মন_গহীনের_গল্প পর্ব ৩৪ রূবাইবা_মেহউইশ

মন_গহীনের_গল্প
পর্ব ৩৪
রূবাইবা_মেহউইশ
💞

হাসপাতালের নিস্তব্ধতা কতখানি ভূতুড়ে লাগতে পারে তা যেন মেহউইশ আজই জানলো। হতে পারে তারা ভি আই পি এরিয়া বলেই এতোটা শান্ত পরিবেশ পেয়েছে। রিশাদকে রাতের খাবারে স্যুপ ছাড়া কিছুই দেওয়া হয়নি৷ মেহউইশ নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে তাকে কিন্তু নিজে না খেয়ে থাকার ইচ্ছে ছিলো, রিশাদ তা হতে দেয়নি। সে নিজে একজন নার্সকে ডেকে খাবার আনিয়েছে এবং ধমকের সাথেই মেহউইশকে খেতে বলেছে। প্রথম প্রথম যেই ধমকগুলো মেহউইশের খুব বিশ্রী অপমান বলে মনে হতো আজকাল সেই ধমকই তার কাছে শাষণ মনে হয়। মনে হয় রিশাদের আচরণই এমন রুক্ষ।সে কোমল সুরে কাউকে কিছু বোঝাতে পারে না। ধমক খেয়ে প্রথমে খারাপ লাগলেও পরে হাসি পায় মেহউইশের। লোকটা রাগ আর জেদের ভান্ডার স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে খুলতে পারলেও ভালোবাসার ভান্ডার তার জেদের আড়ালে লুকানো আছে। রাতের খাওয়া শেষ হলে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করেছে মেহউইশ আর রিশাদ বসে ফোনকলে তার কাজের খবরা-খবর নিয়েছে৷ ম্যানেজার সাহেবকে বলা হলো সে দু দিনের মধ্যেই কক্সবাজার ফিরছে। কথাটা শুনে চকিতে তাকালো মেহউইশ । সে সবেমাত্র করিডোর থেকে কেবিনে ঢুকেছিলো।

-‘ডাক্তার এখনও রিপোর্ট দেখেনি। কবে হাসপাতাল থেকে ছাড়বে তাও জানা নেই’ রিশাদের উদ্দেশ্যে কথাটা বলল মেহউইশ । কান থেকে ফোনটা নিচে নামিয়ে নিলো রিশাদ।

-‘কবে ছাড়বে, কতদিন রাখবে সেটা আমি ঠিক করে নেবো। ‘

-‘বেয়াদব লোক’ বিড়বিড় করলো মেহউইশ।

-কিছু কি বললে?

-নাহ

-‘গুড, এদিকে এসো।’

ভালো বিপদে পড়া গেল। লোকটা যখন তখন বলে বসে কাছে আসার কথা। মেহউইশ ভাবে অন্যকিছু। রিশাদ তাকে আবারও ডাকতেই সে বেডের কাছে যায়। তাকে অবাক করে দিয়ে রিশাদ তার হাত ধরে টেনে বসায় বিছানায়। কোমর জড়িয়ে ধরে ইশারা করে শুয়ে থাকতে। কাপড় ভেদ করেও যেন সেই স্পর্শ কাঁপিয়ে তুলল মেহউইশের ভেতরটা৷ তিরতিরে হাওয়ার বেগ পা হতে মাথা অব্দি ঝড় তুলে দিলো। নিঃশব্দে গা এলিয়ে দিলো মেহউইশ রিশাদের বেডে। গা ঘেঁষে রিশাদও শুয়ে পড়লো চুপচাপ তার পাশে। আলোয় চারপাশ দিনের মত আলোকিত কেবিনটাতে ঝুপ করে নেমে এলো একরাশ নীরবতা। এই নীরবতা দুটি মানুষের নিঃশ্বাস ছন্দ তুলে ঘরময় পায়চারী করছে যেন৷ সারাদিনের অবিশ্রান্ত চিন্তা,দুঃখ আর আতঙ্ক সব নিমিষেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে ফেলল নিজেদের। মাঝরাতে গোঙানির শব্দে ঘুম ছুটে গেল মেহউইশের । নড়েচড়ে উঠে বসতেই দেখলো রিশাদের মুখটা লাল হয়ে আছে। শরীরের উত্তাপও স্পর্শ করার মত নয়। ঘুমানোর সময় রিশাদ তাকি জড়িয়ে রাখলেও জ্বরের তাপেই হয়তো নাকাল হয়ে তাকে ছেড়ে দিয়েছিলো। মেহউইশ খেয়াল করলো রিশাদ বেডের একদম কিনারায় হয়তো আরেকটু হলে গড়িয়েই পড়বে। কপাল,গা ছুঁয়ে দেখে তাড়াতাড়ি রিশাদকে টেনে বেডের মাঝামাঝি শুইয়ে দিলো। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো রাত তখন দুইটা পেরিয়েছে। সারা রাতই নার্স, আয়া থাকে হাসপাতালে কিন্তু ডাক্তার পাবে কি না পাবে ভেবে নিজেই মেডিসিনস চেক করলো। ঔষধের নামগুলো অচেনা তার কাছে তাই অন্য পন্থা অনুসরণ করলো। মগ ভর্তি পানি আর রিশাদেরই পকেট থেকে তার রুমাল বের করলো। জলপট্টি দিলো অনেকটা সময় কাজ হলো না। বোকার মত কেবিনে বসে থেকে জলপট্টি দেওয়া সমাধান নয় মনে হতেই কেবিন ছেড়ে বের হলো সে। একজন ডক্টর একটু আগেই নাকি চতুর্থ তলায় রাউন্ডে ছিলেন। এই মধ্যরাতেও ডক্টর আছে শুনে মেহউইশ আর দেরি করেনি৷ সে গেল ডাক্তারের খোঁজে এবং পেয়েও গেল ডাক্তারকে। কিন্তু তিনি শিশু বিশেষজ্ঞ তবুও মেহউইশের জোরাজুরিতে এসে রিশাদের চেকাপ করলেন। অবস্থা ঠিক নেই বুঝতে পেরে এই মাঝরাতেই অন্য এক ডাক্তারকে কল দিলেন। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মেডিসিন দিয়ে রিশাদের কিছুটা পরিবর্তন দেখে তবেই গেলেন তিনি। যেতে যেতে এও বলে গেলেন, ‘ নতুন বিবাহিত মনে হচ্ছে । ছেলেটা ভাগ্যবান এত যত্নশীল একটা বউ পেয়েছে। ভয় পেয়ো না তোমার স্বামী সুস্থ হয়ে যাবেন।’

বাইশ বছরের জীবনে মেহউইশের আজই প্রথম মনে হলো সে বিবাহিত। সত্যিই সে তার অপ্রিয় মানুষ অপছন্দের স্বামীর চিন্তায় আজ চিন্তিত ছিলো খুব। এখনও আছে কিছুটা চিন্তা তবে খানিকটা কম। লোকটার প্রতি মায়া পড়েছে কিনা জানে না সে তবে অভ্যাসে জড়িয়ে গেছে এটা বোঝে। ক্লান্তি আর ঘুমভরা চোখ নিয়ে রিশাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো সে কিছুক্ষণ। কয়েকঘন্টা আগেও এই লোক তাকে বকেছে,ধমকেছে আর এখনই সে লোকটার সেবা করছে। ‘বিয়ে’ সত্যিই পবিত্র বন্ধন যদিও তাদের জোরজবরদস্তির বিয়েটা কতেটা পবিত্র তা সে জানেনা, তবে এটা বৈধ। বৈধ,হালাল খাবারে যেমন বরকত থাকে রহমত থাকে তেমনি বৈধ সম্পর্কেও। যেই বিয়েটাকে সে মানতেই চায়নি সেই বিয়েটার মাত্র দু মাসের মাথায় সে মেনে নিয়েছে। আবার এই বৈধ সম্পর্কেও মানুষ একসাথে থাকতে পারে না। ভাবনায় বিভোর হয়ে রাতটা কখন ভোর হয়েছে বোঝা গেল না। হাসপাতালের পাশেই হয়তো মসজিদ তাই আজানের ধ্বনি স্পষ্টই শোনা গেল। বাড়তি কাপড়, ওড়না থাকা সত্বেও ওজু করে নামাজ আদায় করলে আর মনে মনে বলল কবুল করার মালিক আল্লাহ্। ফজরের পরপরই রেহনুমা ফেন করলো সে কান বাড়িতেই আছে রাইমা, নির্জনের সাথে। তার কিছুক্ষণ বাদেই ফোন করলো জেবুন্নেসা , করলেন মাইমুনাও। মেহউইশ শুধু অবাক হলো এই ভেবে, রিশাদের অবস্থা সম্পর্কে সবাই অবগত। রিশাদের বাবা কি জানেন না কিছু? না জানার তো কথা নয় তার পুরো পরিবার যেখানে সব জানে৷ নাকি বাবার সাথে তার কোন সম্পর্কই নেই।সে একবার শুনেছিলো বাবা ছেলের মধ্যে মনোমালিন্যতা আর সেকারণেই রিশাদ চট্টগ্রামে চলে গেছে কিন্তু এতোটা দূরত্ব! রিশাদের পরিবারের ভেতরকার বন্ধন কেমন তা মেহউইশের জানার কথা নয়৷ বলা যায় জানার মত সুযোগ কখনো হয়নি আর না সে আগ্রহী ছিলো।

রিহান স্কুলে যাওয়ার পথে এসে রিশাদকে দেখে গেছে। রিশাদের পুরো শরীরে দানাদার কিছু বেরিয়েছে আর তার সকল প্রকার টেস্ট রিপোর্ট চেক করে জানা গেল ডেঙ্গু হয়েছে। হাসপাতালে থাকার পরামর্শ দিয়েছে ডাক্তাররা কিন্তু রিশাদ জেদ ধরে বসে রইলো কালকেই সে চলে যাবে। তার জেদে কথা বলার সাহস দেখালো মেহউইশ। সেও জোর গলায় বলল, ‘ আমি কোন রোগীর সাথে ফিরতে চাই না। হয় হাসপাতালে থাকবে না হয় আমি নির্জনকে নিয়ে মায়ের বাসায় থাকবো।’ কথাটা বলেই আবার তার মনে হলো এই জেদ সে কেন দেখালো! তার তো বাবার বাড়ি বলতে রিশাদের দেওয়া বাড়িটি ছাড়া কিছুই নেই। কিন্তু কাজ হয়েছে তার কথায়। রিশাদ কিছু সময় চুপ থেকে বলেছে, ‘হাসপাতালে থাকলে ছোটবেলা থেকেই আমার দমবন্ধ লাগে। আমার সব ট্রিটমেন্ট বরাবরই বাড়িতে থেকে হয়েছে।’ কথাটা বলার সময় তার আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে এসেছিলো। মেহউইশ বুঝেও বুঝলো না তার সমস্যাটা কিন্তু জেবুন্নেসাও কেবিনে থাকায় বুঝলো সমস্যাটা কোথায়। রিশাদ এখন বাবার ছায়াতলে নেই বাবার অর্থের সাগরেও সে থাকছে না। বাড়িতে সব জোগাড় যন্ত্র করতে লাখের উপর খরচ যা হয়তো রিশাদ করতে পারবে না অথবা করতে চাচ্ছে না। রিশাদ যে তার মতোই আর খান বাড়িতে যেতে চায় না তা জেবুন্নেসা শুনেছে রাইমার কাছে।

-‘আচ্ছা বাবা তুমি তিন কি চারদিন থাকো শুধু । শরীরটা একটু ব্যাটার হলেই আমরা ডাক্তারকে বলবে বাসায় নেওয়ার কথা। এখন তো দেখছোই হুটহাট অবস্থা খারাপ হচ্ছে । তোমার তো অন্তত নির্জনের কথা ভেবে সুস্থ হওয়া লাগবে।’ কাজে দিয়েছে কথাগুলো। রিশাদ চুপ মেরে গেছে ; সত্যিই তাকে ছেলের কথা ভাবতে হবে। মাথার উপর আরো কিছু দ্বায় আছে রিহান,রাইমা আর মেহউইশের ভবিষ্যৎ নিয়ে। দেহের ক্ষয় হলেই তার দুনিয়া অন্ধকার ভেবেই সে আর কথা বাড়ালো না। জেবুন্নেসা যাওয়ার সময় হাজার বিশেক টাকা দিলো মেহউইশের হাতে। রিশাদের অভিভাবকের জায়গা এখন শূন্য। কখন কি লাগবে না লাগবে তা মেহউইশের পক্ষে ঠিকঠাক দেখা সম্ভব নয় এটা ভেবেই জেবুন্নেসা নগদ টাকাটা দিয়ে গেল। সে বাড়ি ফিরে নিজের একাউন্ট থেকে টাকা উঠিয়ে কাল নিয়ে আসবে আরো কিছু। বড় হাসপাতালের বড় খরচ আজ ঠিক গায়ে লাগার মত বেশ অনুভব করলো জেবুন্নেসা। সামান্য একটু স্বর্দি জ্বরেও হাজার হাজার টাকা খরচ করে প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা করে অভ্যস্ত আজ তাদের হিসেব করতে হচ্ছে দুদিনে কতোটা টাকা খরচ হলো। এই মুহূর্তে মনে হলো রাশেদ খান মানুষটা সত্যিই জঘন্য । তার কারণেই এই টাকার সমুদ্রের ভাসার অভ্যেস তাদের হয়েছে। জেবুন্নেসা ওবাইদুলকে ভালোবেসে এই অর্থের পাহাড় ছেড়ে জীবনযাপন করে শিখেছিলো কিন্তু এই জঘন্য লোকটাকে শেষ করার জেদ তাকে আবারও অর্থ আর প্রতিপত্তির অহমিকা শিখিয়ে দিয়েছে। জেবুন্নেসা চলে গেছে রেহনুমাও এসে দেখে গেছে রিশাদকে। নির্জনকে রেখে গেছে দিনের জন্য রাইমা কিংবা রেহনুমা এসে আবার নিয়ে যাবে রাতে। দিন কাটছে বন্দী হয়ে মেহউইশের । মেহউইশ অবশ্য সুযোগ পেলেই বাইরে থেকে হেঁটে আসছে নির্জনকে নিয়ে।বারবার মনে হচ্ছে ইভানকে সে আবার দেখতে পাবে। কিছু কথা বলা জরুরি সামনাসামনি,মুখোমুখি। যতোই সে রিশাদের সাথে সংসার সাজাক মনের ভেতর ইভানকে হারানোর ক্ষত সারাজীবন রয়ে যাবে। অস্তমিত সূর্যের পানে চেয়েও তার প্রথমে ইভানেরই কথা মনে হবে।প্রথম প্রেম,প্রথম ভালোবাসা তার জীবনে ইভানই নিয়ে এসেছিলো। বেরঙ,অসচ্ছল জীবনের প্রথম স্বচ্ছলতা ইভানের হাত ছুঁয়েই এসেছিলো তার। নির্জনের বয়স পাঁচ মাস শেষের দিকে৷ ইদানীং তাকে দুধের পাশাপাশি কলা,খিচুড়ি এটা সেটা দেয় রেহনুমা। আজ সারাটাদিন হাসপাতালে রাখবে ভেবে মেহউইশ একটু কলা দিলো তার মুখে। রিশাদ ঘুমের ঔষধের কারণে ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে তাকিয়ে দেখছে তাদের আর বিড়বিড় করছে, তুমিই কেন তার মা হলে না?’

তিনদিন থাকার পর রিশাদের শরীরের অবস্থার অনেকটাই উন্নতি হয়েছে। এই তিনদিনে মেহউইশকে নতুন করে সংসার পাততে হয়েছে হাসপাতালের কেবিনেই। বাইরের জীবন তো সে আরও আগেই ভুলে গিয়েছিলো এবার অভ্যস্থ হয়েছে পুরোপুরি বন্দী জীবনে। চতুর্থ দিন সকালেই ডাক্তার জানালো রিশাদ বাড়ি ফিরতে পারবে তবে প্রতিদিন একবার করে আসতেই হবে। কিছু ইনজেকশনস আর চেকআপ রয়ে গেছে। রিশাদ রাজী হলো তবুও সে হাসপাতাল থেকে বের হতে চায়। হাসপাতাল নাম ডিসচার্জ করতেই তারা উঠলো মেহউইশদের বাড়িতে। রিশাদের আচরণে কিছুটা নম্রতা এলো এবার। বাড়ি পৌঁছেই সে সালাম দিয়েছে এমনকি হাল তবিয়তও জিজ্ঞেস করেছে। পুলকিত হয়েছে মাইমুনা মনে মনে আরো প্রার্থনা করলেন রিশাদের সাথে মেহউইশের সংসারটা যেন সুখের হয়। রিশাদের অসুখ ভালো করে গেল তার সংসার জীবনে। একধাপ এগিয়ে গেল মেহউইশের সাথে তার সম্পর্ক। অস্বাভাবিক আচরণগুলো বদলে গিয়ে অতি সাধারণ স্বামী স্ত্রীর মত হয়ে উঠেছে।রিশাদের আমূল পরিবর্তন খুশি করলো সবাইকে। তবুও একটা রহস্য মেহউইশের জীবনে রয়ে গেল তা হলো রিশাদের বাবার নিখোঁজ হওয়া।

চলবে

(বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেলেও মন্তব্য পাওয়া যায় না সবার কাছ থেকে এটা সত্যিই দুঃখজনক)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here