চোখের আরশিতে সমুদ্দুর |৬

0
310

চোখের আরশিতে সমুদ্দুর |৬

ডাইনিং থেকে ওয়েটার এসে ধূমায়িত দু’মগ ল্যাটি রেখে গিয়েছে মাত্রই। সী-বীচ থেকে ফিরে শবনমকে ওর স্যুইটে রেখে আমি শাওয়ার নিয়ে লবিতে এসেছি পাঁচ মিনিট হয়। কফির অর্ডার আগে দেয়া ছিল সার্ভিং টাইমিং সহ। সোফায় রিল্যাক্স হয়ে বসে চোখবুঁজে ভাবছিলাম শবনমের সাথে আজকের যুগলবন্দী গান পরিবেশনার মুহূর্তগুলো নিয়ে। এরমধ্যে কফি চলে এসেছে। আর কিছু লাগবে কিনা ওয়েটার জানতে চাইলে সন্ধ্যার পর একটা ছোট্ট এরেঞ্জমেন্ট দিয়ে তাকে বিদেয় করেছি।
ল্যাটির মগে সিপ নেয়ার জন্য ঠোঁট ছুঁয়েছি কেবল, শবনম ওর স্যুইট থেকে বেরোলো।

ফেনিল হোয়াইট শর্টস্লিভ টপসের সাথে এক্যুয়া কালার লং স্কিনি স্কার্ট পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ঢাকা, গলায় জড়ানো সিল্কের রেইনবো স্কার্ফ, টপস আর স্কার্টের মাঝামাঝি দুই ইঞ্চির মত উন্মুক্ত কোমড়ে শামুক ঝিনুক লেয়ারের কোমড় বন্ধনি পরা মেয়েটিকে দেখে আমার হাতে ধরা ধূমায়িত ল্যাটি ছলকে ছিটকে পড়লো কিছুটা টেবিলে আর কিছু ফ্লোরে। ভাগ্যিস গায়ে পরেনি। আমি নিজেও পড়েছি সাদা জিন্সের সাথে এক্যুয়া কালার টি-শার্ট। দু’জনের পোশাক এভাবে মিলে যাবে তা অকল্পনীয় ছিল।
সদ্য শাওয়ার নেয়া ভেজা চুলগুলো শবনম মোছেইনি। কী অদ্ভুত মেয়ে চুলে টাওয়াল পেঁচিয়েই লবিতে বের হয়েছে।
গলায়, হাতে, কানে, নাকে অলংকার শুন্য এই মেয়েকে দেখে কে বলবে মাত্রই ক’দিন হলো তার বিয়ের। একটুও সাজে না শবনম। মন চাইছে এখুনি উঠে গিয়ে ওকে মনের মতন সাজিয়ে নিয়ে আসি। সারাক্ষণ চেহারায় কেমন এক বৈধব্য ভাব বিরাজ করে দেখতে বুকের বা’পাশ মুচড়ে ওঠে। সে যেন অন্য কারো নয়, আমারই বিধবা। দেখি যত মরি তত। আর সে বৈধব্য রূপ নিয়ে সামনে আসে অনায়াসে।

আমায় অনিমেষ চেয়ে থাকতে দেখে একেবারে সামনে দাঁড়িয়ে ঝুঁকলো একদম গায়ের ওপর এসে। চাইলে ওর বিউটি বোন ছুঁয়ে দেয়া যায় আমার ঈগল নাকের অগ্রভাগ দিয়ে। চোখ দুটো আরো কিছু দেখে নিত। কোমল কন্ঠা বেয়ে নেমে যাওয়া নিষিদ্ধ চারণভূমি।
নিজেকে সুধালাম, আমি কী এমন? লোভী! লম্পট! হৃদয়ের গহীন হতে একটি ভিন্ন মেসেজ এল। বলল,

“শবনম শুধুই শাওকাতের। নিজেস্ব রমণী। হতে পারে এক নিষিদ্ধ দেয়ালের ওপারে। তাঁকে ছুঁতে মানা। ধরতে বারণ। দেয়াল পেরিয়ে এপারে আসুক বা না আসুক। সে তোমারই।”

প্রবল বর্ষণে ভিজে উড়ন্ত ঈগল যেমন ডানা ঝাপটিয়ে গা ঝাড়া দেয় ঠিক তেমনি শরীরের আভ্যন্তরীণে গা ঝাড়া দিয়ে সোফায় এলিয়ে বসা পিঠের মেরুদণ্ড সোজা করে বসার সময় মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি চাপলো। মেরুদণ্ড সোজা করার ঐমুহূর্ত আচমকা দাঁত দিয়ে শবনমের চিবুক কামড়ে দেয়ার মেকি ভয় যেই’না দেখিয়েছি অমনি চোখে বিস্ময় নিয়ে আমার নাকের ডগায় আঙুলের তুড়ি বাজালো শবনম। দমে যাবার পাত্র তো নই। বুঝিয়ে দিলাম বিভোর হয়ে দেখছি তাকেই।

আমার মগ্ন মৌনতা ভাঙাতে ব্যর্থ হয়ে হাল ছেড়ে দিল সে। হাত থেকে এঁটো কফির মগ নিয়ে পাশেই সোফায় বসল শবনম। ল্যাটিতে ছোট্ট সিপ নিয়ে বলল,

— তুড়ি মেরে ঘোর কাটে না এমন বেঘোর দৃষ্টিকে কী বলে?

হালকা হেসে সিগার ধরালাম। ছোট্ট একটা টান দিয়ে বাতাসে ধোঁয়া উড়িয়ে বললাম,
— নেশা বলে। এধরণের আউটফিটে যে কেউ মাতাল হতে বাধ্য। উগ্র লাগছে শবনম। চেঞ্জ করে এস যাও।

— হলাম না’হয় উগ্র। ভদ্র সেজে দেখেছি। লাভ হয়নি কিছু। আপনি সিগার খান! আশ্চর্য এ ক’দিন চোখে পড়েনি।

সিগার পাইপ টি-টেবিলের ওপর এস্ট্রেতে রেখে শবনমের দিকে পূর্ণ মনযোগ দিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললাম,
— লাভ লোকসান চিন্তা করে নিজেকে বদলে ফেললে পণ্য হতে দেরি নেই বুঝেছ। উমম সিগার আমার বাবা খান। মাঝেমধ্যে আমি এক দু টান দিই ব্যস।

কেমন ঘোলা দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শবনম সিগার পাইপের দিকে। কিছুই হয়নি এমন ভাবে পাইপটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখছে। তারপর চট করে ঠোঁট ছোঁয়ালো টান দেয়ার জন্য। চোখের পলকে সিগার পাইপ কেড়ে নিয়ে রাগী চোখে ওকে দেখছি।
দেখেও না দেখার ভান করে বলল,

— পণ্য নই কে বলল? পণ্যই তো। কোত্থেকে এক মিস্টার পারফেক্ট এসে আব্বু আম্মুর মন জয় করে তাঁদের কন্যা বাগিয়ে নিয়ে চলে এসেছে কনে তা টেরই পায়নি। হানিমুনে এসে সেই কনেকে একলা ফেলে বর চলে গিয়েছে বন্ধুর বিয়েতে হ্যাং আউট করতে। নিজেকে পণ্য ছাড়া আর কী ভাববো বলুন! আমি পণ্যই।

রাগ ক্ষোভ দুটোই একসাথে গ্রাস করে নিল আমায়। শবনমের মুখে ওর নিজেকে তাচ্ছিল্য করা বাক্য শুনতে অসহ্য লাগলো।
রাগ সংযত করে বললাম,
— তুমি গেলে না কেন? গেলেই পারতে।

— রুচি! রুচিতে হয়নি। কিছু ঘটে চোখের সামনে বুঝলেন শাওকাত কিছু ঘটে। যা নিয়ে কথা বলা যায় না, সহ্য করা যায় না। তবু সয়ে নিতে হয়। বাধ্য।

শবনমের ঘনপল্লবের ডাগর চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। এই হৃদয় গহীনের কতখানি জুড়ে আছে সে যদি জানত তাহলে বুঝত সে কার সামনে বসে নিজেকে নিজে হেয় করে কথা বলছে। জানি, সে আমার বৈধ নারী নয়। না প্রেমিকা। একটুখানি এগোলেই লোকে বলবে পরকিয়া। ‘আই ডোন্ট কেয়ার!’ বাক্যটা ঝট করে মস্তিষ্কে উদয় হতেই সোফা ছেড়ে উঠলাম।

শবনম ভেজা চোখে অবাক তাকিয়ে বলল,
— আরেএএ উঠলেন যে! কফি মগ ছুঁয়ে দেখলেন না, এখুনি উঠবেন? তাড়া আছে? কোথাও যাচ্ছেন বুঝি?

ওর হাত থেকে আমার এঁটো কফি মগটা নিয়ে বললাম,
— এক মগেই যেখানে খাওয়া হয়ে যায় সেখানে ফ্রেশ ওয়ান কেন এঁটো করবো। এস আমার সাথে।

এক হাতে কফি মগ অন্য হাতে শবনমের হাতের রিস্ট ধরে ওকে সোফা থেকে টেনে দাঁড় করালাম।

কন্ঠে বিস্মিত ভাব নিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো,
— কোথায় যাচ্ছি?

— প্রশ্ন কেন! ভয় লাগছে?

— না। এমনি…

— বললে না উগ্র হয়েছ। চলো দেখি উগ্রতা শুধুই কী পোশাকে হয়েছ নাকি স্বভাবেও। এই একঘন্টায় নিজেকে বদলে নিয়েছেন কতখানি মিসেস রবিন চলুন একটু দেখে নিই।

আমার হাত এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে কয়েক পা দূরে সরে পেছালো শবনম। রাগ ঝরছে ভেজা চোখে। যাক কাজ হয়েছে তাহলে।
এবার যদি সে বানোয়াট খোলস ছেড়ে বেরোয়। টি টেবিল থেকে সিগার পাইপ বা’হাতে নিয়ে ডানহাতে ধরা ল্যাটি মগে সিপ নিতে নিতে এগুচ্ছি আমার স্যুইটের করিডোর ধরে।
পেছনে শবনম একাকী দাঁড়িয়ে। আমি নিশ্চিত সে রাগ ভুলে বিস্ময় চোখে আমাকেই দেখছে।

স্যুইটের ডোর আনলক করে রুমের ভেতরে পা রাখার ঠিক আগে ঘাড় ঘুরিয়ে শবনমকে দেখছি। বিস্ময় কাটেনি এখনো।
ঠোঁটের কোণে সিগার পাইপ চেপে বা’হাত বাড়িয়ে ছোট্ট করে বললাম,
— এস।

(চলবে)

©মাহমুদা সুলতানা মবিন একা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here