#চেরি_ব্লসমের_সাথে_এক_সন্ধ্যা
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ১০
_____________
সারারাত মিতুলের দুই চোখের পাতা এক হয়নি। মনে কেবল ঘুরেছে জঙ্গলের ব্যাপারটা। কালকে রাতে কীসব সিরিয়াল কিলার নিয়ে ভেবেছে, যেটা অযৌক্তিক মনে হচ্ছে এখন। কিন্তু কোনো না কোনো গড়বড় তো অবশ্যই আছে। আর সেটা জানতে হলে ওকে ওই জঙ্গলের ভিতর ঢুকতে হবে। ও রাতেই মনস্থির করেছিল সকাল হলেই একবার ওই জঙ্গলে ঢুকে ব্যাপারটা দেখবে। যতই ভয় করুক না কেন একবার বিষয়টা দেখতেই হবে।
মিতুল ব্যাক ডোর থেকে গার্ডেনে নেমে পড়েছে। বাইরে শীতল পরিবেশ। বসন্ত কালেও এখানে বেশ শীত পড়ে। মিতুল গায়ের বেগুনি রঙের সোয়েটারটা ভালো করে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে চলছে। ঘাসের উপর জমে থাকা শিশির বিন্দু পায়ের সাদা কেডস জোড়া ভিজিয়ে দিচ্ছে। জঙ্গলের ভিতর দুই-একটা পাখি ডাকছে অচেনা সুরে। ওর কাছে ভয়ংকর লাগছে ওই সুর। যেন ওকে জঙ্গলে ঢুকতে সাবধান করছে। কিন্তু ওই সাবধান বাণী শুনবে না ও। দেখবেই ব্যাপারটা। চারপাশটা অদ্ভুত রকমের নিস্তব্ধতায় ঘেরা। ভূতুড়ে মনে হচ্ছে কেমন। বাতাসের শীতল পরশ সোয়েটার ভেদ করে ভিতরে ঢুকে গায়ের লোম খাড়া করে দিচ্ছে। মিতুলের গলা শুকিয়ে যাচ্ছে বার বার। ঢোক গিলে গলাটা ভিজিয়ে নিতে চাইছে।
সূর্যের আলোয় চারিপাশ আলোকিত হলেও জঙ্গলের ভিতরে আলোর বিচরণ দেখা যাচ্ছে না ভালো করে। বড়ো বড়ো গাছের ফাঁক ফোকর দিয়ে একটু-আধটু আলো কোনো রকমে ঢুকেছে। যা জঙ্গলকে আলোকিত করতে পারছে না বললেই চলে।
মিতুল জঙ্গলে ঢোকার রাস্তা থেকে এখনও অনেক কদম পিছনে। জঙ্গলে ঢুকতে ভয় করছে ওর। হাত-পা একটু একটু কাঁপছেও বোধহয়। জঙ্গলে ঢুকতে চেয়ে কি ঠিক করছে? না কি ভুল?
হলে হোক ভুল। দেখতেই হবে কী আছে ওই গভীর জঙ্গলে। মিতুল ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত মন নিয়ে এগিয়ে চললো। কিন্তু রাস্তা পর্যন্ত যেতে পারলো না। একটা গম্ভীর পুরুষ কণ্ঠ যেমনি ওর চলন রোধ করলো, তেমনি থামিয়ে দিলো ওর হৃৎস্পন্দন। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল ভয় স্রোত নেমে গেল। পিছন ঘুরে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। জানে না কেন এত ভয় করছে। ভীতু মন নিয়ে পিছনের গম্ভীর কণ্ঠের মানুষটির দিকে ফিরলো ও।
ব্যাক ডোরে গম্ভীর কণ্ঠের মানুষ, অর্থাৎ জায়িন দাঁড়ানো।
মিতুল কী বলবে, কী করবে বুঝতে পারছে না। ও হঠাৎ জায়িনকে এত ভয় পাচ্ছে কেন?
“জঙ্গলে ঢোকার দরকার নেই। বিশেষ কিছু নেই ওখানে। গাছপালা এবং একটা উটকো জিনিস ছাড়া অন্যকিছুই দেখতে পাবে না। ওখানে না যাওয়াই ভালো।”
কথাগুলো বলে ঘরে ঢুকে গেল জায়িন।
মিতুল ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ব্যাক ডোরের দিকে। জায়িন সরাসরি ওকে জঙ্গলে ঢুকতে নিষেধ করেছে? কেন?
আগের থেকে ভয় আরও বেড়ে গেল ওর। জঙ্গলে যাই থাকুক না কেন, তার সাথে জোহান একা জড়িত নয়, জায়িনও যে এর সাথে জড়িত বিষয়টি খুব ভালো করেই বুঝতে পারলো মিতুল। এই দুই ভাই মিলে কী করছে এই জঙ্গলের ভিতর? সত্যি সত্যিই কি কোনো মার্ডার…
মোবাইলে রিংটোনের শব্দে মিতুলের ভাবনায় ছেদ পড়লো। পকেটে ফোন বাজছে।
মোবাইল স্কিনে মা নামটা দেখে মিতুলের মন হঠাৎ কেঁদে উঠলো।
“হ্যালো মা!”
“উঠে পড়েছো ঘুম থেকে?”
“হ্যাঁ মা। তোমায় অনেক মিস করছি মা! লাভ ইউ।”
মিতুলের মা হঠাৎ করে মিতুলের এত ভালোবাসার কারণ বুঝতে পারছেন না। তিনি আশঙ্কা করলেন মিতুল কিছু একটা ঝামেলা বাঁধিয়েছে।
“কী ঝামেলা করেছো তুমি?”
“আমি মরে গেলে তুমি খুব কষ্ট পাবে তাই না?” কথাটা বলতে মিতুলের নিজের মনই কষ্টে জর্জরিত হয়ে গেল।
“কী বলছো এসব আবোল-তাবোল?”
“দোয়া করো, আমি যেন একটি দীর্ঘ জীবন পাই…”
“হঠাৎ করে এসব কী বলছো তুমি? কী হয়েছে?”
মিতুল জোর করে মা’কে নিজের হাসি কণ্ঠ শোনালো।
“না, কিছু হয়নি। এমনি বললাম। দেখতে চাইছিলাম তুমি ঠিক কতটা চিন্তা করো আমাকে নিয়ে। সত্যিই মা, তুমি অনেক অনেক বেশি চিন্তা করো আমাকে নিয়ে। ঠিক আছে, তোমার সাথে পরে আবার কথা বলবো আমি। ব্রেকফাস্ট করবো এখন। রাখছি তাহলে।”
মিতুল ফোন কেটে দিয়ে ফোন সাইলেন্ট করে রাখলো। জানে মায়ের দুশ্চিন্তা একেবারে দূর করে দিতে পারেনি। এরপর মা অনেক বার কল দেবে ওকে। মায়ের সাথে কথা বলার মন নেই এখন। কিন্তু মাকে ও এরকম কথা কেন বললো? নিজেই বুঝতে পারছে না সেটা! জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে মিতুলের দু চোখ অশ্রু ভরাট হলো। না জানি কত মানুষের আত্মচিৎকার এই জঙ্গলের অন্ধকার রাজ্যের ভিতরই আটকা পড়ে আছে!
___________________
আজ সারাদিনে তুলতুলকে কোথাও দেখতে পায়নি। কোথায় উধাও হলো মেয়েটা? সকাল থেকে একবারও চোখে পড়েনি। ব্যাপারটা নিয়ে ভাবেনি এতক্ষণ। কিন্তু এখন না ভেবে উপায় পেল না। কোথায় গেল মেয়েটা? কার্লের কাছে গেছে না কি আবার? কার্লের কথা মনে উঠতেই জোহানের মেজাজ চরমে উঠলো। গ্যারেজে এসে গাড়ি নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লো বাড়ি থেকে।
কার্লের রেস্টুরেন্টে এসে খুঁজলো। কার্লকে পেল, কিন্তু মিতুলকে দেখলো না কোথাও। এখানে আসেনি? কোথায় গেল তাহলে? অন্য কোনো ছেলের পিছনে ঘুরছে না কি?
জোহান আশেপাশের আরও কয়েকটা রেস্টুরেন্টে খুঁজলো। কিন্তু পেল না।
পার্কেও খোঁজ করলো, তবে পাওয়া গেল না মিতুলকে।
সন্ধ্যা নামার খানিক আগে বাসায় ফিরলো জোহান। এর মাঝে রিকার্ডো ফোন করে লং ড্রাইভে যাওয়ার কথা বলেছিল। ও না করে দিয়েছে। কালকে সকালে যাবে বলেছে। মিতুলকে খুঁজে বের করতে হবে আগে। এই বোকা মেয়েটা কোথায় চলে গিয়েছে কে জানে! কোনো ছেলের সাথে ডেট করছে? বয়ফ্রেন্ড জুটিয়ে ফেলেছে? নিজের বয়ফ্রেন্ডের সাথে লং ড্রাইভে চলে গেছে দূরে কোথাও? এই নাকফুলো মেয়েটা…
জোহান ঘরে ঢোকা দিয়ে আবার থামলো। ক্যামিলা লনে আগাছা পরিষ্কার করছে। মেশিন দিয়ে কাটছে আগাছাগুলো। জোহান দরজায় দাঁড়িয়েই ডাকলো,
“সিস…”
“হ্যাঁ, বলো।”
“মিতুলকে দেখেছো কোথাও?”
“হ্যাঁ…”
জোহান অবাক। ও নিজে বাইরে এত এত জায়গায় খুঁজেও পেল না, তাহলে ক্যামিলা কোথায় দেখলো?
“কোথায় দেখেছো ওকে?”
“মিতুল তো নিজের রুমে।”
জোহানের চোখ কপালে উঠলো।
“নিজের রুমে?”
“হ্যাঁ। সকালে ব্রেকফাস্ট করতে না আসায় ডাকতে গিয়েছিলাম রুমে। তখন বললো ব্রেকফাস্ট করবে না, ঘুমাবে। চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল রাতে ঘুমায়নি, তাই ভাবলাম ঘুমাক। সেই যে ঘুমালো আর ওঠেনি। হয়তো ক্লান্ত সে জন্য এভাবে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। আমি ওর ঘুমে ডিস্টার্ব করিনি আর।”
জোহান সব শুনে মিতুলের রুমে চলে এলো। মিতুলের রুমের দরজা আনলক ছিল। একটু ঠ্যালা দিতেই খুলে যায়।
মিতুল উপুড় হয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। সাদা কম্বল কোমর পর্যন্ত টেনে দেওয়া। মুখ নরম বালিশে কাত হয়ে ডুবে আছে। মুখে অসংখ্য চুল এসে পড়ে মুখটা আড়াল করে রেখেছে অনেকখানি।
জোহান ভাবতে পারছে না মিতুল নিজের রুমে ছিল, আর ও বাইরে বাইরে খুঁজে বেরিয়েছে ওকে! কেন সারাদিন রুমের ভিতরে থেকে ঘুমিয়েছে? জোহানের ইচ্ছা হলো সারাদিন ঘুমানোর অপরাধে মিতুলকে একটা কঠিন শাস্তি দেয়। জোহান মিতুলের কাঁধে আস্তে আলতো করে কয়েকটা চাপড় দিয়ে ডাকলো,
“মিতুল!”
মিতুল ঘুমের ঘোরেই বলে উঠলো,
“হুঁ?”
“তুমি এখনও ঘুমাচ্ছ? ওঠো।” কড়া গলায় আদেশ দিলো জোহান।
মিতুল নিদ্রা অবস্থাতেই বিড়বিড় করে বললো,
“ওঠো? কে ওঠো? আমি মিতুল! আমি রাবা!”
“হেই ব্যাঙ্গলি গার্ল! কীসব বলছো তুমি?”
“বেঙ্গল? আমি রয়েল বেঙ্গল টাইগার খাবো না। আমি ভাত চাই। রুই মাছ দিয়ে ভাত খাবো আমি।”
অস্পষ্ট জড়ানো বাংলা শব্দগুলো কিছুই জোহানের বোধগম্য হলো না। তাছাড়া মিতুলের ঘুমের ঘোরে এভাবে কথা বলা জোহানের ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। জোহান হাত দিয়ে জোরে মিতুলের পিঠে আঘাত করে বললো,
“এই ওঠো তাড়াতাড়ি।”
মিতুলের চোখের পাতা কম্পিত হয়ে খুলে গেল। সামনে ঝাপসা করে একটা বিদেশি ছেলেকে বসে থাকতে দেখতে পেল। বিদেশি ছেলেটার মুখে যখন জোহানকে খেয়াল হলো, তখন হুঁশ ফিরলো মিতুলের। জোহানকে দেখে চোখে আতঙ্ক ভর করলো ওর। চকিতে শোয়া থেকে উঠে জোহানের থেকে অনেকটা দূরে ছিটকে গেল ও।
“তু-তুমি এখানে?”
মিতুলের মুখে আতঙ্কের গাঢ় ছায়া।
জোহান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
রুমের খোলা দরজায় চোখ পড়তে হা হয়ে গেল মিতুলের মুখ। দরজার দিকে অঙ্গুলি করে বললো,
“দরজা খুললে কীভাবে তুমি? দরজা তো আমি বন্ধ করে ঘুমিয়েছিলাম। কীভাবে খুললে তুমি?”
জোহান নির্বিকার তাকিয়ে বললো,
“দরজা যদি তুমি বন্ধ করেই ঘুমাও তাহলে কি আমি অলৌকিক শক্তির মাধ্যমে সেটা খুলে ভিতরে ঢুকেছি? সারাদিন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তোমার মাথা কি ড্যামেজ হয়ে গেছে? লিসন, তোমার রুমের দরজা খোলাই ছিল। খোলা রেখেই ঘুমিয়ে পড়েছো।”
মিতুল একটু সময় ভেবে বললো,
“থাকুক খোলা। সেটা বিষয় না। তুমি কেন চোরের মতো আমার রুমে ঢুকেছো সেটা বলো? কী করতে চাইছিলে তুমি?”
মিতুল রেগে গিয়ে একটা বালিশ ছুঁড়ে মারলো জোহানের দিকে। জোহান ক্যাচ ধরে ফেললো।
মিতুল বললো,
“বেরিয়ে যাও এখান থেকে।”
“তোমার রুমে থাকতে আসিনি আমি। আমার থাকার অনেক জায়গা আছে। নিজের পানিশমেন্টের জন্য রেডি হও।” বলে বালিশটা ছুঁড়ে মিতুলের কাছে পাঠিয়ে দিলো আবার।
মিতুলও জোহানের মতো ক্যাচ ধরলো।
“পানিশমেন্ট মানে?” অবাক কণ্ঠে জানতে চাইলো মিতুল।
জোহান রুম থেকে যেতে যেতে বললো,
“রুমে বসে থেকে আমাকে বাইরে বাইরে ঘুরিয়েছো তুমি, খুঁজিয়েছো তোমায়।
বুঝলে, এডমন্টনের এক প্রান্ত ঘোরা শেষ! আমার শক্তি অপচয় হয়েছে, কারের অয়েল ফুরিয়েছে। এর পানিশমেন্ট নেবে না তুমি?”
“কী বলছো এসব?” জোহানের কথার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝলো না।
দরজার কাছে গিয়ে থামলো জোহান। মিতুলের দিকে ফিরে বললো,
“রাতে সুন্দর করে রেডি হয়ে থাকবে। তোমায় নিয়ে পার্টিতে যাব আমি। নিয়ে যাব মানে যাবই। আমার কথা অমান্য করার চেষ্টা করো না একদম। যদি চেষ্টা করো, তাহলে তোমার ওই ফুলো নাক কেটে জঙ্গলের হিংস্র প্রাণীগুলোকে খাওয়াবো আমি।”
মিতুল হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। কী সাংঘাতিক কথাবার্তা! গা শিউরে উঠছে।
জোহান ফিচেল হেসে চলে যায়।
মিতুলের জঙ্গলের কথা মনে পড়ে গেল। চিন্তার রাজ্য এসে নিমেষেই ভর করলো ওর মাথাতে। কী আছে ওই জঙ্গলে? সত্যিই কি কোনো হিংস্র প্রাণী আছে?
“না, ওরকম ভাবে চিনি না। তবে একটু-আধটু জানি দেশটা সম্পর্কে। শুনেছি খুব সুন্দর একটি কান্ট্রি।” কার্ল কফির মগে চুমুক দিয়ে আবার বললো,
“জানো তো, আমার এখানে একজন বেঙ্গলি ফ্রেন্ড আছে। ওর নাম সিয়ম। খুব ভালো সম্পর্ক ওর সাথে আমার। ও সহজ সরল একটি ছেলে। ব্যাংলাডেশ থেকে পড়তে এসেছে এখানে। মাঝে মাঝে ব্যাংলাডেশ নিয়ে কথা হয় ওর সাথে। টরোন্টো থাকাকালীন অনেক সময় ওর সাথে ছিলাম আমি।”
“টরোন্টোতে থাকতে তুমি?”
“হ্যাঁ। এডমন্টনে এসেছি মাত্র পনেরো দিনের মতো হলো।”
“তো টরোন্টো থেকে এডমন্টনে কেন আসতে হলো তোমার?”
“আমার হোমল্যান্ড এই এডমন্টন। আমার ফ্যামিলি এখানেই থাকে। আমার পাপা আমাকে টরোন্টো থেকে এডমন্টনে চলে আসার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। আর তাছাড়া আরও একটা বিশেষ কারণ আছে যার জন্য আমি এডমন্টনে এসেছি।” কার্লের কণ্ঠে কিছুটা খুশির রেশ অনুভব করা গেল।
“কী বিশেষ কারণ?” মিতুলের খুব করে জানতে ইচ্ছা করলো।
“সেটা এখন বলবো না। সময় হলে বলবো। তুমি তো বেশ অনেক দিনই আছো কানাডাতে। আশা করি তুমি আমার বিশেষ কারণটা জানবে এবং দেখবে।”
মিতুল মৃদু হেসে বললো,
“ঠিক আছে।”
“আচ্ছা, তোমাদের দেশের কী যেন একটা পোশাক আছে না ট্র্যাডিশনাল? মেয়েরা পরে। কী যেন বলে ওটাকে স…স…”
“শাড়ি?”
“হ্যাঁ, ওটাই। পোশাকটা পছন্দ আমার। এক ওল্ড দম্পতিকে চিনতাম আমি। মিস্টার এন্ড মিসেস খান। ওনারা ব্যাংলাডেশি ছিলেন। মিসেস খানকে প্রায়ই দেখতাম ওই ট্র্যাডিশনাল পোশাকটি পরতে। তার কাছ থেকেই জেনেছিলাম ওটাকে শ…শারি বলে।”
কার্লের কথা শুনতে কেন যেন খুব ভালো লাগছে মিতুলের। কী সুন্দর করে কথা বলে। সারাদিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা এই কণ্ঠ কানের কাছে বসে বকবক করতে থাকলেও বিরক্তি আসবে না। কার্ল বাংলাদেশ সম্পর্কেও কত সুন্দর করে নিজের অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো। কত সহজে মিশে গেল ওর সাথে। অহংকারের ছিটেফোঁটাও নেই একদম। মিতুলের ইচ্ছা হলো একদিন ও একটা শাড়ি পরে কার্লকে দেখায়!
___________________
জোহান ঠিক ঘরের প্রবেশ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। মিতুল এখনও বাড়ির বাইরে। মিতুলের জন্যই ও দাঁড়িয়ে আছে। মিতুল আসলেই মিতুলকে ধরবে।
মিতুল বাড়িতে ফিরলো আরও বেশ কিছুক্ষণ পর। ঘড়িতে তখন ৭ টা পিএম। তখনও চারিদিক আলোকিত, উজ্জ্বল।
মিতুলকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও খুব আনন্দিত। অবশ্য আনন্দিত থাকবেই বা না কেন? নিজের প্রিয় ধূসর চোখার সাথে ছিল, আনন্দ তো হওয়ারই কথা।
তবে ওই আনন্দ জোহানকে করে তুলছে বিষাক্ত। জোহানের চোখ কিছুতেই ওর এত আনন্দিত, চঞ্চলা মুখ সহ্য করতে পারছে না।
“দাঁড়াও।”
মিতুল জোহানকে দরজার কাছে দাঁড়ানো দেখেও না দেখার ভাণ করে ওর পাশ থেকে চলে যাচ্ছিল। জোহানের রাগান্বিত কণ্ঠ ওকে জোহানের দিকে তাকাতে বাধ্য করলো। ত্যাড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো মিতুল,
“কী?”
“কোথায় ছিলে সারা বিকেল?”
“আমার যেখানে খুশি আমি সেখানে ছিলাম। এই প্রশ্ন আমাকে কেন করছো তুমি?”
“কার সাথে ছিলে?”
“আশ্চর্য! তুমি একের পর এক প্রশ্ন করছো কেন আমায়? তুমি কি আমার অভিভাবক?”
“কোথায় ছিলে?”
আবারও জোহানের একই প্রশ্নে মিতুল অতিষ্ঠ হয়ে বললো,
“জাহান্নামের চৌরাস্তায় ছিলাম আমি, তোমার কোনো সমস্যা? আজকে খুব নাচতে নাচতে জিজ্ঞেস করছো কোথায় ছিলাম আমি। আর সেদিন? সেদিন তুমি নিজে কী করলে? মাঝপথে আমায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিলে, মনে নেই সেটা? কই সেদিন তো জিজ্ঞেস করোনি কোথায় ছিলাম আমি, কীভাবে বাড়ি ফিরেছি। তাহলে আজ কেন এত আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইছো? আর জানতে চাইলেই কি আমি বলবো না কি?”
মিতুল ঘরে ঢোকা দিলে জোহান মিতুলের এক হাত টেনে ধরলো।
তাৎক্ষণিক গরম হয়ে গেল মিতুলের মাথা। জ্বলন্ত চোখে তাকালো জোহানের দিকে। মিতুলের জ্বলন্ত চোখ জোড়া দেখার সময় জোহানের নেই। ওর দৃষ্টি এখন মিতুলের মাথায় একটি ক্ষুদ্র আকারের ক্লিপের দিকে। ক্লিপটা ভালো করে দেখার জন্যই মিতুলকে থামিয়েছে। জোহানের ধারণা এটাও ওই কার্ল দিয়েছে মিতুলকে। যেমন করে হেয়ার রাবার দিয়েছিল, তেমন করে আবার হেয়ার ক্লিপও দেওয়া শুরু করেছে স্টুপিডটা!
মিতুল জোহানের হাত থেকে নিজের হাতটা এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিলো।
“এটা কোন ধরনের বেয়াদবি, হ্যাঁ?”
মিতুল বিদ্রুপ ভাবে তাকালো জোহানের দিকে।
“পৃথিবীতে হাজার হাজার হেয়ার ক্লিপ আছে। এখন একটা হেয়ার ক্লিপ নিয়ে মাথা ব্যথা তোমার?”
“বলো, কোথায় পেয়েছো এটা?”
“এক্সকিউজ মি! আমি সামর্থ্যহীন নই যে সামান্য একটা হেয়ার ক্লিপ কেনার সামর্থ্য থাকবে না আমার। এটা আমি কিনেছি। যেদিন তুমি আমায় গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিলে, সেদিন শপে গিয়ে কিনেছি এটা। আর তাছাড়া আমার কাছে হেয়ার ক্লিপের অভাব নেই। চাইলে তা দিয়ে নিজেও একটা হেয়ার ক্লিপের দোকান খুলতে পারি।”
জোহান চোখ সরিয়ে নিলো মিতুলের থেকে। লনের দিকে শূন্য দৃষ্টি স্থাপন করে বললো,
“গেট লস্ট!”
মিতুলের ভ্রু কুঁচকে এলো। নিজে হাত ধরে থামিয়ে, নিজেই আবার চলে যেতে বলছে? মিতুলের কুঁচকানো ভ্রু জোড়া হঠাৎ প্রসারিত হয়ে উঠে বিস্ময়ের রূপ নিলো। জোহান কি ওকে কোনো রকম ভাবে অপমান করছে না কি? এটা কি ওদের মানুষকে অপমান করার কোনো আধুনিক টেকনিক? মিতুল অপমান বোধ করলো। আধুনিক টেকনিক খাটিয়ে এখন অপমান করছে? বদমাইশ একটা! মিতুল দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকলো।
হলরুম থেকে যাওয়ার সময় ক্যামিলা এগিয়ে এলো কাছে।
“এ কী, তোমায় যে আমি বললাম বন্ধুর সাথে আড্ডা শেষ করে আমাকে কল দিতে, আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো।”
ক্যামিলার টেইক কেয়ার দেখে মিতুলের অপমান বোধ কমে এলো।
“তার দরকার ছিল না ক্যামিলা। কার্ল আমাকে উবারে উঠিয়ে দিয়েছিল। অযথা আবার তোমাকে ফোন করে পেইন দেওয়া উচিত মনে হয়নি আমার।”
“এটাকে পেইন বলছো কেন? এখানে পেইনের কী আছে? রাবার্তাকে(বাড়ির দ্বিতীয় মেইড) পাঠিয়ে দিতাম আমি গাড়ি নিয়ে। ওর বিশেষ কোনো কাজ ছিল না।”
মিতুল বিষয়টাকে ধামাচাপা দিতে চাইলো,
“ঠিক আছে থাক ওসব কথা। আমাকে এক গ্লাস সফট ড্রিঙ্কস বানিয়ে দাও। জানোই তো তোমার হাতের ড্রিঙ্কস প্রিয় আমার।”
মিতুল একটু উজ্জ্বল হাসি উপহার দেওয়ার চেষ্টা করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলো।
রুমের দরজা খুলে রুমে ঢুকতে গিয়ে দেখলো বাড়ির ডলের মতো সাদা লোমের বিড়ালটা ঠিক ওর পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। চুপিচুপি কখন যেন এসেছে পিছু পিছু। মিতুল বিড়ালটাকে কোলে তুলে নিলো। কী কিউট! বিড়ালটা আপোষেই ওর কোলে চলে এসেছে। ও বিড়ালের সাথে ভাব জমাতে চাইলো।
“হোয়াট’স ইওর নেইম?”
বিড়াল তো আর মিতুলের কথার উত্তর দিতে পারে না। আর এই বিড়ালটি এতটাই শান্ত যে মিউ মিউ করেও ডাকলো না একবার।
“ভালোই। তবে এখানের দর্শনীয় স্থান গুলো তো এখনও দেখা হয়নি আমার।”
জায়িন কথা বলার মতো আর কিছু পাচ্ছে না। কী বলা উচিত বুঝতে পারছে না ঠিক!
মিতুলও জায়িনের নীরবতা দেখে আর কিছু বলতে পারছে না।
জায়িন বলার মতো কিছু না পেয়ে কয়েক সেকেন্ড নীরব দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল।
যা অপমানজনক হলো মিতুলের জন্য। একটা মানুষ এভাবে কীভাবে চলে যেতে পারে? ওর কথার জবাবে কিছু তো অবশ্যই বলা উচিত ছিল তার। আবারও কি নিজের অহংকার দেখালো না কি? অপমান করার জন্যই কি কিছু বললো না?
মিতুল বুঝতে পারছে না এই অপমান জিনিসটা ওকে ছাড়তে ছাড়তেও ছাড়ে না কেন!
__________________
রাতের অন্ধকারে আবারও একবার জোহানকে জঙ্গলের ভিতর ঢুকতে দেখবে ভাবতে পারেনি মিতুল। আজকে স্পষ্ট দেখেছে জোহানকে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকতে। জোহানের পরনে খয়েরি টি শার্ট আর কালো প্যান্ট ছিল। বিকেলে ওই পোশাকই পরা দেখেছিল জোহানকে। আজকে জোৎস্না ছিল না, গার্ডেনের লাইট জ্বলছিল। তাতেই স্পষ্ট দেখতে পায় জোহানকে। ঘটনাটা মিতুল দেখে কিচেনে বসে। ফ্রিজ থেকে জুস নিতে এসেছিল কিচেনে। তখন ব্যাক সাইডের জানালা থেকে গার্ডেনে চোখ পড়ে। প্রথমে মানুষটি কে তা বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল কেউ হয়তো গার্ডেনে হাঁটাহাঁটি করছে। কিন্তু হঠাৎ করে কেন যেন ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হয়নি ওর। ও ছুটে যায় জানালার কাছে। জোহান তখনও ঢুকে পড়েনি জঙ্গলে। জঙ্গলে ঢোকার রাস্তা থেকে খানিক দূরে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে জোহানের দেহটি সেদিনের মতো জঙ্গলের অন্ধকারে তলিয়ে যায়। মিতুল ওই মুহূর্তে অনুভব করে ভয়। ভীষণ ভয়। এতটাই ভয় পেয়েছিল যে হাত-পা অসাড় লাগছিল ওর। মনে হচ্ছিল আর দাঁড়াতে পারবে না। নিজের সব শক্তি শেষ হওয়ার আগে ছুটে আসে নিজের রুমে।
মিতুলের হৃদয় ভয়ে দুরুদুরু করছে এখনও। ওই জঙ্গলে যাওয়ার রহস্যটা কী? জোহান কেন যায় ওই জঙ্গলে?
মিতুলের মনে হচ্ছে আর যাই হোক না কেন ওই জঙ্গলে ভালো কিছু নেই। যা আছে তা কেবল মানুষের ভয়ের কারণ। কিন্তু ভয়ের মতো কী আছে ওই জঙ্গলে? মিতুল ভেবে উঠতে পারে না।
রাতে ওই ঘন কালো জঙ্গলে ঢোকা নিশ্চয়ই মুখের কথা নয়। আর কেনই বা ঢুকবে? তাও একদিন নয়, দুই দুই দিন দেখলো ঢুকতে। আচ্ছা…ও কোনো সিরিয়াল কিলারের কাছে এসে পড়েনি তো? জোহান কোনো সিরিয়াল কিলার নয়তো? যে মানুষকে হত্যা করে ওই জঙ্গলে লাশ গুম করে দেয়?
কথাটি মনে হতে মিতুল আঁতকে ওঠে। মুখ তীব্র ভয়ের ভীত ছায়ায় ছেয়ে যায়। আতঙ্ক চেপে ধরে চারিদিক থেকে। হাত-পা কাঁপতে শুরু করে। শরীর ঘামতে থাকে অনবরত। দু চোখে ভয়, মনে সংশয়, ক্ষুদ্র জীবনের মায়া মিতুলকে অসহনীয় যন্ত্রণার গভীর কূপে ঠেলে দেয়।
সত্যিই ওই জঙ্গলে কী আছে?
সকালের মিষ্টি রোদের আমেজ ছড়িয়ে আছে এডমন্টনে। রেশমী আন্টিদের বাড়িটাও হাসছে সোনালি প্রভাত কিরণে। কিচেনের উইন্ডো থেকে মিষ্টি কিছু রোদ প্রবেশ করে জায়িনের মুখ ছুঁয়েছে। ফরসাজ্জ্বল মুখে খুবই ছোটো আকারের দাড়ি, হালকা খয়েরি ঠোঁট, গাঢ় কালো ভ্রু এবং কালো লেন্সের জায়িনকে আজকে সব দিনের থেকে বেশি সুন্দর দেখাচ্ছে। জায়িনের পরনে গ্লো পিঙ্ক টি-শার্ট এবং হোয়াইট ট্রাউজার। ক্যামিলার পাশে দাঁড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলছে। ঠোঁট দু পাটির আড়াল থেকে ঝিলিক দিচ্ছে সাদা চিকচিকে দাঁতগুলো। জায়িন হাসলে ওর চোখের পাশে একটু ভাঁজ পড়ে। যেটা দেখতে আরও বেশি ভালো লাগে। মিতুল এর আগে কখনও এত ভালো করে খেয়াল করে দেখেনি জায়িনকে। কিন্তু আজকে কেন যেন জায়িনকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। হয়তো জায়িনের বলা বাংলায় মুগ্ধ হয়ে ওকে এভাবে পরখ করছে। আজকে প্রথম জায়িনের মুখে বাংলা শুনেছে মিতুল। জায়িনের বলা বাংলা ছিল, ‘ঠিক আছে ড্যাড, আমি কিছুক্ষণ পরেই বেরিয়ে পড়বো।’
কথাটি সাদাত আঙ্কলের সাথে ফোনে বলেছিল জায়িন।
মিতুল কখনও আশা করেনি জায়িন এত সুন্দর করে শুদ্ধ বাংলা বলবে। যদিও আগে জোহান বলেছিল বাংলা ভাষা শেখা ওদের ফ্যামিলিতে বাধ্যতামূলক। তবুও বিদেশে জন্ম, বিদেশে বেড়ে ওঠার পরও এত স্পষ্ট, শুদ্ধ বাংলা বলা সত্যিই অবাক এবং মুগ্ধ করেছে মিতুলকে।
জায়িন কফির মগ নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে কিচেন থেকে। মিতুল তখনও তাকিয়ে আছে ওর দিকে। জায়িন দরজার কাছে দাঁড়িয়ে হঠাৎ মিতুলের দিকে তাকালো।
জায়িনের হঠাৎ করে তাকানোতে থতমত খেয়ে গেল মিতুল। অপ্রস্তুত ভাবে হাসলো একটু। জায়িনেরও উচিত ছিল একটু হাসা। মন থেকে হাসতে না পারলেও মুখে একটু হাসা উচিত ছিল অন্তত। কিন্তু ও হাসলো না। অহংকারী গোমড়া মুখ নিয়েই ভাব দেখিয়ে চলে গেল। মিতুলের একটু আগেও যে মুগ্ধতা ছিল জায়িনের প্রতি এখন আর সেটা রইল না। এত অহংকারী এই দুই ভাই! অহংকারে মাটিতে পা পড়ে না এদের। একজনও ভালো নয়। খুব খারাপ এরা!
ব্যাক সাইডের জানালার দিকে মিতুলের চোখ পড়লো আরও একবার। জানালা থেকে দেখা যাচ্ছে গার্ডেনের টিউলিপ ফুলগুলো হাসছে সোনালি রোদের সাথে। মিতুলের ধারণা বাড়ির ভিতরে সব থেকে ভালো পজিশনে রয়েছে এই কিচেনটা। কিচেনটা বেশ বড়ো। কিচেনের একটা জানালা দিয়ে তাকালে দেখা যায় বাড়ির পিছনের সুরভিত ফুলময় গার্ডেন। আরেকটা জানালা দিয়ে দেখা যায় বাড়ির সামনের লন। কিচেনটা বাড়ির সামনেও নজর রাখছে, আবার পিছনেও নজর রাখছে। ব্যাক সাইডে একটা গ্লাস ডোরও আছে। যেটা দিয়ে বের হলেই গার্ডেন।
মিতুলের নাকে খাবারের মিষ্টি সুগন্ধ এসে লাগছে। চুলোতে বিফ বিরিয়ানি এবং পায়েস রান্না হচ্ছে। ক্যামিলাই রান্না করছে। বাঙালি দম্পতির সাথে থাকতে থাকতে এসব রান্নাও শিখে গেছে সে। তবে আজকে এটা স্পেশালি ওর জন্য রান্না হচ্ছে। রেশমী আন্টি রান্না করতে বলেছেন ক্যামিলাকে।
রেশমী আন্টির কথা মনে হতেই রেশমী আন্টি কোত্থেকে যেন উদয় হলেন কিচেনে। কিচেনে প্রবেশ করলেন না, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এক গ্লাস লেবুর শরবত অর্ডার করে চলে গেলেন।
মিতুল আরও কিছুক্ষণ কিচেনে বসে বসে ক্যামিলাকে দেখলো। তারপর কফি পূর্ণ মগ নিয়ে চলে এলো কিচেন থেকে।
লিভিং রুমে এসে জোহান বদমাইশটাকে দেখতে পেল। সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে আসছে। মিতুলের কালকের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল। কীভাবে এই জোহান ওকে অপমান করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিল! কথাটা মনে হতে জোহানের জন্য মিতুলের ঘৃণার পালাটা আরও বেশি বাড়তে লাগলো।
জোহানের পরনে হোয়াইট কালারের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট এবং হোয়াইট কালারের একটা টি শার্ট। পায়ে এক জোড়া স্নিকার্স। মাথার বাদামি চুলগুলো এলোমেলো। নবাবজাদা বোধহয় এই মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। কী আর করবে, খেয়েদেয়ে তো আর কোনো কাজ নেই। জায়িনের মুখেই তো শুনেছিল সারাদিন ধেইধেই করে বাইরে ঘুরে বেড়ায়। বদমাইশ কোথাকার!
মিতুল সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে প্রায় সিঁড়ির মাঝামাঝি জোহানের কাছে চলে এসেছে। জোহানের পাশ দিয়ে যেতেও এখন সর্বাঙ্গ জ্বলে যাচ্ছে ওর। আল্লাহ ওকে এই জোহানের সামনা সামনিই আর না করুক।
মিতুল মাথা নিচু করে জোহানের পাশ থেকে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু জোহান এর মাঝে একটা কাণ্ড করে বসলো। হাঁটতে হাঁটতে মিতুলের হাত থেকে কফির মগটা নিয়ে নিলো। আর এমন ভাবে নিলো যেন তার জন্য ট্রেতে করে নিয়ে আসা কফির মগটা তুলে নিয়েছে সে।
মিতুল ভেবে রেখেছিল জোহানের সাথে আর কথা বলবে না। কিন্তু আকস্মিক এমন ঘটনায় পিছন ফিরে বলে উঠলো,
“এটা কী হলো?”
জোহান এতক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেছে। মিতুলের দিকে নির্লিপ্ততকার ভাবে তাকিয়ে বললো,
“কী হলো?”
মিতুল অতিক্রম করে আসা সিঁড়ির ধাপগুলো বেয়ে আবার নিচে নেমে জোহানের সামনে এসে দাঁড়ালো। বললো,
“তুমি একটা কাক না কি? মানুষের খাবার চুরি করে খাওয়ার অভ্যাস তোমার?”
“বেশি কথা বলো না। নয়তো এটা তোমার মাথায় ঢেলে দেবো।”
“তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? আমাকে?”
“ভয় দেখাচ্ছি না, হুঁশিয়ার করছি তোমায়।”
“আন্টির কাছে তোমার বিরুদ্ধে নালিশ দেবো আমি। কী ভেবেছো তুমি? গাড়ি থেকে নামিয়ে দেবে মাঝপথে, এখন আবার কফি চুরি করছো, আমি কি মুখ বুজে থাকবো?”
“কথায় কথায় বাংলাদেশ টানবে না একদম। নিষেধ করে দিলাম আজকে।”
“কী করবে টানলে? একশ বার টানবো আমি। দেখি তুমি কী করতে পারো!”
“কী করবো আমি সেটা দেখছে চাইছো? আমি তোমাকে…”
“কী করবে?”
“আমি তোমাকে ঘুসি…”
“কী হচ্ছে এখানে?” মিতুলের কথার মাঝে অন্য একটি শান্ত, গম্ভীর পুরুষ কণ্ঠ কথা বলে মিতুলকে থামিয়ে দিলো।
মিতুল, জোহান দুজনেই তাকালো সিঁড়ির দিকে। সিঁড়িতে জায়িন দাঁড়িয়ে আছে। হাতে অফিস ক্যারি ব্যাগ। পরনে নীল স্যুট। অফিসে যাওয়ার জন্য একেবারে তৈরি সে।
জায়িনকে দেখে একেবারে চুপ হয়ে গেল মিতুল। জায়িন আর তিনটে ধাপ পার হয়ে হলরুমে পা রাখলো। দুজনের দিকেই চোখ বুলালো একবার। তারপর জোহানের দিকে এগিয়ে এলো। জোহানের কাঁধে হাত রেখে শান্ত, গম্ভীর কণ্ঠেই বললো,
“নিজের কাজ কর। অন্যের সাথে ঝামেলা করিস না। এমনিতেই যে ঝামেলা পাকাস তাই ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়।”
জোহান ভাইয়ের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইল প্রায় কয়েক সেকেন্ড। জায়িনও তাকিয়ে রইল।
দুই ভাইয়ের কারো চাহনিই স্বাভাবিক মনে হলো না মিতুলের কাছে। একটু কেমন যেন! দুই ভাইয়ের ওই রকম চাহনি দেখে মিতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল।
জোহান জায়িনের থেকে চোখ সরিয়ে নিলো, তারপর মিতুলের দিকে তাকালো হুট করে। জায়িনও তাকালো।
একই সাথে দুই ভাইয়ের চাহনিতে মিতুল একেবারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। জায়িন নিশ্চুপ তাকিয়ে রইল। জোহান বললো,
“ঘুসি মারবে তুমি আমাকে, তাই না?”
মিতুল বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। আর জায়িনের শান্ত চোখের পর্যবেক্ষণে থতমত খাচ্ছিল বার বার।
_________________
ব্রেকফাস্টের জন্য ডাইনিং রুমে যাচ্ছে মিতুল। ডাইনিংরুমে জোহান বসা। জোহানকে দেখে মিতুলের ফিরে যেতে মন চাইলো। কিন্তু ক্যামিলা মিতুলকে দেখা মাত্রই খাওয়ার জন্য স্বাগত জানালো। এখন চলে যাওয়াটাও ঠিক ভালো দেখায় না। মিতুল জোহানের বিপরীত দিকের একটা চেয়ারে বসলো। ক্যামিলা খাবার সার্ফ করছে। জোহান এতক্ষণ মোবাইলে মুখ ডুবিয়ে ছিল। এবার রেখে দিলো মোবাইলটা। টেবিলে বিরিয়ানি দেখে নাক ছিটকিয়ে বললো,
“উহম, এসব কী?”
ক্যামিলা বললো,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড জোহান?”
“সিস(সিস্টার) এসব খাবার কেন সার্ফ করেছো তুমি? তুমি তো জানো আমি এই খাবারটি পছন্দ করি না।” জোহানের কণ্ঠে বিরক্তির সুর।
“জানি তো। আর সেই জন্যই তো তোমার জন্য স্যান্ডউইচ তৈরি করেছি আমি।”
ক্যামিলা জোহানের ঠিক সামনে স্যান্ডউইচের প্লেটটি দেখিয়ে দিলো। জোহান মোটেই খেয়াল করেনি এটি। জোহান ক্যামিলাকে ধন্যবাদ জানালো,
“ধন্যবাদ সিস। একমাত্র তুমিই আছো যে আমার খেয়াল রাখে। বাকিরা তো প্রায় ভুলেই যায় যে আমি এই বাড়ির একজন সদস্য! ধন্যবাদ তোমাকে।”
জোহানের কথা শুনে মুখ বাঁকালো মিতুল। ইশ কী ঢং করে কথা বলছে দেখো! যত্তসব!
“কিন্তু আমি এখানে বসে মোটেই খেতে পারব না।” জোহানের কণ্ঠে রাজ্যের বিরক্তি।
“কেন?” অবাক হয়ে জানতে চাইলো ক্যামিলা।
জোহান মিতুলের দিকে চাইলো একবার। তারপর বিরিয়ানির দিকে চোখ রেখে বললো,
“চোখের সামনে এই খাবারটা দেখলে আমার গা রি রি করে ওঠে। আর এই খাবারের স্মেলটা আমার মাথায় পেইন উঠিয়ে দিচ্ছে। একদম সহ্য হয় না এই স্মেল। এত বাজে স্মেল এই খাবারটার!”
জোহান বিরিয়ানি পছন্দ করে না তেমন সেটা ঠিক। তবে বিরিয়ানির স্মেলটা ওর বেশ ভালোই লাগে। একটু-আধটু খায়ও মাঝে মাঝে। আজ শুধু মিতুলকে শোনানোর জন্য বিরিয়ানি নিয়ে এত কিছু বললো।
জোহানের কথা শুনে মিতুলের চোখ কপালে উঠলো। বাজে স্মেল? এত সুন্দর স্মেলকে কেউ বাজে বলে? এই হয়তো প্রথম ব্যক্তি যে বিরিয়ানির সুবাসকে বাজে বলছে। কী আর করবে, বিদেশে থাকে তো তাই ঢঙে বাঁচে না।
ক্যামিলা জোহানের কথা শুনে হাসলো। বললো,
“ঠিক আছে, তোমাকে এই বাজে স্মেলের খাবারের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করতে হবে না। নিজের রুমে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করো তুমি।”
জোহান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আর সেই সঙ্গে ওর ফোনটাও বেজে উঠলো। মোবাইলের স্কিনে রিকার্ডোর নাম দেখা যাচ্ছে। জোহান কল রিসিভ করে বললো,
“হেই, কী খবর?”
“উই আর ব্যাক…” ওপাশ থেকে খুব চ্যাঁচানো উচ্ছ্বসিত পূর্ণ একটি ছেলে কণ্ঠ শোনা গেল।
জোহান আনন্দঘন কণ্ঠে বললো,
“আমি এখনই তোদের সাথে মিট করার জন্য আসছি, এখনই।”
উত্তেজিত পূর্ণ ভাবে দৌড়ে বেরিয়ে গেল জোহান। ওর স্যান্ডউইচ অবহেলায় পড়ে রইল প্লেটে। মিতুল অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। জোহানের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পেরেছে যে ওর ফ্রেন্ডসরা পিকনিক করে গ্রাম থেকে এসে পড়েছে। কিন্তু ও বুঝতে পারছে না, এতে এত লাফালাফি করার কী আছে? এমন একটা ভাব করছে যেন ওর একারই বন্ধু আছে। আর মানুষের কোনো বন্ধু নেই বা ছিল না কোনো দিন।
___________________
আজকের দিনটি বেশ রৌদ্রোজ্জ্বল। ফুরফুরা বাতাস, আর গাছে গাছে রঙিন ফুল জানান দিচ্ছে বসন্ত উৎসব চলছে এখন এখানে। আহ, আশপাশ কী সুন্দর মোহনীয়! দেখলে নয়ন জুড়ায়। মিতুল লক্ষ করলো আশেপাশে নজর বুলাতে বুলাতে ও ক্যামিলার থেকে বেশ পিছনে পড়ে গিয়েছে। দৌড়ে গিয়ে ক্যামিলার সাথে মিলিত হলো আবার। ক্যামিলার সাথে গ্রোসারি শপে যাচ্ছে ও।
ক্যামিলা মিতুলের আনন্দিত মুখ লক্ষ করে বললো,
“কী কানাডা কেমন লাগছে তোমার?”
“দারুণ।”
“আশা করি জোহান তোমাকে ভালো ভাবে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে এডমন্টনের সবকিছু।”
জোহানের কথা মনে উঠতেই মিতুলের মন খারাপ হয়ে গেল।
“সবকিছু ভালো করে ঘুরিয়ে দেখিয়েছে না ছাই! ও আবার মানুষকে ঘোরাতেও জানে না কি?”
ক্যামিলা হেসে ফেললো।
“ঠিক আছে, ওর সাথে ঘুরে মন না ভরলে আমি তোমাকে সব ঘুরিয়ে দেখাবো।”
“সত্যি?”
“হ্যাঁ।”
একটু নীরবতা গেল। ক্যামিলা নীরবতা ভেঙে বললো,
“ওহ হ্যাঁ, একটা কথা তো বলা হয়নি তোমাকে। আগামী উইকেন্ডে বারবিকিউ পার্টি হবে।”
“বারবিকিউ পার্টি?”
“হ্যাঁ। মাঝে মাঝেই উইকেন্ডে নেইবরহুডেরা মিলে সবাই এক সঙ্গে পার্টি করে থাকে। অনেক মজা হয়ে থাকে ওই পার্টিতে। বাকি দিন গুলোতে সবাই ব্যস্ত থাকে, এক জায়গায় বসা হয় না, সময় কাটানো হয় না, তাই উইকেন্ডে এই বারবিকিউ পার্টির আয়োজন।”
ক্যামিলা মিতুলকে তাদের বারবিকিউ পার্টির ব্যাপারে বলতে লাগলো বিস্তারিত। এই একই বিষয়ে কথা বলতে বলতে শপ পর্যন্ত পৌঁছে গেল ওরা।
শপে ঢুকে বড়োসড়ো রকমের একটা ঝটকা খেল মিতুল। প্রথমে চোখের ভুল ভেবেছিল, কিন্তু কার্ল ওকে দেখে নিজেই যখন এগিয়ে এলো তখনই স্পষ্ট হলো ব্যাপারটা। মিতুল অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
“তুমি এখানে? তোমার ডিউটি নেই?”
“আজকে ছুটি আমার। আজকের দিনে সাধারণত ডিউটি করি না আমি।”
“ওহ…”
“তোমার সাথে সে কোথায়? আজকে সাথে আসেনি?” জোহানের কথা বললো কার্ল।
“না।”
“সেদিন তো তোমার সাথে পরিচিত হওয়া হয়নি ভালোভাবে। আজকে সময় হবে?”
কার্লকে কী বলবে বুঝতে পারলো না মিতুল। ক্যামিলার সাথে বের হয়েছে, এখন ক্যামিলাকে একা যেতে বলে ও থাকে কী করে?
মিতুল যখন দ্বিধায় ভুগছিল তখন ক্যামিলাকেই বলতে শোনা গেল,
“ঠিক আছে মিতুল, তুমি তোমার বন্ধুর সাথে গল্প করো সময় নিয়ে। তোমাদের আড্ডা শেষ হলে আমাকে ফোন করো, আমি গাড়ি পাঠিয়ে দেবো তোমায় নেওয়ার জন্য।”
কথাগুলো বলে ক্যামিলা ওদেরকে সুন্দর গল্প আসরের শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে গেল।
গ্রোসারি শপ থেকে বের হয়ে কাছেই একটা কফি শপে বসলো ওরা।
জোহান বন্ধুদের সাথে একটা তিনতলা রেস্টুরেন্ট থেকে হাসাহাসি করতে করতে বের হলো। অনেক বন্ধু ওর। অনেকেই নিজেদের গাড়ি নিয়ে বের হয়েছে। জোহানের গাড়িতে উঠলো তিনজন। রিকার্ডো, সারা, জেমস। জোহানের গাড়ি রাস্তায় পার্কিং সাইডে পার্ক করে রেখেছিল। জোহান দরজা বন্ধ করতে গিয়ে ওর পার্ক করে রাখা গাড়ি বরাবর রাস্তার ওপাশে একটা কফিশপের নিচতলায় চোখ পড়তে চোখ আটকে গেল ওর। গ্লাস ওয়াল থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, একটা মেয়ে এবং একটা ছেলে বসে আছে। মেয়েটির মুখে হাসি এবং ছেলেটার মুখেও মৃদু হাসি। দৃশ্যটা একদম সহ্য হলো না জোহানের। ইচ্ছা করলো মেয়েটাকে এখনই টেনে নিয়ে আসে ওখান থেকে।
সকাল সকাল বাড়িতে এক অপরিচিত মুখের আগমন ঘটেছে। অচেনা মুখের ব্যক্তিটির নাম ফ্রেডি। জায়িনের বন্ধু হয়। ছেলেটাকে খুব একটা ভালো লাগেনি মিতুলের। কেমন যেন ছেলেটা! ঠিক কেমন সেটা বোঝাতে পারবে না। ছেলেটা নিজ থেকে পরিচিত হতে এসেছে মিতুলের সাথে। হ্যান্ডশেকের জন্য হাত বাড়িয়ে আছে ওর দিকে।
মিতুলের হ্যান্ডশেক করতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এখানে হ্যান্ডশেক না করাটা হয়তো অভদ্রতার সহিত দেখা হয়। মিতুল যখন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে হ্যান্ডশেকের জন্য কেবল হাত উঠাতে যাবে, ঠিক সেই সময়ে কোত্থেকে যেন উদয় হলো জোহান। ঝড়ের গতিতে এসে হ্যান্ডশেকের জন্য ফ্রেডির বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে হ্যান্ডশেক করলো জোহান। ফ্রেডিকে বুকে টেনে নিয়ে পিঠে জোরে কয়েকটা চাপড় বসিয়ে দিয়ে বললো,
“হেই ব্রো, হোয়াট’স আপ?”
জোহানের এমন আগমনে অবাক ফ্রেডি, অবাক মিতুলও। জোহান এত শক্ত করে ফ্রেডিকে ধরে রেখেছে যে, ফ্রেডি ব্যথা অনুভব করছে। তাছাড়া জোহানের চাপড়গুলোও ছিল আক্রমণাত্মক। ফ্রেডি দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো জোহানের থেকে। মুখে এক টুকরো বাধ্য হাসি ফুটিয়ে বললো,
“এইতো ভালো। তোমার কী খবর?”
জোহানের মুখ থেকে চঞ্চল বুলি ফুটলো,
“আমি তো একটি শান্তিপ্রিয় ছেলে। সব সময় ভালোই থাকি।”
“তা যদি ভালোই থাকো তাহলে মুখের ওই দাগগুলো কীসের?”
মিতুল জোহানের মুখের দিকে তাকালো। জোহানের মুখে এখনও মারের দাগ আছে। সেদিনের মতো গাঢ় নেই, হালকা হয়ে গেছে। জোহানকে মারলো কে সেটা এখনও বুঝে উঠতে পারছে না ও। কারো কাছে জিজ্ঞেস করারও সাহস পাচ্ছে না। কথাটা কে কীভাবে নেবে জানে না ও।
জোহান নিজের ঠোঁটের কোণে ক্ষত স্থানটা স্পর্শ করে বললো,
“আরে ব্রো, জানোই তো এগুলো স্বাভাবিক আমার সাথে। তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ঘরে গিয়ে বসবে চলো।”
জোহান এক হাত দিয়ে ফ্রেডিকে টেনে নিয়ে যাওয়া দিলে ফ্রেডি হাত ছাড়িয়ে নিলো। বললো,
“জায়িনের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। দেখা হয়ে গেছে ওর সাথে। এই ফাইলটা নেওয়ার ছিল শুধু, পেয়ে গেছি এটা। সুতরাং বসবো না। আমার ইম্পরট্যান্ট কাজ আছে। যেতে হবে। আসছি আমি। পরে দেখা হবে আবার।”
মিতুলকে লক্ষ করে বললো,
“আশা করছি তোমার সাথেও দেখা হবে আবার।”
জোহান এবং মিতুল দুজনের দিকে তাকিয়ে দু বার ‘বাই’ জানালো ফ্রেডি। তারপর দ্রুত পায়ে একরকম পালিয়ে যাওয়ার মতো করে চলে গেল।
মিতুল অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ফ্রেডির চলে যাওয়ার দিকে। এমন করে চলে গেল কেন ফ্রেডি? জোহানকে নিশ্চয়ই পছন্দ করে না? মিতুল জোহানের দিকে তাকালো। এই জোহান এমন যে মানুষ এড়িয়ে চলে ওকে?
মিতুলকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জোহান বললো,
“হোয়াট? এমন করে দেখছো কেন?”
“কেন, তোমাকে দেখলেও এত সমস্যা?” কথাটা বলে ঘরের দিকে হাঁটা দিলো মিতুল।
__________________
জোহানের ব্ল্যাক কারটি এগিয়ে চলছে। গাড়ির ভিতর ভীষণ নীরবতা। ড্রাইভিং সিটে বসে রোবটের মতো গাড়ি ড্রাইভ করছে জোহান। আজকে গান-টানও ছাড়েনি। কিন্তু মিতুলের এই সময় গানের খুব প্রয়োজন ছিল। জোহানকে এখনও সেই রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেনি ও। ঠিক কীভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। অনেক ভেবে-টেবে বলার একটা রাস্তা বের করলো। জোহানকে প্রথমে সহজ গলায় বললো,
“আমরা কি একটা রেস্টুরেন্টে যেতে পারি?”
জোহান অবাক হয়ে মিতুলের দিকে তাকালো একবার। তারপর আবার চোখ সরিয়ে নিয়ে বললো,
“কেন? রেস্টুরেন্টে কী কাজ আমাদের?”
“আমি ক্ষুধার্ত। ব্রেকফাস্ট করা হয়নি আমার। যখন ব্রেকফাস্ট করতে যাব ঠিক তখনই দেখলাম তুমি ঘর থেকে বের হচ্ছ। তাই ব্রেকফাস্ট না করেই তোমার সাথে দৌড় দিতে হলো।”
মিথ্যা বলেছে মিতুল। ব্রেকফাস্ট করেছে ও। রেশমী আন্টি নিজের সাথে বসিয়ে ব্রেকফাস্ট করিয়েছে ওকে। কিন্তু এখন মিথ্যা বলা ছাড়া উপায় ছিল না। যে করেই হোক আজকে সেই রেস্টুরেন্টে যেতেই হবে।
জোহানকে কিছুটা বিরক্ত নিয়ে বলতে শোনা গেল,
“তোমরা বাংলাদেশি মেয়েরা দেখছি আসলেই কোনো কাজের না। ঠিক আছে, তোমাকে এডমন্টনের সেরা একটা রেস্টুরেন্টে নিয়ে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করাবো আজ। বলো কোন রেস্টুরেন্টে যাবে? আমার মনে হয় আমাদের লা রোনডে’তে যাওয়া উচিত। ওখানের খাবার বেশ ইয়াম্মি হয়।”
মিতুল বাগড়া দিয়ে বললো,
“কেন? আমাদের সেখানে যেতে হবে কেন? আমরা তো সেদিন যে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম সেখানেও যেতে পারি। সেটাও তো একটা সেরা রেস্টুরেন্ট।”
জোহান ভ্রু কুঁচকে সন্দিগ্ধ চোখে তাকালো।
“হঠাৎ করে সেখানে যেতে চাইছো কেন? কাহিনি কী?”
জোহানের চাহনি দেখে মিতুলের মনে হলো জোহান ওর মনের কথা সব পড়ে ফেলবে। এই জোহানকে যতটা আহাম্মক মনে করেছিল আসলে ততটা আহাম্মক নয় সে। কিন্তু মিতুলও কম চালাক নয়। মুহূর্তেই একটা মিথ্যা বুঝ দিয়ে দিলো,
“আসলে সেই রেস্টুরেন্টের পিরি পিরি প্রন্সটা সুস্বাদু ছিল খুব। সেই খাবারের স্বাদটা আরেকবার নিতে চাইছি আমি। এর আগে যত খেয়েছি ওই রেস্টুরেন্টের মতো এত টেস্ট ছিল না তাতে।”
মিতুলের কথা ঠিক বিশ্বাস হলো না জোহানের। তবুও মিতুলের কথা মেনে নিয়ে সেই রেস্টুরেন্টের পথ ধরলো।
মিতুলের বাম হাতের হেয়ার রাবারটা খেয়াল হলো জোহানের। ও অবাক হয়ে জানতে চাইলো,
“এটা কি হেয়ার রাবার না? হেয়ার রাবার হাতে পরে ঘুরে বেড়াচ্ছ কেন তুমি?”
মিতুল নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ওহ! এটা? আসলে কী বলো তো, মাঝে মাঝে আমি না খুব গরম অনুভব করি। আর গরমে আমি একদমই খোলা চুলে থাকতে পারি না। সে জন্যই এটা সাথে নিয়েছি। যখন-তখন গরম লাগলে যেন চুল বেঁধে ফেলতে পারি।”
মিতুলের মনে হলো ও বানিয়ে বানিয়ে ভালোই কথা বলতে পারে। মনে মনে ফিচেল হাসলো মিতুল।
রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছে গেছে ওরা। মিতুলের মনে উত্তেজনা, উদ্দীপনার ঝড় বইছে। রেস্টুরেন্টে পদার্পণ করেই ওর আঁখি সেই ধূসর চোখ জোড়াকে দেখার পিপাসায় মরিয়া হয়ে উঠলো। এদিক থেকে ওদিক খুঁজে চোখ জোড়া শান্ত হলো অবশেষে। হাসি ফুটলো ঠোঁটের কোণে। ওইতো সে…
একটা টেবিলে খাবার সার্ফ করছে ধূসর চোখের মানুষটি। মিতুলের মনে আনন্দঘন মেঘের আনাগোনা চলছে। শরতের আকাশে থাকা সাদা পেজা তুলোর মতো গাঢ়, ঘনত্ব সেই মেঘ। ছেলেটিকে লক্ষ করতে করতেই জোহানকে অনুসরণ করে মধ্যম সারির একটা চেয়ারে জায়গা করে নিলো মিতুল। এখনও ধূসর চোখাকে দেখে চলেছে চুপিচুপি। সেদিনের মতো একজন ওয়েটার অর্ডার নেওয়ার জন্য এগিয়ে এলো।
জোহানের এখন খাওয়ার মুড নেই, তাই শুধু চিজ কেক অর্ডার করলো। অর্ডার করে মিতুলের দিকে তাকাতে দেখতে পেল মিতুলের ধ্যানজ্ঞান কিছুই এখন এই টেবিলে নেই। ওর ধ্যানজ্ঞান সবকিছু এখন ওই দূরে কোথাও নিবেদিত। জোহান মিতুলের দৃষ্টি অনুসরণ করলো। রেস্টুরেন্টের একটা স্টাফের উপর চোখ আটকে গেল ওর। ছেলেটা একজন কাস্টমারের সাথে হেসে হেসে কিছু বলছে। জোহান মিতুলের দিকে তাকালো। মিতুলের চোখে মুগ্ধতার গভীর নলকূপ।
ব্যাপারটা লক্ষ করে জোহান ভীষণ চমকালো। ও একবার মিতুলকে দেখছে আর একবার ওই ছেলেটিকে। ওর বুঝতে বাকি রইল না মিতুলের এখানে আসার আসল কারণ কী! জোহানকে একই সাথে বিরক্তি এবং রাগে চেপে ধরলো। এই মুহূর্তে ভীষণ বিরক্ত বোধ হচ্ছে ওর। এই নাকফুলো মেয়েটা সত্যিই…
জোহান নিজের বিরক্তি, রাগকে সামাল দিয়ে মিতুলকে ডাকলো,
“হেই মিতুল!”
জোহানের ডাকে ধূসর চোখাকে দেখার অশান্ত তৃষ্ণার্ত মনকে জোহানের দিকে স্থির করতে হলো মিতুলের।
“হ্যাঁ, কী হয়েছে?”
জোহান জোরপূর্বক একটু হাসার চেষ্টা করে বললো,
“পিরি পিরি প্রন্সের স্বাদ নিতে এসে এখানে আবার কোন মধুর স্বাদে হারিয়ে গেলে? অর্ডার করবে না কিছু?”
“ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ…” মিতুল অযথা একবার মেনু কার্ড হাতে তুলে নিয়ে এক ঝলক দেখে বললো,
“আমি পিরি পিরি প্রন্স এবং কোল্ড ড্রিঙ্কস চাই।”
ওয়েটার হালকা মাথা নিচু করে সম্মতি জানিয়ে অর্ডার নিয়ে চলে গেল।
মিতুলের মন এখন আর এই টেবিল অথবা জোহানকে ঘিরে থাকতে চাইছে না। ওর মন এখন ধূসর চোখার দিকে। ওর চোখও বার বার চলে যাচ্ছে তার উপর।
জোহান কিছু বলছে না, বিরক্ত মনে শুধু মিতুলকে দেখছে। এই মেয়েটা এত পাগল সেটা আগে জানা ছিল না ওর।
খাবার চলে আসে। মিতুল খাচ্ছে সেটা ঠিক, কিন্তু ওর মন পড়ে আছে ধূসর চোখের পিছনে। খাওয়ার পাশাপাশি শুধু চুপিসারে তাকেই দেখে গেল। এত ভালো লাগে কেন তাকে? কখনো সেই ধূসর চোখের মানুষটা সদৃশ্যমান হচ্ছে চোখের সামনে, আবার কখনো বা হারিয়ে যাচ্ছে।
খাওয়া শেষ হয়ে গেল। এবার যেতে হবে। মিতুলের যেতে ইচ্ছা করছে না। কিন্তু এখানে পার্মানেন্ট থাকার তো কোনো উপায় নেই। মিতুল ব্যথিত মন নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হওয়ার জন্য জোহানের পিছু পিছু দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দরজার কাছাকাছি এসে গেলে কেউ একজন পিছন থেকে ডেকে উঠলো। কণ্ঠটা পরিচিত লাগলো মিতুলের। তাৎক্ষণিক দাঁড়িয়ে গেল ও।
মিতুলের সামনে হাঁটতে থাকা জোহানও থেমে যায়।
মিতুল পিছনে ফিরে যা দেখলো তা আশা করেনি। দেখলো ওর প্রথম প্রেম, মানে সেই ধূসর চোখা ওর দিকে এগিয়ে আসছে। মিতুল অগাধ বিস্ময় এবং সেই সাথে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে আছে। ভালোবাসার কিছু রঙিন প্রজাপতি মিতুলের আশেপাশে ছড়িয়ে পড়লো।
ছেলেটা একেবারে মিতুলের সামনে এসেই থামলো। মিতুলকে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বললো,
“তুমি সেই মেয়ে না? যাকে হেয়ার রাবার দিয়ে সাহায্য করেছিলাম আমি?”
ছেলেটার কণ্ঠ মিতুলের মনে শিহরণ বইয়ে দিলো। যে মানুষটাকে এতক্ষণ চুপিচুপি দূর থেকে দেখছিল, সেই মানুষটা এখন হাস্যোজ্জ্বল মুখে ঠিক ওর সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। খুব কাছ থেকেই দেখছে তাকে। মিতুল মনে মনে বললো,
‘আহ, আমার প্রথম প্রেম!’
জোহানের ভ্রু জোড়া কুঁচকে উঠলো। মিতুলের চুলের দিকে চাইলো ও। মিতুল খাওয়ার আগে নিজের চুল বেঁধে নিয়েছিল হাতের সেই রাবার দিয়ে। তাহলে এই রাবার এই ছেলে দিয়েছে? আর সে জন্যই তাহলে এটা হাতে পরে রাখা!
ছেলেটা আবার বললো,
“সেদিন তোমার সাথে পরিচিত হওয়া হয়নি। ভেবে রেখেছিলাম এরপর তোমার সাথে আবার দেখা হলে পরিচয় পর্বটা সেরে নেবো। আমি কার্ল জোনাস।”
মিতুল যেন বসন্তের হাওয়ায় উড়ে বেড়াচ্ছে এখন। আহা! আজকের দিনটা এত সুন্দর কেন? ধূসর চোখার নাম শুনেও ওর অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। নামটা যে খুব বেশি সুন্দর তা নয়। কিন্তু এই নাম যেন ওর আজ পর্যন্ত শোনা সব নামের থেকে শ্রেষ্ঠ এখন। মিতুল মিষ্টি হেসে মৃদু কণ্ঠে বললো,
“আমি মিতুল দিলরাবা।”
“মি…মি…হোয়াট?” কার্ল মিতুলের নাম উচ্চারণ করতে পারলো না মোটেই।
মিতুল আবার কার্লের বোধগম্যতার জন্য বললো,
“মি…তুল দিল…রা…বা।”
“রা…রাবা?” কার্ল কোনো রকম উচ্চারণ করলো। তারপর নামটাকে কয়েকবার মনে মনে আওড়িয়ে বললো,
“তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে আমি কি তোমাকে ‘রাবা’ বলে ডাকতে পারি?”
মিতুল ভাবতে লাগলো, কেন ওকে সবাই মিতুল বলে ডাকে? এই রাবা নামটা কেউ কখনও বের করতে পারলো না কেন? এই রাবা ডাকটা কী সুন্দর! ওর নাম মিতুল দিলরাবা না হয়ে শুধু রাবা হলে কী ক্ষতি হতো? এই ডাক এত মিষ্টি কেন? মিতুল প্রশস্ত হেসে বললো,
“অবশ্যই তুমি আমাকে ‘রাবা’ বলে ডাকতে পারো। আমার কোনো আপত্তি নেই।”
কার্লও একটু হাসলো।
জোহান এতক্ষণ পিছনে দাঁড়িয়ে সব সহ্য করছিল। কিন্তু কেন যেন আর পারলো না। মিতুলকে টেনে পিছনে এনে নিজে কার্লের সামনে এসে দাড়ালো। চওড়া হেসে কার্লের সাথে হ্যান্ডশেক করতে করতে বললো,
“হাই ব্রো, আই অ্যাম জোহান।”
কার্ল উজ্জ্বল হেসে বললো,
“ওহ, নাইস টু মিট ইউ।”
জোহান একটু মাথা দোলালো। তারপর বললো,
“আসলে আমরা ব্যস্ত মানুষ। এত ডিটেইলসে পরিচিত হওয়ার সময় আমাদের নেই। আসছি আমরা। তুলতুল, লেট’স গো।”
কথাটা শেষ করে জোহান মিতুলের একহাত চেপে ধরলো শক্ত করে। কাউকে আর একটা শব্দও উচ্চারণ করতে না দিয়ে মিতুলকে জোরপূর্বক টেনে নিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে গেল।
________________
“তুমি এটা কেন করলে?” গাড়িতে বসে ক্ষুব্ধ গলায় প্রশ্ন করলো মিতুল। রাগে ফুঁসছে ও। রেস্টুরেন্ট থেকে প্রায় অনেক দূর চলে এসেছে ওরা। জোহানের এমন বেয়াদবি ওকে শান্ত রাখার বৃথা চেষ্টা পর্যন্ত করতে পারছে না।
“কী করেছি আমি?” নির্বিকার ভাবে জানতে চাইলো জোহান।
মিতুল গর্জে উঠলো,
“আমাকে কী মনে হয় তোমার? আমি কি তোমার পোষা প্রাণী? একটা পাবলিক প্লেস থেকে তুমি আমার হাত ধরে টেনে আনলে কেন ওভাবে? আমাকে কি তোমার হ্যান্ডব্যাগ মনে হয়? কী মনে করো কী তুমি নিজেকে? রাজপুত্র? না কি স্বয়ং রাজাই ভাবো নিজেকে? কী মনে করো, এটা তোমার রাজ্য? আর আমি তোমার রাজ্যের অসহায় একজন প্রজা? যার উপর উঠতে-বসতে শাসন চালাবে তুমি? শুনে রাখো একটা কথা, যদি তুমি নিজেকে রাজাই ভেবে থাকো, তাহলে তোমার ওই চিন্তা চেতনাকে রাজার দাস বানাতেও সময় লাগবে না আমার। অহংকারী বদমাইশ কোথাকার! আর হ্যাঁ, কার্লের সাথে এমন বাজে বিহেভ কেন করলে তুমি? হ্যাঁ? কেন করলে?” চাপা গর্জন করে উঠলো মিতুল।
রাগে দপদপ করা শিরা এবার সত্যিই জ্বলে উঠলো জোহানের। রাস্তার পাশে গাড়ি নিয়ে দ্রুত বেগে ব্রেক কষলো। সিট বেল্ট বাঁধা থাকা সত্ত্বেও বড়োসড়ো রকমেরই একটা ধাক্কা অনুভব হলো।
জোহানের এহেন কারবারে মিতুল অবাক হয়ে চাইলো ওর দিকে।
জোহান সামনে স্থির দৃষ্টি রেখে চোয়াল শক্ত করে বললো,
“বেরিয়ে যাও।”
“কী?”
“সহজ কথা বুঝতে পারছো না? গেট আউট অফ মাই কার!”
জোহান মিতুলের দিকে একটু ঝুঁকে এক হাত দিয়ে মিতুলের পাশের দরজাটা খুলে দিলো। রাগে জোহানের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস পড়ছে।
দু চোখে জ্বালা, বুক ভর্তি ঘৃণা আর রাগ নিয়ে কয়েক সেকেন্ড জোহানের দিকে তাকিয়ে রইল মিতুল। তারপর নিজের আত্মসম্মান নিজের কাছেই গুটিয়ে রেখে রাগ এবং জেদকে প্রধান্য দিয়ে ফট করে গাড়ি থেকে নেমে গেল।
মিতুল বেরিয়ে যেতেই জোহান দরজাটা টেনে বন্ধ করে দিলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দ্রুত বেগে চলে গেল বহুদূর।
মিতুল অদৃশ্যপ্রায় গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইল পলকহীন। অপমান, রাগে শরীর থেকে আগুন ছড়াচ্ছে। এই জোহান এত খারাপ, এত খারাপ, এত খারাপ যে তার প্রমাণ আজ ভালো করে পেল। এই কদিনে মনে হয়েছিল জোহান একটু ভালো হয়েছে। কিন্তু না, ভালো তো দূরের থাক বরং আরও বেশি বদমাইশ শয়তান হয়েছে। রেস্টুরেন্টে কার্লকে ইনসাল্ট করে ওকে টেনে নিয়ে আসলো! কার্লের সাথে একটু ভালো করে কথা বলতে দিলো না। এখন আবার মাঝপথে এত বড়ো অপমান করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিলো!
আজকে জোহানের সাথে বাইরে বের হওয়া ছিল জীবনের আরও একটা সবথেকে বড়ো ভুল। একারই বের হওয়া উচিত ছিল। মিতুল এই মুহূর্তে একটা শপথ নিলো, যে কদিন এই কানাডায় আছে তার মধ্যে একদিনও ওই অহংকারী ফ্যামিলির কারোর সাথে বাইরে বের হতে চাইবে না। বিশেষ করে ওই জোহানের সাথে। বয়কট করলো আজ থেকে জোহানকে। বয়কট জোহান!
জোহান এগিয়ে এলো মিতুলের কাছে। প্রায় এক হাতের মতো দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে বললো,
“এখানে কী করছো? একটু পর রাত নামবে, এখানে কী কাজ তোমার?”
মিতুল কী বলবে বুঝতে পারছে না। এখন জঙ্গলের ভিতর ঢুকতে চাওয়া ছিল বড়োসড়ো একটা বোকামি। এখন এই অন্ধকারে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে কী করতো ও? নিশ্চয়ই পথ হারিয়ে সারা রাত জঙ্গলেই কাটিয়ে দিতো! বোকা মেয়ে! দিনের বেলায় ঢুকতে চাইলেও একটা কথা ছিল, কিন্তু এই রাত্রি নামার ক্ষণে…
মিতুল চোখ তুলে জোহানের দিকে তাকালো। একটু আগে জোহানকে খানিক ভয়ংকর মনে হচ্ছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না। তবুও কেন যেন একটু ভয় লাগছে অবশ্য। জোহানের মুখে রাগের প্রলেপ নেই কোনো। গাম্ভীর্যের ছায়া দেখা যাচ্ছে একটু।
মিতুল মুহূর্তেই একটা কথা বানিয়ে বলে দিলো,
“আমি বনের ভিতরের গাছগুলো দেখছিলাম। আর কিছুই নয়।”
“গাছ কেন দেখছিলে? যেকোনো একটা গাছ চূজ করে তার সাথে প্রেম করতে চাইছিলে বুঝি?” কথাটা বলে গাম্ভীর্য মুখে ফিচেল হাসি ফোটায় জোহান।
মিতুল খানিক রেগে বললো,
“কীসব বলছো? গাছের সাথে আবার প্রেম করে কীভাবে?”
জোহান হাসি থামিয়ে মিতুলের আরেকটু নিকটে এসে দাঁড়ালো। একটু ঝুঁকে ছোট্ট(খাটো) মিতুলের সমানা হওয়ার চেষ্টা করে গলার স্বর খাদে নামিয়ে বললো,
“শোনো বেঙ্গলি মেয়ে, এই জঙ্গলে অনেক হিংস্র প্রাণী আছে। যাদের দেহ লোম দ্বারা আবৃত। যাদের আছে ধারালো বড়ো বড়ো দাঁত, বড়ো বড়ো নখ। যারা এক থাবায় তোমার বুক থেকে তোমার হৃৎপিণ্ড বের করে আনতে পারে। বুঝেছো? তোমার ছোট্ট মস্তিষ্কে ঢুকেছে আমার কথাগুলো?”
মিতুলের আত্মা ভয়ে শুকিয়ে যাচ্ছে। হিংস্র প্রাণীতে ওর ভয় লাগছে কি না জানে না, তবে জোহান যেভাবে বললো তাতে ভয়ের তীব্রতা আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে ছিল। মিতুল জোহানের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না, জোহানের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। জোহানকে এড়িয়ে দ্রুত পদে এগোতে লাগলো ঘরের দিকে। এক সেকেন্ডের জন্যও নিজের গতি থামালো না। এতটা দ্রুতই নিজের রুমের দিকে ছুটছিল যে, প্যাসেজ ওয়েতে বেখেয়ালে জায়িনের সাথে ধাক্কা লাগলো।
জায়িনের হাতে কিছু ফাইলপত্র ছিল, যা পড়ে যায় ফ্লোরে। মিতুল তাৎক্ষণিক দাঁড়িয়ে গেল এমন অপ্রত্যাশিত ঘটনায়।
জায়িন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হয়তো এত দ্রুত পদে ওর ছোটার কারণ ভাবছে সে। মিতুল জায়িনের থেকে চোখ সরিয়ে দ্রুত ফ্লোর থেকে ফাইলগুলো উঠিয়ে দিলো। স্যরি বললো জায়িনকে।
জায়িন কিছুই বললো না। কয়েক সেকেন্ড মিতুলের দিকে নীরব তাকিয়ে থেকে ফাইলগুলো নিয়ে নিচে নেমে গেল।
মিতুল মুখ বাঁকালো পিছন থেকে। ইশ, এমন একটা ভাব করে যেন রাজার ছেলে রাজপুত্র এসে গেছে। মিতুল আবারও একবার ভেংচি কেটে নিজের রুমের দিকে যেতে লাগলো।
_________________
রাত নামার কিছুক্ষণ পরেই তুষারপাত শুরু হয়েছে। উড়ে উড়ে পড়ছে শত সহস্র কুচি কুচি বরফদানা। কৃত্রিম আলোর রোশনাইয়ে ঝলমল করা এই রাত এবং শান্ত, ধীর গতিতে উড়ে উড়ে পড়া তুষারপাত, দুই মিলে পরিবেশ করেছে এক অনন্য রাজ্য।
বসন্তের তুষারপাত উপভোগ করতে মানুষ এখন নিজেদের ঘর ছেড়ে বাইরে পদার্পন করেছে। গায়ে জড়িয়েছে পুরু উষ্ণ কাপড়। রাস্তায় কিছু বাচ্চা ছেলে-মেয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। রাস্তায় অল্প অল্প করে জমতে থাকা বরফে বাচ্চাগুলো পা আটকে পড়ে যাবে বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে তা হয় না। তারা দিব্যি দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
মিতুল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। মন হারাচ্ছে অজানা, অচেনা মুগ্ধতায়। জীবনে এই প্রথম কাছ থেকে স্নো ফল দেখা। এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে উচ্ছ্বসিত মনে তুষার ছুঁয়ে দেখছে নীরবে। তুষারের ঠান্ডা পরশে একটু-আধটু শিহরণ আঁকছে মনে।
জোহান দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুটা দূরত্বে। সেলফি, ছবি তুলতে ব্যস্ত সে। একটা ছেলে জোহানকে ছবি তুলতে সাহায্য করছে।
মিতুল অবশ্য এ কাজটা আগেই শেষ করেছে।
জায়িন বাড়ির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। সবার ভাবমূর্তি লক্ষ করছে সে। কিন্তু তার দিকে কারো বিন্দু মাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই।
রেশমী আন্টি এবং সাদাত আঙ্কল হাঁটতে হাঁটতে বেশ দূরে চলে গিয়েছেন। আর একটু হেঁটে বামে বাঁক নিলেই অদৃশ্য হয়ে যাবেন দুজনে।
সবাই যখন নিজ নিজ ভাবে ব্যস্ত, তখন মিতুল মনে মনে একজনকে ভীষণ ভাবে মিস করছে। চোখের পর্দায় আলতো করে ভেসে উঠছে এক জোড়া ধূসর চোখ। যে চোখের গভীরতায় সাঁতার কেটে বেড়াতে ইচ্ছা করে ওর। মিতুল কল্পনা করছে, ও এবং ওর প্রিয় ধূসর চোখের মানুষটি একে অপরের হাত ধরে হেঁটে চলেছে। পাড়ি দিচ্ছে তুষার জমা পথ। আশপাশ জনমানবহীন। কেবল ওদের অনুভূতির সাক্ষী হয়ে ঝরছে মিহিদানার মতো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বরফ কণিকা।
তুষার মানব তৈরি করার কাজে হাত লাগিয়েছে জোহান। ওকে ছবি তুলতে সাহায্য করা ছেলেটাও তুষার মানব তৈরিতে সহায়তা করছে। বড়ো আকারের একটা গোলাকৃতির তুষারখণ্ড এরই মধ্যে তৈরি করে ফেলেছে জোহান। বড়ো খণ্ডটার উপর আরেকটা ছোটো গোলাকৃতির খণ্ড বসাতে হবে এরপর। সেটা তৈরিতে এখন জোরদার কাজ চালাচ্ছে। একের পর এক বরফ কণিকার আস্তরণ উলটে-পালটে মেখে ছোটো খণ্ডটি তৈরি করে ফেললো। তারপর সেটাকে বসিয়ে দিলো বড়ো খণ্ডটির উপরে। ছোটোখাটো একটা তুষার মানব তৈরি হয়েছে। সাফল্যের হাসি হাসলো জোহান। এরই মধ্যে ওর চোখ গেল কল্পনা বিমোহিত অন্যমনস্ক মিতুলের উপর। মিতুলকে দেখে জোহানের মনে দুষ্টুমির ভাবনা উদয় হলো। দুই হাতে রাস্তা থেকে তুলে নিলো কিছু তুষার, এবং তা ছুঁড়ে মারলো মিতুলের মুখ বরাবর।
আকস্মিক এমন ঘটনায় মিতুল প্রায় লাফিয়ে উঠলো। বেরিয়ে আসলো ওর কল্পনা জয়ী রাজ্য থেকে।
মিতুলের অবস্থা দেখে জোহান হাসতে হাসতে শেষ। পারলে এই বরফ জমা রাস্তাতেই লুটাপুটি খায় অবস্থা। এমন ভাবে হাসছে যেন এরকম মজা সে আগে কখনও পায়নি।
জোহানের হাসি দেখে মিতুলের প্রতিটা শিরা উপশিরায় রাগের তাপদাহ বয়ে যাচ্ছে। আশেপাশে মানুষজন থাকায় ও মুখে কিছু বললো না জোহানকে। মনে মনে হাজারও কথা শুনিয়ে নিজের তুষ্টি মেটালো।
জোহান রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় মিতুলের রাগে ফুলো নাকটা লক্ষ করলো। যা দেখে আরও বেড়ে গেল ওর হাসি।
জোহানের উপর কিছুটা রাগের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে জায়িনের মাঝে। মিতুলের মুখে জোহানের তুষার ছুঁড়ে মারাটা একদমই ভালো লাগেনি জায়িনের। কেন এত খারাপ লাগলো ঠিক জানে না। কিন্তু এতটাই খারাপ লেগেছে যে, এখানে দাঁড়িয়ে থাকার মন মানসিকতা হারিয়ে ফেলেছে ও। জায়িন সত্যি সত্যি আর এখানে দাঁড়ালো না, তুষার জমা রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে যেতে লাগলো। নিজের বন্ধুদের সাথে গিয়ে মিলিত হবে এখন। ফ্রেডি অনেক আগেই ফোন করে ডেকেছিল ওকে। ‘এখনই আসছি’ বলে বাড়ি থেকে বের হয়েও কেন যেন তখনই নিজের বন্ধুদের উদ্দেশ্যে রওনা দিতে পারেনি ও। কিছুক্ষণ বাড়ির সামনেই অন্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছিল।
__________________
মিতুল বেডরুমের বিশাল আকৃতির উইন্ডোটি মেলে দিলো। উইন্ডোর গ্লাসে কুচি কুচি বরফ জমে আছে। বাইরে এখন নীরব পরিবেশ। স্নো ফল থেমে গেছে কিছুক্ষণ আগে। মোবাইলে মায়ের মিসড কল উঠে আছে। মিতুলের কল ব্যাক করতে ইচ্ছা করছে না এখন। কল ব্যাক করলো না ও। পরে মা ফোন দিলে ফোন ধরতে না পারার কোনো একটা কারণ দাঁড় করিয়ে দেবে। গায়ের জ্যাকেটটা খুলে রেখে বিছানার নরম তুলতুলে কোলে গা ভাসালো ও।
মিতুলের মনে একটা জেদ চাপলো। কালকে যে করেই হোক সেই রেস্টুরেন্টে যাবে ও। না, রেস্টুরেন্টে খেতে যাবে না। খাওয়ার ছুতো দিয়ে সেই ধূসর চোখ জোড়াকে একবার দেখতে যাবে। একা যাওয়া যায়। কিন্তু একা গেলে ব্যাপারটা কেমন হবে? না, একা যাবে না। রেশমী আন্টির সাথে…না রেশমী আন্টির সাথে যাবে না। জোহান…হ্যাঁ, জোহানের সাথে যাবে। ওর সাথেই তো গিয়েছিল আগের বার। ওর সাথে আরেকবার ওখানে যেতে চাইলে নিশ্চয়ই কিছু মনে করবে না ও। জোহান অহংকারী, বদমাইশ হলেও তার পাশাপাশি একটু আহাম্মকও আছে। হ্যাঁ, কালকে জোহানের সাথেই যাবে সেই রেস্টুরেন্টে।
মিতুলের হঠাৎ খুশি খুশি লাগছে। লজ্জাও লাগছে একটু। প্রথম কাউকে মনে ধরেছে ওর। আর এমন একজনকে মনে ধরেছে যাকে চেনেই না। সামান্য নামটা পর্যন্তও জানা নেই। ইশ, কে ভেবেছিল যে এমন করে কারো প্রেমে পড়বে! মিতুল লজ্জায় নিজের মুখ লুকালো দু হাতে। শুয়ে রইল অনেকক্ষণ। ভেবে গেল কেবল ধূসর চোখ জোড়াকে।
এরপর উঠে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগলো। আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে ও আগের চেয়ে আর একটু বেশি সুন্দর হয়েছে। আসলেই কি আগের চেয়ে বেশি সুন্দর হয়েছে? না কি মনে তৈরি হওয়া সদ্য রঙিন অনুভূতির জন্য সবকিছু বেশিই সুন্দর মনে হচ্ছে? কোনটা?
মিতুল কাঁধ বেয়ে একটু নিচ ছুঁয়ে যাওয়া অদীর্ঘ চুলগুলো আঁচড়ে নিলো। শুকনো ঠোঁট ভেজালো লিপ জেলে। কণ্ঠে তুললো গুনগুন করে বাংলা গানের সুর। বাম হাতের হেয়ার রাবারটা খুলে চুলগুলো বেঁধে নিলো সযতনে। তারপর দরজা টেনে রুম থেকে বের হলো।
প্যাসেজওয়ে ধরে আপন মনে গুনগুন করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিল সিঁড়ির প্রান্তে পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে, কিন্তু পথে জোহানের কক্ষ থেকে মিষ্টি গিটারের সুর ওর চলন থামিয়ে দিলো। গিটারের সুর বরাবরই ভালো লাগে ওর। মনে পড়লো কালকের রাতের কথা। কালকে রাতে জোহানকে গার্ডেনে দাঁড়িয়ে গিটার বাজাতে দেখেছিল। জোহান যে গিটার বাজানোয় দক্ষ সেটা বুঝতে পেরেছে ও। আচ্ছা, জোহান কি গান-টান করে না কি?
জোহানের রুমের দরজা একটুখানি ফাঁকা। মিতুল উঁকি দিলো সেখানে। রুমের ভিতর সোনালি আলোক রশ্মিতে জোহানকে দেখা যাচ্ছে। একমনে অনবরত গিটার বাজাচ্ছে ও। খুবই শান্ত একটি সুর বাজছে ওর গিটারে। একটুখানি ফাঁকা জায়গাটুকু দিয়ে মিতুল তাকিয়ে রইল জোহানের দিকে।
জোহানের গিটারে চালিত হাত দুটো থেমে যায় হঠাৎ। কোনো দিকে দৃষ্টিপাত না করেই বলে,
“লুকিয়ে লুকিয়ে আমার গিটার বাজানো দেখছো কেন?”
মিতুল চমকে গেল। কী করে বুঝলো যে এখানে দাঁড়িয়ে ওকে দেখছে? মিতুল প্রশ্নটা করেই ফেললো,
“কী করে বুঝলে যে আমি এখানে আছি?”
জোহান গিটার রেখে উঠে আসলো। একটুখানি ফাঁকা থাকা দরজাটা খুলে ফেললো সম্পূর্ণ। গাম্ভীর্যের সাথে বললো,
“চুপিচুপি আমাকে লক্ষ করা ব্যাপারটা আমি খুব অপছন্দ করি। কখনও করবে না আর।”
বলে নিজ অবস্থানে ফিরে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়ালো।
মিতুল তাড়াতাড়ি পিছন থেকে বললো,
“একটা কথা ছিল তোমার সাথে।”
আর মনে মনে বললো,
‘এই অহংকারী ছেলে, নিজেকে কি রাজপুত্র ভাবো তুমি? না হয় চুপিচুপি একটু তাকিয়ে থেকে তোমার গিটার বাজানোই দেখছিলাম। তাতে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে?’
জোহান বিস্ময় নিয়ে পিছন ফিরলো। অবাক কণ্ঠে বললো,
“আমার সাথে? কী কথা আমার সাথে?”
মিতুল ভাবছে কালকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাওয়ার কথাটা এখনই বলে দেবে। খানিক ইতস্তত করে বললো,
“কালকে আমাকে বাইরে নিয়ে যেতে পারবে?”
মিতুল প্যাসেজওয়েতে পা রাখতেই দেখতে পেল ক্যামিলা জোহানের ঘরে ছুটছে ব্যস্ত ভাবে। কালকে রাতে যে ওটা জোহান ছিল একশ ভাগ নিশ্চিত মিতুল।
কালকে জোহান অন্ধকারে হারিয়ে যাওয়ার পর মিতুল বারান্দায় বসে ছিল। জোহান কখন জঙ্গল থেকে বের হয় সেটা দেখার জন্য। কিন্তু জোহান বের হয়নি। মিতুল অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে যায় বারান্দায়। যখন ঘুম ভাঙে তখন ভোরের আভা দেখা দেয়নি আকাশে। ও বারান্দা ছেড়ে নিজের রুমে যাওয়া দেয়। জোহানের কক্ষের দিকে নজর পড়তে দাঁড়ায় আবার। জোহান ফিরেছে কি না প্রশ্ন উদয় হয় মনে। ও জোহানের রুমের দিকে এগিয়ে যায়। না, জোহান রুমে ছিল না। দরজা বাইরে থেকেই লক ছিল।
জোহান ওই ঘন অন্ধকার জঙ্গলে রাতে একা একা কী করতে গেল সেটা এখনও ভেবে পায় না মিতুল। কালকে রাতে গিটার বাজাতে দেখে দুঃখী ছেলে মনে হয়েছিল জোহানকে। কিন্তু জঙ্গলে ঢোকার পর সেই মনোভাব কেটে গিয়েছিল ওর। দুঃখী ছেলে মনে হচ্ছিল না তখন আর। অন্যকিছু মনে হচ্ছিল। কিন্তু অন্য কিছুটা ঠিক কী সেটাই ভেবে উঠতে পারছে না এখনও। তবে এখন এই ভাবনার থেকেও বড়ো ভাবনা হলো, ক্যামিলা এভাবে ছুটছে কেন জোহানের রুমে? ক্যামিলাকে অনুসরণ করে মিতুলও দ্রুত পায়ে জোহানের রুমে ছুটলো।
জোহানের রুমে পা রেখেই চোখ-মুখ কুঁচকে গেল মিতুলের। জোহান সারা রুম বমি করে মেখেছে। ওর ক্লান্ত দেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে ফ্লোরে। মুখ কাত হয়ে আছে, তাই ফরসা বাচ্চা মতন মুখটির একপাশ দেখা যাচ্ছে। দু চোখ বন্ধ, মুখে কীসব বলে চলেছে বিড়বিড় করে। অস্পষ্ট জড়ানো কণ্ঠ। একটা শব্দও বোঝা যাচ্ছে না। অবচেতন অবস্থায়ও হাতের ওয়াইন শূন্য বোতলটা শক্ত করে ধরে আছে। এক বোতল পান করলে এত বমি করার কথা নয়। রুমে শুধু একটা বোতলই দেখা যাচ্ছে। হয়তো আরও বেশি পরিমাণ পান করেছে, কিন্তু বোতলগুলো এখানে নেই। জোহানকে দেখে আধমরা মনে হচ্ছে!
জোহানের রুমের অবস্থার জন্য মিতুলের শরীর ঘৃণায় রিরি করে উঠলো। হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো ও। বিষয়টা জায়িনের চোখ এড়ালো না। জোহানের রুমে সবাই উপস্থিত। রেশমী আন্টি, সাদাত আঙ্কল, জায়িন, বাসার দুই মেইড। ক্যামিলা অনবরত জোহানকে ডেকে যাচ্ছে, আর ওর চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
সাদাত আঙ্কল নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছেন। জায়িনও নিশ্চুপই দাঁড়ানো। তবে সাদাত আঙ্কলের নিশ্চুপতা একটু অন্যরকম। যেন নিশ্চুপতার থেকেও অধিক নিশ্চুপ।
রেশমী আন্টি মুখ বুজে নেই, সে একের পর এক বকাঝকা করেই চলছে জোহানকে। জোহান এখন যেই অবস্থায় আছে তাতে সেই বকা ঝকা জোহানের মস্তিষ্কে পৌঁছাতে পারছে বলে মনে হয় না।
বাসার দ্বিতীয় মেইডটি জোহানের রুম পরিষ্কার করায় ব্যস্ত। প্রথমেই জোহানের কাছের জায়গাটা পরিষ্কার করলো সে। কিন্তু পরিষ্কার করেও লাভ হলো না, জোহান সেই জায়গায় আবারও বমি করে দিলো।
মুখ বিকৃত করে চোখ সরিয়ে নিলো মিতুল।
রেশমী মিতুলের উপস্থিতি টের পেয়ে বললেন,
“মিতুল, এটা স্বাভাবিক ঘটনা। ভয় পেয়ো না। এই পরিবেশে থাকার দরকার নেই তোমার। তুমি তোমার রুমে যাও।”
মিতুল নিশ্চুপ বেরিয়ে এলো জোহানের রুম থেকে। ওর পক্ষে আর ওখানে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না। গা গুলিয়ে উঠছিল। কাউকে বমি করতে দেখলে ওর নিজেরও বমি পায়। তবে ও আরও একটা বিষয় খেয়াল করেছে। জোহানের ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেঁধে লাল হয়ে ছিল। চোখের পার্শ্ব স্থানেও ছিল লাল বর্ণের প্রতিক্রিয়া। দেখে মনে হচ্ছিল কেউ মেরেছে ওকে। কিন্তু মারলো কে?
হঠাৎ রেশমী আন্টির জোহানকে বলা একটি কথা মনে পড়লো। রেশমী আন্টি বলেছিলেন,
‘নিষেধ করেছিলাম তোমাকে ওদের সাথে ঝামেলা না পাকাতে। আবার মার খেলে তুমি! আজকেও যদি ঘটনাটা পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত যেত তাহলে তোমাকে একেবারে মেরেই ফেলতাম!’
রেশমী আন্টি কাদের কথা বুঝিয়েছেন? জোহান কি এর আগেও মার খেয়েছে? পুলিশ স্টেশনে যাওয়ার কথা কেন বললেন? মারামারির জন্য?
মিতুল নিজের রুমে গেল না, এসব ভাবতে ভাবতে লনে চলে এলো। হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির ছোট্ট গেটটি পেরিয়ে একেবারে বাইরে পা রাখলো। শীতল হাওয়া বইছে বাইরে। বেশ শীত পড়েছে আজকে। মিতুল সাদা ফুল হাতার গেঞ্জির উপর একটা ব্লু সোয়েটার পরেছে। মেইন শহর থেকে রেশমী আন্টিদের বাড়ি কিছুটা দূরে। এই এলাকাটা অনেক শান্ত। পরিষ্কার পিচ ঢালা রাস্তার দুই পাশেই সুন্দর সজ্জিত বাড়ি। বিদেশি বাড়িগুলো দেখতেই অন্য রকম হয়। ভালো লাগে ওর।
রেশমী আন্টিদের এক নেইবরহুডের বাড়ি থেকে একটা নীল পোরশে কার বের হতে দেখা গেল। গাড়িটা মিতুলকে অতিক্রম করে ধীর গতিতে এগিয়ে গেল সামনে। গাড়িটি চোখের আড়াল না হওয়া পর্যন্ত মিতুল তাকিয়ে রইল। গাড়িটা অদৃশ্য হলো কিছুক্ষণের মধ্যেই।
মিতুলের হঠাৎ চোখ পড়লো জায়িনের উপর। জায়িন ঠিক ওর পাশ থেকেই চলে যাচ্ছে সামনের দিকে।
জায়িন মিতুলের থেকে বেশ কিছু দূরত্বে গিয়ে থামলো হঠাৎ। অতিক্রম করে যাওয়া পথ হেঁটে আবার মিতুলের কাছে এসে বললো,
“তুমি কি মর্নিং ওয়াকে আমার সাথে জয়েন করতে চাও?”
জায়িনের অফার ফিরিয়ে দেবে কি না বুঝতে পারছে না। একটু আগে তো একেবারে অগ্রাহ্য করে চলে গেল, দেখেও কিছু বললো না! তাহলে এখন আবার ফিরে এসে এই অফার দেওয়ার মানে কী? মিতুল জায়িনের অফারটা ওর মুখের উপর ফিরিয়ে দিতে চাইছিল। কিন্তু শেষমেশ সেটা পারলো না। জায়িনের কথায় সায় দিয়ে বললো,
“ঠিক আছে।”
মিতুল জায়িনের সাথে হাঁটতে হাঁটতে এলাকাটা এক ঝলক দেখে নিচ্ছে। গাড়িতে করে গেলে কিছুই ভালো মতো দেখা যায় না। যেমন এখন খুব ভালো করেই সবকিছু দেখা যাচ্ছে, লক্ষ করা যাচ্ছে, সেটা গাড়িতে বসে হয় না। আজকে ছুটির দিন। তাই অনেককেই দেখা যাচ্ছে। অনেকে হাস্যোজ্জ্বল মুখে সকালের শুভেচ্ছা জানাচ্ছে জায়িনকে। মিতুলকে খুব একটা পাত্তা দিলো না কেউ। যেটা সোজা আত্মসম্মানে আঘাত হেনেছে মিতুলের।
দূরে ঘাস ঘন খোলা ফিল্ডে কয়েকটা কিশোর ছেলে সাইকেল চালাচ্ছে। একটা ছেলে নিজের সাইকেলে ব্রেক কষে জায়িনের উদ্দেশ্যে দূর থেকেই উচ্চৈঃকণ্ঠে বললো,
“হেই ব্রো, তুমি কি আমাদের সাথে এটেন্ড করবে?”
জায়িনও কিশোরটির মতো উচ্চৈঃকণ্ঠে বললো,
“এখন নয়।”
“ঠিক আছে। বিকেলবেলা দেখা হবে।”
ছেলেটা একটু বিরতি নিয়ে আবার বললো,
“তোমার সাথের মেয়েটি কে? তোমার গার্লফ্রেন্ড?”
ছেলেটার কথা শুনে মিতুল বেশ লজ্জা পেল। যদিও এখানে ওর লজ্জার থেকে বেশি রাগ হওয়া উচিত, ছেলেটার এমন না জেনে না শুনে কথা বলার জন্য। কিন্তু ওর রাগ হলো না। ও পেল লজ্জা। এত লজ্জা পাওয়ার কারণ ও নিজেই বুঝতে পারলো না।
মিতুলকে জায়িনের গার্লফ্রেন্ড ভেবে ছেলেটা উৎসুক হয়ে মিতুলকে দেখতে এগিয়ে এলো ওদের কাছে।
জায়িন ছেলেটার ভুল ভাঙিয়ে বললো,
“ও আমার গার্লফ্রেন্ড নয়। ও একজন অতিথি। কানাডা ঘুরতে এসেছে। আমাদের বাড়িতে আছে, আমাদের রিলেটিভ।”
“ওহ, আই সি…” বিজ্ঞের মতো হালকা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললো ছেলেটি।
তারপর করমর্দনের জন্য মিতুলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।
“হাই, নাইস টু মিট ইউ। আই অ্যাম লর্স। হোয়াট ইউর গুড নেম?”
মিতুল মুখে হাসলো, কিন্তু মন থেকে হাসতে পারলো না। বিদেশের মাটিতে পা রাখলে যে নিজের নাম হ্যান ত্যান হয়ে যাবে সেটা আগে থেকেই জানতো। নাম ঠিকঠাক ভাবে উচ্চারণ করতে না পারা তো বিদেশিদের মুদ্রা দোষ। তবুও ভালো, ছেলেটা তো মিটুল বলে সম্বোধন করেছে। অন্যদিকে জোহান তো ওর এত সুন্দর নামটাকে ‘তুলতুল’ বলে ব্যঙ্গ করেছে।
জায়িন লর্সকে বিদায় জানিয়ে চলে এলো। হাঁটতে হাঁটতে বললো,
“এখানের বাচ্চাদের সাথে আমার খুব ভাব। ছুটির দিনে ওদের সাথে ভালোই টাইমপাস হয়।”
মিতুল ছোটো করে বললো,
“ওহ।”
কিছু সময় নীরবতা গেল। জায়িন প্রথমে নীরবতা ভেঙে বললো,
“ওয়েদার নিউজে জানলাম আজকে রাতে তুষারপাত হতে চলেছে। তুমি জানো সেটা?”
মিতুলের জানা ছিল না। তুষারপাতের কথা শুনে ওর দু চোখ তৃষ্ণার্ত হয়ে উঠলো। এই রঙিন বসন্তের মাঝে তুষারপাত ব্যাপারটা কেমন হবে? মিতুলের এক্সাইটমেন্ট কাজ করছে। সেই সাথে হঠাৎ মনে পড়ে গেল সেই ধূসর চোখের মায়াবী মানুষটাকে।
মিতুল ভাবছে, কোনো এক তুষারপাতে যদি সেই মানুষটার হাতে হাত রেখে তুষার জমা পথে হেঁটে বেড়ানো যেত, তাহলে কেমন হতো? ও নিজের বাম হাত দেখলো একবার। হাতে শোভা পাচ্ছে কালো চিকন একটা হেয়ার রাবার। যেটা হাত থেকে খুলতে ভীষণ অনিচ্ছা ওর।
_______________
মিতুল এখন গার্ডেনের পাইন গাছের ডালের সাথে ঝুলে থাকা এক টুকরো কাঠের সেই দোলনাতে বসে আছে। বাগানে মিষ্টি সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসের সাথে। অনেক ফুলের সুবাস একসাথে মিলিত হয়ে এক অনন্য পরিবেশের সৃষ্টি করেছে। মিতুলের দৃষ্টি জঙ্গলের ভিতর। যদিও গাছের ফাঁকফোকর পেরিয়ে চোখ জঙ্গলের অন্তরালে একেবারে প্রবেশ করতে পারছে না বললেই চলে। এডমন্টনে কেবল অন্ধকারের কিঞ্চিৎ আভা দেখা দিলেও, জঙ্গলের ভিতর তা এখন গভীর রাতের সমান। জঙ্গলের ভিতরটা এখন অন্ধকার রাজ্যের মতো। যেখানে কখনও কোনো আলো প্রবেশ করতে পারেনি বলে মনে হয়। জঙ্গলের ভিতর কয়েকটা পাখি এক সঙ্গে দল বেঁধে ডাকছে। ওই পাখির ডাক এখন মিষ্টি মনে হচ্ছে না মিতুলের কাছে। মনে হচ্ছে পাখিগুলোও যেন ওই অন্ধকার রাজ্যের অন্ধকার প্রাণী। যা কেবল ভয়ংকর। মিতুলের মনে নানান প্রশ্নের উদয় হচ্ছে। অত রাতে জঙ্গলে কী কাজ জোহানের? দিনের বেলা জঙ্গলের ভিতর ঢুকতেই তো বোধহয় হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসবে, সেখানে রাতের বেলা…
মিতুলের মনে ভয় হলেও ওর কৌতূহল ওর ভয়ের চেয়ে অনেক বেশি। ওর ইচ্ছা করছে একবার জঙ্গলের ভিতর ঢুকে দেখে, আসলে কী আছে জঙ্গলে যার জন্য জোহান অত রাতে জঙ্গলে গিয়েছিল। মিতুলের কৌতূহল ওকে সম্পূর্ন নিজেদের বশে এনে ফেললো। ও কৌতূহলে বশীভূত হয়ে দোলনা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। জঙ্গলের ঘুটঘুটে অন্ধকারে নিজের চোখ আটকে ধীরে ধীরে এগোয় জঙ্গলের ভিতর চলে যাওয়া সরু রাস্তার দিকে। এগিয়ে এসে যখন সেই রাস্তায় পা রাখলো তখন পিছন থেকে শুনতে পেল,
“হোয়াট আর ইউ ডুয়িং হিয়্যার?”
মিতুলের পা থমকে যায়। আঁতকে ওঠে হৃৎপিণ্ড। সারা শরীর বেয়ে নেমে যায় ভয়ের স্রোত। কৌতূহলের ফাঁদে পা দেওয়া কি ভুল হয়েছে? মিতুল শুকনো ঢোক গিলে ধীরে ধীরে পিছন ফিরলো।
দেখতে পেল ওর থেকে কিছুটা দূরত্বে জোহান দাঁড়ানো। হঠাৎ আগমনে আর ঝাপসা আঁধারে জোহানকে দেখে ভয়ংকর মনে হচ্ছে মিতুলের!
জোহান স্টিয়ারিং এ হাত রেখে গানের সঙ্গে নিজের গলা মিলাচ্ছে। ওর পাশের সিটেই ক্ষুব্ধ মনে বসে আছে মিতুল। এই বসন্তের মাঝে উইন্টারের গান একদম বিরক্ত লাগছে ওর। চোখ-মুখ প্রায় কুঁচকে আছে বিরক্তিতে। কিন্তু জোহান বেশ উপভোগ করছে গানটা। মিতুলের ইচ্ছা করছে এক চাপে প্লে বাটন অফ করে দিতে।
“ব্রেকফাস্ট করেছো তুমি?” জোহানের থেকে হঠাৎ প্রশ্ন এলো।
“না। ব্রেকফাস্ট করার সুযোগ পেলাম কোথায়? তুমি কি সেই সুযোগ দিয়েছো আমায়?” গম্ভীর মুখে বললো মিতুল।
“চলো তাহলে কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করি।”
রাস্তায় তিনটা মোড় আসলে ডান দিকে মোড় নিলো জোহান।
বিশ মিনিটের ব্যবধানে রেস্টুরেন্টে এসে গাড়ি পার্ক করলো জোহান। রেস্টুরেন্টে ঢুকতে গিয়ে লক্ষ করলো মিতুল নেই সাথে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গেল জোহান। খুঁজতে গিয়ে দেখতে পেল রেস্টুরেন্টের নেম প্লেটের দিকে হাঁ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মিতুল। জোহান বিরক্ত হয়ে বললো,
“খাবার না খেয়ে রেস্টুরেন্টের নাম খেয়ে পেট ভরবে না কি? তাড়াতাড়ি এসো।”
জোহানের কথা খেয়াল হতে মিতুল দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো। গ্লাস ডোর অতিক্রম করতেই রেস্টুরেন্টের একজন মেয়ে কর্মচারী স্বাগত জানালো মিতুলদের। বাইরে থেকে দেখে যতটা না বড়ো মনে হয়েছে, ভিতরে তার থেকে অনেক বেশি বড়ো। ঝকঝকে পরিষ্কার সব। প্রায় সব টেবিলই মানুষ জনে ভর্তি। সম্পূর্ণ দেওয়ালের জায়গা জুড়ে থাকা বিশাল গ্লাসের কাছে একটা টেবিল দেখিয়ে জোহান বললো,
“চলো, ওখানটায় বসবো আমরা।”
জোহানের সামনা সামনি একটা চেয়ারে বসলো মিতুল। প্রথমেই ওর চোখ চলে গেল উইন্ডো গ্লাসের বাইরে। সকালের আমেজটা বড্ড প্রাণবন্ত। মিষ্টি সূর্য রশ্মি ছড়িয়ে আছে। পাতাবিহীন ফুল ভরা গাছ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একরাশ সৌন্দর্য নিয়ে। সমতল রাস্তা ধরে এগিয়ে চলছে নানান গাড়ি। পথচারীদের আনাগোনা চলছে স্বাভাবিক নিয়মে।
একজন ওয়েটার এগিয়ে এলো অর্ডার নিতে। জোহান মেনু কার্ড দেখে অর্ডার দিতে লাগলো।
ভীষণ অবাক হলো মিতুল। একই সাথে প্রায় ছয় আইটেমের খাবার অর্ডার দিয়েছে জোহান। এত খাবার খেতে পারবে?
“কী হলো? তুমি কিছু অর্ডার করবে না?”
জোহানের কথায় ধ্যান ভাঙলো মিতুলের। মেনু কার্ড হাতে নিতেই চক্ষু চড়ক গাছ। এত দাম!
এত খাবারের ভিতরে কী যে অর্ডার দেবে বুঝতে পারছে না। এ পাতা ও পাতা উলটে অবশেষে অর্ডার দিলো, পিরি পিরি প্রন আর ফ্রুট স্যালাড।
জোহান কেমন মুখ বাঁকিয়ে বললো,
“মাত্র দুটো খাবার অর্ডার দিলে? আগে তো জানতাম বাংলাদেশি মেয়েরা প্রচুর খায়।”
মিতুল কিছু বললো না। জোহানের কথার জবাব না দেওয়ার চেষ্টা করছে সব সময়।
কিছুক্ষণের ভিতর খাবার চলে এলো। জোহান গরম খাবার ফুঁ দিয়ে একটু ঠান্ডা করে খাচ্ছে।
“গুড মর্নিং। তুমি কি জোহানের সাথে বাইরে বের হয়েছো?”
মিতুলের বলতে ইচ্ছা হলো,
‘জি না আন্টি, আমি তোমার ছেলের সাথে বের হইনি। তোমার বদমাইশ ছেলে আমাকে তার সাথে বের হতে বাধ্য করেছে।’
কিন্তু বললো,
“হ্যাঁ আন্টি, ওর সাথেই বের হয়েছি।”
“ঠিক আছে। ওর সাথে বেশি ঘোরাঘুরি করার দরকার নেই। তাড়াতাড়ি বাসায় চলে এসো।”
মিতুল নিস্তেজ গলায় বললো,
“ঠিক আছে।”
রেশমী আন্টি ফোন কেটে দিলেন। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে বললেন কেন? অবশ্য ভালোই হয়েছে। এই বদমাইশটার সাথে থাকতে ভালো লাগছে না।
“তোমার মম আমাকে তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলেছে। একটু পর আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ো।”
জোহান ভাবলেশহীন কণ্ঠে বললো,
“তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে বলেছে তো যাও। আমাকে কেন বলছো? আমি কি তোমার ড্রাইভার? আমি কেন তোমায় বাড়ি পৌঁছে দেবো? একটা ট্যাক্সি ধরে চলে যাও।”
“একটা ট্যাক্সি ধরে চলে যাব মানে? আমাকে কে নিয়ে এসেছে এখানে? তুমি। তুমি আমাকে নিয়ে এসে এখন বাড়ি পৌঁছে দেবে না?”
“না।”
মিতুলের মাথাটা গরম হয়ে গেল। একটা বাক্যও বললো না আর। এই অহংকারী ফ্যামিলির একটা মানুষের সাথেও যে ও কথা বলে পারবে না সেটা খুব ভালো করে বুঝতে পারছে।
খাওয়ার মাঝপথে জোহানের মোবাইলে ম্যাসেজ এলো একটা। জ্যাকেট থেকে মোবাইল বের করে ম্যাসেজটা পড়লো জোহান। আবার মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে রেখে বললো,
“শোনো, আমার একটা কাজ আছে। আমি চলে যাচ্ছি। তুমি বিল মিটিয়ে দিয়ে সোজা বাড়ি চলে যেয়ো।”
জোহান কথাটা বলে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল রেস্টুরেন্ট থেকে।
মিতুল বিস্ময় নিয়ে শূন্য দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। এটা কী করলো? যেখানে চলে যাওয়ার কথা ওর, সেখানে জোহান চলে গেল? আর বিল? বিল ওকে মিটিয়ে দিতে বলছে মানে? এত খাবার অর্ডার দিয়ে এত বিল বানিয়ে এখন ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো? একেকটা খাবারের যে দাম, এত ডলার এই মুহূর্তে পাবে কোথায় ও? এত ডলার নিয়ে কি বের হয়েছে? মিতুল দ্রুত নিজের ব্যাগ চেক করলো একবার। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লো। যাক, ভালো পরিমাণ ডলার নিয়েই বের হয়েছে ভাগ্য গুনে। কিন্তু ওর কাছে যদি পর্যাপ্ত ডলার না থাকতো, তখন কী হতো?
মিতুলের খেতে সমস্যা হচ্ছে। খাওয়ার জন্য একটু নুলেই ছোটো ছোটো চুলগুলো মুখের উপর পড়ে বেশ ডিস্টার্ব করছে। এমনিতেই এই অচেনা জায়গায়, অচেনা পরিবেশে একার খুব অস্বস্তি লাগছে। তার উপর আবার চুলগুলোর জ্বালাতন। মিতুলের ইচ্ছা হচ্ছে এই মুহূর্তে চুলগুলো ঘ্যাঁচাৎ করে কেটে একেবারে ছোটো বানিয়ে ফেলে। ও কোথাও বের হলে হেয়ার ক্লিপ নিয়ে বের হয়। বাইরে খাওয়া পড়লে বা অস্বস্তি লাগলে নিজের জ্বালাময় চুলগুলো আটকে নেয়। কিন্তু আজকে জোহানের কথা মতো তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে চুলের জন্য কিছুই আনতে মনে ছিল না। আর জোহান যে হঠাৎ করে রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসবে সেটাই বা জানতো কে?
মিতুল নিজের অবাধ্য চুলগুলো কোনো রকম সামলে এক চামচ খাবার মুখে পুরলো, ঠিক সেই মুহূর্তে সামনে আবিষ্কার করলো একটা ছেলেকে। ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকাতেই ছেলেটার সহজ সরল মুখ ধরা দিলো চোখে।
ছেলেটা একটা হেয়ার রাবার বাড়িয়ে দিয়েছে ওর দিকে। মিতুল অবাক হয়ে দেখছে ছেলেটাকে। ছেলেটা বোধহয় এখানের স্টাফ। গায়ে অন্য স্টাফদের মতো পোশাক। মাথা ভর্তি কালো, বাদামি সংমিশ্রণ চুলগুলো পরিপাটি। চোখের মণি ধূসর। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। দেখে এক ঝলকেই বোঝা যায় ছেলেটা কানাডার অধিবাসী। কিন্তু ছেলেটা ওর দিকে হেয়ার রাবার বাড়িয়ে দিয়েছে কেন?
ছেলেটা মিতুলকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,
“তোমার খেতে সমস্যা হচ্ছে। এটা দিয়ে নিজের চুল বাঁধো।”
মিতুলের হৃদয়ের অজানা কোনো জায়গায় থেকে থেকে এক মিষ্টি সুর বেজে উঠলো। এই প্রথম…কানাডায় আসার পর এই প্রথম কোনো মানুষকে ভালো লাগলো ওর। কী ভালো ছেলে! দেখতেও কী সুইট! দেখে মনে হচ্ছে শুভ্র এক গোলাপের পাপড়ি। মিতুলের চোখ সরাতে মন চাচ্ছে না। ইচ্ছে হচ্ছে আজীবন তাকিয়ে থাকুক ওই মুখপানে। ওই ধূসর চোখের মায়াতে হারিয়ে যাক আপোষে।
ছেলেটা একদৃষ্টিতে মিতুলকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ডাকলো,
“ম্যাম!”
মিতুল শুনতে পেল না ছেলেটার ডাক। ছেলেটা আবার ডাকলো,
“ম্যাম…”
মিতুল এবার নিজের হুঁশে ফিরলো। দ্রুত সংযত করলো নিজেকে। ইশ কী করছিল? নির্লজ্জের মতো ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছিল? হায় আল্লাহ! ছেলেটা কী ভাবছে ওকে?
ছেলেটা নিজের হাতের রাবারটা দেখিয়ে বললো,
“এটা নাও।”
মিতুল ছেলেটার হাত থেকে হেয়ার রাবারটা নিলো। নেওয়ার সময় অনুভব করলো ভীষণ অদ্ভুত এক অনুভূতি। এই অনুভূতি অপরিচিত ওর কাছে। আগে কখনও এরকম অনুভূতির সন্ধান পায়নি ওর মন।
_________________
মধ্যরাত। বাড়িটা স্বাভাবিক অর্থেই নীরব। ঘুমে তলিয়ে যাওয়া বাড়ি এখন পাতালপুরীসম। কিন্তু এই পাতালপুরীতে এখনও একজন জেগে আছে।
‘প্রথম দর্শনে প্রেম’ এই কথাটাকে বরাবরই গাঁজাখুরি বলে মনে হয়েছে মিতুলের। কিন্তু আজ বুঝলো, না গাঁজাখুরি নয়, এটা সত্য। সে প্রমাণ ও নিজে। মনের ভিতর এক মিষ্টি মধুর অনুভূতির উপস্থিতি সারাক্ষণ বিরাজ করছে। এই অনুভূতির ব্যাখ্যা জানে মিতুল। অবুঝ মেয়ে নয় ও। এই অনুভূতি সহজেই পড়ে ফেলতে পেরেছে। এই অনুভূতি প্রেমের! হ্যাঁ, প্রথম দেখাতে প্রেমে পড়েছে ও। সেই ধূসর, মায়াবী চোখের প্রেমে পড়েছে। পৃথিবীর সব মায়া যেন ওই চোখেতেই সমর্পণ করেছিল।
বসন্তের বাতাস ঠিক যেন মিতুলের হৃদয় পর্যন্ত ছুঁয়ে গিয়েছে। মিতুল টের পাচ্ছে ওর অনুভূতি গভীর থেকে আরও গভীরতায় হারাচ্ছে।
কালো হেয়ার রাবারটা মিতুল ব্রেসলেটের মতো হাতে পরে রয়েছে। রাবারটার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি করে হেসে ফেললো। প্রথম অনুভূতির কাছ থেকে প্রথম পাওয়া উপহার! মিতুলের কাছে এ তো উপহার নয়, এটা একটা ভালোবাসা! ওর এই মুহূর্তে গান গাইতে মন চাইছে। কী একটা গান যেন সেই থেকে মনে ঘুরঘুর করছে, কিন্তু গানের কথাগুলো স্পষ্টতর ধরা দিচ্ছে না। ও মনে করার চেষ্টা করছে। কী যেন গানটা? হ্যাঁ, মনে পড়েছে। মিতুল গুনগুন করে গেয়ে উঠলো,
“প্রেমে পড়েছে মন, প্রেমে পড়েছে
অচেনা এক মানুষ আমায় পাগল করেছে…”
মিতুল গান গাইতে গাইতে জানালার দিকে এগিয়ে গেল। আজকে জোৎস্না রজনি। জোৎস্নার শুভ্র আলোর মায়ায় জড়িয়ে আছে পুরো বাড়ি। লন জোৎস্নার আলোয় দৃশ্যমান। মিতুল গুনগুন করতে করতে রুম থেকে বের হলো। চলে এলো বারান্দায়। বারান্দা চাঁদের আলোয় মোহনীয়। ঝিরিঝিরি বাতাস পরম আদরে ছুঁয়ে দিচ্ছে। বাতাসের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে ফুলের সুবাস। আহ, কী সুঘ্রাণ! বড়ো করে নিঃশ্বাস নিলো মিতুল।
বারান্দার টবে থাকা ফুলে হালকা হাত বুলিয়ে দিলো। এগোতে এগোতে বারান্দার শেষ প্রান্তে চলে এলো ও। আর এসেই থমকে গেল। থেমে গেল ওর গুনগুনানি। দীর্ঘ লম্বা বারান্দার শেষ প্রান্তে দাঁড়ালে বাড়ির পিছনের গার্ডেন দেখা যায়। মিতুল শুধু গার্ডেনই নয়, সেই সাথে দেখতে পেল একটা ছায়া মূর্তি!
হাত-পা জমে গেল ওর। শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল ভয়ের স্রোত। ওখানে ছায়ামূর্তিটা কীসের? ভূতের নয়তো? ভয়ে আত্মা শুকিয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে, তবুও ওর কৌতূহল দমে না। ও ভালো করে দেখার চেষ্টা করলো ছায়ামূর্তিটা ঠিক কার। ভূতের? না মানুষের? ছায়ামূর্তিটা ওক গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে বিশাল আকৃতির কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। কী ওটা? গিটার? দূর থেকে দেখলেও বোঝা যাচ্ছে, ছায়ামূর্তিটা ওক গাছে হেলান দিয়ে হাতে থাকা গিটার বাজিয়ে চলছে অনবরত। আচ্ছা, ভূত কি গিটার বাজাতে পারে? একটু ভাবলো মিতুল।
না, মনে হচ্ছে পারে না। ভূতের এত ভালো গুণ থাকে না কি?
ওক গাছের নিচে চাঁদের আলো প্রবেশের সুযোগ পায়নি পুরোপুরি। তবুও কিছুটা আলো ছুঁয়েছে ওক গাছের নিচের জমিন। আর সেই আলোতেই দেখা যাচ্ছে ছায়ামূর্তিকে। দেহের গড়ন দেখে মনে হচ্ছে ছায়ামূর্তিটা ছেলে।
মিতুল গিটারের সুর শুনতে পাচ্ছে না, তবুও ওর মনে হচ্ছে গিটারে স্যাড সুর বাজছে। মিতুলের মনে হলো কোনো এক দুঃখী ছেলে গিটারে দুঃখী সুর তুলছে এই নিস্তব্ধ জোৎস্না রাতে। ওর হঠাৎ মায়া হলো ছেলেটার জন্য। কেন হলো জানে না। আচ্ছা, ছেলেটা কে? এ বাড়িতে আরও কোনো মানুষ থাকে না কি?
ছায়ামূর্তিটাকে নড়তে দেখা গেল। বোধহয় ওক গাছের নিচ থেকে বাইরে বের হবে এবার।
হ্যাঁ, ঠিক তাই। ছায়ামূর্তি ওক গাছের নিচ থেকে বেরিয়ে এলো। ছায়ামূর্তির উপর চাঁদের আলো পড়েছে এখন। দেখা গেল, চাঁদের আলোতে গিটার নিয়ে একটা ছেলে এগিয়ে চলছে। মিতুল সচকিত চোখ মেলে চাইলো। মুখ দেখা যাচ্ছে না ঠিক। মাথা নিচু করে হাঁটছে। মাথা উঁচু করলে বোধহয় মুখ দেখা যাবে। ছেলেটা হঠাৎ মাথা উঁচু করলো। মিতুল অগাধ কৌতূহল নিয়ে ওঁৎ পেতে আছে ছেলেটার মুখ দেখার জন্য। চাঁদের মিষ্টি আলো ছেলেটির মুখে পড়েছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না ছেলেটির মুখ। কিন্তু ঝাপসা ভাবে দেখেও ছেলেটিকে চিনতে সমস্যা হলো না মিতুলের। ও বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো,
“জোহান!”
জোহান চাঁদের আবছা আলো গায়ে মেখে এগিয়ে চলছে। এক পা, দু পা করে ক্রমশ চলছে ও। এগিয়ে যেতে যেতে জঙ্গলের ভিতরের দিকে চলে যাওয়া সোজা সরু রাস্তায় চলে গেল। হেঁটে চললো সরু রাস্তা ধরে। কিছুক্ষণের মধ্যে জোহানের শরীর হারিয়ে গেল জঙ্গলের গাঢ় অন্ধকারে।
আকাশে হাজার তারার মেলা। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। সেই সাথে ঝরছে কিছু চেরি ব্লসমের পাপড়ি। মিতুল একটা চেরি ব্লসম গাছের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। রেশমী আন্টি ক্যালগারি থেকে বাড়ি ফেরেননি। কালকে ফিরবেন। মিতুলের ভাবনা তা নিয়ে নয়, ও ভাবছে এই ফ্যামিলির মানুষগুলোর কথা। ফ্যামিলির ভিতরে কেবল একজন মানুষকেই নিরহংকারী এবং ভালো মনে হয়েছে ওর কাছে। আর সেই মানুষটি হলো সাদাত আঙ্কল। বাকি প্রতিটা মানুষের মাঝেই কিছু না কিছু সমস্যা আছেই। বেশি সমস্যা হলো দুই ভাইয়ের মাঝে। এক ভাই তো সকাল বেলা খুব দাপট দেখিয়ে চলে গিয়েছিল অফিস, মিটিংয়ের ছুতো দিয়ে। আরেকজন ভাই কী করলো? গাড়ির ভিতরে বসে যা অপমান করার তা তো করলোই, আবার ঘোরানোর নামেও অষ্টরম্ভা। শুধু রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি ড্রাইভ করে গেছে, আর ওকে পাশের সিটে বসিয়ে রেখেছে। সবশেষে যখন বাড়ি ফিরবে তখন বোকার মতো জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কোথায় যেতে চাও?’। আচ্ছা, এই শহরে কি সে থাকে, না কি ও? তাহলে এটা কেমন ধরনের প্রশ্ন? যেকোনো একটা জায়গায় নিয়ে গেলেই তো হতো। আহাম্মক একটা!
এখানে আসা যে কী পরিমাণ ভুল ছিল সেটা এখন হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছে ও। এই বাড়িতে ওঠা ছিল জীবনের সবথেকে বড়ো একটা ভুল। হোটেল রেখে কেন এই বাড়িতে থাকতে এসেছে? আব্বুর কথাই শোনা উচিত ছিল। আব্বু পইপই করে বলেছিল, ‘এখন কানাডা যাওয়ার কোনো দরকার নেই। বিয়ের পর বরের সাথে যাবে।’
এখানে আসার পর যে অপমান হতে হয়েছে তা বোধহয় আব্বুর কথা না শোনার শাস্তি!
হাতের বাহুতে হঠাৎ কিছুর আঘাতে ব্যথায় হাত দিয়ে জায়গাটা চেপে ধরলো মিতুল। আঘাতের উৎস খুঁজতে গিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা ক্ষুদ্র এক টুকরো গোলাকার মসৃণ পাথর দেখতে পেল। এখানে পাথর এলো কোত্থেকে? মিতুল এদিক-ওদিক পাথর নিক্ষেপের উৎস খুঁজতে লাগলে জোহান দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে বললো,
“হেই, আই অ্যাম ইন হিয়্যার।”
মিতুল কণ্ঠস্বর অনুসরণ করে বারান্দায় তাকালো। জোহান হাত দিয়ে ইশারা করে বললো,
“এদিকে এসো।”
মিতুলের রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। পাথরটা জোহান ছুঁড়ে মেরেছে? আঘাত করে এখন আবার অর্ডারও দিচ্ছে? ওর কথা মতো কেন যাবে বারান্দায়? নিজের দাস মনে করছে?
মিতুলকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জোহান হাঁক পেরে বললো,
“কী হলো দাঁড়িয়ে আছো কেন? হারি আপ।”
মিতুল যাবে না যাবে না করেও কী ভেবেই যেন আবার পা বাড়ালো।
জোহান বারান্দার আর্মচেয়ারে আরাম করে বসে আছে। হাতে কোল্ড ড্রিঙ্কসের বোতল। মাঝে মাঝে সিপ দিচ্ছে বোতলে। মিতুলের মুখ বারান্দায় সদৃশ্যমান হতেই জোহান বললো,
“তোমরা বাংলাদেশের মেয়েরা এত স্লো কেন? নিচ থেকে এখানে আসতে এত সময় লাগে?”
“তা নয়তো কী? মনে হচ্ছিল একটা পিচ্চি মেয়ে ভূত দাঁড়িয়ে আছে গাছের নিচে। আচ্ছা, তুমি এত খাটো কেন?”
“আমি আল্লাহর সৃষ্টি। তিনি আমায় খাটো বানাবেন কী লম্বা বানাবেন সেটা একান্ত তার মর্জি। এখানে মানবজাতির এত মাথা ব্যথা না থাকলেও চলবে।” ফটাফট কথার জবাব দিলো মিতুল।
জোহান কিছু বললো না। শুধু নীরবে চুমুক দিলো বোতলে। কয়েক চুমুকে বোতল প্রায় খালি হয়ে এলো। জোহান হঠাৎ শূন্য প্রায় বোতলটা মিতুলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
“তুমি কি এটা পান করতে চাও?”
মিতুল একবার বোতল, আরেকবার জোহানকে দেখছে। একটা এঁটো খাওয়া জিনিস, যা কি না আবার তলানিতে পড়ে আছে, সেটা খাওয়ার জন্য অফার করছে ওকে? এটাও কি তাদের অপমান করার একটা টেকনিক? টেকনিক কি না জানে না, তবে ও অপমানিত বোধ করছে।
“কী হলো? চাও না এটা?”
“আমি কারো খাওয়া জিনিস খাই না।”
জোহান শব্দ করে হেসে ফেললো।
“কারো খাওয়া জিনিস খাও না? পৃথিবীর সব খাবারই তো মানুষের খাওয়া। তাহলে তুমি কি খাবার না খেয়ে থাকো?”
মিতুলের জবাব দিতে মনে চাইলো না। জবাব দিতে গেলে চরম ঝগড়া বাঁধতে পারে এখানে।
এক চুমুকে বোতলে থাকা তরল বস্তুটুকু শেষ করে উঠে দাঁড়ালো জোহান। চলেই যাচ্ছিল, কিন্তু আবার কী ভেবে যেন থামলো খানিক দূরে গিয়ে। পিছন ফিরে মিতুলকে ডাকলো,
“হেই!”
মিতুল তাকাতেই ‘ক্যাচ ইট’ বলে হাতের খালি বোতলটা ছুঁড়ে মারলো মিতুলের দিকে।
মিতুল দুই হাতে ক্যাচ ধরলো। যদি না ধরতো তাহলে বোতলটা সোজা ওর মুখ বরাবর এসে লাগতো।
জোহান বললো,
“আমার মনে হয় তোমার ওই বোতলটা খাওয়া উচিত। ওটা খাওয়ার রেকর্ড এখন পর্যন্ত গড়েনি। ওটা কেউ খায় না। ওটাই তোমার জন্য উপযুক্ত খাবার।”
মিতুল অবাক হয়ে বড়ো বড়ো চোখে দেখলো জোহানকে।
জোহান আর দাঁড়ালো না, চলে গেল।
মিতুল অগাধ বিস্ময়ে হাতের বোতলটা দেখলো। হে আল্লাহ! এ কোন অপমানের রাজ্যে এসে পড়েছে? এখানে কেউ তো ওকে মানুষ বলেই ভাবছে না! মিতুল খুব জোরে বোতলটা পতিত করলো ফ্লোরে। কাচের বোতলটা ভেঙে গিয়ে তিন টুকরো হলো। অপমানে জর্জরিত হয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগ করলো মিতুল।
প্যাসেজ ওয়ে ধরে হেঁটে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে। এখানে আর থাকা সম্ভব নয়। পদে পদে অপমানের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এত অপমান সহ্য করে একটা মানুষ থাকে কী করে? রাগে শরীর কাঁপছে ওর, সেই সাথে কান্না পাচ্ছে। এই কানাডার মাটিতে কি অপমান কুঁড়াতে এসেছে? কেন এত অপমান এখানে?
রুমের দরজার কাছে আসতেই শুনতে পেল রুমে মোবাইল বাজছে।
মিতুল দ্রুত রুমে ঢুকে মোবাইল রিসিভ করলো। ওপাশের কলারকে মিষ্টি কণ্ঠে বললো,
“হাই মা।”
“এই পাঁচ বার কল দিলাম তোমায় আমি। এতক্ষণ কোথায় ছিলে?”
“আমি? আমি তো বারান্দায় ছিলাম। মোবাইল সাথে নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। স্যরি আমি।”
“হয়েছে স্যরি বলতে হবে না। তোমার রেশমী আন্টির কাছে ফোন দিয়ে শুনলাম সে ক্যালগারিতে আছে। তাই তোমাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল আমার। কারো সাথে মিস বিহেভ করোনি তো আবার?”
‘তোমাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল আমার’ বাক্যটা শুনে মিতুল মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছিল। কিন্তু শেষের বাক্যটা ওর খুশি আর ধরে রাখতে পারলো না। মা আসলে ওকে নিয়ে চিন্তিত ছিল না, কারো সাথে মিস বিহেভ করেছে কি না সেটা নিয়ে চিন্তিত ছিল। মিতুলের সত্যি সত্যি কান্না পাচ্ছে এখন। কেন ওকে ঘিরে চারদিকে এত নির্মমতা?
_______________
মিতুলের যখন ঘুম ভাঙলো তখন এডমন্টনে কেবল ভোর হয়েছে। শীতল অনুভব হচ্ছে ভোরের দিকটায়। মনে হয় যেন শীতকাল চলছে। কিন্তু রোদ উঠে গেলেই দেখা যাবে আসলে শীতকাল নয়, বসন্ত চলছে। গাছে গাছে ফুটে থাকা রঙিন ফুলই তার প্রমাণ।
মিতুল ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো। বাড়িটা অদ্ভুত রকমের নীরব এখন। নীরবতার জাল চিরে কিচেন থেকে টুংটাং শব্দ ভেসে আসছে শুধু। ক্যামিলা ব্রেকফাস্ট তৈরিতে ব্যস্ত বোধহয়।
মিতুল দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। ম্যাপল গাছের পিছন থেকে সূর্যটা উঁকি দিচ্ছে। বাতাসের চলাচল স্বাভাবিক। ঝোপের মাঝে ফোটা হলুদ ফুলগুলো মিষ্টি সুবাস ছড়াচ্ছে। মিতুল নিঃশ্বাসের সাথে ফুলের সুবাস টেনে নিলো কিছুটা।
সাদাত আঙ্কলকে ছোট্ট গেটটি অতিক্রম করতে দেখা গেল। জগিং করতে করতে এগিয়ে আসছেন উনি। বোধহয় জগিংয়েই বের হয়েছিলেন সকাল সকাল। সাদাত আঙ্কল কাছাকাছি আসলে মিতুলকে ‘গুড মর্নিং’ জানালেন। মিতুলও গুড মর্নিং জানালো তাকে।
সাদাত আঙ্কল পায়ে মৃদু দৌড় অব্যাহত রেখেই পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন।
এর একটু সময় পর দেখা গেল জোহানকে। সাদাত আঙ্কলের মতো জগিং করতে করতে এগিয়ে আসছে। পরনে ট্রাউজার এবং টি-শার্ট। মিতুল জোহানকে এক নজর দেখে আর তাকালো না ওর দিকে। মাথা নিচু করে ঘাসের দিকে তাকিয়ে রইল।
জোহান মিতুলকে দেখে হাসলো এক ঝলক। নিচু করে রাখা মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট মিতুলের। নাকের ছিদ্র দুটো স্বাভাবিক থেকে কিছুটা বড়ো আকার ধারণ করেছে ওর। জোহান মনে মনে বললো,
‘নাক ফুলো মেয়ে তুলতুল!’
মিতুলের পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময় ইচ্ছাকৃত ভাবে মিতুলকে ধাক্কা দিলো জোহান। হঠাৎ করে এমন হওয়ায় মিতুল কিছু বুঝে ওঠার আগেই পড়ে গেল ঘাসের উপর।
মিতুলকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েও জোহান একবার পিছন ফিরে দেখলো না। কোনো ভ্রুক্ষেপ ছাড়াই সোজা চলে গেল ঘরে।
মিতুল কোথাও ব্যথা পেল না। কিন্তু জোহানের আচরণ ওর মস্তিষ্কে যন্ত্রণা ধরিয়ে দিলো। কোন সাহসে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো ওকে? ওকে কি মানুষ মনে হয়নি? একটা মশা ভেবে তোয়াক্কা না করে চলে গেছে এভাবে? মিতুলের মুখ রক্তিম হয়ে উঠছে রাগে। মনে মনে বাজে ভাবে গালি দিলো জোহানকে। তারপর উঠে দাঁড়ানোর জন্য উদ্বুদ্ধ হলে ওর দিকে বাড়িয়ে দেওয়া একটা হাত চোখে পড়লো। হাতটা অনুসরণ করে মানুষটিকে দেখে অবাক হলো মিতুল। জায়িন!
জায়িন ওর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সেটা বিশ্বাস হচ্ছে না ওর। এই দুই ভাইকে কিছুতেই বিশ্বাস হয় না ওর। এরা ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায়। ভালো মানুষের মুখোশ পরে থাকে। আসলে পিছনে অহংকারী শয়তান! মিতুলের মোটেও জায়িনের হাত ধরে উঠে দাঁড়াতে ইচ্ছা হলো না। কিন্তু হাত ধরে উঠে না দাঁড়ালে সেটা অভদ্রতা হবে। মিতুল জায়িনের হাত ধরেই উঠে দাঁড়ালো। সৌজন্যস্বরূপ ধন্যবাদ জানালো জায়িনকে।
জায়িন প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে ঘরে চলে গেল।
“হেই তুলতুল!” দূর থেকে জোহানের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে কানে।
মিতুল তীব্র আক্রোশের সাথে তাকালো জোহানের দিকে।
জোহান দোতলায় বারান্দার রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ানো। মিতুলকে দেখে হাসছে।
মিতুলের কান থেকে উত্তাপ বের হচ্ছে রাগে। কথায় কথায় বাংলাদেশি মেয়ে বলে হেয় করে কথা বলা যেন জোহানের নেশা হয়ে গেছে। কীসে এই নেশা ছাড়বে ওর? দুই গালে কয়েকটা থাপ্পড় পড়লেই এই নেশা বাপ বাপ করে কেটে যাবে। ও পারলে এখনই জোহানের গাল থাপড়ে লাল করে দেয়। কিন্তু সেটা বোধহয় এই ইহজনমে পারবে না!
মিতুল অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে কটমট করে বললো,
“তোকে আমি পুকুরে চুবিয়ে মারবো বদমাইশ!”
“হোয়াট?” জোহান মিতুলের কথা স্পষ্ট ভাবে শুনতে পেল না।
“হোয়াট ডিড ইউ সে? ডিড ইউ স্পিক বেঙ্গলি এ্যাগেন?”
মিতুল রক্তচক্ষুতে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর হনহন করে ঘরে ঢুকে সোজা নিজের রুমে চলে যায়।
_______________
মিতুল ঠিক করেছে আজকে একা একাই বাইরে বের হবে। ও তো আর ছোটো বাচ্চা নয় যে বাইরে বের হলে হারিয়ে যাবে। তাছাড়া একা বের হলে যে আনন্দটুকু উপভোগ করা যায় সেটা অন্য কারো সাথে বের হলে পাওয়া যায় না। হ্যাঁ, ও একাই বের হবে। এটা কালকেও ভাবা উচিত ছিল। কেন একজন লোক নিয়ে বাইরে বের হতে হবে? তাও আবার এই অহংকারী ফ্যামিলির!
ঠকঠক করে দরজা নক করার শব্দ হলো। দরজা নক করছে কে? ক্যামিলা? মিতুল জানালার কাছের চেয়ার ছেড়ে এসে দরজা খুললো। দরজা খানিক খুলতেই দেখা গেল জোহানের মুখ। মিতুল খোলা দরজাটা আবার বন্ধ করার জন্য উদ্যত হলো, কিন্তু পারল না। জোহান হাত দিয়ে টেনে ধরলো দরজাটা। জোহানের প্রতি রাগ যাও একটু কমে এসেছিল তাও আবার বেড়ে গেল।
জোহানের কণ্ঠে থাকা তার সব সময়ের বিরক্ত সুরে বললো,
“শোনো, বেশি স্মার্ট সাজার চেষ্টা করো না। আগেই বলেছি তোমরা বাংলাদেশি মেয়েরা হলে আনস্মার্ট। যা একটু স্মার্ট সাজার চেষ্টা করো ওগুলো সব উপরে উপরে। ওগুলো কোনো কাজের নয়। দশ মিনিট…না, পাঁচ মিনিট। পাঁচ মিনিট সময় দিচ্ছি তোমায়। এর মধ্যেই গ্যারেজে উপস্থিত থাকবে। নয়তো রুমে এসে তুলে নিয়ে যাব তোমায়। আর আমার যদি এখানে দ্বিতীয় বার আসার প্রয়োজন পড়েই, তাহলে কিন্তু শুধু তুলে নিয়ে যাব না, মেরে হাড্ডিও ভেঙে দেবো। সো বি কেয়ারফুল। অ্যান্ড বি এ গুড গার্ল, ও কে?”
রেশমী আন্টিদের বাড়ির পিছনে যে এত সুন্দর গার্ডেন আছে সেটা আগে দেখেনি মিতুল। ফ্রেশ হয়ে হলরুমে নামার পর ব্যাক ডোরে চোখ পড়তে কী ভেবেই যেন বের হয়েছিল। বের হয়ে যা দেখলো তাতে মন অনেকখানি ভালো হয়ে গেছে। গার্ডেনের বেশির ভাগ জায়গাই ফুল গাছে ভরা। বসন্ত তাই সব গাছেই ফুল ধরে আছে। অনেক ফুলের নাম অজানা মিতুলের।
গার্ডেনে আছে অনেক ফল ও শাকসবজির গাছও। আপেল, স্ট্রবেরি, চেরি, কমলা, আঙুর, গাজর, আনারস, লেবু, বাঁধাকপি, লেটুস, পালং, সুইস চার্ড আরও কত কী। ওদিকে গার্ডেনের শেষ প্রান্তে বড়ো একটা পাইন গাছের ডালে দড়িতে এক টুকরো কাঠ ঝুলছে। দোলনাটা অনেক আগের তৈরি মনে হচ্ছে। এ বাড়িতে আবার দোলনায় দোল খায় কে?
গার্ডেনের পিছন দিকটা জংলা টাইপের। বিশাল জঙ্গল বোধহয়। একটা সরু রাস্তার মতো দেখা যাচ্ছে। যেটা সোজা জঙ্গলের অন্ধকার রাজ্যের দিকে চলে গেছে। মিতুল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল রাস্তাটার দিকে। ওই জঙ্গলের মধ্যে মানুষ যায়?
রেশমী আন্টির ডাক কানে এলো। সম্ভবত ব্রেকফাস্ট করার জন্য ডাকছেন। মিতুল ঘরে চলে এলো।
ডাইনিংরুমে রেশমী আন্টি বসে আছেন। মিতুলকে দেখে হাসলেন তিনি। মিতুলও হাসলো মৃদু। রেশমী আন্টি অহংকারী হলেও তার হাসিটা বরাবরই প্রাণবন্ত মনে হয়। ওই হাসিতে কোনো অহংকারের ছোঁয়া নেই।
ক্যামিলা খাবার রাখছে টেবিলে। ব্রেড, জ্যাম, কফি, কেক, দুধ দিয়ে তৈরি এক ধরনের পানীয় এবং স্পেশাল একটা খাবার। স্পেশাল খাবারটির নাম জানা নেই মিতুলের। এর আগে দেখেনি কখনও। দেখে অনেক সুস্বাদু মনে হচ্ছে।
মিতুল রেশমী আন্টির সাথে ব্রেকফাস্ট সারতে লাগলো। আর কাউকে দেখা গেল না ডাইনিং রুমে। মিতুল একটা জিনিস লক্ষ করেছে, এই বাড়ির কারোর খাওয়াদাওয়ার ঠিক নেই। যার যে সময় ইচ্ছা সে সেই সময় খায়। একসাথে বসে খায় না সবাই। যেমন, আজকে সকালের মতোই কালকে রাতে ডিনারের সময় ডাইনিং টেবিলে কেবল ও আর রেশমী আন্টিই ছিল। বাকিরা হয় আগে খেয়েছে, নয়তো পরে।
রেশমী খাওয়ার এক পর্যায়ে বললেন,
“ভাবছি আজকে তোমায় নিয়ে ঘুরতে বের হবো। গতকালকে জার্নি করে এসেছিলে, ভাবছিলাম রেস্টে থাকো। আজকে বের হবো বাইরে। ব্রেকফাস্ট শেষে রেডি হয়ে থেকো।”
মিতুলের মন ভালো হয়ে গেল। আনন্দ হাওয়া বইল মনে। এটাই তো চায়। কানাডা এসেছে কি ঘরে বসে থাকার জন্য? ঘুরে বেড়াবে বলেই তো এসেছে। মিতুল নিজের উত্তেজনা, উদ্দীপনা চেপে রেখে ভদ্র কণ্ঠে বললো,
“ঠিক আছে।”
মিতুল হোয়াইট কালারের কাপড়ের উপর হোয়াইট সুতোর এমব্রয়ডারি করা একটা টপস এবং নেভি ব্লু রঙের জিন্স পরলো। আর গলায় একটা স্কার্ফ পেঁচিয়ে নিলো। চুলগুলো খোলা রেখেছে। ওর চুল তেমন লম্বা নয়। চুলগুলো কোনো রকম কাঁধ বেয়ে একটু নিচে নেমেছে। ইচ্ছা করেই চুল লম্বা রাখে না। লম্বা চুল ভালো লাগে না ওর।
নতুন কেনা এক জোড়া কেডস পায়ে দিয়ে কাঁধে সাইড ব্যাগ ঝুলিয়ে রুম থেকে বের হলো মিতুল।
প্যাসেজওয়ে ধরে আসার সময় ওর রুম থেকে একটা রুম রেখে পরে যে রুমটা রয়েছে, সে রুমের বন্ধ দরজার আড়াল থেকে গানের সাউন্ড ভেসে এলো কানে। উচ্চৈঃস্বরে গান বাজছে। এই রুমটা কার? ওই বদমাইশের হতে পারে।
মিতুল ক্যামিলার কাছ থেকে জেনেছে, কালকে ওকে ‘ননসেন্স, ইডিয়ট, সিক গার্ল’ বলা মদখোর ছেলেটা রেশমী আন্টির ছোটো ছেলে। একটা জিনিস মিতুল কিছুতেই বুঝতে পারছে না, রেশমী আন্টির ছোটো ছেলে বিদেশিদের মতো দেখতে কেন? বাবা-মা দুজনই তো বাংলাদেশি, তাহলে সে ওরকম দেখতে কেন? সার্জারি করেছে? চুলে কালার করেছে? মিতুল আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে হলরুমে নেমে এলো।
রেশমী আন্টির পরনে খয়েরি রঙের লং গাউন এবং মাথায় খয়েরি হিজাব। রেশমী আন্টিকে দেখতে ইয়াং লাগছে। মনে হচ্ছে বয়স বাড়েনি। বয়স যেন ত্রিশের কোঠায় আটকে আছে। অথচ ওনার বড়ো ছেলের বয়সই আঠাশ বছর। রেশমী আন্টির মুখে চিন্তার ছাপ উপস্থিত। মিতুল নিস্তেজ গলায় বললো,
“আন্টি, এনিথিং রং?”
মিতুল যে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তা খেয়াল করেনি রেশমী। তাই হঠাৎ করে মিতুলের কণ্ঠ ওনাকে চমকে দিলো। রেশমী শুকনো মুখে বললেন,
“একচুয়্যালি, আমার কাজিন হিমানি অসুস্থ। আমাকে ফোন করে জানিয়েছে এইমাত্র। ওরা ক্যালগারিতে থাকে। আমাকে সেখানে যেতে হবে এখন। তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে পারি, কিন্তু অপরিচিত ব্যক্তির উপস্থিতি ওদের ভালো লাগবে না। ওরা আসলে এমনই। আর তাছাড়া তোমারও সেখানে থাকতে বোরিং ফিল হবে।” রেশমী খানিক বিরতি নিলেন।
মিতুলের মনে হলো রেশমী আন্টি পেঁচিয়ে কথা বলতে জানেন না। যা বলার সরাসরিই বলেন। তা না হলে এমন একটা কথা কিছুতেই এত সহজ ভাবে বলতে পারতেন না। মিতুলের একটু মন খারাপ হলো। কোথায় ভেবেছিল আজকে একটু ঘুরতে বের হবে, কিন্তু সেটা আর হলো না!
আবারও রেশমী আন্টির গলা শোনা গেল,
“তুমি চিন্তা করো না। বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার জন্য অন্য একজন মানুষ দিয়ে দিচ্ছি তোমাকে।”
“গুড মর্নিং মম!” সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে মমের দিকে উইশ ছুঁড়লো জায়িন। তারপর হলরুমে পা রেখে মিতুলকেও গুড মর্নিং জানালো।
মিতুলও প্রতিউত্তরে হেসে গুড মর্নিং জানায়।
“আমার একটা কাজ করে দাও মাই বেবি!” রেশমী বিনয় নিয়ে বললেন ছেলেকে।
“কী কাজ?”
“মিতুলকে একটু বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাও।”
জায়িন অবাকের তুঙ্গে উঠে বললো,
“তোমার কি মাথা খারাপ মম? আমি কীভাবে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাব ওকে? আমি পারব না…”
জায়িনের কথা গায়ে লাগলো মিতুলের। অপমান বোধ করলো জায়িনের এমন কথায়। এই পরিবারের মানুষ প্রত্যেক কথায় বোধহয় মানুষকে অপমান করার ক্ষমতা রাখে। এদের প্রত্যেক কথায়ই কেমন যেন একটা ভাব থাকে। মানুষকে যেন মানুষ বলে মনে হয় না এদের।
“আমার অফিস আছে। অফিস বাদ দিয়ে কাউকে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার সময় আমার নেই। তাছাড়া আজকে রাশিয়ান ক্লায়েন্টদের সাথে মিটিং আছে। সো, আমার হাতে বাড়তি কোনো সময় থাকবে না।” জায়িন পরাপর কথাগুলো শুনিয়ে গেল মমকে।
রেশমী খুব করে চাইছিলেন জায়িনের সাথে মিতুলকে পাঠাতে, কিন্তু সেটা সম্ভব হবে না। তাই রেশমীর মন খারাপ হলো।
কেউ কোনো কথা বললো না মধ্যমে।
জায়িনকেই আবার বলতে শোনা গেল,
“একটা কাজ করো। জোহানের সাথে পাঠিয়ে দাও ওকে। জোহান তো সারাদিন ঘুরেই বেড়ায় বাইরে বাইরে। ওর সাথে গেলেই ভালো হবে…আসছি আমি। আবার দেখা হবে।” জায়িন বেরিয়ে গেল।
জোহান গুনগুন করে গলায় ইংলিশ গানের সুর তুলে আঙুলের চরকায় কারের চাবি ঘুরাতে ঘুরাতে নেমে আসছিল। মিতুলকে এবং মমকে দেখেও সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আনমনে গুনগুন করতে করতে এগিয়ে চললো দরজার দিকে। দরজা থেকে কিছুটা দূরে থাকতেই রেশমী ডাক দিলেন।
“জোহান!”
জোহানের পথ চলা থামলো। সেই সাথে থামলো আঙুলের চরকায় ঘোরানো গাড়ির চাবিও। নির্বিকার ভাবে পিছনে ফিরে বললো,
“হোয়াট?”
রেশমী ইংরেজদের মতো গলায় টোন তুলে জোহানের বোধগম্য ইংলিশে বললেন,
“কোথায় যাচ্ছ? ফ্রেন্ডসদের সাথে টাইমপাস করতে?”
“মম, আমি তো তোমাকে বলেছিলাম, আমার ফ্রেন্ডস সার্কেলের সবাই গ্রামের ওদিকে পিকনিকে গেছে। ওরা কেউ নেই এখানে। শুধু আমি ছাড়া। কি বলিনি?”
মিতুল লক্ষ করলো জোহানের কথা বলার মাঝে কেমন যেন এক বিরক্তির সুর ফুটে ওঠে। যেন ওই সুরটা ছাড়া কথা বলতে পারে না সে। আর মিতুল কালকে জোহানকে পরিচিত মনে হওয়ার কারণটা ধরতে পেরেছে। জোহানের চেহারায় কিছুটা রেশমী আন্টির প্রতিফলন। যার কারণে কাল জোহানকে চেনা চেনা লাগছিল।
“ঠিক আছে, বুঝতে পেরেছি আমি। এখন আমায় একটি বিষয়ে সাহায্য করো।”
“হোয়াট’স দ্যাট?” আবারও নির্বিকার ভাবে প্রশ্ন করলো জোহান।
“ওকে নিজের সাথে নিয়ে যাও এবং শহরটি ঘুরিয়ে দেখাও।” রেশমী হাত দিয়ে মিতুলকে দেখিয়ে দিলেন।
জোহান মমের হাত অনুসরণ করে তাকালো মিতুলের দিকে। ওর দিকে তাকিয়ে থেকে কী যেন ভাবলো একটু। তারপর কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
“ও কে, নো প্রবলেম। লেট’স গো!” শেষের ‘লেট’স গো’ কথাটি মিতুলের উদ্দেশ্যে বললো। তারপর আঙুলে চাবি ঘোরাতে শুরু করে গুনগুন করতে করতে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে।
মিতুল যতক্ষণে গ্যারেজে এসে পৌঁছলো ততক্ষণে জোহান ড্রাইভিং সিটে বসে সিট বেল্টও বেঁধে ফেলেছে। মিতুল পিছনের সিটে বসার জন্য গাড়ির পিছনের দরজা খুললো। সামনে থেকে জোহান গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
“হেই, এটাকে কি ট্যাক্সি পেয়েছো তুমি? সামনে এসে বসো।”
জোহানের এহেন আচরণে মিতুলের মেজাজ খারাপ হলো। এমনিতেই গতকালকের সন্ধ্যার ঘটনাটা ওর চোখে এখনও জ্বালা ধরিয়ে দেয়। ও খোলা দরজাটা জোরে শব্দ করে বন্ধ করলো। বন্ধ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে জোহানের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটে বললো,
“বদমাইশ বেক্কল!”
মিতুল গাড়ির পিছন ঘুরে গিয়ে জোহানের পাশের সিটে বসলো। ও সিটবেল্ট ঠিক মতো বাঁধতেও পারলো না, তার আগেই জোহান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে গ্যারেজ থেকে ড্রাইভওয়েতে নামিয়ে ফেললো। মিতুল কোনো রকম সিট বেল্টটা লাগিয়ে নিলো তাড়াতাড়ি।
কোলাহলহীন শান্ত রাস্তায় জোহানের ব্ল্যাক কারটি এগিয়ে চলছে ধীর গতিতে। মিতুল ব্যস্ত উইন্ডো থেকে বাইরের পরিবেশ দেখতে। আশেপাশে শুধু রঙিন ফুলের ছড়াছড়ি। অনেক গাছ আছে যাতে কোনো পাতাই নেই, আছে শুধু ফুল। যেগুলো নিজেদের সৌন্দর্যের বাহার ছড়াচ্ছে।
কারের ভিতরে চলছে নীরবতা। গাড়িতে ওঠার পর কোনো কথা হয়নি দুজনের। জোহান রাস্তার বাম দিকে বাঁক নিয়ে প্রথম মুখ খুললো,
“হেই গার্ল, হোয়াট’স ইওর নেম?”
জোহানের প্রশ্নে মিতুল বাইরে থেকে দৃষ্টি এনে জোহানের মুখে নিক্ষেপ করলো। জোহানের বাদামি চুলগুলো কপাল জুড়ে পড়ে আছে। বাদামি চোখ জোড়া ঢাকা সানগ্লাসে। চোখ সরিয়ে নিলো মিতুল। সামনের গ্লাসের ভিতর থেকে সামনের দৃশ্যমান রাস্তাটাকে দেখতে দেখতে বললো,
“মিতুল দিলরাবা।”
“হোয়াট? হোয়াট ডিড ইউ সে? তুলতুল?”
মিতুলের শান্ত চোখ জোড়া হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে উঠলো। তুলতুল? ওর এত সুন্দর নামটাকে পর্যন্ত ব্যঙ্গ করলো? কেমন মানুষ এরা? এরা কি পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছে কেবল মানুষকে অপমান করার জন্য? মিতুলের দাঁতে দাঁত লেগে এলো। ভিতরটা প্রস্তুত হলো কয়েকটি কঠিন কথা শোনানোর জন্য। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলো না। মায়ের কথা মনে পড়লো। মায়ের কানে কিছু গেলেই খবর হয়ে যাবে ওর। মিতুল নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করলো। কঠিন বুলি ছুটতে চাওয়া মুখটি খুব ভালো করে বোঝানোর চেষ্টা করলো,
“তুলতুল নয়। মিতুল। মি…তুল।”
“ওহ আচ্ছা, মি-তুল! নট ব্যাড। তুলতুলের থেকে ভালো আছে।”
মিতুল সন্দ্বিগ্ন চোখে তাকালো। ‘নট ব্যাড’ এবং ‘তুলতুলের থেকে ভালো আছে’ কথা দ্বারা কী প্রমাণ করতে চাইলো? ওর নামটা খারাপ? হুহ্! এমন একটা ভাব করছে যেন নিজের নাম কত ভালো! নিজের নাম কী? নিজের নাম তো জোহান। যে নাম বাপ-দাদার জন্মেও শোনেনি কখনও। নিজে একটা অহেতুক নাম নিয়ে চলছে, আবার সে আসছে অন্যের নামকে ব্যঙ্গ করতে! মিতুল জোহানের অগোচরে ভেংচি কাটলো ওকে।
“কী করো তুমি?” আবারও জোহানের প্রশ্ন।
“কিছু না, লেখাপড়া করছি।”
“বাংলাদেশ থেকে এসেছো, তাই না?” কেমন গা ছাড়া ভাবে জিজ্ঞেস করলো।
“হ্যাঁ।”
জোহান এমন একটা ভঙ্গি করলো যেন বাংলাদেশ থেকে আসাটা নিছক একটা উটকো ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। জোহান বিরক্ত ভরা কণ্ঠে বললো,
“এই বাংলাদেশি মানুষদের আমি একদমই পছন্দ করি না। এখানে অনেক বাংলাদেশি থাকলেও কোনো বাংলাদেশি বয়-গার্লদের আমি আমার ফ্রেন্ড সার্কেলে ঢুকাইনি। বাঙালিরা বোকা এবং নিষ্কর্মা হয়। এই জন্যই ওদের পছন্দ নয় আমার। অপছন্দ করি ওদের। আর সবচেয়ে বেশি অপছন্দ করি বাঙালি মেয়েগুলোকে। ওরা ছেলেদের থেকে অনেক বেশি বোকা হয়। গাধা টাইপের। ওদের মগজ বিক্রি করলে হাফ ডলারও পাওয়া যাবে না বোধহয়।”
জোহানের কথায় মিতুলের গায়ের রক্ত টগবগ করে উঠলো। কথাটি যে বিশেষ করে ওকে ইঙ্গিত করে বলেছে সেটা বুঝতে ওর এক সেকেন্ডও লাগলো না। এরকম কথা শোনানোর জন্যই বোধহয় এক বাক্যে নিজের সাথে ঘুরতে আনতে রাজি হয়েছে? মিতুল তীব্র ক্রোধের সাথে গর্জে উঠলো,
“হ্যাঁ, বাঙালি মেয়েরা তো গাধা টাইপের। ওদের মগজ বিক্রি করে হাফ ডলারও পাওয়া যাবে না। তুমি তো স্বয়ং বুদ্ধির ডিব্বা একটা। তুমি গিয়ে নিজের মগজ বিক্রি করে কোটিপতি হও না, কে নিষেধ করেছে তোমায়?”
মিতুল নিজের হুঁশে ফিরলো। এতটাই ক্ষুব্ধ ছিল যে বাংলা ভাষা বলে ফেলেছে? অবশ্য এতে স্বস্তি অনুভব করলো ও। যাক, বাংলাতে বলায় জোহান কিছুই বুঝতে পারেনি মনে হয়। বাংলা ভাষায় অবগত নয় হয়তো। যদি অবগত হতো তাহলে ওর কপালে ভোগ নেমে আসতো। মিতুল দুই পাশে মাথা নেড়ে হাসার চেষ্টা করে বললো,
“নাথিং।”
জোহান চোখ সরিয়ে নিয়ে সামনে দৃষ্টিপাত করলো। কিছুটা ক্ষোভ নিয়ে বললো,
“বাংলাদেশের মানুষদের যেমন অপছন্দ করি, ঠিক তেমনি অপছন্দ করি বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজটাকেও। বাজে ল্যাঙ্গুয়েজ একটা। ফ্যামিলি থেকে এই বাজে ল্যাঙ্গুয়েজটাই আবার বাধ্যতামূলক করেছে। ড্যাম ইট! সব সময় টপার স্টুডেন্ট ছিলাম। হাইয়েস্ট মার্ক ছিল সবকিছুতে। কিন্তু এই বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজটা আমার সকল ইমেজ নষ্ট করে দিয়েছে। আমার এই চব্বিশ বছর লাইফের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ সময়টা আমি ছুটেছি এই বাংলা ল্যাঙ্গুয়েজের পিছনে। কিন্তু কী হলো? পাজি ল্যাঙ্গুয়েজটা কিছুতেই ঠিকঠাক ভাবে আমার আয়ত্তে এলো না। সামথিং যা শিখেছি তাও চর্চা না করলে ভুলে যাওয়ার মতো অবস্থা। স্প্যানিশ ল্যাঙ্গুয়েজ শিখতেও আমার এত ঝামেলা পোহাতে হয়নি। মাত্র কয়েক মাস লেগেছিল শিখতে। অথচ এই স্টুপিড ল্যাঙ্গুয়েজটা…”
মিতুলের হাত-পা রাগে নিশপিশ করছে। খুব করে ইচ্ছা করছিল জোহানের কথার মাঝে ওর দু গালে চব্বিশ মণ ওজনের দুটো চড় মারে। কিন্তু নিজের গাল দুটোর কথা ভেবেই আবার ইচ্ছা দমে যায়। জোহানের গালে চড় মারলে নিজের গাল দুটোও চড় খেয়ে লাল টমেটো হয়ে যাবে। মায়ের হাতের জোরের কথা মনে আছে। সেই ক্লাস ফাইভে বাংলায় কম মার্ক পাওয়ার কারণে চড় খেয়েছিল মায়ের হাতে। সে যে কী ব্যথা ছিল! মনে হতেই মিতুলের গা শিরশির করে উঠলো।
গাড়ি এসে চেরি ব্লসমের রাজ্যে প্রবেশ করলো। রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে কিছু চেরি ব্লসম ট্রি। বাতাসের তালে তালে গাছ থেকে ঝরে পড়ছে চেরি ব্লসম পাপড়ি। আহ্, কী মনোরম! কী নয়নাভিরাম!
মিতুল মুগ্ধ নয়নে চেরি ব্লসম ঝরে পড়া দেখছিল উইন্ডো থেকে। শখও জেগেছিল হাত বাড়িয়ে একটু ছুঁয়ে দেবে পাপড়িগুলো। কিন্তু সেই সুযোগ ও পেল না। তার আগেই উইন্ডো কাঁচ ধীরে ধীরে উপরে উঠে উইন্ডো বন্ধ করে দিলো। কী হলো ব্যাপারটা? মিতুল চকিতে চাইলো জোহানের দিকে।
জোহান কণ্ঠে বিরক্তি ঝরিয়ে বললো,
“একদম ভালো লাগে না এই ঝরা ফুল। এত ধীর গতিতে ঝরে যে জাস্ট বিরক্তিকর!”
মিতুলের নাক রাগে ফুলে উঠলো। ওর বুঝতে বাকি নেই, আসলে ফ্যামিলির মধ্যে সবচেয়ে অহংকারী, হিংসুটে, পাজি মানুষটি হলো এই জোহান!
বিদেশে বসবাস করলে যে মানুষের অহংকার এত বেড়ে যায়, সেটা আগে জানা ছিল না মিতুলের! কিন্তু কানাডার মাটিতে পা রাখার পর অবগত হলো সে ব্যাপারে। ও একা একটি মেয়ে সুদূর বাংলাদেশ থেকে এই কানাডা এলো, অথচ রেশমী আন্টির ফ্যামিলির কেউ একজন ওকে নিতে না এসে বাসার একজন মেইডকে পাঠিয়ে দিলো? কেমন ফ্যামিলি তাদের?
অপমান, রাগে সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে মিতুলের। তবুও নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো।
সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে ভালো করে দেখতে লাগলো মিতুল। মেয়েটির নাম ক্যামিলা। বয়স আনুমানিক আঠাশ কি ত্রিশ হবে। এটা কেবলই ওর ধারণা। মেয়েটির বয়স এর থেকে কমও হতে পারে, আবার বেশিও হতে পারে। দেখতে ভীষণ সুন্দর। ত্বক অত্যধিক উজ্জ্বল। চোখের মণি কিছুটা কমলা রঙের। মাথার অপূর্ব সোনালি চুলগুলো হেয়ার রাবার দিয়ে পিছনে বাঁধা। পরনে গ্রীন কালারের শার্ট এবং ব্ল্যাক কালারের হাটু অবধি একটা শর্ট স্কার্ট। পায়ে উঁচু হিল। মেয়েটিকে দেখে একদমই মনে হচ্ছে না যে সে একজন পরিচারিকা।
মেয়েটি মিতুলকে নিজের উপর দৃষ্টি বুলাতে দেখে বললো,
“ম্যাম, শ্যাল উই গো টু আওয়ার কার?”
মেয়েটি মিতুলের লাগেজ নিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। মিতুল তার পিছন পিছন হাঁটলো।
প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে এলো দুজনে।
লাগেজ দুটো গাড়ির পিছনে বুটে রেখে সামনের আসনে বসে গাড়িতে স্টার্ট দিলো মেয়েটি। মিতুল পিছনের আসনে চুপটি করে বসে রইল।
গাড়ি ক্যালগারির রাস্তা ধরে এডমন্টনের দিকে এগিয়ে চলছে।
মিতুলের চঞ্চল আখি দুটি গাড়ির উইন্ডো দিয়ে বাইরে দৃষ্টি বুলিয়ে চলেছে। মিতুলদের গাড়ির পাশ কাটিয়ে একের পর এক গাড়ি চলে যাচ্ছে। বড়ো বড়ো দালান সাঁইসাঁই করে অতিবাহিত হচ্ছে চোখের পলকে। মাঝে মাঝে নান্দনিক ডিজাইনের ছোটো ঘরবাড়িও চোখে পড়ছে। সাদা চামড়ার কানাডিয়ান অধিবাসীরা ক্ষণিকের জন্য চোখে ধরা দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে আবার। রাস্তার দু পাশে ছোটো-বড়ো গাছগুলোতে ফুলের সমারোহ। এখানে যে বসন্ত চলছে এখন সেটাই জানান দিচ্ছে তারা। ম্যাপল গাছগুলো বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে, মিষ্টি রোদ্দুর মেখে।
কানাডা ঘুরতে আসার স্বপ্ন ছিল মিতুলের। অবশেষে পূরণ হলো সেটা। আর এটা পূরণ হওয়ার পিছনে অবদান হলো রেশমী আন্টি এবং মায়ের। বলতে গেলে রেশমী আন্টির ক্রেডিটই বেশি।
ওর আব্বু একটু কঠোর টাইপের। একা একটি মেয়েকে বিদেশ ছাড়তে কিছুতেই রাজি ছিলেন না তিনি। কিন্তু রেশমী আন্টি আব্বুকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে রাজি করালেন।
রেশমী আন্টি মিতুলের খুব বেশি ঘনিষ্ঠ কোনো আত্মীয় নন। আবার কমও নন। মায়ের এক রকমের কাজিন হয়, এবং সেই সাথে বান্ধবী। ছোটো বেলা থেকে কলেজ লাইফ পর্যন্ত এক সাথে ছিল তারা। মায়ের সাথে তার ভালো সম্পর্ক। তবে মিতুল তাকে খুব কম সময়ের জন্য দেখেছে।
রেশমী আন্টি প্রায় ত্রিশ বছর যাবৎ কানাডা থাকেন। আর তার হাসব্যান্ড থাকে তারও অনেক আগে থেকে। বিয়ের পর পরই তার হাসব্যান্ড তাকে কানাডা নিয়ে এসেছে। রেশমী আন্টি মাঝে মাঝে বাংলাদেশে যান। ওদের বাড়িতেও গিয়েছিল কয়েক বার। ছোটো বেলায় তাকে দু চার বার দেখলেও দেখতে পারে, কিন্তু তা কিছুই মনে নেই। ছোটো ছিল বলেই হয়তো স্মৃতিতে নেই। তবে বড়ো হওয়ার পর শুধু একবার দেখেছিল তাকে। আরও একবার গিয়েছিল ওদের বাড়িতে। কিন্তু ওর এক্সামের জন্য দেখা হয়নি তার সাথে। মিতুলদের বাড়ি ঢাকাতে। আর ও এখন পড়াশোনা করে রাজশাহী। ইন্টারের পর বান্ধবীর সাথে রাজশাহী ভর্তি হয়েছে। বেশির ভাগ সময় রাজশাহীতেই থাকে এখন। তাই রেশমী আন্টি ওদের বাসায় গেলেও ও এক্সাম রেখে তার সাথে দেখা করতে পারেনি। এখন বলা চলে ওর কেবল একবারই দেখা হয়েছে তার সাথে। তবে বাসায় থাকলে মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হয় তার সাথে। মা ফোন ধরিয়ে দেয় কথা বলার জন্য।
মানুষটা তো বেশ ভালো ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে অহংকারী হয়ে গেছে। সে নিজেই এত কিছু করলো ওকে এখানে আনতে। অথচ এনে কী করলো? শুরুতেই অপমান! কেন রেশমী আন্টি নিজে নিতে এলো না?
ঠিক আছে, ধরলো সে কোনো এক কারণে আসতে পারলো না। কিন্তু তার ছেলেরা? শুনেছে দুইজন যুবক ছেলে আছে তার। যদিও নিজে কোনো দিন দেখেনি তাদের। তারাই তো ওকে এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারতো। কেন এলো না নিতে? কাজের ছুতো? একটু সময়ের জন্য কাজ ছাড়লে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে? রাগ আবার চড়াও হতে লাগলো মিতুলের।
অনেকক্ষণ চুপ করেই বসে রইল মিতুল। কিন্তু চুপ করে বসে থাকতে ভালো লাগছে না একদম। সামনের আসনের মেয়েটিকে দেখলো একবার। মেয়েটি সামনে নজর রেখে গাড়ি চালাচ্ছে। মিতুলের মনে হলো মেয়েটি দক্ষ একজন চালক।
রেশমী আন্টির বাড়ি এডমন্টন শহরে। শহরটি যে বেশ সুন্দর বুঝতে বাকি নেই মিতুলের।
প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টার ব্যবধানে রেশমী আন্টির বাড়ি এসে পৌঁছালো। ড্রাইভ ওয়ে দিয়ে গাড়িটি গ্যারেজের দিকে নিয়ে যাচ্ছে ক্যামিলা। মিতুল উইন্ডো দিয়ে আশপাশ দেখতে লাগলো। বেশ দীর্ঘ একটি বাড়ি। বিশাল লন। লনের চারপাশ গাছ দ্বারা বেষ্টিত। ম্যাপল গাছ, পাইন গাছ, ঝাউ গাছ, ওক গাছ…কয়েকটি চেরি ব্লসমের গাছও দেখতে পেল। গাছে ফুটে আছে গুচ্ছবিদ্ধ চেরি ব্লসম।
রেশমী হলরুমে বসে অপেক্ষা করছিলেন। মিতুল ঘরে প্রবেশ করতেই এসে জড়িয়ে ধরলেন ওকে, কপালে চুমু খেলেন।
নিমেষেই মিতুলের রাগ কমে গেল। কিন্তু অভিমান রয়েই গেল। অপমান সহজে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। রেশমী আন্টি খুব বেশি কথা বললেন না। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হতে বললেন।
ক্যামিলা মিতুলকে রুমে নিয়ে এলো।
রুমে এসে আরেক দফা মুগ্ধতায় হারালো মিতুল। এত সুন্দর রুম! দেওয়াল জুড়ে থাকা বিশাল আকৃতির গ্লাস উইন্ডোর দিকে ছুটে এলো ও। ওয়াও!
জানালা দিয়ে বাড়ির লনটা ভালোই দেখা যায়। এক সাইডে থাকা চেরি ব্লসমের ট্রিগুলোও নজরে পড়ে। মিতুল এক মুহূর্তের জন্য রাতের দৃশ্য কল্পনা করার চেষ্টা করলো। জোৎস্না মাখা রাত। মৃদুমন্দ বাতাস বইছে। ও দাঁড়িয়ে আছে জানালার কাছে। খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো সরাসরি গায়ে এসে পড়েছে ওর। চুলগুলো হালকা বাতাসে উড়ছে। ও তাকিয়ে আছে দূরে থাকা কিছু চেরি ব্লসমের ঝরা পাপড়ির দিকে। আহ, কী রোমাঞ্চকর মুহূর্ত!
গোসল সেরে নিলো মিতুল। বাড়ির অন্য এক পরিচারিকা রুমে খাবার দিয়ে গেল। কজন মেইড রাখা আছে এই বাড়িতে? এদের বেতন কত দেওয়া হয়? নিশ্চয়ই আকাশচুম্বী? এখানে এসে যা বুঝতে পারলো তা হলো, রেশমী আন্টিদের সম্পর্কে ও যা শুনেছিল রেশমী আন্টিরা তার থেকেও অনেক বেশি ধনী। অবশ্য ধনী হবেই বা না কেন? তার হাসব্যান্ড সেই কতগুলো বছর যাবৎ কানাডা থাকছে, বিশাল বড়ো চাকরি করছে, ধনী তো হওয়ারই কথা। তাছাড়া দেশের বাড়িতেও তাদের পরিবার বিশাল বিত্তশালী পরিবার!
মিতুল নিজের পারিবারিক অবস্থার কথা ভাবলো একবার। ওরাও কি কম ধনী না কি? ঢাকায় তিন তিনটা বাড়ি ওদের। বাবার ভালো ব্যাবসা। গাড়িও আছে। রেশমী আন্টিদের মতো এত ধনী না হলেও বলতে গেলে ভালো রকম ধনীর কাতারেই পড়ে ওরা।
মিতুল খাওয়া শেষ করলো। প্লেটে কোনো খাবার বাঁচলো না। এতটাই ক্ষুধার্ত ছিল যে সকল খাবারই গপাগপ করে খেলো।
গোসল শেষ, খাওয়া শেষ, এবার একটু শান্তিময় ঘুম প্রয়োজন। মিতুল গা এলিয়ে দিলো বিছানায়। এক টুকরো সাদা মেঘের তুলতুলে কোমল কোলে যেন গা ডুবে গেল। বড়ো করে এক নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো ও।
মিনিট পার হলো, পার হলো ঘণ্টাও। কিন্তু এ কী! ঘুম আসার নাম গন্ধও নেই। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে উঠে গেল ও। মানুষ দীর্ঘ জার্নির ফলে ক্লান্ত থাকে, আর সেই ক্লান্তি থেকে আসে ঘুম। ওর এত দীর্ঘ জার্নির পরে ক্লান্তি লাগছে একটু, তবে ঘুম পাচ্ছে না। অপরিচিত জায়গা বলেই হয়তো এমন হচ্ছে। ধরা দিচ্ছে না ঘুমটা। মিতুল খানিক দোনামনা করে মোবাইলটা নিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।
দোতলার প্যাসেজওয়ে ধরে এগিয়ে চলছে। বাড়িটা ঘিরে আছে নিস্তব্ধতায়। যেন কোনো পাতালপুরী। সব সময় কি এমনই থাকে? চলতে চলতে দোতলার কয়েকটি দরজার দিকে নজর পড়লো। কারা থাকে এই দরজার পিছনের রুম গুলোতে?
মিতুল সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলে ওর রুমে খাবার নিয়ে যাওয়া মেইডটিকে দেখতে পেল। একটি সাদা লোমের ডলের মতো বিড়ালকে ক্যাট ফুড খাওয়াচ্ছে। বিড়ালও পালে না কি এরা?
মিতুল সোজা দরজার দিকে হেঁটে গেল।
বাইরে পা রাখতেই পরশ বুলিয়ে দিলো নির্মল বাতাস। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলো মিতুল। এই তো সত্যি সত্যি কানাডার অক্সিজেন গ্রহণ করছে ও। বাইরে সোনালি রোদ্দুর খেলা করছে। ঘাসে, গাছের পাতায়, ফুলে সবখানে রোদ্দুরের বিরাজ। তবে এ রোদ্দুরে তেমন কোনো তাপ নেই। ঘরের সামনে থাকা একটু ঝোঁপের মতন জায়গাটায় ছোটো ছোটো হলুদ ফুলের আশেপাশে কয়েকটা প্রজাপতি ঘোরাঘুরি করছে। ফুলগুলোর নাম জানা নেই ওর।
লনের বাম সাইডে গাছের ছায়ায় পর পর তিনটি ইজি চেয়ার রাখা। মিতুল একটিতে বসলো গিয়ে। দৃষ্টি রাখলো লনের ডান সাইডে থাকা চেরি ব্লসমের উপর। কী অপূর্ব দেখতে এই চেরি ব্লসম! পুরো গাছটাকে এক সুপ্ত মায়ায় ভরিয়ে রাখে। এই মায়া যেন আর কিছুতে পাওয়া যায় না। ওই গোলাপি পাপড়ির সুপ্ত মায়ায় জড়িয়ে রাখা পুষ্পই হলো গাছের মূল প্রাণ। মিতুল মোবাইল বের করে কয়েকটি ছবি তুললো চেরি ব্লসমের। সেলফিও তুললো চেরি ব্লসমের সাথে। এই পিকগুলো ইন্সট্রাগ্রাম, ফেসবুকে দেবে। সত্যি সত্যিই যে কানাডা এসেছে জানাতে হবে না মানুষদের?
তোলা ছবিগুলো দেখতে লাগলো মিতুল। ঠিক এই সময়েই পাশে শোনা যায় একটি নারী কণ্ঠ,
“মিস, তোমার জন্য এই ড্রিংকসটি।”
একটি হাস্যোজ্জ্বল মেয়ে মুখ দেখতে পেল মিতুল। মিষ্টি মুখে মিষ্টি হাসি মেয়েটির। মিতুল ভেবে পায় না এই মেয়েটি এত মিষ্টি কেন?
মিতুল হাসি হাসি মুখে ‘থ্যাংক ইউ’ জানিয়ে ক্যামিলার হাত থেকে সফট ড্রিঙ্কসের গ্লাসটি নিলো। এক চুমুক পান করেই বললো,
“ওয়াও! দারুণ মজাদার ড্রিঙ্কস বানাও তো তুমি।”
“ধন্যবাদ।” ক্যামিলা একটু হাসলো। তারপর ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড বলে একটি সিম কার্ড এগিয়ে দিয়ে বললো,
“ম্যাম দিতে বললো এটা।”
সিম কার্ডটি দিয়েই চলে গেল ক্যামিলা।
মোবাইলে নেট কানেক্ট করার পর মিতুলের প্রথম যেটা মনে পড়লো সেটা হলো, ‘মা’। মিতুল সিম কার্ডটি মোবাইলে ঢুকানোর সময় নিলো না। তার আগেই মায়ের কাছে কল করা দিলো। কিন্তু আবার থামলো। আচ্ছা, বাংলাদেশে কয়টা বাজে এখন?
পর মুহূর্তেই আবার কল দিয়ে ফেললো। কয়টা বাজে তা নিয়ে মাথা ঘামালো না।
কয়েকটি রিং হতেই কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে শোনা গেল মায়ের গলা,
“মিতুল!”
মিতুল মৃদু কণ্ঠে বললো,
“মা, কেমন আছো?”
“ভালো।”
“আব্বু, ভাইয়েরা ভালো আছে?”
“হ্যাঁ। ওখানে গিয়ে কী করছো তুমি? ভদ্র ভাবে থাকছো তো?”
“হ্যাঁ মা। আমি কি অভদ্র যে অভদ্র ভাবে থাকবো?”
“কোনো কমপ্লেইন যদি পাই তাহলে তোমার ভাগ্যে কিন্তু খারাপ আছে। বুঝেছো? কারো সাথে খারাপ আচরণ করবে না। সবসময় হাসি-খুশি ভাবে কথা বলবে, সবার সাথে আন্তরিক থাকবে। বাইরে বাইরে সারাক্ষণ ঘোরাঘুরি করবে না। লক্ষ্মী হয়ে থাকবে। কোনো ধরনের বেয়াদবি করার কথা যেন শুনতে না পাই। ভেবো না যে বিদেশ গিয়েছো বলে কী করছো, না করছো সে বিষয়ে আমি জানতে পারব না। তোমার রেশমী আন্টির সাথে সব সময় কথা হবে আমার। যদি খারাপ কিছু শুনতে পাই তবে কিন্তু ওদেশ থেকে ফিরে আর ঘরে পা রাখতে পারবে না। তোমার জায়গা হবে ফুটপাতে। বুঝেছো?”
মিতুলের মনঃক্ষুণ্ণ হলো। কষ্ট পেল! ওর মা-বাবা এত কঠোর কেন ওর সাথে? ফোন দিতেই এসব সাবধান বাণী শোনায় কেউ? আসতে কোনো সমস্যা হয়েছে কি না, এখানে অপরিচিত পরিবেশে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছে কি না, সেসব না জিজ্ঞেস করে এমন কথা বলে কেউ? মিতুল একটু নিশ্চুপ থেকে মাকে আশ্বাস দিয়ে বললো,
“জানি মা। চিন্তা করো না, ভালো মেয়ে হয়েই থাকব আমি।”
“হুম, ঠিক আছে। আর খাওয়া-দাওয়া ঠিক মতো করবে, কেমন? খাওয়া-দাওয়া নিয়ে যেন কোনো রকম ফাঁকিবাজি না হয়। ফোন রাখছি এখন।”
মিতুলের মা কল কেটে দিলেন।
এই মায়ের জন্য ওর শান্তি মতো ঘোরাটা না আবার মাটি হয়ে যায়।
চেয়ারের সাথে মাথা হেলিয়ে দিলো মিতুল। রেশমী আন্টিকে নিয়ে ভাবছে ও। রেশমী আন্টি সত্যিই আগের মতো নেই। অবশ্য আগে কতটুকুই বা চিনতো তাকে? যাই হোক, তবে এটা সুস্পষ্ট যে অহংকারী অহংকারী ভাব আছে রেশমী আন্টির মাঝে। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় কোথাও দেখেনি তাকে। একজন মেহমান এসেছে, আর সে সমস্ত দায়িত্ব মেইডদের উপর ছেড়ে দিয়ে রুমের ভিতর গিয়ে বসে আছে। এটাকে কোন ধরনের ভদ্রতা বলে? ও লনে এসে বসে রয়েছে, তার কি উচিত না এখানে এসে ওর সাথে একটু কথা বলা? একটু গল্প করা?
না, এই ফ্যামিলির মানুষ ভদ্রতা, আন্তরিকতা জানে না। তাদের আন্তরিকতার মাঝে ব্যাপক ঘাটতি আছে। মিতুলের ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
গেট খোলার শব্দ হতেই চকিতে মাথা তুলে সোজা হয়ে বসলো মিতুল। গেট অতিক্রম করেছে এক যুবক। লম্বাদেহী। ত্বক উজ্জ্বল ফরসা। মাথা ভর্তি কালো চুল। চুলগুলো জেল দিয়ে পরিপাটি করে রাখা। মুখে ছোটো ছোটো দাঁড়ি পড়ে আছে। অবহেলায় না কি সযত্নে সেটা বুঝতে পারছে না। নাকটা লম্বা, সরু।
মিতুল ধারণা করলো এটা হয়তো রেশমী আন্টির ছেলে। বড়ো ছেলে না কি ছোটো ছেলে সেটা ধারণার বাইরে।
মিতুল এগিয়ে এলো লম্বাদেহী যুবকটির দিকে। দেখার পরও চুপচাপ বসে থাকা অভদ্রতার পরিচয় বহন করে। যুবকটি হেঁটেই চলছিল। মিতুল হ্যান্ডশেকের জন্য একহাত বাড়িয়ে দিলো তার দিকে। ভদ্রতার সহিত নিজের পরিচয় দিতে চাইলো। কিন্তু যা ঘটলো তাতে ওর কণ্ঠ রোধ হয়ে গেল। ও মোটেই প্রস্তুত ছিল না এই ঘটনার জন্য। যুবকটি ডিরেক্ট ওকে অবহেলা, অগ্রাহ্য করে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। এমনকি একটিবার ওর দিকে তাকালো না পর্যন্ত। মিতুলের হাত কেঁপে ওঠে অপমানে। এত বড়ো অপমান?
বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা দুর্বল ভাবে নেমে এলো নিজ অবস্থানে। ওর চোখে-মুখে অবিশ্বাসের ঘোর। যা ঘটলো তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। নিজ থেকে পরিচিত হতে এলো, আর ছেলেটা এমন ভাবে অপমান করে চলে গেল? অসম্মানের আত্মগ্লানিতে ছেয়ে গেল মিতুলের মন। একটু সময়ের ব্যবধানে এই দেশের মাটিতে পরপর দু বার অপমানের সম্মুখীন হতে হয়েছে ওকে। আগের অপমান তো হিসেবে ক্ষুদ্র ছিল। কিন্তু এই ছেলেটা যেভাবে অপমান করলো তাতে অপমানেরও সীমা অতিক্রম হলো! মিতুল নির্দ্বিধায় একটা জিনিস সুনিশ্চিত হলো, এই ফ্যামিলির ভিতরে সবচেয়ে অহংকারী ব্যক্তি হলো এই ছেলে। লম্বা, সরু নাকের অহংকারী ব্যক্তি একজন!
মিতুল ইজিচেয়ারে বসেই কাটালো বেশ কিছু সময়। বিষয়টি ভুলে যেতে চাইলো কিন্তু পারলো না। মস্তিষ্কের সর্বত্র অপমানের অসহ্য যন্ত্রণার উপস্থিত ঝেঁকে বসেছে। কোনো উপায়েই মুক্তি মিলছে না এর থেকে। চোখে কেবল ভাসছে অপমানের সেই কালো, অসহ্যকর, তিক্ত মুহূর্ত। এই একুশ বছরের জীবনে এমন বিকৃত মুহূর্তের সম্মুখীন হতে হয়নি আগে কখনও। এটাই প্রথম। ওই অহংকারী ছেলেটা এর সূচনা ঘটালো। মিতুলের মুখ এখনও লাল হয়ে আছে রাগে। শরীর থেকে উত্তাপ বের হচ্ছে যেন।
না, এভাবে বসে থাকা যাবে না। রুমে গিয়ে আবার লম্বা শাওয়ার নিতে হবে। তাতে যদি মাথায় একটু শান্তি মেলে। মিতুল লন ত্যাগ করলো।
দরজার নিকট আসলে হলরুম থেকে রেশমী আন্টির কণ্ঠ মিতুলের পা থমকে দিলো। রেশমী আন্টি সেই অহংকারী যুবকটির সাথে কথা বলছে। মিতুল কথা বলার বিষয়টি মুহূর্তে ধরে ফেললো। লুকিয়ে পড়লো দেয়ালের আড়ালে। কর্ণ খাড়া হয়ে আছে হলরুমের কথা শোনার জন্য। রেশমী আন্টি বললেন,
“ক্যামিলা কিচেনে বসে দেখেছে, তুমি কেন মেয়েটাকে ওভার টেইক করে চলে এসেছো? হ্যান্ডশেক করোনি কেন?”
অহংকারী যুবক বিরক্তির সুরে বললো,
“কার কথা বলছো মম? কোন মেয়ে? হাউজে আসার সময় কোনো মেয়েই চোখে পড়েনি আমার। যদি আমি দেখতাম, তাহলে কি এভাবে চলে আসতাম? কোনো মেয়ে ছিলই না ওখানে।”
মিতুলের মুখ হাঁ হয়ে গেল। বলে কী? দেখেনি ওকে? জলজ্যান্ত একটা মানুষকে চোখে পড়েনি তার?
মিতুল আরও একবার অপমান বোধ করলো। ছেলেটা একের পর এক অপমান করে চলেছে ওকে! মানছে ও একটু খাটো। তাই বলে কি এতই ক্ষুদ্র হয়ে গেছে যে কারো চোখে পড়ার মতো নয়?
মিতুল নিজের রুমে যাবে বলে ঠিক করেছিল, কিন্তু হলরুম পেরিয়ে এই মুহূর্তে কিছুতেই আর যেতে পারবে না। ও আবারও ইজিচেয়ারে এসে নিজের আসন করলো।
বসে থাকার চার-পাঁচ মিনিট পর দেখতে পেল অহংকারী যুবকটি ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে। মিতুল চোখ সরিয়ে নিলো। ওই অহংকারী যুবকের দিকে তাকাতেও বিরক্ত লাগছে ওর। ও নিচে দৃষ্টি রেখে বসে রইল।
কিছুক্ষণ পর মনে হলো অহংকারী যুবক ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। আড় চোখে দেখলো একবার। হ্যাঁ ঠিকই তো, ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। আবার কোন অপমান করার ফায়দা নিয়ে আসছে? দু বার অপমান করেও বুঝি সাধ মেটেনি? মিতুল দেখেও না দেখার ভাণ ধরে বসে রইল।
ছেলেটা মিতুলের নিকটে এসে থামলো। মিতুল তার উপস্থিতি টের পেল কিন্তু ফিরেও তাকালো না। শুধু শুনতে পেল একটা শান্ত সুন্দর পুরুষ কণ্ঠ ওকে বলছে,
“আসসালামু আলাইকুম মিস।”
মিতুলের কান এমন সুন্দর, শুভ্র সালাম শুনে আর না তাকিয়ে পারলো না। তাকালো মিতুল। খুব কাছ থেকে দেখতে পেল অহংকারী যুবকটির মুখ। ওর পাশে দাঁড়িয়ে আছে অহংকারী যুবকটি। কে বলবে যে এই মানুষটার ভিতরে হাজারও অহংকার লুকায়িত। দেখতে কী নিষ্পাপ লাগে! মিতুলের রাগ পাতলা হয়ে এলো মানুষটার মুখ থেকে নির্গত সালামের পবিত্র শব্দে। ও সালামের উত্তর দিলো,
“ওয়াআলাইকুমুস সালাম।”
মানুষটা নিষ্পাপ মুখে এক টুকরো নিষ্পাপ হাসি ফুটিয়ে মিতুলের পাশের ইজিচেয়ারে জায়গা করে নিলো। একটু জড়তা নিয়ে টানা টানা ইংলিশে বললো,
“আসলে তখন তোমায় দেখতে পাইনি আমি। ফোনে কথা বলছিলাম তো, তাই খেয়াল করিনি তোমায়। কিছু মনে করো না।”
মিতুল মনে মনে ভেংচি কাটলো। খেয়াল করেনি না ছাই! খাটো বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে সেটা সরাসরি বলতে পারছে না এখন। কিন্তু খাটো বলে অপমান যা করার তা তো করেই ফেলেছে। মিতুল মনে মনে এসব ভাবলেও বাইরে এমন কিছুই ধরা দিলো না। বললো,
“না, কিছু মনে করিনি। তোমারই বা দোষ কী? দোষ তো আমার। আমারই উচিত হয়নি তুমি ফোনে কথা বলা সত্ত্বেও তোমার কাছে যাওয়া।”
ছেলেটাকে অপ্রস্তুত দেখালো। কয়েক মুহূর্ত পর সে মিতুলের দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডশেকের জন্য।
“আমি জায়িন। জায়িন আহমেদ।”
মিতুলের হ্যান্ডশেক করতে ইচ্ছা করলো না। কারো সাথে হ্যান্ডশেক করার ইচ্ছাই মরে গেছে ওর। তবুও সৌজন্য স্বরূপ হ্যান্ডশেক করলো। নিজের পরিচয় দিলো,
“আমি মিতুল দিলরাবা।”
জায়িন হাত ছেড়ে দিলো। বলার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছে না সে। মমের কথা রক্ষার্থে এখানে এসেছে মেয়েটির সাথে কথা বলতে। নয়তো কিছুতেই আসতো না এখানে। এমনকি মেয়েটির সাথে হ্যান্ডশেকও করেছে মমের জন্য।
জায়িন অস্বস্তিতে ভুগছে। মনে মনে ভাবছে, আর কী বলা যায়? না, বলার মতো কোনো শব্দভাণ্ডার এই মুহূর্তে জমা নেই তার কাছে।
তার ফোনটা তার দুঃসময়ের বন্ধু হয়ে বেজে উঠলো। ‘ফ্রেডি’ কল দিয়েছে। জায়িনের ঠোঁট স্বস্তির সাক্ষী হয়ে নীরব হাসলো।
জায়িনকে হাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো মিতুল।
জায়িন মিতুলকে কিছু না বলে বিনা বাক্যে ফোন রিসিভ করে কথা বলতে বলতে জায়গা ত্যাগ করলো। গেট অতিক্রম করে বাড়ির বাইরে চলে যায়।
মিতুলের চোখ আরও একবার অবিশ্বাসের সাক্ষী হলো। কী বেয়াদব ছেলেরে বাবা! ওর সাথে বসে কথা বলছিল, অথচ একটা ফোন আসতে কিচ্ছুটি না বলে অভদ্রের মতো চলে গেল? কেমন মানুষ? মানুষটা যে একজন অভদ্র, অহংকারী সে প্রমাণ আরও একবার পেল ও।
ইজি চেয়ারেই পুরো বিকেল কাটলো মিতুলের। ঘরে যেতে ইচ্ছে হয়নি। একা একাই ছিল। মধ্যমে রেশমী আন্টির দর্শন পেয়েছিল একবার। এক নেইবরহুডের বাড়ি যাওয়ার সময় ওকে বসা দেখে এগিয়ে এসেছিলেন। নিজের সঙ্গে ডেকেছিলেন ওকে, ও যায়নি। কোথাও যেতে ভালো লাগছে না ওর। যে অপমানের উপর দিয়ে পার হলো আজকের দিন! মিতুল ধারণা করেছে আজকের দিনটা ওর জন্য খারাপ। মানুষের জীবনে একটা-দুটো খারাপ দিন আসেই। ওর জীবনের খারাপ দিন হলো এটা।
ধীরে ধীরে আবছা অন্ধকার বিরাজ করলো প্রকৃতিতে। সন্ধ্যা কেটে গিয়ে এরপর নামবে রাত। প্রকৃতি আবছা আলো থেকে হবে নিকষ কালো। কৃত্রিম আলোতে ঝলমল করবে শহর। রাতের সৌন্দর্যে শোভা পাবে এডমন্টন। গাছে গাছে থাকা চেরি ব্লসম ঝরে পড়বে রাতের নিঝুম মুগ্ধময় মুখরতা হয়ে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইবে। শহরের গাছপালাগুলো বাতাসের কোমলতা জড়াবে গায়ে। শহর সাজবে রাতের মোহনীয়তায়।
মিতুল ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ইতোমধ্যে ঘর কৃত্রিম আলোর উৎসে আলোকিত হয়েছে। হলরুমে লাইট জ্বলছে। জ্বলছে দুটো ল্যাম্পশেডও। সোনালী আলোর আভা হাসছে হলরুমের প্রতিটা কোণায়।
মিতুল মাথা নিচু রেখে এগিয়ে চলছিল সিঁড়ির দিকে। ঠিক সামনেই দুটো পা চোখে পড়তেই ওর পা দুটো থমকে গেল। সিঁড়ি থেকে এক পা দূরত্বে দাঁড়ানো ও। সামনে দাঁড়ানো মানুষটি কে, তা দেখার জন্য চোখ ওঠাতে চোখে ধরা দিলো এক বিদেশি যুবক। হাঁটুর নিচ অবধি সাদা নাইট ড্রেস পরা ছেলেটি। ফরসা পা দুটো দেখা যাচ্ছে। মাথার ব্রাউন হেয়ার কপাল বেয়ে নেমে ছুঁয়ে দিচ্ছে ভ্রু। বাদামি চোখ জোড়ায় একরাশ মুগ্ধতা ছড়ানো। শেভ করা ফরসা চকচক করা মুখখানিতে এখনও দাড়ি, গোঁফ গজানোর সুযোগ পায়নি। ফোলা ফোলা মুখ খানিতে কেমন বাচ্চা বাচ্চা ভাব। হয়তো সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে বলে চেহারা এমন দেখাচ্ছে। ঠোঁট দুটো একটু বেশিই লাল।
কিন্তু এ ঘরে বিদেশি ছেলে কেন? প্রশ্নটা মিতুলের মনে উদয় না হয়ে পারলো না। তবে চেনা চেনা লাগছে এই বিদেশি ছেলেটাকে। মনে হচ্ছে কোথাও যেন দেখেছে এই মুখ। কোথায় দেখেছে?
বাজে একটা গন্ধ এসে লাগলো মিতুলের নাকে। কীসের গন্ধ এটা? এত বাজে!
মিতুলের মস্তিষ্কে আপনা থেকেই একটা শব্দ উদয় হলো, ‘মদ’?
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে ভীষণ বিরক্তি চলে এসেছে জোহানের মাঝে। কাল রাতে ড্রিঙ্কস করার পর ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভেঙেছে এই সবে। ঘুম থেকে ওঠার পর সব কিছুই অসহ্য, বিরক্তিকর লাগছে। আর সব থেকে বেশি বিরক্তিকর লাগছে এখন এই মেয়েটাকে। মুখের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে কেন? মুখে কি গাধার ছবি পেইন্টিং করে রেখেছে যে এই ভাবে দেখছে? অসহ্য, বিরক্তিকর মেয়ে!
মদের কথা মনে হতেই মিতুলের কেমন যেন লাগলো। যদিও এদিকে এসব স্বাভাবিক ব্যাপার। তবুও ব্যাপারটা ঠিক ভালো লাগলো না। ও এড়িয়ে যেতে চাইলো ছেলেটাকে। পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই আবারও থমকে দাঁড়াতে হলো।
ও যেদিকে পা বাড়িয়েছে, বিদেশি ছেলেটাও চলে যাওয়ার জন্য ঠিক সেদিকে পা বাড়িয়েছে।
মিতুল বিব্রত বোধ করলো। দ্রুত স্থান ত্যাগের জন্য অন্যদিকে পা বাড়ালো আবার। কিন্তু এবারও একই ঘটনা ঘটলো। ভুলবশত একই দিকে পা বাড়িয়েছে দুজনে। এমনই হলো আরও দু বার।
বিদেশি ছেলেটা শেষমেশ বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। উপরের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফোঁস করে বিরক্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
মিতুলেরও অস্বস্তি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি যে কারোর জন্যই বিব্রতকর।
ছেলেটা মিতুলের দিকে তাকালো এবার। দুই চোখে বিরক্তি আর রাগ। বিরক্তির সুরে বললো,
“ননসেন্স, ইডিয়ট, সিক গার্ল!”
বলে ভীষণ বিরক্তিকর একটা চাহনি দিয়ে বড়ো পা ফেলে মিতুলের পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
মিতুলের মুখ হাঁ হয়ে আছে। ননসেন্স, ইডিয়ট, সিক গার্ল? মিতুল এক হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। আরও একবার অপমান!
We use cookies to ensure that we give you the best experience on our website. If you continue to use this site we will assume that you are happy with it.Ok