# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৮
ছুটিতে ধ্রুব বাসায় এলে ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন শুরু হলো। আমার চোখের সামনেই। আমি অসহায়ের মত চেয়ে চেয়ে সবই দেখলাম। না দেখে উপায় নেই কারণ আন্টি রোজ আমাকে ডেকে পাঠান তাঁকে হেল্প করার জন্য। আমি গিয়ে কাজ শেষে আবার চলে আসি। তবে ধ্রুবর সাথে আমার খুব কমই দেখা হয়। ইনফেক্ট ও বেশিরভাগ সময়ই বাসার বাইরে থাকে। তাতে আমার সুবিধেই হলো। ও বাসায় থাকলে আমার সংকোচ বোধ হয়, অস্বস্তি হয়। ওকে আর তরুকে একসাথে দেখলে চিৎকার করে কাঁদতে মন চায়। তাই ও বাসায় না থাকলেই আমার সুবিধে।
ওর হলুদের দিন সন্ধ্যা থেকেই আমার শরীর খারাপ ছিলো। রাতের দিকে একশো চার ডিগ্রী জ্বর উঠলো। মাকে জানাই নি। মা ধ্রুবদের বাসায় ছিলো। আন্টিকে হেল্প করছলো। বাসায় আমি একা। আমাকে রেডি হয়ে রাত দশটায় ছাদে চলে যেতে বলা হলো। কারণ তখন অনুষ্ঠান শুরু হবে। আমি গেলাম না। বিছানা ছেড়ে উঠার শক্তি আমার নেই। জ্বরের চোটে বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার দশা। এগারোটার দিকে আন্টি নিজে চলে এলেন আমাকে ডাকতে। আমার তখলো একশো চার ডিগ্রী জ্বর। জ্বরে কাঁতরাচ্ছি। আন্টি আমার অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলেন। মাকে খবর পাঠিয়ে তিনি নিজে বসে গেলেন আমার মাথায় পানি ঢালতে। আমি বারবার করে বাধা দিলাম এসবের প্রয়োজন নেই। আজকে তার ছেলের হলুদ তার সেখানে থাকা উচিৎ, তিনি শুনলেন না। কাজের মেয়ে তাকে ডাকতে আসলে তিনি গেলেন না। খবর শুনে মা নিচে নেমে এলেন। এসেই হুলস্থুল কান্ড।
কতক্ষন অচেতন ছিলাম আমি জানি না। জ্ঞান ফিরতে আবছা আবছা কানে এলো আমাকে হস্পিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নিচে গাড়ি এসে গেছে। আমি চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করলাম। আমার পাশে মা এবং আন্টি বোরখা পরে বসে আছেন। ঘরভর্তি লোকজন। ধ্রুব কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছিলো। ওর পরনের হলুদের পাঞ্জাবি! গালে হলদে ভাব। খুব কিউট লাগছিলো। ফোন রেখে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে টেম্পারেচার চেক করলো। আমি যেন স্বপ্ন দেখছিলাম। আমার স্বপ্নের রাজকুমার মায়াভরা চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমার কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে বলছে,”ভয় নেই। আমি আছি তো।” কিন্তু এসব কিছুই হল না। আমার স্বপ্নের রাজকুমার আমাকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো। আমি জ্বরের ঘোরে কেবল বললাম,”তোমার আজকে হলুদ। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হচ্ছো কেন?”ধ্রুব আমায় কোন কথা বললো না। সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো। তার পেছন পেছন মা, আন্টি আরো অনেকেই নামছে। বিয়ের বাড়ির অনেকেই হয়ত বুঝতে পারছে না সবাই এত ব্যস্ত হচ্ছে কেন? সামান্য জ্বর! তা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কি আছে। কিন্তু, ঘটনাটা হচ্ছে আমি যখন আধোচেতন, আধোজাগরণ অবস্থায় ছিলাম তখন নাকি আমার নাক দিয়ে টুপটুপ করে রক্ত পড়ছিলো। এবং মাকে কেউ একজন বলেছে নাক দিয়ে রক্ত পড়া ক্যান্সারের লক্ষণ। তারপর থেকেই মা পাগলের মত আচরণ করছেন। বিলাপ করে কাঁদছেন। আমি যে তাকে একটু সান্ত্বনা দেবো সেই জোরটুকুও হারিয়ে ফেলেছি। শরীর প্রচন্ড দুর্বল। ধ্রুব আমাকে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। আমার পাশে মা আর আন্টি বসলো, ধ্রুব বসলো ড্রাইভারের পাশে। আমি রুগ্ন কন্ঠে বারবার ওকে আর আন্টিকে বারণ করতে লাগলাম, ওদের যাওয়ার কোন দরকার নেই। কিন্তু ধ্রুব কিংবা আন্টি কেউ আমার কথা শুনলো না। মা তখন এসব শোনার অবস্থায় নেই। তিনি ক্রমাগত কেঁদে চলেছেন। এবং আন্টি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছেন। এদিকে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো, আমি শরীরে ঝাঁকুনি অনুভব করছিলাম। খিঁচুনি শুরু হলো। মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছিলো। পরিনামে আবার জ্ঞান হারালাম।
হস্পিটালে পৌঁছাতেই আমাকে কেবিনে শিফট করা হলো। এবং অক্সিজেন দিয়ে শুইয়ে রাখা হলো। মা আমার পাশে বসে রইলেন। ডাক্তারদের সাথে যাবতীয় কথাবার্তা ধ্রুবই বললো। কথা শেষে মা ওকে ডেকে এনে বললেন,”তুমি এবার বাসায় ফিরে যাও বাবা। আজকে তোমার হলুদ! তরু বারবার ফোন দিচ্ছে।” মায়ের কথার জবাবে ধ্রুব স্পষ্ট জানিয়ে দিলো ডাক্তার রিপোর্ট দেওয়ার আগে সে যাচ্ছে না। মা মনে মনে খুশি হলেন। কারণ বাবা ঢাকার বাইরে কিন্তু এই মুহূর্তে একজন পুরুষমানুষ সাথে থাকা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু চক্ষুলজ্জায় তিনি ধ্রুবকে আটকেও রাখতে পারছেন না আবার জোর করে চলে যেতে বলতেও পারছেন না। তবুও বললেন,”তোমার হলুদ অনুষ্ঠান। তুমি না থাকলে খুবই খারাপ দেখাবে।”
—“হলুদ লাগানো তো শেষ।”
—“কিন্তু অনুষ্ঠান?”
মায়ের প্রশ্নের উত্তর আন্টি দিলেন। বললেন,” এই অবস্থায় কি অনুষ্ঠানে মন বসবে? আগে মানুষের জীবন তারপর অনুষ্ঠান। বেঁচে থাকলে এমন বহু অনুষ্ঠান করা যাবে। মেয়েটা অসুস্থ। এখন ওর কথা ভাবুন। এখন এসব কথা থাক। তাছাড়া নিশাতের বাবা ঢাকার বাইরে এইমুহূর্তে একজন পুরুষ মানুষ তো হস্পিটালে থাকা প্রয়োজন। ওষুরপত্র আনার জন্যে হলেও তো লাগবে? ধ্রুব থাক।”
মা কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে আন্টির দিকে তাকালেন। এবং বিগলিত চিত্তে আন্টিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। আন্টির প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেলো। আমার চিন্তায় মা খুবই ভেঙ্গে পড়েছেন। আন্টি না থাকলে এইমুহূর্তে মায়ের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যেত। ধ্রুবর দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম ও বারবার ফোন কেটে দিচ্ছে। শেষে ফোন রিসিভ করে বাইরে চলে গেলো।
মা ওজু করে নামাজে বসলেন। আর আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। আমি চোখবন্ধ শুয়ে রইলাম।
আনুমানিক দশমিনিট পর ধ্রুব ফিরে এলো। আন্টি ভেবেছে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো কে ফোন করেছে। আমার তখন হুঁশ ছিলো আমার ছিলো না। কেমন যেন একটা আচ্ছন্নভাব। ধ্রুব গম্ভীরমুখে বললো,”তরু।” আন্টি জিজ্ঞেস করলেন,”কি বলেছে?”
—“বললো, বাসায় সবাই আমাদের জন্য ওয়েট করছে।”
—“তুই বলিস নি আমরা এখন ফিরবো না?”
—“বলেছি।”.
—“ও কি বলেছে?”
—“কি আর বলবে। মন খারাপ করেছে।”
আন্টি কিছুক্ষন নিরবে ধ্রুবর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন,” তুই ওকে ফোন দে, আমি বুঝিয়ে বলছি।”
ধ্রুব ফোন বের করে তরুর নাম্বারে ডায়াল করলো। আন্টি ওর সাথে কথা বললেন। ধ্রুব আমার পাশেই বসে ছিলো। আন্টি ফোন রেখে ধ্রুবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”তুই ওর সাথে রাগারাগি করেছিস কেন? বুঝিয়ে বললেই তো হতো? জবাবে ধ্রুব শুধু বললো,”আমি বুঝিয়েই বলেছি।”
ওদের কথার মাঝখানেই আমার আবার চোখমুখ অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করলো। আবার শুরু হলো কাঁপুনি। নিশ্বাস ক্রমাগত উঠানামা করছিলো। খবর পেয়ে নার্স এসে ইঞ্জেকশন পুস করলো। মা মোনাজাতে বসে কাঁদছেন। আন্টি কাঁদোকাঁদো গলায় ধ্রুবকে বললেন,”মেয়েটার হঠাৎ কি হলো বলতো? বেশতো ভালোই ছিলো।
ইঞ্জেকশন পুশ করার ঘন্টাখানেক বাদে আমার কন্ডিশন মোটামুটি স্টেবল হলো। আমি খেয়াল করলাম ধ্রুবর হলুদ নিয়ে আন্টির কোন চিন্তা নেই তার যাবতীয় চিন্তা কেবল আমাকে নিয়ে। নার্স এসে জানালো কালকের আগে রিপোর্ট পাওয়া যাবে না। কালকে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
নার্স চলে গেলে মা ধ্রুবকেও চলে যেতে বলে বাবার সাথে কথা বলতে বলতে কেবিনের বাইরে বেরিয়ে গেলো। আন্টির কাছেও বারবার বাসা থেকে ফোন আসছিলো। আন্টি ফোন নিয়ে একপাশে সরে গেলেন। ধ্রুব আমার পাশে বসে রইলো।
একরাতেই ওর চেহারা বেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে। ওকে অনেক বেশি রোগা দেখাচ্ছে। আমার পাশে চেয়ার টেনে বসলো। আমি মনে মনে দুঃখ পেলাম। বেচারা আমার জন্য নিজের হলুদটাও ঠিক মত এঞ্জয় করতে পারে নি। বললাম,”তুমি যাও নি কেন?”
—“তোমার রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এবার যাবো।”
—“হ্যাঁ যাও। কালতো আবার বিয়ে। পরে আবার শরীর খারাপ করবে।”
—“যাবো।”
—“আর শোনো তরুকে বলো আমি ওর কাছে ক্ষমা চেয়েছি। আমার জন্যই তোমাদের হলুদ প্রোগ্রামটা নষ্ট হয়ে গেলো। ”
—“বলবো।”
—“তুমি কিন্তু না এলেও পারতে।”
—“হুম।”
আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম আকাশ ফরসা হয়ে এসেছে। বললাম,”সকাল হয়ে এসেছে তাই না?”
—“হ্যাঁ!”
—“আর দেরী করা ঠিক হবে না। এবার বেরিয়ে পড়ো।”
ধ্রুব হোলদোল দেখালো না। নিরাসক্ত কন্ঠে বললো,”যাবো।”
—“কখন যাবে?”
—“এইতো যাবো।”
—“হুম, যাও। গিয়ে একটা হট শাওয়ার নাও। তোমাকে দেখে তো চেনাই যাচ্ছে না। রোগী রোগী লাগছে।”
ধ্রুব আপনমনেই বলে উঠলো,”রোগী লাগছে? মিথ্যে কথা!”
—“আমি শুধু শুধু মিথ্যে বলতে যাবো কেন?”
—“কী জানি!”
—“তোমার বিশ্বাস হলো না তো। ঠিক আছে বাসায় গিয়ে আয়নায় একবার নিজের চেহারাটা দেখো , তারপর বুঝবে কি হাল হয়েছে।”
—“আচ্ছা।”
আমি অবাক হয়ে ধ্রুবর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ধ্রুবকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আমার কোন কথাই ও ঠিকমত শুনছে না। মনে হচ্ছে কি যেন ভাবছে!
ভোর পাঁচটায় আন্টিকে নিয়ে ধ্রুব চলে গেলো। আমি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম। চোখ বন্ধ করতেই কাল রাতের ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ধ্রুব আমাকে কোলে নিয়ে একেরপর এক সিঁড়ি বেয়ে নামছে। তখন ওর চোখেমুখে কি উৎকণ্ঠাই না ছিলো। একমুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিলো বুঝি ধ্রুব নিজেও জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। আমি জানি না ওর আমার জন্য এই উৎকণ্ঠা আমি কি হিসেবে ধরে নেবো। ভালোবাসা নাকি মানবিকতা, নাকি দায়িত্ববোধ। কিন্তু আমি মনে প্রাণে সেই জিনিসটাকে উপভোগ করেছি। বুকের ভেতর একসাথে আনন্দ, বেদনা হাহাকার শুরু হলো।চিনচিন করে করে উঠলো। কাছে পেয়েও মানুষটাকে আমি পেলাম না। সে আজকে সারাজীবনের জন্য আরেকজনের সাথে বাধা পড়বে। তাঁর সঙ্গে সারাজীবন একসাথে পাড়ি দেওয়ার অঙ্গিকার গ্রহণ করবে ভাবতেই কান্না চলে এলো। আমি ফের চোখ বন্ধ করে কান্না আটকালাম। মা আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছিলো। আর দোয়াদরুদ পড়ে ফুঁ দিচ্ছিলো।
দুইদিন বাদে আমি হস্পিটাল থেকে রিলিজ পেলাম। এই দুইদিনে আর ধ্রুবর আমার দেখা হয় নি। এমনকি আন্টিও আমাকে আমাকে দেখতে আসে নি। আমি মনে মনে দুঃখ পেলাম। আন্টির কাছ থেকে এটা আসা করি নি। পরে ভাবলাম নতুন বউ নিয়ে ব্যস্ত হয়ত।
তিনচার দিন বাদে হঠাৎ একদিন ছাদে ধ্রুবর সাথে দেখা হলো। সাথে তরুও আছে। তরুর পরনে শাড়ি। শুকনো জামাকাপড় নিতে এসেছে। আমার বুকটা ধক করে উঠলো। বিয়ের পর তরু খুব সুন্দর হয়ে গেছে। দুজনকে একসঙ্গে মানাচ্ছিলোও বেশ। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাকে দেখে তরুর মুখ ভার করে ফেললো। পাঁচসাত মিনিট পরে তরু শুকনো জামাকাপড় নিয়ে নেমে গেলো। কিন্তু ধ্রুব নামলো না। তরু নেমে যাওয়ার পর আমিও নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ধ্রুব আমার পাশে এসে দাঁড়ালো,”কেমন আছো?”
আমি কোনরকমের নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,”ভালো।”
—“জ্বর পুরোপুরি সেরেছে?”
আমি ম্লান মুখে বললাম,”হ্যাঁ। তোমার কি খবর? আন্টি কেমন আছে?”
—“মা ভালো আছেন।”
তারপর অনেক্ষন নিরবতা। দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। নিরবতা ভেঙ্গে আমিই ইতস্তত করে বললাম,”একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”
—“কি?”
—“আন্টিকে অনেকদিন দেখি না। তুমি কি আন্টিকে আমাদের বাসায় আসতে বারণ করে দিয়েছো? না মানে আমি তো এখন তোমাদের বাসায় যাই না।”
ধ্রুব অবাক হয়ে বলল,”মা তোমাদের বাসায় যান না? কই আমাকে তো কিছু বলেন নি? তাছাড়া আমি কেন বারণ করতে যাবো?”
—“না মানে তরু…!”.
—“তরু বারণ করে নি।”
আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমি ভেবেছিলাম আন্টিকে হয়ত ওরা নিষেধ করার তিনি আমাকে দেখতে আসেন নি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি তিনি নতুন বউ পেয়ে আমাকে ভুলে গেছেন। ধ্রুব ছাদ থেকে নেমে গেলো। আমি মনে মনে আশ্চর্য হলাম। ধ্রুব আমার রিপোর্টের কথাও একটাবার জিজ্ঞেস করলো না। যেই রিপোর্টের জন্য সেদিন ও নিজের হলুদ প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করে দিয়েছিলো অথচ আজ তা জানবার প্রয়োজনও মনে করলো না! মানুষ কত তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হয়ে যায়! দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমিও নিচে নেমে গেলাম।
পরেরদিন আন্টির সাথে দেখা হয়ে গেলো ছাদে। তরুও আছে। আমি আন্টিকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”কেমন আছেন আন্টি।” আন্টি সংক্ষেপে উত্তর দিলেন তিনি ভালো আছেন। তারপর আর আমার সাথে তেমন কথা বললেন না। যেটা আমার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। তিনি এবং তরু নিজেদের মত করে গল্প করে যাচ্ছেন। আমার খুব কষ্ট হলো। খুব খারাপ লাগলো। মনে মনে ভাবলাম, আন্টি যখন একা ছিলেন তখন আমার দরকার ছিলো। এখন আর আমার প্রয়োজন নেই। এখন তার নতুন সঙ্গী জুটেছে। কিন্তু তাই বলে কি ভালো করে দুটো কথাও বলা যায় না? হায়রে মানুষ! এত তাড়াতাড়ি বোধহয় গিরগিটিও তার রঙ পরিবর্তন করে না যত তাড়াতাড়ি মানুষ তার রূপ বদলায়! আমি সেদিনও চুপচাপ নিচে চলে এলাম।
ধ্রুব ছুটি শেষ হলে ও চলে গেলো। এবং ধ্রুব চলে যাওয়ার পর আজকে তিনমাস আমি ওদের বাসায় যাই নি। আন্টির সাথেও কোন দেখা সাক্ষাৎ হয় নি। একদিন দুপুর বেলা আমি ভার্সিটি থেকে ফিরছিলাম। সিঁড়িতে আন্টির সাথে দেখা। তিনি মার্কেট থেকে ফিরছিলেন। আমাকে দেখে হাসলেন। সেদিন বিকেলে ছাদের ঘটনা মনে পড়ে গেলো। আমি তার পেছন পেছন নিরবে উঠে গেলাম। একটা কথাও বললাম না তার সাথে। তাদের বাসার সামনে আসতেই তিনি আমার হাত চেপে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমি বিরক্তমুখে বললাম,”কি ব্যাপার আন্টি? এভাবে টেনে নিয়ে এলেন কেন?”
—“তোর সাথে আমার কথা আছে।”
—“তাই বলে এভাবে টেনে নিয়ে আসতে হবে?”
—“বেশ করেছি। তুই আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলি কেন?”
আমি অভিমানী গলায় বললাম, “আমি কোথায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আপনি তো আর আগের মত আমার সাথে কথা বলেন না।”
আন্টির আমার গালটা টেনে দিয়ে বললেন,”তাই বুঝি রাগ করে আমাদের বাসায় আসিস না?”
—“আপনিও তো যান না।”
—“আমি তো সারাদিন ব্যস্ত থাকি। আমার কত কাজ। তরু মা হতে যাচ্ছে সব কাজ তো আমাকেই করতে হয়।”
আন্টির কথা শুনে আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তরু এসে চা দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও প্রেগন্যান্ট। এরপরে আন্টি কি কথা বললেন সেসব কিছুই আমার কানে গেলো না।আমার চারদিকটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আমার ভেতরের আমিটা চিৎকার দিয়ে জানান দিচ্ছিলো, “অনেক হয়েছে নিশাত। এবার ধ্রুবর ঘোর থেকে বেরিয়ে এসো। আর পাগলামি নয়। এবার নিজেকে সময় দাও! বেরিয়ে এসো ধ্রুবর ঘোর থেকে!” আমি মৌনমুখে বললাম,”আন্টি আজকে আমি আসি।”
আন্টি আমার হাত চেপে ধরে বললেন,”সে কি। তোর সাথে আমার কত কথা আছে। আমি ভাবলাম খেয়ে দেয়ে দুজনে জমিয়ে আড্ডা দেবো।”
—“আজকে না আন্টি অন্যদিন। আমি আসি।”
বাসার সিঁড়ি কীভাবে পার করলাম আমি জানি না। কেউ যেন আমার চলৎশক্তি কেড়ে নিয়ে নিয়েছিলো। আমার পা দুটো টেনে আটকে দিচ্ছিলো। দরজা খুলে মা আমার মুখ দেখে চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন আমার কি হয়েছে? আমি জবাব না দিয়ে ঘরে চলে গেলাম। মা আমার পেছন পেছন ঢুকলেন। তাঁর চোখে ভয়। আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”তোর কি হয়েছে মা? চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”
—“কিছু না মা। একটু টায়ার্ড লাগছে। আমি একটু রেস্ট নেবো।”
মা সন্দিগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি আত্মসংবরণ করতে পারলাম না। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,”আমি মরে যেতে চাই মা! আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।”
মা চোখ সরু করে ফেললো। সান্ত্বনা না দিয়ে বললো,,”তোর কি কাউকে পছন্দ আছে? থাকলে আমাদের বল!”
মায়ের এমন প্রশ্নে আমি রীতিমত অবাক হয়ে গেলাম। তিনি কি কোন ভাবে টের পেয়ে গেছেন আমি ধ্রুবকে ভালোবাসি! আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,”হঠাৎ করে এমন প্রশ্ন?”
—“এমনি, তোর বাবা জিজ্ঞেস করছিলেন। যদি পছন্দ থাকে বল, আমরা খোঁজখবর নিয়ে দেখবো। এভাবে কান্নাকাটি করিস না! ”
—“সত্যি করে বলো কি হয়েছে মা? হঠাৎ বাবা এসব কেন জিজ্ঞেস করেছে?”
—“কেন জিজ্ঞেস করবে আবার? তুই বড় হয়েছিস, তোকে বিয়ে দিতে হবে না? তাই। আজকে বিকেলে ছেলেপক্ষ তোকে দেখতে আসছে।”
আমি আবারো অবাক হলাম। হুট করে ছেলেপক্ষ দেখতে আসার মানে কি? মা আমাকে আগে জানালো না কেন? মাকে জিজ্ঞেস করতেই বললো ছেলেপক্ষ অনেকদিন থেকেই মেয়ে দেখতে চাইছে। বাবা সব খোঁজখবর নেওয়া ছাড়া মেয়ে দেখাতে রাজি ছিলেন না। তাই এতদিন কাউকে কিছু জানানো হয় নি। আমি চুপ করে রইলাম। মা ফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন আমার কোন পছন্দ আছে কি না। আমি না বলে দিলাম।
এই উত্তরে মা মনে মনে খুশি হলেন। এইমুহূর্তে মাকে ঘর থেকে বের করার জন্য বাধ্য হয়ে আমাকে কথাটা বলতে হলো। তা না হলে তিনি জেরা করতে করতে আমার জান বের করে দিতেন। আর চাইলেও মাকে সবটা বলা আমার পক্ষে অসম্ভব। মা চলে গেলে আমি চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে রইলাম। ধ্রুবর সাথে আমার প্রথম দেখা, লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম করার স্মৃতিগুলো এক এক করে মনে পড়তে শুরু করলো। তখন আমি বেশ ঝগড়ুটে এবং মেজাজি ছিলাম। প্রথম কয়েকমাস প্রেমের নতুন নতুন ক্রেজ থাকলেও এর পর রোজ ঝগড়া হতো আমাদের। তারপর দুজনেই রাগ করে ব্রেকাপ করলাম। প্রায় একবছরের মত কোন যোগাযোগ ছিলো না। তারপর একদিন ধ্রুবরা আমাদের বাসায় ভাড়াটিয়া হয়ে এলো। কত কিছু ঘটে গেলো! এখন ধ্রুব বাবা হতে চলেছে। সুখে সংসার করছে তরুকে নিয়ে.. আর কিছু ভাবতে পারলাম না। না পাওয়ার তীব্র বেদনা আমাকে তিলে তিলে যন্ত্রনা দিয়ে শেষ করে দিচ্ছিলো। একটা কথা খুব ভালো করে বুঝতে পারলাম ধ্রুব বা ধ্রুব জড়িত ঘটনা গুলো যতক্ষণ আমার চোখের সামনে থাকবে ততদিন আমি ধ্রুবকে ভুলতে পারবো না। তাই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। হয়ত বিয়ের মাধ্যমেই ধ্রুবকে ভোলা সম্ভব।
.
.
.
চলবে