সুখের_সন্ধানে পর্ব_৪৪

0
456

#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৪৫

সকাল থেকে মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করছে । শরীরটাও গরম মনে হচ্ছে। ভয় হচ্ছে জ্বর টর না আসে। সবদিকে সামলাতে হয় একা হাতে। এই অবস্থায় অসুস্থ হলে কীভাবে চলবে? সকালে নাস্তাও খাওয়া হয়নি। খেতেই ইচ্ছে হচ্ছে না। মুখে দিলেই কেমন বমি চলে আসছে। আজ আবার বিকেলে আমার শাশুড়িকে নিয়ে হাসপাতালে যেতে হবে। কখনো সেলিমকে নিয়ে আবার কখনো আমার শাশুড়িকে !এভাবে ডিউটি দিতে দিতে নিজেই অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। কিন্তু কিছুই করার নেই । আমি ছাড়া এই মানুষ দুটির আর আছেই বা কে? আমার দেবর অবশ্য কয়েকবার আমার শাশুড়িকে তার বাসাতে নিতে চেয়েছে। আমার শাশুড়ি সেখানে যেতে চায় না। আমারও কেন যেন মন সায় দেয় না ওনাকে এখান থেকে পাঠিয়ে দিতে। সারা বাড়িতে মানুষ এই তিনজন। আম্মাও যদি চলে যায় তবে তো ভূতের বাড়িতে রূপ নিবে। মন খারাপ হলে আম্মার পাশে বসে খানিকসময় কথা বলি। সেও যদি চলে যায়! আম্মা তো এ বাড়ি ছেড়ে যেতেই চায় না। তার একটাই কথা মরতে হলে এ বাড়িতে বসেই মরবে। এখানে থাকতেই সে অভ্যস্ত। এখান ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। তাই এই অসুস্থ মানুষ দু’জনকে নিয়েই আমার পৃথিবী।

বাবুর্চী কী রান্না করবে জিজ্ঞেস করতে এলে কেনো যেন মনে হলো আজ প্রিয়র পছন্দের খাবার রান্না করতে বলি। ওর পছন্দের খাবার যেদিন রান্না হয় মনে হয় এই বুঝি একটু বাদেই প্রিয় এসে বলবে , আম্মু খাবার দাও। আমার কিন্তু তর সইছে না।
আমি বাবুর্চীকে বললাম , আজ আলু ভর্তা ,চিংড়ী শুঁটকি ভর্তা, মসুর ডাল ভর্তা করো। সাথে পাবদা মাছের ঝোল আর কচুর লতি ইলিশ রান্না হবে।

বাবুর্চী চলে যাবার পর সেলিম বলল, ছেলেকে মনে পড়েছে?

– মনে তো সবসময়ই পড়ে। আজ যেন কেন খুব বেশিই মনে পড়ছে। এই ক’দিন ওকে কল করেও পাওয়া যাচ্ছে না। পরশু একটা মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে সে ব্যস্ত। ফ্রী হলে নক করবে। এই তিনদিনেও ফ্রী হয়নি ভেবে অবাক হই! হায়রে সন্তান! এর থেকে নিঃসন্তান থাকলেও মনকে শান্ত রাখতে পারতাম। জীবনের কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছি না। এভাবে একটা জীবনকে আর টেনে নিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় না। ওর পছন্দের খাবার রান্না হলে মনে হয় এই বুঝি ছেলেটা আসবে। প্লেট নিয়ে আমার পাশের চেয়ারে বসবে। এটুকু ভাবতেও খুব ভালো লাগে। ওসব তুমি বুঝবে না। তুমি খাবার আগের ওষুধটা খেয়ে নিও। আমি একটু শুয়ে পড়ব। শরীরটা কেমন ব্যথা মনে হচ্ছে। জ্বরটর না আসলে হয়! ঘুমিয়ে গেলে ডাক দিও না।

– আচ্ছা। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল , সেলিম।

ঘণ্টাখানেক একটু শুয়ে থাকলাম। ঘুম আর আসলো না। শরীরটাকে টেনে নিয়ে কোনোরকমে খাবার টেবিলে এসেছি। আম্মার খাবারটা পাঠিয়ে দিলাম ওপরে। আমি একটা একটা করে ঢাকনা তুলছি আর চোখ জোড়া ভিজে আসছে। সেলিম বুঝতে পারে আমি কেন কাঁদছি । একটা প্লেট নিয়ে সেলিমকে খাবার দিলাম। আমিও অল্প কিছু খাবার নিয়ে মাখিয়ে মুখে দেয়ার চেষ্টা করছি। কিছুই খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না একদম। মনে হচ্ছে এই বুঝি বমি চলে আসবে।

মাত্র এক লোকমা খাবার মুখে দিব ঠিক তখন মনে হলো পেছন থেকে প্রিয় এসে বলল, আম্মু আমার প্লেট কই?
আমার হাত থেকে ভাতের লোকমা নিচে পড়ে গেল। ভাবলাম , আমার ভ্রম হবে হয়ত। সেলিমের দিকে তাকিয়ে দেখলাম , সেলিম মুখের খাবার চিবানো বাদ দিয়ে কেমন হা হয়ে পেছনে তাকিয়ে আছে।

আমিও পেছনে তাকালাম। নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছি না। কাকে দেখছি আমি। আমি কি জ্বরের ঘোরে ভুলভাল দেখছি? কিন্তু সেলিম সেই বা আমার মতো ভুলভাল দেখছে কেন। সেলিমও খাওয়া বন্ধ করে হা হয়ে তাকিয়ে আছে সামনে দাঁড়ানো মানুষটির দিকে।

আমি কিছু বলতে যাব অমনি হাটুগেড়ে ধপাস বসে পড়ল সেলিমের পায়ের উপর।

– আব্বু, কেমন আছো তুমি? এই কুলাঙ্গার ছেলেকে মাফ করে দাও। আমি তোমাকে কেমন দেখে গিয়েছিলাম আর আজ কি দেখছি। তোমাকে চিনতেই তো পারছি না। এ আমি কাকে দেখছি?

সেলিম শুধু কাঁপছে । মনে হচ্ছে এখনি হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠবে। নিজেকে সে সামলাতে পারছে না কিছুতেই। ভেতর থেকে কান্না বেরিয়ে আসছে তার । কোনোরকমে প্রিয়কে টেনে তুলল পায়ের উপর থেকে। কিছুই বলতে পারছে না। শেষমেশ এত চেষ্টা করেও কান্না আর থামাতেই পারল না সেলিমও। বাপ ছেলে মিলে কেঁদে কেটে একাকার। এত বছরের অভিমান গলে গলে পড়ছে। এ যেন ফুরাবার নয়। সেলিম একটু ঝুঁকে প্রিয়র মুখে চুমা দিতে দিতে যেন ক্লান্ত হচ্ছে না। আমি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। ঘরের মধ্যে কী এক অদ্ভুত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে; আমিও যেয়ে সেলিমের পায়ের কাছে প্রিয়র পাশে বসে পড়লাম। প্রিয়কে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম এবার তিনজন মিলে। আশেপাশের মেইডরা কে কী ভাবছে সেটা ভাবার সময় আমাদের নেই। দু’একজন বাদে সবাই নতুন মেড। নতুনদের কাছে হয়ত অবাক লাগছে ।
প্রিয়কে কান ধরে টান দিয়ে কোনো রকমে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম, আসবে আমাকে বললেই পারতে। এই তোমার ব্যস্ততা ? এই জন্যই এ ক’দিন কথা বলোনি , তাই না!
প্রিয় কান্নার মাঝেও হেসে দিয়ে বলল, যদি এক্সাইটেড হয়ে সত্যি বলে ফেলতাম তাই সাহস হয়নি কথা বলার।
– বললে কী হতো!

– যদি মিথ্যে আশা দেয়া হতো! কাঁদছে আবার হাসছে প্রিয়।

সেলিম এখনো নিশ্চুপ! আট বছর বাদে ছেলের সাথে দেখা আর কথা। কত কথা জমা আছে তার। অথচ মুখ খুলে বলতেই পারছে না কিছু। শুধু প্রিয়র মাথা হাতড়াচ্ছে আর কিছুক্ষণ পর পর বুকে চেপে ধরছে। পাগলের মত কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে সে। বুঝতে পারছি সেলিমের কেমন লাগছে! আমি তো তবু প্রিয়র সাথে ভিডিও কলে মাঝামাঝে কথাবার্তা বলি । কিন্তু সেলিমের সাথে তো কখনো কথাই হয়নি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বাপ ছেলের সামনা সামনি দেখা হলে এই অভিমান গলে বরফ হয়ে যাবে। ভালোবাসার উষ্ণতার কাছে এসব অভিমানের কোনো মূল্য নেই।

এতক্ষণে মনে হলো প্রিয়র সাথে হয়ত এনা আর আমার নাতী আয়াতও এসেছে। আমি এদিক সেদিক তাকিয়ে প্রিয়কে বললাম , বাবা! এনা আর আয়াত কোথায়?

হঠাৎ খেয়াল করলাম প্রিয় এতক্ষণে একটু স্বাভাবিক হলো। আমার কথা শুনে কেমন চমকে উঠে বলল, ওরা আসেনি আম্মু। একাই এসেছি। শুষ্ক গলায় বলল , আমার ছেলেটা।

– ওহ! আসেনি তবে! আয়াতকে দেখা হবে না তবে? মনের মধ্যে প্রদীপ হয়ে উঁকি দিয়ে জ্বলে ওঠার আগেই আশাটুকু নিভে গেল এক ঝলকে।

– প্রিয় চোখ মুছতে মুছতে বলল, কেন হবে না? অবশ্যই হবে! আজ আসেনি তো কী হয়েছে? খুব তাড়াতাড়িই আয়াতের সাথে তোমাদের দেখা হবে। আব্বু, দাদী কোথায়?

– সে তো হাঁটাচলা করতে পারে না । উপরে রুমেই থাকে। চলো , উপরে যাই।

সেলিম ধীরে ধীরে টুকটাক কথাবার্তা বলতে বলতে স্বাভাবিক হলো। প্রিয়র সাথে কত কথা তার! বাবা ছেলের কথাপোকথন শুনতে শুনতে আমিই আবেগপ্রবণ হয়ে হয়ে গেলাম ।

আমরা উপরে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি তখনই দেখলাম আমার শাশুড়ি এসে হাজির। আমাদের একজন পুরাতন সার্ভেন্ট মতিন ওই নিয়ে এসেছে আম্মাকে। প্রিয়কে দরজাও আসলে ওই খুলে দিয়েছে। কিছুক্ষণ আগে বেল বাজার শব্দ হলে আমিই মতিনকে পাঠিয়েছিলাম দরজা খুলতে। ভেবেছিলাম কোনো সার্ভেন্ট বা অন্য কেউ এসেছে হয়ত। মতিন প্রিয়কে দেখেই আম্মাকে খবর দিতে গিয়েছিল। আম্মাই নিশ্চয় নিচে আসার জন্য জেদ ধরেছিল।

আমার শাশুড়ি আসার পর শুরু হয় আরেক আবেগী দৃশ্য ! নাতীকে পেয়ে যেন আকাশ পেয়েছে সে। বুকের সাথে জাপটে আছে প্রিয়কে। কান্না করছে আর বলছে, কত ডেকেছি উপরওয়ালাকে! আমি জানতাম মরার আগে তোকে আমি দেখতে পাবই। আমার ডাক আল্লাহ শুনেছেন! আমি এবার শান্তিতে মরতে পারব। আর কিছু চাওয়ার নেই আমার?

কান্নাকাটি পর্ব শেষ করে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে প্রিয় ফ্রেশ হতে রুমে গেল। ওর রুমটা দেখলে মনে হয় প্রিয় এখনো এখানেই থাকে। ও যে আট বছরের বেশি সময় ধরে এ ঘরটাতে থাকে না এটা বোঝাই যায় না। প্রতিদিন ওর রুমের ঝাড়ামোছা হয়। এমনকি ড্রেসিং টেবিলের উপর ওর ব্যবহৃত পারফিউম, বডিস্প্রেসহ আরো অন্যান্য কসমেটিকসগুলি পর্যন্ত এমনভাবে রাখা যে দেখে মনে হবে প্রতিদিনই এগুলি ব্যবহার করা হয়।
আলমারীতে কাপড় চোপড়ও একইভাবে প্রতিদিন নাড়াচাড়া করে গুছিয়ে রাখি আমি। প্রায়দিনই ঘুমাতে যাবার আগে ওর ঘরে বসে এগুলি নাড়াচাড়া করি আর ওর শরীরের ঘ্রাণ নেয়ার চেষ্টা করি।

প্রিয় ওর রুম এমন পরিপাটি দেখে অবাক হয়ে গেল। ঠিক সেই দিনের মতোই আছে যেদিন সে চলে গিয়েছিল।

খাবার টেবিলে বসে প্রিয় আরো অবাক। সব তার পছন্দের খাবার রান্না হয়েছে আজ। আসলে মায়ের মন ঠিকই সব টের পায় । আজ কী মনে করে এই খাবারগুলি আমি রান্না করতে বলেছিলাম। খুবই ভালো হলো। প্রিয় তৃপ্তি সহকারে খাবার খেলো। আমি কী খাব শুধু তাকিয়ে দেখছি। শরীরের সেই যন্ত্রনাও যেন ভুলে গেছি নিমেষে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে নিজেকে।
তবে আসার পর থেকেই প্রিয়র চেহারার মাঝে একটা বিষন্নতার ছাপ দেখতে পাচ্ছি। নিশ্চয়ই এনার সাথে ঝগড়াঝাঁটি করে এসেছে। ওই বদমায়েশ মেয়ে এত সহজে তো প্রিয়কে আসতে দেয়নি। বড় রকমের যুদ্ধ, দাঙ্গা হাঙ্গামা করেই এসেছে এটা আমি শিওর। যা হয় হোক! আমার ছেলে এসেছে এটাই আমার বড় পাওয়া!

এতক্ষণে মনে হলো ও ক’দিন না ক’দিন থাকবে জানা দরকার। কতকিছু করে খাওয়াব ছেলেটাকে। আবার ভাবছি এটা জিজ্ঞেস করলে ও কিছু মনে করে যদি!

হঠাৎ সেলিমই বলে উঠল, ক’দিন থাকবে, বাবা?

– তাড়িয়ে দিতে চাচ্ছ? আসতে না আসতেই যাওয়ার কথা বলছ! হাসতে হাসতে বলল, প্রিয়।

– না, না! তা কেন? তোমার বাবা সেটা বোঝায়নি।

– বুঝেছি আম্মু। আমি তো মজা করছিলাম। দেখি কতদিন থাকা যায়। এত বছর পরে এলাম এত সহজে তো যাচ্ছি না। ইচ্ছে হলে এবার তোমাদের সাথে থেকেও যেতে পারি।

– তাই! তবে তো খুব ভালো হয়। এনা আর আয়াতকেও নিয়ে আসো।

– দেখি!

আজ আইমানের সাথে আইমানের অফিসের একটা ডিনার পার্টিতে যাচ্ছে মিথিলা। আইমানই খুব জোর করে রাজী করাল। মিথিলা যেতেই চায়নি। তবে এ ক’দিন আইমানের সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলতে বলতে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়েছে সে। অফিস শেষে আইমান নিজে আসবে মিথিলাকে নিতে। মিথিলা অগত্যাই অনুরোধে ঢেকি গেলার মতো করে রাজী হয়েছে। তার এক মন একবার বলে আইমানকে এই সম্পর্কের ব্যাপারে না করে দেয় আবার ভাবে , সবাই তো ঠিকই বলেছে। এভাবে একা একটা মানুষ কীভাবে বাঁচতে পারে। মেহরাবের সংসারে যেয়ে তার থাকবার ইচ্ছা কোনোদিনই নেই। দূরে আছে তাই ছোটভাইয়ের বউয়ের কাছে সম্মান আছে, শ্রদ্ধা আছে। তার সংসারে যেয়ে থাকলে নিজের সম্মানটাই হারিয়ে যাবে। তাছাড়া বাকী জীবন আর কারো ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকতে তার মন সায় দেয় না। আইমানকে হ্যা অথবা না কিছুই বলেনি। মিথিলা ভাবছে ,একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তো আগে হোক! তারপরে বিয়ে শাদীর চিন্তা তারপরে করা যাবে। আইমান মাঝেমাঝেই এখানে সেখানে যাবার জন্য তাকে কল করে। মিথিলার সময় থাকলে যায় , আবার সময়ে না মিললে যায় না। আইমান অবশ্য রাগ করে না। সে মিথিলাকে বোঝে। আইমান এখন অবধি তার বন্ধুত্বের সীমা অতিক্রম করেনি। এটা মিথিলার সবচেয়ে ভালো লেগেছে। সে নিজেও আসলে একটু সময় নিতে চাচ্ছে। আইমানকে সে এ কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অবশ্য আগেই বুঝিয়ে দিয়েছে । আইমানও নির্দ্বিধায় এটা মেনে নিয়েছে। সেও চায় মিথিলা কোনো চাপে পড়ে নয় , স্বেচ্ছায় একটা সিদ্ধান্তে আসুক! তবে একজন ভালো বন্ধু হিসেবে দু’জনের আড্ডা হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় তার কাছে। বরং এটা তো ভালোই। এই সুযোগে দু’জন দু’জনকে আরো জানার সুযোগ হবে।

আমি প্রিয় এসেছে সেই খুশিতে আর উত্তেজনায় কাউকে জানাতেই মনে নেই যে প্রিয় আসার খবর আত্মীয় স্বজনদের জানানো দরকার। বিশেষ করে মিথিলাকে, সে তো রীতিমত অভিমানের পাহাড় সাজিয়ে বসে আছে এতদিনে।

ফোনটা হাতে নিতেই ওপাশ থেকে ফোন সুইচড অফ বলছে। এটা এই মেয়েটার একটা বদ অভ্যাস! স্কুল থেকে ফেরার পরে কোনোদিকে হুশ থাকে না। ব্যাগের মধ্যে ফোন বাজতে বাজতে একসময় চার্জ ফুরিয়ে যায়! খুব রাগ হলো বারবার ওই কম্পিউটারাইজড লেডির একই কথা শুনতে!

এদিকে আম্মাকে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে। এসে আবার প্রিয়র জন্য কত রকমের রান্না করতে হবে। ছেলেটা ক’দিন না ক’দিন থাকে খবর আছে। হুট করে বলবে আমার অমুক তারিখে ফ্লাইট! ওর কোনো বিশ্বাস নেই। প্রিয় ওর রুমে ঘুমাচ্ছে। আমি দু’জন সার্ভেন্টকে সারাক্ষণ ওর ডিউটিতে লাগিয়ে দিলাম। ও কী খেতে চায় , কোথায় যেতে চায় সবদিক খেয়াল রাখতে বলেছি।

আম্মাকে নিয়ে ফেরার পর থেকে শরীরটা আর চলছেই । দুপুরে মেডিসিন খেতে ভুলে গেছি। এখন খেতে হবে। ফিরে দেখলাম প্রিয় তখনও ঘুম। ওকে আর জাগালাম না। কতটা পথ জার্নি করে এসেছে । দ্রুতপায়ে কিচেনের দিকে গেলাম । প্রিয় সন্ধ্যার নাস্তায় মিষ্টি খাবার পছন্দ করে। ও ওঠার সাথেই যাতে ওর পছন্দের নাস্তা দিতে পারি তাই একটু তড়িঘড়ি। দেখলাম সবজির ঝুড়িতে খুব কচি একটা লাউ রাখা। তৎক্ষণাৎ মনে পড়ল প্রিয়র খুব পছন্দ লাউয়ের ক্ষীর, চালকুমড়ার মোরব্বা।

বাবুর্চীকে বললাম দ্রুত চুলায় দুধ জ্বালিয়ে ঘন করতে। এবং আরেকজনকে বললাম লাউ খুব মিহি করে কেটে দিতে। আমি বাকীসব আয়োজন দেখার জন্য চুলার পাশে গেলাম। এটা সেটা নেড়েচেড়ে দেখছি এর মধ্যে কি হলো আর কিছু মনে নেই। শুধু মনে আছে একটা কেমন যেন চক্কর দিলো মাথার মধ্যে। চারপাশ অন্ধকারে ভরে যাচ্ছে যেন।

একজন সার্ভেন্ট দৌড়ে গিয়ে সেলিমকে খবর দিলো। দ্রুত প্রিয়কে ডাকতে বলল, সেলিম। সে খুব ঘাবড়ে গেছে। এই মুহূর্তে সে কী করবে? সে তো অপারগ! ক’দিন ধরেই কেমন অসুস্থ মনে হচ্ছিল , রুম্পাকে। কিন্তু আজ তো ছেলেকে পেয়ে মনে হলো কিছুটা সুস্থই লাগছিল । কী হলো হঠাৎ?

প্রিয় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো বাবার রুমে।

– কী হয়েছে আম্মুর? কই সে?

– আমি নিজেও জানি না। এখানে নেই। নীচে আছে। আমাকে একটু নিয়ে চলো।

– আচ্ছা।

তড়িঘড়ি একটা এম্বুলেন্স ডাকল , প্রিয়। একদমই সেন্স নেই। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে । সেলিম আর প্রিয় দু’জনই ঘাবড়ে গেল খুব।

এম্বুলেন্স আসতে আর মিনিট কিছু বাকি। প্রিয় একাই যাচ্ছে তার আম্মুকে নিয়ে। সেলিম খুব হাহাকার করছে আর আফসোস করছে পাশে না থাকতে পারার জন্য।

সে তার ফোনটা বের করে দ্রুত মিথিলাকে কল দিলো। এই মুহূর্তে মিথিলা ছাড়া আর আছেই বা কে? রুম্পার পাশে এই মুহূর্তে মিথিলাকে খুব প্রয়োজন।

দুইবার রিং বাজতেই মিথিলা কল রিসিভ করল।

– আসসালামু আলাইকুম , মা। তুই কই এখন?

– এই তো বাসায়? কিছু কী বলবেন?

– তোর রূম্পা মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেন্স নেই একদমই। তাড়াতাড়ি চলে আয়। এম্বুলেন্স চলে আসছে। এভারকেয়ারে নিয়ে যাচ্ছি।

মিথিলা আর কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই কল কেটে দিলো সেলিম।

মিথিলা রেডি হচ্ছিল পার্টিতে যাবার জন্য। খুব সুন্দর করে পরিপাটি সাজে সেজেছে সে। বহুদিন পর ডিপ সবুজ আর মেজেন্টার কম্বিনেশানের একটা জামদানী শাড়ি পরেছে, চোখে কাজল পরেছে, ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়েছে আর কপালে একটা ছোট্ট সবুজ টিপ। আইমান এসে গেছে প্রায়। কিছুক্ষণ আগেও কল করেছিল রেডি হওয়া শেষ হয়েছে কিনা জানতে।

মিথিলার মাথা কাজ করছে না। রূম্পা মাকে কে নিয়ে যাবে? কে দেখছে? ও বাড়ি তো সবাইই পেশেন্ট। কী হলো এমন? গতকাল কীসব ব্যস্ততায় কথাও হয়নি রূম্পা মায়ের সাথে। দিনে একবার কথা হয় তার সাথে। নিজের উপর রাগ হচ্ছে গতকাল কথা না বলতে পারার জন্য।

গত পরশুও আইমানের ব্যাপারে কত কথা জানতে চাইল রূম্পা মা। বারবার মিথিলাকে বুঝেশুনে থাকবার পরামর্শ দিলো। সারাক্ষণই সবার কথা ভাবে মানুষটা। অথচ নিজের মাঝে কী সমস্যা চলছে কিছুই বলে না।

মিথিলা দ্রুতই যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায়ই রওয়ানা হলো হাসপাতালে যাবার জন্য। রাস্তায় যেতে যেতে আইমানকে জানিয়ে দিবে সে পার্টিতে যেতে পারবে না।

চলবে…

পর্ব-৪৪

https://www.facebook.com/111576077291737/posts/396368762145799/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here