চোখের আরশিতে সমুদ্দুর |৪
কেটে গেল আরও দুটো দিন বিষন্ন অবসাদে। রবিনের সময়টা দারুণ কাটছে। বন্ধুরা সবাই মিলে তাদের অন্য আরেক বন্ধুর বাড়ী মহেশখালী সেখানে এক রাত দুইদিনের ট্রিপে গেল সবাই। আমিও যেতাম যদি ভয়ংকর গতকালটা আমার জীবনে না আসতো।
হঠাই মৃন্ময়ীর হাজব্যান্ড কায়সার ভাইয়ের আম্মু স্ট্রোক করেছে খবর আসায় ভাইয়া ইমার্জেন্সি ফ্লাইটে বিকেলেই চলে গেলেন। সীট ছিল না বিধায় ঠিক হলো পরদিন মানে আজকে বাচ্চাদের নিয়ে ব্যাক করবে মৃন্ময়ী।
সন্ধ্যায় আমি আর রবিন বীচে বসে সূর্যাস্ত দেখবো প্ল্যান করেছি। কুসুম রঙা একটি জামদানী শাড়ী পরলাম। শাড়ীটি রবিন কিনে এনেছিল বিয়ের পরদিন। ওর হঠাত শখ হয়েছিল আমাকে কুসুম রঙে দেখার। একদম ট্রান্সপারেন্ট শিফন শাড়ীর মত পাতলা জামদানী শাড়ীটা ঢাকার আড়ংয়ের তিনটি শো রুম ঘুরে কালার মনের মত না পেয়ে শেষে গুলশান আড়ং থেকে কিনেছে সে। একটি শাড়ীর জন্য এত পরিশ্রম! শুনে হেসেছি আমি। আচরণের সাথে মেলে না মানুষটির স্বভাব।
রেডি হয়ে বের হবো। রবিন অপার মুগ্ধতায় আচমকাই রুমের দরজা খুলতে যেয়ে খুললো না। কাছে টেনে নিল আমায় প্রবল আকর্ষণে। আমি বিগত দিনের সমস্ত যন্ত্রণা মুহূর্তে ভুলে যেতে চেয়েছি রবিনের রোমান্সের উন্মদনায়। পারিনি। মন সাড়া দিল না। বার বার চেষ্টা করেও পারছিলাম না শাওকাতের মত করে রবিনকে একটি চুমু খেতে। রবিন একজন বিশ্বস্ত জীবনসঙ্গী চেয়েছিল। আমার মন শাওকাতকে বিশ্বাস করছে। কী অদ্ভুত এই দোলাচাল!
আমাদের সন্ধ্যায় আর বাইরে যাওয়া হয়নি। একবারে ডিনারে বের হলাম দু’জন। খাওয়া শেষ করে সৈকতে হাঁটতে এসেছি। রবিন আমায় নিজের পাঁজরের সাথে মিশিয়ে হাঁটছে আর একটু পর পর কোলে তুলে ঘনিষ্ঠ দুষ্টুমি করছে। একটু একটু করে মনের কালো মেঘ সরে যেতে লাগলো বুঝি। সৈকতে কাটানো পুরোটা সময় আমার দৃষ্টি শাওকাতকে খুঁজেছে। লাপাত্তা।
সেদিন রাতের পর শাওকাতকে আর দেখিনি। ইচ্ছে করেই সামনে পড়ছে না হয়তো।
রাত সাড়ে বারোটায় রবিনের ফোনে কল এল। স্বামী স্ত্রীর একান্ত ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত ছিল আমাদের। ঐ অবস্থায় বেড সাইড টেবিল থেকে মোবাইলটা নিল রবিন। রিসিভ করার সময় অস্ফুট আওড়ালো, “মৃন্ময়ী” বলে।
ওর কাছথেকে ফোনটা নিয়ে লাইন কেটে সুইচ অফ করে দিলাম। হতভম্ব হয়ে গেল সে। বুকের ওপর থেকে আমাকে এক ঝটকায় বেডের একপাশে ফেলে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো।
— কী করলে এটা শবনম!
— খুব স্বাভাবিক একটি কাজ করেছি। কেন তোমার মনে হয় না এটাই স্বাভাবিক আর তুমি যা করতে যাচ্ছিলে সেটা অস্বাভাবিক?
— মৃন্ময়ী আমার কলেজ লাইফের বন্ধু। ওর স্বামী এমুহূর্তে পাশে নেই। নিশ্চয়ই কোনো প্রয়োজনে ফোন করেছে।
— ও তুমি নও তোমার অন্য বন্ধুদের সাথে গ্রুপ বেঁধে এসেছে কক্সবাজারে। তুমি বাদে সী প্যালেসে পাশাপাশি কামরা সবার। তুমি সায়মনে। দূরত্বের হিসেবে তেমন প্রয়োজন হলে তোমাকে ডাকার কথা নয়। অন্য বন্ধুরা আছে যারা কল করার সাথে সাথে সামনে হাজির হবে। তুমি কেন?
— তুমি সন্দেহ করছো?
— না, সন্দেহ করা থেকে নিজেকে বাঁচাতে চাইছি। তুমি দিলে না। অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে আমাকে নিজের থেকে এভাবে ছুঁড়ে ফেলা অনেক সন্দেহ দূর করে দেয়।
— তুমি সিক!
— হয়তো.. তুমিই ঠিক।
কথা না বাড়িয়ে মোবাইল নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল রবিন। রাত দেড়টা বাজে তখনও এল না। কী মনে করে রবিনকে অন্য কোথাও না খুঁজে রিক্সা নিয়ে সোজা সী প্যালেসে এলাম। রিসিপশনে আটকালো না। একাধিক বার আসা যাওয়ায় মৃন্ময়ীর গেষ্ট হিসেবে চেনে ওরা আমাকে। ডোর নক করতেই দরজা সামান্য খুলে উঁকি দিল মৃন্ময়ী। আমায় দেখে চোখ উল্টে যাওয়ার দশা হলো তার।
কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে জোর করে দরজা ধাক্কা দিয়ে ওর রুমে প্রবেশ করলাম। ডাবল বেড রুমের একটি বেডে ওর মেয়ে দুটো গলাগলি করে ঘুমোচ্ছে অন্যটিতে রবিন বিবস্ত্র শরীরে শুধু শটস পরা যা ওর নিজের নয়। কার সেটা ভাবার মত রুচিতে এল না।
ফিনফিনে নাইটি পরিহিতা মৃন্ময়ীকে দেখে আমার পেট গুলিয়ে বমি এল। এবং সত্যি সত্যি আমি ওর গায়ে বমি করে দিলাম। বেশিক্ষণ হয়নি ডিনার করেছি। বমির পরিমাণ দেখে নিজেই লজ্জা পেলাম ইশশ আমি এত খেলাম কখন! ফ্লোর কার্পেটের বারোটা বাজলো। সোফার ওপরে রাখা রবিনের টিশার্ট দিয়ে আমার সিক্ত ঠোঁট মুছে নিলাম। রবিন পাথর হয়ে বসে আছে।
অত্যাধিক সুদর্শন আর আকর্ষণীয় লাগছে আমার প্রিয়তম স্বামীকে। এই নেশা কাটানো খুব কম মেয়ের পক্ষেই সম্ভব।
মৃন্ময়ীর দিকে তাকিয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম,
— মৃন্ময়ী আপু আপনি যদি ফুলি ন্যুড হয়ে রবিনের কোলে চড়ে বসেন। রবিন চুমোর ঝড় তুলবে বলেই আমার বিশ্বাস। কিন্তু আপনাকে নিয়ে বিছানায় শোবে না। ব্যবহার করা টিস্যু পেপার ব্যবহার করতে আপনার বন্ধুটির খুব না পছন্দ আমি জানি। বিশ্বাস না হয় দিয়ে গেলাম চেষ্টা করে দেখুন ওকে নিয়ে শুতে পারেন কিনা।
মৃন্ময়ী আপু কিছু না বলে রাগে কাঁপতে কাঁপতে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন। ফিরলাম রবিনের দিকে।
খুব শান্তস্বরে বললাম,
— যে বিশ্বাস ও নিরাপত্তা পেতে তুমি আমায় মরিয়া হয়ে বিয়ে করেছো সেই বিশ্বাস ও নিরাপত্তা তুমি আমার বেলায় কেন দিলে না রবিন? দেয়া উচিৎ ছিল।
যা তুমি অন্যের কাছে এক্সপেক্ট করো তা আগে তোমার নিজে ডিজার্ভ করা উচিত ছিল। আমি সিক বলেছিলে না? হ্যাঁ সত্যিই আমি সিক..
কথার মাঝে রবিন উঠে এসে আমায় জড়িয়ে ধরতে এল। ওর ফর্সা লোমশ বুকে মৃন্ময়ীর ঠোঁটের গোলাপি লিপস্টিকের দাগ দিয়ে ভরা। পিছিয়ে এসে দৌড়ে বের হয়ে এলাম রুম থেকে। রিক্সা ওয়েটিংয়ে রেখে গিয়েছিলাম।
ঘুটঘুটে অন্ধকার শ্রাবণ রাত্রির মধ্যভাগ বড় ভয়ংকর। কুকুর ডাকা নির্জন রাস্তায় বৃষ্টি নামলো ঝরঝরিয়ে। ছুটে চলা রিক্সার হুড ফেলে আমি যেন এবার সত্যি সত্যি পাগল হলাম।
রুমে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পরেই রবিন এল। কথা হোলো না আমাদের। আমি সোফায় শুয়েছিলাম। সে ফ্রেশ হয়ে বেডে যাবার আগে আমায় ডাকলো না। ভেবেছে হয়তো ঘুমিয়ে গেছি। রুমের লাইট নিভিয়ে টেবিল ল্যাম্প জ্বেলে দিল। বেডে এপাশ-ওপাশ নড়াচড়ার শব্দ পাচ্ছি। বেশ ভালোভাবেই জানি, এই কয়দিনে আমাকে বুকের ওপর নিয়ে ঘুমোনোর দারুণ এক বদ অভ্যাস তৈরি হয়েছে ওর।
কিন্তু সে তো মৃন্ময়ীর ঘোর কাটাতে পারছে না। না গেলে সে কী এ রাতে ফিরতো?
একটু পরেই রবিন এসে আমার সোফা ঘেঁষে দাঁড়ালো। তারপর আলগোছে ঘুমন্ত আমাকে কোলে তুলে নিল।
রাতটা আমায় কোলে নিয়েই আধশোয়া হয়ে কাটিয়ে দিল রবিন। জেগে ঘুমানো মানুষকে জাগানো যায় না। আমিও জাগিনি।
সকালে ব্রেকফাস্ট টেবিলে রবিনের সব বন্ধুরা এসে জানালো ওদের এক বন্ধুর বিয়ে। মহেশখালীতে ওদের বাড়ী। সমস্যা না হলে একরাত দুইদিনের জন্য আমরা যেন যাই ওদের সাথে রিকোয়েস্ট করলো সবাই।
আমার সমুদ্র ভীতি আছে বলে এড়িয়ে গিয়ে রবিনকে বললাম তুমি ঘুরে এস। রবিন আমার পানে সন্দিহান চোখে তাকালো। পরে কী ভেবে রাজি হয়ে গেল।
আমি জানতাম মৃন্ময়ী চলে যাবে। ওর শাশুড়ী স্ট্রোক করেছে। কিন্তু সবাই যখন রওনা হলো মৃন্ময়ী এসে হাজির সেখানে। সেও যাবে ওদের সাথে। সবাই খুশী হলো শুধু রবিন কিছুটা চমকালো মনে হোলো। মাইক্রোবাসে মৃন্ময়ীর বাচ্চাদের কোলে নিয়ে বসা রবিনকে দেখে আমার মন থেকে সৃষ্ট ভয়ংকর একটি বাক্য ঠোঁটে অস্ফুট উচ্চারিত হলো,
“তুমি আমি – আমরা কখনো আমাদের ছিলাম না।”
মাইক্রোবাস চোখের সামনে থেকে আড়াল হোলো খুব স্বাভাবিকভাবে আমায় অস্বাভাবিক কান্নায় রেখে। না চোখ দিয়ে পানি ঝরছে না। মন কাঁদছে। বের হয়েছিলাম সমুদ্র সৈকতে যাবো বলে। পেট থেকে কান্নার উথলে ওঠা মানসিক পরিস্থিতি বুকের ভেতরটা ছুঁতেই রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটছি। লিফটে একাই। ফ্লোর বাটন টিপে চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করলাম। শরীর সমস্ত ভার ছেড়ে দিল। মনে হোলো স্লো মোশনে গড়িয়ে পড়তে গিয়ে শক্ত কিছুর সাথে কাঁধ আটকে গেল। কোথাও বাঁধা পেলাম। উষ্ণ নিঃশ্বাসের আওয়াজ কর্ণকুহরে প্রবেশ করলে অনিচ্ছাকৃত চোখ মেললাম, দেখি লিফটের দেয়ালে হাত রেখে আমার পতন ঠেকাতে কিছুটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে শাওকাত।
— আপনি! আবারও পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচালেন!
— ভাগ্যে ছিল। ব্রেকফাস্টের জন্য ডাইনিংয়ে ছিলাম। সৈকতে যাবো দেখি আপনি টালমাটাল পায়ে রুমে ফিরছেন। পড়ে যাওয়ার সংশয় পিছু নিতে বাধ্য করলো। আপনি ঠিক আছেন?
— তুমি আপনি হয়ে গেল? ভালো।
— এটি আমার প্রশ্নের উত্তর নয়।
— ডোন্ট অরি আই’ম ওকে। থ্যাংকস।
— আপনার গানের গলা সুন্দর। নিয়মিত গাওয়া হয়?
— ওহ আপনি ছিলেন গতরাতে! ডাক দিয়ে আড়াল হলেন কেন?
— আপনার হাজব্যান্ড চলে এসেছিল। উনি আমায় দেখলে হয়তো আপনি মন্দ কথা শুনতেন।
— বাঃ আপনি দেখি আমার সম্মান নিয়ে ভাবছেন! আশ্চর্য, দুই সাক্ষাতে এত কে ভাবে?
— সাক্ষাত দুটো ক্যাজুয়াল ছিল কী? আমার তরফ থেকে অন্তত নয়। যাকে নিজের ভাবছি তার সম্মানের দিক দেখবো না ভাবছেন? বলুন!
— না দেখবেন না দূরে থাকুন যেন দেখতে না পাই।
— নিজের শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে চলুন। দেখবেন না। ইচ্ছে করে সামনে আসিনি। নিয়তি বার বার আপনার পতন ঠেকাতে আমাকেই টেনে নিয়ে আসছে আপনার কাছে। আমার হাতে নেই কিছু। সোজা হয়ে দাঁড়ান হাত সরাবো। কাঁধের মাসলে প্রেশার পড়ছে আমার। এত ভারি আপনি।
— সরি!
— ইট’স ওকে অতটাও ভারি নন।
— তাহলে!
— বলে দেখলাম আমার অনুমান ঠিক কিনা।
— কী অনুমান!
— বাঁকা কথাই আপনি কানে ভালো শোনেন। যা প্রকৃত অর্থে না শোনার ভান করা উচিত।
শাওকাত থেকে দূরে সরে দাঁড়িয়ে ওর দিকে নির্বাক চেয়ে আছি।
ভাবছি, যার কিছু নই নিয়তি তাকেই বার বার সামনে টেনে আনছে। যার সবকিছু শুধু তার নজরে আসছি না আমি। ভাগ্য বিড়ম্বনার এ কোন খেলা!
লিফট আমার রুমের ফ্লোরে থামলো। আপ্রাণ চেষ্টায় স্বাভাবিক হেঁটে লিফট থেকে বের হলাম। চোখে রবিন আর মৃন্ময়ীর গাড়ীর সীটে গা ঘেঁষে বসার দৃশ্যটা চোখ হতে সরছে না। ভুলতে না পারার কারণে নিজের ভার বইতে কষ্ট হচ্ছে।
রুম আনলক করার সময় হুঁশ হলো শাওকাতকে ‘বাই’ বলা হয়নি।
কী ভেবে ঘুরে দাড়ালাম। পাশের স্যুইটের দরজা মেলে দাঁড়িয়ে আছে শাওকাত।
— এটা আপনাদের…
— হ্যাঁ এটাতে উঠেছি আমরা। দেখুন না নিয়তি আমাদের আলাদা হতে দিচ্ছে না। এখানেও পাশাপাশি….
শাওকাতের কথা ফুরোবার আগেই বললাম,
— আর আসবো না আপনার সামনে নিশ্চিত থাকুন।
রূঢ় আক্রোশে ফেটে পড়ে শাওকাত বলল,
— স্রেফ তোমার সম্মানের দিকটা ভাবছি বিধায় কিছু বলছি না নইলে লিফটের দেয়ালেই পিষে ফেলতাম মেয়ে তোমাকে।
এইটুকু বলে অবজ্ঞা ভরে দড়াম করে ওর স্যুইটের দরজা লাগিয়ে দিল শাওকাত। চোখের অশ্রু এবার আর বাঁধ মানলো না।
রুমে ঢুকেই বেডের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ফোন বাজছে। কায়সার ভাই কলিং…
…
বন্ধু রাজুর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতে মধ্য রাত হয়ে গেল। মহেশখালী রাজুদের বাড়ী পৌঁছানোর আগেই হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছিল। মৃন্ময়ী আমার গা ঘেঁষে ছিল সারাক্ষণ যার ফলে রাজুর বাড়ীর সবাই ভেবেছে মৃন্ময়ী আমার বউ।
বন্ধুরা ইচ্ছে করেই ভুল ভাঙায়নি। রাজুটার মুখে কিছু আটকায় না। সে মৃন্ময়ীর সামনেই বন্ধুদের আড্ডায় দুম করে বলে বসলো,
— মৃন্ময়ী যেভাবে তোর সাথে চিপকে থাকে ওকে বউ পরিচয় দিয়ে ভাল হইছে। সম্মান রক্ষা হইলো তোর। নইলে বাজে কথা বলত সবাই।
হতবাক হয়ে গেলাম শুনে। বন্ধুদের সায় আছে এতে। ওরা সবাই জানে একসময় মৃন্ময়ী আমি লিভ ইন রিলেশনে ছিলাম। এই এক রাত থাকলে কিছু আসবে যাবে না। কিন্তু ওদের ওয়াইফরা এটাকে মোটেও সমর্থন করছে না। অবশ্য মুখে ভদ্রতার খাতিরে কেউ কিছু বলছে না তেমন। এরা শবনমকে খুব পছন্দ করে।
এক কামরায় থাকতে প্রথমে রাজি হচ্ছি না দেখে রাজু ফ্রেন্ডদের সামনেই গালি দিয়ে বলেছিল,
— শালা উজবুক তুই নতুন বউ ফালায়া প্রাক্তন লইয়া ফুর্তি করছিস, কী ভাবিস তোর বউ আর মৃন্ময়ীর স্বামী ওরা দুইটা কিছু বোঝে না! একজনের শ্বাশুড়ি মরতেছে সে আসছে বন্ধুর বিয়ে খাইতে। এই শালী বান্ধবী হইছে তাতে কী। কায়সার ভাইয়ের জায়গায় আমি হইলে কোমড়ে লাত্থি দিয়া বাইর কইরা দিতাম।
শোন রবিন তোর বউয়ের সম্পর্কে যা শুনলাম তোদের মুখে, আমার মন কু ডাক দিতাছে কইলাম।
রাজুর এমন একটা অপমান সূচক বাজে কথায় মৃন্ময়ী গা করলো না। আমি বেশ অস্বস্তি নিয়ে বললাম,
— কীসের কু ডাক? বাজে কথা বলিস না। শবনম অন্যরকম মেয়ে। ফ্লার্ট করার মত না। বুঝেশুনে চ্যুজ করেছি। আমি যেমনই হই আমার বউ….
মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ঝাঁঝালো গলায় মৃন্ময়ী বলল,
— কী তোর বউ কী সলিট্যায়ার (Solitare)?
আনমনা হয়ে বললাম,
— না তারচেয়েও দুর্লভ।
— এক্সাম্পল দে শুনি কী তোর বউ যাকে নিয়ে এত বড়াই তোর। অসহ্য, কই বন্ধুরা মিলে এনজয় করতে এসছি আর সে আছে বেহেনজি মার্কা বউয়ের প্রশংসা নিয়ে।
— রবিন ভাইয়ের বউ হলো ইউরেনিয়াম বুঝলেন মৃন্ময়ী আপু। সবার কপালে এই ধাতু সহ্য হয় না।
কথাটা আমাদের সাথে আসা আরেক বন্ধু নজরুলের মিসেস রেবেকা বেশ গম্ভীর স্বরে বলল। ওর বলার ধরণ তীর্যক ছিল। বন্ধু ও বন্ধুদের ওয়াইফরা কেউ পছন্দ করেনি শবনমকে ফেলে আসা। মৃন্ময়ীর কাণ্ডকারখানা বন্ধুর ওয়াইফরা একদমই নিতে পারছে না।
আমার যে কী হয় মৃন্ময়ীকে সামনে পেলে বুঝি না। গভীর প্রেম থাকা স্বত্তেও ওকে বিয়ে না করার কারণ ওর স্বভাব। মারাত্মক ডমিনেটিং। নয় বছর হলো ব্রেক আপ হয়েছে তবু অনুভূতি সেই আগের মত। ফিজিক্যালি ও আমায় টানে খুব। মৃন্ময়ীর বিয়ের পর ওকে ছুঁইনি সেভাবে। শত হলেও সে অন্যের বউ। আরেকজনের বউকে ছুঁতে রুচিতে বাঁধে।
কিন্তু মৃন্ময়ীটা মানছে না। বিয়ের আগের মতই কাছে পেতে চায়। সাড়া দিতে ইচ্ছে করে। পারিনা। ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে শবনমের নিষ্পাপ আদুরে মুখটা কীভাবে যেন মৃন্ময়ীর রূপ বদলে গিয়ে ফুটে ওঠে। গতরাতে তাই ঘটেছিল। আজ রাতে শেষ রক্ষা হবে বলে মনে হয় না।
রাজুর বাবা মা আমাদের স্বামী স্ত্রী ভেবে এক রুমে থাকতে দিয়েছে।
মৃন্ময়ী ওর বাচ্চাদের ঘুম পাড়াচ্ছে এই ফাঁকে আমি বারান্দায় এসে শবনমকে কল দিচ্ছি। ধরছে না মেয়েটা।
এখানে খুব বৃষ্টি হচ্ছে। শবনম বৃষ্টি ভালোবাসে। কী করছে ও এখন? আমায় মিস করছে কী? ভেবেছি বহুদিন পর বন্ধুদের আড্ডায় এসে আনন্দ পাবো। রাজু আর নজরুলের বউয়ের কথাগুলো কানে বাজছে।
রাজুর মন কু ডাকছে। রেবেকা শবনমকে ইউরেনিয়াম মীন করে বলেছিল এই ধাতু সব কপালে সয় না। কিন্তু শবনম অলরেডি আমার বউ। আমি চিরদিনের জন্য পেয়ে গেছি শবনমকে। কপালে সইবে না কেন, অবশ্যই সইবে।
পেছন থেকে এসে মৃন্ময়ী আমাকে জড়িয়ে ধরলো। হাত থেকে মোবাইল নিয়ে চেক করে দেখলো শবনমকে কল দিচ্ছি। সে ফোনটা রুমের ফ্লোরের কার্পেটে আছাড় মেরে ফেলেই আমার ওপর চড়াও হলো হিংস্র উন্মাদনায়।
ওভাবে ফোন ছুঁড়ে ফেলায় মৃন্ময়ীকে কিছুই বলতে পারলাম না। অথচ শবনমকে কথা শোনাতে ছাড়িনি। আত্মসম্মানে আঘাত করে বেডে ছুড়ে ফেলেছিলাম।
ভুলিনি, এই শবনমকে পাওয়ার জন্য কী পরিমাণ ডেস্পারেট ছিলাম আমি। এবার ফিরে গিয়ে ওকে মনেপ্রাণে কাছে টেনে নেবো। ওর মনের মত হবো। আদর্শ স্বামী হয়ে দেখিয়ে দেবো বন্ধুদেরকে একমাত্র আমিই শবনম নামক ইউরেনিয়াম ধাতুকে পাওয়ার যোগ্যতা রাখি। অন্য কেউ না।
স্রেফ আজকের রাতটা আমায় ক্ষমা করে দিস তোরা। ক্ষমা করে দিও শবনম। মৃন্ময়ীর সাথে এটাই শেষ একান্তে সময় কাটানো। আর নয়।
বিস্ময়ে চোখ উল্টে যাওয়ার অবস্থা হোলো মৃন্ময়ী নিজেকে নিরাভরণ করে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়ালে!
ও জানে ওর এই আমন্ত্রণ কখনো উপেক্ষা করতে পারিনি আমি। মনেমনে কসম কাটলাম আজকের পর মৃন্ময়ীর আমন্ত্রণে রবিন নেক্সট টাইম কখনো সাড়া দেবে না।
আবেগীয় উন্মাদনায় ছটফট করতে থাকা মৃন্ময়ীকে আদিম বন্যতায় কাছে টেনে নিলাম। রুমের লাইট নিভিয়ে দিল মৃন্ময়ী।
শেষরাতের দিকে পরিতৃপ্তির ক্লান্তিতে শ্রান্ত হয়ে আমার খোলা বুকের পশমে নাক ঘষতে ঘষতে মৃন্ময়ী তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল,
— ষ্টুপিড গার্ল শবনম। কী বলেছিল যেন… ও হ্যাঁ মনে পড়েছে। স্বামী প্রেমে অন্ধ মিসেস রবিন ইফতেখার বলেছিল, আমাকে কোলে নিয়ে তুমি নাকি চুমুর ঝড় তুলতে পারো কিন্তু তুমি কখনো আমায় নিয়ে শোবে না.. হাহ বুদ্ধু কাঁহিকা! ও কী জানে রবিন আজন্মই মৃন্ময়ীতে মত্ত থাকতে চায়।
আমার হাত পা জমে গেল মৃন্ময়ীর কথা শুনে। কতটা বিশ্বাস নিয়ে বলেছিল শবনম। কীভাবে ভুলে গেলাম কথাটা… শিট! কী করেছি আমি! মৃন্ময়ী কী রিভেঞ্জ নিল? আর ভাবতে পারছি না। বেড ছাড়তে উঠে পড়লাম।
মৃন্ময়ী জোর করে বাঁধা দিতে চেষ্টা করলে কষে কয়েকটা থাপ্পড় মারলাম ওর দু’গালে। বললাম,
— আমার জানা ছিল না তুই শরীর মন উভয়ই দিক দিয়েই নষ্ট হয়ে গেছিস। তোকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।
তুই না হতে পেরেছিস তোর প্রেমিকের আর না হতে পেরেছিস তোর স্বামী কায়সারের। ভেবেছি ভালোবাসিস তাই কাছে এসেছিস। তুই রিভেঞ্জ নিচ্ছিস জানলে… ছিঃ মৃন্ময়ী!
হাতে পায়ে ধরে মাফ চাইতে লাগলো মৃন্ময়ী। এবার সত্যিই আমার রুচিতে হলো না ওর সান্নিধ্যে থাকার। মোবাইলটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এলাম সোজা বাড়ীর বাইরে। শবনমকে কল দেয়ার জন্য ফোন আনলক করতেই শবনমের টেক্সট মেসেজ চোখে পড়লো।
সে লিখেছে,
“কল দিওনা। মিথ্যে শুনতে ভালো লাগছে না। আই’ম সো টায়ার্ড ইউ নো… এনজয় ইয়োর ফ্রেন্ডস গ্যাদারিং। এনিওয়ে, মৃন্ময়ী আপুকে মেসেজটা কনভে করে দিও ‘কায়সার ভাইয়ের আম্মু মারা গিয়েছে। উনি বলেছেন, মৃন্ময়ীর তাড়াহুড়ো করে আসার দরকার নেই মায়ের দাফনকাজ সম্পন্ন। এসে লাভ নেই। বেটার, প্ল্যান ওয়াইজ বাচ্চাদের নিয়ে একবারে ছুটি কাটিয়ে আসুক মৃন্ময়ী। ফোনে রিচ করা যাচ্ছে না ওদের। শবনম কাইন্ডলি জানিয়ে দেবেন।’
এই নাও জানিয়ে দিলাম। তুমি নিশ্চয়ই মৃন্ময়ী আপুর সাথেই আছো। আই নো এভ্রিথিং রবিন। এনজয় ইয়োর ট্রিপ।”
এই নিয়ে পাঁচ বার পড়লাম মেসেজটা। অস্থির মনকে শান্ত করে ফোন দিলাম শবনমকে। মোবাইল সুইচ অফ.. স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেলফোনের দিকে। ওয়াল পেপারে শবনমের হাস্যোজ্জ্বল মুখ নিদারুণ বিদ্রুপ করছে আমাকে। নাহ যেভাবেই হোক এখুনি ফিরতে হবে। জগত উল্টে গেলেও শবনমকে হারাতে পারবো না আমি। রাজুকে ডাকতে ওর ঘরের দিকে দমবন্ধ করে ছুটছি।
…
সকালে ঘুম ভাঙলো হোটেল রিসিপশন থেকে আসা ইন্টারকম ফোনের ক্রিংক্রিং শব্দে। ঘুম জড়ানো গলায় বললাম,
— হ্যালো..
— গুডমর্নিং ম্যাম আমি রিদওয়ান বলছি রিসিপশন থেকে।
— মর্নিং! জ্বি বলুন। এত সকালে.. কটা বাজে এখন?
— ৮টা ১১ মিনিট ম্যাম। সরি আপনার ঘুম ভাঙানোর জন্য। আসলে ব্রেকফাস্টের পর হোটেল সায়মনে আগত অতিথিদের নিয়ে হোটেল কতৃপক্ষের তরফ একটি কনসার্টের আয়োজন করা হয়েছে। সকাল ১০টায় কনসার্ট শুরু হবে ম্যাম। মোটামুটি সব গেষ্টদের ব্রেকফাস্ট ডান। যাঁরা করেননি আমরা তাঁদেরকে রুমে কল করে জানিয়ে দিচ্ছি।
— ও তাই বলুন! থ্যাংকইউ মিস্টার…
— রিদওয়ান বলছি ম্যাম।
— থ্যাংকইউ রিদওয়ান। আমি এখনো ব্রেকফাস্ট করিনি। রুমে পাঠিয়ে দেবেন প্লীজ? ডাইনিংয়ে যেতে ইচ্ছে করছে না। ব্রেকফাস্ট সেরে কনসার্টে আসতে চেষ্টা করবো।
— শিওর ম্যাম। ব্রেকফাস্ট মেন্যু বলুন।
— কনসার্ট কোথায় হচ্ছে, রুফটপে?
— নো ম্যাম, সায়মন বীচে।
— আরে বৃষ্টির সিজনে সী-বীচে কনসার্ট!
— শামিয়ানা টাঙিয়ে দেয়া হয়েছে ম্যাম। আশা করছি অসুবিধে হবে না। মাত্র দেড়ঘন্টার আয়োজন।
ব্রেকফাস্ট মেন্যু বলে ফোন রেখে ফ্রেশ হতে উঠলাম। সারারাত কান্নার ফলে মাথা ঝিমঝিম করছে। শাওয়ার না নিলে চলছে না। মোবাইল অন করে চার্জে দিয়ে শাওয়ার রুমে ঢুকবো এমন সময় ডোর নক হলো। ব্রেকফাস্ট এত তাড়াতাড়ি চলে এসেছে!
বেশ অবাক হয়ে দরজা খুলতেই সামনে দীর্ঘদেহী সুদর্শন পুরুষ শাওকাত হাতে একটা র্যাপিং করা প্যাকেট নিয়ে দাঁড়িয়ে। মানুষটাকে আজ একটু বেশিই ম্যানলি লাগছে।
ডেনিম ব্লু জিন্সের সাথে সুঁই সুতোর অলওভার কাজ করা অফ হোয়াইট খাদি পাঞ্জাবি আউটফিটে ম্যাগনেটিক একটা আকর্ষণ ওনার ব্যক্তিত্বে সূর্যের মতই প্রখর। পাঁচ সেকেন্ড তাকিয়ে থাকা গেল না। চোখ নামিয়ে নিয়ে কিছু বলতে যাবো উনিই শুরু করলেন,
— গুডমর্নিং রাস্পবেরি (Raspberry)!
— মর্নিং শাওকাত! কীহহ আমি রাস্পবেরি!
— নন?
— কীভাবে?
— অন্য একদিন বলবো। এই নিন এটি ঝটপট পরে আসুন কনসার্টে আপনার অপেক্ষায় থাকবো।
— আপনি কনসার্টে অংশগ্রহণ করবেন?
— ডিপেন্ডস আপনি এটি পরবেন কিনা তারওপর।
— কী এটি?
— শাড়ী। আপনার জন্য কিনেছি গত বিকেলে।
— সরি আমি নিতে পারবো না।
পাশের স্যুইট সম্ভবত ক্লিন করতে এসেছে ক্লিনার। বন্ধ দরজার সামনে লন্ড্রি ট্রলি। শাওকাত ট্রলির বিন বক্সে শাড়ীর প্যাকেট ছুঁড়ে ফেলতে চাইলে ওর হাত খপ করে ধরলাম। শাড়ীর প্যাকেট নিতে চাইলে দিল না। কেড়ে নিতে গিয়ে ওর কাছাকাছি হতে হলো। একহাতে আমার গ্রীবা পেঁচিয়ে আমায় নিজের পাঁজরের সাথে মিশিয়ে নিল শাওকাত। এলোমেলো চুল ছড়ানো কপালে গভীর চুমু এঁকে দিল। গালে ঠোঁট ডুবিয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। ভাবা তো দূর কোনো কিছু বুঝে ওঠার অবকাশ পেলাম না।
কম্পিত কণ্ঠে ফিসফিস করে বললাম,
— এত রাগ!
— আমাকে রাগাও কেন?
— ফের তুমি বলছেন। গিরগিটির মত ‘আপনি তুমি’ বদলাতে সময় লাগে না আপনার।
— এ্যানাকোন্ডা হয়ে গিলে ফেলিনি সেজন্য শোকর করো। কথা নয় যাও রেডি হয়ে এসো। সবাই বীচে চলে গিয়েছে। আমার আব্বু আম্মু ভাইবোন ওরাও ওখানে। আমাকে যেতে হবে। যাই রাস্পবেরি? একাকী শাড়ী সামলে আসতে পারবে?
— হুঁ পারবো। একটি প্রশ্ন ছিল শাওকাত।
— বলো।
— দু’বার দেখায় ভালোবাসা হয়ে যায়?
গাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে নিয়ে ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাস ফেললো শাওকাত। বুক ভরে সশব্দে দম নিয়ে নাকের সাথে নাক শক্ত করে চেপে ধরলো।
আমার শ্বাস নেয়ার সুযোগ হোলো না। দমবন্ধ হবার যোগাড় হলো অমন একটা মুহূর্তে ধারালো কন্ঠে শব্দ কেটে কেটে শাওকাত বললো,
— দুই সেকেন্ড লাগে না প্রেমে পড়তে। আর একবার প্রেমে পড়লে ভালোবাসা তখুনি শেকড় গজাতে শুরু করে। হিসেব করে দেখো কত হাজার সেকেন্ড ধরে ভালোবাসছি। জানি এই রাস্পবেরি আমার হতে চাইছে না। তবু ভালোবাসি।
আর দাঁড়ালো না মানুষটা।
কথা ক’টি বলে শাড়ীর প্যাকেট হাতে তুলে দিল। পর পরই আমার চোখ হতে বিগত রাতের শুকিয়ে যাওয়া কান্নার দাগ ওর হাতের তপ্ত আঙুলগুলোয় ঘষে মুছে নিল।
তারপর মাপা মাপা ঋজু পদক্ষেপে লম্বা করিডোর ধরে চলে গেল শাওকাত। ইচ্ছে করছিল বলি, ‘একটু দাঁড়াবে? একসাথে যাই।’
এ মন যা বলতে চাইলো তা বলতে পারিনি তাকে। মস্তিষ্ক বাঁধা দিয়ে নিউরনে সূঁচ ফুটিয়ে বললো,
‘এ ভারি অন্যায়! তুমি এখনও অন্যের বিয়ে করা বউ.. কাছে যেওনা।’
বিদ্যুৎ স্পৃষ্টের ন্যায় চমকে উঠে মনে পড়লো, মৃন্ময়ী আপুর গতরাতে পাঠানো টেক্সট মেসেজ,
“তোমার স্বামী পরিপূর্ণ রূপে আমার হোলো। আশা করি তুমি যখন শোবে রবিনের গায়ে বমির গন্ধ পাবে। যা তুমি উগরে ফেলেছিলে আমার গায়। কেমন লাগলো জানাতে ভুলো না। মিথ্যে বলছি না। ভিডিও ক্লিপ আছে, পাঠাবো?”
মধ্য রাতে ক্লিনার এসে আমার রুম সাফ করেছিল। ফুড পয়জনিংয়ের মিথ্যে কজ দেখিয়ে অস্বস্তি হতে রক্ষা পেয়েছিলাম। ক্লিনারকে নিশ্চয়ই বলা যায় না স্বামীর প্রাক্তনের নোংরা টেক্সট মেসেজ পড়ে বদহজম হয়েছিল তাই বমি করেছি।
রুম ক্লিন করার সময় স্যুইটের দরজার বাইরে করিডোরে পায়চারী করছিলাম। লিফট থেকে শাওকাত বের হলো। মাথার চারদিকে ওর সিল্কি শাইনিং ঘাড় ছড়ানো চুলগুলো ভীষণ উসকোখুসকো। পরনের ট্রাউজার ভেজা। সমুদ্রে নেমেছিল বোঝা যায়।
আমার বিধ্বস্ত পোশাক ও হতবিহ্বল চেহারার পানে প্রশ্নবোধক চাহনি দিয়ে অবাক হয়ে চেয়ে ছিল সে।
দুজনের মাঝে দূরত্ব তিন ফুটের। তার চোখ শুকনো আমারটা অশ্রুসিক্ত। সে ডাকলো,
— শবনম কাছে আসুন মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। লম্বা লম্বা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে খোঁপা বাঁধুন। আঁচল খসে যাচ্ছে… নিজেকে সামলে নিন শবনম নয়তো আমাকে সীমারেখা অতিক্রম করতে হবে? যা আপনার পছন্দ হবে না।
আমি কিছুই করিনি। অনড় দাঁড়িয়ে রইলাম। ব্রেইন কাজ করছে না। শাওকাত ধীর কদম ফেলে এগিয়ে এসে আঁচল ঠিক করে মাথায় ঘোমটা টেনে দিল। তর্জনী দিয়ে আমার সিক্ত চোখের অশ্রু মুছে ঠোঁটে ব্যথা দিয়ে ঘষে ঘষে আঙুল বুলালো.. বুলাতেই থাকলো যতক্ষণ না আমি কথা বললাম।
কার ওপর জানি না, তীব্র অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বিড়বিড় করে আবৃত্তি করলাম,
“একটা সময় তুমি আমায় ভুলে যাবে
যেমন করে রাত ভুলে যায় চাঁদকে
সকালের সূর্যস্নানে
একটা সময় আমি তোমার স্মৃতি হবো
যেমন করে ধুলোয় মলিন দিন মিশে যায় সন্ধ্যায়
তেমনি করে একদিন আমিও মিশে হবো মিশমিশে
সরে থাকো আকাশের মত
দূরে গিয়ে মরো না কেন তুমি
কেন এসে জ্বালাও বার বার
দীপ নিভে যাওয়া বাতিকে
আমি কী বলেছি কাছে এস?
কেন আসো তুমি
জানো না আমি শবনম!
রাতের নিবিড়ে ঝরে
মরি সকালের সোনালী রোদ্দুরে।
তুমি সূর্য, শক্তিশালী প্রখর
তোমার সাথে আমার কী মিল বলো!
একটা সময় তুমি আমায় ভুলে যাবে
যেমন করে রাত ভুলে যায় চাঁদকে
সকালের সূর্যস্নানে,
একটা সময় আমি তোমার দুঃখ স্মৃতি হবো।”
আবৃত্তি শেষ হতেই ঠোঁট হতে হাত সরিয়ে নিল শাওকাত। ওর শুকনো সাদা চোখে সূর্যাস্তের সিক্ত রঙেরা চিক চিক করছে। রুম ক্লিন করে লন্ড্রি বয় চলে গেল। আমি একছুটে রুমে।
আমার চোখে মৃন্ময়ীর টেক্সট মেসেজ শ্বাপদের ন্যায় জ্বলছে, নিভছে.. ভাসছে। বাচ্চা দুটিকে কোলে নিয়ে রবিন হাসছে মৃন্ময়ীর পাশে বসে। চোখের ফ্রেমে ওদের কী নিদারুণ মানিয়ে যায়। ওদের এত এত লোক সমাগমের উত্তাপে শবনম বাষ্প হয়ে উড়ি। আমার একটু ঘুম দরকার। কিছুতে আসছে না। দরজার ওপাশে একটি মানুষের ছায়া পড়ে। সেই ছায়া দেখতে দেখতে চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে ঘুমে।
সে কী জেগে ছিল সারারাত? জানি না, জানতে চাই না। আমি নিষ্ঠুর হবো।
শাড়ীটা রেখে শাওয়ার রুমে ঢুকলাম। সেলফোনে ননস্টপ রিং হচ্ছে দেখে এসেছি। রবিনের কল…
শাওয়ারের শীতল পানিতে তপ্ত অশ্রুরা চিবুক গড়িয়ে নামছে, আমি ওদের আলাদা করে চিনতে পারি। বাথরুমের দরজা লক করিনি। ব্যালকণির দরজা খোলা। বাহির থেকে ভেসে আসছে কনসার্টের ড্রাম পেটানোর আওয়াজ। দ্রিমি দ্রিমি মিউজিকের তালে তাল মিলিয়ে সুর তুলে গাইছে কেউ। উমম শাওকাত নাতো! কী অদ্ভুত ভরাট সেই গানের কন্ঠ… কী গাইছে সে?
“বাতাস তোমার অঙ্গ ছুঁয়ে সুবাস নিয়ে আসে
বেঁচে আছি গন্ধে তারই নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে
কাছে থেকেও তুমি আছো দূরে
কত ব্যথা তাই অন্তরে…
তোমাকে দেখলে একবার
মরিতে পারি শতবার…
বন্দিনী গো কাঁদছো তুমি আমায় মনে করে
তাইতো তোমার অশ্রুগুলি বৃষ্টি হয়ে ঝরে
শত বাঁধা আজ ভেঙেচুরে
মন পেতে চায় তোমারে…
তোমাকে দেখলে একবার
মরিতে পারি শতবার
তুমি নও তো কভু হারাবার জীবনে মরণে…”
ভেজা শরীরে রুমের কার্পেটে পা রেখে শাওকাতের গানের মর্মার্থ বুঝতে গিয়ে বুক ভেসে গেল অশ্রুতে!
(চলবে)
©মাহমুদা সুলতানা মবিন একা