বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি
উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)
পর্ব :১৮
সেহের অনামিকা আঙুলের ডায়মন্ড রিংটা খুব নিখুঁত ভাবে পরখ করছে।গোল্ড হোয়াইট গোল্ড কম্বিনেশনে ডায়মন্ড রিং।মাঝবরাবর বড় এক ডায়মন্ড তার চারপাশে ছোট ছোট ডায়মন্ড গুলো চকচক করছে।চমৎকার একটা রিং।সেহেরের আংটিটা ভীষণ পছন্দ হয়েছে কিন্তু চিন্তার বিষয় হলো আংটিটা তার হাতে আসলো কি করে? কাল রাতে ঘুমানোর আগ অবধি তো এটা ছিলো না! তাহলে সকালে হুট করে কোথা থেকে আসলো? ঘুমের ঘোরে আরহাম দিয়েছে কি? কিন্তু কেন?
একবার ভাবল আরহাম থেকে জিগ্যেস করবে কিন্তু পরক্ষণে মত ঘুরায়।আরহাম থেকে সোজাসুজি ভাবে কোন উত্তর পাওয়া অসম্ভব ।আংটিটা দিয়ে থাকলেও কোন দিন মুখ খুলে সত্যিটা জাহির করবে না। উল্টো নাকে দড়ি লাগিয়ে সেহেরকে কথার প্যাঁচে ফেলবে । এসব ভাবতে ভাবতে সেহের বারান্দা থেকে ভ্রু কুঞ্চিত করে রুমের দিকে তাকাল।আরহাম জানালার পাশে রকিং চেয়ারে বসে।হাতে ইংলিশ নভেল ‘The longest ride’। খুব গভীর মন দিয়ে বইটা পড়ছে।সেহের একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয়।বাড়ীর প্রত্যেকে এখনো গভীর নিদ্রামগ্ন।এই কয়েক দিনের ধকল ক্লান্তি এক রাতে ঘুমিয়ে কাটে কি? যে যার যার রুমে বিশ্রামরত । শুধু মাঝে একবার দুপুরের দিকে লাঞ্চের জন্য জেগেছিল ।তারপর পুরোদিন আবারো ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে।
সেহের চেয়ার ছেড়ে শক্ত ভাবে রেলিং ধরে দাঁড়ায়। অদূর আকাশের পানে তাকিয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নেয়।সূর্যটা ধীরেধীরে পশ্চিমা আকাশে ঢলে পড়ছে।বাতাসে মৃদু মৃদু উষ্ণতা ছড়িয়ে।চারপাশ আস্তে আস্তে আবছা হয়ে আসছে ।আলোর প্রখরতা ধীরেধীরে কমে যাচ্ছে। আকাশটা কেমন গোমড়া সেজে। লাল হলুদের মাঝামাঝি অনেকটা কমলা রাঙা হয়ে আছে।চারদিকে তীক্ষ্ণ কমলা আলো ছড়িয়ে।যেন দিনের আলো হাত উঁচু করে বিদায় জানাচ্ছে। ছাড়াছাড়া মেঘ গুলো ভেসে বেড়াচ্ছে ।রঙ নিয়ে এমন নিখুঁত খেলা কেবল প্রকৃতি- ই খেলতে পারে।অন্য কারো সাধ্যি কই?
হানি অরেঞ্জ শাড়ির আঁচলটা এলোমেলো বাতাসে উড়ছে ।কেশবতীর মেঘবরণ লতানো কেশ মাতাল বাতাসের হেলে দুলে নাচছে।সূর্যের কমলা আলো গায়ে মাখিয়ে অদূর আকাশের পানে তাকিয়ে।দুধেআলতা গায়ের রঙে সূর্যের কমলা রঙ মিশে স্বর্নের মত চকচক করছে। পৃথিবীর অদ্ভুত মোহিত সুন্দরী মেয়েটা যেন আরহামের চোখের সামনে দাড়িয়ে ।মেয়েটা কি সত্যি এতোটা সুন্দর নাকি শুধুমাত্র আরহামের চোখেই তাকে এতো বেশি সুন্দর লাগে?
আরহাম বইয়ের আড়াল থেকে গভীর মনে নিজেকে প্রশ্ন করে।,”তুমি আকাশের বুকেতে বিশালতার উপমা ,তুমি আমার চোখেতে সরলতার প্রতিমা ”
ফিসফিস আওয়াজে গানের দু’লাইন গায়।মৃদু হেসে চোখ ফিরিয়ে নেয়। মেয়েটার দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না।মেয়েটার মাঝে কিছু একটা আছে যা অত্যন্ত নেশালো অন্যরকম মাদকীয়।আরহামকে সেউ জিনিসটা খুব টানে গভীর ভাবে নিজের মায়াজালে জড়িয়ে নেয়।
হুট করে আরহাম প্রচণ্ড মাথা ব্যথা অনুভব করে।ধীরেধীরে শরীরটা কেমন জানো অবশ হয়ে আসছে।শরীর থেকে আত্মা আলাদা হয়ে যাচ্ছে। নিজের শরীরের উপর তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই।অদ্ভুত এক পীড়া হচ্ছে মাথায়।তার শরীরটা যেন অন্যকেউ নিয়ন্ত্রণ করছে।মুহূর্তে- ই আরহাম ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাড়ায়।লালসার চোখে সেহেরের দিকে তাকায়।আরহামের ভেতর দ্বিতীয় সত্তা জেগেছে ।ধীরেধীরে এক পা এক পা করে সে সেহেরের দিকে এগিয়ে যায়।সেহের তখনো গভীর ভাবনায় ডুবে ।আকাশের বিশালতা মাপার ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে ।এমন সময় পেছন থেকে শাড়ীর ভাঁজের ভেতরে কারো শীতল স্পর্শ অনুভব করে।সাথে সাথে সেহেরের ঠোঁটের কোণায় লেগে থাকা মিষ্টি হাসিটা গায়েব হয়ে যায়।ভীতু উত্তেজনায় শরীর কেঁপে উঠে।পেছনে ফিরে তাকানোর মত সাধ্যি নেই। পেছনের মানুষটা খুব শক্ত ভাবে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে।গায়ের ঘ্রাণ তীব্র ভাবে জানান দিচ্ছে এটা আরহাম।সেহের কান্নারত চাপা আওয়াজে বলে,”আপনি কি করছেন ,ছাড়ুন আমাকে। ”
সেহেরের আকুতিতে আরহাম কর্ণপাত করল না। শক্তভাবে সেহেরের সমতল মসৃণ পেট চেপে ধরল।স্পর্শে সেহেরের গা কেঁপে উঠে। স্পর্শটা কেমন জানো লালসা মেশানো।কেন জানো মনে হচ্ছিল এটা আরহাম না অন্য কেউ।অন্যকেউ আরহামের মুখোশে তার সামনে দাড়িয়ে।আচমকা আরহাম চুল সরিয়ে সেহেরের পিঠে এলোমেলো ভাবে চুমু দিতে লাগে।ধীরে ধীরে সেই স্পর্শ কামড়ে পরিণত হচ্ছে ।সেহের ব্যথায় চিৎকার করে কান্না ভরা আকুতি করছে।কিন্তু সেহেরের গলা ফাটানো চিৎকার আরহামের কান অবধি পৌঁছয় না। উল্টো জোরপূর্বক কোলে তুলে বিছানার দিকে অগ্রসর হয়।সেহের হাতপা ছুঁড়াছুঁড়ি করছে।কিন্তু আরহামের শক্তির সাথে কিছুতে পেরে উঠতে পারছে না।আরহাম সেহেরকে বিছানায় ফেলে হাত আটকে ধরে।সেহেরের ঘাড়ে মুখ ডুবায়।সেহেরের গাল বেয়ে অঝোর ধারায় পানি ঝরছে। চিৎকারে ঘরের দেয়াল গুলো কাঁপছে ।হ্ঠাৎ আরহাম মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে। সেহেরকে ছেড়ে উঠে বসে।সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করে ।সেহের বিছানায় উপুড় হয়ে কান্না করছে।সেহেরের কান্নায় তার ধ্যান ফিরে।সে সেহেরের সাথে কি করতে যাচ্ছিল? কি করতে যাচ্ছিল! খানিক আগে ঘটে যাওয়া কোন কিছু তার মনে পরছে না।পুরো মাথা খালি খালি লাগছে।কি এমন ঘটেছিল?
সেহেরের দিকে খেয়াল করতে দেখল সেহের এলোমেলো ভাবে বিছানায় পড়ে।বুকের উপর শাড়ীর আঁচলটা বিছানায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে।ঘাড়ে গলায় কালচে দাগ ।মুহূর্তেই আরহামের মাথা তড়াক করে উঠে।সে কি নিজের অজান্তে সেহেরের সাথে জোরজবরদস্তি করছিল? মুহূর্তেই নিজের প্রতি প্রখর ঘৃণা জন্মালো।সেহেরের দিকে হাত বাড়াতে সেহের দূরে সরে চিৎকার করে বলে,”আপনার এই নোংরা হাতে ছুঁবেন না । ঘৃণা করি আপনাকে।ছিঃ এতো নিকৃষ্ট আপনি! এতো শরীরে চাহিদা আপনার। তাহলে আগে বললেই পারতেন । আমি নিজের থেকেই….কাল রাতে ভালো মানুষের মুখোশ পরার কি দরকার ছিল? সত্যি বলতে আপনাদের মত রাজনীতিবিদের মুখের কথার কোন দাম দেই।ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। চরিত্রটাও গিরগিটির মত রঙ পাল্টায় ।ছিঃ ”
সেহের আর কিছু বলতে পারে না। কান্নায় ভেঙে পড়ে।এই মুহূর্তে আরহামের নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। শরীরের প্রত্যেকটা শিরা যদি কুচি কুচি করে কাটতে পারতো তাহলে হয়তো শান্তি মিলত । আরহাম একবার হাত বাড়িয়েও গুটিয়ে নেয়।তড়াক করে বিছানা ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ।ধীরে ধীরে পৃথিবী অন্ধকারে ডেকে যাচ্ছে।কুচকুচে কালো অন্ধকার রুমটা থেকে চাপা কান্না ভেসে আসছে।আরহাম ভীতু পায়ে রুমে প্রবেশ করে।ড্রিম লাইটটা জ্বালাতে অন্ধকারে ঘরটায় কোমল আলো ছড়িয়ে পড়ে।আবছা আলো ছায়ার খেলায় বিছানায় সেহেরের প্রতিমূর্তি ভেসে উঠে।এখনো আগের ভঙ্গীতে শুয়ে । ডুকরে কান্নার আওয়াজটা ঐদিক থেকে ভেসে আসছে।আরহাম লজ্জিত চোখে সেহেরের দিকে তাকায়।সেহেরের সামনে কি মুখ নিয়ে যাবে? কি বলবে ,যে সব তার অজান্তে হয়েছে? সেই সময়টায় যা ঘটেছে তার কোন কিছু মনে নেই! সেহের মানবে? নাকি মিথ্যা ছলনা ভেবে উড়িয়ে দিবে ।
অনেক সময় চিন্তাভাবনার পর আরহাম বিছানার দিকে পা বাড়ায়।সেহেরের পাশে বসে তার দিকে হাত বাড়িয়ে গুটিয়ে নেয়।সেহের আরহামের উপস্থীতি রুমে ঢোকার সাথে সাথে টের পেয়েছে ।আরহামের কাছে আসায় সেহেরের মাঝে কোন পরিবর্তন ঘটল না।আগের মত একই ভঙ্গিমায় বিছানায় পরে।আবছা আলোয় সেহেরের কান্নামাখা মুখ দেখে আরহাম কেঁপে উঠে।গলা ঘাড়ের দাগ গুলো অন্ধকারেও স্পষ্ট ফুটে।আরহাম ফাস্ট এইড বক্স এনে সেহেরের দিকে এগিয়ে নিচু স্বরে বলে,”দাগ গুলোতে মেডিসিন লাগিয়ে নেও ”
সেহের আরহামের কথা কানে তুলল না।আরহাম বেশ কিছুক্ষণ প্রত্যুত্তরের আশায় থাকল।সেহেরের কোন গতি না দেখে নিজের বিছানা থেকে টেনে তুলে।শাড়ির আঁচলটা গায়ে জড়িয়ে দেয়।আলতো হাতে গলায় ঘাড়ের কালচে দাগ গুলোতে মেডিসিন লাগিয়ে দেয়।ঔষধের তেজে চোট গুলো পুড়ে উঠে।সেহের চোখ বন্ধ করে ঠোঁট চেপে ‘আহ’আর্তনাদ করে উঠে।আরহাম সেহেরের দিকে আহত চোখে তাকিয়ে থাকে।সেহেরের প্রত্যেক আঘাত আরহামের বুকে যেয়ে বিঁধছে ।সেহের উঠে যেতে নিলে আরহাম পেছন থেকে শক্ত করে চেপে ধরে ভারী স্বরে বলে,” সরি ,আ’ম সো সরি।”
গালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে নাক ঘষতে ঘষতে বলে।সেহের সামনের দিকে পা বাড়াল না ।চুপ করে বসে রইলো। কেন জানো উঠে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না। আরহাম সেহেরের গালে ঠোঁট ছোঁয়াচ্ছে অনবরত আহত স্বরে সরি বলছে।সেহেরের মায়া হলো।ভীষণ মায়া ।অগোছালো আরহামের রক্তে ভেজা হাতটা দেখে সেহের কেঁপে উঠে।আরহাম কি নিজেকে শাস্তি দিয়েছে? জড়সড় বিস্মিত চোখে আরহামের দিকে মুখ তুলে তাকাল।আরহাম তখন গভীর নেশায় ডুবে।কিন্তু সেহেরের এবার ভয় হলো না।মনকে অদ্ভুত শান্তিতে ভরে দিচ্ছে।খানিক আগে মনের অন্তঃক্ষত গুলো ধীরেধীরে কোথাও যেন মিশে যাচ্ছে।কেন এমন হচ্ছে? আরহামের প্রেমময় ঔষধি তে কি?
কে কেমন প্রেম ? কখনো মধু কখনো বিষ …..
চলবে….❣️❣️❣️
প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন ।ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন 😊😊😊।