সুখের সন্ধানে পর্ব ৭

0
720

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৭

– তোমার স্বামী তিন তিনটে বিয়ে করেছে তারপরও তুমি তাকে ঘরে জায়গা দাও?

– জায়গা দেবো না কী করব আপা? তিন তিনডা ছাওয়াল পাওয়াল। এইগুলারে বাপের ছায়া থাইকা কতক্ষণ দূরে রাখব?

– তুমি তো তোমার স্বামীর প্রথম বউ, তাই না?

– জি। আমারই বিয়া হইছিল পরথম তার সাথে। গ্রামের হুজুর ডাইকা একশ মানুষ খাওয়াইয়া আমারে বড় শখ কইরা উনার হাতে তুইলা দিছিল আব্বা। ঘরের ছোড মাইয়া আমি। আব্বার বড় আদরের ছিলাম। আব্বাও মরল আর আমার কপালও পোড়ল। বিয়ার পরে দুই বছর আমরা গ্যারামেই ছিলাম। নদী ভাঙ্গনে যখন সব শ্যাষ কিছুই আর নাই তখন ঢাকা শহরে আসলাম। ঢাকা শহরে আইসা গতর খাইটা দুইডা পয়সার মুখ দেখছি ঠিকই কিন্তু সেই গ্যারামের মত সুখটা আর পাই না। উনি যেন কেমন কেমন হইয়া গেল।
বড় মাইয়াডা হওনের কিছুদিন পর হইতেই তার এই তামশা শুরু হয়। হঠাৎ কইরা কিছুদিন ধরে নিরুদ্দেশ। আমরা তো সবাই হন্য হইয়া তারে খুঁজি। কোনো খানে তার খোঁজ নাই। কী যে কষ্ট কইরা চাইয়া চিন্তা আমি আমার গেন্দা মাইয়া লইয়া পেটটা চালাইছি সেই কথা মনে পড়লে এহনো দরদর কইরা চোউখ দিয়া পানি আসে। মাইয়ার বয়স যখন এক বছর তখন উনার খবর পাওয়া যায়। শুনি নতুন কইরা আবার সংসার পাতছে। ঢাকা শহর ছাইড়া চট্টগ্রামে থাকে বউ লইয়া।
আমি সেই কোলের মাইয়া লইয়া চট্টগ্রামে যাই। হাত পাও ধইরা কাইন্দা কাইটা কই ঢাকায় ফেরত আসতে। ওনার বউয়ের সহ আমি ঢাকায় লইয়া আসি।

– তুমি তোমার সতীনকে মেনে নিয়েছিলে? তোমার স্বামীকে কিছু বললে না?

– কী বলব? বললে কিছু তো হবে না। উলটা আমারে আর আমার মাইয়ারে থুইয়া আবার চইলা যাবে। সতীন লইয়া সংসারের জ্বালা যে কী হাড়ে হাড়ে টের পাইছি একটা বচ্ছর। বেডি ঘরের কোনো কাজকর্ম করবে না। গার্মেন্টসে কাম করত। নিজে পয়সা গোছাইত। সংসারে সারাদিন আমি খাটতাম আবার মাইনষের বাসায়ও কাম করতাম। আর নবাবজাদী রান্ধা খাওন খাইয়া আমার চোউখের সামনে আমার স্বামীরে লইয়া আলেদা বিছানে থাকত। আমি মাইয়াডা লইয়া আলেদা বিছানে খাটের উপ্রে থাকতাম। সেরা নিচে। আমার সাথে কোনোসময় বেডি ভালো মুহে কতা কইত না। এইয়া কিচ্ছু নালিশ করলে মাইয়ার বাপ তারে আলেদা বাসা লইয়া থাকনের হুমকি ধামকি দিত। আমার গায়ে হাত তুলত। সবাই আমারে কইত এমন সংসারে লাত্থি মাইরা আলাদা হইয়া যাইতে। কিন্তু আমি পারি নাই। মাইয়াডার দিক তাকায়া আমি কিছুই পারি নাই। সব অত্যাচার সহ্য করছি।

– তোমার সেই সতীন এখন কই?

– শয়তান মহিলা নিজেই বিদায় হইছে। গার্মেন্টসের আরেক বেডার লগে প্রেম পিরিতি কইরা ভাইগা গেছে।
বউয়ের শোকে আমার জামাইয়ের কত দুঃখ! কতদিন তামাত তার নাওয়া-খাওয়া কাজকর্ম সব বন্ধ হইয়া গেছিল। আমি খালি দেখতাম আর হাসতাম। হেতেও সে আমার দোষ বাইর করত। কইতো আমার অত্যাচারে নাকি তার পিরিতের বউ এই ঘর ছাইড়া গেছে।
তারপর ধীরে ধীরে বউয়ের শোক ভুলছে, সংসারে মনোযোগী হইছে। এরপর ছোড মাইডার জন্ম হইলো।
এরপর পোলাডা হইল। ততদিন উনি ভালোই ছিল।
হঠাৎ আবার কি হইছে কয়দিন আগে শুনি সে নাকি অন্য জায়গার আরেক খান বিয়া করছে। আমি আর পরথম বারের মত এইবার অবিশ্বাসও করিনাই। আর খোঁচাখুঁচিও করতে যাই নাই। যা করে করুক গা। বিয়া সে করতে পারে। আগের মত ঠিকঠাক ঘরে আসে না এখন আর। মাঝেমধ্যেই দুইদিন তিনদিন গায়েব অইয়া যায়। আমার ও নিয়া আর মাথা ব্যথা নাই। বিয়া করুক, নিকাহ করুক যা খুশি কইরা বেড়াক।

– তোমার স্বামী তো এখনো মাঝে মাঝে আসে। জিজ্ঞেস করো না তারে?

– আফা, যার এক কান কাডে হে ঢাইকা চলে। আর যার দুই কানই কাডে হে উদাম কইরা চলে। ওই ব্যাডার তো দুই কানই কাডা। লাজ-লজ্জা কিছু তো নাই। জিগাইলে যেসব ভন্ড দিয়া দিয়া উত্তর দেয় এই জন্য জিগাই না এহন আর। ভালো লাগে না। আমি এহন কামাইতে পারি। খাওন পরন না দিলে না দিক গা। মাইয়া পোলা লইয়া মরব না আল্লার দোয়ায়।

– আরেক জায়গায় যদি বিয়েই করে তাইলে তোমার কাছে আবার আসে কেন? আর তুমিই বা অ্যালাউ করো কেন? নিজে ইনকাম করো। স্বাধীন ভাবে জীবন যাপন করবে। এই সমস্ত মানুষের সাথে থাকার কোন মানেই হয়না।

– আসে মাইয়া-পোলার টানে। লোকটা আমার সাথে যেমন ব্যবহারই করুক মাইয়া-পোলারে আবার খুব ভালো পায়। ওরাও বাপ ছাড়া কিছু বোঝে না। আফা, যতই কামাই রোজগার করি পোলাপানের মুখে খাবার তুইলা দিতে পারব কিন্তু আমি ওগো বাপের আদর তো দিতে পারব না।

– এই সমস্ত ভুয়া কথা কই পাইছ? যে পুরুষ নিজের স্ত্রীর সন্তান রেখে আবার একটার পর একটা বিয়ে করতে পারে সে তার স্ত্রীকেও ভালোবাসে না, সন্তানদের কেও ভালোবাসে না। তুমি তোমার বাচ্চাদের বোঝাও। ওরা যখন বাবার চরিত্র সম্পর্কে জানবে তখন নিজে থেকেই বাবার থেকে দূর হয়ে যাবে।

– না, আফা। লোকটা মাইয়া পোলারে খুব ভালো পায়। এইডা তো আমি জানি। এইডা মিছা কতা না। হয়তো আমারই কপাল খারাপ। দেখতে শুনতে হয়তো ভালা না। যে কারণে আমার দিক তার এখন নজর আসে না। ওরা বাপছাড়া হোউক আমি কোনোদিনও চাই না। তাছাড়া উনি যাই করুক আমি তো উনারে ভালো পাই।

– এ সমস্ত ভুয়া কথা বাদ দাও তো! রাগে গায়ে জ্বালা ধরে খুব। এই যে তোমার ভাগ্য খারাপ এসব কথা বলোনা একদম! ভাগ্য খারাপ তো ওনার। তোমার মতো বউ রেখে আবার বিয়ে করে। চৌদ্দটা বিয়ে করা পুরুষ মানুষের কোন ভাগ্য আছে নাকি ? এ তোমার আর তোমার সন্তানদের ভালোবাসার যোগ্য না। তুমি যদি বল তোমার স্বামীকে পুলিশে ধরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করি। তাহলে বিয়ের সাধ একদম মিটে যাবে।

– ছি, ছি, আপা। একি সর্বনাশে কথাবার্তা বলেন? উনার আমি পুলিশে দেবো কেন? উনি আমার বাচ্চাকাচ্চার বাপ, আমার স্বামী। উনারে জেলহাজতে পাঠাইয়া আমি এই পোলাপানের কাছে কী জবাব দিব?
উনি আমার কদর একদিন ঠিকই বুঝব।আমি সেই দিনের আশায় আছি। মানুষ মাত্রই ভুল করে । মানুষ তো আর ফেরেশতা না। দোষে গুণে মানুষ। উনি উনার দোষ নিশ্চয়ই একদিন বোঝবে। উনারে কোন বিপদে ফেলার আগে আমি দশবার ভাবি আমার পোলাপানের কথা। তাই আমার বিশ্বাস একদিন না একদিন সে ঠিকই বুঝব।

– হ্যাঁ, সেই আশাতেই থাকো। তোমার মরার পরে উনি ঠিকই বুঝবে। ওই একই রকমের কাজ যদি তুমি করতা তাহলে কি তোমার স্বামী তোমারে ঘরে তুলত?

– আমি ওই কাজ করতে যাব ক্যান? জন্মের পর হইতেই দেখে আসতেছি মাইয়া মানুষের সবকিছুতেই দোষ। জোরে হাসা যাবে না, জোরে কাশা যাবে না জোরে কথা বলা যাবে না, আরো কত কত নিয়ম আমাগোর জন্য। আর পুরুষ ছাওয়ালের কোন নিয়ম নাই। এরা এগো ইচ্ছামত চলবে কোন সমস্যা হয় না তখন। আমার স্বামী তিন চারটে বিয়া করতেই পারে আমার তো সেইসব করার অধিকার নাই। আমাগো ধর্মেও নাই। নাউজুবিল্লাহ।
উনি নিজের ভুল বোঝবেই। আমি ধৈর্য ধরব।

– বুঝতে পেরেছি। পতিব্রতা পত্নী তুমি। এখন কি করবে ভাবছ?

– ওনার মন জয় করার চেষ্টা করব যাতে উনি আমারে আর ছাইড়া না যায়। আমি যদি উনারে ছাইড়া যাই তাইলে পরে তো সাহস আরো বাইড়া যাবে। ইচ্ছামতো আকাম কুকাম করব। এখন তো কিছুডা লুকাই চাপাই রাহে। তখন একদম উদাম হইয়া যাবে। আমি উনার ধারে থাইকা, পাশে থাইকা মন জয় করতে চাই।

– সেটাই করতে থাকো। এত বছরে পারলা না। এখন কী করবা তুমি জানো। দেখো কোন ফলাফল যদি মিলে।

রহিমা বিবি আর মমতাজ আপার কথোপকথনগুলো আমি এত সময় ধরে শুধু শুনেই গিয়েছিলাম। ভাবছি আমাদের দেশের মেয়েদের কথা, মায়েদের কথা! যারা সন্তানের একটু সুখের জন্য দিনের পর দিন যুগের পর যুগ এমন অত্যাচার সহ্য করে যাচ্ছে।

রাতে আর ভালো ঘুম হল না। ভাবনায় রাত পার হলো। শুধু রহিমা বিবির কথাগুলো কানে বাজছিল। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই ড্রাইভারকে ফোন দিলাম। ড্রাইভারকে পরেরদিন আসতে বললাম।

আমি নাস্তা শেষ করেই ঢাকা সিলেট এয়ার টিকেট করে ফেললাম। আমিও হারতে চাই না। অধিকারের জন্য লড়তে হবে। এত সহজে এতদিনের অধিকার ছেড়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করার মতো এখনো কিছুই হয়নি। রহিমা বিবি, মালিহা ঠিকই বলেছে নিজের অধিকার, নিজের জায়গা নিজেরই করে নিতে হয়, করে নেয়া জানতে হয়।
এই বস্তিতে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে জীবনবোধের ধারণা দিয়েছে, চোখ খুলে দিয়েছে। সমাজের উঁচুতলার মানুষের মাঝে এই শিক্ষা বিলিয়ে দেয়াটা খুব জরুরী। বিলকিস বানু, রহিমা আপা, আদরি সবার কাছে অনেক অনেক শিক্ষা নিলাম। এদের প্রতি কৃতজ্ঞতা অসীম।

চলবে……

পর্ব-৬
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/338448007937875/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here