#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৩০
‘ আমায় ইগ্নোর করতে ভালোলাগে তাই না আহি? আজ সারারাত তোমার কাছাকাছি থাকবো। তারপর দেখি তুমি আর কত আমায় ইগ্নোর করতে পারো।’
কন্ঠস্বর বিধ্বস্ত আনভীরের। উত্তেজনায় কেঁপে উঠছে বারবার। আমি কিছুক্ষণ অনিমেষ দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে নিচে তাকালাম। উনার কথাগুলো এখনও কানে বাজছে নুপুরের মতো। ক্রমাগত শুকনো ঢোক গিললাম আমি। কিন্ত আনভীরকে বুঝতে দিলাম না যে আমি আপাতত বিচলিত অবস্থায় আছি। নিজেকে উনার বাহু বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে প্রগাঢ় কন্ঠে বললাম,
‘ ছাড়ুন আমায়।’
উনি এক চিলতেও নড়লেন না। ঠায় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন সেভাবেই। আমি চোখ নামিয়েই রুদ্ধ কন্ঠে পুনরায় বললাম,
‘ বধির হয়ে গেলেন নাকি মশাই? ছাড়তে বলছি ছাড়ছেন না কেনো?’
উনি এই কথার প্রতিউত্তর না দিয়ে ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
‘ আমার চোখের দিকে তাকাও।’
নিজের জমা রাগ গুলো বরফের ন্যায় ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে এবার। আশঙ্কা ঢুকেছে যে এবার এই মান অভিমানের দাঙ্গায় জিতবো কি-না। উনার ঘায়েল চোখের দিকে একবার তাকালেই তো সব ভুলে শুধু নির্লজ্জের মতো সেদিকে তাকিয়ে থাকবো, যেটা আমি নিশ্চিত। আর যদি আনভীর সেটা ধরতে পারেন তবে আমায় নিয়ে ঠাট্টা যে উনি থামাবেন না এ নিয়েও কোনো অনিশ্চয়তা নেই। নিজেকে স্থির করলাম তাই। তাকাবো না উনার চোখের দিকে। একটুও না। এই অসভ্য লোকটা তখন যেভাবে বকেছিলো নাহিদ ভাইয়ার সামনে, তা কি ভুলে গিয়েছি আমি? মোটেও না। তাই সেভাবেই অন্যত্র তাকাতে দেখে আনভীর তথারুপি জিজ্ঞেস করলেন,
‘ তাকাচ্ছো না কেনো আমার দিকে? সমস্যা টা কি?’
শেষ কথায় কেঁপে উঠলাম আমি। তবুও নিজেকে শান্ত করে বললাম,
‘ আমার কোনো সমস্যা নেই। আর সমস্যা হবে কেনো?’
‘ তাহলে তাকাচ্ছো না কেনো আমার দিকে?’
‘ ইচ্ছে করছেনা তাই।’
বলেই হাত কোনোরকম মুচড়ে নিজেকে উনার বেড়াজাল থেকে ছাড়ার চেষ্টা করতেই উনি হাত টেনে পুনরায় নিয়ে এলেন নিজের কাছে। এবার এমনভাবে চেপে ধরলেন যে আমি আর নড়াচড়া করতে পারলাম না। আনভীরের চোখে মুখে এবার স্বস্তির আভাস। আমার কানপিঠে চুল গুঁজে কাতর কন্ঠে বললেন,
‘ বড্ড অস্থির মেয়ে তো তুমি। এত ছটফট করছো কেনো?’
আমি কোনো কথা না বলে ফোস ফোস করতে থাকলাম এখনও। জানান দেই যে এখনও রেগে আছি। ভীষণ ভীষণ রেগে আছি। আনভীর আমার এ অবস্থা দেখে ভ্রু নাচিয়ে বললেন,
‘ তখন ওভাবে ধমক দিয়েছিলাম বলে রেগে আছো?’
আমি নিরুত্তর।
‘ তাই জন্যে তাকাচ্ছো না আমার চোখে?’
আমি এবার চুপ থাকলাম না। প্রতিউত্তরে মৃদু কন্ঠে বলি,
‘ হ্যাঁ!’
আনভীরের দৃষ্টি ক্রমশ গম্ভীর হলো এতে। বলে উঠলো,
‘ আমায় শাস্তি দেওয়ার একটা ভালো ওয়ে খুঁজে বের করেছো আহি। জানো বিগত সময়গুলো কিভাবে কেটেছে আমার? একই বাড়িতে থেকেও তোমার হদিস নেই। কল দেই , রিসিভ করো না। রিসিভ করলে, কথা বলো না। আমায় দেখলে পালাই পালাই করে বেড়াও আর সবশেষে কি করলে? আমায় ছাড়া ডিনার করলে আর আমায় ছাড়াই ছাদে ওই হাদা দুটার সাথে আড্ডায় মশগুলো থাকলে। একবারও মনে হয়নি যে নিচে এই মানুষটার কেমন লাগছিলো?’
‘ কেন মনে হবে আমার এমন? যে আমার ইমোশনের দাম দেয় না তার ইমোশনের চিন্তা করে আমার লাভ আছে?’
কথাটি আমি একেবারেই বললাম অভিমানীনসুরে। আনভীর হেসে দিলেন এতে। আমি রগচটা হয়ে বলে উঠলাম,
‘ জানতাম যে আপনি এমনই করবেন। ছাড়ুন আমায়। কি দরকার আমার রাগের কথা চিন্তা করে?’
আমায় এভাবে ছটফট করতে দেখে উনার হাসির মাত্রা যেন আরও বেড়ে গেলো। ভাবখানা এমন করেছেন যে মজা পাচ্ছেন বেশ। অতঃপর আমায় খাটে বসিয়ে দিলেন উনি সন্তর্পণে। নির্লিপ্ত চোখে তাকালেন আমার দিকে। আমার শরীর রি রি করছে রাগে। তাই একপলকও তাকালাম না উনার দিকে। আনভীর ডাক দিলেন,
‘ আহি!’
আমি প্রতিউত্তরহীন। আনভীর হাটু গেড়ে বসলেন আমার কাছে। কোমল কন্ঠে পুনরায় ডাকলেন,
‘ একবার তো তাকাও?’
‘ তাকাবো না।’
বাচ্চাদের মতো ফুসিয়ে বলি আমি। আনভীর হাসলেন এমন কান্ডে। আমার এসব বাচ্চামো সবসময় জানান দেয় যে আমার অস্তিত্বই গেঁথে আছে এই মানুষটার কাছে। আনভীর নিজের হাতের মধ্যে আমার হাত নিয়ে বললেন,
‘ সরি জান! নেক্সট টাইম কখনও বকা দিবো না। প্রমিস!’
এই তিনটা বাক্য আমায় অবাক করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো বলতে গেলে। আমি নিনির্মেষে তাকাই আনভীরের দিকে। উনার চোখে মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। সারাদিনের এত ব্যস্ততার পর দিনশেষে আমার প্রতি এই আড়ষ্ট কন্ঠ আমার অন্তরে এক অন্য আনন্দ দিলো। আনভীরের নিষ্প্রভ দৃষ্টি আমাতে আবদ্ধ। ঠোঁটের স্মিত হাসি যেন গৌরবর্ণের গায়ে নিদারুন ফুটিয়ে তুলেছে। গায়ে জড়ানো হালকা রঙের টিশার্ট আর অগোছালো চুল জানান দিচ্ছে মানুষটার সীমাহীন সৌন্দর্যের কথা।
আমায় এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আনভীর উঠে আবেশে ঠোঁটের স্পর্শ করালেন আমার চোখজোড়ায়। বলে উঠলেন,
‘ তোার ইগ্নোরেন্স বড্ড পোড়ায় আমায় আহি। আর সকালে অমন এক্সিডেন্টের পর তোমার পায়ের যেই হাল হলো তারপর একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তোমায় নিয়ে। ভেবেছিলাম কিচেনে গেলে আবার যদি এমন কিছু হয়? তাই তোমায় ওখানে আবার যেতে দেখে অনেকটা ভয়েই রুড বিহেভ করে ফেলি। ওয়ান্স এগেইন সরি আহি। নেক্সট টাইম আর এমন করবো না। প্রমিস!’
উনি কথাগুলো বললেন নিতান্তই জড়ানো কন্ঠে। তারপর উঠে গিয়ে লাইট নিভিয়ে আমায় টেনেই বিছানায় শুয়িয়ে দিলেন। আমি এতক্ষণ পাথর হয়ে বসে ছিলাম। হঠাৎ জ্ঞান ফিরে পেতেই দ্বিধা নিয়ে বললাম,
‘ কি করছেন?’
‘ অনেক জ্বালিয়েছো আজকে। সবচেয়ে বড় ভুল করেছো আমায় এড়িয়ে চলার সাহস করে। এখন ভুলেও আমার থেকে দূরে সরার চেষ্টা করবে না আহি। লেট মি স্লিপ।’
উনি আমায় নিজের কাছাকাছি টেনে পেটের ওপর হাত রেখে চোখ বন্ধ করলেন। আমার নিঃশ্বাস ক্রমশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। ক-ক-কি করছেন উনি? এভাবে নিজে ঘুমিয়ে আমার ঘুম কেড়ে নেওয়ার বন্দোবস্ত করেছেন নাকি? আজ তোর ঘুম হবে না আহি। এই মানুষটা কাছাকাছি থাকলে মনে জেগে ওঠা ভয়ঙ্কর বাসনাগুলো তোকে ঘুমোতে দিবেনা।
____________________
হসপিটালে আজ প্রেজেন্টেশন আমার। শুধু আমার না। যারা রিসেন্টলি ইন্টার্নশিপ করে হসপিটালে জয়েন করেছেে তাদের সবার। স্বনামধন্য বেসরকারি হাসপাতাল বলে মাঝে মাঝে ফরেইন ডক্টরদের সাথে বিশাল মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়। প্যানডেমিকের জন্য এই মিটিং গুগল মিট বা জুম এ হলেও এবার সেটা সরাসরি অফলাইনে ফেস টু ফেস হচ্ছে। টেনশন পুরো মনমস্তিষ্কে গেঁথে গিয়েছে আমার। এতটাই টেনসড ছিলাম যে সকালে ব্রেকফাস্টও ঠিকমতো করতে পারিনি। আনভীর দেখেছিলেন আমায় অস্থির হতে। তারপর গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন,
‘ ড্রিংক ইট।’
তাই করলাম আমি। পরপর দু তিন গ্লাস পান করলাম। আনভীর ব্রেডে বাইট দিয়ে বললেন,
‘ বি রিলেক্স আহি। ধরো এটা একটা নরমাল ফাংশন যেখানে সবার সাথে কথা বলো। তাহলেই চিন্তা কেটে যাবে।’
‘ আপনি আপনার হাজারো ফ্যানদের সাথে কথা বলাতে অভ্যস্ত বলে আমি আপনার মতো এতটা অভ্যস্ত নই আনভীর। এটা এতটাও সহজ না।’
‘ জানি আমি। তাই তো সহজ উদাহরণ দিলাম। নাও বেস্ট অফ লাক আহি।’
নাহিদ ভাইয়া এবার বললেন,
‘ আমি ড্রপ করে আসবো ভাবিকে?’
‘ নাহ্ থাক। তুই বডিগার্ডকে নিয়ে প্রেস ক্লাবে যা। ওখানে এখন তোর কাজবেশি। বাবাকে বলবি আমি আধঘন্টার মধ্যেই সেখানে পৌঁছাবো। আহিকে আমি ড্রপ করে আসি।’
বলেই আনভীর বেড়িয়ে পড়লেন আমায় নিয়ে। সারাপথে আমি চুপ ছিলাম। সেই সাথে আনভীরও। হসপিটালেন সামনে গাড়ি থামাতেই আমি নামলাম গাড়ি থেকে। আনভীর ডাকলেন,
‘ আহি!’
‘ কিছু বলবেন?’
‘ বেস্ট অফ লাক।’
মিহি হাসলাম আমি। তারপর আনভীর চলে গেলেন।
___________
আজকের মিটিংটা ভালোভাবেই সম্পন্ন হয়েছে।বিশেষ করে ডক্টর ধ্রুব সহ বাকি ফরেইন ডক্টররা সবাই স্যাটিসফাইড আমাদের কাজে। আমি প্রসন্ন হলাম। এতদিন কাজ ভালোভাবে হয়েছে বলে ভালো লাগছিলো বেশ। এসব নিয়ে আমাদের জন্য যে লকার রুমটা বরাদ্দ করা হয়েছিলো সেখানে আলোচনা করছিলাম আমি আর আমার কলিগরা। সবাই মোটামুটি প্রসন্ন হয়েছে এতে। তারপর সবাই যে যার ডিউটি করার জন্য চলে গেলো লকার রুম থেকে। বাকি রইলাম শুধু আমি। কারন আমার ডিউটি শেষ হয়ে গিয়েছিলো। এখন শুধু ফিরে যাওয়ার পালা। আমি স্টেথোস্কোপ, এপ্রোন সব গুছিয়ে লকারো রাখার জন্য মনোনিবেশ করলাম। তখনই পেছন থেকে কেউ তীব্র কন্ঠে বলে উঠলো,
‘ দিন দিন আরও সুন্দর হয়ে যাচ্ছিস তুই আহি!’
কথাটি শুনে হাত থেকে স্টেথোস্কোপ নিচে পড়ে গেলো আমার। মাথাটা ঝিম ধরে গিয়েছে। এত লম্বা প্রহর অতিবাহিত হওয়ার পর ভাবতে পারিনি এই মানুষটার মুখোমুখি আমি পুনরায় হবো। পাহাড় সমান ভয় নিয়ে পেছনে তাকালাম আমি। মনকে বারবার বলছিলাম যে আমি যা শুনেছিলাম সেটা ভুল। কিন্ত পেছনে তাকাতে পুরোই হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। মানুষটা আবার বলে উঠলো,
‘ এআরকের আশ্রিতা হয়ে এত দ্রুত ভুলে গেলি আমাকে?’
আমার চোখে এখনও বিরাজ করেছে আতঙ্ক। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে অবশেষে বলেই উঠলাম,
‘ অপূর্ব ভ-ভাইয়া ত-তুমি?’
#চলবে
ভুলক্রুটি মার্জনীয়।