বিদায়_বরণ পার্ট ৯

#বিদায়_বরণ
পার্ট ৯
লেখা- মেহরুন্নেছা সুরভী

পুরোনো দিনের সেসব কথা ভেবে স্বামীর ছবির সামনে কাঁদতে লাগলেন বিভাবরী বেগম।
পিছন থেকে সাখাওয়াত এসে মা বলে জড়িয়ে ধরল। তিনি শীঘ্রই নিজের চোখের জল মুছে নিলেন। সিঙ্গেল মাদারদের চোখের জল সন্তানকে দেখাতে নেই যে!

সাখাওয়াতকে ছাড়িয়ে ফিরে তাকালেন বিভাবরী বেগম। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “সাখাওয়াত, কী হয়েছে বাবা?”
“তুমি কাঁদছিলে মা?”
“না বাবা, আমি কই কাঁদছি!দেখো না চোখে কী যেন পরেছে, তাই চোখে জল এসেছে। ”

বিভাবরী বেগম সরে আসেন সাখাওয়াতের সামনে থেকে! সাখাওয়াত ছোট হলেও যথেষ্ট বুঝতে শিখে গিয়েছে। মা যে তার বোনের বিয়ে নিয়ে ভেবে কাঁদছিলেন, সেটা সাখাওয়াত শুনেছে। মেয়েদের নির্দিষ্ট বয়স হলে স্বামীর ঘরে যেতে হয়। এটাই দুনিয়ার নিয়ম। সাখাওয়াত মুখটা ভার করে বিছানায় বাে রইল।

বিভাবরী বেগম আলমারি থেকে টাকা বের করে সাখাওয়াত এর কাছে দিয়ে বললেন বাজার করে আনতে। সাখাওয়াত এর মুখটা একদম চুপসে গেল। বাজারটা আসলে তার দ্বারা সম্ভব হয় না। একটা না একটা ভুল হবেই।
তবুও, বিভাবরী বেগম তার ছেলেকে সঠিক ভাবে মানুষ করতে চান। সব সময় সকল পরিস্থিতিতে টিকে থাকার শিক্ষা দিতে চান।

সরকারী চাকুরিরতে স্বামী মারা গেলে মাসিক বেতন তার স্ত্রী পেয়ে থাকে, যতদিন স্ত্রী জীবিত। বিভাবরী বেগম সেই টাকা গতকাল উঠিয়ে এনেছেন। আর তার স্কুলের চাকুরীতে বেশ ভালো ভাববেই সংসার চলে যায়। তবুও একজন বাবা না থাকার কমতি সে কীভাবে মিটাতে পারেন না। এটা তো আদৌও সম্ভব নয়!
ছেলে মেয়েদের সুখী দেখা গেলেও, কোথাও এক চাপা কষ্ট থেকেই যায়।
বাজরের একটি ব্যাগ হাতে দিয়ে সাখাওয়াতকে বাহিরে পাঠিয়ে দিলেন। শিখিনী এখনো ঘুমে। তিনি একটু মিসেস আনোয়ার চৌধুরীর কাছে গেলেন।

প্রেম দরজা খুলে দেখল বিভাবরী বেগম দাঁড়িয়ে। তটস্থ হয়ে সালাম দিয়ে দরজা থেকে সরে দাঁড়ায়।
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি, ভিতরে আসুন।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, তোমার মা আছেন? ”
“জি, মায়ের রুমে। ”
“আচ্ছা। ”

বিভাবরী বেগম উত্তর পাশের একটি রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, প্রেম দরজাটা বন্ধ করে বলল,
” আন্টি, সাখাওয়াত আছে বাসায়?
” না, ওকে তো বাজারে পাঠিয়েছি।”
“হঠাৎ, ওকে বাজারে পাঠালেন!ও তো বাচ্চা একটা ছেলে। ”
” প্রেম, ও কোথায় আর বাচ্চা, ক্লাস টেনে পড়ে। এখনি সব শিখে না নিলে কীভাবে চলবে!”
প্রেম মাথা দুলাতে দুলাতে ধীর কণ্ঠে বলল,” আমায় একবার বলতে পারতেন!”
” তুমি! তুমি বাজার করতে পারো?”
প্রেম আমতা আমতা করে বলল, ” হ্যাঁ, শিখে নিবো আরকি, মানে শিখতে তো হবে। ”

বিভাবরী বেগম হাসিমুখে মিসেস আনোয়ারের রুমে চলে গেলেন। বিলেত ফেরত ছেলে নাকী বাজার করতে যাবো! তাহলে তো হলোও! প্রেমের মুখটা দেখার মত হয়েছিল। সে নিয়েই মিসেস আনোয়ারের সাথে হাসি মুখে বলতে লাগলেন। মিসেস আনোয়ারের সাথে তার সেই প্রথম থেকেই বেশ ভালো সম্পর্ক।

প্রায় ১৬ বছর হয়ে গেছে এই শহরে এসেছিলেন একা সন্তান নিয়ে। সবার মত মিসেস আনোয়ার খুব সাপোর্ট করেছিলেন। বিভাবরী বেগমের ব্যক্তিত্ব আচরন দেখে মিসেস আনোয়ার সব সময়ই মুগ্ধ হতেন। শ্রদ্ধা করতেন। একা মেয়ে মানুষ থাকলে শহরে তার হালচাল নাকী ঠিক থাকে না। যদিও আনোয়ার চৌধুরী বেশ অমায়িক মানুষ ছিলেন। তবুও, স্ত্রীর মন। বেশ নজরে রাখতেন প্রথম দিকে বিভাবরী বেগমকে। ধীরে ধীরে বিভাবরী বেগমকে চিনতে পেরে নিজের প্রতি লজ্জিত হলেন। এরপর কারণে, অকারণে দুজনের সুখ দুঃখের আলাপ চলে। সাখাওয়াত হওয়ার সময় বেশসময় দিয়েছিলেন বিভাবরী বেগমকে। সে থেকে মিসেস আনোয়ারের প্রতি বেশ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন বিভাবরী বেগম।

বাসায় চলে যাওয়ার সময় দেখলেন প্রেম সোফায় পা উঠিয়ে বসে আছে। বিভাবরী বেগম মুচকি হেসে বললেন, ” আসি বাবা, সময় মত চলে এসো কিন্তু। আমি নিজে হাতে সব রান্না করব।”
বিভাবরী বেগমের কোনো কথা প্রেম বুঝতে পারল না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। তিনি চলে গেলে প্রেম তার মায়ের সাথে কথা বলতে গেল।
“মা, আন্টি কী বলে গেল?”
” আন্টি কী কিরে! তুই না ছোট থেকে মনিমা বলে ডাকতি। ”
প্রেম মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। সত্যি সে বিদেশ থেকে এসে কেমন পাল্টে গেছে। বিদেশ যাওয়ার আগে প্রয়মের মত শহরটা চলে বেড়াত। কত সুন্দর মুহূর্ত ছিলো। জীবন ছিলো। আর এখন গম্ভীর চেহারায় সব সময় বসে থাকা। শুয়ে থাকা। পরিচিত মানুষের সাথেও সেই আগের মত সখ্যতা নেই! প্রেম এমন পরিবর্তনে তার বাবা-মা সহ সকলেই ব্যথিত হয়েছেন। তাদের ধারণা, ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে তারা একটি ভুল করে ফেলেছে!

ছেলেকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিসেস আনোয়ার বললেন,
” শিখিনীকে আজ পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে, সেখানেই আমাদের যেতে বলেছে সন্ধ্যায়, বুঝলি।”

কথাগুলো শুনে যেন প্রেমের মাথায় আগুন চড়ে গেল। শিখিনীকে দেখতে আসবে! কই আজ সকালেও তো শিখিনী এসব কথা তাকে বলেনি। তার মানে কী শিখিনীর এসবে মত আছে! ভিতরে ভিতরে প্রেম রাগে ফুঁসতে লাগল। খুব না, খুব বিয়ে করার সখ!
একপ্রকার রাগ নিয়েই ঘর থেকে বাহিরে চলে গেল প্রেম। প্রেমের যাওয়ার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। কেমন ছেলে! এমন ভাবে বদলে গেল।আগে তো শিখিনী বলতে অজ্ঞান ছিল!
যা’হোক, তিনি চিন্তিত হয়ে প্রিয়মকে ফোন করলেন, সুন্দর কিছু গিফট নিয়ে আসতে বলে রেখে দিলেন। এরপর, রান্না ঘরে পা বাড়ালেন। দুপুরের জন্য কিছু খাবার বানতে হবে!

প্রেম সোজা তার চিলেকোঠার রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। বাহিরে তপ্ত রোদের হাতছানি! মোবাইল নিয়ে একবার শিখিনীর নাম্বারে ডায়াল করবে ভেবে, আবার বিছানায় ঠাস করে ফেলে দিলো! কী পেয়েছি কী তাকে, এসে ভালোবাসার কথা বলবে৷ আবার অন্যের সাথে বিয়ের পিরিতে বসবে!ছাড়বে না সে শিখিনীকে!
মোবাইলটা হাতে নিয়ে শিখিনীর নাম্বারে ডায়াল করল, কিন্তু রিং শেষ হওয়ার আগেই লাইনটা কেটে দিলো, এরপর মোবাইলটা বন্ধ করে দিলো! ফ্যানটাও চালু করল না, গরম পরেছে ভীষণ! সে গরমের মাঝেই শুয়ে পরল। কিন্তু এত অস্থিরতা কী আর ঘুম আসে! মোবাইলটা সেভাবে রেখেই প্রেম নিচে নেমে সোজা শিখিনীর রুমে চলে গেল। বিভবরী বেগম যে রান্না ঘরে, সেটা প্রেম গ্রাহ্যই করল না।

শিখিনী ঘুমিয়ে আছে। ঘুমিয়ে থাকা শিখিনীকে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে।মুগ্ধ নয়নে কিছুক্ষণ শিখিনীর দিকে তাকিয়ে রইল প্রেম।
এরপর বিয়ের বিষয়টা মাথা নাড়া দিয়ে উঠতেই দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে শিখিনীর দিকে এগিয়ে গেল। ইচ্ছে করছিল, ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিতে।
ঘুমন্ত দেখে কিছু না বলে ডেসিন টেবিলে রাখা ফুলদানিটা ফ্লোরে বেশ জোড়ে ছুড়ে মারল। কাঁচের ফুলদানিটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here