#সুখের_সন্ধানে
#পর্ব_৪৬
মিথিলা পাগলের মতো ছুটতে ছুটতে রূম্পা মায়ের কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াল । এখানে সে তাকে নিয়ে আগেও কয়েকবার এসেছে। সে এদিক সেদিক তাকাতেই খেয়াল করল একজন নার্স ওই রুম থেকে বেরিয়েছে। এই নার্সকে সে আগে থেকেই চিনে। মিথিলা সেদিকে দ্রুত এগিয়ে গেল।
নার্সকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, পেশেন্টের টেম্পারেচার প্রচণ্ড বেশি। এখনো সেন্সলেস। আমরা ট্রিট্মেন্ট শুরু করে দিয়েছি। ভয়ের কিছু নেই। ওনার ব্লাড স্যাম্পলও নেয়া হয়েছে অলরেডি। ডাক্তার আর কিছুক্ষণ অবজার্ভ করলেই বুঝতে পারবে আসলে কী হয়েছে।
মিথিলা তড়িঘড়ি করে কেবিনের ভেতর ঢুকল। রূম্পা মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তার কান্না চলে আসছে। কেমন ফ্যাঁকাসে হয়ে আছে মুখখানা। আহারে! মায়ার বাঁধনে আঁকা মুখখানি যেন তার হৃদয়কে তোলপাড় করে দিচ্ছে।
কাছে গিয়ে একটা হাত চেপে ধরে বসে পড়ল। ডাক্তার কীসব ইঞ্জেকশান না স্যালাইন পুশ করছে তাকে। মিথিলা ঘাবড়ে যেয়ে ডাক্তারকে বলল, আমার মা সুস্থ হবেন তো!
– ভয় পাচ্ছেন কেন? সাহস রাখেন। আমরা চেষ্টা করছি। টেম্পারেচার একটু কমলেই জ্ঞান ফিরিবে , ইন শা আল্লাহ!
– ইন শা আল্লাহ!
ডাক্তার নার্স রুম থেকে বেরিয়ে গেলে মিথিলার হঠাৎ মাথায় আসলো , রূম্পা মাকে এখানে নিয়ে এল কে? নিশ্চয়ই বাসার কোনো সার্ভেন্ট বা ড্রাইভার এনে রেখে গেছে। হায়রে নিয়তি! যে সন্তানের মঙ্গলের কথা ভেবে সে নিজের সব অপমান সহ্য করে স্বামীর সংসারে এত বছর কাটিয়ে দিয়েছে সেই সন্তান আজ তার কথা মনে রেখেছে কিনা সন্দেহ! সে আজ থাকতেও নেই। এমন কুলাঙ্গার সন্তান থাকার চাইতে না থাকাই ভালো। মিথিলার মন চাচ্ছে একবারের জন্য যদি প্রিয়কে সামনাসামনি পেত তবে জিজ্ঞেস করত , “এত বড় অমানুষ হলি কী করে ? যে মা বাবা পেলেপুষে এত বড় করেছে তাদেরকে ছেড়ে বউ আর শ্বশুর শাশুড়ি এত প্রিয় হয়ে গেল?”
এমন হাজারো কথা ভাবতে ভাবতে রাগে ফেটে পড়ছে সে। ঠিক সেই সময়ে রুমে ঢুকল , প্রিয়। প্রিয় ঢুকেই খেয়াল করল কেউ একজন তার মায়ের পাশে বসা। একটু অবাক হলো। সে তো কাউকে খবর দেয়নি। কে এল? মাত্রই বিল কাউন্টারে যাবার সময়েও তো কেউ ছিল না। সে মিথিলার পেছন বরাবর দাঁড়িয়ে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, এক্সকিউস মি!
মিথিলা হুট করে পুরুষালি কণ্ঠে খানিকটা ঘাবড়ে যেয়ে পেছনে ফিরল। ফিরতেই সে চোখ নামাতে পারছে না আর! সে স্বপ্নে টপ্নে দেখছে না তো! নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছে না একদমই। সে ভাবল , এতক্ষণ ধরে প্রিয়কে গালাগাল করে গোষ্ঠী উদ্ধার করছিল বলে হয়ত সে জেগে জেগেই স্বপ্ন দেখছে। নাকি প্রিয়র ভূত দেখছে সে?
– মিথিলা তুমি! মনের অজান্তেই বলে ফেলল, প্রিয়!
– ভ…ভা…ভাইয়া… ত…তু…মি ?
– হুম, আমি। তুমি কখন এলে? কেমন আছ? কিছুটা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, সে।
– ভ…ভালো! কিন্তু?
– আগে বসো। ভয় পাবার কিছু নেই । আমিই। আমার ভূত টুত না। বসো , সব বলছি।
মিথিলা আর কিছু না বলেই আজ্ঞাবহ ছাত্রীর মতো বসে পড়ল । কিন্তু তার চোখের নজর এখনো প্রিয়র ওপর থেকে সরেনি।
– আমি আজই এসেছি। আম্মু মনে হয় তোমাকে আমার কথা কিছুই বলার সুযোগ পায়নি। আর বলবেই বা কখন? আসতে না আসতেই আম্মুর কী হলো দেখো!
মিথিলার ঘোর আস্তে আস্তে কাটছে। সে বুঝতে পারছে সে স্বপ্নের দুনিয়াতে না বাস্তবেই আছে। আর তার সামনে দাঁড়ানো জলজ্যান্ত মানুষটি আর কেউ নয় প্রিয়ই।
– কেমন আছ, ভাইয়া? এই তোমার আসার সময় হলো? অভিমান ভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, মিথিলা।
মিথিলার চোখের কানায় কানায় ঠাঁসা নোনাপানি। সে অবাক হলো আবার লজ্জাও পেল। এতক্ষণ যার উপরে রাগ করে পিণ্ডী চটকালো আর এখন কি না সব ভুলে বরফের মত গলতে শুরু করেছে! এর কারণটা সে বুঝতে পারছে না। প্রিয়কে নয়ন ভরে দেখছে সে।
কিন্তু পিছে প্রিয়র কাছে ধরা পরে না যায় তাই নিজেকে লুকাতে প্রাণপণ চেষ্টা তার। কিছুতেই স্বরূপে ফিরতে চায় না প্রিয়র সামনে। না হলে কী ভাববে তাকে নিয়ে প্রিয়!
গোপণে চোখের কোণ মুছলেও প্রিয়র সেটা নজর এড়াল না। সে নিজেও এতবছর পর মিথিলাকে দেখে খুব অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে। কিন্তু মিথিলাকে সেটা বুঝতে দেয়নি কোনোভাবেই। তার চোখজোড়াও যেন এই মুখখানি দেখার জন্য বছরের পর বছর বড় তৃষ্ণার্ত ছিল।
– তুমি কখন এলে বললে না তো!
– এই তো মিনিট দশেক হবে! কী হয়েছিল রূম্পা মায়ের?
– আমি নিজেও জানি না। দুপুরে আমার জন্য কত কী করল! বিকেলে দাদীকে নিয়ে হসপিটালেও গিয়েছিল। এর কিছুক্ষণ পরেই কিচেনে যেয়ে সেন্সলেস হয়ে পড়ে যায়। আমি ঘুম ছিলাম। শাউটিং শুনে লাফিয়ে উঠি। য়াম্মুর এই অবস্থা দেখে তো আমার হাত পা কাঁপা শুরু হয়। খুব ভয় পেয়ে যাই। আম্মুর গায়ে হাত দিতেই দেখি আগুনের তাপে গা পুড়ে যাচ্ছে যেন! এরপর তো দেখছই। ডাক্তার বলেছে খুব তাড়াতাড়িই তারা বুঝতে পারবে আসলে কী হয়েছে। আম্মুর সাথে কথা বলতে পারলে ওনাদের জন্য সহজ হতো! আব্বুর কাছে যতটুকু জেনেছি তাতে মেবি আরো দু’চারদিন আগে হতেই আম্মু মাথা ব্যথা , জ্বর জ্বর এমনটা বলছিল। ডাক্তারকে সেটা বলেছি। সবকিছু দেখে আর শুনে প্রাইমারিভাবে তারা ডেঙ্গুর সন্দেহ করছে! বলছে প্লেটলেট হয়ত কমে গিয়েছে খুব। ব্লাড স্যাম্পল নিয়ে গেছে আগেই। তাছাড়া আম্মুর দাঁতের গোড়া থেকে ব্লিডিং হচ্ছে হালকা। রিপোর্ট আসলেই জানা যাবে সবকিছু।
– ওহ আল্লাহ! এত খারাপ অবস্থা এতদিন ধরে অথচ একটা বারের জন্য আমাকে বলল না। আমি জানলে তখনই এসে ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসতাম। মানুষটা এত বেখেয়ালি নিজের ব্যাপারে। সবার সবকিছু নিয়ে তার মাথাব্যাথার শেষ নেই অথচ নিজের বেলায় অবহেলার অভাব নেই। আমি বলেছি , কতবার বলেছি, তুমি মরবে , এমন করতে করতে ঠিক একদিন কিচ্ছু না বলেই উড়াল দিবে! একটা কথা শোনে না আমার। সময়মত প্রেসারের ওষুধটা পর্যন্ত খায় না। বিপি এত ফ্লাকচুয়েট করে। অথচ তার কোনো মাথাব্যাথা নেই এসব নিয়ে । বলে আমি এমনিই সুস্থ হয়ে যাব। যা মন চায় করুক , আমার কী! কী আর হবে ? বড়জোর মরেই তো যাবে? ওটা সহ্য করার মতো ক্ষমতা আমার আছে। রাগের সাথে কথাগুলি বলতে বলতে কেঁদে ফেলল , মিথিলা। সে দু’ হাতে রূম্পা মায়ের মুখখানা চেপে ধরে মাথাটা ঝুঁকে বাচ্চাদের মতো আদর করছে ।
মিথিলার কথাগুলি প্রচণ্ডভাবে লাগে প্রিয়র বুকে! সে শুধু ভাবছে , “তার জন্মদাত্রী মা! অথচ সে এভাবে কখনোই ভাবেনি মায়ের জন্য। দূরদেশে চলে গিয়েছে অভিমান করে। একবারের জন্যও ভাবেনি এই মানুষ দু’টির কী হবে? কে তাদের ভালো মন্দের খেয়াল রাখবে? শুধু কাড়িকাড়ি টাকা থাকলেই চলে না। আপনজনের পরশের উপরে আর কিছুই নেই। তাদের সবচেয়ে প্রয়োজনের সময় সে তাদের ফেলে দূরে চলে গেছে । অথচ এই মানুষ দুটি না থাকলে এই পৃথিবীর আলো বাতাস সে কী করে দেখত! মিথিলা পেটের সন্তান না হয়েও কত ভাবে আর সে কি না এমন কুলাঙ্গার সন্তান যে দিন শেষে একটা কল করে হাই হ্যালো করেই দায়িত্ব শেষ করেছে বলে মনে করেছে। কখনো তাঁদের মনের গহীনে যেয়ে স্পর্শ করার সাহস করেনি ।
সে মিথিলাকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এসে মিথিলার মাথায় হাত রাখল। তার নিজের চোখ জোড়াও যেন নোনাবাণের ঢেউয়ে উপচে পড়ছে।
– আম্মু , ঠিক হয়ে যাবে, দেখো! আল্লাহ আমার প্রতি এতটা নির্দয় নিশ্চয়ই হবেন না। এত বছর পরে আম্মুর বুকে ফিরে এসেছি । সেই ঠাই তিনি এভাবে পাওয়ার আগেই কেড়ে নিতে পারেন না।
রাত বারোটার দিকে হুশ এলো রূম্পা্র। জ্বরও কিছুটা কমেছে। মিথিলা এক নাগাড়ে পাশে বসে দোয়া দুরুদ মনে মনে আওড়াতেই আছে। একটু সুস্থ বোধ করলে ধীরে ধীরে টুকটাক কথা বার্তা হলো দু’জনের। এরপর কিছুক্ষণের মাঝেই আবার ঘুমিয়ে যায় সে।
– খুবই দুর্বল লাগছে , আম্মুকে তাই না!
মিথিলা বাইরের চেয়ারে বসে আছে। এ কথা শুনে ফিরে তাকাল সে। প্রিয় বেশ কিছুক্ষণের জন্য কই যেন গিয়েছিল। হয়ত কোনো বিল সংক্রান্ত ঝামেলা মেটাতে । মিথিলা কিছু বলার আগেই পাশের চেয়ারটিতে বসল, প্রিয়।
মিথিলা মাথা নেড়ে বলল, হুম! ডাক্তার বলেছে ভয় কেটে গেছে। সেন্স যখন ফিরেছে আর কোনো ভয় নেই। প্রপার ট্রিট্মেন্ট পেলে দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবেন , ইন শা আল্লাহ!
আল্লাহর অশেষ রহমত! রিপোর্ট হাতে পেলেই নিশ্চিন্ত হওয়া যাবে । আচ্ছা, তুমি তো কিছু খেলেই না। চলো হালকা পাতলা কিছু খেয়ে আসি। তাছাড়া এক কাপ চা খাওয়াও দরকার।
– আমার ক্ষিধে নেই , ভাইয়া। তুমি খাও।
– বললেই হলো। সাজগোজ দেখে তো মনে হচ্ছে কোনো দাওয়াত এটেন্ড করতে যেতে চেয়েছিলে। বহু সময় পেটে কিছু পড়েনি নিশ্চয়ই। চলো কিছু খাই। আম্মুর পাশে এখন তো আমাদের যেতে দিবে না। আম্মু সুস্থ হয়ে যদি জানতে পারে তার আদরের মেয়েকে আমি এত সময় অবধি না খাইয়ে রেখেছি তবে আমাকে কি আস্ত রাখবে ভেবেছ!
– আচ্ছা, চলো ! এক কাপ চা খাব শুধু। যাতে ঝিমুনির ভাব না আসে।
– ওকে!
চা খেতে খেতে প্রিয় বারবার মিথিলার অগোচরেই তার দিকে তাকাচ্ছে আর ভাবছে সেই আগের মতই সুন্দর আছে মিথিলা। অথচ এই বয়সেই কত বড় তুফান সামলেছে । জীবনটা যেন থমকে আছে মেয়েটার।
– কোথায় গিয়েছিলে নাকি যেতে চেয়েছিলে বললে না যে? অবশ্য আপত্তি থাকলে জোরাজুরি নেই। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলল, প্রিয়।
– এক ফ্রেন্ডের সাথে ডিনার পার্টিতে যাবার প্লান ছিল।
– ওহ! বয় ফ্রেণ্ড ?
– আরেহ না, জাস্ট ফ্রেন্ড! তুমি তাকে চিনবে! আইমান! আমার কাজিন! ওই যে ভার্সিটিতে বড় ভাই ছিল । তুমি একদিন ঝগড়া বাঁধিয়েছিলে মনে পড়ে?
– কিছুক্ষণ চেষ্টা করতেই মনে পড়ল প্রিয়র। সে বলল, হুম। মনে পড়েছে। আইমান তো ভালো মানুষ না। ওর সাথে কেন?
– এই দুনিয়ায় কে ভালো আর কে মন্দ এটা বোঝাই তো দায়! ওপরের চেহারা দেখে আমরা কখনো কী বুঝি ভেতরে কার কী চলছে?ওপর থেকে দেখে কাউকে ফেরেশতা মনে করে ভুল করে ফেলি আবার কাউকে মনস্টার!
আইমান অনেক বদলে গেছে । এখন বেশ গোছানো স্বভাবের একজন মানুষ। দেখলেই বুঝবে। মোটেই আগের মতো নেই।
– প্রিয় নিশ্চুপ। কী বলবে বুঝতে পারছে না। কথাগুলি যে তাকে খোঁচা মেরেই বলেছে এটা সে নিশ্চিত।
– আচ্ছা, একটা ব্যাপার অনেক সময় ধরে খেয়াল করেছি , তুমি আমাকে ‘তুমি’ করে বলছ সেই সন্ধ্যা থেকেই। ব্যাপার কী বলো তো! আগে তো তুই বলতেই অভ্যস্ত ছিলে। নাকি তোমার বউ কোনো নির্দেশনা জারি করেছে?
– এতক্ষণে প্রিয়রও ব্যাপারটা মাথায় এলো। এতদিনের ব্যবধানে একদম ভুলতেই বসেছিল! সে বলল, অনেকদিন পরে দেখা তো! তাই হুট করে তোমাকে তুই বলতে খুব শাই ফিল করছিলাম। আর কিছুই না।
– বাই দ্যা ওয়ে! আমার সুন্দরী ভাবি কোথায়? বাসাতে নিশ্চয়ই?
– হুম! বাসাতে।
মিথিলার মনের মধ্যে কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। কিন্তু কেন এটা সে জানে না।
– ভাবির অসুবিধা হচ্ছে না তো বাসাতে? তুমিও এখানে , রূম্পা মাও এখানে। ওদের টেইক কেয়ার হচ্ছে তো ?ফোন দিয়ে খোঁজখবর নিও আর খেয়াল রেখো। নইলে আবার তোমার বারোটা বাজিয়ে দিবে দেখো।
– আরে না! ওরা তো আসেনি।
– বললে যে বাসায়?
– আরে সে তো ইতালির বাসায়।
– ওহ!
– গতকাল এলো না যে?
– আসবে নেক্সট টাইম। আচ্ছা , ওসব বাদ দাও। এবার বলো কেমন কাটছে সারাক্ষণ? এরপরে কিছুক্ষণ থেমে প্রিয় বলল, আমি সরি , মিথিলা! তোমার এমন দুর্ঘটনার সময়ে আমি আসতে পারিনি। জানো ,আজও সাজিদের মুখখানা স্পষ্ট হয়ে আমার চোখের সামনে ভাসছে। উফ!
– ওসব কথা বাদ দাও , প্লিজ! আমি সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করতে পারছি না।
– সো সরি! আমি একটু ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলাম। প্লিজ, মাফ করো!
– ইটস ওকে! কতদিন থাকছ এবার?
– সবাই মনে হচ্ছে আমাকে তাড়াতে পারলেই বাঁচো ! আব্বুও সেম প্রশ্ন করল আসতে না আসতেই।
– সেটা কখন বললাম? আংকেলও তুমি যা ভাবছ তা বলতে চায়নি হয়ত।
– হুউম, মেই বি। আছি, বেশ কিছুদিন থাকব ভাবছি। আসতে না আসতে আম্মুর যে অবস্থা হলো! ঘরে আগে থেকেই দু’জন পেশেন্ট আছে তার মধ্যে এবার আম্মুও। কে কাকে দেখবে আমার মাথায় আসে না।
– দেখার কথা তো তোমার। দেশে ফিরলেই পারো! মানুষগুলিকে আর কষ্ট না দিয়ে পারা যায় কি না দেখো। অবশ্য তোমার বউ যদি পারমিশান দেয় তবে!
– কথায় কথায় এত বউ বউ করছ কেন? বাদ দাও তো! চলো, আম্মুর কাছে ফিরে যাই। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল!
– হুউম, চলো। দেখি রিপোর্ট সব এলো কি না!
কেবিনে পৌঁছাতেই নার্স জানাল ডাক্তার তার কেবিনে তাদের ইমিডিয়েট দেখা করতে বলেছে। প্রিয় আর মিথিলা বেশ ভয় পেয়ে গেল, খারাপ কিছু না তো!
ডাক্তারের রুমে বসতেই ডাক্তার ফাইলটা হাতে নিয়ে বলল, দেখুন ! আপনার আম্মুর কিছু রিপোর্ট চলে এসেছে। সমস্যা বেশ গুরুতরই । তবে ভয় পাবার কিছু নেই। আমাদের কাছে যখন এসেছেন সুস্থ হয়ে যাবে , ইন শা আল্লাহ! তবে আগেই এডমিট করতে পারলে ভালো হতো! এত সিরিয়াস পর্যায়ে পৌঁছাত না। উনার ডেঙ্গু পজিটিভ। আমরা যেটা ভেবেছিলাম! প্রথম তিনদিনের মধ্যে টেস্ট করলে রোগ আইডেন্টিফাই করতে এত জটিলতা হতো না। উনি বেশ ক্রিটিকাল স্টেজ মানে শক ফিভারে চলে গেছেন। ব্লিডিং তো হচ্ছেই , শরীরের কয়েক জায়গায় কালো ছোপ ছোপ রক্তজমাট বেঁধেছে। পালস আর প্রেসারও ঠিকঠাক পাওয়া যাচ্ছে না। প্লেটলেট ফরটি থাউজ্যান্ডের মতো যেটা থাকার কথা দেড় লাখের উপর। বুঝতেই পারছেন ওনার সিচুয়েশান! এটা আরো নেমে যেতে মুহুর্তও সময় লাগবে না। এটাই ভয় পাচ্ছি। তবে উঠতেও বেশি সময় লাগে না যদি ইম্প্রুভমেন্ট শুরু হয় একবার। উনার আরো কিছু জটিলতা আছে। ভয় পাচ্ছি কিছুটা যাতে কোনো অঘটন ঘটে না যায়! তবে আমরা চেষ্টা করছি এবং আমরা খুব আশাবাদী।
প্রিয় আর মিথিলা দু’জনেরই মুখ ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছে ডাক্তারের কথাবার্তা শুনে। কী বলছে এসব? প্রিয় থরথর করে কাঁপছে মনে হলো। মিথিলারও একই অবস্থা। সে প্রিয়কে দেখে ঘাবড়ে গেল। নিজেকে নিয়ে ভাবাভাবির সময় নেই। সে প্রিয়র হাতখানা চেপে ধরে সান্ত্বনা দিচ্ছে নাকি নিচ্ছে নিজেও জানে না।
প্রিয় কোনোরকম নিজেকে সামলে করে বলল,আম্মু ঠিক হয়ে যাবে তো ?
– ইন শা আল্লাহ! তবে ব্লাড ডোনার রেডি করেন। ওনার গ্রুপ ‘ বি পজিটিভ’। আপনারা ম্যানেজ করতে না পারলে আমরা আমাদের ব্লাড ব্যাংক থেকে দিব। তিন চার ব্যাগ ব্লাড রেডী রাখতে হবে। প্লাজমাও দিতে হতে পারে।
– আমার সেম গ্রুপ। আমার থেকে নিন, প্লিজ! বলল, মিথিলা।
– আরো ডোনার লাগবে তবে!
– আমি ম্যানেজ করে দিচ্ছি এখনই। আমার পরিচিত কয়েক জনেরই আছে। ওরা এখনই আসতে না পারলে তবে ব্লাড ব্যাংক থেকে নিতে হবে। আপনি শুধু আমার রূম্পা মাকে বাঁচান , প্লিজ! বলতে বলতে চোখের পানি আর সামলাতে পারল না , মিথিলা।
প্রিয়র খুব অসহায় লাগছে। তার ব্লাড গ্রুপ ‘এ পজিটিভ’ । তার বাবার সাথে ম্যাচ করেছে। মায়ের জন্য কিছুই করতে পারছে না ! কেমন অধম সন্তান সে!
চলবে…
পর্ব- ৪৫
https://www.facebook.com/111576077291737/posts/397614678687874/