের কথা বলছ তুমি?’
-‘এই যে এই গ্রামে ছুটে আসার পেছনের আসল কারণ।’
-‘মৃত্যুঞ্জয় গলা ঝেরে কাঁশো।’
-‘কাজে মন না বসার পেছনে, আপনার এত চুপচাপ থাকার পেছনের কারণ টা কী এই কন্যা জমিদার সাহেব!’
শাহনেওয়াজ ধরা পড়া চোরের মত বলল,
-‘কোন কন্যার কথা বলছ?’
-‘জমিদার বাবু বলে জোরে হাঁক ডাকছিল যে তার কথাই বলছি। আমি দেখেছি আপনাদের দুজনের একে অপরের দিকে চেয়ে থাকাটা। ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল।’
-‘তেমন কিছু না। তোমার চোখের ভুল।’
-‘আপনি নিজেই বলেছিলেন শেখ মৃত্যুঞ্জয়ের চোখ আজ পর্যন্ত কেউ ফাঁকি দিতে পারেনি এবং পারবেন ও না। তবে কী আমি ধরে নিব আপনি মিথ্যে বলেছেন? কিংবা এই কথাটি আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়?’

শাহনেওয়াজ এতক্ষণে হেসে দিল। সে মৃদু পায়ে হেঁটে গিয়ে আরাম কেদারায় বসে। ইশারা করে মৃত্যুঞ্জয়কে ও বসতে। সে পাশে এসে বসার পর শাহনেওয়াজ প্রথম থেকে সবটা বিস্তারিত বলল। সব শুনে মৃত্যুঞ্জয় বলল,
-‘তা না হয় ঠিক আছে। তবে আপনি কি বর্তমানে মেয়েটির প্রতি বিশেষ কোনো দুর্বলতা অনুভব করছেন!’

এই কথার বিপরীতে শাহনেওয়াজ তাৎক্ষণিক কিছু বলতে পারল না। প্রশ্নটা বুঝি সে নিজেই নিজেকে করেছে! সে নিজেও এর উত্তর খুঁজে চলেছে। তবে একটা কথা পরিষ্কার! মেয়েটি তার মন মস্তিষ্কে বেশ বড় একটা প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। শাহনেওয়াজ কিছুটা বিচলিত হয়ে মৃত্যুঞ্জয়কে বলল,
-‘মনের কথা আমি বলতে পারছিনা। আসলে আমি নিজেই ধরতে পারছিনা। তবে মেয়েটিকে আগে বিরক্ত লাগলেও তাকে নিয়ে যে এতটা ভেবেছি! এই এত ভাবার পর মনে হলো মেয়েটিকে নিয়ে ভাবতে আমার ভালো লাগে। তার কথা গুলো মনে পড়লে আমার রাগ হয়না উল্টো হাসি পায়। আমি এই রকম অনুভূতি এই প্রথম অনুভব করছি। আগে কখনো এমন হয়নি আমার সাথে।’

শেখ মৃত্যুঞ্জয় কথাগুলো শুনে মুঁচকি হাসে এরপর কিছুটা চিন্তিত ও দেখা যায় তাকে। সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে শাহনেওয়াজকে। সব বিবেচনা করে মলিন মুখ করে এবং বেশ নরম হয়েই বলল,

-‘বিলেতে পড়ালেখা করতে গিয়েছিলাম যখন তখন একটা কথা আমি ভালোই মস্তিষ্কে গেঁথে নিয়েছিলাম-“They do not love that do not show their love. The course of true love never did run smooth. Love is a familiar. Love is a devil. There is no evil angel but Love.” উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের এই উক্তিটি আমাকে কেন যেন খুব টানছিল। আপনি বিবাহিত জমিদার সাহেব। আপনার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা। আপনার নিশ্চয়ই এই অবস্থায় পর নারীতে আকৃষ্ট হওয়া উচিত হবে না। তবে ভালোবাসা এবং ভালোলাগা দুটোর আকাশ পাতাল তফাৎ। এটা যদি ভালোলাগা হয়ে থাকে তবে বলব সরে আসুন। আর যদি ভালোবাসা হয় আমার কি কারোই, কোনো মানুষ বা প্রাণীর সাধ্য নেই আটকানোর। আশা করছি আপনি সব দিক ভালো করে ভেবে দেখবেন।’

#চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here