সুখের সন্ধানে পর্ব ১৮

0
702

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_১৮
সেলিমকে পাশ কাটিয়ে আমি প্রিয়র রুমে গেলাম। ওর ছয়টার দিকে বের হবার কথা । কী করছে দেখে আসা দরকার। তাছাড়া সেলিমের বকবক শোনার হাত থেকে রেহাই দরকার । কী আজব পুরুষ মানুষ রে! এরা হাজারটা অন্যায় করলেও আমরা ঠিকই মেনে নেই। সেলিমের এমন কাকুতি মিনতি শোনার পর জানি না কতক্ষণ নিজেকে ঠিক রাখতে পারব। তাই সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচাটাই এই মুহূর্তে বেস্ট সল্যুউশান।
প্রিয়র রুমে ঢুকে আমি তো হতবাক। ওর পুরো রুমে চারপাশে সবকিছু বিক্ষিপ্ত অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রিয়কে দেখতে পাচ্ছি না। ওয়াশরুমে উঁকি মেরেও পেলাম না, বিছানার অবস্থা দেখে মনে হলো না এখানে কেউ আদৌ ঘুমিয়েছিল । বুকের মধ্যে ছ্যাঁত করে উঠল। ছেলেটা গতরাতে একটা বিধ্বস্ত মন নিয়ে রুমে এসেছিল । আবার উলটাপালটা কিছু করেনি তো ! এই বয়সের ছেলেরা প্রচন্ড জিদ্দি হয়। ইমোশানে ভরপুর থাকে এদের মন। বারান্দায়ও পেলাম না। মুহূর্তের মাঝে পুরো নিচতলা দোতলা তন্নতন্ন করে খুঁজলাম । সার্ভেন্টরাও সব এ সময় ঘুমায়। কাকে জিজ্ঞেস করব বুঝতে পারছি না। সেলিম এখনো বেডরুমেই আছে। তাকে জিজ্ঞেস করেই বা কী লাভ। সেও তো রুমেই ছিল। হঠাৎ মনে হলো প্রিয়র খুব বেশি মন খারাপ হলে ছাদে যেয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছোটবেলা ওর এক টিচার এটা শিখিয়েছিল ওকে। আজও সেটাই করছে না তো? দৌড়ে ছাদে গেলাম। দরজা দিয়ে তাকিয়ে কাউকে দেখলাম না। খুব ভয় পেয়ে হতাশ ভঙ্গিতে তাও আরেকবার পুরো ছাদ ভালো করে দেখবার জন্য দরজা পেরিয়ে ওপাশে গেলাম। হঠাৎ চোখ পড়ল ছাদের এক কোণে কাঁচুমাচু দিয়ে বসে আছে আমার কলিজার টুকরা। আমার এতক্ষণ ধরে আটকে থাকা দম ছাড়লাম। খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম।
পেছন থেকে যেয়ে ওর ঘাড়ের উপর হাত রেখে যথেষ্ঠ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে বললাম, বাবা! এত সকালে এখানে কেন ? তোমার তো যাবার সময় হয়ে এল।

প্রিয় কিছুটা চমকে যেয়ে পেছনে ফিরতেই ওর টকটকে লাল বর্ণের চোখ দেখে এবার খুব বেশি ঘাবড়ে গেলাম।

– কী হাল করেছ তুমি নিজের ? একি অবস্থা? সারারাত ঘুমাওনি?

– প্রিয় নিশ্চুপ!

– বাবা, তুমি কথা বলবে না আমার সাথে?

প্রিয়র কোনো সাড়াশব্দ নেই। চোখ দিয়ে শুধু পানি গড়িয়ে পড়ছে । ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে । মনে হচ্ছে মুখ খুললে এখনি বাচ্চাদের মতো ভ্যা ভ্যা করে কান্না করে দিবে। ওর অবস্থা দেখে আমার নিজেরই কান্না আসছে। আমি নিজেকে সংবরণ করতে ওকে বুকের মধ্যে চেপে ধরলাম। খানিকক্ষণ মা ছেলে মনের খায়েস মিটিয়ে কাঁদলাম । প্রিয় সত্যিই বাচ্চাদের মতো ভ্যা ভ্যা করে কেঁদেই যাচ্ছে। আর আমি নিঃশব্দে। এভাবে কতক্ষণ পার হলো জানি না। চারপাশে আলো ঝিলমিল করছে । আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম , তোমার দেরী হয়ে যাচ্ছে , বাবা। সময়ের মধ্যে না পৌঁছালে আবার ওরা ঝামেলা করবে।

– আমি কোথাও যাছি না, আম্মু। বেশ ভারী কণ্ঠে বলল, প্রিয়।

– মানে?

– আমি আর ওখানে পড়াশুনা করতে চাই না। এদিকে কোথাও ভর্তি করিয়ে দিতে বলব আব্বুকে।

– মানে কী? তুমি এ বছর পরীক্ষার্থী। অন্য কোথাও কী করে ভর্তি হবে? দু’বছর মাটি করতে চাও?

– আই ডোন্ট কেয়ার! প্লিজ, আমাকে আর ওখানে যেতে বলো না। আমার মন টানছে না একদম। কিছুই ভালো লাগছে না। পড়াশুনা হলে হবে না হলে নেই। আমার তো বিশাল বড় ডিগ্রীর প্রয়োজন নেই। কোথাও চাকরীর জন্য ধর্ণা দিতে হবে না। লেখাপড়া যা শিখেছি তাও কম হয়নি। এখন অনেক কিছু বুঝি।

– পাগল হয়েছ? মাথা ঠাণ্ডা করো। আর মাত্র ক’টা মাস আছে। পরীক্ষা দিয়েই চলে আসবে তুমি।

– প্লিজ, আম্মু! রিকয়েস্ট করো না তো! মনের বিরুদ্ধে যেয়ে আমি কিছুই করতে পারব না। আমাকে একা থাকতে দাও।

– তুমি এমন করছ কেন আমি বুঝতে পারছি । ওকে ফাইন! আমি তবে কোথাও যাচ্ছি না। তোমার আব্বুর কাছে সারাজীবন মাথা নত করে নিজের সব আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে, তার করা সব অন্যায় মেনে নিয়ে একটা মৃত মানুষের মতো কাটিয়ে দিব। খুশি তুমি ? এ আর নতুন কী! এটাই তো হচ্ছে বাংলার প্রতিটি ঘরে। সন্তানের জন্য মায়েরা স্বামীর সংসারে সব শারীরিক, মানসিক অত্যাচার মুখ বুজে সহ্য করে যাচ্ছে যুগের পর যুগ ধরে। লাল শাড়িতে সেই যে ঢুকে এই যন্ত্রণা ভোগ করার খুশিতে । আর কাফনেই মুক্তি মিলে । আমিও কেন তার বিকল্প হবো? আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে বুঝবে, আমাকে এতবড় স্টেপ নিতে হেল্প করবে। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। অন্য সব মেয়েদের মতো আমিও নিজের অস্তিত্বকে বিলিয়ে দিয়ে তোমার আব্বুর হেলেনদেরকে সহ্য করে যাব। কী আর করার আছে? এটা সন্তান হিসেবে তোমার জন্য নিশ্চয়ই খুব গর্বের মনে হবে? তোমার চোখের সামনে তোমার মা মরার আগে প্রতিদিন একটু একটু করে মরবে। মেয়ে হলে বুঝতে কেমন যন্ত্রণা এ জীবনের?

– প্রিয় নিশ্চুপ।

– বললাম তো আমি যাচ্ছি না কোথাও । এবার চলো। আমাকে একটু শান্তি দাও । তোমার থেকে আমার কী প্রাপ্য হবে সে আমার বোঝা হয়ে গেছে। জানি না কেন বুঝতে পারছ না তুমি? আমি কত কষ্টে আমার এত বছরের সাজানো সংসার, আমার সন্তান , আমার ভালোবাসার মানুষ তোমার আব্বু, এত এত প্রাচুর্য ছেড়ে কষ্টের জীবন বেছে নিতে চাচ্ছি? নিশ্চয়ই কোনো মানুষ স্বেচ্ছায় এমন জীবন বেছে নিবে না? যেহেতু বুঝতেই চাইছ না । আমিও মেনে নিব আমাদের বাকীসব মা বোনের মত একটা আত্মমর্যাদাহীন জীবন। চলো, ভেতরে যেয়ে এ কথা তোমার আব্বুকে জানাও। সেলিব্রেট করো। তোমার জীবনের চাইতে আমার কাছে কিছুই মূল্যবান নয়। আমার নিজের জীবনও না। আমি আরেকবার হেরে গেলাম তার কাছে। এটা নিশ্চয়ই সে খুব ধুমধাম করে সেলিব্রেট করতে ভুল করবে না।
মা হিসেবে এই পাওয়ার ছিল তোমার কাছে। একটা দায়বদ্ধাতার শিকলেই না হয় বন্দী রয়ে যাব আজীবন।
আমি যাচ্ছি না তবে আর। এবার হোস্টেলে ফিরে চলো।

প্রিয় কোনো কথা বলছে না । ওর চোখ দিয়ে দরদর করে শুধু পানি পড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে বলল, ঠিক আছে আমারই ভুল ছিল। আমি তোমাকে আর অপমানিত হতে দিতে চাই না। হয়তো আমার কিছুদিন কষ্ট হবে কিন্তু আমি বোধহয় নিজেকে সামলে নিতে পারব। তোমার সব কথা ভালোভাবে চিন্তা করে মনে হলো আব্বুর থেকে দূরে থাকাই তোমার জন্য বেটার। খুব বেশি আবেগী হয়ে গিয়েছিলাম । স্বার্থপরের মতো নিজের কথাই ভেবেছি তোমার কথা একবারও ভাবিনি। কোন সন্তানই চায় না তার মা-বাবা আলাদা হয়ে যাক। আমিও চাইনি। কিন্তু তোমার দিক থেকে চিন্তা করলে আমার মনে হয় তুমি ঠিকই করছ।

প্রিয়কে নিয়ে খুব গর্ব বোধ হল আমার। ছেলেটা আসলেই বড় হয়ে গেছে।

পেছন থেকে সুফিয়া এসে বলল,

– আফা, আমনেরা এইহানে? সারাঘর খুঁইজ্জা পরে এইহানে আইলাম।

– কেন? কী হয়েছে?

– খালুজান আইছে।

– খালুজান?

– পিও বাবার দাদা।

– ওহ! এত সকালে আব্বা এখানে?

– কি জানি? কইল আমনেরে ডাকতে।

আমি প্রিয়র দিকে রাগচোখে তাকালাম। ভাবলাম ওই হয়ত ওর দাদাকে ডেকেছে।
কিন্তু প্রিয়কে দেখে মনে হলো সেও তার দাদার আসার খবর শুনে খানিকটা অবাক। আমি আর কোনো কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি নেমে আসলাম।

ড্রয়িং রুমে থমথমে মুখে বসা আব্বা। আমি যেয়ে সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় সারতেই সে আমাকে বসতে বলল,

– কী শুনছি, মা?

– না,মানে… আব্বা!

– এসব পাগলামি কেন করছ, মা? আমি তো এখনো বেঁচে আছি। আমাকে কিছু জানানোর কথা মনে হলো না?

– আব্বা, আপনি এত ব্যস্ত থাকেন। এসব জানিয়ে আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি।

– আমার ছেলেমেয়ের জীবনের চেয়ে কোনো কাজই আগে না। আজকেই আমার চিটাগাং যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এই খবর শুনে সব ক্যান্সেল করে চলে এলাম।

– আব্বা, এটা এমন কোনো বড় ইস্যু না। এটাতো রোজকার ঘটনা। আপনি চিটাগাং যাওয়া ক্যানসেল না করলেই পারতেন!

– এসব কী বলছ? আমার কাছে তোমাদের গুরুত্ব সবার আগে। কাল আলম ফোন দিতেই সব শুনে আমার মাথা গরম হয়ে গেছে। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল বিধায় তোমাদের আর কল দেইনি।
– ভাইয়া আপনাকে কল করেছিল?ভাইয়াটা না!

– হুম। আলমই বলল, তুমি নাকি মিরপুর বাবার বাসাতে ফিরতে চাচ্ছ। এখানকার সব ছেড়েছুড়ে সেখানেই থাকবে। তাই ও খুব অনুরোধ করল সংসারটা বাঁচানোর। ছোটবোনের এমন বিপদ শুনলে কোনো ভাইয়েরই মাথা ঠিক থাকবার কথা না।
এখন যা হয়েছে হয়েছে। সব ভুলে নতুন করে ভাবো। এই বয়সে এমন বাচ্চাদের মতো করলে চলে, মা? তোমাকে আমি খুব বুদ্ধিমতী ভাবি।

– প্লিজ, আব্বা। এজন্যই আমি আপনাকে জানাতে চাইনি। আপনি আমাকে রিকোয়েস্ট করে লজ্জা দিবেন না । আমি আপনার অবাধ্য হতে চাই না। আশা করছি আপনি আমার সিদ্ধান্ত মেনে নিবেন। আমার চলার পথকে পিচ্ছিল করবেন না, আপনি আমার গুরুজন । আপনাকে অমান্য করার মতো ধৃষ্টতা দেখাতে চাই না। আমার সীমাবদ্ধতাকে বুঝবেন নিশ্চয়ই!

– সবই বুঝি, মা। বুড়ো তো আর এমনিই হইনি। কিন্তু, তুমিও একটু ভাবো। প্রিয়র কথা ভেবেছ?

– ভেবেই ডিসিশান নিয়েছি। প্রিয় আমাকে সাপোর্ট করছে। আপনি চাইলে নিজেই ওর মুখে শুনতে পারেন।

– আহা, মা! এতো কঠোর হলে কী করে চলবে? সেলিমের সাথে আমি কথা বলেছি এসেই। গাধাটা যা করেছে তার জন্য ভীষণ অনুতপ্ত। ওকে মাফ করে দাও মা। ও ওর আচরণের জন্য খুবই লজ্জিত। সে তোমাকে চায় , মা। তুমি ছাড়া ওর কী করে চলবে বলো তো! ভুলে গেছ সেই দিনগুলির কথা। কী করে সবার সাথে যুদ্ধ করে তোমাকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছিল।

– কিছুই ভুলিনি আব্বা। আপনি ছাড়া কেউই রাজি ছিল না । এমনকি এখনো পর্যন্ত আমি আম্মা, সজল , সিলভি কারো কাছে আপন হতে পারিনি। আমি পরই রয়ে গেলাম। এতদিন সবকিছু মেনে নিয়েছি শুধু একজনের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু সেই যখন আমার থেকে এত দূরে চলে গেছে তখন আর কেন এই অর্থহীন জীবনের বয়ে চলা? তাই আমি অনেক ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাকে আর কনফিউজ করবেন না , প্লিজ। অনেক কষ্টে , অনেক ভেবে আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার পক্ষে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া একদমই সহজ ছিল না। তাই আমি আর নতুন করে ভাবতে চাইনা এ ব্যাপারে।

– কিন্তু , মা। মানুষ মাত্রই ভুল করে। সেলিম তো কোনো ফেরেশতা নয়। একটা ভুল করে ফেলেছে। সে তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী। তাকে একবার শোধরানোর সুযোগ দেওয়া কি খুব বেশি চাওয়া হয়ে যাবে তোমার কাছে?

– সারাজীবন ধরে অন্যায় করে এখন বউয়ের পায়ের কাছে এসে মাফ চাইলেই কি মাফ পাওয়া যায়? অবশ্য এদের মতো পুরুষ মানুষের জন্য যবই সম্ভব। আমরা মেয়েরাও সংসার বাঁচাতে যুগের পর যুগ সব সহ্য করে যাচ্ছি বলেই এদের মাঝে আত্মবিশ্বাস জন্মে গেছে এরা যতবড় অন্যায়ই করুক ক্ষমা পেয়ে যাবে। এই সেম অপরাধ যদি আমি করতাম তবে কি সে আমাকে এভাবে ক্ষমা করতে পারত? আপনারা করতেন? কখনোই করতেন না। নষ্টা উপাধি দিয়ে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিতেন। একবারও ভাবতেন না যে মেয়েটাকে একবার শোধরানোর সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। তাতে আমি যদি সবার পা ধরেও কান্নাকাটি করতাম । কারণ আমি মেয়ে। মেয়েরা যুগের পর যুগ এভাবেই মূল্যায়িত হচ্ছে আপনাদের কাছে। আমি আর ছোটো করতে চাই না নিজেকে। আমি সেলিমকে বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছি, সে চাইলেই বিয়ে করতে পারবে। আমি কোনো অধিকার নিয়ে এসে দাঁড়াব না। প্রথমে ভেবেছিলাম তার সব অপরাধ দেখেও না দেখার মতো করে থেকে সংসারটা বাঁচাব । কিন্তু আমি ভুল ছিলাম । এতে সংসার বাঁচলেও নিজেকে প্রতিনিয়ত ছোটো করা হবে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে নিজের চোখে নিজেই চোখ মেলাতে পারব না। তাই আপনি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবেসে থাকেন তাইলে শুধু এটুকুই চাওয়া আপনার কাছে যে আমাকে আর এ বাড়িতে থাকতে বলবেন না। আপনার অনুরোধ ফেলার মত দুঃসাহস আমি দেখাতে পারব না। কিন্তু এখানে থাকলে আমি কখন যে দম বন্ধ মরে যাব জানতেও পারবেন না। বাকিটা আপনার ইচ্ছা।

সেলিম অদূরে দাঁড়িয়ে সবই শুনছিল। আমি তাকে দেখেও না দেখার মতো করেই থাকলাম। প্রিয় মাথা নিচু করে ওর দাদার পাশে বসা । আমার শ্বশুরও একদম চুপ। কী ববে আর? বেশ খানিকক্ষণ কারো মুখে কোনো কথা নেই। কিছুক্ষণের নিরবতা কাটিয়ে আব্বা বললেন,

– যেহেতু তুমি এখনো এ বাড়ির বড়ো বউ তাই তোমার কিছু জানা দরকার। এ ক’দিন তোমার উপর ভীষণ ঝড় বয়ে গেছে বুঝতে পারছি। তাই হয়ত আমাদের বাসার কোনো খোঁজখবর তোমার জানা নেই।

– কী হয়েছে ? আম্মা ভালো আছে তো?

– আছে মোটামুটি!

– তবে?

– তুমি এটা তো জানো যে সিলভি কানাডা চলে গেছে জামাইয়ের কাছে।

– হুম!

– আচ্ছা, আসল কথা বলি। কথাটা মালিহা আর সজলের ব্যাপারে। মালিহা বেবি কনসিভ করেছিল। এ কথা আমরা কেউই জানতাম না। যাই হোক সিলভি যাওয়ার দু’দিন আগেই সে এবোরশান করিয়ে এসেছিল। এটা সজল জানত। মালিহার হাভভাব দেখে সিলভিই প্রথম বুঝতে পারে ব্যাপারটা। সিলভি পরে সব সত্য বের করে ফেলে কীভাবে কীভাবে যেন। ও কেমন তা তো তুমি জানোই। এটা নিয়ে তোমার শাশুড়ির সাথে ধুন্ধুমার কাহিনী লেগে যায় মালিহা আর সজলের। মালিহা আরো পরে মা হতে চায় তাই এবোরশান করিয়েছে। আর তোমার শাশুড়ির কথা হচ্ছে তিন বছর পেরিয়ে গেছে এখনো কিসের সময়? তোমার শাশুড়িও যেমন । মালিহাও তেমন। কারো চেয়ে কেউ কম না। লাগাতার যুদ্ধ চলছিল সজল আর মালিহার সাথে তার। একপর্যায়ে সজলকে সে দু’চারটা থাপ্পড়ও মারে সেদিন। তোমার শাশুড়ি বাচ্চার ব্যাপারে কতটা পোজেসিভ তাতো জানোই। প্রিয়র পরে এ বাড়িতে আর কোনো বাচ্চা আসেনি। কত বছর পেরিয়ে গেল । তাই সজল এবং মালিহার এমন ব্যাবহারের কারণে খুবই কষ্ট পেয়েছে ।

– কষ্ট পাবারই কথা। মালিহার বোঝা উচিত ছিল। বাচ্চাদের মতো জিদ করার স্বভাব যে ওর কবে যাবে?

– আচ্ছা, আসল কথায় আসি। বাচ্চা ইস্যুতে নানান ধরণের কথাবার্তা হয় বউ শাশুড়ির মাঝে। সজলের ব্যবহারেও ভীষণ কষ্ট পায়। ওদের সাথে কথাবার্তা বলা বন্ধ হয়ে যায় তোমার শাশুড়ির। মালিহা আর সজলের ব্যবহারে খুব ইনসিকিউরড ফিল করতে শুরু করে সে। আমার কাছে খুব কান্নাকাটি করে বলে, সহায় সম্পত্তি আমি থাকতেই যেন ভাগ বাটোয়ারা করে রেখে যাই যাতে আমার অবর্তমানে তোমরা কেউ এ নিয়ে হাউকাউ না করো! আমিও ভেবে দেখলাম কথাটা ঠিকই বলেছে।
পরে ল’ইয়ারের সাথে কথা বলে আমার সবকিছুর মোটামুটি একটা ভাগ বণ্টন করলাম যেটা আমার মৃত্যুর পরে বলবৎ হবে। তোমার শাশুড়ি ছাড়া আমি কাউকেই এ কথা জানাতে চাইনি। কিন্তু কী করে যেন সবকিছু মালিহা আর সজল টের পেয়ে যায়। এটা নিয়েই শুরু হয় আসল গ্যানজাম।
আমার সব সম্পত্তির টুয়েন্টি পার্সেন্ট করে ওদের তিন ভাইবোনের নামে দিয়েছি। ফাইভ পার্সেন্ট করে দুই বউকে আর ফাইভ পার্সেন্ট জামাইকে দিয়েছি। বাকি পঁচিশ পার্সেন্টের মধ্যে বিশ পার্সেন্ট তোমার শাশুড়ির আর পাঁচ পার্সেন্ট প্রিয়কে দেবার জন্য সিদ্ধান্ত নিলে তোমার শাশুড়ি তার অংশ থেকেও পাঁচ পার্সেন্ট প্রিয়কে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সেই মতো প্রিয়কে দশ পার্সেন্ট আর তোমার শাশুড়িকে পনেরো পার্সেন্ট দিয়ে একটা উইল রেডি করি। সেখানে তোমার শাশুড়ি আরেকটা কথা উল্লেখ করেছে যে সে যদি আমার আগে মৃত্যুবরণ করে তবে তার পনেরো পার্সেন্টের মাঝে দশ পার্সেন্ট প্রিয়র অংশের সাথে যোগ হবে আর বাকি পাঁচ পার্সেন্ট সজলের বাচ্চাদের মাঝে সমভাবে বণ্টিত হবে। আর সজলের যদি বাচ্চা না থাকে তবে সজলের অংশের সাথে যোগ হবে।
এ নিয়েই মহা ধুন্ধুমার কাহিনী।
প্রিয়কে এত অংশ কেন দেয়া হয়েছে এটা নিয়ে মালিহা বাসায় প্রায় হরতাল শুরু করে দেয়। তার উপর সিলভিকে কেন ভাইদের সমান সম্পত্তিতে অংশীদার করা হয়েছে, জামাইকে কেন আলাদা করে দেয়া হয়েছে, সজলকে কেন ঠকানো হয়েছে? এমন হাজারো কেন নিয়ে মহাপ্রলয় হয়েছে পরশু থেকে। পরে এক পর্যায়ে রাগ করে সজল আর মালিহা বাসা থেকেই বেরিয়ে যায়। আর কোনোদিন এখানে আসবে না , আমাদের সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবে না এমন হাজারো তর্ক বিতর্ক করে ঘর ছেড়েছে দু’জনে ! এই আগুনে আবার ঘি ঢেলেছে মালিহার মা বাবা। সবকিছু মিলিয়ে কী যে অবস্থা বলে বোঝানো যাবে না। তারা তাদের মেয়ে আর জামাইকে নিজেদের বাসাতেই রাখবে এখন থেকে। মালিহা ওর সবকিছু এসে গতকাল নিয়ে গেছে। তোমার শাশুড়ির সাথে একটা কথাও বলেনি। আমি অনেক চেষ্টা করেছি বোঝাতে কিন্তু কোনো কাজই হয়নি।

– কিন্তু, আব্বা! আপনারা তো অন্যায়ই করেছেন ওদের সাথে। প্রিয়কে এত দেবার কী দরকার ছিল? তাছাড়া আমাকেই বা কেন? আমার অংশ মালিহাকে দিয়ে দেন। তাছাড়া আমি আর এখন থেকে এ পরিবারের কেউ থাকছি না।
– তুমি এ পরিবারের না কে বলল? সেলিমের সাথে তোমার সম্পর্ক থাক বা না থাক তুমি আমার প্রিয়র মা। সারাজীবনই এ পরিবারের সাথে তোমার সম্পর্ক থাকবে। আর প্রিয়র ব্যাপারটা যে বললে তার পেছনে যথেষ্ঠ যুক্তি আছে আমার। এই এত এসেট অর্জনের পেছনে সেলিমের অবদান সজলের থেকে অনেক অনেকগুণ বেশি। সেই হিসেবে আমি সেলিমকে আলাদা করে কিছু দিতে গেলেও সজলের গায়ে বাঁধত । তাছাড়া প্রিয়র সাথে কারো কম্পেরিজান কেউ করুক আমি সেটা চাই না। আমার কষ্টার্জিত সম্পদ । অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ এই অবস্থানে এসেছি। কারো রায় নিয়ে আমি আমার সম্পদ ভাগ করিনি। যা মন চেয়েছে তাই করেছি। আমি আমার ইচ্ছেমতো চলি এ কথা সবাই ভালো করেই জানো। আমার মেয়েকে, জামাইকে কী দিলাম সেটা নিয়েও সে প্রশ্ন তোলে কোন সাহসে? এটা তো আমি একদমই টলারেট করব না। আর তোমার শাশুড়ির ব্যাপারে আমার বলার কিছু নেই। সে প্রিয়কে কতটা ভালোবাসে সেটা তো জানোই। হয়তো মালিহা আর সজলের ব্যবহারে কষ্ট পেয়ে সে তার অংশ নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেটা তার ব্যাপার ! আমি সেখানে কোনো হস্তক্ষেপ করতে চাই না। আশা করছি এটা নিয়ে মালিহা আর সজলের মতো তোমরাও কোনো প্রশ্ন তুলবে না আমার সামনে।

– কিন্তু ওরা যে বাড়ি ছেড়ে চলে গেল!
– যাক! যতোসব আগাছা। সময়মতো ঠিকই সুড়সুড় করে চলে আসবে। আর না আসলে না আসুক। আচ্ছা, অনেক কথা তো হলো।
পেছনে ফিরি। তুমি এ বাড়িতে থাকতে চাও না। সেলিমের সাথে সংসার করবে না এটা তবে ফাইনাল , তাই তো!

– জি, আব্বা। আপনি মেনে নিলেই আমার আর এখান থেকে যেতে বাঁধা নেই।

– আমি মেনে নিচ্ছি তবে শর্ত হলো আমার একটা কথা মেনে নিতে হবে তোমার।

– এখান থেকে যাবার জন্য আমি আপনার যেকোনো শর্ত মানতে রাজী।

– মা, তুমি আমার সবচেয়ে বিশ্বস্ত ইমপ্লয়ী , আমার সহকর্মী , আমার বন্ধু আমজাদের মেয়ে। আমার ছেলের বউয়ের পরিচয়ের আড়ালেও এই পরিচয়টা রয়েছে। সেই সুবাদে আমি তোমার শ্বশুর হবার পাশাপাশি তোমার বাবার বন্ধু। তুমি আমার মেয়ের মতো। সেই অধিকারে আমার বাড়িতে আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে চাই। এখানে কোনো না আমি শুনতে চাই না। এই বুড়ো বাবা মায়ের তোমাকে দরকার, মা।

– আব্বা, এসব কী বলছেন? ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেই একই কথা কেন বলছেন?

– মোটেই একই কথা নয়। বাবার বাড়িতে মেয়ে যাচ্ছে। তুমি শ্বশুরবাড়িতে যাচ্ছ না।

– আব্বা!

– তুমি কথা দিয়েছ কিন্তু।

– আব্বা, আম্মা আমাকে পছন্দ করেন না। সেটা তো আপনি জানেন।

– হুম, জানি। তাতে কী হয়েছে? আমি তো করি। ধীরে ধীরে তুমি তার মন জয় করে ফেলবে আমি জানি। তাছাড়া আমার মনে হয় মালিহার ওই ব্যবহারের পর সে কিছুটা হলেও চেঞ্জ হয়েছে। সো ,আর কোনো কথা নয়। কী কী নিতে হবে প্যাক করে ফেলো। আমি অপেক্ষা করছি।

– আব্বা, এ কেমন শর্ত দিলেন? প্লিজ, আব্বা! আমি কারো উপর আর বোঝা হয়ে থাকতে চাই না। আমি নিজেকে চিনতে চাই। নিজের একটা পরিচয় বানাতে চাই। আমাকে এভাবে হাত পা বেঁধে দিয়েন না।

– কতক্ষণ চুপচাপ থেকে উনি বললেন, ঠিক আছে। তোমার জন্য সেই ব্যবস্থা আমার কাছে আছে। আমার মেইন ব্রাঞ্চে একজন একাউন্ট্যান্ট দরকার । তুমি তো একাউন্টিং এ পড়াশোনা করেছ। তাই তোমার জন্য একটা বেস্ট সল্যুউশান পেয়ে গেলাম। এবার আর না করতে পারবে না। আর হ্যা , সেলিমকে নিয়ে ভয় নেই। ওর সাথে তোমার কোনো যোগাযোগ থাকবে না। সেলিম যেহেতু অন্য ব্রাঞ্চে বসে তাই এটাকে ইস্যু করে না করো না। ওর অপরাধের শাস্তি ও এই নির্বাসিত জীবন থেকেই পাবে। প্রিয় চাইলে মায়ের সাথে থাকতে পারবে। আবার বাবার কাছেও থাকতে পারবে। সেটা তার ইচ্ছার উপর নির্ভর করবে। এবার আর না করো না , মা। আমি অনেক আশা নিয়ে এসেছি। আমাকে ফিরিও না।

– আমি খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে অনেক ভেবে যেতে রাজী হলাম। এছাড়া আর করারই বা কী আছে? নিজের কথার জালে নিজেই বন্দি হয়েছি। প্রিয়র দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখের মাঝে প্রশান্তির ছায়া। প্রিয়র চোখে এই আলোর ঝিলিকটুকু দেখে কিছুটা ভালো লাগছে আমার।

চলবে…..

পর্ব- ১৭
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/350558823393460/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here