#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৩৬)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৬৩.
শহরে পা রাখার পর সিন্ধুর মনের ভেতরকার প্রজাপতি গুলো অবাধে উঁড়তে থাকে। বহু দিনের স্বপ্ন সত্যি হওয়ার আনন্দ যে এত সুন্দর তা সে বেশ উপলদ্ধি করতে পারছে। তার বাবা তাকে নিয়ে এসেছে। বর্তমানে জমিদারের দানকৃত আশ্রমে থাকছে তারা। অবশ্য তারা বলতে সে এবং তারই মতো কিছু হতদরিদ্র ঘরের অসহায় মেয়ে। জমিদার এই সকলকেই পড়ালেখার সুযোগ করে দিয়েছে। বাবা তাকে রেখে চলে যাওয়ার পর সে কেমন একা একা বোধ করে। পরবর্তীতে সব ঠিক হয়ে যায়। ধীরে ধীরে মানিয়ে নিতে থাকে এই নতুন পরিবেশ। মাঝে একদিন শেখ মৃত্যুঞ্জয় এসে তার খোঁজ খবর নিয়ে গেছিল। তারপরের সপ্তাহেই জমিদার শাহনেওয়াজ সরকার আসে। এবং সেই আসা একদিনেই সীমাবদ্ধ রইল না। সে কখনো নিজের আসল রূপে আসে তো কখনো নিজেকে নানান চরিত্রের মাঝে লুকিয়ে আনে। যেমন একদিন এলো দুধওয়ালা সেজে। একদিন এলো মেয়েদের খাতা-কলমের বস্তা নিয়ে। কারণ সে চাইছেনা সরাসরি সিন্ধুর সামনে উপস্থিত হতে। তার ভেতরকার খবর সিন্ধুকে জানাতে চাইছিল না। তবে একদিন আর সহ্য হলো না। সিন্ধুর কলেজের সামনে গিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। সিন্ধু বের হয়ে আসতেই জানায় কিছু কথা বলবে। সিন্ধু নিজেও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। জমিদারের সামনে দাঁড়াতে গিয়েই ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা!
-‘তোমার লেখা পড়া কেমন চলছে?’
-‘জ্বি ভালো।’
-‘এখানে সমস্যা হচ্ছে না তো!’
-‘আজ্ঞে না।’
-‘সত্যি বলছ?’
-‘হু।’
-‘তোমার সাথে আমার জরুরী কথা ছিল!’
-‘বলুন।’
-‘বললে তুমি রাগ করবে।’
-‘করব না। বলুন।’
-‘আমার তোমাকে ভালো লাগে। আমার বোধ হয় তোমার সনে প্রণয় হয়ে গেছে।’
আঁতকে উঠে সিন্ধু বলল,
-‘কী বলছেন!’
-‘আমি মিথ্যা বলছিনা। মশকরাও করছিনা কিন্তু। যা বলছি সুস্থ্য মস্তিষ্কেই বলছি।’
-‘আপনি জমিদার! আমি সাঁপুড়ে কন্যা! আসমান জমিন তফাৎ।’
-‘আমরা যতই আসমানে থাকিনা কেন জমিনে পা দিতেই হয়। জমিন ছাড়া আসমান অচল। আসমান ছাড়া জমিন অচল। এখন আমার মনে হচ্ছে তুমি ছাড়াও আমি অচল।’
-‘জমিদার মশাই!
-‘অনেকদিন তোমার মুখে বদমাইশ ডাকটা শুনিনা। আমার তোমার মুখের বদমাইশ ডাকটা শুনতে ইচ্ছা করছে।’
-‘এসব কেমন কথা?’
-‘জানিনা। তুমি বলো! তুমি কী কখনো আমার প্রতি কিছু অনুভব করো নি? আমার মনে হচ্ছে তুমি আমাকে খুব ভালোবাসো।’
ধরা পড়া চোরের মতো ক্ষাণিকসময় চেয়ে থেকে সিন্ধু বলল,
-‘না তা নয়।’
-‘হ্যাঁ তা-ই।’
-‘আপনাকে কে বলল?’
-‘তোমার আঁখিদ্বয়।’
-‘ভুল বলেছে।’
-‘ঐ চোখ ভুল বলেনা।’
-‘বলে।’
-‘আমি জানি বলে না।’
-‘আপনার স্ত্রী আছে। শুনেছি অন্তসত্তা।’
-‘আমি জানি। সেই অপরাধবোধ ও আমায় কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। কিন্তু বিশ্বাস করো! ভালো আমি তোমাকেই বাসি। তুমি যেদিন সাপুড়ে পল্লীতে ঘুরে এলে সেদিনও আমি গিয়েছি। তবে ছদ্মবেশেই। কারণ একটা! তোমাকে ছাড়া আমি এখন আর থাকতে পারিনা। আমার সর্বদা তোমার কথা মনে পড়ে। তোমার নামটা জপতে ভালো লাগে। তোমার চোখের ঐ সিন্ধুর নীলে ডুবে যেতে আমার ভালো লাগে। সে যে চোখ নয়! সে নিজেও একটা সিন্ধু! একটা সমুদ্র! নীল সমুদ্র। নীল সমুদ্র আমার বরাবরই প্রিয়।’
-‘এটা হয়না। আমি পারব না কারো সংসার ভাঙতে। আপনি অন্য কারো স্বামী।’
-‘জমিদারদের তিন চারটা বউ থাকেই।’
-‘আপনি কী তবে এই রীতি পালন করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছন!’
-‘ধরে নাও তাই। তবে সত্যি! তোমায় আমি আর ছাড়ছিনা।’
-‘আমিও আপনার কাছে যাচ্ছিনা। কারো স্বামী সুখ ছিনিয়ে আমি বাঁচতে পারব না।’
৬৪.
শাহনেওয়াজ সিন্ধুর উপর আরেক দফা মুগ্ধ হলো। তার চিন্তা চেতনা দেখে সে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছে। আরেকটা ব্যাপারও সে লক্ষ্য করেছে সিন্ধু এখন আর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেনা। তার কথার ধরন পাল্টেছে। এতে তাকে আরো বেশি ভালো লাগছে। সেদিন ব্যর্থ হয়েই তাকে ফিরতে হলো। এরপরও সে হাল ছাড়েনি। দিন রাত সিন্ধুর দরবারে হাজির হতে থাকে। সিন্ধুও নিজের সিদ্ধান্তে অটল। জমিদার নাওয়া খাওয়া ভুলতে বসে। চার মাসের পেট নিয়ে বেগম সুগন্ধ্যা হাজির হয় জমিদারের কক্ষে। আজকাল তিনি যে তাকে স্মরণ করেন না! সারাদিন কেমন চিন্তায় মশগুল থাকে। শুনেছে খাবারও খায়না ঠিক মতো। এমন কেন করছে? শাহনেওয়াজকে সে জিজ্ঞেস করল,
-‘আপনার কি হয়েছে? আমাকে বলুন!’
শাহনেওয়াজ হাঁটু গেড়ে বসে তার পেটে চুমু এঁকে বলল,
-‘কিছু নয়। তুমি চিন্তা করবেনা অযথা। আমার সন্তানের ক্ষতি হবে।’
-‘সন্তানের ক্ষতিই দেখছেন শুধু! আমার চিন্তা কী অযথা! আপনি জানেন না আপনার কষ্ট আমার সহ্য হয়না! কী হয়েছে আমায় বলুন।’
-‘ব্যবসায়িক ব্যাপার। কিছুদিনের মধ্যেই সব ঠিক হবে। তুমি যাও বিশ্রাম করো।’
চলে এলেও মনের ভেতর চিন্তা রয়েই গেল। না সইতে পেরে সে সরণাপন্ন হলো প্রত্যয় শাহ্ এর কাছে। তিনি জানালেন যে এই ব্যাপারে তার ধারণা নেই।
-‘ভাবিজান! আপনি অযথা দুশ্চিন্তা করবেন না। আহামরি কিছু হয়নি। আমি তার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলব। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।’
-‘কী করে নিশ্চিন্ত হই? আমার স্বামী নিজেই সারাক্ষণ কী চিন্তা করে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। খাবার খায়না নিয়মিত। আমি চিন্তামুক্ত থাকি কীভাবে!’
-‘থাকতে হবে। কিছু করার নেই। অনাগত সন্তানের কথা ভেবে হলেও শুধু শুধু এমন চিন্তা করবেন না। অসুস্থ আপনিও হতে পারেন।’
প্রত্যয় শাহ্ এর থেকেও আশানুরূপ সাহায্য পেল না। থমথমে মুখ নিয়ে ফিরে আসতেই ডাক পড়ে পেছন থেকে,
-‘ভাবিজান!’
আকস্মিক পরিচিত গলা পেয়ে বেগম সুগন্ধ্যা কিছুটা ভড়কে যায়। এই মুহূর্তে মৃত্যুঞ্জয় কে সে আশা করেনি। সে সবসময় মৃত্যুঞ্জয়কে এড়িয়ে চলে। কেননা মৃত্যুঞ্জয়ের মনে তার জন্য বিশেষ জায়গা আছে। তার বিবাহের আগ থেকেই মৃত্যুঞ্জয় এবং সে একে অপরকে চেনে। মৃত্যুঞ্জয়ের পক্ষ থেকে ভালোবাসা থাকলেও তার পক্ষ থেকে কেবলই না ছিল। সে ভালোবাসত শাহনেওয়াজকে। তবে সে জানে, আজও মৃত্যুঞ্জয় তাকে ভালোবাসে। তার চোখ মুখ তো তা-ই বলে!
-‘আপনার সাথে কিছু কথা ছিল!’
-‘কীসের কথা?’
-‘আপনি জানতে চাইছেন যে জমিদারের কি হয়েছে, তাই তো?’
-‘হ্যাঁ তাই।’
-‘আমি জানি।’
-‘কী জানেন?’
-‘তার দুঃখের পেছনের কারণটা।’
-‘কী কারণ!’
-‘আগে বলুন আপনি রাগ করবেন না।’
-‘কী বলতে চাইছেন!’
-‘আপনার স্বামী অন্য কাউকে ভালোবাসে। তার বিরহে দিন এমন বিষণ্ণ কাটছে।’
কেঁপে উঠল সুগন্ধ্যা। অবিশ্বাসের সুরে বলল,
-‘কী বলছেন আপনি! আমি বিশ্বাস করিনা। আপনি মিথ্যে বলছেন।’
-‘এত বছরেও যদি আপনি আমাকে একটু হলেও চিনে থাকেন তো বলব আমি কখনো মিথ্যে বলিনা এটা আপনার জানার কথা।’
-‘এখন বলছেন।’
-‘একদমই না।’
এবার ক্রোধে আর কান্নায় ফেটে পড়ে বেগম। হিশহিশিয়ে বলে,
-‘সে ডাইনি কে!’
-‘সে কোনো ডাইনি নয়। সে ও মানুষ কন্যা।’
-‘সে অমানুষ। নাহলে পরের স্বামীকে কীভাবে ছিনিয়ে নেয়?’
-‘সে ছিনিয়ে নেয়নি। বরং ফিরিয়ে দিয়েছে। আর তাতেই আপনার স্বামীর এই অবস্থা। বিশ্বাস না হলে তাকে জিজ্ঞেস করে দেখুন। উত্তর পেয়ে যাবেন।’
বেগম সুগন্ধ্যার পায়ের তলার মাটি নড়ে গেল। এত বড় আ’ঘা’ত কীভাবে সহ্য করবে সে? মৃত্যুঞ্জয় চলে গেল। তার মনে হয়েছিল সুগন্ধ্যার সত্যটা জানার দরকার তাই জানিয়েছে। এতে তার ব্যক্তি স্বার্থ নেই। কেননা এক তরফা ভালোবাসার চেয়েও বন্ধু আগে তার কাছে। তার বন্ধুর সাহায্যই সে করেছে। কেননা সে চেনে সুগন্ধ্যাকে। তার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে সেই ধারনা একটু হলেও তার আছে।
রাতে সুগন্ধ্যা জমিদারের কাছে আবারও গেল। এবার আর জমিদার শাহনেওয়াজ কিছু গোপন করলেন না। সবটা জানিয়ে দিল। অবশেষে নিজের মনকে মানিয়ে সে জমিদারকে অনুমতি দিল সে যেন বিয়ে করে সিন্ধুকে। তবে তাকেও যেন কখনো না ছাড়ে! স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে ধরে শাহনেওয়াজ নিজেও কেঁদে দেয়। সে জানে সে ভুল! তবুও প্রেম ভালোবাসার কাছে সেই ভুল কিছুই নয়। পরের সপ্তাহে বেগম নিজে দাঁড়িয়ে থেকে জমিদারের বিয়ে দেয়। তবে পুরো সমাজের আঁড়ালে। কেন না তার শর্ত আরেকটিও ছিল সমাজের কাছে সিন্ধু যেন কখনো জমিদারের স্ত্রীর পরিচয় না পায়। আবেগের বশবর্তী জমিদার নির্দ্বিধায় সেটিও মেনে নিলো।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে এইসব দেখা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না শেখ মৃত্যুঞ্জয়ের। সুগন্ধ্যা তার ভালোবাসা। সুগন্ধ্যার একটু কষ্টও তার যে সহ্য হয়না! তবে তার করার কিছু নেই। সে এ ব্যাপারে অপারগ।
সব ঠিক ছিল। তবে খুব অল্প সময়ের জন্যই। কেননা জমিদারের দ্বিতীয় বিয়ের খবর তার আম্মাজান জেনে যায়। তিনি কোনো সাঁপুড়ের মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে মানতে নারাজ। তার মতে তার পুত্র ঘোর অপরাধ করেছে। এর যে খুব বড় সাজা তাকে ভোগ করতেই হবে!
#চলবে!
(অতীতটাই এই উপন্যাসের একটা বড় অংশ। তাই সবাইকে বলছি অতীতের ঘটনায় বিরক্ত হবেন না আপনাদের জন্যই অনেক বেশি সংক্ষিপ্ত করতে হচ্ছে সব। তাই এমন অগোছালো লাগছে। তবে কিছু করারও নেই। হাতে সময় কম। প্রথম খন্ডের সমাপ্তি এবার টানতেই হবে।)