সুখের সন্ধানে পর্ব ১৬

0
692

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_১৬

রাতে আর কথা হলো না সেলিমের সাথে। সকাল বেলা উঠে দেখলাম মুখ গম্ভীর করে বসে আছে সে । আমিও আগ বাড়িয়ে তেমন কথা বলতে যাইনি। দেখলাম প্রিয়র মুখ খানাও থমথমে ভাব। হবারই কথা । ছেলেটার মনের উপর দিয়ে গতকাল থেকে কী যে বয়ে যাচ্ছে সে তো আমি ঠিকই বুঝতে পারছি।

– খুব মন খারাপ বাবা ? তোমার মন খারাপ করে আর কী হবে? ভাগ্যে যা আছে তাই হবে। তুমি এখন তো আর ছোট নও।

– প্রিয় নিশ্চুপ!

– আমি একটা বিয়ের দাওয়াতে যাব ? তুমি আমার সাথে গেলে আমি খুবই খুশি হবো।

প্রিয় খানিকক্ষণ কি যেন ভেবে বলল, এই দমবন্ধ করা পরিবেশ থেকে একটু বাইরে বের হতে চাই।

– থ্যাঙ্কস বাবা । ঠিক বলেছ। বাইরে গেলে তোমার ভালোই লাগবে আশা করছি।

গাড়িতে চুপচাপ বসে আছি আমরা দুজন। হঠাৎ প্রিয় বলল আমরা কার বিয়েতে যাচ্ছি আম্মু? কিছুই তো বললে না ।

– যাই তো আগে। গেলেই দেখতে পাবে।

– আচ্ছা, আম্মু তুমি কি সত্যিই আব্বুকে ছেড়ে চলে যাবে? আমি জানি আব্বু খুব খারাপ করেছে তোমার সাথে। কিন্তু , এটাকে কী কোনোভাবে ঠিক করা সম্ভব না?

– তোমার কি মনে হয় আমি আবার বিয়ে করব?

– আমার কিছুই মনে হয় না । তবে কেন যেন একটু একটু মনে হচ্ছে আব্বু যে ভুল করেছে তুমি সেই একই ভুল করবে না কোনোমতেই।

– মন থেকে বলছ তো?

– হুম। ইস , সত্যিই যদি এমন হতো!

– কী করতে তাহলে?

– এই খুশিতে এসএসসি দিয়েই তোমাদের কাছে চলে আসতাম! আর কোনোদিনই দূরে থাকার চিন্তাও করতাম না।

– লক্ষী ছেলে হয়ে যাচ্ছ একদম।

শুক্রবার হওয়াতে সেলিম আজ আর অফিসে যায়নি । বাইরে কোথাও বেরুতেও মন চাচ্ছে না তার। কিছুই কেন যেন ভালো লাগছে না । নিজেকে নিজে জিজ্ঞেস করছে এত মন খারাপ কেন তার! কিন্তু কোনো সদুত্তর মিলছে না নিজের কাছে। একবার মনে হচ্ছে হেলেনের জন্যই বুঝি তার মন খারাপ। হেলেনের কথা মাথায় আসতেই তার মনে হলো হেলেনের ব্যাপারে সব খবর তবে রূম্পা আগে থেকেই জানে। সে জেনে বুঝেই হেলেনকে অফিস থেকে বের করেছে সেদিন। যা করেছিল অবশ্য ভালোই করেছিল রূম্পা। হেলেনের মতো একটা মেয়েকে ভেবে আর সময় নষ্ট করতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার । একটা নষ্টা আর ক্যারেক্টারলেস মেয়ে। মুহূর্তেই রূপ বদল করতে পারে এ ধরণের মেয়েরা। এরা খুবই বিপদজনক হয়। হেলেন বিদায় হয়ে বরং ভালোই হয়েছে। তাহলে তার মন খারাপ কেনো? রূম্পা বিয়ে করছে এজন্য?
রুম্পার সাথে তার সম্পর্ক স্বাভাবিক না বহু বছর। এ আর নতুন কী? যে রুম্পাকে ভালোবেসে বিয়ে করার জন্য কতটা উদগ্রীব ছিল। তার মায়ের সাথে রুম্পাকে এ বাড়ির বউ করে আনার জন্য কত যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে। অথচ সেই রূম্পা আর তার মাঝে এখন বিশাল এক অদৃশ্য দেয়াল। এই দেয়াল একদিনে উঠেনি। ধীরে ধীরে একটু একটু করে বেড়ে উঠেছে। তার এক সময়ের প্রেয়সী , তার অপ্সরা স্ত্রী রূম্পা এখন শুধুমাত্র তার কাছে তার সন্তান প্রিয়র মা পরিচয়টুকুই বহন করছে। সেটা তো রূম্পা পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে চলে গেলেও থাকবে। তাহলে রুম্পার জন্যই বা তার মন খারাপ হবে কেন? কিছুই বুঝতে পারছে না সেলিম। মাথাটা প্রচণ্ড ধরেছে। বাবুর্চী আলমকে ডেকে তার মাথাটা মাসাজ করালো খানিক সময়। তাও কোনো কাজ হচ্ছে না।

আমার গাড়ি থামল একটা মন্দিরের সামনে।

– এখানে কেন আম্মু? তুমি না বললে বিয়েতে যাচ্ছি আমরা।

– হুম। বিয়েতেই এসেছি। এখানেই বিয়ে। খুবই সিম্পল আয়োজনে বিয়ে। এখান থেকে বিয়ে সেরে কোর্টে রেজিস্ট্রেশান করে পরে একটা রেস্টুরেন্টে সবাই মিলে লাঞ্চ করব। সব মিলিয়ে বিশ বাইশ জন মানুষের আয়োজন।

– বেশ ইন্ট্রেস্টিং তো! কার বিয়ে তা তো বললে না?

– আমার এক ফ্রেন্ড! এই তো এসে গেছি। মাত্র দু’চার মিনিট । গেলেই দেখতে পাবে।

আমি ঢুকতেই সিদ্ধার্থ আর মোনা এগিয়ে এলো। মোনা তো পারলে উপুর হয়ে আমাকে প্রণাম করে। আমিই তাড়াতাড়ি ওকে হাত দিয়ে আটকালাম।

– ধূর পাগলি! করছো কী? আমাকে প্রণাম করছো কেনো?

– আপনি আমার দিদিভাই। আপনাকে প্রণাম না করলে তো কাকে করবো বলুন?

– কী যে বলছো না? তোমাকে কিন্তু বউয়ের সাজে দারুণ লাগছে!

– তা তো লাগতেই হবে। সবকিছু যে আমার দিদিভাইয়ের পছন্দে কেনা। আপনার উপর পূর্ণ আস্থা ছিল বলেই আমি কেনাকাটাতে যাইনি।

– খুব ভালো লাগছে জেনে। খুব ভালো থেকো বোন। আমার বন্ধুটি কিন্তু খুব পাগলা ধরণের। দেখেশুনে রেখো। খুব অল্প সময় ওর সাথে পরিচয় হলেও ওর স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে মোটামুটি আমি অভিজ্ঞ।

– হা হা হা। বেশি পাগলামী করলে আপনাকে খবর পাঠিয়ে দিব। আপনি সাইজ করে দিবেন।

– ওহ, কথা বলতে বলতে তোমাদের সাথে পরিচয়ই করিয়ে দেইনি। আমার একমাত্র ছেলে, আমার কলিজা , প্রিয়। আর প্রিয়, এই হচ্ছে আমার ফ্রেন্ড সিদ্ধার্থ আর ও মোনা। মোনা একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটতে বায়োলজীর লেকচারার হিসেবে আছে। আমরা এদের বিয়েতেই আসছি।

সিদ্ধার্থ নামটা শোনার সাথে সাথেই প্রিয়র মনের মধ্যে যে কী হতে পারে এই মুহূর্তে সেটা আমার থেকে ভালো আর কেই বা বুঝবে? আমি প্রিয়কে এই চমকটা দেবার জন্যই সত্যটা এতসময় বলিনি। প্রিয়র চোখেমুখে যে দীপ্তি খেলে যাচ্ছে সেটা স্পষ্ট। কেউ না বুঝলেও আমি ঠিকই দেখতে পাচ্ছি।

সিদ্ধার্থ এগিয়ে এসে প্রিয়কে জড়িয়ে ধরল।

– হেই, ইয়ংম্যান! তোমার গল্প শুনতে শুনতে এতদিনে তোমার মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি। যাক, ফাইনালি তবে দেখা হলো আমাদের। তোমার আম্মুর সাথে গল্পে বসলে তিন ভাগের দুই ভাগ সময় জুড়েই থাকে তোমার গল্প। তুমি নাকি দেখতে তোমার আব্বুর মতো হয়েছ, এটাই সবসময় তোমার আম্মু বলে এসেছে। কিন্তু আমি তো দেখছি উলটো। হয়ত তোমার আব্বুকে খুব বেশি ভালোবাসে তাই তার ছাপ খুঁজে পায় তোমার মধ্যে। তুমি তো মায়ের চেহারা পেয়েছ একদম। সুদর্শন আর ড্যাশিং! যেমন মা আর তেমন তার ছেলে। অবশ্য ছেলেদের চেহারা মায়ের মতো হলেই লাক ভালো হয় বলে একটা কথা আছে।

প্রিয় কিছুটা লজ্জাবনত চোখে সিদ্ধার্থের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার মত সুন্দর মানুষের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে সত্যিই খুব ভালো লাগছে , আংকেল। আমিও আপনার অনেক গল্প শুনেছি আম্মুর কাছে। দেখা হয়ে মনে হলো আপনি সত্যিই খুব ভালো মানুষ।

– হতেই হবে। দেখতে হবে না বন্ধু কার! আফটার অল, আমার বন্ধু বলে কথা! হা হা হা ! আচ্ছা , পরিচয় পর্ব তো শেষ হলো। এবার বলো বিয়ের কতদূর?

– এই তো ! সবাই অলরেডি এসে পড়েছে। শুধু তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম । এবার শুরু করা যায়।

– তবে আর দেরি কেনো?

সিদ্ধার্থ আর মোনার বিয়ের রীতি রেওয়াজ চলছে । আমরা একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখছি। প্রিয় আমার পাশেই দাঁড়ানো। হঠাৎ সে আমার ডান হাতটা শক্ত করে তার হাতের মধ্যে চেপে ধরল। ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখজোড়া সিক্ত।

– কি রে কাঁদছ কেনো?

– আমার বিশ্বাসের জয় হয়েছে, আম্মু। আল্লাহকে ধন্যবাদ, তোমাকে ধন্যবাদ। আমি জানতাম আমার আম্মু এমন করতেই পারে না। কিন্তু , আব্বু যে বলল।

– জানি অনেক প্রশ্ন তোমার মাথায়। সংক্ষেপে বলছি শোনো।

এই যে মোনা মেয়েটাকে দেখছ না! মেয়েটা বড় অভাগী। ওর কাছেই বসা ছোট মেয়েটা মোনার। ওর বিয়ের পরের বছরই ওর মেয়ে তৃষ্ণার জন্ম। ও এখন যে ইউনিভার্সিটিতে পড়ায় সেখানেরই একজন প্রফেসর ছিলেন ওর স্বামী। ওর স্বামী মেয়েটার জন্মের দু’বছর তখন স্ট্রোক করে মারা যান। মোনা তখন মাত্র পড়াশুনা শেষ করেছে। শশুরবাড়ির লোকজন কিছুদিনের মধ্যেই তাদের আসল চেহারা দেখানো শুরু করে। মোনা এবং ওর মেয়ের দায়িত্ব নিতে কেউ রাজী নয়। বাধ্য হয়ে মেয়েকে নিয়ে খালি হাতে বাপের বাড়িতে চলে আসে । মোনার বাবা মা বেঁচে নেই। ভাইয়ের সংসারে একেবারে আশ্রিতা হয়ে থাকতে লাগল মেয়েকে নিয়ে। হিন্দু ধর্মে বাবার সম্পত্তিতে মেয়েদের যে কোনো কানাকড়িও পাওনা থাকে না সে তো জানোই। অনেক স্ট্রাগল করে মেয়েটা দু’বছর ঘুরে এই মাস ছ’য়েক আগে ওই জবটা পায়। মেয়েটাকে নিয়ে একটা মোটামুটি সম্মানের জীবন যাপন করছে এখন।
এর মাঝে মাস দু’য়েক আগে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং এর কারিশমায় সিদ্ধার্থের সাথে ওর পরিচয়। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরেই এই বিয়ে। সিদ্ধার্থ দেশে এসে ওর মাসীর বাসাতে ওঠে। দেশে আসার পর সিদ্ধার্থের অনুরোধে আমি মোনার সম্পর্কে সব খোঁজখবর নেই। মোনাকে সিদ্ধার্থ সম্পর্কে সবকিছু জানাই। বলা যায় ওদের পুরো বিয়েটাই আমি এরেঞ্জ করেছি। মোনার দ্বিতীয় বিয়েটাকে কেউই সম্মতি দিচ্ছে না পরিবার থেকে। আমি মোনাকে সব ধরণের সাপোর্ট দিয়েছি । একদিকে ওর নতুন চাকরি। পরিবারের কারো সম্মতি না থাকায় ভীষণ মন খারাপ ওর। তার উপর ছোট মেয়েকে নিয়ে বিয়ের কেনাকাটাও সম্ভব ছিল না মোনার পক্ষে। তাই সব দায়িত্ব আমার উপরে দিয়ে সে নিশ্চিন্ত ছিল। এই হচ্ছে মোনা আর সিদ্ধার্থের কাহিনী। আর আমি সিদ্ধার্থের খুব ভালো বন্ধু। সেই সুবাদে সবসময় তার সাপোর্ট দিয়েছি। তোমার বাবা সেটাকে অন্য ভাবে ভেবেছে । সেটা তার নীচু মানসিকতার পরিচয়।

– সরি আম্মু! আমিও না বুঝেই তোমাকে নিয়ে অনেক উলটাপালটা ভেবেছি। খুবই খারাপ লাগছে ভাবতে।

– ধুর বোকা! খারাপ লাগার কিছুই নেই। আমি তোমার জায়গায় হলে আরো কী যে খারাপ রিয়াক্ট করতাম সে তুমি ভাবতেই পারতে না। তুমি তো যথেষ্ঠ ম্যাচিউরিটির পরিচয় দিয়েছ , বাবা। তোমাকে নিয়ে প্রাউড ফিল হচ্ছে খুব।

খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই চলে যাবার পরে আমি সিদ্ধার্থকে এক পাশে ডেকে বললাম, মেয়েটা অনেক দুঃখী। ওর বাচ্চাটাকে নিয়ে জীবনে অনেক কষ্ট করেছে। তোমার কাছে খুব রিকোয়েস্ট নিজের এই পরিবর্তিত রূপটাকে আর সেই পুরানো জীবনে ফিরিয়ে নিও না। মোনা আর তৃষ্ণাকে আপন করেই ভেব আজকের মতো করে। সময়ের সাথে সাথে যেন এই ভালোলাগা ভালোবাসা ফিকে হয়ে না যায়। আমাদের বন্ধুত্বের দাবিতে তোমার কাছে এইটুকু চাওয়া। ওকে খুব তাড়াতাড়ি তোমার কাছে নিয়ে যাবে আশা করছি। মোনাকে আর তৃষ্ণাকে করা কোনো ওয়াদাই মুছে ফেল না কোনোদিন। একটা মেয়ে তার স্বামী সম্পর্কে যতটুকু সহ্য করতে পারবে ঠিক ততটাই বলেছি আমি মোনাকে তোমার সম্পর্কে । অবশ্য এর থেকে একটু বেশিই বলেছি মনে হচ্ছে। ও সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। সে শুধু এখন জানে তুমি শুধু তার। এই জানার মাঝে কখনোই যেন কোনো ভুল বোঝাবুঝি না আসে। অনুরোধটুকু ফেলে দিও না এই ক্ষণিকের বন্ধুর, প্লিজ। স্ত্রীকে সম্মান করলে তুমিও তার কাছে সম্মানের পাত্র হয়ে থাকবে। তাই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ কী বলছি। একটা সুস্থ , সুন্দর আর স্বাভাবিক জীবনের প্রত্যাশা করছি তোমাদের।

সিদ্ধার্থ মাথা নিচু করে সব কথা শুনছে।

– কথা দিলাম। জীবনটা তো আর ক’দিনের তাই না। এতটুকু বোধ এতদিনে হয়েছে রূম্পা। আর বাঁচবই বা ক’দিন কে জানে? আমিও একটা স্বাভাবিক জীবন চাই । মোনাকে পেয়েছি, তৃষ্ণার মতো একটা ফুটফুটে মেয়ে পেয়েছি। আমি কখনোই ওদের হাত ছাড়ব না। এই তোমাকে প্রমিজ করলাম। তুমি আমাকে একটা স্বাভাবিক জীবনে ফেরার তাগিদ অনুভব করিয়েছ। এই ঋণ আমি কোনোদিনই শোধ করতে পারব না।

– কী যে বলছ বোকার মতো! আরেকটা কথা , অনেক তো হলো আমাদের দুই বন্ধুর আড্ডাবাজি। এবার একটু বউ আর মেয়ের সাথে আড্ডা দাও মন ভরে । এবার তো সাতদিনের ছুটি নিয়েছে তোমার বউ। আমিও একটু ব্যস্ত থাকব । বোঝই তো প্রিয় এসেছে এতদিন পর।

– বুঝেছি বুঝেছি। আমাকে পর করে দিচ্ছ কী?

– আরে গাধা , বলো কী! আমি কী বলি আর তুমি কী বোঝ! তোমাদের কোয়ালিটি টাইম দরকার একে অন্যকে বুঝতে। তুমি তো চলে যাবে আবার সপ্তাহ ঘুরতেই। ওর সাথে থাকাটা এই মুহূর্তে খুব জরুরি। আমি তোমাদের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হতে চাই না। আর হ্যা, সুন্দরী বউকে পেয়ে আবার আমাকে একদমই ভুলে যেও না। হা হা হা!

– তোমাকে ভোলা এ জীবনে সম্ভব না সেটা আমার মতো তুমিও ভালো করে জানো। আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি। ঠিকই বলেছ মোনা আর তৃষ্ণার সাথেই আমার থাকাটা এখন খুব প্রয়োজন । দোয়া করো জীবনটাকে যেন ওদের সাথে ঢেলে সাজাতে পারি।

– শুভকামনা সবসময়। আমার জন্যও দোয়া করো। আমিও যেন আমার জীবনটাকে সঠিক দিশায় চালাতে পারি।

– শুভকামনা আর ভালোবাসা সবসময় সাথে থাকবে, প্রিয় মানুষ।

বিদায়ের বেলায় সিদ্ধার্থের এবং আমার দু’জনের চোখ ভিজে উঠল।

সন্ধ্যার কিছু বাদেই বাসায় ফিরে দেখলাম সেলিম চুপচাপ বেডরুমে শুয়ে আছে। আমি রুমে গেয়ে চেঞ্জ করলাম কিন্তু সে আমাকে দেখেছে কি না সন্দেহ! ওকে দেখে মনে হলো খুব বেশি নিরিবিলি আর মন খারাপ হয়ত। মেইডদের কাছে শুনলাম সারাদিন কোথাও নাকি বের হয়নি। কারো সাথে কথা বলেনি তেমন। দুপুরে খাওয়া দাওয়াও করেনি। শরীরটা নাকি কিছুটা খারাপ । মাগরিবের পরপর শুধু এক কাপ চা খেয়েছে । আর কিছুই নাকি খায়নি। বুঝতে পারলাম হয়তো ওই হেলেনের কষ্টে ওর এই অবস্থা। সিদ্ধান্ত নিলাম হেলেনের ব্যাপারে সবকিছু বলে দিব। এই মিথ্যে সম্পর্ককে টেনে নেবার কোনো মানে হয় না। সে যদি ওই হেলেনকে নিয়ে ভালো থাকতে পারে আমার সেটাতেই সুখ।
ধরে বেধে ভালোবাসাহীন একটা সম্পর্ক নিয়ে এত ছলচাতুরী করে সংসার করার কোনো ইচ্ছেই আর নেই আমার।

রান্নাঘরে গেলাম সেলিমের জন্য কিছু নাস্তা বানাতে। সারাদিন না খাওয়া সে । শরীর আরো খারাপ করতে পারে। সত্যিই হয়তো ওর শরীর খারাপ। স্নাক্স টাইপের খাবার ওর বেশ পছন্দ। আমি ওর পছন্দের পাস্তা বানালাম আর এক কাপ ব্লাক কফি বানিয়ে নিয়ে ওর কাছে গেলাম।

যেয়ে দেখি সেলিম সোফার উপরে বসা। থমথমে মুখ আগের মতই। আমি নাস্তার ট্রে টেবিলের উপর রেখে বললাম , এগুলি খেয়ে নাও। সারাদিন নাকি কিছুই খাওনি? পাস্তা খেয়ে কফিটা খাও । ভালো লাগবে।

সেলিম দেখলাম বাধ্য ছেলের মতো কোনো কথা না বলেই পাস্তার বাটি থেকে দু’চামচ মুখে দিলো।

– কেমন হয়েছে? সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো?

– হুম। থ্যাংকস।

আমি আর কোনো কথা না বলে আলমারী খুলে সেখান থেকে গহনার বক্সগুলি নামিয়ে থরেথরে সাজিয়ে রাখলাম। সাথে কিছু কাগজপত্রের ফাইল ।

– কী করছ তুমি? কোথাও কি যাচ্ছ? একটু বসো । কথা আছে।

– বলো , শুনছি।

– তোমার বন্ধুর নাকি আজ বিয়ে হয়ে গেল?

– ওহ ! খোঁজখবর নিয়ে ফেলেছ?

– না , মানে প্রিয় রুমে এসেছিল খানিকক্ষণ আগে । ওই সব বলল।

– হুম, আজই বিয়ে হলো।

সেলিমের মুখে কোনো শব্দ নেই। কী বলবে হয়ত গুছিয়ে উঠতে পারছে না।

– আর কিছু কী বলবে? তোমার কথা শেষ হলে কিছু কথা বলতে চাই।

– সেলিম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, হুম ! বল।

– আসলে আমি হেলেনের ব্যাপারে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।

– -শোনার আগ্রহ নেই।

– তোমার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় জানাটা। তাই শুনতে না চাইলেও শুনতে হবে। আসলে হেলেনকে আমিই তোমার লাইফ থেকে সরাতে ঢাকা থেকে ওর গ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছি। অনেক ভয়ভীতি দিয়েছি। যে কারণে সে তোমার সাথে যোগাযোগ করছে না হয়তো। ও কোনোখানে জব টব করছে না। তোমাকে কাদের যা কিছু বলেছে সবই আমার শেখানো বুলি। প্লিজ, কাদেরকে কিছুই বলো না। ও নির্দোষ। আমিই ওকে ফোর্স করেছি। অনেকটা ব্লাকমেইলিং এর মতোই। এই রিকোয়েস্টটুকু রেখো। তুমি হেলেনের পার্মানেন্টে এড্রেসে খোঁজখবর করতে পারো। ও সেখানেই আছে আমি নিশ্চিত। আর আমি খুবই দুঃখিত বাচ্চাদের মতো এ ধরণের ব্যবহারের জন্য।

সেলিম খানিকটা অবাক হয়ে বলল, এসব কথা এখন আমাকে জানাচ্ছ কেন?

– কারণ তোমার এই করুণ দশা দেখার আমার সাধ নেই একদমই। এই বয়সে ছেলের সামনে এমন দেবদাস হয়ে থাকাটা একদমই বেমানান তোমার জন্য। তাছাড়া সার্ভেন্টরাও কানাঘুষা করছে। খানিকটা হেসে জবাব দিলাম ।

আমার ভেতরের রক্ত ক্ষরণ আমি সেলিমের সামনে প্রকাশ করতে চাই না একদমই। বীরের বেশে আমি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে চাই।

সেলিম কোনো জবাব না দিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে।

আমি গহনার বাক্সগুলি এগিয়ে দিলাম সেলিমের সামনে।

– এখানে আমার এত বছরের জমানো সব জুয়েলারী আছে। এই ব্যাগে আমার নামে যেসব প্রোপার্টি করেছ আর সেভিংস আছে তার ডকুমেন্টস সব গোছানো আছে। ব্যাংকে কিছু টাকা আছে সেটাও আমি আগামী দু’ একদিনের মধ্যে তোমার একাউণ্টে ট্রান্সফার করে দিব। আর ডেস্কের উপরে আমার ল্যাপটপ , ট্যাব সবই আছে। এই যে আমার গাড়ির চাবি।

– সেলিম নিশ্চুপ।

– আর এই বাসার কোথায় কী আছে আমি আলেয়া খালাকে বুঝিয়ে দিয়েছি। তোমার সমস্যা হবে না আশা করছি।

– এগুলি দিয়ে আমি কী করব?

– এগুলি এসেট। এসেট দিয়ে সবাই যা করে তুমিও তাই করবে।

– তোমার লাগবে না?

– নাহ, আমি মিরপুরে ভাইয়ার বাসায় চলে যাবো। ভাইয়ার সাথে কথা বলেছি। ওখানে ওই বাড়ির অর্ধেক তো আমাদের দু’বোনের । সেখানে আমার একা মানুষের বেশ চলে যাবে।

আমার ভেতরে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেটাকে চেপে রেখে খুব স্বাভাবিক আচরণ করছি সেলিমের সামনে।

– তাহলে চলেই যাচ্ছ?

– হুম!

কিছুসময় চুপচাপ থেকে সে বলল,

– যাওয়াটা কী খুব প্রয়োজন?

– আমার জন্য না হলেও তোমার জন্য খুব। তাই যেতে হচ্ছে।

– আমার জন্য কেনো?

– আমি না গেলে অন্য কেউ আসবে কী করে? একজন গেলেই তো আরেকজনের জন্য জায়গা খালি হবে। ওহ, ভেবে দেখলাম যেহেতু আমিই হেলেনকে ঢাকা থেকে রংপুরে যেতে বাধ্য করেছি তাই আমিই ওকে আবার ঢাকায় আসার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তোমার কষ্ট করতে হবে না।

– তারপর?

– তারপর আর কী ? এই রুমে স্থায়ীভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দেওয়ার দায়িত্ব তোমার । এভাবে পাপ কাজ না করে আইনগত ভাবে ওকে বৈধতা দিলেই তো হয়। প্রিয় তো বলে দিয়েছে ওর কোনো সমস্যা নেই।

– তোমারও নেই?

– উহু! আমার কীসের জন্য থাকবে? আমি অধিকার ছেড়ে দিয়েছি। যেখানে অধিকার নেই সেখানে জোর করে অধিকার ফলিয়ে নিজেকে অসম্মানিত করার মতো আর বোকামি করতে চাই না আমি।

– আমি তো অধিকার ছাড়িনি!

– হাসালে খুব। যেদিন তুমি আমার সাথে তোমার সম্পর্ককে উপেক্ষা করে ওই মেয়েকে তোমার বিছানায় নিয়েছিলে সেদিন থেকেই আমার উপর তোমার কোনো অধিকার নেই। সো, এসব বলো না তো! খুব হাসি পায়।

– সেলিম নিশ্চুপ।

ভেবেছিলাম কিছুই বলব না। কেনো যেন নিজেকে থামাতে পারছি না বলা থেকে। মনে হচ্ছে বলা যখন শুরু করেছি তখন আরেকটু বলি। যাবই তো, আর কোনোদিন হয়ত বলার সুযোগ হবে না। তাই আজ কয়টা কথা বলাই যায়। অধিকার ছেড়ে তো দিয়েছিই। যাবার বেলায় না হয় দুটো কথা শুনিয়েই যাই।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here