কেন এমন হয় পর্ব -১৮

কেন এমন হয়

পর্ব – ১৮

খুশিতে আত্মহারা হয়ে সিমিকে জড়িয়ে ধরলো হিয়া।
পেছনে দাঁড়ানো রহিম বললেন-
—কি রে আমারে দেখি চিনসই না।
সিমিকে ছেড়ে রফিককে জড়িয়ে ধরে বলল-
—কাক্কু কি যে বল!
হিয়া যেন ছোট্ট বাচ্চা হয়ে গেছে এমন উচ্ছাস প্রকাশ করছে।হিয়ার মনে হচ্ছে কত কত মাস পর কিংবা বহুবছর পর বাবার বাড়ির কাউকে দেখল। বিয়ের পর বাবার বাড়ির কাউকে দেখলে কি এমনই মনে হয়?

রফিক তালুকদার সিমির বাবা,যার দাপটে পুরো গ্রাম কাঁপে কিন্তু নিজের সন্তান আর ভাইয়ের সন্তানেরা হলো জানের টুকরা। নিজের কিংবা ভাইয়ের সন্তানদের কখনো আলাদা চোখে দেখেননি।

এখন কাক্কুকে পেয়ে হিয়া কি করবে না করবে দিশা পাচ্ছে না।রফিক বললেন-
—এত ব্যস্ত হইস না।তুই আগে শান্ত হয়ে বস,একটু দেখি তোরে।তোর পছন্দের মিষ্টি স্পঞ্জ রসগোল্লা হারাধনের দোকান থাইকা আনছি,এই সিমি দে তো।
এই বলে হিয়াকে একটা মিষ্টি খাইয়ে দিলেন।

দ্বিতীয়বার রিং হতেই আরজু রিসিভ করলো। খুবই অবাক হলো রফিক চাচার কথা শুনে। তার সঙ্গে এমন কি কাজ থাকতে পারে যে, একেবারে বাসায় এসে দেখা করবেন? মনের মাঝে হাজারো চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। যদিও উনি বললেন-ঢাকায় একটা কাজে এসেছেন তাই আরজুর সাথে দেখা করে যাবেন। কিন্তু আরজু জানে রফিক তালুকদার এমনি এমনি কোন কাজ করেন না। তাঁর আগমন মানেই অনেক বিরাট কোন ঘটনা।
কনা জানতে চাইলে আরজু এড়িয়ে গেল।আসলে কথা বলতে ইচ্ছে হয়নি।প্রত্যেকবার কল আসলেই কনা এমন ভাবে জানতে চায় যেন গোপনে প্রেমিকার সাথে কথা বলছে কিংবা ভাড়াটে খুনি দিয়ে কনাকে খুন করার গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। সত্যি কথা বললেও চোখে-মুখে অবিশ্বাসের ছাপ দেখা যায়। আস্তে আস্তে কনার মন সন্দেহে পরিপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

কয়েক রকমের মিষ্টি নিয়ে হাজির হয়েছেন রফিক তালুকদার সাথে আদনান। আরজুর শ্বশুর বাড়িটা বানিয়েছে রাজ প্রাসাদের মতো। আরজুর শ্বশুর-শাশুড়ি সবার সাথেই কথা পরিচয় হলো। আরজুর বুক ধুকপুক করছিল।এক সময় রফিক বললেন-
—বিশেষ প্রয়োজনে আরজুর সাথে একা কথা বলতে চাই।
সবাই চলে গেলেও কনা রয়ে গেল।
রফিক বললেন-
—বৌমা তুমি থাকতে চাইলে থাকতে পার সমস্যা নাই। তোমার ও তো জানা উচিত তোমার স্বামীর মহান কীর্তির কথা।
হিয়ার মোবাইল বের করে মেসেজগুলো দেখিয়ে রফিক বললেন-
—সবগুলো দেখ,বৌমা তুমি পড়ে পড়ে শোনাও।
কনা চুপ করে আছে দেখে কঠিন স্বরে বললেন-
—কি হইলো পড়।
কনা পড়তে শুরু করলো-
মাঝামাঝি এসে পড়া বন্ধ করে দিল কনা,এমন জঘন্য কথা-বার্তা সবার সামনে পড়া সম্ভব না।
আরজু মোবাইল কেড়ে নিয়ে সবগুলো পড়লো,ওর চোখ ফেটে যেন রক্ত বেরিয়ে আসবে।কনার দিকে তাকিয়ে,আস্ত গিলে ফেলতে ইচ্ছে হলো।কনা উঠে চলে যেতে চাইলে আরজু শক্ত করে হাত ধরে বসিয়ে দিল।
—এই বার বল কোন বৈধ সন্তান এই কাজ করতে পারে? আমার অবশ্য এত কথা জানার দরকার নাই ,সোজা করে বল ,কেন করছস?
আরজু কনার দিকে তাকিয়ে রইল,কনার একটা হাত এতটা শক্ত করে ধরা যে,কনা ব্যথায় অবশ হয়ে যাচ্ছে।
—আমি এইখানে সারাদিন থাকতে আসি নাই। আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙিস না আরজু। তুই মুখ না খুললে তোর শ্বশুরের সাথে কথা বলি।
তখনই কনা বলল-
—এই সব মেসেজের কথা আরজু জানে না, আমি ওর নামে একটা ফেইক আইডি বানিয়ে আমিই ঐ সব মেসেজ দিসি।
সবাই এই কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল।
আরজু অনেক দুর থেকে খুব আহত কেউ যেভাবে কথা বলে ঠিক সেইভাবে বলল-
—কেন?
—কারন তুমি হিয়াকে ভালোবাস আর এই কথা আমাকে গোপন করছ। আমার ধারণা এখনো দুজনের প্রেম আছে।
এইবার রফিক বললেন-
—মুখ সামলে কথা বলবা।হিয়ার সাথে ওর সম্পর্ক এই সব ফালতু কথা কই শুনছ?নিজেরে অতি চালাক ভাবা বেক্কেল মেয়ে ,এইটা বোঝ না , দুইজনের মধ্যে যোগাযোগ যদি থাকতো তোমার এই জুচ্চুরি অনেক আগেই ধরা পড়তো হিয়ার কাছে। তখন তোমার খবর আরজুই নিতে পারতো।হিয়া আর আমরা ভাবছি এই কাজ আরজুই করছে। স্বপ্নেও ভাবি নাই এই কান্ড তোমার উর্বর মস্তিষ্কের ফসল!
আরজু বলল-
—চাচা কোন কথা বলার মুখ নাই আমার । নিজের স্ত্রীর এমন কাজের দায় ভার আমারই।
আদনান এবার কনাকে উদ্দেশ্য করে বলল –
—সন্দেহ হলে দুজনে মিলে কথা বলতে পারতেন।কথা বললে যে কোনো সমস্যার কারণ জেনে ব্যবস্থা নেয়া যায়।আন্দাজে এভাবে একটা মেয়েকে মানসিক কষ্ট দেয়ার কোন মানে হয়?হিয়া কতটা মানসিক কষ্টে কাটিয়েছে সেটা আমি দেখেছি।যেটা করেছেন খুব অন্যায় হয়েছে।
রফিক বললেন-
—এই মেয়ে আর কোনদিন যদি উল্টা পাল্টা কিছু করছ,আমি মনে রাখবো না তুমি কে-ঐ সময় আমারে খুব ভালোভাবে চিনতে পারবা।

আরজু দ্রুত রুমে ঢুকে কাপড় গোছানো শুরু করলো।

বাসার সবাই কি হয়েছে জানতে চাইলে,পরে জানাবে বলে নিজেদের রুমে ঢুকে গেল কনা।
—আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি তাই এমন করেছি।হিয়ার বিয়ের আগে ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম মনে আছে?তখন হিয়ার আচরণ দেখে আমার এমন মনে হয়েছিল।
আরজু রাগে বলতে লাগল-
—আর কি কি মনে হয়েছিল বলতে হবে না। সবকিছুই তো মেসেজে লিখাই ছিল। আমার আশ্চর্য লাগছে এই ভেবে , একটা মেয়ে হয়ে এমন নোংরা মেসেজ কিভাবে দিতে পার।
শোন , সত্যিটা খুব ভালো করে শোন-হিয়াকে ভালোবাসতাম আমার ধারণা সেও আমাকে ভালোবাসতো।মনে হয় বলছি কারণ আমাদের মনের অনুভূতির কথা কখনো কেউ কাউকে জানাইনি।প্রেম তো অনেক দুরের কথা।
বিয়ের পর তোমাকে শুধুই তোমাকে ভালোবাসতে চেয়েছি, ভেবেছিলাম ভালোবাসতে ও পেরেছি কিন্তু তোমার আচরণ আমার থেকে তোমাকে অনেক দুরে নিয়ে গেছে।এত দুরে যে সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব না।আর এখন তোমার এই সব কর্মকাণ্ড জেনে,
তোমাকে ভালোবাসা তো দুরে থাক তোমাকে ঘৃণা করতেও আমার ঘৃণা হচ্ছে।
আর একটা কথাও না বলে আরজু বেরিয়ে গেল।

হিয়া চিন্তা করতে লাগলো আজ শুক্রবার ছুটির দিন, কোথায় গেল কাক্কু আর আদনান?সিমি কে জিজ্ঞেস করেও সঠিক উত্তর পেলো না। শুধু বলে গেল একটা কাজে যাচ্ছে।এত দেরি হয়ে গেল এখনো আসার নাম নেই।কল করার জন্য মোবাইলটা কোথাও খুঁজে পেলো না হিয়া।
সিমি কে বলল-
—সিমি আমার মোবাইলটা যে কোথায় রাখলাম, খুঁজে পাচ্ছি না।তোর মোবাইল দিয়ে কাক্কুকে একটা কল দে তো।
বলতে না বলতেই কলিং বেল বেজে উঠলো।
আসার সময় বাজার থেকে অনেক কেনাকাটা করে এলেন।এ সব দেখে হিয়ার একটু রাগ হলো-
—কাক্কু এই সব কি,বাড়ি থেকে এত কিছু নিয়ে আসলে ,ফ্রিজে তো জায়গা নেই। কোথাও রাখবো?
আদনানকে উদ্দেশ্য করে বলল-
—আপনার ও কি আক্কেল নাই,কাক্কুকে কিনতে দিলেন কেন?
—আরে মা আদনানরে কথা শোনাইস না?ও মানা করছে। বাজারে গিয়া তাজা জিনিসগুলি দেইখা কিনতে ইচ্ছা করলো খুব।
শোনরে মা আগামী কালকে আমরা চইলা যাবো।
—এটা কি বল গত কাল মাত্র আসলে,আরো দুইদিন পরে যাও।
—আমার অনেক কাজ পরে আছে রে।
—কি কাজে যেন আসলে ,সেটা কি হয়েছে?
—সেই কাজ শেষ।
—তোমার জরুরি কাজ থাকলে যাও তবে সিমি কে রেখে যাও। কিছু দিন থাকুক আমাদের সাথে।
সিমিও বলল –
–বাবা থাকি?
—আচ্ছা ঠিক আছে।
শাপলা কোন কাজে হিয়াকে হাত লাগাতে দেয় না,নিজেই সব করে ফেলে।ডাক্তার দেখানোর পর থেকে হিয়াকে আরো বেশি পছন্দ করে শাপলা। তার মতে হিয়ার আচার- আচরণ দেখে মনে হয় সে মানুষ না, ফেরেশতা। একদিন শাপলা এই কথা হিয়াকে বলেও ফেলল।হিয়া এই কথা শোনে বলেছিল-
‘শাপলা ভাবি তুমি কি ফেরেশতা দেখেছ?’
‘দেখা লাগবে কেন?’জানি তো ফেরেশতাগো কোন পাপ নাই।শোইনা শোইনাই বিশ্বাস করি।কেউ কোন দিন আল্লাহ তাআলাকেও তো দেখে নাই,তাই বইলা কি আল্লাহর উপরে আমাগো বিশ্বাস নাই?’
‘তা ঠিক।’

রাতে সবাই মিলে রেস্টুরেন্টে খেতে গেলো। আহনাফ সবচেয়ে বেশি খুশি। শাপলা আর মফিজ এই প্রথম কোন রেস্টুরেন্টে খেতে গেলো। শাপলা যা দেখে তাতেই অবাক। মফিজ ঘোষণা দিল,এই সব কি খাওয়া যায়, বাসায় গিয়ে শাপলা যেন ভাত রেঁধে দেয়।
শাপলা বলল-
—এই এক মানুষ ভাত ছাড়া বাঁচতে পারে না।খালি ভাত ভাত করে।

আহনাফকে হিয়া খাইয়ে দিতে চাইলে,সে বলল, সবাই নিজে খাচ্ছে তাই সবার সামনে অন্যের হাতে খাবে না,সেও কাঁটা চামচ দিয়ে খেতে পারে।সে এখন অনেক বড় হয়ে গেছে না!
হিয়া ও বলল,আসলেই তো আহনাফ তো অনেক বড় হয়ে গেছে।
আসার আগে হিয়াকে সিমি জোর করে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিল।সেই শাড়ি সামলাতেই ব্যস্ত হিয়া।সিমি কে বলল-
—দেখ তো শাড়ি পড়া কি ঝামেলা! জোর করে পড়ালি।
আহনাফ হঠাৎ বলল-
—মামনি তোমাকে অনেক প্রিটি লাগছে।
ও এমন ভাবে বলল,সবাই ওর কথা শুনে হেসে ফেলল।

বাসায় ফিরে হিয়া যখন চুড়ি খোলায় ব্যস্ত তখন আদনান হিয়ার একদম কানের কাছে দাঁড়িয়ে বলল-
—আসলেই খুব প্রিটি লাগছে তোমাকে।
হিয়ার গালগুলো লাল হয়ে গেল।

চলবে…

ফাহমিদা লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here