Sunday, December 14, 2025
Home Blog Page 2040

যাত্রাশেষে (পর্ব-৬+৭)

#যাত্রাশেষে (পর্ব-৬+৭)
#হালিমা রহমান

মহুয়া বাস বা মাইক্রোবাসে যাতায়াত করে খুব বেশি একটা আরাম পায় না।এগুলোতে উঠলেই ওর ঘুম চলে আসে।সে রিকশা দিয়েই চলাচল করে আনন্দ পায়।নয়া পল্টনে পৌঁছানোর আগেই মহুয়া ঘুমিয়ে পরলো।কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে গেল তা নিজেই জানে না।আবরারদের বাড়ির সামনে পৌঁছে যখন মহুয়াকে ডাক দেওয়া হলো, তখন সে সহসা কয়েক মিনিট আশপাশের কোনোকিছু ঠাওর করতে পারলো না।এ নিয়েও হাসি-ঠাট্টা করতে ছাড়েনি কেউ।একগাদা মানুষজন ঠেলে,হাজারটা নিয়মকানুন পালন করে মহুয়া যখন আবরারের ঘরে বসেছে ; তখন ঘড়িতে প্রায় দশটা বেজে গেছে।পৌষ মাসের শীতেও অসহ্য গরম লাগছে মহুয়ার।গরমে,ঘামে মাথার ছোট চুলগুলো কপালের দু-দিকে লেপ্টে আছে।কানের দুল,টিকলি,চুড়ি,হার, শাড়ি —সবকিছু মিলিয়ে নিজেকে একটা ভারী বস্তার মতো লাগছে।আহ!বিয়েতে এতো কষ্ট কেন?বিয়ে একটা রহমত-বরকতের অনুষ্ঠান।অথচ,এই শান্তির অনুষ্ঠানটাকেই হাজারটা নিয়ম-কানুনে বন্দি করে ঝামেলা বানিয়ে ফেলা হয়েছে।গায়ে হলুদ,মেহেদী,বিয়ের সাজ,বৌ-ভাত—এতোকিছুর দরকার আছে?এর চাইতে কাজির সামনে তিনবার কবুল বলে ফেললেই তো হয়।ব্যাস,ঝামেলা শেষ।সাজানো বিছানার এককোনে বসে এসব কথাই ভাবছিলো মহুয়া।সেই গায়ে হলুদের আগের রাত থেকে সে ভালোমতো ঘুমাতে পারেনি।মাথা ব্যাথায় ছিড়ে যাচ্ছে।ক্ষিদেও পেয়েছে খুব।দুপুরে ভালোমতো খেতে পারেনি।কিভাবে খাবে?এই চুড়ি-শাড়ির জন্য শান্তিতে খাওয়া যায়?মহুয়া নিজের হাত ছাড়া আরেকজনের হাতে খেতে পারে না।কেমন যেন লাগে।তাই,দুপুরে ছোট চাচি খাইয়ে দেওয়ার পরেও পেটভরে খেতে পারেনি।মহুয়া চোখ ঘুরিয়ে আশপাশটা দেখলো।মাঝারি আকারের একটা ঘর।ঘরের দুটো জানালার একটা খুলে রাখা। খুলে রাখা জানালার সাথেই লাগোয়া বিছানা।তার পাশে একটা টেবিল।এককোনে একটা আলমারি,একটা ড্রেসিং টেবিল।আরেকপাশের দেয়ালজুরে একটা বড় বুক-সেলফ।মহুয়া উঠে দাঁড়িয়ে হাত-পা ঝারা দিল।বিশাল বিছানাটা রজনীগন্ধা ও গোলাপ ফুল দিয়ে সাজানো।দূর্ভাগ্যবশত, এই দুটো ফুলের একটাও পছন্দ না মহুয়ার।সে একদম সহ্যই করতে পারে না এই দুটো ফুল।মহুয়া এগিয়ে যেয়ে বইগুলো দেখলো। বেশিরভাগ কবিতার বই।মহুয়া নাক ছিটকে ফেললো।কবিতা সে পছন্দ করে না।পছন্দ করে না বললে ভুল হবে,আসলে কবিতা ও বুঝতেই পারেনা।মহুয়ার পছন্দ উপন্যাসের বই।মোটা মোটা বইগুলো পড়ার সময় অন্য এক জগতে চলে যায় মহুয়া।পড়তে পড়তে আনমনে প্রায়ই ভাবে—” আহা,জীবনটা যদি উপন্যাসের মতো হতো!”
মহুয়া ঘরের উত্তর দিকের জানালাটা খুলে দিল।দো-তলার এই ঘর থেকে নিচে তাকালে একটা ছোট্ট গলি দেখা যায়।মহুয়া চোখ ঘুরিয়ে দেখলো।জানালার ওপাশে এক-দেড়হাত দূরেই একটা বহুতল ভবন চোখে পরে।অন্ধকারেও বুঝতে পারলো, এখানে এখনো কেউ থাকে না।বাড়িটা নতুন করছে।মহুয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।ভাগ্য ভালো পাশের বাড়িটা খালি।নাহয়,জানালাটা খোলাও যেত না।
খট করে খুলে গেল দরজা।মহুয়া ভেবেছিলো হয়তো আবরার এসেছে।কিন্তু,না। পিছু ফিরে দেখলো বিলকিস বেগম এসেছেন। তার সাথে আরেকটা মেয়ে।বয়সে আবরারের বড়ই হবে।মহুয়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল।শত হলেও সে নতুন বউ।এভাবে এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করলে নিশ্চয়ই কেউ ভালো চোখে দেখবে না।মহুয়া একটু দ্রুতপায়ে এসে বিছানায় বসে পরলো।বিলকিস বেগম ও তার সাথে আসা মেয়েটি শব্দ করেই হেসে ফেললো।মহুয়া বুঝতে পারে না,এ বাড়ির সবাই অকারণে এতো হাসে কেন।বিলকিস বেগম এসে খাটের কোনে বসলেন।একদম মায়েদের মতো আদুরে স্বরে বললেনঃ”তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে,মা?”
মহুয়া এদিক-ওদিক মাথা নাড়ায়।
বিলকিস বেগম আবারো জিজ্ঞেস করলেনঃ”ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই? ”
মহুয়া কিছু না বলে চুপ করে রইলো।তার সত্যি ক্ষিদে পেয়েছে।চুপ থাকা সম্মতির লক্ষণ।বিলকিস বেগম পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বললেনঃ” আফিয়া যা তো,ভাতের প্লেটটা নিয়ে আয়।”
আফিয়া চলে গেলে বিলকিস বেগম বললেনঃ”ও তোমার ননাস হয়।আমার বড় মেয়ে।ওকে তুমি আপা বলেই ডেকো।”
মহুয়া বুঝলো এটাই আবরারের সেই পালক বোন।যার কথা মা বলেছিল।ভাত নিয়ে আসার পর বিলকিস বেগম নিজের হাতে খাইয়ে দিতে চাইলে,হতাশ হলো মহুয়া।এইবার নিজের হাতে খেতে না পারলে বোধহয় ও মরেই যাবে।মহুয়া তাই সাহস নিয়ে মিনমিন করে বলেই ফেললোঃ” আমি নিজের হাতেই খাই।”
—” নিজের হাতে খেতে পারবে?”
—” জ্বি।আমি নিজের হাত ছাড়া অন্যকারো হাতে খেতে পারি না।”
—” আচ্ছা,খাও।”
পেটভরে শান্তিতে খাওয়ার পর আফিয়ার সাথে পরিচিত হলো মহুয়া।আফিয়াকে বেশ মনে ধরলো মহুয়ার।হাসি-খুশি উচ্ছল একটা মেয়ে।কথা বলার সময় হাসি লেগেই থাকে মুখে।আফিয়া অনেক কিছুই বুঝিয়ে দিলো মহুয়াকে।বিলকিস বেগমের পছন্দ-অপছন্দ,আবরারের স্বভাব,বাড়ির নিয়ম- কানুন।আবরারের নাকি অনেক রাগ।রাগলে মাথা ঠিক থাকে না।রাগের মাথায় কাকে কি বলে বসে তার কোনো ঠিক-ঠিকানা থাকে না।এসব কথা শুনে মহুয়া মনে মনে হাসে।রাগ দেখাবে মহুয়ার সাথে? হুহ! এতো সাহস! আবরারের আর কিইবা মেজাজ।মহুয়া রাগ দেখালে সামলাতে পারবে তো? ছোটবেলা থেকেই মহুয়া হুটহাট রেগে যায়।রাগ তার নাকের ডগায় থাকে।আর রেগে গেলে চিল্লাচিল্লি করে ঘর-দোর উল্টে -পাল্টে ফেলে না।চোখ-মুখ ফুলিয়ে চুপ করে থাকে।তারপর হাতের কাছে যা পায় তাই ছুড়ে মারে।এভাবে, সাবিনা বেগমের কতো কাঁচের জিনিস যে ভেঙে ফেলেছে তার ইয়ত্তা নেই।বিনিময়ে মায়ের হাতের চর- থাপ্পড়ও কম খায়নি।কিন্তু,তবুও এই বদ অভ্যাস যায়নি।দিনদিন যেন এ স্বভাব বেড়েই চলছে।
আফিয়া চলে যাওয়ার পর মহুয়া বিছানায় হাত- পা ছড়িয়ে বসলো।আফিয়া যাওয়ার আগে একটা পাতলা সুতির শাড়ি পরিয়ে দিয়ে গেছে।শাড়ি পরতে মহুয়ার ভালোই লাগে।সে ঠিক করে রেখেছে,এখন থেকে শাড়িই পরবে।শাড়ি না পরলে বউ বউ লাগে নাকি?আচ্ছা,এ বাড়ির মানুষ কেমন হবে? ভালো নাকি খারাপ? নাটক- সিনেমায় যেমন দেখায় শ্বাশুড়ি বউদের উপর অত্যাচার করে,দিন-রাত ঝগরা করে, স্বামী অত্যাচার করে—এমন হবে? মহুয়ার কপালে ভাঁজ পরে।হুহ! এমন হলে মহুয়া সেই সিরিয়ালের নায়িকাদের মতো কখনোই মুখ বুজে সহ্য করবে না।সংসারের কপালে ঝাড়ু মেরে চলে যাবে।মহুয়া কি মধ্যযুগীয় মেয়ে নাকি?সে আধুনিক মেয়ে।ব্যাক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।সে মানিয়ে নেওয়া নয় সমঝোতায় বিশ্বাস করে।কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই এসব ছাড়াছাড়ি চিন্তা মাথায় আসায় নিজেকেই মনে মনে আবার ধমক দিলো মহুয়া।ছিঃ! বিয়ের প্রথম দিনেই কে এসব ভাবে।মহুয়া ঘড়ির দিকে তাকালো।এগারোটা বেজে গেছে। আবরারের আসার নাম-গন্ধ নেই।মহুয়ার রাগ জমলো আবরারের উপর।আশ্চর্য মানুষ তো! মহুয়াকে এভাবে জাগিয়ে রাখার মানে কি? আরো দুবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে এককোনে শুয়ে পরলো মহুয়া।দিন-দুনিয়া ভেঙে ঘুম আসছে।কারো জন্য অপেক্ষা করে ঘুমকে অবহেলা করতে পারবে না মহুয়া।ঘুম এসেছে,এখন সে ঘুমাবে।বাকি সবাই জাহান্নামে যাক।

***

বিয়ের পর দেখতে দেখতে পাঁচদিন কেটে গেছে।কিন্তু,স্বামী নামক প্রাণীর সাথে এখনো সহজ হতে পারেনি মহুয়া।সহজ হওয়া তো দূরের কথা, খুব বেশি কথাই হয়না দুজনের মাঝে।এই পাঁচদিনে আবরারের সাথে মহুয়ার কথা হয়েছে দশবারের কম।বিয়ের দিন রাতে আবরার কখন ঘরে এসেছে,কখন ঘুমিয়েছে এসবের কিছুই জানে না মহুয়া।সকালে ঘুম ভেঙেছিলো বেশ বেলা করে।প্রায় নয়টার দিকে চোখ খুলে মহুয়া আবিষ্কার করে সে এখনো ঘরে একা।ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাফ দিয়ে উঠে পরে।শুক্রবার ছাড়া এতো বেলা করে ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস নেই।মহুয়া তাড়াহুড়ো করে বাথরুমে ঢুকে।প্রথমদিনই এতো দেরি করে ঘুম থেকা উঠা মোটেও ঠিক হয়নি।ভাগ্যিস এখানে মা নেই।মা থাকলে নিশ্চিত এখন দু-চারটে চর লাগিয়ে দিত।
সকাল থেকেই একটু বেশি গরম পরেছে।শীতে গরম পরবে কেন? গরমদের জায়গা শুধু গ্রীষ্মে।মহুয়া সকাল সকাল উঠেই গোসল করে ফেললো।ছোট্ট বাথরুমে শাড়ি পাল্টাতে বেশ বেগ পেতে হলো তাকে।হালকা মেরুন রঙের শাড়ির অর্ধেকটা ভিজিয়ে ফেললো পরতে যেয়ে।আগের দিনের ব্যবহার করা শাড়ি ধুয়ে বারান্দায় মেলে দিলো মহুয়া।আবরারের বারান্দাটাও মোটামুটি বড়ই।এককোনে একটা কাঠগোলাপের গাছ আছে।মহুয়ার নজর কাড়লো পাশের বাড়ির বারান্দাটা।বেশ বড় সেটা।অনেকগুলো গাছ লাগানো যাবে।মহুয়া চুল থেকে গামছা খুলে চুল ঝারতে ঝারতে ঘরে ঢুকলো।ঢুকেই আবরারকে দেখলো।বিছানার উপর বসে আছে পা তুলে।বিয়ের দিনের পর এই প্রথম মুখোমুখি দেখা।মহুয়া একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।গামছা পাশের চেয়ারের উপর রেখে মাথায় শাড়ির আঁচল তুলে ঘোমটা দিলো।মহুয়াই বোধহয় একমাত্র মেয়ে,যার সাথে বিয়ের রাতে স্বামীর দেখা তো দূর কথাই হয়নি।আবরার মহুয়ার দিকে একবার নজর দিয়ে বললঃ” আপনি কি সবসময়ই দেরি করে উঠেন?”
—” জ্বি, না।ক্লান্ত থাকার কারণে আজ উঠতে দেরি হয়ে গেছে।আমি দুঃখিত।”
—” ঠিক আছে।মা আপনাকে খাওয়ার জন্য ডাকছে।আপনার তৈরি হতে কি আরো সময় লাগবে?”
—” জ্বি,না।”
—“আমি তাহলে আপাকে পাঠাচ্ছি।ওর সাথেই চলে আসুন।”
উঠে চলে যায় আবরার।দুপুরের আগ পর্যন্ত আর কোনো কথা হয়না দুজনের মাঝে।সারাদিন অনেক মানুষের আনাগোনার ভীড়েও একটা কথা মহুয়া কিছুতেই মাথা থেকে ঝেরে ফেলতে পারে না।আবরার কি এমনই চুপচাপ থাকে? নাকি মহুয়াকে দেখলেই চুপচাপ হয়ে যায়?আবরার কি বিয়েতে রাজি ছিলো না?
এরকম দূরে দূরে থেকেই পাঁচদিন কেটে গেছে।বিয়ে উপলক্ষে আবরার ব্যাংক থেকে ছুটি নিয়েছিলো মাত্র তিনদিন।বড় করে বৌ-ভাতের অনুষ্ঠান হয়নি।এ নিয়ে অবশ্য অভিযোগ করেনি মহুয়া।এমনিতেও এসব অনুষ্ঠানকে ঝামেলা মনে হয় ওর কাছে। দু-দিন যেয়ে থেকে এসেছে বাড়িতে।বাড়িতে আত্মীয়ের দল কমে এসেছে।পুরো বাড়িতে সারাদিন একা একা থাকে মহুয়া।বিলকিস বেগম বিয়ের ঝামেলায় একটু অসুস্থ হয়ে গেছেন।অসুস্থ থাকলেও মহুয়াকে কোনো কাজ করতে দেন না।নতুন বউ থাকুক একটু আরামে।শ্বাশুড়ির এই আহ্লাদে বেশ সন্তুষ্ট মহুয়া।সারাদিন শুয়ে- বসে থাকতে কার না ভালো লাগে?তবে,আবরারকে এখনো বুঝতে পারে না মহুয়া।সারাদিনের মাঝে কথা হয়না বললেই চলে।রাতে বাড়ি ফিরার পর মহুয়া লক্ষ্মী বউয়ের মতো আবরারের সব পোশাক গুছিয়ে রাখে।মহুয়া তার মাকে সবসময় দেখত বাবার জন্য লেবুর শরবত করে রাখতে।আফজাল সাহেব বাজারে গেলেও সাবিনা বেগম আগে আগেই একগ্লাস লেবুর শরবত তৈরি করে রাখতেন।বাজার থেকে ফিরার পর এই শরবতটাই যেন আফজাল সাহেবের পুরো ক্লান্তি দূর করে দিত।মায়ের এই ছোট-খাটো যত্ন দারুন লাগতো মহুয়ার। তাই,আবরারের ক্ষেত্রেও মহুয়া একই ধরনের চেষ্টা করে।অফিস থেকে ফিরার পরেই একগ্লাস শরবত এগিয়ে দেয় আবরারের দিকে।হাত-মুখ ধোয়ার পর ঘরে পরার পোশাক এগিয়ে দেয়।কখন কি দরকার পরে, আবরারের পছন্দের খাবার কি, পছন্দের রঙ কি —এসব আগ্রহ নিয়ে জানার চেষ্টা করে।কিন্তু,কিছুদিনের মধ্যেই একটা জিনিস চোখে পরে মহুয়ার।ও যতটুকু আগ্রহ নিয়ে ভাব জমাতে চায়, ততোটা আগ্রহ আবরারের মাঝে দেখা যায় না।আবরার যেন ঘরের বাইরেই ভালো থাকে।ঘরের বাইরে থাকলেই আবরারকে হাসি-খুশি দেখা যায়।মহুয়ার সাথে না পারতে কথা বলে না।যতক্ষন কথা বলে ততোক্ষণ কপাল কুঁচকে রাখে।মহুয়া খুব সুন্দর করে কথা বললেও বিনিময়ে সামান্য ভালো কথা আসে না আবরারের থেকে।
মহুয়ার কপালে চিন্তার ভাঁজ পরে।আবরারের কি বিয়ের আগে কোনো সম্পর্ক ছিলো?আবরারের আচরণ যেন স্পষ্ট জানান দেয়,সে মহুয়াকে নিয়ে খুশি নয়।মহুয়ার সাথে সে সহজ হতে চায় না।আবরার আড়ালেই থাকতে চায়।সবার থেকে নয়।শুধুমাত্র মহুয়ার থেকে।মহুয়ার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

#(পর্ব-৭)

বিলকিস বেগম আরাম করে খাটের এককোনে বসে আছেন।তার দু-হাত সামনেই আড়ষ্ট হয়ে বসে আছে মহুয়া।বিলকিস বেগমের প্রতি তার ভয় নয়,শ্রদ্ধা কাজ করে।সাবিনা বেগমের চাইতেও বেশ স্নেহপরায়ণ তিনি।কিন্তু,সমস্যা একটাই।বিলকিস বেগম কথা কম বলেন।তাই মহুয়া তার সাথে কথা বলতে একটু অপ্রস্তুত বোধ করে।বিলকিস বেগম মহুয়ার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেনঃ”তোমার কি এখানে কোনো সমস্যা হয় মহুয়া?”
—” জ্বি,না আম্মা।”
—” সমস্যা হলে আমাকে খুলে বলো, কেমন?আমি তো তোমার মায়ের মতোই।”
মহুয়া মাথা নিচু করে রাখে।বিলকিস বেগম আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেনঃ” তুমি কি রাঁধতে জানো?”
মহুয়া ঢোক গিলে।মনে মনে আল্লাহর নাম জপ করে।যা ভয় পেয়েছিলো ঠিক তাই।আজ থেকেই বোধহয় রান্নাঘরে যেতে হবে।আহ! যন্ত্রণা। ভালো লাগে না এসব।
—“মহুয়া,মহুয়া।”
—“জ্বি,আম্মা।”
—” কী ভাবছো?”
—” না,আম্মা। কিছু না।”
বিলকিস বেগম মহুয়ার নীরবতা হয়তো বুঝতে পারেন।তিনি মৃদু হেসে মাথার নিচে বালিশ রেখে শুয়ে পরেন।নরম গলায় বলেনঃ” তুমি কোনো রান্নাবান্না জানো না,তাইনা?”
মহুয়া মাথা নিচু করে বলেঃ”শুধু পানি গরম করতে জানি।তাছাড়া আর কিছু জানি না।”
—” কেন? শিখতে ইচ্ছে হয়নি কখনো?”
—” উঁহু।আমি আগুন খুব ভয় পাই।তাছাড়া,পড়াশোনায় ব্যস্ত ছিলাম বলে বাবা-মা জোর করে চুলার কাছে পাঠায়নি।”
বিলকিস বেগম একটু চিন্তিত হয়ে পরেন।সবাই আশা করে তার ঘরের বউ কাজে পটু হবে।কিন্তু,মহুয়া যে ঘরের কাজে একদম অপদার্থ তা বুঝতে বাকি থাকে না।মেয়েটা আবার খুব অলস নয় তো? অলস মানুষ নিয়ে ঝামেলা।অপদার্থ, বোকা দিয়ে কাজ করানো যায়।কিন্তু অলস মানুষ দিয়ে হাজার চেষ্টা করেও কাজ করানো যায় না।এরা সবসময় নিজের গা বাঁচিয়ে চলতে চেষ্টা করে।এরকম মানুষ দিয়ে আর যাই চলুক সংসার চলে না।
—” আম্মা,আপনি শিখিয়ে দিলে আমি কাজ করতে পারব।”
মহুয়ার কথায় ঘোর থেকে বেরিয়ে আসেন বিলকিস বেগম।গভীর ভাবনায় থাকার কারণে সহসা মহুয়ার কথা বুঝতে পারেন নি।তাই আবার প্রশ্ন করেনঃ” কি বললে?”
—” আপনি যদি শিখিয়ে দেন, তবে আমি সব কাজ করতে পারব।একটু সময় লাগবে শুধু।”
—“তাহলে এখন থেকে আমি যখন রান্না করব,তখন আমার পাশে দাঁড়িয়ে থেকো।কয়েকদিন দেখলেই শিখে যাবে।রান্নাবান্না এতো কঠিন কিছু নয়।”
মহুয়া চুপ করে থাকে।শ্রদ্ধেয় শ্বাশুড়ি মা তো বলে দিলেন,রান্না কঠিন কিছু না।কিন্তু,আসলে এটা যে কি ঝামেলার কাজ তা তো বললেন না।
মহুয়ার চিন্তিত মুখ দেখে মৃদু হাসেন বিলকিস বেগম।মহুয়াকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে বলেনঃ” এতো চিন্তা করো না।আমি কিন্তু শ্বাশুড়ি হিসেবে খুব খারাপ না।কাজ না করলে খুব বেশি বকাবকি করব না।আস্তে ধীরে শিখে নিয়ো।আমি আর কয়দিন।আমার পরে তো তুমিই সংসারটাকে আগলে রাখবে।যত তাড়াতাড়ি শিখবে, ততোই তোমার লাভ।”
মহুয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।এই বাড়িতে এই মানুষটাকে অসাধারণ লাগে মহুয়ার কাছে।বিলকিস বেগমের আচরণ, স্নেহ দেখে শ্বশুড়বাড়ি সংক্রান্ত অনেক ভয়-ভীতি কেটে গেছে মহুয়ার।বিলকিস বেগম না থাকলে একা বাড়িতে আবরারের সাথে সে বোধহয় দুই দিনও থাকতে পারতো না।মহুয়া যখন একা থাকে তখন প্রায়ই মনে মনে ভাবে- আবরারও কি বিলকিস বেগমের কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে নাকি?নাহয় মা-ছেলের মাঝে এতো অমিল কি করে হয়?

***

দিনগুলো নিজেদের মতো করে কেটে যাচ্ছে।আবরার আগের থেকে এখন একটু বেশি কথা বলে।খুব বেশি না কিন্তু।সামান্য পরিবর্তন হয়েছে তার।বিয়ের পর কয়েকটাদিন মহুয়া খুব ভাব জমাতে চাইতো আবরারের সাথে।সেধে সেধে কথা বলতো।কিন্তু যখন দেখলো আবরার এসব কাজে খুব বিরক্ত হচ্ছে, তখন মহুয়া নিজেই আবার সরে আসলো।আবরারের আচরণ তার সম্মানে আঘাত করেছিলো। মহুয়া খুব আত্মমর্যাদা রক্ষা করে চলতে জানে।আবরারের অনবরত এড়িয়ে যাওয়া দেখে প্রথমেই মহুয়ার মাথায় যেই কথাটা এলো,তা হলো— মহুয়া কি ফেলনা কিছু?নাকি মর্যাদাহীন নির্লজ্জ মেয়ে?না, এমন কিছুই নয় সে।তবে কেন মর্যাদা বিকিয়ে কথা বলবে সে?সম্পর্ক সহজ করার দায়-দায়িত্ব কি একা মহুয়ার?
মহুয়া কিছুদিনের মধ্যেই আবরারকে নিজের চিন্তা থেকে বাদ দিয়ে দিলো।আবরারকে বাদ দিয়ে বিলকিস বেগম ও ঘরটাকেই আপন করে নিলো।মহুয়ার দিনগুলো বেশ ভালোভাবেই কেটে যায় এখন।সারাদিন খুব বেশি কাজ থাকে না।বিলকিস বেগম যখন রান্না করেন তখন দাঁড়িয়ে থাকে।মাঝে মাঝে নিজে নিজেও চেষ্টা করে।এই তো সেদিন, একা একা ভাতের মাড় ফেলতে যেয়ে ডানহাত পুড়িয়ে ফেললো।হাত পুড়িয়ে সে কি চিৎকার তার।লাফিয়ে লাফিয়ে কেঁদেছে।বাবা-মায়ের স্নেহের চাদরে বড় হওয়া মহুয়ার জন্য এসব যন্ত্রণা বেশ নতুন।তাই ছেলেমানুষীও তার মাঝে বেশিই দেখা যায়।মহুয়ার পোড়াহাত দেখতে যেয়ে বেশ উভয় সংকটে পড়ে যান বিলকিস বেগম।একদিকে মেয়েটা ব্যাথায় কাঁদছে আবার ঔষধও লাগাতে দিচ্ছে না।শেষে অনেক চেষ্টা তদবিরের পর শান্ত হয় মহুয়া।দুপুরে শ্বাশুড়ির হাতে ভাত খেয়েছে।ব্যাথার তীব্রতায় বিকালের দিকেই গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে মহুয়ার।আবরার বাড়ি ফিরার আগ পর্যন্ত বিলকিস বেগম মহুয়ার পাশেই বসা ছিলেন।আবরার ব্যাংক থেকে বাড়ি ফিরে দেখে মহুয়ার এই অবস্থা।সে জামা-কাপড় পাল্টে মহুয়ার পাশে বসে।বিলকিস বেগমকে ঘরে চলে যেতে বলে নিজ হাতে প্লেটে ভাত নেয়।জ্বরে কাঁপতে থাকা মহুয়ার গায়ে আলগোছে হাত বুলিয়ে বলেঃ” তোমার কি খুব খারাপ লাগছে মহুয়া?ডাক্তারের কাছে যাবে?”
একটু যত্ন।আবরারের কথায় কিছু একটা মেশানো ছিলো যা মহুয়ার কানে খট করে বাজে।ক্ষনিকের জন্য জ্বরে নয় ঘোরে কেঁপে উঠে মহুয়ার শরীর।আবরার স্বাভাবিকভাবে কথা বলল?মহুয়া মনে মনে হিসাব করার চেষ্টা করে তাদের বিয়ের বয়স।বিয়ের বয়স বোধহয় একমাস হয়েছে।এই একমাসে এই প্রথম আবরার নিজ থেকে একটু ভালোভাবে কথা বলল।এর আগে যতবারই কথা বলেছে ততোবারই মহুয়ার কথার প্রেক্ষিতে কথা বলেছে।সচরাচর নিজ থেকে কথা বলতো না সে।আজ কি হলো?এতো পরিবর্তন যে?
—“মহুয়া,তুমি কি ঘুমিয়ে গেছো?মহুয়া?”
—” না,ঘুমাইনি।”
মহুয়া আবরারের দিকে মুখ করে শোয়।আবরারের দিকে তাকাতেই তার চোখে পড়ে সুন্দর একটা ক্লান্ত মুখ।আবরারের চেহারাটা খুব সুন্দর।এতোদিন ভালোভাবে দেখেনি মহুয়া।তাই হয়তো চোখে পড়েনি।আজ অসুস্থ শরীরে আবরারকে দু-চোখ ভরে দেখে মহুয়া।অর্ধেক খুলে রাখা চোখে এদিক-ওদিক দিয়ে উঁকি মেরে দেখে।সুন্দর,বলিষ্ঠ একটা পুরুষ তার স্বামী –এই কথাটা মাথায় আসতেই আনন্দে ভরে যায় মহুয়ার মন।
আবরার চোখ ছোট ছোট করে মহুয়াকে দেখে।এই মেয়ের সমস্যা কী?এভাবে তাকিয়ে আছে কেন?কখনো চোখ খুলে তাকিয়ে আছে আবার কখনো অর্ধেক চোখ বন্ধ করে তাকিয়ে আছে।কি এতো দেখছে সে?আবরার আরো একবার মহুয়াকে ডাক দেয়—-” মহুয়া।”
—” হুম?”
—” ভাত খেয়েছো?”
—” উঁহু।”
—” তাহলে,উঠো ভাত খাবা।”
—” আমার ডান হাত পুড়ে গেছে।হাত নাড়তেই পারছি না।ভাত খাব কি করে?”
—” উঠো, আমি খাইয়ে দেই।তাড়াতাড়ি উঠো।তোমাকে খাওয়ানোর পর আমি খাব।সকাল সকাল ব্যাংকে যেতে হবে আমাকে।তাড়াতাড়ি ঘুমাতে হবে।উঠেছো?”
ঐ ঘটনার পর থেকে এখন প্রায়ই মহুয়ার সাথে কথা বলে আবরার।আগের মতো একদম চুপ করে থাকে না।কখনো কখনো অফিসে যাওয়ার আগে মহুয়াকে ডেকে জিজ্ঞেস করে—” এই মহুয়া,তোমার কিছু লাগবে?কি আনব আসার পথে?”
আবার ছুটির দিনে মহুয়া যখন কোমড়ে শাড়ির আঁচল গুজে ব্যস্ত হাতে রান্না করে তখন প্রায়ই আবরার অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে থাকে।আগে তো সে ছুটির দিনে বাড়িতেই থাকতো না।কাজের দোহাই দিয়ে বাইরে চলে যেত।আবরারকে তাকিয়ে থাকতে দেখলে নিজের কাছেই খুব লজ্জা লাগে মহুয়ার।নাকের পাটা লজ্জায় লাল হয়ে যায়।কান গরম হয়ে যায়।লোকটার নজর খুবই খারাপ।এভাবে তাকিয়ে থাকার কি আছে?আশ্চর্য! মহুয়ার কি লজ্জা লাগে না?নাকি অসভ্য লোক ধরেই নিয়েছে মহুয়ার কোনো লজ্জা-টজ্জা নেই।

রান্নাঘরের কাজগুলো শিখতে খুব বেশি সময় লাগেনি মহুয়ার।রান্না করা খুবই সহজ।চুলার উপর হাঁড়ি-পাতিল তুলে চামচ দিয়ে দু-তিনবার নাড়াচাড়া করলেই রান্না শেষ হয়ে যায়।মহুয়ার রান্না এখন খুব মজা হয়।বিলকিস বেগম যখন আঙুল চেটে খায় আর মহুয়ার প্রশংসা করে তখন আনন্দে তার মুখে চওড়া হাসি ফুটে।আবরারের কন্ঠে খুব বেশি একটা প্রশংসা শোনা যায় না।সে নির্বিকার ভঙ্গিতে খেয়ে উঠে যায়।তার ভাবটা যেন এই, একরকম রান্না হলেই চলবে।মহুয়া মনে মনে ক্ষুব্ধ হয়।দু-একদিন একটু প্রশংসা করলে কি হয়?বিয়ের এতোদিন পার হয়ে গেলেও সে এখনো পুরোপুরি আবরারকে বুঝতে পারে না।মাঝে মাঝে আবরারের আচরণ দেখলে মনে হয়, সে মহুয়ার প্রতি আকৃষ্ট।আবার মাঝে মাঝেই আবরারের অবহেলা দেখলে মনে হয়, মহুয়ার চিন্তা-ভাবনা ভুল।আবরার মহুয়ার প্রতি কোনোভাবেই আকৃষ্ট নয়।

বিয়ের দেড় মাসের মাথায় প্রথমবারের মতো মহুয়া আবরারের রাগ দেখলো।সেদিন বোধহয় শনিবার ছিল।আগেরদিন,আবরারের অনেকগুলো শার্ট-প্যান্ট ধুয়ে দিয়েছিলো মহুয়া।একটা শার্টের পকেটে কি একটা কাগজ ছিলো।মহুয়ার নজরে আসেনি তা।ভুলে ওটাসহ জামা-কাপড় ধুয়ে ফেলে।সকালে অফিসে যাওয়ার আগে তন্ন তন্ন করে কাগজটা খুঁজেছে আবরার।শেষে পেয়েও যায় অবশ্য।ভিজে কাগজটা আধভেজা হয়ে একদলা হয়ে আছে।কাগজের লেখাগুলো কিছুতেই বুঝা যাচ্ছে না।দরকারি জিনিসের এই অবস্থা দেখে সে কি রাগ আবরারের।ভীষণ চোটপাট করেছে মহুয়ার সাথে।সকালে নাস্তা অবধি খায়নি।পুরোটা সময় মহুয়া চুপ করে ছিলো।শত হলেও দোষটা তারই।মহুয়া যতবার শুকনো মুখে ভুল স্বীকার করতে গেছে, ততোবার মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে গেছে আবরার।সেদিন নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়েছে মহুয়ার।সব ছেড়ে নিজের বাড়িতে চলে যেতে ইচ্ছে করেছে।বিলকিস বেগমও বাড়ি ছিলেন না সেদিন।দিন কয়েকের জন্য আফিয়ার বাড়িতে গিয়েছিলেন।মহুয়াকে বাড়িতে একা পেয়ে যেন নিজের সব রাগ উগরে দিয়েছে আবরার।আবরার চলে যাওয়ার পর মহুয়া একা একা অনেক্ষণ চিন্তা করেছে।অনেকদিন হয়েছে বাড়িতে যাওয়া হয়না।আবরারের আজকের আচরণের পর মহুয়া সহজে তার সামনে স্বাভাবিক আচরণ করতে পারবে না। মহুয়ার সময় লাগবে।তাই মহুয়া সিদ্ধান্ত নিলো আজ আবরার বাড়ি ফিরলেই, সে আজিমপুর যাওয়ার অনুমতি নেবে।কাল বিকালের দিকে বিলকিস বেগম চলে আসবেন।মহুয়া সকাল সকাল রান্না শেষ করে রাখবে।তাহলেই আর কোনো সমস্যা হবে না।মহুয়া ক্লান্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। হাঁপিয়ে গেছে সে।কিছুদিন বিশ্রাম না করলে নিশ্চিত মরে যাবে মহুয়া।আবরারের উগ্র আচরণ আজ খুব চোখে লেগেছে।একটু ভুল নাহয় করেই ফেলেছে।তাই বলে এতো খারাপ ব্যবহার!এতোটা কি কাম্য ছিলো? রাতের বেলা একা বাড়িতে খুব ভয় লাগে মহুয়ার।আবরারদের বাড়ির নিচ তলায় ভাড়াটিয়া আছে।দো-তলায় কেবল আবরাররাই থাকে।দরজা-জানালা বন্ধ করে শোবার ঘরে খাটের এককোনে বসে থাকে মহুয়া।মহুয়ার মুখোমখি আয়না রাখা।মহুয়া খাটে বসেই নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে।আবরার কেন আকৃষ্ট হয় না তার প্রতি? মহুয়া কি যথেষ্ট সুন্দরী নয়?
মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে।তার বোঝার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে।সে নিশ্চিত বিয়ের আগে আবরারের একটা সম্পর্ক ছিলো।এখনো আছে কি না তা জানে না মহুয়া।আবরার নিশ্চয়ই আগের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না।তাই হয়তো এখনো স্বাভাবিকভাবে মিশতে পারছে না মহুয়ার সাথে।মহুয়ার ইচ্ছা করে বিষয়টা নিয়ে বাবার সাথে কথা বলতে।কিন্তু,ইচ্ছা পূরণের কোনো রাস্তা নেই।আফজাল সাহেব মহুয়ার প্রতি খুবই দূর্বল।মহুয়ার মানসিক অশান্তির কথা তার কাছে খুলে বলা মানেই বাবাকে চিন্তার সাগরে ডুবিয়ে দেওয়া।এই কাজ কিছুতেই করতে পারবে না মহুয়া।ভাগ্যের উপর ভর করে দেখাই যাক,সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছেটা কি।
ভাবতে ভাবতে একসময় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে মহুয়া।ঘুম ভাঙে আবরার আসলে।আবরার রাত দশটার দিকেই বাড়ি চলে আসে।মহুয়া আজ আগ বাড়িয়েই কথা বলে না।এমনকি আবরারের জামা-কাপড় এগিয়ে দেয় না,শরবতের গ্লাস এগিয়ে দেয় না।তাকায়ই না আবরারের চেহারার দিকে।হয়তো মহুয়ার এই ভিন্ন আচরণ আবরারের চোখে পড়ে।রাতে ভাত না খেয়েই বিছানায় চলে আসতে চায় মহুয়া।তবে আসতে পারে না।পিছন থেকে হাত টেনে ধরে আবরার।নিজের মুখোমুখি দাঁড় করায় মহুয়াকে।দু-হাতের আজলায় তুলে নেয় মহুয়ার মুখ।নরম গলায় প্রশ্ন করেঃ”ভাত খাওনি কেন?”
—” ইচ্ছে করছে না।”
—” রাগ করে আছো?”
—” না।হাত সরান। আমার ঘুম পেয়েছে,আমি ঘুমাব।”
আবরার হাসে।মুখ ছেড়ে দু-হাতে আলগোছে জড়িয়ে ধরে মহুয়াকে।মহুয়া অবাকের চূড়ান্তে।আবরার কি অসুস্থ?এরকম বিকারগ্রস্থের মতো আচরণ করার মানে কি?
—” মহুয়া তুমি কবিতা পছন্দ করো?”
—” না।আমি কবিতা বুঝি না।আপনি এভাবে জড়িয়ে ধরে আছেন কেন? দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলুন।”
মহুয়ার কথার ধারে কাছেও যায় না আবরার।নিজের মতো করেই বলেঃ”আমার সবচেয়ে পছন্দ জীবনানন্দ দাশের কবিতা।ওনার একটা কবিতা আছে, বনলতা সেন নামে।পড়েছ?”
—” উঁহু, নাম শুনেছি।”
আবরার হঠাৎ করেই গভীর পুরুষালি গলায় জীবনবাবুর কবিতার দুটো লাইন আবৃত্তি করে।কবিতার চরণে ঢেলে দেয় গলার সব আবেগ।

“আমি ক্লান্ত প্রাণ এক,চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।”

“মহুয়া আমি পৃথিবীর এক ক্লান্ত যাত্রী।আমাকে দু-দন্ড শান্তি দিবে,প্লিজ।আজকে থেকে আমার বনলতা সেন হবে?আমার একান্ত ব্যক্তিগত বনলতা সেন??”

চলবে….

(বি.দ্রঃভুল -ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো)

যাত্রাশেষে (পর্ব-৪+৫)

# যাত্রাশেষে (পর্ব-৪+৫)
# হালিমা রহমান

মহুয়ার বাড়ি ফিরতে ফিরতে আটটা বেজে গেল।রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে আগেই বাড়ির পথ ধরেনি সে।এদিক-সেদিক ঘুরাঘুরি করেছে।ইদানিং কিছুতেই মন বসাতে পারছে না মহুয়া।কেমন যেন অস্থির লাগে সবসময়।গলা শুকিয়ে আসে।হুটহাট মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়।নতুন কোনো রোগ দেখা দিলো নাকি কে জানে!জানার ইচ্ছে নেই।তাই মহুয়া কোনো ডাক্তারের কাছেও যায়নি।এই বিয়েতে মোটেও রাজি না মহুয়া।তুষারের সাথে বিয়ের কথা-বার্তা যতটুকু এগিয়েছে, তার পিছনে পুরোই মায়ের অবদান।সাবিনা বেগম সবকিছু ঠিকঠাক করে মহুয়াকে তার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন।যেদিন তুষারের খালামনি মহুয়াদের বাসায় এসেছিল,সেদিন প্রথম মহুয়া জানতে পারে তার বিয়ের কথা।মহুয়া হতবাক! তার বিয়ে অথচ সে শুরু থেকে কিছুই জানে না!এ নিয়ে আজ বিকেলেও একচোট ঝামেলা হয়েছে বাসায়।মহুয়া তুষারের সাথে দেখা করতে যাবে না।কিছুতেই আরেকটা লোকের সামনে পুতুল হয়ে বসে থাকতে পারবে না সে।সাবিনা বেগম প্রথমে বুঝিয়েছেন,এরপর ধমক দিয়েছেন।কিন্তু,এরপরেও যখন দেখলেন একরোখা মেয়ে কিছুতেই যাবে না; তখন সপাটে দুটো চর মেরেছেন।মায়ের চর খেয়েই মহুয়া আজ তুষারের সাথে দেখা করতে এসেছে।নাহয় কিছুতেই আসতো না।
মহুয়া বাড়ি ফিরলো আটটায়।সে ঘরে ঢুকে দেখলো তার মা রান্না করছে।মহুয়ার মায়ের এই এক স্বভাব,তিনি একবেলার খাবার আরেক বেলায় খেতে পারেন না।তাই,তিন বেলায়ই খাবার রান্না করেন তিনি।মহুয়া ঘরে ঢুকে শব্দ করে ব্যাগ রাখলো।দু-পায়ের দুপাটি জুতো এদিক-সেদিক ছুঁড়ে মারলো।বাড়ি ফিরার পথে ঘরের জন্য দু-কেজি পেয়ারা এনেছিল।শব্দ করে সেগুলো রান্নাঘরে রাখলো।তবুও,সাবিনা বেগম ফিরেও তাকালেন না।যেমন একমনে রান্না করছিলেন,সেরকমই রান্না করতে লাগলেন।মহুয়া বুঝতে পারলো মায়ের রাগ এখনো কমেনি।আশ্চর্য হয়ে যায় মহুয়া।রাগ করার কথা ওর।অথচ রাগ করেছে মা।মহুয়া রান্নাঘরে সময় নষ্ট না করে বেড়িয়ে এলো।এঘর-ওঘর উঁকি-ঝুঁকি দিয়ে বাবাকে খুঁজল।মহুয়ার বাবা মহুয়ার কাছে জাদুকরের মতোন।এই একটা মানুষ যার কাছে সব সমাধান আছে।আফজাল সাহেবকে খুঁজে না পেয়ে হতাশ হলো মহুয়া।কোথায় যে গেল বাবা?মহুয়ার পেটের ভিতর কথাগুলো গুড়্গুড় করছে।যতক্ষণ না এগুলো আফজাল সাহেবের সামনে উগরে দিতে পারবে,ততোক্ষণ এই গুড়গুড়ানি থামবে না।মহুয়া নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো।বাবা না আসা অবধি একটু বিশ্রাম নেওয়া যাক।সারাদিন অনেক কাজ করেছে সে।সেই সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্কুলে ক্লাস নিয়েছে,বিকেলে সাবিনা বেগমের সাথে ঝামেলা করেছে আর শেষ বিকালে তুষারের সাথে প্যাচাল পেরেছে।কথা বলাও একটা ঝামেলা।কথা বলে মুখ ব্যাথা করার চাইতে চুপ করে থাকা ভালো।মহুয়ার মাথা ব্যাথা করছে খুব।শুধু মাথা না।ঘাড়,গলা, কান, চোখ সব একসাথে ব্যাথা করছে।এতো যন্ত্রণা একসাথে সহ্য করতে পারলো না মহুয়া।গা এলিয়ে দিলো নরম বিছানায়।খুব বেশিক্ষণ চোখ দুটো খুলে রাখতে পারলো না সে।পাড়ি দিলো শান্তির স্বপ্নময় জগতে।

***

রুবিনা বেগম বিছানায় বসে আছেন।তার সামনে মৃত্তিকা বসা।তুষার তাকে একগাদা খেলনা এনে দিয়েছে সেদিন।বল,গাড়ি, প্লেন,হাড়ি,পুতুল এরকম আরো অনেক কিছু।এর মধ্যে অর্ধেক আছাড়-টাছাড় মেরে ভেঙে ফেলেছে মৃত্তিকা।বাকি অর্ধেক ভাঙার পায়তারা করছে।কখনো দাঁত দিয়ে কামড়ে দেয় আবার কখনো খেলনাগুলোকে মেঝেতে ছুড়ে ফেলে দেয়।এরপরেও যদি না ভাঙে তবে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে।মৃত্তিকার দিকে তাকিয়ে প্রায়ই অবাক হয়ে যান রুবিনা বেগম।মেয়েটা এতো দুষ্টু! কার মতো হয়েছে ও।তুষার তো এতো দুষ্টু নয়।
রুবিনা বেগম ইদানিং তুষারকে নিয়ে খুব চিন্তা করেন।এই বিয়ে তুষার বাধ্য হয়ে করছে।তাই,তার কাজ- কর্মগুলোও কেমন যেন ঝিমধরা।বিয়ে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই,ইচ্ছে নেই,আগ্রহ নেই।বিয়ের পর সুখী হবে তো তুষার?মহুয়া ভালো হবে নাকি আর দশটা সৎমায়ের মতো হবে?যদি মৃত্তিকার সাথে খারাপ ব্যবহার করে?যদি এই পুতুলটাকে আপন করে না নেয়, তবে? কী হবে তখন?
ভাবতে পারেন না রুবিনা বেগম।সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা বুঝা মুশকিল।তিনি কি থেকে কি করবেন তা কেউ আগেই বুঝতে পারে না।রুবিনা বেগম শত শত চিন্তাকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেন।তিনি ধৈর্য্য ধরে সৃষ্টিকর্তার উপর ভরসা রেখে সময়ের অপেক্ষা করেন।এছাড়া আর কিছুই করার নেই তার।
তুষারে ফিরতে রাত হলো।প্রায় দশটা বেজে গেছে।সে যতোক্ষণে রুবিনা বেগমের বাসায় পা রেখেছে,ততোক্ষণে মৃত্তিকা ঘুমিয়ে গেছে।তুষার ঘরে ঢুকে দেখলো মৃত্তিকাকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছেন রুবিনা বেগম।তুষার আস্তে আস্তে দরজায় আওয়াজ করলো।মৃদু আওয়াজে বললঃ” খালামনি,ঘুমিয়েছ?”
—” কে তুষার?ভিতরে আয়।”
তুষার ঘরে ঢুকে খাটের এককোনে বসল।মৃত্তিকাকে ইশারায় দেখিয়ে বললঃ” কখন ঘুমিয়েছে?”
—” একঘন্টা আগে।”
—” সারাদিন তোমাকে বিরক্ত করেছে খুব,তাই না?”
—” তোকে না দেখলে তো ও একটু বিরক্ত করেই। ওসব বাদ দে।এখন বল,মেয়ে কেমন দেখলি? পছন্দ হয়েছে?”
—” খারাপ না।”
রুবিনা বেগম বিরক্ত হলেন।কথার কি ধরন! মুখ ভোঁতা করে বললেনঃ”মেয়েটা খুব সুন্দর। ব্যবহারও খুব ভালো।তুই এভাবে বললি কেন?”
—” কিভাবে বললাম?”
—“খারাপ না আবার কেমন কথা।তুই বলবি,মেয়েটা খুব সুন্দর।আমার পছন্দ হয়েছে।আমি জিজ্ঞেস করেছি,মেয়ে পছন্দি হয়েছে কিনা।আর তুই বলিস খারাপ না।হারামজাদা কোথাকার।কোথায় পেয়েছিস এসব কথা?”
তুষার হাসে।খালামনি পারলে আজকেই তাকে বিয়ে দিয়ে দিত।সে বালিশ ছাড়াই বিছানায় মাথা রেখে শুয়ে পরলো।
—” খালামনি বিয়ের তারিখ কি ঠিক করেছ?”
—” না, কেন?তোর খুব পছন্দ হয়েছে মহুয়াকে? এই সপ্তাহেই বিয়ের তারিখ ঠিক করি?”
খুব উৎফুল্ল শোনায় রুবিনা বেগমের কন্ঠস্বর।তুষার কিছুক্ষণ ভেবে বলেঃ”না,খালামনি।বিয়ের তারিখ এতো তাড়াতাড়ি ঠিক করো না।একমাস পিছনের একটা তারিখ ফেলো।আমার একমাস সময় লাগবে।”
—” একমাস!”
—” হুম।”
—” একমাস সময় নিয়ে কি করবি তুই?”
—” নয়া পল্টনের ফ্ল্যাটটা পুরোপুরি শেষ করতে আরো একমাস সময় লাগবে।আমি চাইছি,বিয়ের পর ওদেরকে নিয়ে ওখানেই উঠতে।দোকানে আসা- যাওয়া করতে সুবিধা হবে।”
একটু মিথ্যা বলল তুষার।ফ্ল্যাট প্রায় শেষ হওয়ার পথেই।বড়জোর দু-সপ্তাহ লাগবে। তুষার বিয়ের তারিখ পিছিয়েছে মহুয়ার জন্য।মেয়েটাকে আজ ভালোও লাগেনি আবার খারাপও লাগেনি।আর কয়েকটা দিন তার সাথে মিশতে চায় তুষার।মহুয়াকে বিশ্বাস নয় বুঝতে চায়।একমাসে কি একটা মানুষকে পুরোপুরি বুঝে ফেলা যায়?কে জানে!মহুয়াকে একটু হলেও বুঝে নিতে চায় তুষার।না বুঝে মানুষকে বিশ্বাস করলে সেখানে বিশ্বাসের মূল্য থাকে না।এ সত্য তুষারের চাইতে আর কে বেশি জানে??

***

মহুয়া ঘুমিয়ে আছে।তবে বেঘোরে নয়।মহুয়ার ঘুম পাতলা।ঘুমের মধ্যে একটু আওয়াজ কানে এলেই ঘুম ভেঙে যায়।মহুয়ার মনে হচ্ছে কেউ ওর চুলে আঙুল চালাচ্ছে।নরম আঙুলে চুলগুলো টেনে দিচ্ছে কেউ।আহ! কি আরাম।চুলের ভিতর যেন কেউ আদর ঢেলে দিচ্ছে।কে করছে এরকম?এমন মহান মানুষটাকে দেখার উদ্দেশ্যেই চোখ খুললো মহুয়া।চোখ খুলে আর কাউকে নয় বাবাকেই পেল।মাথার কাছে বসে বসে চুল টেনে দিচ্ছেন আফজাল সাহেব।মহুয়া মৃদু হাসে।মহুয়া যেদিন খুব ক্লান্ত থাকে সেদিন বাবা এরকম করে।কি করে যেন বুঝে
যায় বাবা।
—” মহু মা,শরীর কি বেশি খারাপ লাগে?”
—” না, বাবা।”
মহুয়া নিজের মাথাটাকে বাবার কোলে আরো গুজে দেয়।পরম শান্তিতে চোখ বুজে নেয়।
—” কোথায় ছিলা তুমি,বাবা?”
—” মসজিদে গেছিলাম।তারপর সেখান থেকে তালিমে।তাই আসতে দেরি হলো।তুই কখন এসেছিস?”
—” আটটায়।”
—” তোর মায়ের সাথে কথা বলেছিস?”
—” না।সাহস হয়নি।”
আফজাল সাহেব হাসেন।হাসতে হাসতে বলেনঃ” এতো কম সাহস নিয়ে তোর মায়ের সাথে বিদ্রোহ করতে যাস কেন?যা বলে তা মেনে নিলেই পারিস।”
মহুয়া চুপ করে রইলো।মনে মনে বললঃ” সব কি চাইলেই মেনে নেওয়া যায়?”
আফজাল সাহেব মেয়ের কোনো হোলদোল না দেখে বললেনঃ” কীরে,আবারো ঘুমিয়ে গেছিস?”
—” উঁহু। ”
—” তুষারকে দেখেছিস আজকে?কেমন লাগলো?”
—-” খুব স্বার্থপর একজন মানুষ, বাবা।”
—“স্বার্থপর!”
—” হুম।”
—” কি করে বুঝলি?”
উঠে বসলো মহুয়া।আফজাল সাহেবের মুখোমুখি বসে ওরনা ঠিক করতে করতে বললঃ” আমাকে বিয়ের প্রস্তাব কি করে দিলো জানো? বলে কি– আমি মেয়ের জন্য বিয়ে করছি।আমি যাওয়ার পর জিজ্ঞেসও করেনি আমার যেতে কোনো সমস্যা হয়েছে কী না।তাহলেই চিন্তা করো।”
আফজাল সাহেব পা গুটিয়ে বসলেন।
—” তুই কয়টা বাজে গেছিলি সেখানে?”
—” সাড়ে পাঁচটায় মনে হয়।”
—” তার মানে তুই তাকে আধঘন্টা বসিয়ে রেখেছিলি।আধঘন্টা সময় মানে বুঝিস? অনেক সময়।আমি তুষারের জায়গায় থাকলে কখনোই অচেনা একটা মেয়ের জন্য এতোক্ষণ অপেক্ষা করতাম না।চলে যেতাম।অথচ,সে কিন্তু এটা করেনি।এ থেকে বোঝা যায়,তুষার খুব ভদ্র।”
অবাক হয়ে যায় মহুয়া।ও কি বলল আর বাবা কি বলল!অধৈর্য্য গলায় বললঃ” আরে বাবা, তুমি সময় দেখছো কেন? লোকটার কথা তো শুনলে ।তোমার তাকে স্বার্থপর মনে হয়নি?”
—” মোটেও না।তুই যেমন একটা দুর্ঘটনার শিকার,তেমনি সেও একটা বিশ্রি দুর্ঘটনার শিকার।তাই তার কাছ থেকে বিয়ে সম্পর্কে সাধারণ কথা-বার্তা আশা করা বোকামি।তুই একটা চরম বোকা মহুয়া।”
মহুয়া গাল ফুলালো।বাবাও কেন বিরোধিতা করছে আজ? কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললঃ” বিয়েটা না করলে হয় না, বাবা?”
—” হবে না কেন,অবশ্যই হয়।”
—” তবে তোমরা এতো পাগল হয়ে যাচ্ছ কেন? আরো যাক না কয়েকটা বছর।”
আফজাল সাহেব মেয়ের মাথা টেনে কোলের উপর রাখেন।মেয়েকে কোলের উপর শুয়ে পরতে ইশারা করেন।মহুয়াও কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পরে।আফজাল সাহেব মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেনঃ” তোর মা আর আমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছি,মা।আমরা সারাদিন যাই করিনা কেন ভিতরে ভিতরে চিন্তায় মরে যাই।তোর ভবিষ্যৎ কী,আমাদের কিছু হলে তোর কি হবে,বাইরে মানুষ তোকে বাজে কথা শুনাচ্ছে নাকি, এসব ভেবে ভেবে দম বন্ধ হয়ে আসে আমাদের। এসব চিন্তার অনেক জ্বালা মা।তাই, চিন্তামুক্ত হতেই তোকে এখন বিয়ে দিচ্ছি।”
—” আমি তোমাদের দুঃশ্চিন্তা?”
—” অবশ্যই।শুধু তুই কেন,সব সন্তানই বাবা- মার কাছে চিন্তার বিষয়।এখন তুই বুঝবি না।কিন্তু,যেদিন মা হবি সেদিন বুঝবি।”
আচমকা মহুয়ার চোখের উপর ভেসে উঠে মৃত্তিকার মুখ।একদম তুলতুলে একটা পুতুল।মহুয়া মৃদু হাসে।
—” কিন্তু, আমার যে ভয় করে বাবা।যদি আগের মতো হয়? যদি আবারো আমি একটা দুর্ঘটনার শিকার হই, তবে?”
—” এই যদি শব্দটাকে জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিতে হয় মা।এই একটা শব্দ আমাদেরকে ভয় দেখায়। জুজুবুড়ির ভয়।যতদিন না তুই এই ভয়কে জীবন থেকে ঝেরে ফেলে দিতে পারবি,ততোদিন তুই কিছুতেই সুখী হতে পারবি না।”
মহুয়া হঠাৎ করেই খুব অসহায়ের মতো করে উঠলো।বিধ্বস্তের মতো বললঃ” চাইলেই কি বাদ দেওয়া যায়?স্বপ্ন ভাঙার কষ্ট অনেক, বাবা।”
—” হয়তো তোর কথাই ঠিক।চাইলেই সব বাদ দেওয়া যায় না।কিন্তু,আমার মেয়ের উপর আমার বিশ্বাস আছে।সে খুব সাহসী।সৃষ্টিকর্তা যদি পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চান,তবে আমরা কেউ তা ঠেকাতে পারব না।কিন্তু,মুখোমুখি নিশ্চয়ই দাঁড়াতে পারব।সেই সাহস ও ধৈর্য্য আমার মেয়ের আছে।তাছাড়া, এতো চিন্তা করছিস কেন মা? ইনশাআল্লাহ, এবার যা হবে ভালোই হবে।”
মহুয়া নিশ্চুপে চোখ বন্ধ করে।মনে মনে প্রার্থনা করে, এবার যাতে সে সৌভাগ্যের মুখ দেখে।দূর্ভাগ্যরা যেন দূরে থাকে।দুঃখরা তাকে এবং তার পরিবারকে যেন স্পর্শও না করতে পারে।।

#(পর্ব-৫)

আজ আবারো মহুয়ার জন্য অপেক্ষা করছে তুষার।ঢাকা শহরে পার্কের অভাব নেই।সেরকমই একটা পার্কে বসে বসে আশপাশে নজর বুলাচ্ছে সে।এইদিকটায় মানুষের আনাগোনা কম।তাছাড়া,বেলাও খুব বেশি হয়নি।সবে তিনটা দশ বাজে।তুষার এখানে এসেছে পৌনে তিনটায়।প্রায় পঁচিশ মিনিট ধরে বসে আছে সে।আজকেও মহুয়া দেরি করছে।মহুয়া বলেছিল তিনটার মধ্যেই সে পার্কে থাকবে।একটা বিরক্তিযুক্ত দীর্ঘশ্বাস ফেললো তুষার।এই মেয়ের কি কোনো কান্ডজ্ঞান নেই?নাকি সে ভেবে নিয়েছে, তুষারের কোনো কাজ-কর্ম নেই।তুষার ভেবে পায় না,একজন মানুষ কি করে সবজায়গায় দেরি করতে পারে।সেদিনও দেরি করলো, আজকেও দেরি করছে।উফ! অসহ্য।

প্রায় তিনটা বিশের দিকে পার্কে ঢুকলো মহুয়া।আজ সে ইচ্ছে করে দেরি করেনি।স্কুল ছুটি হয় একটায়।মহুয়ার শেষ ক্লাস ছিল সাড়ে বারোটায়।সে ভেবেছিল ক্লাস শেষ করে বাসায় যাবে।তারপর খেয়েদেয়ে আস্তে ধীরে বের হবে।কিন্তু,বিধি বাম!স্কুল ছুটির পর একটা মিটিং শুরু হলো।সেই মিটিংয়ে আটকে গেল মহুয়া।বাসায়ও ফিরতে দেরি হলো ফলস্বরূপ এখানেও আসতে দেরি।মহুয়া এই চাকরিটার উপর খুব বিরক্ত।সে আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল নতুন একটা চাকরি পেলে এই চাকরিটা ছেড়ে দিবে।এখন মনে হচ্ছে শীঘ্রই নতুন একটা কাজ খুঁজতে হবে।স্কুল কর্তৃপক্ষ হুটহাট মিটিং ডাকে।এটা একদমই সহ্য হয় না মহুয়ার।পার্কে ঢুকতেই চোখে পড়ে উত্তর দিকের একটা বিশাল অশ্বত্থ গাছ। গাছের নিচে একটা রংচটা স্টিলের বেঞ্চ পেতে রাখা।তার উপরেই বসে আছে তুষার।হেলান দিয়ে বসে বসে মোবাইল টিপছে।মহুয়ার আজকে নিজেকে একটু অপরাধী মনে হচ্ছে।ওর জন্য প্রতিবার এই মানুষটার সময় নষ্ট হয়।মহুয়া দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল তুষারের দিকে।

—” আসসালামু আলাইকুম, তুষার সাহেব।আপনি নিশ্চয়ই অনেক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন।আমি আসলে খুবই দুঃখিত।অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঘটনায় আটকে গিয়েছিলাম।তাই,দেরি হলো।আপনি কিছু মনে করবেন না, প্লিজ।আমি ইচ্ছে করে দেরি করিনি।”
তুষার মৃদু হাসলো।হেসে বেঞ্চের একদিকে চেপে বসলো।অন্যদিক খালি করে দিল মহুয়াকে।মোবাইলটাকে পকেটে রাখতে রাখতে বললঃ” ঠিক আছে কিছু মনে করলাম না।বসুন।”
মহুয়া বসার পর তুষার বেঞ্চের উপর এক-পা তুলে বসলো।তারপর মুখে বললঃ” আপনার আসতে কোনো কষ্ট হয়নি তো?”
—” নাহ।কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন আপনি?”
—“প্রায় পঁয়ত্রিশ মিনিট।আজকে খুব রাগ হয়েছিল আপনার উপর।ভেবেছিলাম আপনি আসলে মাথায় তুলে দু-একটা আছাড় মারব।কিন্তু,এসে যেভাবে দুঃখ প্রকাশ করলেন তাই আর কিছু বললাম না।আমার আবার খুব দয়ার শরীর।”
হেসে ফেললো মহুয়া।
—” আপনার সাহস তো কম নয়।বিয়ের আগেই আমাকে হুমকি দিচ্ছেন।আমি কিন্তু আর পাঁচটা সাধারণ লুতুপুতু মেয়েদের মতো না।আমাকে অকারণে ধমক দিলে একেবারে খুন করে ফেলব।আমি মহুয়া,হুহ!”
তুষার জবাবে কিছু বলার আগেই কল এলো মোবাইলে।দোকানের কর্মচারী ফোন দিয়েছে।তুষার উঠে একটু দূরে চলে গেল কথা বলার জন্য।মহুয়া একা বসে একমনে তুষারের দিকে চেয়ে রইলো।আজকে এখানে দেখা করার সিদ্ধান্ত তুষারের।কি জন্য তুষার দেখা করতে চেয়েছে তা এখনো অজানা মহুয়ার।তুষার দু-দিন আগে ফোন করে অনুরোধ করেছিল মহুয়াকে যেন আজকে দেখা করে।না করতে পারেনি মহুয়া।লোকটা একটু কেমন যেন।সহজেই মিশে যায়।কিন্তু নিজের সীমা অতিক্রম করে না।যারা নিজেদের সীমারেখা বজায় রাখে তাদেরকে আর যাই হোক খারাপ বলা যায় না।তাই,তুষারকেও মহুয়া খারাপ বলতে পারছে না।তুষারকে মাঝে মাঝেই খুব সহজ-সরল মনে হয়।আবার মাঝে মাঝে স্বার্থপর।মহুয়ার কাছে বর্তমানে তুষার একটা মস্ত ধাধা।
—” মহুয়া কি ভাবছেন?”
—” না,কিছু না।”– তুষারের কন্ঠে ঘোর থেকে বেরিয়ে আসে মহুয়া।
—” আচ্ছা,মৃত্তিকা কেমন আছে?”
—” ভালো।”
—” ও আপনাকে না দেখলে কাঁদে না?”
—” অনেক্ষণ না দেখলে কাঁদে।কিন্ত সমস্যা হয় না খালামনি ওকে সামলে নেয়।ও ওর দাদির খুব ভক্ত।”
—” ভাত খেয়েছেন দুপুরে?”
—” হুম।আপনি খেয়েছেন?”
মহুয়া মাথা নাড়ে।যার অর্থ সে খেয়েছে।মহুয়া এদিক- ওদিক নজর বুলিয়ে বললঃ” আজ এখানে ডাকলেন যে? কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবেন নাকি?”
—” বলব না, শুনব।”
—” কি শুনবেন?”
তুষার হেলান দিয়ে বসে বললঃ” ওইদিন মাঝ পথে কথা থামিয়ে চলে গিয়েছিলেন,মনে আছে?এরপর কি হয়েছিল তা তো আর বললেন না।সেই পুরো ঘটনাটাই আজ শুনব।আজ কিন্তু অর্ধেক বলে চলে যেতে পারবেন না।পুরোটা শেষ করতে হবে।”
মহুয়া অবাক হয়ে গেল।বিস্মিত স্বরে বললঃ”আমার আগের বিয়ের ঘটনা শোনার জন্য আজ এই জরুরি তলব!আপনার আজ কোনো কাজ নেই? অন্য একদিন শুনে নিলেই তো হয়।অনেক সময় লাগবে তো বলতে।”
তুষার বেশ আয়েশ করে বসে বললঃ” লাগুক।আজকে সব কাজ কর্মচারীদেরকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।খালামনিকেও বলে এসেছি আজকে আমার ফিরতে দেরি হবে।আপনি রিল্যাক্সে বলুন।আজ আমার সারাদিন আপনার নামে লিখে দিলাম।আমার কোনো তাড়া নেই আজ।”
মহুয়া চুপচাপ কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো।তার মাথায় নড়চড় করছে অতীতের কিছু পোকা।সে একটা বড়সড় দম নিলো। তারপর সামনের দিকে চেয়ে বললঃ” কোথায় যেন ছিলাম?”
—” ঐ যে আবরার না কী যেন একটা নাম, ওর সাথে দেখা…
—” ওহ, মনে পরেছে।আচ্ছা,শুনুন তাহলে।”

***

আবরারের মায়ের নাম বিলকিস বেগম।মহুয়াকে তার পছন্দ হয়েছে খুব।তিনি কিছুদিন ধরেই ছেলের জন্য মেয়ে খুঁজছেন।সেদিন আজিমপুরে মূলত মেয়ে দেখতেই গিয়েছিলেন।কিন্তু,মাঝপথেই দূর্ঘটনার শিকার হন।মহুয়াকে দেখার পর থেকে আর কোনো মেয়ে মনে ধরছে না।আজিমপুর থেকে ফিরেও দুটো মেয়ে দেখেছেন।কিন্তু,তাদের সবকিছুই কেমন যেন মেকি মনে হয়েছে।মনে হয়েছে এরা একজনও স্বাভাবিক আচরণ করছে না।বিলকিস বেগম অনেক ভেবেচিন্তে মহুয়াদের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠালেন।তার একটাই ছেলে।একটা সোনার টুকরা মেয়ে না ঠিক করলে চলবে কেন?

মহুয়া রাতের বেলা বসে বসে ছবি দেখছিল।পরীক্ষার পর থেকে দিনের বেলা ব্যস্ত থাকলেও রাতের বেলা অলসের মতো পরে থাকে মহুয়া।হাতে কোনো কাজ নেই।ঘরের কাজে আগ্রহ নেই।মহুয়া জীবনে রান্নাঘরে কতবার গেছে তা হাতে গুনে বলতে পারব।রান্নাবান্নার কাজে সে প্রচন্ড অলস।পানি গরম ছাড়া আর কিছুই পারে না।ওকে এক প্রকার অপদার্থই বলা যায়।তবে,এতোটা অলস হওয়ার পিছনে আফজাল সাহেবের অবদান কম নয়।সাবিনা বেগম বারবার মেয়ের অদক্ষতা প্রচার করে বকাবকি শুরু করলেই তাকে থামিয়ে দিতেন আফজাল সাহেব।মুখে বলতেনঃ” আহ,সাবিনা থামো তো।রান্না করার সময় আসলে মেয়ে এমনিতেই শিখে যাবে।মায়ের কাছে থাকলে মেয়েরা একটু অলস হয়ই। নিজের ঘাড়ে পরলেই সব কিছু শিখে যাবে।দেখে নিও।”
মহুয়া যখন বসে বসে একটা হলিউড মুভি দেখছিল,তখনই ঘরে আসেন সাবিনা বেগম।মহুয়া একনজর মায়ের দিকে তাকালো।আজকে কেন যেন মাকে একটু বেশিই খুশি খুশি দেখাচ্ছে।সে ল্যাপটপে নজর রেখেই বললঃ” কী ব্যাপার মা? তোমাকে এতো খুশি খুশি লাগছে কেন?”
—” একটা ঘটনা ঘটেছেরে মহুয়া।”
মহুয়া ল্যাপটপ বন্ধ করে সাবিনা বেগমের দিকে ঘুরে বসে।মুখে বলেঃ” কি ঘটলো আবার?”
—” ওইদিন একটা মহিলাকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছিলি না,ওই যে….
—” মনে আছে আমার।কি হয়েছে ওনার?”
—” তার ছেলের জন্য তোকে চেয়েছেন উনি।ছেলেটা কি সুন্দর, তাই না? আর অনেক ভদ্র,মা ভক্ত ছেলে একদম।ছেলে ব্যাংকে চাকরি করে।সংসারে কোনো ঝুট-ঝামেলা নেই।মা- ছেলে এই দুজন নিয়েই পরিবার।ছেলের একটা পালক বোন আছে।বিয়ে হয়ে গেছে তার।আবরারের বাবা মারা গেছে অনেক আগে,তারপর…..
—” থামো মা”— সাবিনা বেগমকে থামিয়ে দেয় মহুয়া।আরেক ছেলে নাড়ি-নক্ষত্র শুনতে মোটেও ভালো লাগছে না তার।এরকম বিয়ের প্রস্তাব বহুবার এসেছে মহুয়ার জন্য।প্রত্যেকবার পড়ালেখার দোহাই দিয়ে আটকে দিয়েছে মহুয়া।কিন্তু এবার কি করবে? এবার তো বিয়ে আটকানোর মতো কোনো অজুহাত নেই মহুয়ার কাছে।কি যে করবে মহুয়া।বেশ চিন্তায় পরে যায় সে।কপাল কুঁচকে বলেঃ” আমাকে ওই ছেলের মা একদিন দেখেছে।এতেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দিলো! খোঁজ খবর নিয়েছে আমার সম্পর্কে? ”
—” তা কি আর না নিয়েছে।নিশ্চয়ই আড়ালে আবডালে নিয়েছে।তোর বাবাও নয়া পল্টনে ছেলেদের এলাকায় যেয়ে খবর নিয়ে এসেছে।ছেলের কোনো খারাপ রেকর্ড নেই।”
অবাকের আতিশয্যে সোজা হয়ে বসে মহুয়া।গলায় অবাকের রেশ ছড়িয়ে বলেঃ” তোমরা চুপিচুপি এতোকিছু করে ফেলেছো?এখন বলতে এসেছ কেন? বিয়ের তারিখ ঠিক করে একেবারে বিয়ের দিনই বলতে।আমি তৈরি থাকতাম।”
সাবিনা বেগম মুখ বাকিয়ে ঝাঝালো স্বরে বললেনঃ” খোচা মেরে কথা বলবি না ফাজিল মেয়ে।ছেলেটা ভালো।এইখানে বিয়ে হলে ভালো থাকবি তুই।তোর বাবা- চাচারা সবাই ছেলে দেখেছে।তাদের খুব পছন্দ।ছেলের পক্ষের কোনো চাহিদা নেই।এরকম ছেলে আজকাল পাওয়াই যায় না।তোর কোনো কথাও এবার শুনব না।আল্লাহ যদি চায় তবে এখানেই বিয়ে হবে তোর।”
সাবিনা বেগম উঠে চলে গেলেন।মহুয়া থম মেরে বসে রইলো কিছুক্ষণ। তাহলে কি বিয়েটা করতেই হবে? ব্যক্তিগতভাবে মহুয়ার কোনো পছন্দ নেই।বাবা- মায়ের উপর তার অগাধ বিশ্বাস। তারা যা করবে তাই সৌভাগ্য বয়ে আনবে– এই কথাটাই বিশ্বাস করে মহুয়া।কিন্তু,তবুও বিয়ে নিয়ে খুব ভয় মহুয়ার।বিয়ের পর নিশ্চয়ই রান্নাঘরে যেতে হবে।হাত পুড়িয়ে রান্না করতে হবে।কাপর কাঁচতে হবে,ঘর ঝাড়ু দিতে হবে,বিছানা গোছাতে হবে— কতকাজ।উফ! অসহ্য! কোলবালিশ জড়িয়ে উপুর হয়ে শুয়ে পড়ে মহুয়া।কি হয় বিয়ে না করলে।মা কি জানে না তার মেয়েটা কত অলস? সে কি এসব কাজ করতে পারবে?
অবশেষে আবরারের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েই গেল মহুয়ার।বিয়ের আগে ট্রেনিং সেন্টারের কাজটা ছেড়ে দিলো মহুয়া।নয়া পল্টন থেকে প্রতিদিন এসে কাজ করা সম্ভব না ওর পক্ষে।বিয়ের পরে ভালো কোনো চাকরি পেলে বরং ওটাই করবে।আবরারের সাথে বিয়ের আগে একবার মাত্র দেখা হয়েছে মহুয়ার।তাও আংটি পরানোর দিন।মহুয়া ঘোমটার আড়াল থেকে একটুখানি উঁকি দিয়ে দেখেছিল।কেমন গম্ভীর একটা মুখ আবরারের।মহুয়া ভেবেছিল মানুষটাই বুঝি এরকম গম্ভীর।কিন্তু,কে জানতো ওর ভাবনাটাই ভুল ছিল!আবরারের গম্ভীর চেহারার পিছনেই অন্যকিছু লুকিয়ে ছিল।
অবশেষে সেই পৌষ মাসের মাঝামাঝিতে আবরারের সাথে মহুয়ার বিয়েটা হয়েই যায়।এক পাতাঝরা রিক্ত বিকেলে বাবার হাত ছেড়ে মহুয়া আঁকড়ে ধরে আবরারের হাত।যাত্রা করে এক নতুন ঠিকানায়।সাথে পুঁজি করে নিয়ে যায় একচোখ স্বপ্ন,কিছটা লজ্জা,একটু ভয়-সংকোচ আর এক আকাশ মন খারাপ।।

চলবে…

যাত্রাশেষে (পর্বঃ১-৩)

যাত্রাশেষে (পর্বঃ১-৩)
#হালিমা রহমান।

মাস কয়েক আগে,তুষারের স্ত্রী মহিমা যখন অন্য আরেকজনের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল;তখন পুরো এলাকার মানুষ বিস্ময়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল।সবার একটাই প্রশ্ন –” মহিমা কি মানুষ?যার শরীরে মানুষের রক্ত বইছে,সে কীভাবে এমন কাজ করতে পারে?তুষারের মতো একটা ঠান্ডা মানুষকে কীভাবে ফেলে যেতে পারলো?আচ্ছা,ঠিক আছে তুষারকে ছেড়ে যেতে নাহয় কষ্ট হয়নি কিন্তু নিজের নাড়ি ছেড়া ধন?তাকে কী করে মানুষ ফেলে যেতে পারে?এটা কি মা নাকি ডাইনি?
মহিমা যখন পালিয়ে গেছে,তখন তুষার বাড়ি ছিল না।মহিমা তাদের মেয়ে মৃত্তিকাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেই বেরিয়ে গেছে।মৃত্তিকার বয়স তখন মাত্র তিনমাস।মহিমা তৈরি হয়ে,হাতে একটা ছোট ব্যাগ ঝুলিয়ে, দরজায় বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে দ্রুতপায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিল যখন,তখন সিড়ির গোড়ায় রিদিতার সাথে দেখা।রিদিতা একই বাড়ির পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা। রিদিতা মহিমাকে দেখে একগাল হাসে।মহিমাকে তার খুব পছন্দ।তাই, আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করেঃ” কই যান, ভাবি?মৃত্তি কই?”
—” আমি একটু সামনেই যাব ভাবি।আমার বড় ভাই আসছে চৌরাস্তার মাথায়।ওর সাথে কথা বলে চলে আসব।আপনি মৃত্তিকার দিকে একটু খেয়াল রাখতে পারবেন? ও ঘুমাচ্ছে।ঘুম থেকে উঠলে হয়তো কাঁদবে।আমি এই যাব আর আসব।”
মহিমার কন্ঠে খুব ব্যস্ততা।যেন পালাতে পারলেই বাঁচে।তার পা কাঁপে,গলা শুকিয়ে আসে,ঠোঁটের উপর ও কপালে ঘাম জমে।বাম হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে তা মুছে নেয় সে।একটু ভয় পেয়ে যায় রিদিতা।এই অবস্থা কেন ভাবির? উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করেঃ” কোনো খারাপ খবর নাকি ভাবি?”
—” না,না।কোনো খারাপ খবর নেই।আসছি ভাবি।মৃত্তিকে একটু দেখবেন প্লিজ।”
দরজা পেরিয়ে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে যায় মহিমা।রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা খালি রিকশায় চেপে হুড তুলে নেয়।রিকশাওয়ালাকে তাড়া দেয় তাড়াতাড়ি চালিয়ে যাওয়ার জন্য।
মহিমাকে এভাবে চলে যেতে অনেকেই দেখেছে।কিন্তু, কেউ বুঝতে পারেনি এরকম ভরদুপুরেই সবার নাকের ডগা দিয়ে পালিয়ে যাবে মহিমা।তুষার যখন খবর পেয়েছে তখন বোধহয় বিকাল পাঁচটা বাজে।দুপুর দুটোর দিকে ঘুম ভাঙে মৃত্তিকার।দুধের বাচ্চা উঠেই কান্না শুরু করে দেয়।সেই কি কান্না তার! কান্না ছাড়া যার ভাষা নেই,সে আর কিইবা করতে পারে! রিদিতা ঘুমিয়ে ছিল।তার নিজেরও একটা একবছর বয়সী ছেলে আছে।মৃত্তিকার উচ্চস্বর কানে আসতে সময় লাগে না তার।ধরফরিয়ে উঠে রিদিতা।মৃত্তিকা কাঁদে কেন? তার মানে মহিমা ভাবি এখনো আসেনি? কেমন বেয়াক্কেল মানুষ! রিদিতা ছুটে যায় পাশের ফ্ল্যাটে।দরজা খুলে কোলে নেয় মৃত্তিকাকে।একদম নরম একটা পুতুল।এই কতক্ষণেই প্রস্রাব-পায়খানা করে পুরো পিঠের নিচ পর্যন্ত ভরিয়ে ফেলেছে।সব পরিষ্কার করে রিদিতা।কল করে মহিমার ফোনে।কিন্তু,ফোন বন্ধ।একদিকে মায়ের ফোন বন্ধ, অন্যদিকে মেয়ে দুনিয়া উজার করে কাঁদছে।এই দুজনের চক্করে পরে রিদিতারও হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।কোনো উপায় না পেয়ে মৃত্তিকার মুখে ছেলের ফিডারের সবটুকু দুধ ঢেলে দেয়।বুভুক্ষের মতো তা গিলে নেয় মৃত্তিকা।রিদিতার খারাপ লাগে খুব।মুখ থেকে এমনিই বেরিয়ে আসে সহানুভূতির সুর।আহারে!মেয়েটার পেটে কত ক্ষিদা ছিল।
“মহিমা বাড়িতে নেই, মৃত্তিকা অনবরত কাঁদছে”— কথাটা কানে যেতেই প্রায় উড়ে আসে তুষার।আসতে আসতে শ্বশুরবাড়ি ফোন দেয় খবর নেওয়ার জন্য।মহিমা ওখানে গেল নাকি কে জানে!রিদিতা যখন তুষারকে ফোন দিয়েছিল, তখন তার কোলে ছোট্ট মৃত্তিকা কাঁদছে।কলিজার টুকরার কান্না কানে আসতে দেরি হয়নি তুষারের।তাই মনে মনে ক্ষোভ জমে মহিমার উপর।যেখানেই গেছে যাক।কিন্তু মৃত্তিকাকে নিয়ে গেলে কি হতো?আশ্চর্য মানুষ তো! এইটুকু মেয়ে কি মাকে ছাড়া থাকতে পারে?আজ মহিমা বাড়ি এলে খবর আছে তার।একটা হেস্তনেস্ত করেই ছাড়বে তুষার।
তুষার ঘরে ঢুকে মেয়েকে কোলে জড়িয়ে নেয়।চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দেয় পুরো মুখ।ছোট্ট পুতুলটাও যেন বাবাকে চিনে।বাবার কোলে যেয়েই কেমন শান্ত হয়ে গেছে!মহিমার বাবার বাড়ি থেকে কোনো খবর পাওয়া যায়নি।তারা জানে না কোথায় গেছে মহিমা।তাদের ওখানেও যায়নি সে।এই খবর পেয়ে একটু চিন্তা হয় তুষারের।কোনো বিপদ হলো না তো মেয়েটার! এই শহরে বিপদ ঘটতে দেরি লাগে না।চিন্তার ভাঁজ পরে কপালে।এমন সময় রিদিতা আসে তুষারের ফ্ল্যাটের সামনে।ঠকঠক আওয়াজ করে দরজায়।
—” তুষার ভাই,ভাবির কোনো খোঁজ পেয়েছেন?”
—” না,আপা।”
—” ভাবির বড় ভাইরে ফোন দেন।ভাবি তো দুপুরে তার সাথেই দেখা করতে গেল চৌরাস্তার মাথায়।যাওয়ার সময় আমার সাথে দেখা হয়েছিল।তখন আমাকে বলেছে।”
অবাক হয়ে যায় তুষার।ছোট বোনের সাথে দেখা করতে হলে বাড়িতে আসবে।চৌরাস্তায় কেন দেখা করতে হবে?তুষার ফোন দেয় মহিমার বড় ভাইকে।প্রথমবার কল ধরে না কেউ।দ্বিতীয়বারের বেলায় মহিমার বড় ভাইয়ের গলা শোনা যায়।
—” কি অবস্থা তুষার?”
—“এইতো ভাই।মহিমা কোথায় আছে?ওকে একটু বলবেন তাড়াতাড়ি ফিরে আসতে।”
—” মহিমা কোথায় আছে মানে?ও বাড়িতে নেই?”
—” নাহ,ওতো দুপুরে আপনার সাথে দেখা করতে গেল।আপনি না চৌরাস্তার মাথায় এসেছিলেন ওর সাথে দেখা করতে?”
—” কি বলো এইসব! আমি তোমার ভাবিরে নিয়ে কুয়াকাটা আসছি দুইদিন আগে।”
অবাক হয়ে যায় তুষার।আজ বোধহয় তার অবাক হওয়ার দিন।এটা নিশ্চিত মহিমা অন্য কোথাও গেছে কাউকে না জানিয়ে।চিন্তায় মাথা ছিঁড়ে যাওয়ার জোগাড়। সেই রাতে পুরোটা সময় মেয়েকে বুকে জড়িয়ে শুয়েছিল তুষার।একফোঁটা ঘুমায়নি সারাটা রাত।মাথায় বিভিন্ন চিন্তা।সবচেয়ে বেশি চিন্তা মহিমাকে নিয়ে।ভোরের দিকে একটু চোখ লেগে এসেছিল তুষারের।ঘুমটা হয়তো গাঢ় হতে পারতো।কিন্তু,হলো না বিস্ফোরক একটা খবরের জন্য।একটু আগে তুষারের ছোট শ্যালক ফোন দিয়ে জানিয়েছে,মহিমার পালিয়ে যাওয়ার খবর।মহিমা নাকি তাকে শেষ রাতে ফোন করে জানিয়েছে।মহিমা পালিয়ে গেছে! খবরটা কি সত্যি! প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় তুষারের।আশ্চর্য! কেন পালাবে মহিমা?তাদের মাঝে তো কোনো সমস্যা হয়নি।বেশ সুখী দম্পতিই ছিল তারা।তবে?গতকাল এই সময়েও মহিমা এইঘরে ছিল।এই যে এই বিছানায় মৃত্তিকার গা ঘেষে শুয়েছিল।কালকে যেন একটু বেশি আদুরে দেখাচ্ছিল তাকে।তুষার নয়টার দিকে দোকানে যাওয়ার আগে যখন ব্যবসায়ের হিসাব-নিকাশ করছিল, তখন মহিমাও পাশে বসা ছিল।দু-তিন মাস যাবৎ কেবল ক্ষতিই হচ্ছিলো ব্যবসায়ের।চারদিকে দায়-দেনা বেড়ে গেছে গেছে।তুষারের চিন্তিত মুখ দেখে তার কাঁধে হাত বুলায় মহিমা।সান্ত্বনার সুরে বলে —” চিন্তা করছো কেন?আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।”
এইছিল তুষারের সাথে মহিমার শেষ কথা।কালকের আচরণ তবে অভিনয় ছিল!কিছু ভাবতে পারে না তুষার।মাথাটা কেমন খালি খালি লাগছে।শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।অক্সিজেনের অভাব পরলো নাকি চারপাশে?বিছানায় কেঁদে উঠে মৃত্তিকা। হয়তো মায়ের শরীরের উষ্ণতার অভাব টের পেয়েছে।মেয়ের কান্না শুনে ফাঁকা দৃষ্টিতে তাকায় তুষার।মেয়েটা খুব কাঁদছে।হয়তো ক্ষিদে পেয়েছে।তুষার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নেয়।ঢেলে দেওয়ার চেষ্টা করে শরীরের সবটুকু উষ্ণতা। রিদিতার থেকে ধার করে আনা এক ফিডার দুধ মেয়ের মুখে গুজে দেয়।তারপর মেয়ের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলেঃ” কাঁদে না মা।আজ থেকে তোমার নতুন দিন শুরু।মায়ের নরম কোলের আদর ভুলে যাও।তোমার জন্য বাবা আছি,আর বাবার জন্য আল্লাহ আছে।আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।”

***

দিন আসে, দিন যায়।ছোট পুতুল মৃত্তিকা এখন আর আগের মতো ছোট নেই।তার এখন এক বছর। সে এখন বিছানায় থাকার চাইতে মাটিতে থাকতে বেশি পছন্দ করে।একটু একটু হাঁটতে পারে।এই দুপা হাঁটে আবার কিছুক্ষণ পরেই ধপ করে পরে যায়।দুটো দাঁত উঠেছে তার।এ নিয়ে তার বাহাদুরির শেষ নেই।তুষারের কোনো কথা পছন্দ না হলেই,কুট করে দাঁত বসিয়ে দেয়।আধো আধো বুলিতে যখন “বা বা,বা বা” বলে ডাকে, তুষার তখন স্বর্গীয় সুখ লাভ করে।তবে,ইদানিং মেয়েকে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয় তাকে।ব্যবসা-বাণিজ্যের পাশাপাশি একটা এক বছরের দুষ্টুকে সামলানো সহজ কথা নয়।তুষারের মা-বাবা নেই।বড় কোনো ভাই-বোনও নেই।এই শহরে অভিভাবক বলতে শুধু একটা খালা আছে।তিনি গুলিস্তানে থাকেন।এক্ষেত্রে, বেশ সুবিধা হয়েছে তুষারের।তুষার কাজে যাওয়ার আগে মেয়েকে সেখানে রেখে যায়।আবার বাসায় ফিরার সময় সাথে করে নিয়ে যায়।অনেক সময়,কাজের ফাঁকে কয়েকবার দেখতেও যায়।
তুষারের খালা-খালু বেশ কয়েকবার বলেছে তুষারের বিয়ের কথা।কিন্তু,তুষার একবারেই রাজি না।খালা-খালু যখন বিয়ের সুফল বুঝায়,প্রয়োজনীয়তা বুঝায়; তখন তুষার মুচকি হেসে বলেঃ” এখন ইচ্ছে নেই খালা।বিয়ের ইচ্ছে হলে তোমাকে জানাব।”এরপর আর কোনো কথা থাকে না।তুষারের খালাও চুপ মেরে যান।তুষারের দিকটাও বুঝেন তিনি।এরকম একটা দূর্ঘটনার পর কোনো মেয়েকে বিশ্বাস করা সহজ কথা নয়।তুষারের যখন ইচ্ছা হবে তখনই নাহয় বিয়ের কথা তুলবেন।
কিন্তু,একটা কথা আছে না।মানুষের ইচ্ছা- অনিচ্ছার উপর ভবিষ্যৎ নির্ভর করে না।মানুষ পরিস্থিতির শিকার।পরিস্থিতির চাপে পড়ে মানুষ চরম অপ্রিয় কাজটাও করতে বাধ্য হয়।তুষারের সাথেও তাই হয়েছে।তুষারের খালা-খালু হজ্বে যাবে এইবছর।একটা দীর্ঘসময় তারা থাকবে না।তখন মৃত্তিকার কী হবে?কার কাছে থাকবে সে?প্রথমে,তুষার বলেছিল সারাদিন মৃত্তিকাকে নিজের কাছেই রাখবে।কিন্তু,এ কি হওয়ার মতো?জীবনতো আর সিনেমা নয় যে, মা-ছাড়া একটা বাচ্চা সারাদিন বাবার সাথে বাবার কর্মস্থলে থাকবে।এই পরিকল্পনা যখন কাজে এলো না, তখন তুষার ভাবলো একটা আয়া ঠিক করবে।কিন্তু এতেও তীব্র আপত্তি তুষারের খালার।তিনি চিন্তিত মুখে বলেনঃ”না,বাবা।আয়ারা টাকার জন্য কাজ করে।তার আমার নাতনির যত্ন নিবে না ঠিক মতো।তুমি তার চাইতে একটা বিয়েই করো।আজ হোক, কাল হোক বিয়েতো করবাই।সারাজীবন তো আর একলা কাটানো সম্ভব না।তাহলে,পরে করে কি লাভ?এখনই করো।মেয়েটা একটা মা পাক।তাছাড়া, বড় হওয়ার পর মিত্তি নতুন কাউরে মা ডাকতে চাইবে না।তার চেয়ে তুমি বরং এখনই একটা বিয়ে করো।”
তুষারও ভেবে দেখলো।খালার কথা মন্দ নয়।তাই অনেক ভেবেচিন্তে অবেশেষে তুষার বিয়েতে মত দিয়েই ফেললো।তুষারের খালা মনে আনন্দ নিয়ে বউ খোঁজার কাজে নেমে পড়লেন।কিন্তু,এখনকার দিনে ছেলের জন্য মেয়ে খোঁজা কি সহজ কথা! মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, অভিজ্ঞ চোখে সবটা দেখে অবশেষে ছেলের জন্য মেয়ে ঠিক করলেন।মেয়ের নাম মহুয়া।আজিমপুরে থাকে। একটা স্কুলে চাকরি করে।মেয়ের পরিবারব খুব ভালো,নম্র-ভদ্র।সবই ঠিক আছে,কিন্তু একটা জায়গায় একটু গোলমেলে।মহুয়া ডিভোর্সি।তার আগের সংসার ভেঙেছে এক বছর আগে,তারপর থেকে সে বাবার বাড়িই আছে।।

#(পর্ব-২)

ঘড়ির কাঁটায় এখন বিকাল পাঁচটা।তুষার বসে আছে আজিমপুরের একটি বিলাসবহুল রেস্টুরেন্টে।ঢাকা শহরের অলিতে-গলিতে এখন রেস্টুরেন্ট। একদম ব্যাঙের ছাতার মতো।তুষার চোখ ঘুরিয়ে একবার পুরোটা দেখলো।বেশ সুন্দর করেই সাজিয়েছে পুরোটা।সবখানে আধুনিকতার ছোঁয়া।তুষার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে একবার ঘড়ির দিকে তাকালো।অনেক কাজ-কর্ম ফেলে সে এখানে এসেছে।এখানে আসার উদ্দেশ্য মহুয়ার সাথে দেখা করা।মহুয়ার সাথে বোধহয় বিয়েটা এবার হয়েই যাবে।
তুষারের খালা, রুবিনা বেগম মহুয়ার খোঁজ পেয়েছেন তুষারের বন্ধু শফিকের মাধ্যমে। শফিক বন্ধু মহলে ঘটক হিসেবে পরিচিত।কতো বন্ধুর বিয়ে যে ও ঠিক করেছে তা হাতে গোনা মুশকিল।প্রায় সপ্তাহ খানেক আগের এক শুক্রবারে, সারাদিনের কাজ শেষ করে,মৃত্তিকাকে ঘুমে রেখে, তুষার বেরিয়েছিল বন্ধুর সাথে দেখা করতে।একসময় প্রায়ই দেখা সাক্ষাৎ হতো শফিকের সাথে।কিন্তু, এখন আর হয় না।যে যার জীবন, ঘর-সংসার, ছেলে-মেয়ে নিয়ে ব্যস্ত।তাই সচরাচর এখন আর দেখা করা হয় না।ব্যস্ত জীবনকে পাশে রেখে তুষার আজিমপুরে গিয়েছিল শফিকের সাথে দেখা করতে।শফিক আজিমপুরের বাসিন্দা।এখানেই একটা স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক।বহুদিন পর প্রাণের বন্ধুকে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরে শফিক।তুষারটা কেমন শুকিয়ে গেছে! চোয়াল ভেঙে চেহারাটা একটুখানি হয়ে গেছে।চোখের নিচেও বোধহয় এক আঙুল কালি পরেছে।শফিকের ভিতরটা হু হু করে উঠে, বন্ধুর এই দশা দেখে।তুষারকে দেখে কে বলবে একসময় সে বন্ধু মহলের সবচেয়ে সুন্দর যুবক ছিল!ভার্সিটির বহু মেয়ের ঘুম হারাম করেছে নিজের সৌন্দর্য দিয়ে!মনে মনে মহিমার উপর আকাশসম রাগ জমে শফিকের।ওর মতো ছলনাময়ী আর কোনো পুরুষের ভাগ্যে না থাকুক।
—” কিরে, শফিক ছাড় আমাকে।এতোক্ষণ কে মানুষকে জড়িয়ে ধরে রাখে?”
তুষারের কথায় ভাবনার সুতো ছিঁড়ে যায়।সে আরো একবার জোরে জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দেয় তুষারকে।তুষারের পিঠের হাড়গোড় বোধহয় ভেঙেই গেছে।সে শফিকের পেটে একটা ঘুসি মেরে বলেঃ” শালা, গন্ডারের স্বাস্থ্য বানাইছিস।আমার পিঠটা ভেঙেই গেছে।”
শফিক মুচকি হেসে বলেঃ”তোরে আপাদমস্তক ভাঙার জন্য গন্ডারের স্বাস্থ্য লাগে না।যেই অবস্থা করেছিস নিজের! একটা কঙ্কালের চাইতেও খারাপ দেখা যায়।নিজের যত্ন-টত্ন নিস না নাকি?”
—” আরে ধুর,নিজের দিকে তাকানোর সময় আছে এখন?দোকানের কাজ,মৃত্তির খেয়াল সবকিছুর দেখাশোনার বাইরে সময় কই আর।”
—” শোন এইসব আমারে বুঝাইস না,বুঝছোছ? ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়।তুই তো মনে হয় বউয়ের শোকেই দেবদাস হওয়ার পায়তারা করছিস।মানে,এটা কোনো কথা ভাই?একটা প্রতারকের জন্য কে নিজের এই হাল করে! শালা,তুই পুরুষ জাতির কলঙ্ক।তোকে এই মুহূর্তে আমাদের জাতি থেকে বহিষ্কার করা উচিৎ। ”
শফিকের কণ্ঠে ক্ষোভ ঝরে পড়ে।তাই কথা ঘুরিয়ে ফেলে তুষার।ব্যস্ত শহরের ব্যস্ত রাতে ল্যাম্পপোস্টের হলদে-সাদা আলোয় বহু কথা হয় দুজনের মাঝে।কখনো বাড়ির কথা,কখনো পুরোনো বন্ধুদের কথা আবার কখনো দেশের কথা।কথার এক ফাঁকেই শফিক তুষারকে প্রশ্ন করেঃ” বিয়ে-সাদি করবি না আর?মৃত্তির কিন্তু এখন একটা মায়ের দরকার।”
—” কেন? আমি কি কম নাকি? তাছাড়া, খালামনি ওর খুব খেয়াল রাখে।ওর কোনো কষ্টই হয় না।”
—” তুই আর কতটুকু খেয়াল রাখিস?তাছাড়া, দাদির আদর দাদির মতো আর মায়ের আদর মায়ের মতো।দুটো কি এক নাকি?”
—” আমার দ্বিতীয় স্ত্রীই কি ওর মা হয়ে উঠবে?যাকে নিজের মায়ই ফেলে গেছে,তাকে আর কে আপন করে নিবে?”
—” এইসব নিম্ন শ্রেণির কথা- বার্তা বন্ধ কর।সব সৎমা খারাপ হয় না। এমনও তো হতে পারে মৃত্তির দ্বিতীয় মা তাকে সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখবে।”
—” কি জানি।কিন্তু,এবার বোধহয় বিয়ে একটা করতেই হবে।খালা-খালু হজ্বে যাবে এবার।আমি একা মিত্তিকে দেখে রাখতে পারব না।”
খুবই খুশি হয় শফিক।উৎফুল্ল স্বরে জিজ্ঞাসা করেঃ” মেয়ে কি দেখেছিস নাকি?আমার কাছে খুব ভালো একটা মেয়ের খবর আছে।”
—” না,মেয়ে এখনো দেখা হয়নি।খালামনি দেখেছি খুঁজছে।”
—” তাহলে,খালামনির নাম্বার দে।আমি তার সাথে কথা বলি।”
তুষার নাম্বার দিতে দিতে বলেঃ”মেয়ে যাতে ডিভোর্সি হয়।অবিবাহিত মেয়েদের আমি বিয়ে করব না।”
খুবই অবাক হয় শফিক।অবাক কন্ঠে বলেঃ” একটা ষাট বছর বয়সী বুড়োও দ্বিতীয় বিয়ে করার সময় অবিবাহিত মেয়ে খুঁজে। তুই এমন দল ছাড়া,গোত্র ছাড়া হতে যাবি কেন?”
—” আমার বউ নয়,মেয়ের মা দরকার।দুটো ভাঙা জিনিস একসাথে জোড়া লাগতে পারে।কিন্তু একটা ভাঙা জিনিস আর একটা ভালো জিনিস কখনোই একসাথে জোড়া লাগতে পারে না।বুঝেছিস?”
—” উঁহু, কিছুই বুঝলাম না।আচ্ছা,বাদ দে।এখন মেয়ের কথা শোন।মেয়ের নাম মহুয়া।সে আমার সহকর্মী।আমাদের স্কুলের আইসিটির জনপ্রিয় শিক্ষক।ভাইরে ভাই,কি যে মেধাবী! আমাদের স্কুলের কলেজ সেকশন হচ্ছে।ওইটা হলে,এই মেয়ে নিশ্চিত কলেজের লেকচারার হতে পারবে এক চুটকিতে।”
—” এতো কিছু বাদ দে।তুই বল,সে ডিভোর্সি নাকি?”
—” হুম।এক বছর হয়েছে ডিভোর্স হয়েছে।আমি বুঝি না কোন শালা এই নম্র-ভদ্র মেয়েটারে ছারছে।ওই শালা নিশ্চিত একটা বলদ।”
তুষার বুঝলো শফিক মহুয়ার বিশাল ভক্ত।তাই সে কিছু বলল না।
—” বুঝলি তুষার,মেয়েটা এতো ভালো।আমার এতো ভালো লাগে।তোর ভাবি যদি না থাকতো, তবে আমিই ওকে বিয়ে করার চেষ্টা করতাম।”
তুষার মুচকি হেসে শফিকের পিছনে লাথি দেয়।মুখে বলেঃ” এই কারণেই ভাবি তোকে দু-বেলা জুতোপেটা করে।তোর মতো মানুষের জন্য এটাই ঠিক আছে।কত্ত বড় বদমায়েশ হলে,মানুষ ঘরে বউ রেখে বাইরের মেয়েদের দিকে তাকায়!”
বিয়ের জন্য তুষারকে আর কিছুই করতে হয়নি।রুবিনা বেগম ও শফিক মিলেই সবকিছুর ব্যবস্থা করেছে।রুবিনা বেগম প্রথমে গাইগুই করেছিলেন,মহুয়া ডিভোর্সি বলে।কিন্তু,পরে যখন জানলেন তুষার ডিভোর্সি ছাড়া বিয়ে করবে না ; তখন আর কিছুই বলেননি।ছেলের জীবন,সিদ্ধান্তও সেই নেক।রুবিনা বেগম বাড়ি যেয়ে দেখে এসেছেন মহুয়াকে।পছন্দ হয়েছে তার।তুষারকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।কিন্তু,তুষার যায়নি।বাড়ি বয়ে মেয়ে দেখতে তুষারের ভালো লাগে না।তবে,তুষার শফিকের সাথে একদিন গিয়েছিল স্কুলে। সেখানে, একবারের জন্য চোখে পড়েছে মহুয়াকে।দেখতে খারাপ না।আর পাঁচটা সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতোই।দুই বাড়ির কারোরই আপত্তি নেই বিয়েতে।তুষারেরও আপত্তি নেই।তাই বিয়ের আগে একবার মহুয়ার সাথে দেখা করতে চেয়েছে তুষার।মহুয়ার সাথে কিছু কথা খোলামেলা আলোচনা করতে চায় সে।মহুয়াও সায় দিয়েছে।তাই আজ বিকাল পাঁচটায় আজিমপুরের বিলাসবহুল এই রেস্টুরেন্টে বসে আছে তুষার।পাঁচটা বেজে গেছে অনেক আগেই।তুষার বিরক্ত নিয়ে বসে আছে।আশ্চর্য!এই মেয়ের কি কোনো সময়জ্ঞান নেই?সে কি জানে, তুষার কতো কাজ-কর্ম ফেলে এখানে এসেছে?সামনাসামনি দেখা হওয়ার আগেই, মহুয়ার প্রতি বিতৃষ্ণায় ভরে গেল তুষারের মন।

***

ঘড়ির কাঁটা যখন সাড়ে পাঁচটার ঘরে এসেছে, তখন রেস্টুরেন্টে টুকটুক করে ঢুকলো মহুয়া।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরটায় চোখ বুলালো।কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখে ফেললো তুষারকে।তুষারকে সে চিনে।ছবি দেখেছে এর আগে।মহুয়া ধীরপায়ে তুষারের দিকে এগিয়ে গেল।এককোনে একটা টেবিলে বসে আছে।কপাল কুঁচকে ফোন টিপছে।মহুয়া টেবিলের সামনে পৌঁছে গলায় কাশি তুলে বললঃ” আসসালামু আলাইকুম, আপনিই কি তুষার সাহেব?”
মহুয়াকে দেখে উঠে দাঁড়ালো তুষার।মুখে বললঃ” জ্বি।বসুন,প্লিজ।”
মুচকি হেসে বসলো মহুয়া।তুষার বসতে বসতে বললোঃ” আমি ভেবেছিলাম, আপনি আসবেন না।আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেই চলে যেতাম আমি।”
—” আমি অনেক আগেই আসতাম।কিন্তু,বাসায় একটু ঝামেলা হওয়ায় দেরি হয়ে গেছে।আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ”
—” ঠিক আছে,সমস্যা নেই।নিন অর্ডার করুন।”
মেনু কার্ড এগিয়ে দিলেও খুব বেশি একটা অর্ডার করলো না মহুয়া।কেবল এককাপ কফির ফরমায়েশ দিলো।তুষারও এক কাপ কফির বেশি আর কিছু অর্ডার দিলো না।এখানে তারা আজ খেতে আসেনি।খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছে।
তুষার ভিতরে ভিতরে কথা সাজিয়ে বললঃ”আপনি বোধহয় আমার সম্পর্কে সবকিছুই জানেন।তবুও আমি নিজের মুখেই বলছি।আমি তুষার আহমেদ।গুলিস্তানের সুন্দরবন মার্কেটে একটা ও পাতাল মার্কেটে একটা দোকান আছে আমার।দুটোই মোবাইলের। আমার একটা একবছর বয়সী মেয়ে আছে।মৃত্তিকা তার নাম।আপনি বোধহয় দেখেছেন ওকে।”
—” জ্বি, দেখেছি।সেদিন আপনার খালামনির সাথে সে এসেছিল আমাদের বাসায়।আপনার মেয়েটা খুব ফুটফুটে।”
—” হুম।ওর জন্যই এখন আবার বিয়ে করতে হচ্ছে আমাকে।আমি আমার প্রথম স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতাম।”
—” স্বাভাবিক।আপনার স্ত্রী কেন পালিয়ে গিয়েছিলো? ”
খুবই বিশ্রি একটা প্রশ্ন।তুষার বিরসমুখে বললঃ”সে নতুনত্বের খোঁজ পেয়েছিলো।ব্যক্তিগতভাবে, আমাদের দুজনের মাঝে কোনো সমস্যা ছিলো না।তবে,আমি সেই কয়েকটা মাস মহিমাকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারিনি।”
—” কেন?”
—” মৃত্তি হওয়ার কয়েক সপ্তাহ পরেই আমার মা মারা গিয়েছিলো।দোকানগুলোর অবস্থাও তখন ভালো ছিল না।মৃত্তি হওয়ার কারণে মহিমার পিছনেও অনেক টাকা খরচ হয়েছিল।হাতে তখন বেশ টানাটানি।এসব নিয়েই মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত ছিলাম আমি।তাই খুব একটা সময় দিতে পারিনি ওকে।”
—” আচ্ছা,আপনি কি পরে খবর পেয়েছিলেন কার সাথে মহিমা পালিয়ে গিয়েছিল?”
—” হুম। আমাদের এলাকায় বিদ্যুৎ বিলের কাগজ বিলি করতো একটা লোক।তার সাথেই। ”
—“ওহ,আচ্ছা।”
কফি এসে পড়েছে।দুজনেই উদাস মুখে একটা চুমুক দিলো কফি কাপে।তুষার এক চুমুক কফি খেয়ে বললঃ”আমি আসলে এখন মেয়েটার জন্যই বিয়ে করছি।আমার এখন বউয়ের দরকার নেই।আমার মেয়েটার একটা মা দরকার।আপনি কি আমার মেয়ের মা হবেন, প্লিজ?”
নিঃসংকোচ আবেদন।মহুয়া মুচকি হেসে বললঃ ” আপনার কথাগুলো বেশ স্বার্থপরের মতো শুনাচ্ছে।মিত্তির জন্য বিয়ে করছেন,কিন্তু আমি যদি ওর মা না হয়ে উঠতে পারি?”
—” দেখুন ভবিষ্যতকে কল্পনা করা যায়।আমি কেন ভবিষ্যৎ সম্পর্কে খারাপ কল্পনা করব? আমি আশা করেই নিচ্ছি আপনি আমার মেয়ের খুব ভালো মা হবেন।”
—” আরেকটা প্রশ্ন,আপনার যেই বয়স; এই বয়সে একটা অবিবাহিত মেয়েকেই বিয়ে করতে পারেন।মানে,এই বয়সে আমাদের দেশের অনেক ছেলেই প্রথম বিয়ে করে।তো আপনি কেন আমার মতো একটা ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করছেন?”
—” আমি তিন বছর সংসার করেছি মহিমার সাথে।সংসারের অলিগলি সব আমার চেনা।আমাদের দেশের মেয়েরা সংসার চিনে কোন বয়স থেকে, জানেন?যখন তারা পুতুল খেলে তখন থেকে।তখন থেকেই তারা স্বামী- সংসারের স্বপ্ন দেখে।দেখেন না, আমাদের মেয়েরা ছোটবয়সে কিন্তু বল খেলে না।তারা দুটো পুতুলের বিয়ে দিয়ে সংসার সংসার খেলে।আমি যদি একটা অবিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করি, তবে সে প্রথমেই আমার বউ হতে চাইবে।আমার বাচ্চার মা না।তাই, আমি একজন ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছি।”
মহুয়া বুঝলো লোকটা বেশ বাস্তববাদী।তাই কফি শেষ করে বললঃ” আপনার মনে প্রশ্ন জাগে না, আমার কেন ডিভোর্স হয়েছে? এমনও তো হতে পারে, আমার দোষেই আমার আগের সংসার ভেঙেছে। ”
—” আপনি যদি নতুনত্বের খোঁজে সংসার ছাড়তেন তবে নিশ্চয়ই এতোদিন বিয়ে না করে থাকতেন না।দু কারণে আমাদের সংসার ভাঙে।নতুনত্বের খোঁজ পেলে অথবা অত্যাচারের কারণে। তাছাড়া,আমি খালামনির কাছে শুনেছি, তৃতীয় ব্যক্তির জন্যই আপনার সংসার ভেঙেছে। ”
—” তৃতীয় ব্যক্তির জন্য কখোনো আমাদের বন্ধন ছিন্ন হয় না।বন্ধন ছিন্ন হয়, আমাদের নিজেদের মানুষদের জন্যই।আপনি কি শুনবেন আমার এলোমেলো সংসারের পুরোপুরি ভেঙে যাওয়ার গল্প?”
খুব অসহায় দেখালো মহুয়ার চোখ।সহসা না করতে পারলো না তুষার।সবারই কিছু না কিছু গল্প থাকে
আজ নাহয় শোনাই যাক মহুয়ার পুরোনো সেইসব কথা।এক পুরোনো সংসারের কিছু ঘটনার নগ্ন উত্থান।

# (পর্ব-৩)

দুবছর আগের এক শীতের সকাল।ঘরের দরজা- জানালা বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে মহুয়া।একেবারে কম্বল মুড়ি দিয়ে, কোলবালিশ জড়িয়ে, বিছানার মাঝে গুটিশুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে।এখন বোধহয় সকাল নয়টা বাজে।এতোবেলা পর্যন্ত মহুয়ার এই সুখনিদ্রা পছন্দ হচ্ছে না মহুয়ার মা,সাবিনা বেগমের।তিনি তিনবার মহুয়ার বন্ধ দরজায় জোরে জোরে আঘাত করেছেন,গলা উঁচিয়ে বকাবকি করেছেন, নিজের মোবাইল দিয়ে মহুয়ার মোবাইলে কল করেছেন।তবুও, মহুয়ার ঘুম ভাঙার কোনো নাম – গন্ধ নেই।আশ্চর্য! মেয়ে কি মরে-টরে গেল নাকি?সাবিনা বেগমের এইসব কাজে চরম বিরক্ত মহুয়ার বাবা,আফজাল হোসেন।একটা মাত্র আদরের মেয়ে তার।সারা সপ্তাহ মেয়েটা বাইরে কাজ করে। অন্যান্য দিনতো সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠতে হয়।সপ্তাহে একটা দিনই একটু ঘুমানোর ফুরসত পায়।ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক।তিনি চেয়ারে বসে বিরক্ত চোখে সাবিনার দিকে চেয়ে আছেন।এই মূর্খ মহিলার কাজ- কর্মের কোনো দিকপাল নেই।সাবিনা বেগম আরো একবার মহুয়ার দরজায় আঘাত করলেন।গলা উঁচিয়ে বাংলা ভাষায় কয়েকবার গালাগালিও করলেন।তবুও যখন দেখলেন মেয়ের উঠার কোনো লক্ষণ নেই,তখন রেগেমেগে তেড়ে আসলেন মহুয়ার বাবা আফজাল সাহেবের দিকে।
—” আপনার জন্য,শুধুমাত্র আপনার জন্য আজকে আমার মেয়ের এই অবস্থা।মেয়েরে লাই দিয়ে দিয়ে এক্কেবারে মাথায় তুইলা ফেলসেন।আমি ওরে ছোটবেলা থেকে একা মানুষ করি নাই?কই তখন তো ওর এতো সাহস ছিল না।মেয়ের কত্ত পাখা গজাইছে,আমার কথা কানে নেয় না!আজকে শুধু উঠুক, ওরে যে কি করব আমি।আপনি যদি শুধু মেয়েরে সাপোর্ট করছেন,খবর আছে আপনার।”
—” সাবিনা,একটু আস্তে কথা বলো।আজকে শুক্রবার,সব বাসায় মানুষ এখনো ঘুমায়।মেয়েটা তো একটু শুক্রবারেই ঘুমায়।অন্যান্য দিন সেই সকালে উঠে রাত বারোটায় ঘুমাতে যায়।সেগুলো কি তোমার চোখে পড়ে না?আমার মেয়ের মতো কোন মেয়েটা সারাদিন এতো কাজ করে?তুমি ওর মা,কোথায় একটু মায়ের মতো আচরণ করবা,ভালোবাসবা তা না।মেয়েটা বাড়িতে থাকলেই খিটমিট শুরু করো।একদম সৎমাদের মতো।”
সাবিনা বেগম রাগে দিশেহারা হয়ে গেলেন।স্বামীর দিকে আবারো তেড়ে এসে বললেনঃ” হ্যাঁ, আমি সৎমাই।ওরে কি আমি পেটে ধরসি নাকি? আমার তো মেয়ের প্রতি আদর নাই।মেয়েটা উঠবে এগোরাটায়,সকালের নাস্তা খাবে বারোটায়,এরপর দুপুরের খাবারই আর খাবে না।এটাই আদর,তাই না?থাকেন আপনারা বাপ-মেয়ে।কিছু বলব না আর।আমি তো আপনাদের শত্রু।মেয়েরে সবকিছুতে লাই দিতে হবে।এই স্বভাব নিয়ে যদি পরের বাড়িতে যায় না,এক দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকিয়ে আরেক দরজা দিয়ে বের করে দিবে।আমি তো…….” আফজাল সাহেব আর কানে নিলেন না সাবিনা বেগমের কথা।চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।এই মহিলার কথা শোনা মানেই স্বেচ্ছায় কানের উপর অত্যাচার করা।সব কিছুতে এতো বাড়াবাড়ি ভালো না।তাছাড়া,মেয়েরা তো একটু বাবার বাড়িতেই আরাম করবে তাই না?শ্বশুর বাড়িতে কি আর আরাম করতে পারবে?মেয়েটা একটু চলুক না নিজের মতো।কি সমস্যা হয় এতে?
আফজাল সাহেব ধীরপায়ে যেয়ে মেয়ের দরজার সামনে দাঁড়ালেন।যতটা ধীরে ধীরে মেয়ের দরজার সামনে গিয়েছিলেন, তার চাইতেও ধীরে দরজায় আঘাত করলেন।নরম গলায় ডাক দিলেন মেয়েকে।
—” মহু মা, মা।উঠো মা।নাস্তা করবা না? উঠো।মহুয়া,মহুয়া।”
খট করে খুলে গেল মহুয়ার দরজা।সকাল সকাল বাবাকে দেখে মনটাই ভালো হয়ে গেল মহুয়ার।এতোক্ষণ সে জেগেই ছিল।সাবিনা বেগম যেইহারে চিল্লাচিল্লি করেছেন,এতে কারো সাধ্য নেই ঘুমানোর।আফজাল সাহেব মেয়ের ঘরে ঢুকে বিছানায় আয়েস করে বসলেন।দূর্বল হাঁড়ের পাগুলোকে ঢুকিয়ে দিলেন মেয়ের নরম উষ্ণ কম্বলে।এতোক্ষন চেয়ারে পা ঝুলিয়ে বসে থাকার কারণে পায়ে ব্যাথা হয়ে গেছে।মহুয়া এসে আবারো বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।আফজাল সাহেব মৃদু হেসে বিলি কেটে দিলেন মেয়ের মাথায়।
—” মা এমন করে কেন বাবা?”
—” তোকে বেশি ভালোবাসে তাই।”
—” এটা কেমন ভালোবাসা?ভালোবাসায় শান্তি থাকতে হয়।শান্তি না থাকলে কি আর তাকে আর ভালোবাসা বলে?”
—“হুম, অবশ্যই বলে।তোর কাছে যেটা অশান্তি,তোর মায়ের কাছে তা সচেতনতা।তুই যে ছুটির দিনে দুপুরে ভাত খাস না, এটা তোর মাকে বড্ড পোড়ায়।বুঝলি? সে তোর স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন।ভালোবাসার প্রকাশভঙ্গি ভিন্ন।”
—” এক বেলা না খেলে কি এমন হয়? মানুষ কি মরে যায়?একটা জিনিসকে কেন্দ্র মা সেই সকাল থেকে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেয়।হাহ।”
—” শোন তোর মা একটু এমনই।সে সবকিছু নিয়ে বেশি বেশি ভাবে বুঝলি।তোকে একটা ঘটনা বলি।তোর ছোটবেলায় একবার খুব জ্বর হয়েছিল।একদম গা কাঁপানো জ্বর।তুই বোধহয় তখন তিন- চার বছরের বাচ্চা মেয়ে।আমি দেশে নেই।তোর মায়ের চিন্তা তখন দেখে কে!তখন তো আর এতো সহজে যোগাযোগ করা যেত না।তোর মা নাকি তোকে নিয়ে তখন খুব দৌড়াদৌড়ি করেছে।একা মানুষ হয়েও এই ডাক্তার থেকে ঐ ডাক্তারের কাছে দৌড়ে গেছে।যে যা বলেছে তাই করেছে।কখনো ঔষধ, কখনো ভেষজ লতা- পাতা খাইয়েছে তোকে।অথচ,তোর জ্বর ছিল মাত্র তিনদিন।তাও আবার সাংঘাতিক কিছু না।সিজোনাল জ্বর।তোর মা সবসময়ই একটু পাগলাটে।বুঝলি?”
—” বুঝলাম।এখন তুমি যে এখানে বসে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমাকে ঘুম পাড়াচ্ছ,মা দেখলে কি করবে বল তো?”
—” আমাদের গর্দান নেবে।যা যা তাড়াতাড়ি উঠ।তুই নিজেও তোর মায়ের সাথে বেশি করিস। কি হয় একটু তাড়াতাড়ি উঠলে?”
মহুয়া উঠে বসেছিলো। বাবার কথা শুনে অসহায় চোখে তাকিয়ে বললঃ” বাবা,একটা দিনই তো মাত্র।নিজের মায়ই যদি এই সুযোগ না দেয়,তবে কে দিবে আর?”
আফজাল সাহেব মৃদু হেসে উঠতে উঠতে বললেনঃ”আমার মাকে সবাই ভালোবাসবে,সুযোগ দেবে।আমার মহুয়া মায়ের জন্য আমি একটা নদের চাঁদ খুঁজে আনব।পড়েছিস না মহুয়ার পালা?নদের চাঁদকে তো চিনিস।কি ভালোই না বাসতো মহুয়াকে।নিজের জীবনটা পর্যন্ত দিয়ে দিল।”
মহুয়া বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে গলা বাড়িয়ে বললঃ” নদের চাঁদরা যুগে যুগে আসে না বাবা।তারা শুধুমাত্র একবারই আসে।আর তাছাড়া, বাস্তবে কি আর নদের চাঁদ হয় নাকি?এরা সাহিত্যেই হয়।”
আলফাজ সাহেব কিছু বললেন না আর।তিনি নিজেও জানেন নদের চাঁদরা বাস্তবে হয় না।এরা সাহিত্যেই সুন্দর।তবুও বাবা-মায়ের মন।সব বাবা-মায়ই চায় ছেলে-মেয়ের জন্য রাজকন্যা বা রাজপুত্র ।তেমনি,আফজাল সাহেবও ব্যতিক্রম নয়।তিনিও মেয়ের জন্য একটা রাজপুত্রই চান।যে তার মেয়েকে তার মতোই আগলে রাখবে।মেয়েটা যে তার বড় আদরের।

মহুয়া আফজাল সাহেব ও সাবিনা বেগমের একমাত্র মেয়ে।আঁধার ঘরের একমাত্র বাতি।আফজাল সাহেবের জীবনভর মালয়েশিয়া ছিলেন।সেই যে বিয়ের একমাস পর গিয়েছিলেন সেখানে,এসেছিলেন পুরো সাত বছর পর।দেশে আসার সুযোগ ছিল না এমন নয়।অনেকবার সুযোগ পেয়েছিলেন।কিন্তু,আসেননি।মালয়েশিয়ায় একটা গ্লাস কোম্পানিতে চাকরি করতেন।বিদেশিরা সেখানে চাকরি করতো বটে,কিন্তু সুযোগ খুব কম ছিল।সারামাসে গাধার মতো খেটে নামমাত্র বেতন পেতেন।এছাড়া,অস্থায়ী চাকরি।দেশে আসলে চাকরি থাকবে কিনা তারও নিশ্চয়তা নেই।তাই, দেশে আসেননি আফজাল সাহেব।সাতবছর পর দেশে এসেছিলেন মাত্র তিনমাসের জন্য।এরপর আবার পাড়ি জমিয়েছিলেন বিদেশে।মহুয়ার জন্মের সময় দেশে ছিলেন না তিনি।যোগাযোগ ব্যবস্থা এতোটা উন্নত ছিল না।তাই, মহুয়ার মুখ দেখা ছিল দুঃসাধ্য ব্যাপার। সাবিনা বেগম কয়েকমাস পর পর একটা চিঠির ভাঁজে মহুয়ার একটা ছবি পাঠাতেন।সস্তা স্টুডিওতে তোলা ছবি।তাই দু-চোখ ভরে দেখতেন আফজাল সাহেব।কখনো মুখে হাসি নিয়ে দেখতেন আবার কখনো চোখে জল নিয়ে দেখতেন।কলিজার টুকরাকে দু-হাতে ধরতে না পারার ব্যর্থতা তাকে কুড়ে কুড়ে মারতো। মহুয়ার বয়স যখন পনেরো বছর,তখন দেশে এসেছেন আফজাল সাহেব।দেশে এসে রোগে পড়লেন।দীর্ঘ প্রবাস জীবনে যেই টাকা জমিয়েছিলেন,তার অর্ধেকটাই খরচ হয়ে গেল নিজের পিছনে।বাকি অর্ধেক ভাইয়ের চালের ব্যবসায়ে খাটালেন।মাস শেষে একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা আসে ঘরে।এই তার আয়।আফজাল সাহেব তার মেয়েকে সবকিছুতেই সমর্থন করেন।সাবিনা বেগমের ভাষায় তিনি লাই দিয়ে মাথায় তুলছেন মেয়েকে।আফজাল সাহেব কানে নেন না তার কথা।পনেরো বছর তিনি মেয়ের থেকে দূরে ছিলেন।তাই তার আচরণ ভিন্ন হবেই।তিনি মেয়েকে বেশি বেশি ভালোবাসবেন এটাই স্বাভাবিক। সাবিনাটা কেন যে বুঝে না!!

বিকাল বেলা একটু বাইরে বের হলো মহুয়া।সারা সপ্তাহে কাজে ক?