#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ৩৭
অবলীলায় বিকেল অতিবাহিত হওয়ার পর সন্ধ্যায় ঢাকাকে দেখা যায় এক অন্য রূপে। এ শহরটা অনেক বড় আর রহস্যময় লাগে আমার কাছে। যেমন রয়েছে ঘিন্জি পরিবেশ, তেমনি ভাবে রয়েছে আভিজাত্য এলাকা। আর আনভীর যেই কলোনিতে থাকে সেটা আভিজাত্যেরই প্রমাণ দেয়। কিন্ত আজ এই সন্ধ্যের সময়টাকে আপনমনে উপভোগ করতে পারিনি আমি। এর একটি কারন দুপুরে আনভীরের সেই মেসেজ। যেটা সময়ের পরিক্রমায় আমায় অস্থির থেকেও বেশি অস্থির করে তুলেছে।
নীলু চুপচাপ খাটে বসে দেখে যাচ্ছে আমার কার্যকলাপ। কলেজে পড়ুয়া এই মেয়ের চলাফেরা উদ্ভট ধরনের হলেও বিচক্ষণতা যেন তুঙ্গে। বিকেলেই এসে পড়েছে ট্রেনে চেপে ব্যাগপত্র নিয়ে। রেলস্টেশন নিয়ে নিয়ে এসেছে আনভীরের একজন বিশ্বস্ত ড্রাইভার। এসে মেয়েটা কই ভেবেছিলো আমার সাথে জম্পেশ আড্ডা দিবে কিন্ত আমার এই অস্থিরতা ক্রমেই ওকে বিরক্ত করে তুললো। হাই তুলে অবশেষে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
‘ কাহিনী টা কি রে আপু বল তো! সেই কখন এসেছি। এসেই দেখছি তুই একাই ভ্রমরের মতো ঘরে কানামাছি ভোঁ ভোঁ খেলে যাচ্ছিস। কিছু হয়েছে?’
আমি ঠোঁট কামড়ে ভীত চোখে নীলুর পানে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। কেননা বুঝতে পারছিনা না যে ঘটনাটি বলবো কি-না। অবশেষে ফোস করে বলেই ফেললাম,
‘ আ-আনভীর ড-ডিনারে নিয়ে যেতে চ-চায় আমাকে?’
নীলু প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে আমার কথার মানে বুঝতে চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ। মৌনতা কাটয়ে বললো,
‘ তোকে ডিনারে নিয়ে যেতে ইচ্ছুক?’
‘ শুধু ইচ্ছুক না নীলু, উনি আজকেই আমায় নিয়ে যাবেন ডিনারে। পাল্টা কোনো কথা শুনেননি আমার।’
প্রথমে নীলু থম মেরে বসে থাকলেও কিছুক্ষণ পর ওর চোখে মুখে দেখা গেলো উল্লাসের হাসি। আহ্লাদে আটখানা হয়ে বলে উঠলো,
‘ তাহলে তুই হাইপার কেন হচ্ছিস আপু? ও মোর আল্লাহ! আজীবন টিভি সিরিয়ালেই এমন সুযোগ দেখে আসলাম। ভুলে যাসনা আপু তোর বর কে? তার সাথে ডিনারের কল্পনা অজস্র ফ্যানরাই শুয়ে বসে করে। আর সে নিজ থেকে তোকে অফার দিচ্ছে। আর যদি সেটা ক্যান্ডেল লাইট ডিনার হয় উফফ্! আমি তো কল্পনা করেই মরে যাচ্ছি। আর তুই এমন অস্থির হচ্ছিস?’
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকলাম নীলুর দিকে। এই মেয়ে তো জানে না তার কল্পনার চার্মিং প্রিন্স এআরকে কতটা অসভ্য আর ভয়ঙ্কর ধরনের মানুষ। কথা তো বলে না যেন গুলিবর্ষণ করে। এমন কয়েকটা ধারালো বেলাজ কথা বলবে, ইচ্ছে করে যে ওখানেই লজ্জায় কেটেকুটে একাকার হয়ে যেতে। নীলু এবার তাড়া দিতে থাকলো আমায়। বলে উঠলো,
‘ সেই কখন বলেছে আর এখন তো সন্ধ্যা গড়িয়ে এলো। শাড়ি-টাড়ি কিছু চুজ করেছিস?’
‘ ন-না। কিন্ত আমার কথা একবার………’
আমায় আর বলতে দিলো না মেয়েটা। কাঙ্খিত উত্তর শুনে হতাশ হয়ে বললো,
‘ তাহলে জলদি চুজ কর যে কি পড়বি! এমন সুযোগ কমই আসে গো আপু। তোর জায়গায় আমি থাকলে আজ সারা বিকেল সন্ধ্যা ভেবেই কাটিয়ে দিতে যে কিভাবে উনার সামনে নিজেকে রিপ্রেজেন্ট করবো। তুই আসলেই একটা গাধি!’
আমায় ঠেলেঠুলে আয়নার সামনে দাঁড় করালো এবার। আলমারি থেকে বেশ কয়েকটা ড্রেস বের করে দেখতে লাগলো যে কোনটা আমার মানাবে। আমি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলাম নীলুর দিকে। আমার থেকে ওর এক্সাইটমেন্টটাই বেশি দেখছি আমি। নীলু সচকিত গলায় বললো,
‘ উমম্! ব্ল্যাকটা দারুন মানাবে তোকে। তাহলে তুই ব্ল্যাক শাড়ি পড় আজ।’
‘ এই না!’
আমার হঠাৎ চিৎকারে বিরক্ত হলো নীলু। প্রশ্ন করলো,
‘ শাড়ি পড়লে হবে টা কি শুনি?’
আমি কথা বলতে পারলাম না। একেতো শাড়ি পড়ায় অভ্যস্ত নই। আর দ্বিতীয়ত শাড়ি নিয়ে করুন স্মৃতি জড়িতে আছে আমার। আমার কালো মুখ দেখে হয়তো সেটা আন্দাজ করতে পারলো নীলু। বলে উঠলো,
‘ পুরনো ঘটনাগুলোর জন্য তুই নিজের বর্তমানকে নষ্ট করবি আপু?’
আমি নিশ্চুপ। নীলু আবার বললো,
‘ দেখ্, অপূর্ব ভাইয়া তোর পাস্ট। একটা ভয়ঙ্কর পাস্ট যেটা ভুলে যাওয়াই ভালো। তাহলে তার জন্য তুই এখন কেন কষ্ট পাচ্ছিস? আমি যতটুকু জানি এআরকে অসম্ভব ভালোবাসে তোকে। আমি কিন্ত টিভিতে, নিউজ পেপারে সব জায়গায়ই ঘটনাটা দেখেছি আপু। টানা তিনদিন উনি হেডলাইনে ছিলেন। উনি লিভ টুগেদারে আছেন কার সাথে আর কেনই বা সেরাত হসপিটালে অপূর্ব হাসানকে মারলেন এটা নিয়ে বিব্রতকর প্রশ্ন ছুঁড়েছে জার্নালিস্টরা। তবে উনি একবারও তোর নাম বলেনি এটা জানা সত্বেও যে এতে উনার ক্যারিয়ারে রিস্ক আছে।
এ সমাজ ভালো না রে আপু। যতই তুই নিজেকে আনভীরের ওয়াইফ বলিসনা কেন, সমাজ যেহেতু দেখেনি তাই বলবে তুই এআরকের আশ্রিতা। আর তোর ক্যারেক্টারে যাতে কেউ আঙুল না তুলতে পারে তাই সময় হলেই সবার সামনে বলবে তুই কে। শুধু সুযোগের অপেক্ষা। উনি বাবাকেও বলেছেন এ কথা।’
নীলুর প্রতিটা কথাই আমি শুনলাম গভীর মনোযোগ দিয়ে। আনভীর নিঃসন্দেহে আমার জন্য নিজেও ক্যারিয়ারও ঢালে ফেলে দিতে পারবেন, এ আমি নিশ্চিত। আমি তাকালাম নীলুর দিকে। বললাম,
‘ এখন শাড়ি পড়ার ভালো টাইম না নীলু। সময় যখন হবে, তখন অবশ্যই আমি পড়বো, শুধুমাত্র উনার জন্য।’
___________________________________
ঘড়ির কাটা গিয়ে ঠেকেছে আটের কোঠায়। আটটা বাজা মাত্রই নীলুর মোবাইল ওয়াচে বিপ বিপ সাউন্ড হলো এবার। আমি আর নীলু চুপচাপ সুইমিংপুলের সামনে বসে আছি। অপেক্ষা করছি আনভীর আর নাহিদ ভাইয়ার আসার। কিছুক্ষণ পূর্বেই আনভীর টেক্সট করলেন যে উনার আসতে আর ত্রিশ মিনিট লাগবে। তাই রেডি হয়ে অগত্যাই অপেক্ষা করতে থাকলাম।
একটা ব্ল্যাক কালার থ্রি পিস পড়েছি আমি। সাথে সিলভার কারুকার্যের ওড়না। এই ড্রেসটা আজরান ভাইয়া গিফ্ট করেছিলো আমায়। আর উনার চয়েস বলতে হবে নিঃসন্দেহে পার্ফেক্ট।তাই শিউলি ভাবির জন্য উনার চুজ করা জিনিস দারুন লাগে আমার কাছে।
এদিকে ধ্রুব স্যার বেশ কয়েকবার কল দিয়েছিলো আমায়। কারনটি আমি জানি। বিকেলে উনাকে মেসেজে বলে দিয়েছিলাম যে আমার একটা প্রোগ্রাম আছে। আসা সম্ভব না। উনি সেটা সিন করেন কিছুক্ষণ আগে। এর মধ্যে কয়েকবার কল দেওয়াতে আমি বিমর্ষ হয়ে মোবাইল সাইলেন্ট করে দিলাম।
নীলু সুইমিংপুলের একপ্রান্তে বসে পা ভিজাচ্ছিলো। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘ নার্ভার্স ফীল করছিস আপু?’
আমি প্রতিউত্তর দেইনি। একটু নার্ভাস ফীল হওয়াটা আমার স্বাভাবিক মনে হলো। কারন এটা আমার একেবারেই নতুন অভিজ্ঞতা। নীলু উঠে আমার কাছে ঘেঁষে বসল এবার। দুষ্টু হেসে বললো,
‘ চিল আপু! তুই তো এমন ভাব করছিস উনি বুঝি তোর পর কেউ। এমন করলে তো পুরো মজাটাই বিগড়ে যাবে। এবার আমার কথা ভালো করে শোন, বর হয় তোর। হাসিমুখে কথা বলবি, প্রেম প্রেম নিয়ে কথা আগাবি, প্রয়োজন পড়লে দু’তিনটা চু’মুও ফ্রিতে সাপ্লাই করবি। পারবি তো?’
বিস্ফোরিত নয়নে তাকাই আমি নীলুর দিকে। জোড়ালো গলায় বলে উঠলাম,
‘ মরে গেলেও পারবো না।’
‘ কি মরে গেলেও পারবেন না ভাবি?’
হঠাৎ পেছন থেকে একথা শুনে ভড়কে পেছনে তাকালাম আমি। নাহিদ ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। পুরো কথাটি শুনেনি বিধায় স্বস্তি পেলাম। নাহিদ ভাইয়ার চোখে মুখে রাজ্যের ক্লান্তি। দেখেই বুঝা যাচ্ছে ভালোই ধকল গিয়েছে উনার উপর। কিন্ত যেই না নীলুর মুখে উনার চোখ পড়লো ফানুসের মতো রঙ পাল্টালো উনার মুখশ্রী। অপ্রস্তুত হয়ে এবার আমায় বললেন,
‘ আন-আনভীর ভাই গাড়িতে ওয়েট ক-করছে আপনার ভ-ভাবি! যেতে বলেছে আপনাকে।’
আমি তাকালাম নীলুর দিকে। বললাম,
‘ একা থাকতে পারবি?’
নীলুকে বলতে না দিয়েই নাহিদ উশখুশ ভাবে বললো,
‘ আমি আছি না? কোনো সমস্যা হবেনা।’
নীলু প্রতিক্রিয়া করলো না এ কথায়। আমি তাই ওদের বিদায় জানিয়ে পা বাড়ালাম বাইরের দিকে। লনের পাশে মার্বেল বাধাঁ রাস্তায় কালো গাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির সামনে। ভেতরে আনভীর আছে কি না বোঝা গেলো না। আমি দাঁড়ানো মাত্রই ভেতর থেকে দরজা খুলে দিলেন আনভীর। গাড়িতে বসে পড়ি আমি। আনভীরের দিকে তাকানো মাত্রই আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
একটা সাদা শার্টের ওপর ব্ল্যাক ব্লেজার আর ব্ল্যাক প্যান্ট পড়াতে দারুন মানাচ্ছে উনাকে। সকালে এটা পড়ে বের হননি। বুঝাই যাচ্ছে পরবর্তী সময়ে পড়া। আমি আড়ষ্ট গলায় বললাম,
‘ গুড ইভনিং!’
প্রতিউত্তর দিলেননা উনি। ঠায়ভাবে তাকিয়ে রইলেন আমায় দিকে কিছুক্ষণ। এমন চাহিনীতে আমি অপ্রস্তুত না হয়ে পারলাম না। অস্থির দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকাতে থাকলাম তাই। নিস্তব্ধতা গ্রাস করে ফেলেছে সবকিছু। পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হয়ে যাচ্ছে। আনভীর ঘোরলাগা কন্ঠে ডেকে বললেন,
‘ আহি!’
‘ জ-জ্বী?’
আনভীর ঠোঁট ভিজালেন হালকা করে। ভারী কন্ঠে ফোস করে বললেন,
‘ আমার তোমার মতো একটা কিউট মেয়ে বেবি চাই বুঝলে? তাই নিজেকে প্রস্তুত রাখবে। আজকাল তুমি যেভাবে আমায় পাগল করছো, হয়তো ক’দিন পরই বাবা-মাকে সুসংবাদ দিতে হবে।’
.
.
.
.
.
.
#চলবে…….ইনশাআল্লাহ!
আপনাদের মন্তব্য না পাওয়ার ব্যপারটা আমায় নিরুৎসাহিত করে পাঠকমহল। তাই ছোট্ট করে হলেও মন্তব্য করবেন প্লিজ।
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখার অনুরোধ রইলো।
লেখিকার গল্পমহল: ❤️কায়াভ্রমর❤️-{Stories of Kayanat Afrin}