বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :১৭
ফুলে সজ্জিত বিছানায় সেহের বসে।সারা ঘর জুড়ে মোমবাতির মিটিমিটি আলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে । চারদিক গোলাপের সুবাসে ম- ম ।দরজা থেকে শুরু করে বিছানা অবধি গোলাপের পাপড়ি বিছানো।বাহিরে তখন গভীর রাত। ঘড়ির কাটা একের ঘর ছুঁই ছুঁই।সেহের নিদ্রাজড়িত ঘুম ঘুম চোখে বার বার দরজার দিকে তাকাচ্ছে । আরহাম এখনো রুমে আসেনি। সারাদিনের ক্লান্তি তার উপর ভারি লেহেঙ্গা আর গহনা সব মিলিয়ে ভীষণ ক্লান্ত সে।ইচ্ছে করছে গা থেকে সব কিছু খুলে দূরে ছুঁড়ে মারতে কিন্তু তা করা সম্ভব না।আরহাম ঘরে না আসা অবধি কোন ভাবেই চেঞ্জ করতে পারবে না।মায়ের কড়াকড়ি আদেশ। ইচ্ছে না থাকা শর্তেও ঘুম ঘুম চোখ নিয়ে আরহামের অপেক্ষায় জেগে। আরহাম নিশ্চয় তার পিচ্ছি গার্লফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে ।এই বিয়েটা কেন করেছে সেই ব্যাখ্যা দিচ্ছে।এখনে আসার পর লিয়া থেকে শুনেছিল আরহামের একটা পিচ্ছি গার্লফ্রেন্ড আছে । যাকে ভীষণ ভালোবাসে । হয়তো তার মান ভাঙাতে ব্যস্ত! শুধু বেচারি মেয়েটার হৃদয় ভেঙে খান খান হলো। আরহাম বিয়েটা কেন করল? । সেহের ঘুম ঘুম অলস মস্তিষ্কে ভাবল । বার বার চোখ লেগে আসছে মুরগির মত ঝিমাচ্ছে!
গভীর রাত। বাহিরে কোলাহল বিহীন নিরিবিলি পরিবেশ আকাশের চাঁদটা মেঘের বুকে লুকিয়ে ।কারো উষ্ণ নিশ্বাসচ ঘুমন্ত সেহেরের মুখে আঁচড়ে পড়ছে ।গায়ের মিষ্টি ঘ্রাণটা খুব কাছ থেকে আসছে।আবছা ঘুমে সেহের সবটা টের পেলেও। চোখ খুলে দেখতে ইচ্ছে করছে না। তাই অপর পাশ ফিরে শোয় ।পরক্ষণেই টের পায় কারো হিম শীতল স্পর্শ সেহেরের গাল ছুঁয়ে দিচ্ছে।গায়ে কাটা দিয়ে উঠে।ঘুমের মাঝে তড়াক করে উঠে বসে। বড় বড় নিশ্বাস ফেলতে থাকে।চোখ থেকে ঘুম ছুটেছে অনেকক্ষণ । ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বরাবর রাত তিনটা। পুরো দু’ঘন্টা ঘুমিয়েছে।ক্লান্ত শরীর নিয়ে কখন যে চোখ বুঝে এসেছে টের পায়নি। ভয়ে আচমকা জেগে যাওয়ায় শরীর এখনো থরথর কাঁপছে । সেহের ঘাড় ফি্রিয়ে দেখে আরহাম পাশে বসে গভীর চোখে তাকিয়ে।সেহে্রের চোখে মুখে কঠোরতা ফুটে উঠে। বাজখাঁই গলায় জিগ্যেস করে ,”ঘুমিয়ে কি খুব দেরী করে ফেলেছি?……এখনো পুরোটা রাত পরে তো শুরু করুন! ”
আরহাম কুঞ্চিত ভ্রু করে বলল,”কি শুরু করবো? ”
সেহের তাচ্ছিল্য হাসি হেসে বলল,”যার জন্য বিয়ে নামক মোহর লাগিয়েছেন। এতো টাকা খরচা করেছেন ভোগ করবেন না? তো শুরু করেন ”
আরহাম কাঠকাঠ ক্রুদ্ধ চোখে সেহেরের দিকে তাকিয়ে । সেহের সেদিকে তোয়াক্কা না করে বলে,”ও বুঝেছি এসব গা ডাকা ড্রেসে পরে আছি বলে মুড হচ্ছে না! তাই তো ? …অকে দ্যান চেঞ্জ করে আসি।স্লিভলেস ব্যাকলেস শর্ট নাইটি চলবে? ”
সেহেরের প্রত্যেকটা কথা আরহামের কাছে গা জ্বালা করা অপমান মনে হচ্ছে।রাগে মাথা বিগড়ে যাচ্ছে ।সেহের বিছানা থেকে নেমে সামনের দিকে পা বাড়াতে আরহাম পেছন থেকে হেচকা টান দেয়। সেহের বিছানায় পড়ে।রাগে গরগর করছে সে।সেহের কিছু বলতে নিলে আরহাম ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে চুপ করিয়ে দেয়।দাঁতে দাঁত চেপে ভারী স্বরে বলে”চুপ একদম চুপ! এতো বাজে বকো কেন ? চুপ থাকা যায় না? ”
সেহের উত্তর না দিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়।আরহাম পাতাল কোলে তুলে সেহেরকে বিছানার মাথার সাথে হেলান দিয়ে বসায়। মাথা ঘোমটার সাথে লাগানো পিন গুলো খুব আলতো ভাবে খুলছে ,যেন ব্যথা না লাগে। সেহের ভ্রু কুঁচকে গাঢ় চোখে তাকিয়ে থাকে । উনি কি করতে চাইছে? উত্তর মিলল না । আরহাম মাথার ঘোমটা খুলতে খুলতে বলে ,”এখনো চেঞ্জ করো নি কেন? ”
“মা বলেছে ,আপনি না আসা অবধি যেন চেঞ্জ না করি ”
সেহের মুখ ভার করে উত্তর দিলো। আরহাম মুচকি হাসল।গহনা খোলার জন্য হাত বাড়িয়ে বলল,”সবার সব কথা শুনতে হবে? ”
সেহেরের এবারো প্রত্যুত্তর করলো না।আবছা আবছা হলদে আলোয় আরহাম খেয়াল করল সেহেরের গলা কান হাত লালচে লালচে হয়ে আছে।অনেকক্ষণ গয়না পরে থাকায় হয়তো!
আরহাম ঠোঁটের ছোট ছোট স্পর্শে আলতো স্পর্শে লালচে স্থান গুলো ছুঁয়ে দিলো।সেহের আরহামকে নিজের এখনো কাছে পাওয়ায় আবেশে চোখ বুঝে নিলো।গা আবারো থরথর কাঁপছে।এবারের কম্পন সম্পূর্ণ ভিন্ন।মনে ভিন্নরকম এক অনুভূতি তৈরি করছে।সেহের মুঠো করে বিছানার চাদর চেপে ধরে। গলা থরথর কাঁপছে। কিছু বলতে চাইছে কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না।সব কিছু এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। আরহাম সেহেরের গালের সাথে গাল মিলিয়ে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,”ভয় নেই ,তোমার অনুমতি ছাড়া আমি একপা বাড়াবো না।যেদিন তুমি মন থেকে ধরা দিবে সেদিন তোমাকে নিজের করবো।ততদিন অপেক্ষা করবো,দূর থেকে দেখবো ! ”
আরহামের প্রত্যেকটা কথায় সেহের কেঁপে উঠেছে। আরহাম দূরে সরে যায়। সেহের কাঁপা কাঁপা চোখজোড়া খুলে আরহামের দিকে তাকায়।আরহাম হাতের চুড়ি খুলতে ব্যস্ত ।সেহের আড়চোখে আরহামকে দেখছে।
“ফ্রেশ হবে? ”
“উহু ,ঘুম ছুটে যাবে! ”
“বেশ” আরহাম হেসে বলল,”সারাদিন শরীরের উপর ধকল গেছে । এখন একটু ঘুমাও ,অনেক রাত হয়েছে । ”
সেহের নাচুক করল না।বাধ্য মেয়ের মত হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়াল । সাথে সাথে বিছানায় গা এলিয়ে জোরপূর্বক চোখ বুঝে নিল।আরহাম মুচকি হেসে গায়ে চাদর টেনে এসির পাওয়ার বাড়িয়ে সেহেরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসলো প্রিয়তমার হাত নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে গাঢ় করে চুমু খেলো । এই মোহিত রাত যেন শেষ না হয়! রাতভর মন ভরে প্রিয়তমাকে দেখল।
ক্লান্তি ভরা দিনের পর নতুন এক দিনের সূচনা ।শব্দহীন রুমটায় এসির শোঁ শোঁ আওয়াজ ভাসছে।পুরো রুম হিম শীতল ঠাণ্ডা হাওয়ায় জমে।সেহের শক্ত করে গায়ে চাদরটা জড়িয়ে নেয়।হাত পা বরফের মত জমে গেছে।ভারী পর্দা ভেদ করে সূর্যের মৃদু আলো চোখে পড়তেই মুখে বিরক্ত ভাব ফুটে উঠে ভ্রু কুঁচকে নেয়। আবছা আলো ধীরেধীরে প্রখর রূপ নেয়। সেহেরের ঘুম ছুটে ।আধো আধো চোখ মেলে তাকায়।আরহামের রুম ।সেহের ছোট এক নিশ্বাস ছাড়ে। আড়মোড়া ভেঙে অলস ভঙ্গিতে উঠে বসে।হাই তুলে সামনে তাকাতে থতমত খায়।আরহাম সেই রাতের ভঙ্গিতে সেহেরের হাত চেপে বসে।হাতটা বেশ শক্ত ভাবে চেপে আছে। যেন হাতের বাঁধন হালকা হলে সেহের পালাবে।ঘুমের মাঝে এতো শক্ত করে কিভাবে হাত ধরে আছে কে জানে! কই সেহের তো এমনটা পারে না। চোখ লাগতেই দুনিয়াদারী সব ভুলে বসে থাকে। ঘুমের মাঝে কেউ যদি তাকে পানিতে ফেলে তাও বুঝি টের পাবে না।
এখনো গায়ে শেরওয়ানী । চেঞ্জ করা হয়নি। আচ্ছা ,আরহাম কি সারারাত এখানেই বসে ছিল? ভাবতেই সেহেরের ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি ফুটে ।মনের গভীরে কোথাও সুক্ষ্ম এক ভালো লাগার জন্ম হয়! বিয়ের প্রথম রাতে স্ত্রী কে না ছুঁয়ে সারারাত তাকে দেখে কাটিয়ে দেওয়া যে কোন পুরুষের ক্ষেত্রে খুব একটা সহজ নয়। ভীষণ কঠিন।আরহামের এই ছোট কাজটা সেহেরের মনে গভীরতর প্রগাঢ়ভাবে ভালোলাগার একটা ছাপ ফেলল। ঘুমন্ত আরহামকে কি মোহিত লাগছে। দুনিয়ার সব সরলতা সৌন্দর্য যেন এই মুখটায় ঢেলে রেখেছেন ।আরহামের এই নিষ্পাপ চেহারা সেহেরকে খুব গভীর ভাবে টানল ।না চাওয়ার শর্তেও আরহামের পানে হাত বাড়াল । আলতো হাতে কপাল ছুঁই ছুঁই চুল গুলো সরিয়ে দিল।আরহাম। নড়েচড়ে উঠলে সেহের ভয়ে কেঁপে উঠে। মুখের মিষ্টি হাসিটা নিমিষে গায়েব হয়ে চিন্তা ফুটে উঠে।সেহের ধীরে ক্ষিপ্রভাবে দূরে সরে যেতে নিলে পেছন থেকে আরহাম খপ করে হাত টেনে ধরে। সেহের চোরা মুখ করে চোখ বুঝে নেয়। ধরা পরে গেল কি?
“এদিকে তাকাও ”
পেছন থেকে ঘুম ঘুম ভারী আওয়াজ আসে।সেহের ছোট ঢোক গিলে ভিতু ভিতু মুখে পিছনে ফিরে তাকায়। আরহামের সাথে চোখাচোখি হতেই সেহের একপাটি দাঁত বের করে হাসল ।আরহাম কঠিন মুখে তাকিয়ে । আরহামে কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই সেহের থতমত গলায় বলল ,”দে.দেখুন আমি মানছি আমার ভুল হয়েছে…ঘুমের ভেতর এভাবে আপনাকে স্পর্শ করা উচিত হয়নি,,,,আ’ম সরি …..আর কোনদিন আপনার চুল …..উহু ,কপাল …না না চুল ছুঁবো না। পাক্কা প্রমিজ! ”
সেহের এলোমেলো ভাবে কথা গুলো বলল।আরহামের সেহেরের কথায় কর্ণপাত না করে।হুট করে নিজের কাছে টেনে আনল । সেহের ভয়ে ঢোক গিলে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে নিল।আরহাম সেহেরের কোমর চেপে গালের সাথে গাল মিশিয়ে মুচকি হেসে বলল ,”গুড মর্নিং লাভ ”
গালে গভীর ভাবে চুমু এঁকে বাঁকা হেসে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়।সেহের তখনো বিস্মিত চোখে তাকিয়ে।এই মানুষটা এমন কেন? এই ভালো এই মন্দ! সেহের ধরেই নিল তার সারাজীবন এই মানুষটাকে বুঝতে গিয়ে পাড় হবে।
চলবে….❣️
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।