Sunday, December 14, 2025
Home Blog Page 2039

পিশাচ_দেবী ২য় পর্ব + ৩য় পর্ব

পিশাচ_দেবী
২য় পর্ব + ৩য় পর্ব
.
গতদিন সন্ধ্যার পর আকলার ঘরে না ফেরাটা অনেকের নজরে পড়েছিল। সকালে তাই গোষ্ঠীর একজন-দুজন করে মানুষ তার সঙ্গে দেখা করতে এলো। আকলা তাদের সবাইকে সেই ভয়ঙ্কর রাতের বর্ণনা শুনালো। ডাকাত , গুহা , দেবী হারমা। সকলে বিস্মিত হয়ে তার কথা শুনলো। প্রমাণ স্বরূপ আকলা তার ছেড়া , জরাজীর্ণ সেই পোশাকটা দেখালো। সেখানে এখনো বীর্যের দাগ লেগে রয়েছে।

কথাটা পুরো গোষ্ঠীতে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগলো না। তারা পিশাচ দেবী হারমা সম্পর্কে এমন অনেক কথা শুনেছিল। তবে সবই পুরোনো কাহিনী হিসাবে। এখনো বনে এখনো দেবী রয়েছেন জেনে সবাই কৌতূহলী আর উদ্বিগ্ন। ঘন্টা দুয়েক পরেই গোষ্ঠী প্রধান আকলার ঘরের সামনে হাজির হলেন। বৃদ্ধের বয়স ৭০ এর ওপরে। আকলা তার দোরগোড়ায় গোষ্ঠী প্রধান মানজা বু কে দেখে অবাক হলো। কোনো প্রয়োজনে গোষ্ঠী প্রধান মানুষদের ডেকে আনেন। নিজে আসেন না।

মানজা বু চকিতে বসতেই আকলা হাটু গেড়ে মেঝেতে বসলো। মানজা বু কিছুক্ষণ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই বয়সেও তার চোখের নজর তীক্ষ্ণ। পড়তে চেষ্টা করছে মেয়েটার মন।

আকলা , প্রিয় মা। তুমি কী জানো তুমি কী করছো ?

আকলা এমনিতেই ভয় পেয়ে আছে আরো চুপসে গেল। বৃদ্ধ :

এটা কি ঠিক হচ্ছে তুমি পুরো গোষ্ঠীতে একজন পিশাচ শয়তানের মহত্ত্ব প্রচার করে বেড়াচ্ছ? তুমি কী জানো না আমাদের গোষ্ঠীতে এই পিশাচের নাম নেয়াও মহাপাপ। পিশাচ সাধনার কারণে আমরা আমাদের কত পূর্ব-পুরুষ , আত্মীয় , ভাই হারিয়েছি ? কত রক্তপাত ঘটেছে। সেই সব কাহিনী কী সব মিথ্যা মনে করো তুমি?

কিন্তু বু , আমি বানিয়ে কিছুই বলছি না। যা আমার সাথে ঘটেছে তাই বলছি। সত্যিটা!

মায়ার জগতে সত্য , মিথ্যা বলে কিছু নেই , মা আকলা। এর সবটাই মিথ্যা। এই পিশাচের ভয়ঙ্কর মায়া সম্পর্কে কিইবা জানো তুমি ? আমি আমার বাবা , ভাই, দুই সন্তানকে হারিয়েছি এই পিশাচের কারণে। তুমি যে বললে ডাকাতের কথা , তাদের অত্যাচারের কথা। কিন্তু তোমার গায়ে কী কোনো দাগ আছে ?

আমি বলেছি বু , ওই কুয়োর পানি দিয়ে গোসল করার পর সব কষ্টের সাথে দাগগুলোও মুছে গেছে।

বোকা বানানো হয়েছে তোমাকে। ফাঁদে ফেলা হয়েছে। মায়ার ফাঁদ! তুমি ভাবছো তুমি ডাকাত দলটাকে বোকা বানিয়ে মায়ার জগতে আটকে দিয়েছ পিশাচটার সাহায্যে। কিন্তু হতেও তো পারে এই ডাকাতের দলটাও মায়ার একটা অংশ। তাদের বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই। তুমিই মায়ায় আটকে গেছ। তোমার যা মনে হচ্ছে রাতে ঘটেছে , তার কিছুই ঘটেনি।

কিন্তু এই ছেড়া কাপড়, লেগে থাকা দাগ! একই রকম নতুন কাপড় পিঁড়ি থেকে আমিই পরেছি। এই দেখুন এখনো আমার পরনে!

এই রকম কাপড় এই গোষ্ঠীতে অন্তত পঞ্চাশ ঘরে পাওয়া যাবে। তুমি জঙ্গলে পেয়েছিলে এই গোষ্ঠীরই কারো ফেলে দেওয়া পুরোনো ছেড়া কাপড় , তুমি যেই কাপড় পরে জঙ্গলে ঢুকেছিলে আর এখন যে কাপড় পরে রয়েছে , দুটো একই। পোশাক পাল্টানোর প্রয়োজন হয়নি তোমার। মায়া তোমাকে ভুল বোঝাচ্ছে!

আকলার কিছুতেই বু এর কথা বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করে না। সে মাথা নিচু করে বসে থাকে। বু তার মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন। আর বলেন :

এইভাবেই প্রতিবার শুরু হয় তার আগমন। একজন সরল মানুষকে ফাঁদে ফেলে। সে তার কথা ছড়িয়ে দেয় গোষ্ঠীতে। এরপর শুরু হয় অনাচার, হত্যা , ধ্বংস। তোমাকে বুঝতে হবে আমার সাহায্য ছাড়া তুমি এতদিন এই বসতিতে থাকতে পারতে না। বাবার পরিচয় হীন একটা মেয়েকে বসতিতে রাখার নিয়ম নেই। তবুও আমি সদয় হয়েছি। কিন্তু পিশাচ শয়তানটাকে নিয়ে আর একটুও কথা হলে ধরে নেব তুমি এই বসতি ছেড়ে চলে যেতে চাইছ। এই নোংরা , কাপড়টা এখনই পুড়িয়ে ফেল , আমার হুকুম।

এই বলেই মানজা বু ধীরে ধীরে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। ঘরের মাঝখানেই একটা পাতিলে আগুনে পুড়ছে সেই কাপড়টা যা গত রাতের তার ওপর হওয়া অত্যাচারের আর দেবীর দয়ার একমাত্র প্রমান। সে যে পিতৃপরিচয়হীন এটা মনে করিয়ে দেওয়ায় তার মনটা খারাপ হয়ে এলো। সে পিতৃপরিচয়হীন না। আসল কথা হলো তার পিতার পরিচয় গোষ্ঠীর আর কেউ না জানলেও আকলা নিজে জানে। এই বুড়ো গোষ্ঠী প্রধানই তার পিতা। বুড়ো নিজেও জানে না আকলার মা মরার আগে কানে ফিসফিস করে তার বাবার নাম প্রসঙ্গে প্রধান মানজা বু এর নাম নিয়েছিলেন। ছোট বেলা থেকে যদিও সে বুঝতে পারতো লোকটা তার প্রতি একটা টান অনুভব করেন। কিন্তু মায়ের মৃত্যুর পর পিতার দাবি নিয়ে সে কখনো মানজা বু এর কাছে যায়নি । কী লাভ ? কী প্রমাণ আছে তার ? উল্টো গোষ্ঠী ছাড়া হবে সে।

গোষ্ঠী প্রধানের লাঠিয়াল লোক পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো। পিশাচ শয়তান হারমা এর নাম যে মুখে আনবে বা আলোচনা করবে ধরে নিয়ে গিয়ে তাদের চাবুক পেটা করা হবে। গোষ্ঠীর কেউ তাই প্রকাশ্যে এই ঘটনা নিয়ে আলোচনা করা বন্ধ করে দিল। কিন্তু তাদের মনের ভেতরের এই ঘটনার ছাপ মোছার ক্ষমতা কোনো গোষ্ঠী প্ৰধানের নেই।

এক প্রকার নজরবন্দি করেই রাখা হলো আকলাকে। সে টয়লেটে গেলেও যে তার ওপর কেউ নজর রাখছে তা বুঝতে পারে সে। ঘরের সামনেই মাটির চুলো। কাঠের জোগাড় করে দিয়েছেন বু এর লোক।

সারাদিন সেই রাতের জঙ্গলের কাহিনী স্মরণ করেছে আকলা। ভয়ংকর অনুভূতি গুলো এতই তাজা যে সে এখনও নিশ্চিত তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা কোনো মায়া না। দেবী হারমা সত্যিই তাকে রক্ষা করেছেন। আপন মনেই ভক্তি জাগলো দেবীর প্রতি। শ্রদ্ধার সাথে তার নাম জপতে জপতে শুয়ে পড়লো আকলা।

সে বুঝতে পারছে সে স্বপ্ন দেখছে। তবুও এত বাস্তব সবকিছু ! সে একটা মাটির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আকাশে পূর্ণচন্দ্র। জোৎস্নায় ফকফকে চারপাশ। এই জায়গায় সে আগে আসেনি। হঠাৎ একটা মিষ্টি কন্ঠের সুরেলা খিলখিল হাসির শব্দ শুনে চমকে উঠলো সে। প্রথমে মনে হলো শব্দটা মাটির ঘর থেকে আসছে। পরবর্তীতে বুঝতে পারলো উঠানের সামনে ঝোপের পেছন থেকে শব্দটা আসছে। সে ঝোপের ভেতর গলে সামনে বেরিয়ে গেল।

চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছে পুকুরের পানি। সেই পুকুরে অপরূপ রূপবতী একটা মেয়ে গোসল করছে। এত ফর্সা গায়ের রং , টানা চোখ , লম্বা চুলের মেয়ে আগে কখনো দেখেনি আকলা। পুরো দেবী!মেয়েটা তার চোখের দিকে তাকিয়ে পানিতে নামতে ইশারা করলো। আকলা পানিতে নামতেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তারা দুজন দুজনের দিকে।

হঠাৎ খেয়াল করলো আকলা, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অপরূপ মেয়েটা আসলে তারই প্রতিবিম্ব। হুবহু তার মুখায়ব। শুধু আরো সুন্দর। আকলার শ্যামা রং , দুধে আলতা মিশিয়ে যেন তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বিড়বিড় করে প্রতিবিম্ব বলল :

মাথা নোয়া দেবীর সামনে আশীর্বাদ পেতে।

কে দেবী !

আমাকে চিনতে পারছিস না! যে তোর লজ্জা লুকাল , তোর সতিত্ত্ব ফিরিয়ে দিল। তাকে ভুললে চলবে ?

আপনি দেবী হারমা ?

তোর কী মনে হয় ?

আপনি আমার মতো দেখতে!

আমিতো তোদের সবার মতই দেখতে। আমি যে তোদের মা। তোদের সবার ভেতরে আমার বাস।

সবাই যে বলে আপনিতো অভিশপ্ত ! আর ডাকলেও আসতে পারবেন না কারো সামনে!

তোরাই আমাকে পরিত্যাগ করেছিস! রক্ত, সম্পদ , ক্ষমতা উন্নতির পথ বন্ধ করে অভিশপ্ত পথ বেছে নিয়েছিস। খেত, খামার করে, ঔষধ বিক্রি করে কোনোমতে বেঁচে আছিস। তোরা কী তোদের পূর্ব পুরুষের উন্নতির , সাহসের , গর্বের গল্প শুনিসনি? আমার দয়া ছাড়া আর কে তোদের গোষ্ঠীকে সর্বোচ্চ উন্নতিতে পৌঁছে দিয়েছিল। কে না তোদের গোষ্ঠীর লোককে না চিনতো? তাদের দেখলেই মাথা নত করে পালাতো সবাই। আমি এমন কোন ইচ্ছা আছে যা পূরণ করিনা! তবুও কেন আমায় পরিত্যাগ করলো সবাই ?

আপনি আমার জীবন বাঁচিয়েছেন।

কতযুগ পর কেউ আমার নাম এমন বিশ্বাসের সাথে স্বরণ করলো! আমাকে মুক্ত করলো অভিশাপ থেকে। তাইতো তোকে আমার শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করলাম। তোর কাছে এলাম। তুইই এখন ফিরিয়ে আনতে পারবি তোর গোষ্ঠীর মর্যাদা আমাকে তোদের মাঝে প্রতিষ্ঠিত করে।

কিন্তু , ওরা সবাই যে বলে আপনি ডাইনি!

আমার ক্ষুধার কারণে বলে। কার ক্ষুধা নেই বল ? আমি তোদের সব দিব । তার বদলে তোরা আমার ক্ষুধা মিটাবি না! আমার পূজা করবি না! বিনিময় দিবি না?

বিনিময়!

তোর প্রাণ বাঁচালাম। তোর সব রক্ষা করলাম। তুই কী কৃতজ্ঞ না? তুই তার মূল্য দিবি না? আমার যে খুব ক্ষুধা!

আপনি কী চান?

যা তোরা অপচয় করিস। মাটিকে খাওয়াস। অথচ মাটির তা প্রয়োজন নেই! প্রয়োজন আমার।

কিন্তু দেবী….।

হঠাৎ করেই আকলা বুঝতে পারে তার নিয়ন্ত্রণ তার কাছে নেই। সে মাথা ঝুকিয়ে পানির নিচে বসে পড়েছে। ভাসা ভাসা ভাবে দেখা দেবীর পা দেখে স্পর্শ করল। দেবীর হাত তার মাথায় স্পর্শ করতেই ঘুম ভেঙে গেল তার ।

হতভম্ব হয়ে নিজের ভেজা কাপড়, শরীর আর ভেজা বিছানা হাতড়াতে থাকে । সে এমন ভাবে ভিজে আছে যে মনে হচ্ছে মাত্র পুকুর থেকে ডুব দিয়ে এসে বিছানায় শুয়েছে কাপড় না পাল্টে। অথচ পুরোটাইতো স্বপ্নে ঘটলো ! ……………………………
.
.
. . . . . চলবে . . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana
.

#পিশাচ_দেবী
.
৩য় পর্ব
.
এরপর প্রায় মাস পেরিয়ে গেল। আকলার জীবন আবার আগের মতো চলতে লাগলো। সেদিন স্বপ্নে দেবী হারমাকে দেখার পর থেকে এই পর্যন্ত আর তার কোনো অস্তিত্ব তিনি জানান দেননি আকলাকে। গোষ্ঠীর লোকেদের মাঝে যে ফিসফিসানি ছিল পিশাচ দেবী হারমাকে নিয়ে তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে।

আকলার মন থেকে অবশ্য তিনি গেলেন না। সে দিনের অনেক সময়ই দেবীর কথা ভাবে। এমনকি ঘুমানোর আগেও। এই দেবীর কারণে কী এমন ভয়ংকর কাণ্ড ঘটেছিল এই গোষ্ঠীতে, যে দেবীকে তারা বিতাড়িত করল! এমন কী তার নাম নেয়াও নিষিদ্ধ! কিছুই জানে না আকলা। এই সম্পর্কে ভালো বলতে পারবে গোষ্ঠীর বৃদ্ধরা। কিন্তু তারা বেশির ভাগই মানজা বু এর ঘনিষ্ঠ হওয়ায় এই বিষয়ে কথা বলবেন না।

দেবীকে সেদিন স্বপ্নে নিজের রূপে পুকুরে দেখার পর থেকে কেমন যেন ভয় করতে লাগলো আকলার দেবীকে। এক অজানা অনুভূতি শরীরটাকে কাঁপিয়ে তোলে দেবীর কথা মনে এতেই। দেবীকে সে ভুলে থাকতে চাইছিল। কিন্তু পারছিল না কিছুতেই।

অনেকদিন পর আজ রাতে সে ঘুমানোর আগে বিড়বিড় করে বলতে লাগলো , ” হারমা , হারমা , হারমা , হারমা…..”

স্বপ্নে আবার সেই মাটির ঘরের সামনের উঠানে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। সামনে ঝোপের কারণে কিছু না দেখা গেলেও আকলা জানে সেখানে একটা পুকুর আছে। তবে আজ সেদিনের মতো জোৎস্না নেই। ঘরের সামনে ঝুলে থাকা হারিকেনের আলোতে চারপাশে তাকালো একবার। নিস্তব্ধ অন্ধকার। এরপর ঘরের ভেতর থেকে অসুস্থ কণ্ঠের একটা গোঙানির শব্দ শুনলো সে। কিছুটা চমকে হারিকেন হাতে নিয়ে ধীরও পায়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই আলোতে , চকিতে শুয়ে থাকা অপরূপ সুন্দর মেয়েটাকে দেখতে পেল। কিছুক্ষণ কোনো কথা বলতে পারলো না আকলা। হারিকেনের আলো ফেলে অপলক ভাবে মেয়েটার মুখের দিকে চেয়ে রইলো। এত সুন্দর মুখ!

ধীরে ধীরে মুখায়বটা পরিচিত লাগতে লাগলো। তার মায়ের মুখ! শুধু মুখের রংটা আরো ফর্সা, চোখগুলো আরো বেশি সুন্দর , মুখ নিখুঁত। আর সবচেয়ে অপরিচিত , বেমানান লাগলো মুখে লেগে থাকা মিষ্টি হাসিটা। সে তার মাকে এত মিষ্টি করে হাসতে কখনই দেখেনি।

মা!

চিনতে পারিস?

আপনি দেবী ? বহুরূপী দেবী ! আমার মায়ের মতো দেখতে।

রূপতো আমার শরীরের অংশ বিশেষ রে। আমার রূপ ইতো তোদের সবার ভেতর রয়েছে। তোদের সবার রূপ আমার ভেতর।

আপনি বাস্তবে আমার সামনে আসেন না , কেন ?

তোরা ডাকলেই আমি আসবো। আমিতো তোদের জন্যই।

কিন্তু ওরা যে বাধা দেয় আপনার নাম মুখে নিতে। বু আর লোকেরা।

ওরা সঠিক পথ রেখে ভুল পথ বেছে নিয়েছে। সহজ পথ ছেড়ে জটিল পথ। সবাই আবার সঠিক পথে চলে আসবে। শুধু শুরু করতে হবে তোকে। তুইই আমাকে আবার তোদের গোষ্ঠীতে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবি। ফিরিয়ে আনতে পারবি হারানো গৌরব।

কিভাবে?

বিনিময়! এর মাধ্যমেই সব মঙ্গল হবে। উপকারের বিনিময়ে উপকার। আমার ক্ষুধা মেটাতে হবে তোদের। আমার যে খুব ক্ষুধা! তোদের গোরস্থানে আমার প্রবেশ নিষেধ। ওখানে আমি যেতে পারি না । গেলেই দুর্বল হয়ে যাই। তোরাই পারবি আমার ক্ষুধা মেটাতে।

এবার চোখ-মুখ শুকিয়ে আসে আকলার। এখানে গোরস্থানের কথা আসছে কেন ! তার মনে পড়ে দেবীর বলা সেই কথা , ” যা তোরা মাটিকে খাওয়াস। অথচ মাটির তার প্রয়োজন নেই । প্রয়োজন আমার!”

তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অপরূপ নারী মূর্তিকে এই প্রথম ভয়ঙ্কর লাগলো তার কাছে। বুঝতে পারলো কেন এই দেবীকে সবাই পিশাচ বলে। স্বপ্নেও আকলা প্রচুর পানি পিপাসা অনুভব করতে পারল। ইচ্ছা করলো ছুটে পালায়। সে আৎকে দাঁড়িয়ে উঠে চেঁচিয়ে বলে ওঠে :

এ আমি কিছুতেই পারবো না। কেউই পারবে না। কেউই করবে না! এ অন্যায়, অনাচার!

কেন করবে না? এর বিনিময়ে কী এমন জিনিস , ইচ্ছা , চাহিদা আছে তোদের যা আমি মেটাবো না ? তোকে রক্ষা করেছি। তার বিনিময় নাই দিলি। কিন্তু তোকে যদি তোর পিতৃপরিচয় জানিয়ে দেই আমি। তবে ?

আকলা দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার আবার বিছানায় শুয়ে থাকা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলল :

আপনি অন্তর্যামী! আপনি জানেন আমি আমার পিতার নাম জানি!

তুই মনে করে দেখতো তোর মা একবারও বলেছিল কিনা যে তোর বাপ মানজা বু ? সে শুধু তোর বাবার ব্যাপারে বলতে গিয়ে এই নামটা নিয়েছিল। মানজা বু যে তোর বাবা তা বলেনি। পুরো কথা শেষ করার আগেই মারা যায়। মনে করে দেখ!

ভাবনায় ফেলে দেয় কথাটা আকলাকে। সে জেদের সঙ্গে বলে :

আমি ঠিক জানি ! তিনিই আমার বাবা। আপনি আমাকে বোকা বানাচ্ছেন।

তোর মা এমন একটা পাথর ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা করেছিল যে তোর বাবার নাম কখনো প্রকাশ করবে না সে। এটাতো তোকে তোর মা অনেক বার বলেছে ? তুই জানিস তোদের গোষ্ঠীর সেই পবিত্র পাথরের প্রতিজ্ঞা কেউই ভাঙে না শত বিপদেও। তোর মাও ভাঙেনি। সে মানজা বু এর নাম এই কারণে নিয়েছিল কারণ তোর পিতার কথা সে ছাড়া আর কেউ জানে না। এটাই সে বলতে চাইছিল।

আর কেউ জানে না!

আর জানে তোর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই অন্তর্যামী। একবার ভেবে দেখ আমি চাইলেই গোষ্ঠীতে তোর বাবার নাম প্রকাশ করে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। কেউ আর তোকে পিতার পরিচয়হীন বলবে না। তোকে ছোট করে দেখবে না। শরীরের দিকে তাকা। এই উৎলে ওঠা যৌবন আটকে রাখবি কী করে ? তুই জানিস পিতৃপরিচয়হীন কন্যারা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত একা থাকবে। না স্বামী , না সন্তান। একা ঘরে কুমারীত্ব নিয়ে ধুকে ধুকে বৃদ্ধ অবস্থায় মরবি। যেমনটা তোদের গোষ্ঠীর অনেক মেয়ের পরিণতি হয়েছে। তুই কী এমনটাই চাস?

আকলার কাছে সব গুলিয়ে যাচ্ছে। দেবীর কথাগুলো এলোমেলো হলেও সত্যি। পরিচয়হীনতার কারণে তাকে কেউ বিয়ে করবে না , সম্মান পাবে না সে , তার বৈধ সন্তান হবে না , চাইলেই একটা সময় জোরপূর্বক তাকে ভোগ করলেও কাউকে বু শাস্তির আওতায় আনবে না। এই নিয়ম! এটাই তার মতো পিতৃপরিচয়হীন মেয়ের জীবনের পরিণতি। এটাকেই মেনে নিতে হয়! ভাবনার মাঝেই সে বুঝতে পারলো তার নিয়ন্ত্রণ নিজের মধ্যে নেই। সে ঝুঁকে দেবীর পা স্পর্শ করল। তার মাথায় তার হাতের স্পর্শ পেতেই ঘুম ভেঙে যায়।

তিন দিন পর , মাঝরাত ।

পিশাচদের বসবাস এই অঞ্চলে প্রায় হাজার বছর ধরে। গোরস্থানটাও শত বছরের পুরনো। এই গোষ্ঠীর পূর্ব-পুরুষেরা বুঝতে পারে পিশাচদের কারণে মৃত্যুর পরেও তারা নিরাপদ না । অনেক সময় দেখা যায় কবর দেওয়ার রাতেই গোরস্থানে পিশাচের আগমন ঘটেছে। ছিন্ন-ভিন্ন করে ছিড়ে লাশটা খেয়ে শুধু হাড্ডিগুলো ফেলে যেত। আবার মাঝেমধ্যে পুরো লাশটা নিয়েই অদৃশ্য হয়ে যেত , কোনো নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নিয়ে ক্ষুধা মেটানোর জন্য। কিছু কিছু পিশাচ মায়াবলে লাশ নিয়ে যাওয়ার পর কবরটা আবার আগের মতো করে রাখতো যাতে লাশ চুরির ব্যাপারটা কেউ টের না পায়।

এইসব বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে পূর্বপুরুষেরা গোরস্থানটাকে নানান রীতিনীতি করে এমন ভাবে রূপ দিয়েছে , মন্ত্রবলে দীর্ঘদিন সাধনা করে এমন মায়ার বাধা সৃষ্টি করেছে যে পরবর্তীতে আর কোনো পিশাচ এই গোরস্থানে প্রবেশ করতে পারবে না । হয়েছেও তাই। কয় যুগ হবে এই গোরস্থানে কোনো পিশাচের প্রবেশ ঘটেনি। কিন্তু মানুষের প্রবেশ করতে তো দোষ নেই। গোরস্থানটাই তো মানুষেরই!

সেই মায়া শক্তিই গোরস্থানকে পিশাচদের থেকে রক্ষা করেছে এতদিন। অনেক পিশাচ অন্যত্র চলে গেছে , মারা গেছে ক্ষুধার্ত হয়ে। আবার তাদের অলৌকিক শক্তির উদারতা অনেক পিশাচকে পূজনীয় করে তুলেছে মানুষের কাছে। তাদের মায়া শক্তি , মানুষের সব চাহিদা পূরণের অলৌকিক শক্তির ব্যবহার অনেক মানুষকেই প্রলুব্ধ করেছে তাদের অনুসারী হয়ে খাবার যোগানের। বিনিময় , বিনিময়, উপকার , উপকার খেলা!

আজ সকালেই মারা গিয়েছিল গোষ্ঠীর ফিরো , আর আনারা এর ৮ বছরের বাচ্চা মেয়েটা সাপের কামড়ে। দুপুরেই সব আয়োজন শেষ করে মানজা বু এর অনুমতি নিয়ে এই গোরস্থানে কবর দেওয়া হয় তার। সেই কবরটাই এখন খুঁড়ছে আকলা হারিকেনের মৃদু আলোতে।

অনেক দিন ধরে এই গোরস্থানে লাশ চুরি হয়না বলে কেউ পাহারায় থাকে না। তবুও কাঁপছে-ঘামছে আকলা , সতর্ক দৃষ্টিতে চার-পাশে তাকাচ্ছে বারবার ।

সেই রাতের পরে আরো একবার স্বপ্নে দেবীর সঙ্গে কথা হয়েছে তার। দীর্ঘ আলাপন শেষে সে সিদ্ধান্ত নেয় যাতে তার পিতার পরিচয় গোষ্ঠীতে প্রতিষ্ঠিত হয় আর তার জীবনটা সহজ হয় সেই পথেই যাবে সে। দেবী হারমা তার উপকার করবেন। কিন্তু বিনিময় লাগবে! সেই বিনিময়ই জোগাড় করছে সে। লাশের কাছে পৌঁছে গেছে সে। ওপরের মাটি সরাতেই কলা পাতা দিয়ে মোড়া লাশটা দেখতে পেল সে।

ভয়ে তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। এখনো চিন্তা করছে কাজটা কী তার উচিত হচ্ছে কিনা। না, সময় নষ্ট করা যাবে না! মেয়েটার ওজন বেশি না। সহজেই কবরের ওপর তুলে কবরটা আবার মাটি দিয়ে ভরে দিল সে। অনেকটা সময় লাগলো।

এক হাতে হারিকেন নিয়ে পাঁজাকোলা করে লাশটা নেওয়া যাবে না। বাহুর সঙ্গে লম্বালম্বি করে জড়িয়ে লাশটা নেয়ার সাহস হচ্ছে না আকলার। সেক্ষেত্রে লাশটার মাথা থাকবে তার কাঁধে। তার মনে হবে যেকোনো মুহূর্তে লাশটা চোখ খুলে তার ঘাড়ে কামড়ে দেবে বা শক্ত করে তার পিঠটা চেপে ধরবে। যদিও এছাড়া আর উপায় নেই। জঙ্গলের ভেতর ভয়ানক অন্ধকার।

সে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে কলা পাতা মোরা লাশটা লম্বালম্বি করে বুকের সাথে লেপ্টে নিল। এমন সময়েই লাশটার মুখের ওপর থেকে কলা পাতা সরে যেতেই অস্ফুট একটা আর্তনাদ বেরিয়ে এলো আকলার গলা থেকে। ইচ্ছা করছে লাশটা এখানে ফেলে পালায়। কিন্তু এটা সম্ভব না। হারিকেনটা তুলে কাঁপতে কাঁপতে, দেবী হারমার নাম নিতে নিতে গোরস্থানের পথ পেরিয়ে জঙ্গলের দিকে এগোলো আকলা।

আরুল, মানজা বু এর লাঠিয়াল বাহিনীর লোক। রাতে গোষ্ঠীর লোকদের গুদামগুলো পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে রয়েছে সে। এক নতুন ধরনের নেশার জিনিস পেয়েছে কয়দিন আগে। বুড়োর বয়স হলেও এইসব গন্ধ টের পেয়ে যায়। তাই সেটাই কলকেতে নিয়ে আগুন ধরাতে জঙ্গলের এইদিকে চুপিচুপি এসেছে সে। এখনো একটাও টান দেয়নি। এমন সময় মনে হলো একটা মেয়ে লোককে , কোলে একটা বাচ্চাকে নিয়ে জঙ্গলে ঢুকতে দেখলো সে। হাতে হারিকেন! এত রাতে কে যাবে জঙ্গলে ! সে কী ভুল কিছু দেখেছে ! নেশাতো এখনো শুরু করেনি! ঝাপসা আলো!

কলকেটা এক জায়গায় লুকিয়ে রেখে হারিকেন আর লাঠি হাতে নিয়ে সেও ধীরে ধীরে জঙ্গলে ঢুকে গেল অনুসন্ধানের জন্য। ……………………………..
.
.
. . . . . চলবে . . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana

.

পিশাচ_দেবী ১ম পর্ব

পিশাচ_দেবী
১ম পর্ব
.
মেয়েটার ওপর সব রকম শারীরিক অত্যাচার করার পরও মেয়েটা যখন বুঝতে পারলো ডাকাতের দল তাকে না মেরে আরো কিছুদিন বয়ে বেড়াবে এরকম অত্যাচারের জন্য , তখন সে অসহায় ভাবে কেঁদে বলল :

আমাকে যেতে দিন । আমার বাড়িতে ছোট দুটি বোন আছে। তারা রাতে ভয় পাবে।

ডাকাতদের দলনেতার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠলো। সে মেয়েটার আরো কাছে এসে থুতনিতে চাপ দিয়ে মুখ উঁচু করে জানতে চাইলেন , বয়স কত ওদের?

মেয়েটা এবার আরো আড়ষ্ট হয়ে গেল। কী একটা কথা যেন ভুল করে ভুল মানুষের সামনে বলে ফেলেছে। মেয়েটা কথা বলছে না দেখে সর্দার তার এক অনুসারিকে চোখের ইশারা করতেই কাপড়ে পেঁচিয়ে এক পাশ গরম লোহাটা নিয়ে এলো। মেয়েটার উরু থেকে গলা পর্যন্ত এই লোহার মাথার আগুনের অসংখ্য পোড়া ছাপ। আড়চোখে তাই লোহার টুকরোটা দেখে শিউরে উঠলো সে। বিড়বিড় করে বলল, ১৪ আর ১৬ ।

সরদার ছাড়া দলের বাকি ৮ জনই সমস্বরে হৈহৈ করে চেঁচিয়ে উঠলো। গুপ্তধন পেয়ে গেছে যেন তারা। সবার চোখ লোভে চকচক করছে।

মেয়েটা প্রথমে তার বাসায় এই দলটাকে নিয়ে যেতে চাইলো না। কিন্তু গরম লোহার স্পর্শ আবার উরুসন্ধিতে পেতেই আকাশ কাঁপানো চিৎকার দিয়ে হাঁটা আরম্ভ করলো। একটা ঘোরের মধ্যে থেকেই পেছন থেকে গুঁতো খেতে খেতে সামনে বাড়লো সে। দলের বাকি সবাই উৎসুক হয়ে ফিসফিস করতে করতে তার পিছু নিল।

অমাবস্যার রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। জঙ্গলের গভীরের দিকে হারিকেনের আলোতে শ্লথ গতিতে চলেছে দলটা। সর্দারের আদেশে নীরবতা পালন করে এগোচ্ছে। একজন অনুসারী বলে উঠল , জঙ্গলের এত গভীরে কারো বাড়ি হয় নাকি! মেয়েটার কোনো হুস নেই নয়তো বোকা বানাচ্ছে। এলোমেলো দিকে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের।

আরেকজন উত্তর দিল , এমনটা মনে হয় না। মেয়েটা ভয় পেয়ে গেছে লোহাটাকে। এখন যা করতে বলবি তাই করবে ও লোহার আঁচ থেকে বাঁচতে। জঙ্গলের এইদিকে শুনেছি নদীর একটা দিক বয়ে গেছে। তার তীরে কয়েক ঘর কাঠুরে থাকে।

কয়েক ঘর! আনন্দে চেঁচিয়ে উঠলো বাকি সবাই। সর্দারও একমত হয়ে মাথা ঝাঁকালেন। জঙ্গলের এই দিকে আগে না আসলেও বনভূমি সম্পর্কে ধারণা আছে ওর।

প্রায় ২০ মিনিট মেয়েটার পিছু পিছু হাঁটার পর নদী দিয়ে পানি বয়ে যাওয়ার কলকল শব্দ শুনতে পেল তারা। এবার কিছুটা গতি বাড়িয়ে দিল তারা। আরো ১০ মিনিট হাঁটার পরেই ঝোপ-ঝাড় গাছের সংখ্যা কমে এলো। পরিষ্কার জায়গায় বেরিয়ে এলো তারা । হতচকিত ভাবে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল সবাই। চোখে গভীর কৌতূহল আর তৃষ্ণা। তাদের থেকে ৫০ ফুট দূরে হবে নদীর তীর। চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এই রাতে নদীর কিনারে দুজন তরুণী গোসল করছে। পরনে তাদের এক টুকরো কাপড়ও নেই। দলটাকে দেখে ভয় পেয়ে আৎকে না উঠে উল্টো কামুক দৃষ্টিতে সর্দার আর সবার দিকে তাকিয়ে হাসলো দুই তরুণী। তারপর শরীরে কোনো রকম কাপড় জড়িয়ে হেটে হেটে কুঁড়েতে পৌঁছে চোখ ইশারায় ডাকল তাদের।

সাথে সাথে পাশের দুইটা কামরার দরজাও খুলে গেল সেখানেও তারা দেখলো কয়েকজন তরুণী মেয়ে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র অবস্থায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। মায়া ভরা হাসি আর চোখে তাদের আহবান করছে। তারা প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলো না নিজেদের চোখকে। তারপর আত্মহারা হয়ে গেল।

হারিকেন আর এই মেয়েটাকে ফেলে আনন্দে নাচতে নাচতে দলনেতা সহ সবাই সেদিকে ছুটলো। তারা মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল আজ অমাবস্যার রাত। চারদিকে এতো জোৎস্না থাকার কথা না। আর যে মেয়েটাকে অনুসরণ করে তারা এসেছে এখানে , সেই মেয়েটার আসলে এই বয়সী কোনো বোন কোনো কালে ছিলই না, মেয়েটা ফাঁদে ফেলার জন্য মিথ্যে কথা বলে তাদের এখানে নিয়ে এসেছে।

মেয়েটা বিস্মিত হয়ে হারিকেনটা তুলে নিয়ে সামনে ধরলো । অবাক হয়ে ডাকাতের দলটাকে একটা গুহার ভেতর ঢুকে যেতে দেখলো। চারপাশে ঝোপ-ঝাড় আর গাছ ছাড়া আর কিছু নেই। দলটা কী এমন দেখলো যে এত আনন্দে আলো ছাড়াই এই অন্ধকার গুহার ভেতর ঢুকে গেল!

তবে কী লোকে যেটা বলে সেটা সত্যি ! এই জঙ্গলে কী সত্যিই দেবী হারমা বাস করেন ! সেই মায়ার দেবী ! এই বনের সবচেয়ে ক্ষমতাবান স্বত্তা। বন যার ভাই , নদী যার বোন , সূর্য যার পিতা, মাটি যার মা।

তাদের গোষ্ঠীতে হঠাৎ এক বৃদ্ধলোক এসেছিল। সে এই দেবীর গল্প সবাইকে শুনিয়েছিল। এই বনেই তার বাস। যে তার পূজা করে তাকে বিশ্বাস করে , তার উপাসনা করে এমন কিছু আশা , উপকার নেই যে সে পূরণ করতে পারে না।

মেয়েটার নাম আকলা। এই পৃথিবীতে আপন বলে কেউ নেই তার। গোষ্ঠীর সঙ্গে বনের পাশের একটা আবাসে থাকে। বিকেলে একটা গাছের চারা খুঁজতে জঙ্গলে ঢোকে। খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যা হয়ে যায় আর সে অনেক গভীরে চলে আসে। তবে তার ভয় নেই , সব রাস্তা তার চেনা । সূর্যের আলো তখনো মিলিয়ে যায়নি। এরকম ভুল তার আগে কখনো হয়নি। পথ ভুলে উল্টোপথে চলে আসে সে। এরপরেই সামনে পড়ে এই ডাকাত দলের। পরের ইতিহাসটা করুণ। পশুর মতো আচরণ করেছে তারা তার সাথে। মৃত্যু কামনা করছিল মেয়েটা নিজের। সেই সময় জানতে পারে তারা তাকে ধরে নিয়ে যাবে দাসী হিসেবে। আরো নির্যাতন ! তখনই শেষ ভরসা হিসেবে দেবী হারমা এর নাম ঝপ করতে থাকে। যদিও সে শুনেছিল এই দেবী পিশাচ। আর তাদের গোত্রে পিশাচ সাধনার সাথে কাউকে জড়িত পেলেই পুড়িয়ে মারার নিয়ম। তাছাড়া এই দেবী অভিশপ্ত হয়ে বন ছেড়ে চলে গেছেন।

পিশাচ দেবী হারমা এই জঙ্গলে এক অদ্ভুত মায়ার জগৎ সৃষ্টি করতে পারতেন। তার একটা মায়ার গুহা রয়েছে । ঐদিকে তাকিয়ে মানুষ যা চিন্তা করে , যা দেখতে চায় তাই তাকে দেখানো হয়। পুরো বাস্তবের মতো মনে হলেও এটা ভয়ংকর মায়া। কেউ এই মায়ায় পরে গুহার ভেতর একবার ঢুকলেই আর বেরোতে পারে না।

জঙ্গলের কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানায় এটা নেই। গভীর রাতে দেবী হারমা এর নাম ঝপতে ঝপতে হাটতে হয়। দেবী চাইলে সেই গুহাটা তার সামনে হাজির করেন। যারা এটা জানে তাদেরও এই গুহার মায়া কাটিয়ে ফিরে যেতে কষ্ট হয়। কাঙ্খিত এমন কিছু এমন ভাবে মায়ার মাধ্যমে দেখানো হয় যে এর আকর্ষণ থেকে মুখ ফেরানো অসম্ভব। এগোতে ইচ্ছা করে সামনে।

ডাকাতের দল যেন সেই মায়ায় পড়েছে। দেবী তাকে রক্ষা করেছে। আকলা বিস্মিত দৃষ্টিতে গুহার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়েই উল্টো-পথে হাটা ধরলো। ঐদিকে তাকিয়ে থাকলে হয়তো সেও কোনো মায়ায় আটকে যাবে।

পুরো শরীর জ্বালা করছে তার। পরিধেয় কাপড়কে আর কাপড় বলা যায় না। কয়েক টুকরো শুধু কোনোমতে শরীরের সাথে লেগে রয়েছে। এখন মরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। সে কিছুতেই গোষ্ঠীতে ফিরে যেতে পারবে না ।

হঠাৎই হারিকেনের আলোয় সে দেখলো তার সামনে ইট দিয়ে বাঁধাই করা একটা কুয়ো , সাথে রশি দিয়ে বাঁধা বালতি। আরো আশ্চর্য সে যেই কাপড় পরে জঙ্গলে এসেছিল হুবহু ঐরকম একটা নতুন কাপড় পিঁড়িতে রাখা। এটা কোনো মায়া! কিছুই ভাবতে ইচ্ছা করছে না তার। হারিকেন আর কাপড় এক জায়গায় রেখে কুয়ো থেকে পানি তুলে গায়ে ঢাললো। আশ্চর্যরকম একটা শান্তি অনুভব করলো সে। হঠাৎ খেয়াল হলো শরীরের জ্বালা আর নেই। হারিকেনের আলোতে নিজের নগ্ন শরীরের দিকে তাকিয়ে হতভম্ব না হয়ে পারলো না। শরীরের কোথাও এক ফোঁটা আগুনের ছেঁকার দাগও নেই।

কাপড়টা পড়ে , টুকরো ছেড়া-কাপড় গুলো কী মনে করে নিজের সঙ্গে নিয়ে চলল। অসম্ভব ! কিছুক্ষণ হাঁটার পরেই ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পেল সে। তার পুরো শরীর অবিশ্বাসে কাঁপছে। এই এক রাত যে তার আর তার গোষ্ঠীর জীবনে কী পরিবর্তন ঘটাবে তার কোনো আন্দাজও নেই আকলার। এত রাতে কেউ জেগে নেই। সে ধীরে ধীরে নিজের ঘরে ফিরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। আকস্মিক এই ঘটনার উত্তেজনায় তখনো তার শরীর কাঁপছে। ………………………
.
.
. . . . . চলবে . . . . .
.
.
লেখা : #Masud_Rana

[ শুরুর জন্য পর্বটা ছোট হলো। পরবর্তী পর্বগুলো আরো বড় হবে ]

যাত্রাশেষে (পর্ব-১৮) শেষ পর্ব

যাত্রাশেষে (পর্ব-১৮)
শেষ পর্ব
# হালিমা রহমান।

প্রচন্ডে গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। জ্বিভ শুকিয়ে কাঠ।কুকুরগুলো পর্যন্ত একটু পানি পেলেই তাতে গা ডুবিয়ে দিচ্ছে।সূর্যের তীব্র তাপে শরীর পুড়ে যাওয়ার জোগার।গাছের পাতার কোনো নড়নচড়ন নেই।এরকম অবস্থায় রাজপথে বিশাল জ্যাম।একদম সাপের মত সোজা হয়ে আছে গাড়িগুলো।এ যেন মরার উপর খাড়ার ঘা।আফজাল সাহেব জ্বিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলেন।গলার শেষ পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে।বুড়ো বয়সের এই এক সমস্যা।খুব বেশি ভ্রমণ করা যায় না।আফজাল সাহেব রিকশায় বসে গলা উঁচিয়ে দেখলেন।এখনো অনেক জ্যাম।এই জ্যাম কখন ছুটবে আল্লাহ মালুম।হাসপাতালেও তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে।তিনি পাশে নাতনীর দিকে তাকালেন।অধীর আগ্রহে সে এদিক-ওদিক দেখছে।আর কিছুক্ষণ পরপর নানার পাঞ্জাবী ধরে খুটছে।

—” নানাভাই,আর কতদূর?”
—” বেশি না বোন।আর একটু।”
—” উফ, তাড়াতাড়ি যাইতে বল।আমরা যাব না?”
—” যাব।আরেকটু সোনা।”

এনিয়ে পাঁচবার একই কথা বলল মৃত্তিকা।সে অধৈর্য হয়ে উঠেছে।সেই কখন বেড়িয়েছে ঘর থেকে।এখনো এতো সময় লাগবে কেন?না জানি কতকিছু হয়ে যাচ্ছে সেখানে!
আফজাল সাহেব মিনিট কয়েক কপাল কুঁচকে চিন্তা করলেন।এই জ্যাম ছাড়ার আশায় বসে থাকলে হবে না।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো মৃত্তিকা কান্নাকাটি শুরু করে দেবে।ওকে তখন সামাল দিবেন কি করে?তাই বেশ চিন্তিত সুরেই নাতনীকে বললেনঃ”মিত্তি,তুমি তাড়াতাড়ি যেতে চাও?”
—” হুম।”
—” এভাবে বসে থাকলে তো তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে না।তুমি কি হেঁটে যেতে পারবে?হাসপাতাল এখান থেকে মাত্র আধা ঘন্টার রাস্তা।”

আধা ঘন্টার রাস্তা কম নয়।মৃত্তিকা কয়েক সেকেন্ড ভাবে।এভাবে বসে থাকলে দেরি হবে।তার চেয়ে যত তাড়াতাড়ি যাওয়া যায় ততোই ভালো।তাই মাথা নেড়ে বললঃ” পারব।চলো নানাভাই নেমে যাই।”
—” সত্যিই পারবে তো।নানাভাইয়ের কিন্তু কোমড়ে ব্যাথা। তোমাকে কোলে নিতে পারব না।মাঝ রাস্তায় কান্নাকাটি করতে পারবে না কিন্তু।ঠিক আছে?”
—” আচ্ছা।চলো নামি।”

আফজাল সাহেব নাতনীকে নিয়ে নেমে যান রিকশা থেকে।অর্ধেক রাস্তার ভাড়া দিয়ে দেন রিকশাওয়ালাকে।তারপর ফুটপাত ধরে হাঁটতে শুরু করেন।এখানে মানুষ,ওখানে মানুষ।একদম মানুষে গাদাগাদি।এত মানুষ এইটুকু শহরে কি করতে যে আসে!আফজাল সাহেব নাতনীর ডানহাত শক্ত হাতে ধরেন।নাতনীর আগে-পিছে সাবধানী দৃষ্টি রাখেন।তার সাধের নাতনীর গায়ে যেন কেউ হাতও দিতে না পারে,সেদিকে কঠোরভাবে নজর দেন।ফুটপাতের পাশেই একটা ফেরিওয়ালা দেখে হাঁটা থামিয়ে দেয় মৃত্তিকা।তার কাছে অনেকগুলো বেলুন আছে।তিনটা বেলুন কিনলে কেমন হয়!

—” নানাভাই,বেলুন কিনে দেও।”
—” কোথায় বেলুন?”
—” ওই যে।”

মৃত্তিকার নজর অনুসরণ করে আফজাল সাহেব সেদিকে তাকান।তাদের থেকে অনেকটা দূরে একজন ফেরিওয়ালা।হরেক রকম বেলুন তার কাছে।আফজাল সাহেব নজর ঘুরিয়ে বলেনঃ” এখন না,মিত্তি।পরে কিনে দিব।লোকটা অনেক দূরে।”
—” দেও না, নানাভাই।তিনটা বেলুন লাগবে আমার।বেলুন না নিয়ে আমি যাব না।”

অগত্যা বেলুন কিনতে ছুটে যান আফজাল সাহেব।তিন বেলুনের হিসাব বুঝতে পেরেছেন।বেলুন কিনে আবারো রাস্তা ধরেন।ভালোয় ভালোয় হাসপাতালে পৌঁছাতে পারলেই হয়।
আধ-ঘন্টার রাস্তা পাড়ি দিতে চল্লিশ মিনিট লাগলো।মৃত্তিকার পা ব্যাথায় টনটন করছে।সে বোধহয় জীবনে এতোটা হাঁটেনি।তবে তার মন খারাপ নয়।হাসপাতালের গেটে আসতেই মৃত্তিকার পায়ের শক্তি বেড়ে যায়।সে একছুটে নিচতলা পেড়িয়ে যায়।পিছন থেকে শোনা যায় আফজাল সাহেবের সাবধানী সুর।

—” নানু,আস্তে।”

মৃত্তিকার কি সেসব শোনার সময় আছে?সে কখন সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেছে!

—” আম্মু,আমি আসছি।”

মহুয়া মেয়ের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি।শরীরের অসহ্য যন্ত্রণা। তবুও একটু উঠে বসার চেষ্টা করে।দু-হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কাছে ডাকে।মৃত্তিকা ঝাপিয়ে যেয়ে মায়ের বুকের উপর পড়ে।মা ছাড়া ঘুমনোর অভ্যাস নেই তার।অথচ,কালকে এই অপ্রিয় কাজটাই করতে হয়েছে।সে মায়ের উপর দিয়ে ওপাশে নজর দেয়।দুটো ঘুমন্ত পুতুল। কি সুন্দর মায়ের পাশে ঘুমিয়ে আছে। কখন এলো এরা? কাল রাতে?

—” আম্মু,এগুলা ভাইয়া বাবু?”
—” হুম।”
—” ওরা এত ছোট কেন?ওরা আমার মত বড় থাকতো।”
—” ওরাও বড় হবে।”
—” কবে?”
—“কয়েকদিনের মধ্যেই ইনশাআল্লাহ। তোর নানাভাই কোথায়?”
—” আসতেসে।আম্মু,ওরা কিভাবে আসলো?ওরা কোথায় ছিল?ওরা কি রাস্তা চিনে?”

মৃত্তিকা এখনো খুবই কৌতুহলী। যেকোনো জিনিস নিয়ে তার আগ্রহের শেষ নেই।পাখি কেন উড়ে,গাছ কেন হাঁটে না,আকাশ কেন শুধু নীল আর সাদা হয়,সূর্যের দিকে কেন তাকানো যায় না—এসব নিয়ে ওর প্রশ্নের শেষ নেই।মহুয়া মেয়ের মাথায় বিলি কেটে মৃদু হাসে।
—“ওদেরকে মার্কেট থেকে কিনে এনেছে তোর বাবা।”
—” কোন মার্কেট? ”
—” কি জানি।তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করিস।”
—” আব্বুর অনেক টাকা?এই দুইটা বাবু কিনতে অনেক টাকা লেগেছে না?”
—” হুম ”

আফজাল সাহেব বাইরে থেকে কেবিনের দরজায় নক করেন। এতোটা রাস্তা হাঁটার পর দুই তলার সিড়ি বাওয়া অনেক কষ্টের।দরজার আওয়াজ শুনে মহুয়া তাড়াতাড়ি করে শরীরে ওরনা টেনে দেয়।তারপর আস্তে করে বলেঃ” ভিতরে আসো, বাবা।”
আফজাল সাহেব ভিতরে ঢুকেন।চেয়ার টেনে মেয়ের বিছানার কাছে বসেন।মহুয়াও ততোক্ষণে উঠে বসার চেষ্টা করেছে।তা দেখে ধমক দেন আফজাল সাহেব।

—” উঠছিস কেন?উঠিস না, শুয়ে থাক।নাতীরা কি করে?”
—” ঘুমায় বাবা।”
—” কালকে রাতেই আসতে চেয়েছিলাম আমি।কিন্তু জামাই নিষেধ করলো।আবার, আমার সাথে মিত্তি আছে তাই আসতে পারলাম না।”
—” ঠিক করেছ।আমাকে রাতে কেবিনে দিয়েছে।তুমি তো আর থাকতে পারতে না।মিত্তিকে নিয়ে আরেক ঝামেলা হতো তখন।মিত্তি বিরক্ত করেছে কাল?”
—” না।তোকে হাসপাতালে নিয়ে আসার কথা শুনে একটু কেঁদেছে।আবার ভাইদের খবর শুনে থেমে গেছে।সমস্যা হয়নি।জামাই কই?”
—” মাকে বাড়িতে দিয়ে আসতে গেছে।আসার সময় খাবার নিয়ে আসবে।”
—“তুই সকাল থেকে না খাওয়া?”
—” না। মাল্টা খেয়েছি একটু আগে।ওখানে মাল্টা আছে।তুমি কেটে খাও।”

মৃত্তিকা মায়ের ওপাশে বসে ভাইদের দেখছে।কি সুন্দর দুটো পুতুল।একসাথে দুটো পুতুল কিনলো বাবা?কত দাম নিয়েছে এদের? কোটি কোটি টাকা?
কাল রাতে দুটো ছেলে হয়েছে মহুয়ার।অসমকোষী জমজ।বিয়ের তিন বছরের মাথায় দুটো প্রাণ এসেছে মহুয়া-তুষারের ঘরে।মহুয়া ঘাড় ঘুরিয়ে একবার ছেলে-মেয়েদের দেখে।ঠোঁটের কোনে তার হাসি ফুটে উঠে। একটা টুকুনের শখ ছিল।আল্লাহ,এখন তিনটা দিয়েছে।

প্রায় একঘন্টা পর হাসপাতালে আসে তুষার।হাতভর্তি খাবার।নিজেরটাও এখানে নিয়ে এসেছে।বউ-বাচ্চার সাথে একসাথে খাবার খাবে।কালরাতে একটা ঝড় গেছে তার উপর দিয়ে।মহুয়ার একটু স্বাস্থ্যগত জটিলতা ছিল।তারউপর একজোড়া সন্তান।চিন্তায় গলা শুকিয়ে গিয়েছিল।কালরাতে কয়েক ঘন্টায় যেই পরিমাণ আল্লাহকে ডেকেছে,সেই পরিমাণ শ্বাসও বোধহয় নেয়নি।তারপর ছেলে দুটোকে যখন কোলে নিল,তখন কি যেন হলো তার। চুমু আর চোখের পানিতে ভরিয়ে ফেললো সন্তানের মুখ।বাবা হওয়ার অভিজ্ঞতা নতুন নয়। কিন্তু এই দুটো সন্তান তো নতুন! প্রতিবার সন্তান কোলে নেওয়ার পরে বোধহয় একই অনুভূতি সব বাবার হয়।রাতে কেবিনে থাকতে পারেনি।সাবিনা বেগম,রুবিনা বেগম,মহুয়া ও বাচ্চারা ছিল।তাই তুষারের জায়গা হয়েছে হাসপাতালের মসজিদে।কখন আবার কি প্রয়োজন হয়–এই চিন্তায় সারাটা রাত সে ঘুমাতেই পারলো না।
তুষার কেবিনে ঢুকলো একরাশ ক্লান্তি নিয়ে। দুটো বিছানা আছে এখানে।ভাত খেয়ে এখন সে ঘুমাবে।আনন্দ,পরিতৃপ্তি এসব অনুভূতি মনকে সতেজ করে শরীরকে নয়।একটু না ঘুমালে সে আর পারবেই না।
তুষারকে একবার চোখ তুলে দেখলো মহুয়া।সারা শরীর ফুটে যেন ক্লান্তি বেরোচ্ছে।সে আস্তে আস্তে বসার চেষ্টা করতেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল তুষার।সযত্নে, সাবধানে বউকে বসালো।আফজাল সাহেব নেই এখানে।এতোক্ষণ কথা-বার্তা বলে বাইরে গেছেন।

—” মহুয়া,শরীর কেমন এখন?”
—” আলহামদুলিল্লাহ। আপনি ঘুমিয়ে নিতেন একটু।পরে আসলেও তো চলতো।”
—” খাবারগুলো?”
—” আমি বাবাকে বলতাম একটু এনে দিতে।”
—” কাজ নেই আর।তোমার মনে হয়, তোমাকে হাসপাতালে রেখে আমি ঘরে ঘুমাব?”

মৃত্তিকা বাবাকে দেখে আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে দাঁড়ালো।সে এখন কোনো শব্দ করছে না।যদি ভাইয়েরা উঠে যায়।আস্তে আস্তে তুষারের পিছনে যেয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো। বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে বললঃ”বাবা,ভাইদের দাম কত?কোন মার্কেট থেকে এনেছ ওদের?আমাকেও নিয়ে যেতে,আমি একটু দেখতাম।”

মেয়ের প্রশ্ন বুঝতে না পেরে স্ত্রীর দিকে তাকায় তুষার।তা দেখে হেসে ফেলে মহুয়া।গলায় কৌতুকের সুর ফুটিয়ে বললঃ” নিন বলুন।কোথা থেকে এনেছেন ওদের।আমি বলেছি,আপনি কিনে এনেছেন।”

মেয়েকে দুই হাতে কোলের কাছে নিয়ে আসে তুষার।দুই গালে চুমু দেয়।তারপর মেয়েকে কোলে বসিয়ে বলেঃ” ওদেরকে কিনতে টাকা লাগেনি,মা।আমি কাল রাতে হাসপাতালের দরজার কাছে যেয়ে দেখলাম, এই দুটো পুতুল মাটিতে শুয়ে শুয়ে কাঁদছে।পরে ওদেরকে তুলে তোর মায়ের পাশে শুইয়ে দিয়েছি।ওদেরকে আল্লাহ পাঠিয়েছে।”
—” আম্মু যে বলল?”
—” তোর মা তো ঘুমিয়ে ছিল,জানবে কি করে?তুই ঘুমিয়ে থাকলে কিছু বুঝতে পারিস?”
—” উঁহু। ”
—” তোর মাও বুঝতে পারেনি।যা ভাইদের কাছে যেয়ে বসে থাক।নাস্তা খেয়েছিস সকালে?”
—” হ্যাঁ, নানাভাইয়ের সাথে খেয়েছি।আমি ভাইদের জন্য বেলুন এনেছি।ওরা খেলবে না?”
—” এখন না।ওরা ঘুম থেকে উঠলে খেলবে।”

মৃত্তিকা আবারো বাচ্চাদের কাছে যেয়ে বসে।কি সুন্দর মুখ হা করে ঘুমাচ্ছে দুজনে।ছোট্ট হাত,ছোট্ট পা,ছোট্ট পেট।ওরা খেলতে পারবে?এই ছোট্ট হাত দিয়ে বড় বেলুনগুলো ধরবে কি করে?
তুষার টিফিন বক্স থেকে মহুয়ার খাবার বের করে।নরম নরম ভাত সাথে কি একটা যেন ঝাল ছাড়া তরকারি। খাবার দেখেই মহুয়ার নাড়ী-ভুরি উল্টে আসে।এগুলো খেতে হবে?তুষার প্লেটে খাবার নিতেই সজোরে মাথা নাড়ায় মহুয়া।এগুলো কিছুতেই পেটে যেতে দেবে না।

—“মহুয়া,হা করো।”
—” অসম্ভব। এগুলো কিছুতেই খাব না।”
—” তাহলে সেই পাতলা পাতলা সাদা স্যুপ এনে দেই।ওগুলো খাবে?”
—” মোটেও না।আমি ঝাল তরকারি দিয়ে ভাত খাব।কাল রাত থেকে ভারী কিছু খাইনি। এগুলো পেটে গেলে নিশ্চিত বমি করে ভাসিয়ে ফেলব।”

মহুয়ার কথায় কান দেয় না তুষার। ঝাল তরকারি খাবে বললেই হলো।অপারেশনের পরে নরম খাবার খেতে হয়।এই মেয়ের মাথায় বুদ্ধি নেই নাকি?
এক লোকমা,দুই লোকমা জোর করে দিল তুষার।না খেলে শরীর ঠিক হবে?দু’বার জোর করে গিললেও, তৃতীয়বারের বেলায় আর সহ্য করতে পারলো না মহুয়া।বমি করে নিজের শরীরসহ তুষারের শরীরের একাংশ ভাসিয়ে ফেললো।

***

বাচ্চা দুটোর নাম রাখা হলো সাত দিনের দিন।চুল ফেলে,আকিকা দিয়ে নাম রাখলো।একজনের নাম মৃন্ময় আরেকজনের নাম তমাল।ভাইদের চুল ফেলতে দেখে মৃত্তিকারও সাধ জাগলো,সেও চুল ফেলবে।রুবিনা বেগম ফেলে দিলেন মৃত্তিকার চুল।সবাই যখন বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত,মৃত্তিকা তখন দৌড়ে বারান্দায় চলে গেল।মায়ের মত তারও এই জায়গাটা খুব প্রিয়।মৃত্তিকা বারান্দার গ্রিলে হেলান দিয়ে সামনের বারান্দার দিকে নজর দিল।কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে দেখতে পেল না।তাই হাঁসের মত গলা বাড়িয়ে ডাক দিল।

—” আংকেল,আংকেল।”

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো আবরার।সে যেন অপেক্ষাতেই ছিল।ঘর থেকে বারান্দায় এসে আবরারও হেলান দিয়ে দাঁড়ালো।মৃত্তিকাকে দেখে হেসে ফেললো সে।

—” কি অবস্থা মা তোমার?চুল ফেলে দিয়েছো যে?”
—” ভাইয়েরা ফেলেছে, তাই।তুমি ভালো আছ?”
—” হুম।কবে এসেছ তুমি?”
—” কালকে রাতে।আমরা নানু বাড়ি ছিলাম এতোদিন।জানো আমাকে দুটো ভাই দিয়েছে আল্লাহ।ওরা এইটুকু।—” হাত দিয়ে ভাইদের আকার দেখায় মৃত্তিকা।
—” নাম কী ওদের?”
—” তমাল,মিনময়।”—মৃন্ময়ের নাম সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে না মৃত্তিকা।
—” ওরা কার মতো হয়েছে?”
—” আম্মু বলেছে আমার মত।তুমি আমাদের বাসায় আসো। দেখে যাও ভাইদেরকে।”
—” অন্য একদিন আসব।”
—” তুমি থাকো আংকেল।আমি ভাইদের কাছে যাই।”

মৃত্তিকা দৌড়ে চলে যায়।আবরার ওদিকে তাকিয়েই থাকে।ওই বাড়ির তুষার ও মৃত্তিকার সাথে ওর কথা হয়।মৃত্তিকার সাথে আবার তার খুব ভাব।নিজের বাড়ির সাথে ও বাড়ির তুলনা করে আবরার।এটা যেন পাতালপুরী।এক আবরার ছাড়া এখানে আর কেউ নেই।পুরো ঘরে নিস্তব্ধতায় মোড়ানো। আবরার বারান্দার ফ্লোরে বসে পড়ে।নিজের জীবনের জমা-খরচ তুলে ধরে সামনে।কি করলো জীবনে?কি পেল আর কি হারালো।অনন্যার সাথে বিচ্ছেদের বয়স বোধহয় এক বছর হয়ে গেছে।অনন্যা প্রথম প্রেম ছিল।আবরারের দুর্বলতা ছিল।অথচ,একদিনের বোঝাপড়ায় সব শেষ।অনন্যা যতই নিজের চারপাশে ব্যস্ততার শক্ত প্রাচীর গড়ে তুলতে লাগলো,আবরার ততোই হাঁপিয়ে উঠতে শুরু করলো।প্রায়ই নিজের মনে প্রশ্ন করতো সে।এভাবে কি সম্ভব? আদোও কি এভাবে দু-প্রান্তে দুটো মানুষ দূরে দূরে থাকা সম্ভব?আবরারের অস্বস্তি আরো বেড়ে গেল যখন তার অন্তরঙ্গ বন্ধু রাফির একটা ছেলে হলো।রাফি কি সুন্দর করে সন্তানকে আদর করতো,চুমু দিত,কোলে নিত! এসব দেখে আবরারের ভিতরটা একদম পুড়ে যেত।তারপর বাড়িতেও আরেক জ্বালা।পাশাপাশি রুম হওয়ায় মৃত্তিকার কথা একদম স্পষ্ট শোনা যেত ঘর থেকে।মেয়েটা সুন্দর করে আধো আধো বুলিতে বাবাকে ডাকতো,মাকে ডাকতো।আবরার যেন আরো পাগল হয়ে গেল।মানুষের জীবনে বোধহয় একটা সময় আসে,যখন রমনীর রূপ-লাবন্যের চাইতে শিশুর কোমলতার প্রতি বেশি বেশি আকর্ষণ কাজ করে।রমনীর প্রনয়গাঁথার চাইতে শিশুর অর্থহীন কথার প্রতি বেশি ভালোলাগা কাজ করে।আবরারের ঠিক সেটাই হলো।পিতৃত্বের স্বাদ তার চাই।যেভাবেই হোক তার ঘরেও একটা নিষ্পাপ শিশু চাই।কিন্তু বেকে বসলো অনন্যা।বাচ্চা সামলালে ক্যারিয়ার?বাচ্চা পালতে সময়ের দরকার।এতো সময় তার কোথায়?বাচ্চা সামলাতে গেলে ক্যারিয়ারে সময় দিতে পারবে না।ফলস্বরূপ এতোদিনের অর্জন সব শেষ।তিলে তিলে গড়ে তোলা সব অর্জনকে গলা টিপে মেরে ফেলা অসম্ভব।এই মতবিরোধের ইতি টানলো আবরার।এ বোধহয় সেই গত বছরের কথা।আবরারের রাগের ছিলি খুলে গেল যেন।আবরার রাগারাগি করলো, মুক্তি চাইলো,অনন্যাও দিয়ে দিল।যেখানে সম্মান নেই, সেখানে ভালোবাসাও থাকতে পারে না।ভালোবাসার মানুষটাই যদি বদলে যায়,তবে সকল অনুভূতি সেখানে ফিকে হয়ে যায়। আবরার মুখ ঘুরিয়ে নিলো,অনন্যাও আড়ি নিয়ে চলে গেল।সেই থেকে আবরার নিঃস্ব।জীবন যাত্রায় হারানোর সূচনা মহুয়াকে দিয়ে।মহুয়াকে হারিয়ে অনুশোচনা হতো।খুব খারাপ লাগতো,যখন একা একা ওর কথা ভাবতো।মহুয়ার পরে গেল মা।আবরারের মা ভীষণ অভিমানী। যেদিন মহুয়ার সাথে আবরারের ডিভোর্স হয়ে গেল,সেদিন মাও এবাড়ি ছেড়ে চলে।আবরার কুলাঙ্গার। এই কুলাঙ্গারের সাথে এক বাড়িতে আর কিছুতেই না।এ বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পর একমাসও পৃথিবীতে ছিলেন না বিলকিস বেগম।এককালের মা ভক্ত আবরারের ভাগ্যে মায়ের লাশের খাট ধরার সৌভাগ্য হয়নি।কারণ,সে তখন অনন্যাকে নিয়ে সিলেটে ছিল মধুচন্দ্রিমা উপলক্ষে।সবশেষে চলে গেল অনন্যা।এ নিয়ে আফসোস নেই আবরারের।কাপুরুষেরা অন্যের ঘাড়ে অপরাধের বোঝা চাপিয়ে দিয়ে শান্তি পায়।আবরার বোধহয় সেই শ্রেণির। নিজের করা কর্মের জন্য যখন তার অনুতাপ হয়,অনুশোচনায় ভিতরটা মরে যায়;তখন সে অনন্যার উপর দোষ চাপিয়ে শান্তি পায়।তার কি দোষ?সে তো তুলসি পাতা ছিল।মহুয়ার সাথে ভালো ছিল।সে কি কখনো মহুয়াকে ছাড়তো?সব সেই অনন্যার দোষ।বেহায়া মেয়ে! আবরার বিবাহিত জানার পরেও কত পাগলামি করেছে।সব সেই অনুরই দোষ।তবুও ভিতরে শান্তি পায় না আবরার।অনুশোচনা, অনুতাপ,আফসোস —এগুলো পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর নীরব শাস্তি।যে একবার এই শাস্তি পায়,সে আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না।কত অদ্ভুত বিষয়! যেই বারান্দায় বসে মহুয়া একটা টুকুনের স্বপ্ন দেখতো,আজ সেই একই বারান্দায় বসে আবরার মহুয়ার সাজানো সংসারে উঁকি দিয়ে দেখে।তার সবটা জুড়েই একটানা বিষাদ সুর বাজে—” তিনটে টুকুন আজ আমারো থাকতে পারতো।কিন্তু থাকলো না,আর হয়তো থাকবেও না।”

***

চুলের মাঝখানে সিঁথি করলো মহুয়া।ঘাড়ে ফালিয়ে একটা খোপা করলো।শাড়ির আঁচল টেনে সুন্দর করে কাঁধে ফেললো।বহুদিন পরে চোখে মোটা করে কাজলের রেখা টানলো।মাথার খোপায় গুজে দিল একটা কাঠগোলাপ।এটা তার গাছের ফুল।একটাই হয়েছে এই মাসে।মৃত্তিকার জন্য গাছে ফুল রাখা যায় না।সে দেখলেই ছিঁড়ে ফেলে।লিপস্টিক হাতে নিয়েও আবার রেখে দিল মহুয়া। এই একটা জিনিস তুষার পছন্দ করে না।তাই ঠোঁটে কিছুই দিল না সে।মহুয়া সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে।আজ কতদিন পর শাড়ি পরলো।বাচ্চারা ছোট বলে এখন আর শাড়ি পরা হয় না।মহুয়ার স্বাস্থ্য একটু ভারী হয়েছে আগের থেকে।বয়স যে ত্রিশের কোঠায় পৌঁছে গেছে তা,এখন চেহারা দেখলেই বুঝা যায়।খাটের কাছে যেয়ে ছেলে-মেয়েদের দিকে নজর দেয়।তিনজন ঘুমাচ্ছে।ছেলেগুলোর বয়স দুই মাস।এই বয়সেই ভয়াবহ বিরক্ত করে মহুয়াকে।এটাকে ধরলে ওটা ছুটে যায়,ওটাকে ধরলে এটা ছুটে যায়।মহুয়া মশারী টাঙিয়ে ঘরের বাতি বন্ধ করে দেয়।নাহয় বাচ্চারা উঠে যাবে।অন্ধকার রাতে ঘরের বারান্দায় যেয়ে দাঁড়ায় মহুয়া।তার বারান্দায় এখন অনেক গাছ।বাগান বিলাসী লতা,কাঠগোলাপ,হাসনাহেনা,টাইম ফুল,একটা মরিচ গাছ,ক্যাকটাস, পুঁই লতা আর এককোনে একটা নয়নতারা গাছ।একটা ময়না পাখির খালি খাচাও আছে একপাশে।মাস কয়েক আগে ময়না পাখিটা মরে গেছে।বাচ্চারা ছোট বলে আরেকটা আনা হয়নি।আশেপাশে বাতাস আছে তবে বোধহয় বৃষ্টি হবে না।মহুয়া শুনেছে আকাশে চাঁদ-তারা থাকলে নাকি বৃষ্টি হয় না।এর সত্যতা কতটুকু জানে না সে।মহুয়া প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেয়।আসার সময় ঘরিতে দেখেছে বারোটা দশ বাজে।আজ একটা বিশেষ দিন।আর মহুয়া এই রাতদুপুরে সুন্দর করে সেজে একটা জ্ঞানহীন মানুষের জন্য অপেক্ষা করছে।
মহুয়ার অপেক্ষার পালাকে আরো দশমিনিট দীর্ঘ করলো তুষার।বারোটা বিশের দিকে সে বারান্দায় পা দেয়।আস্তে-ধীরে পা ফেলে মহুয়ার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়।মহুয়াকে নিজের দিকে ফিরিয়ে মৃদু হেসে বলেঃ”শুভ বিবাহ বার্ষিকী।চতুর্থ বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে আপনাকে আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।”
—“এতোক্ষণে?”
—” হ্যাঁ, দিন তো আর চলে যায়নি।”
—” সেটাই।”—মহুয়ার গলায় তীব্র অভিমানের সুর।

তুষার একবার মুখ বাকিয়ে কিছু একটা ভাবে।তারপর পকেট থেকে এক গুচ্ছ টকটকে লাল ফুল বের করে মহুয়ার সামনে ধরে।অন্ধকারেও ফুলগুলো চিনতে অসুবিধা হয় না মহুয়ার। তার মুখে হাসি ফুটে উঠে। এই ফুলগুলো তার খুব পছন্দ।কিন্তু সচরাচর এর দেখা মিলে না।ফুলগুলো হাতে নিয়ে বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠে সে।

—” বাহ,খুব সুন্দর তো! কোথায় পেলেন?”
—” গাছ থেকে এনেছি।অবশ্য আমি নিজে গাছে উঠিনি,আরেকজনকে উঠিয়েছি। আজব পছন্দ তোমার।শিমুল তুলা গাছের ফুল আবার কারো প্রিয় হয়?কোনো গন্ধ নেই শুধু সৌন্দর্য। ”
—” আপনি ফুলের রঙ দেখেছেন।কি দারুন!”

মহুয়ার নজর যায় তুষারের পাঞ্জাবির দিকে।সাদা পাঞ্জাবির বুকের কাছে কালো সুতার কাজ।কাজটুকু অসমাপ্ত। মহুয়া নিজেই বানিয়েছে এটা।প্রতিবছর বিবাহ বার্ষিকী উপলক্ষে নিজের হাতে তুষারের জন্য একটা পাঞ্জাবি বানায়।এবার অর্ধেক করার পর আর সময় পায়নি।তাই বুকের কাছে কাজটুকু এখনো অসমাপ্ত।তুষার আরো একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ায় মহুয়ার সাথে।

—” এইভাবে তাকায় থাক কেন?নজর লাগবে তো?”
—” আমি আপনার পাঞ্জাবি দেখছিলাম।এটা না পরলেই পারতেন।শেষ হয়নি এখনো।”
—” না শেষ হোক।আমার এটাই ভালো লাগে।তোমার চুলে এইটা কি ফুল?কাঠগোলাপ?”
—” হুম।”
তুষার দু-হাতের আজলায় মহুয়ার মুখ তুলে নেয়।অন্ধকারেই খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকে প্রেয়সীর মুখ।আগে যেমন লাগতো এখনো তেমনি লাগে।তুষার ফিসফিস করে বলেঃ” ভালোবাসি মহুয়া।কি চাও এবার?”
—” পাহাড়ে নিয়ে যাবেন।”
—” এবারেও?”
—” হুম।”
—” আচ্ছা মহুয়া,তুমি কি সুখী?”
—” জীবন একটা পথের মতো,মিত্তির বাবা।আমরা সবাই তার যাত্রী।যাত্রাপথে যে যেই বাধার সম্মুখীনই হোক না কেন,যাত্রাশেষে সবাই সুখী হয়।তবে একশ্রেণির মানুষ বাদে।যাদের ভাগ্যে কর্মফল অথবা রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার, এই দুটো ভারী শব্দ জুটে যায়।তাদের জীবনটাই চলে যায় অতীতের জমা-খরচ বিশ্লেষণ করতে করতে।বুঝলেন?”
—” সবার কথা বাদ দেও।শুধু নিজের কথা বলো।”
মহুয়া মৃদু শ্বাস ছাড়ে।
—” সাহিত্যের ছাত্ররা প্রেমিক হিসাবেও উপযুক্ত নয়, স্বামী হিসাবেও উপযুক্ত নয়।এদেরকে সব কথা কথা ভেঙে বলতে হয়।আপনি বুঝেন না আমি সুখী নাকি না?
তুষার কিছুই বলে না শুধু মুচকি হাসে।প্রেয়সীর কপালের মাঝ বরাবর উষ্ণ চুমু এঁকে দেয়।নিস্তব্ধ রাতের দূর আকাশের জ্বলজ্বলে নক্ষত্ররা এর নীরব সাক্ষী হয়ে রইলো।

(সমাপ্ত)

(অনভিজ্ঞ, অপটু হাতের লেখা।তবুও যারা সাথে ছিলেন, তাদেরকে অসংখ্য ধন্যবাদ।)

যাত্রাশেষে (পর্ব-১৭)

#যাত্রাশেষে (পর্ব-১৭)
#হালিমা রহমান

মৃত্যু, কর্মফল —এ দুটো অনিবার্য বিষয়।মানুষ এ দুটোকে কখনোই এড়াতে পারে না।বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণকেও সহজে এড়ানো যায় না।বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।একে অনেকটা অনিবার্য বিষয়ও বলা যায়।এই আকর্ষণকেই কখনো মোহ,কখনো মায়া আবার কখনো ভালোবাসার মতো শ্বাশত অনুভূতি নামে আখ্যায়িত করা হয়।
তুষারের অবস্থা নাজেহাল।ইদানীং কি যেন হয়েছে তার।ব্যবসায়ের কাজ দেখতে ইচ্ছা করে না,ঘুমাতে ইচ্ছা করে না,ঘরের বাইরে বের হতে ইচ্ছা করে না।সারাক্ষণ শুধু ঘরে থাকতেই ভালো লাগে।তার সুন্দর, সাজানো সংসারটাকে দু-চোখ ভরে দেখতে ইচ্ছা করে।কি সুন্দর সবকিছু!মেয়ে ভালো আছে,সে ভালো আছে,অর্ধাঙ্গিনী ভালো আছে।একটা ছোট্ট সংসারের সবকিছু গোছানো।এ বাড়িতে যখন নতুন এসেছিল,তখন ঘরগুলোতে দমবন্ধ অবস্থা ছিল।এখানে আসবাব,সেখানে আসবাব—সবকিছু এলোমেলো। রুবিনা বেগম চলে যাওয়ার পর, এক শুক্রবারে মহুয়া এসব টেনে টেনে বের করলো।এরকম দমবন্ধ অবস্থায় আর কিছুতেই না।তুষারকে নিয়ে সব ঘরের আসবাব গুছিয়েছে।খাট থেকে শুরু করে সোফা,ফ্রিজ সব।পাঁচ রুমের একটা ফ্ল্যাট গোছানো চাট্টিখানি কথা!ক্লান্তিতে,বিরক্তিতে তুষারের প্রাণ ওষ্ঠাগত। কিন্তু ঘর পুরোপুরি গোছানোর পর তুষার অবাক হয়ে পুরোটা দেখেছে।এই ছোট ফ্ল্যাটটা এতো সুন্দর!এই ঘরটাই বহু বছর আগ থেকে মহুয়ার পছন্দ।মহুয়া কি কখনো কল্পনা করেছিল, এই ঘরেই তার ভাগ্য বেঁধে যাবে?
মহুয়ার প্রতি অন্যরকম এক আকর্ষণ অনুভব করে তুষার।এই মেয়ের সব কিছুতে সে মুগ্ধ হয়।কখনো কথায়,কখনো বুদ্ধিতে,কখনো এলো চুলে,কখনো হাসিতে আবার কখনো শাড়ির ভাঁজে।তবে,তুষারের সবচেয়ে বেশি পছন্দ মহুয়ার পরিপক্বতা। মেয়েটা অতি মাত্রায় পরিপক্ব।সে যেন একটা পরিণত ফুল।কোনো কিছুতে ভণিতা নেই,ন্যাকামি নেই।তার সবকিছুই সহজ, সুন্দর,স্বাভাবিক।এই তো সেদিনের কথা।অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছিল তুষার। নাস্তা করে কিছুক্ষণ মেয়ের সাথে দুষ্টুমি করে,মহুয়ার সাথে বকবক করে আবারো বিছানায় শুয়ে পড়লো।তার ইচ্ছা, সে এখন ল্যাপটপে দোকানের সিসি টিভির ফুটেজ দেখবে।আজ আর দোকানে যাবে না।আজকাল খুব কাজচোর হয়েছে সে।বাড়ি থেকে বেরই হয় না।তুষার আয়েশ করে কোলের উপর ল্যাপটপ রেখে ফুটেজ দেখছিল।এভাবে বসে দেখতে ইচ্ছা করছে না।যদি হালকা কোনো খাবার অথবা টকটকে লাল শুকনো মরিচ দিয়ে কাঁচা আমের ভর্তা খাওয়া যেত, তবে দারুন হতো।মহুয়াকে গলা বাড়িয়ে ডাক দেওয়ার আগেই সে এসে হাজির।ঘর্মাক্ত শরীরে কচু পাতা রঙের একটা শাড়ি জড়ানো।তুষারের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে।মেয়েটাকে শাড়িতে খুব মানায়।

—” মহুয়া ঘরে আম থাকলে একটু ভর্তা বানিয়ে দেও না,প্লিজ।বেশি করে শুকনো মরিচ দিয়ো।আর তোমার কাজ থাকলে, আমাকে বটি আর আম দিয়ে যাও। আমি কেটে দেই।তুমি একটু মেখে দাও শুধু।”

তুষারের অনুরোধ পালন করলো না মহুয়া।বরং,কপাল কুঁচকে তুষারের সামনে বসলো।ল্যাপটপ বন্ধ করে বললঃ”আপনি এখনো বাসায় কেন?”

—” তো কোথায় থাকব আমি?”
—” আপনার ব্যবসা-বাণিজ্য নেই? সবকিছু কি ডোবানোর ইচ্ছা আছে?ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ ভাবতে হবে না?”
—” আরে,টেনশন করো না।এতোজন কর্মচারী থাকতে আবার আমার যাওয়া লাগে?তাছাড়া,আমি ঘরে বসেই দেখছি।তাহলে আর যাওয়ার কি দরকার।”
—” আরেকজনের উপর ভর দিয়ে যদি ব্যবসা হতো,তাহলে আর পৃথিবীতে চাকরিজীবী খুঁজে পাওয়া যেত না।এরকম ঘরে বসে থাকলে ব্যবসায়ে লাল বাতি জ্বলতে সময় লাগবে না।উঠুন,দোকানে যাবেন।উঠুন।আরে আশ্চর্য! শুয়ে পড়ছেন কেন?মিত্তির বাবা,উঠুন।”

তুষার বিরক্তি নিয়ে উঠে বসে।চোখ-মুখ কুঁচকে ফেললো একেবারে।

—” আমি নতুন ব্যবসায়ী না। আমি যখন অনার্স ফাইনাল ইয়ারে, তখন বাবা মারা গেছে।সেই তখন থেকে ব্যবসায়ের হাল ধরেছি।একটা দোকানের জায়গায় দুটো হয়েছে,ফ্ল্যাট হয়েছে।তুমি কি আমাকে যে সে ভাবছো নাকি?”
—” আপনি অনেক বড় কারবারি তা বুঝলাম।কিন্তু এখন কিছুতেই বাড়ি থাকতে পারবেন না।পুরুষ মানুষ ঘরের কোনে বসে থাকে?সারাদিন শুধু ঘর।এই আপনার বিরক্ত লাগে না?”

তুষার মাথা নাড়তে নাড়তে খাট থেকে নেমে পড়ে।মুখে দুষ্টুমির আভাস ফুটিয়ে তুলে বলেঃ” ঘরে নতুন বউ থাকলে কার যেতে ইচ্ছে করে?আমার একটামাত্র সুন্দরী বউ।যদি একা ঘরে ভয় পায়?”

—” ধান্দাবাজি বন্ধ করুন।সন্ধ্যা সাতটার আগে যেন বাড়ি ফিরতে না দেখি,খবরদার।”

মহুয়ার এসব অধিকারবোধ, কর্তৃত্ব খুব ভালো লাগে তুষারের।আবার মহুয়া যখন যত্ন করে তুষারের পছন্দের খাবার রান্না করে, তখনও ভালো লাগে।মনে হয় যেন,খাবার নয়।মহুয়ার ভালোবাসা খাচ্ছে সে।শুধু একটা জিনিস অপছন্দ।মহুয়াকে কখনো লজ্জা পেতে দেখেনি।নতুন বউয়েরা কোথায় স্বামীকে দেখলে লজ্জা পাবে, মুখ লুকাবে;তা না।এই মেয়ে কথায় কথায় উত্তর দেয়।এ যেন একটা পাথরের মূর্তি।একে ভাঙা গেলেও নিজের মতো করে তৈরি করে নেওয়া যাবে না।তবুও,নিজের মনে বসন্ত হাওয়ার খোঁজ পায় তুষার।সময়টা কি প্রনয়ের?অবশ্যই প্রণয়ের।নাহয় এই একত্রিশ বছর বয়সে এসে হঠাৎ মহুয়ার প্রতি এতো আকৃষ্ট হয়ে পড়বে কেন সে??

তুষারের মতিগতি খুব ভালো করেই বুঝতে পারে মহুয়া।তার উপর কারো চোখ আটকে থাকবে,চোখে একরাশ মুগ্ধতা থাকবে,ভীষণভাবে কেউ নির্ভর হয়ে পরবে—আর সে বুঝতে পারবে না?এটা কি সম্ভব?তুষারকে দেখে মহুয়ার হাসি পায় মাঝে মাঝে।বিয়ের মাস দেড়েকের মাঝেই কেউ এতোটা দুর্বল হয়ে পরতে পারে, তা তুষারকে না দেখলে বুঝতো না।মহুয়া হেঁটে গেলেও মনে হয় তুষার ব্যাথা পায়।মহুয়ার মাইগ্রেনের ঔষধ আর কয়টা আছে,কোন শাড়িটা পুরোনো হয়ে গেছে,কোন মাছ পছন্দ,বাইরের কোন খাবারটা মহুয়া দুই চোখে দেখতে পারে না, কোন ফুল পছন্দ, কখন মহুয়াকে কেমন দেখা যায়,নাকের উপর ঘাম জমলে ভালো লাগে নাকি মন্দ,মহুয়া কখন ভ্রু কুঁচকে তাকায়, কপালের তিলটাকে কখন সবচেয়ে বেশি সুন্দর দেখায়,কিভাবে হাসলে ঠোঁটের আধ ইঞ্চি নিচে একটু ভাঁজ পড়ে —এসব খবর তুষারের চাইতে আর কে বেশি রাখে? তুষার যেন মহুয়ার পায়ের আওয়াজও চিনে।মহুয়া আর মৃত্তিকাকে একসাথে দেখে কি সুন্দর করে হাসে সে! তুষারের গেজ দাঁতটা খুব পছন্দ মহুয়ার।যখন সে হাসে,তখন এর একাংশ একদম ঠোঁটের উপরে চলে আসে।আগের থেকে স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে এখন।তাই একটু বেশিই সুন্দর দেখা যায়। তুষারের প্রতি মহুয়া নিজেও খুব আকৃষ্ট। মানুষটা ভালো,ভদ্র।একজন ভালো অভিভাবকের সাথে,একজন ভালো বন্ধুও বটে।মহুয়াকে ভরসা করে,সম্মান করে,ভালোবাসে।মহুয়া নিজেও সাবলম্বী।জীবনে সুখী হওয়ার জন্য আর কি লাগে?আশপাশটা খুব রঙিন লাগে মহুয়ার।আজকাল মুখোমুখি ফ্ল্যাটের দিকে নজরও যায় না।কেন যাবে?ওটা ছলনা ছিল,এটা সত্যি।ওটা অশান্তি ছিল,এটা শান্তি।আবরার স্বপ্ন ভেঙেছে, তুষার গড়ার চেষ্টা করছে।তাহলে,অতীতের দিকে নজর পড়ার প্রশ্নই আসে না।প্রাক্তনে দেখে এখন মহুয়া প্রাণখুলে হাসতে পারে।এখন আর আবরারের সামনে বিব্রত হতে হয় না।আবরারকে অকারণে গালি দিতে ইচ্ছে হয় না।আবরারকে ক্ষমা করে দিয়েছে মহুয়া। এই পৃথিবীতে সবাই সুখী থাকতে চায়।আবরার যদি অনন্যাকে নিয়ে সুখী হয়, তবে হোক।ওর প্রতি রাগ পুষে রেখে মহুয়ারই বা কি লাভ হবে?তার চেয়ে সব ভুলে,তুষারের সাথে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করলেই হয়।মহুয়া এখন খুব সুখী।

—” আম্মাম্মাম্মা….”

মৃত্তিকার ডাক শুনে মৃদু হাসে মহুয়া।এই মেয়েটা তাদের পূর্ণতা। একসপ্তাহ ধরে সে মাকে এভাবেই ডাকে।মৃত্তিকা মা ডাকতে জানতো না।মহুয়া মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তাকে শিখিয়েছে।এখন সারাক্ষণ মায়ের নাম জপ করে মৃত্তিকা।মহুয়া টেনে কোলে নেয় মৃত্তিকাকে।দু-গালে চুমু দেয়।তারপর গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বারান্দায় চলে যায়।বিকেলের দিকে এদিকটায় কেউ থাকে না।তাই মহুয়ার কোনো বাধা নেই।নিজের এতো সুন্দর পরিস্থিতি দেখে মাঝে মাঝে সে নিজেই অবাক হয়।দ্বিতীয়বার একসমুদ্র সুখ পাবে বলেই হয়তো প্রথমবার কাঁদতে হয়েছে।সত্যিই সৃষ্টিকর্তার পরিকল্পনা বুঝা মুশকিল।ভাগ্যে তিনি সুখই রেখেছেন।শুধু মাঝখানে একটা দুঃস্বপ্নকে এনে অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছেন।

***

রাতের খাবার গরম করছিলো মহুয়া।আজ তুষারের ফিরতে দেরি হয়েছে।সে হাত-মুখ ধুয়ে মেয়ের সাথে খেলছে।
মহুয়ার দেরি দেখে তুষার কিছুক্ষণ পরেই রান্নাঘরে এলো।হেলান দিয়ে দাঁড়ালো দেয়ালের সাথে।মহুয়া একনজর তাকালেও পাত্তা দিল না।সে জানে তুষার কিছুক্ষণ নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে থাকবে,তারপর কিছুক্ষণ বকবক করে বিরক্ত করবে।এগুলো তার প্রতিদিনের রুটিন।

—” মহুয়া,কালকে বিকালে আমরা এক জায়গায় যাব।তুমি তৈরি থাকবে, ঠিকাছে?”
—” কোথায় যাব?”
—” অনেক জায়গায়।এখন বলতে পারব না।”
—” না বললে নাই।”

তুষার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে বউকে দেখে।শুকনো কাঠাল বিচির উপরের সাদা আস্তরন ফেলে দিলে যেরকম রঙ হয়,ঠিক সেই রঙের একটা সুতি শাড়ি গায়ে।আঁচলের দিকটা সাদা।মহুয়াকে এই মুহূর্তে তার কাছে একটা কাঠাল বিচির মতো লাগছে।অর্ধেক ছিলে রাখা একটা কাঁঠাল বিচি।শুকনো কাঁঠাল বিচি দিয়ে শুটকির তরকারি খুব পছন্দ তুষারের।মহুয়াকেও তো কাঁঠাল বিচির মতোই দেখা যাচ্ছে।ওকে যদি শুটকি দিয়ে রেঁধে খেয়ে ফেলা যেত,তবে তাই করতো তুষার।এমন উদ্ভট একটা কথা মনে আসার পরমুহূর্তে, নিজেই হেসে ফেললো তুষার।তার হাসির শব্দ কানে আসায় ভ্রু কুঁচকে তাকায় মহুয়া।

—” কি সমস্যা?”
—” তোমাকে শুটকি দিয়ে রেঁধে খাব।ঘরে শুটকি আছে?”

আর দাঁড়ায় না তুষার। রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে যায়।মহুয়াও খুব বেশি একটা গুরুত্ব দেয় না তুষারের কথায়।তুষার মাঝে মাঝে অসংলগ্ন কথা বলে।এই স্বভাবের সাথে খুব পরিচিত মহুয়া।

মহুয়া প্রায় ঘুমিয়েই গিয়েছিল।এমন সময় কাঁধে মৃদু ধাক্কা দিয়ে তাকে ডেকে তুলে তুষার।

—” এই মহুয়া,মহুয়া।উঠো।”
—” আপনার সমস্যা আসলে কোথায়, মিত্তির বাবা।আজকে আবার কি?আমার ঘুমের সাথে খুবই শত্রুতা করেন আপনি।”

মহুয়াকে একটানে উঠে বসায় তুষার।তারপর বেশ আবদারের সুরে বলেঃ”চলো বারান্দায় যেয়ে বসি।আমার ঘুম আসছে না।”
—” একা যান।অসহ্য বিরক্তিকর একটা লোক।মাঝরাতে শয়তানে ধরে আপনারে?”

মহুয়া আবারো শুয়ে পড়তে চেয়েছিল।কিন্তু তাকে সে সুযোগ দিলো না তুষার।টেনে হিঁচড়ে বারান্দায় নিয়ে গেল।মহুয়ার হাতে একটা ছুরি থাকলে সে নিশ্চিত তা তুষারের গলায় ধরতো।ফাইজলামির একটা সীমা-পরিসীমা থাকা উচিত।
নিজে বারান্দার ফ্লোরে বসে মহুয়াকেও টেনে পাশে বসালো তুষার।এভাবে বসাটা বেশ কষ্টকর। তাই দু-তিনটে চেয়ার কিনবে।তাহলে আরামে বসা যাবে।মহুয়ার মাথা নিজের কাঁধে চেপে ধরে।
এলোমেলো চুলগুলোতে সযত্নে হাত বুলাতে বুলাতে বলেঃ”আত্মসমর্পণের জন্য ডাকলাম তোমায়।রাগ করো না, প্লিজ।”
—” এভাবে গরমের মধ্যে কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বসে থাকে।মাঝে মাঝে রাতের বেলা কি হয় আপনার?”
—” বউয়ের কাছে আবদার করতে ইচ্ছা হয়।আচ্ছা,এবার মনোযোগ দিয়ে শোনো।আত্মসমর্পণের মন্ত্র বলি তোমায়।”
—” কিছু শুনবো না আমি।ঘুম পেয়েছে,ঘুমাব।”
—” আরে,শুনেই যাও।না শুনলে পরে আফসোস করতে হবে।”

বিরক্তিতে শরীর ছেড়ে দেয় মহুয়া।
—“ঠিক আছে,বলুন।”
—” ভালোবাসি, মহুয়া।একদম মহুয়ার পালার সেই নদের চাঁদের মতো ভালোবাসি।”

মুখে হাসি ফুটে মহুয়ার।জানা কথাটাই তুষারের মুখ থেকে শুনতে কি ভালো লাগলো!মহুয়াকে আর কেউ কখনো এরকমভাবে বলেছে?উঁহু, কেউ বলেনি।

—” মহুয়া? ”
—” হুম।”
—” কেমন লাগলো?”
—“ভালো। কিন্তু নদের চাঁদের সাথে তুলনা করলেন কেন নিজেকে?নদের চাঁদ যুগে যুগে আসে?”
—” তুমি মহুয়া তাই।নদের চাঁদরা যুগে যুগেই আসে।কেবল ভিন্নরূপে।এবার তুমি উত্তর দাও?”
—” কিসের?”
—” ভালোবাসো?”

মহুয়া অন্ধকারেই মুচকি হাসে।তুষারের কাধেঁর ভিতর নিজের মাথাটাকে আরেকটু গুজে দেয়।

—” বুঝতে পারেন না?”
—” উঁহু। ”
—” আত্মসমর্পণের মন্ত্র না জানলে আপনার উপর আমার এতো অধিকারবোধ,কর্তৃত্ব কোথা থেকে আসে?সাহিত্যের ছাত্রকে সবকিছু ভেঙে বুঝাতে হয় কেন?”

মহুয়ার প্রশ্নের উত্তর দেয় না তুষার।বরং,মুচকি হেসে মহুয়াকে আরো একটু জড়িয়ে ধরে।আজ সে বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।আচ্ছা এই যে তুষারের হৃৎপিণ্ডে খুশিরা দামামা বাজাচ্ছে,তা কি মহুয়া অনুভব করতে পারছে?বুঝতে পারছে,তার হৃদয়ের জয়ধ্বনী?

***

ঘড়ির কাটায় প্রায় সাড়ে পাঁচটা বাজে।তুষার মৃত্তিকাকে কোলে নিয়ে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।বউ-মেয়েকে নিয়ে আজ একটু ঘুরতে যাবে।অনেককিছু কেনাকাটা করতে হবে আজ।কিন্তু প্রায় পনেরো মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পরেও কোনো রিকশা পেল না।বিরক্তিতে শরীর অবশ হয়ে আসছে তুষারের।অন্যান্য দিন রিকশার অভাব থাকে না।অথচ, আজকেই পৃথিবীতে আকাল পড়েছে সবকিছুর।অসহ্য!
আরো মিনিট দশেক পর একটা রিকশা এসে থামলো তুষারের সামনে।আরোহীর আসনে আবরার ছিল।সে হয়তো ব্যাংক থেকে এসেছে।তুষারকে দেখে আবরার এগিয়ে গেল।

—” কি ব্যাপার, তুষার ভাই?মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন যে?”
—” একটু ঘুরতে যাব। কিন্তু রিকশাই পাচ্ছি না।”
—” এটা নিয়ে যান।দূরে কোথাও যাবেন নাকি?”
—” হ্যাঁ, একটু দূরেই যাব।বউয়ের পাখি আর গাছের শখ।ওগুলো কিনতে যাব।তাছাড়া, মেয়ের কিছু খেলনাও লাগবে।অনেকদিন পর বের হলাম।তাই অনেকটাই ঘুরে আসব।”

আবরারের মনে হলো, তুষার মায়ের কাছে মাসির গল্প করছে।মহুয়ার শখগুলো তো সব পরিচিত তার।তাহলে,এতো ফলাও করে বলার কি আছে?লোকটা বোধহয় জানে না ওদের সম্পর্কের কথা।তাই এতো সহজে আবরারের সাথে মিশতে পারে।
আবরারের চিন্তা কাটলো মহুয়াকে দেখে।সে হয়তো এতোক্ষণ গেটের ভিতরে ছিল।খয়েরী রঙের শাড়ি পরা মাঝারি গড়নের মেয়েটাকে আজ নতুন লাগছে আবরারের চোখে। মেয়েটার মুখে যেন সুখ ও হাসি লেপ্টে আছে।তবে কি তার সব স্বপ্ন পূরণ হয়ে গেছে?
মহুয়াকে রিকশায় বসতে সাহায্য করলো তুষার।তারপর নিজেও উঠে বসলো মেয়েকে নিয়ে।আবরারের চোখের সামনে দিয়েই চলে গেল রিকশাটা।তবুও আবরার সেদিকেই চেয়ে রইলো। তার মানসপটে ভেসে উঠলো তিনজনের সেই সুখী মুখ।অসুখী মানুষদের চোখে সুখী মানুষরা সহজেই ধরা পড়ে।আবরার অসুখী।তাই তুষার-মহুয়ার সুখছবিও ধরা পড়তে খুব বেশি সময় লাগে না।আবরার ঈর্ষাপরায়ণ নয়।তাই মুখে হাসি ফুটানোর চেষ্টা করে।কিন্তু আজ আর হচ্ছে না।মনের একাংশ যেন বারবার ঘোষণা করছে—” তুমিও এমন সুখী হতে পারতে।এরকম তিনজনের একটা ছোট্ট পরিবার তোমারও থাকতে পারতো।মহুয়ার পাশের মানুষটা আজ তুমিও হতে পারতে।”
আবরার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ির গেটের দিকে পা বাড়ায়।মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত।একদিন যাকে মোহ বলে অপমান করেছিল, আজ সেই মানুষটার কাছেই আবার ছুটে যেতে ইচ্ছা করছে।অনন্যা আগের মতো নেই।আগে তো শুধু বিয়ে নিয়ে উদাসীন ছিল।এখন সংসার নিয়েও উদাসীন।আবরারের জন্য একটু সময় তার ঝুলিতে নেই।সে ভীষণ ব্যস্ত।আর আবরার ভীষণ একা।অনন্যাকে দেখলে তার একটা কথাই মাথায় আসে।অনন্যা বোধহয় মুক্ত খাচার পাখি।এরা কখনোই নীড় বাধে না।।।

চলবে…..

যাত্রাশেষে (পর্ব-১৬)

#যাত্রাশেষে (পর্ব-১৬)
#হালিমা রহমান।

তুষার বয়কট করেছে মহুয়াকে।একদম ভয়াবহ বয়কট।কথা বলছে না,আশেপাশে থাকছে না,তাকাচ্ছে না।মহুয়ার কাছ থেকে মৃত্তিকাকেও জোর করে টেনে নিয়ে গেছে।তাদের বিয়ে হয়েছে, প্রায় পনেরো দিন হয়ে গেছে।এই কয়েক দিনে মৃত্তিকার কাজগুলো মহুয়াই করতো।তুষারও খুব বেশি নজর দিত না এদিকে।মা-মেয়ে যেভাবে থাকলে কাছাকাছি থাকতে পারবে সেভাবেই থাকুক।মহুয়ার অনেক কাছাকাছি থাকার কারণে, এখন অনেকটাই মা নেওটা হয়ে গেছে মৃত্তিকা।মা তার সারাদিনের খেলার সাথী।মৃত্তিকা সারাদিন মহুয়ার সাথেই লেপ্টে থাকে।মহুয়া যখন রান্না করে তখন মৃত্তিকা রান্নাঘরের ফ্লোরে বসে থাকে।মহুয়া কাটাকাটি করতে গেলে মৃত্তিকাও তার পাশে বসে পিঁয়াজ-রসুন এলোমেলো করে ফেলে।অনেক সময় মৃত্তিকাকে এককাঁখে নিয়ে রান্না সারতে হয়।মহুয়া এখন পাঁচ মিনিটে গোসল সাড়ে।মেয়ের দুঃশ্চিন্তায় একদম মরে যায় সে।এমনকি নামাজের সময়ও মৃত্তিকা জায়নামাজের পাশে থাকে।তাই মহুয়া তাকে প্যাম্পার্স পরিয়ে রাখে।কখনো কখনো আবার মহুয়ার সেজদার জায়গায় চলে আসে হামাগুড়ি দিয়ে।গোলগোল চোখ করে মাকে নামাজ পড়তে দেখে।মহুয়া সেজদা দিতে গেলে পিঠ ধরে দাঁড়িয়ে যায় মৃত্তিকা।এসব খুব ভালো লাগে মহুয়ার।ইচ্ছে করে মেয়েটাকে একেবারে জাপটে ধরে রাখতে।একদম পাখির ছানার মতো।একটা বাচ্চার অনেক শখ মহুয়ার।যতবার মহুয়া মৃত্তিকাকে আদর করে,ততোবার মৃত্তিকাও নিজেকে যেন সঁপে দেয় মায়ের কাছে।একেবারে মায়ের বুকের সাথে লেপ্টে থাকে।মা-মেয়ের এই সম্পর্ক দুচোখ ভরে দেখে তুষার।আজকাল নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হয়।তারও একটা রাজ্য আছে।সেখানে একটা আদুরে রাজকন্যা আছে। একটা গম্ভীর রানী আছে।মৃত্তিকা-মহুয়া যখন কাছাকাছি থাকে তখন মহুয়ার মুখ খুব উজ্জ্বল হয়ে উঠে। ঠোঁটের কোন থেকে হাসি সরেই না।তুষার কখনো কখনো খুব আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থাকে।বাচ্চাদের প্রতি মহুয়ার দুর্বলতার কথা সে জানতো।কিন্তু,মহুয়ার আচরণ দেখে তার মাথায় একটাই চিন্তা খেলে যায়।একটা ছোট্ট শিশু শুধু মহুয়ার শখ ছিল নাকি আকুলতা ছিল?মানুষ অনেক লোভনীয় কিছু পেলে যেমন দিশাহারা হয়ে যায়, মহুয়াও ঠিক তেমন।মৃত্তিকাকে পেয়ে সে কি করবে না করবে ঠিক করতে পারছে না যেন।মহুয়া কি খুব লোভী?কিসের এতো লোভ তার?মাতৃত্বের?

বিপত্তি ঘটলো আজ সকালে।শুক্রবার হলেও ফজরের নামাজ পড়তে পারেনি ওরা।কাল তুষারের খালা-খালু বাংলাদেশ ছেড়েছে।তাদেরকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এসেছে ওরা।ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেছে।তাই না খেয়ে ক্লান্ত হয়েই শুয়ে পড়েছিল দুজনে।সেই ঘুম ভেঙেছে সকাল নয়টায়।মৃত্তিকাকে ঘুম থেকে থেকে তুলে, তাকে তৈরি করে,খাবার খাইয়ে ;মহুয়ার আর ইচ্ছে করলো না নাস্তা বানাতে।তাই তুষারকেই ঘুম থেকে টেনে তুলে দোকান থেকে নাস্তা আনতে পাঠালো।তুষারের কিছু টিশার্ট, ট্রাউজার ধোয়া লাগবে।সকাল সকাল সেগুলো ভিজিয়ে রাখলো।ঘর ঝাড়ু দিল।দুপুরের জন্য ফ্রিজ থেকে মাছ নামিয়ে, ভাত বসিয়ে দিল চুলায়।এখানে একটু বেলা হলেই আর গ্যাস থাকে না।কালকে একটানা অনেক্ষণ বসে ছিল।তাই সকাল থেকে পা ব্যাথা করছে।নাস্তা খেয়েই একটা ব্যাথার ঔষধ খেতে হবে।নাহয় আর বাঁচবেই না মহুয়া।
দোকানে অনেক ভীড় থাকায় তুষারের বেশ দেরি হলো ঘরে ফিরতে।দুজনে একসাথে নাস্তা করার পর, মহুয়া কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।তুষার বসে পড়লো মোবাইল নিয়ে।ইদানীং, ওর কাজ কমে গেছে।পাতাল মার্কেটের দোকানটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছে।একসাথে দুটো দোকান চালানো খুবই কষ্টকর।ঘরে একদম সময় দিতে পারে না।তুষার আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে চায় না।স্ত্রী-সন্তানকে সর্বোচ্চ সময় দিতে চায় সে।টাকার পিছনে দৌড়ে কি লাভ,যদি পারিবারিক বন্ধনটাই না থাকে?গুলিস্তানের দোকানটাতেও চারজন কর্মচারী। তাই তুষারের কাজ অনেকটাই কমে গেছে।সারা দোকানে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছে।ঘরে বসেই কাজ তদারক করা যায়।পাতাল মার্কেটের দোকান থেকেও মাস শেষে ভালোই ভাড়া আসে।দিনগুলো বেশ কেটে যায় এখন।তুষারের প্রায়ই গলা ছেড়ে গান গাইতে ইচ্ছা করে।আহ! আশেপাশে এতো সুখ কেন?

মহুয়া রান্না চাপিয়ে তুষারের পাশে এসে বসলো।দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না।ঔষধ খাওয়ার পরেও কমলো না কেন?
তুষার ফোন রেখে বউয়ের দিকে নজর দেয়।দুজনের মাঝে মৃত্তিকা।মহুয়াকে দেখেই মৃত্তিকা তার কাছে চলে যায়।মায়ের কানের দুল নিয়ে খেলতে শুরু করে। তার খুব প্রিয় খেলা এটা।মহুয়াকে শরীর ছেড়ে দিতে দেখে রীতিমতো অবাক হলো তুষার।মেয়েটা অলস নয়।একটু কাজ করেই হাঁপিয়ে যায় না।আজ কি হলো? অসুস্থ নাকি?

—” কি হয়েছে,মহুয়া?অসুস্থ?
—” উঁহু।”
—” তাহলে?”
—” পা ব্যাথা করছে খুব। অনেকদিন পরে অনেক হেঁটেছি না কালকে।ব্যাথা করছে।”
—” ঔষধ খেয়েছ?”
—” হুম।”
—” কমে যাবে, চিন্তা করো না।আজ আর রান্না ঘরের দিকে যেয়ো না।কি বসিয়েছো?আমি দেখতে পারব না?”
—” চিংড়ি মাছ দিয়ে মিষ্টি কুমড়ো,করলা ভাজি।আর মিত্তির জন্য ঝাল ছাড়া মাংস।আপনি এগুলো রাঁধতে পারবেন না।খামোখা ওদিকে যেয়ে তরকারি নষ্ট করার দরকার নেই।”

মহুয়া বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।তুষারও ওর পাশে আধশোয়া হয়ে বসে।গালে হাত দিয়ে বলেঃ” তুমি চাকরি করবে কিভাবে,বলো তো?ঘরের কাজ সামলে একটু ঘুরতে গেলেই এই অবস্থা।আর যখন রান্নাবান্না শেষ করে মাস্টারি করতে যাবে,আবার দুপুরে এসে মিত্তিকে ধরতে হবে,দম ফালানোর সুযোগ পাবে না,তখন কি করবে?আল্লাহ মালুম।”

মহুয়াও তুষারের মতো বালিশে ভর দিয়ে একটু উঠে বসে।অবাক গলায় প্রশ্ন করেঃ” আমি চাকরী করব তা আপনাকে কে বলল?আমি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি না?”

—” হ্যাঁ, সেটাতো আজিমপুরে বলে।এখানে স্কুলে জয়েন করবে না?”

—” কেন!”— বেশ অবাক হয়ে যায় তুষার।হঠাৎ চাকরি করবে না কেন?
হুট করেই মহুয়ার কি যেন হলো।সে আউটসোর্সিংয়ের কথা খুলে বলল না তুষারকে।ঠোঁটের কোনে হাসি টেনে বললঃ” মেয়ের জন্য বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছেন।আমাকে খাওয়াচ্ছেন,পরাচ্ছেন।আমিই যদি চাকরি করি তবে মেয়ে রাখবে কে?আমার খানিকটা হলেও জ্ঞান-বুদ্ধি আছে।”

তুষারের কানে যেন কেউ সিসা গলিয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে।বিরক্তিতে সর্বাঙ্গ ঝিমঝিম করতে লাগলো।এ নিয়ে বিয়ের আগেই ঝামেলা-টামেলা চুকে গেছে।আজ আবার কেন?মহুয়ার কথাগুলো যতটা বিরক্তিকর তার চাইতে কথা বলার ধরন আরো বেশি অসহ্য।মহুয়ার মনে এসব চলে?মৃত্তিকাকে কেন এতো আদর করে তবে?সব কি শুধু তুষারের সেই কথার জন্য! হতভম্ব হয়ে যায় তুষার।মহুয়ার প্রতি এক আকাশ অভিমান নিয়ে ঝট করে নিচে নেমে দাঁড়ায়।তীব্র আক্রোশ ফুটিয়ে তুলে গলায়।

—” আমি আমার মেয়ের জন্য মা এনেছি,আয়া নয়।শুধুমাত্র মেয়ের খেয়াল রাখার জন্য বিয়ে করতে হতো না।টাকা দিয়ে আয়াই রাখতে পারতাম।তাছাড়া, তুমি যেই কথা নিয়ে খোটা দিলে তা আমি কেন বলেছি, তার কৈফিয়ত আগেই দিয়েছি।তাহলে আজ আবার কেন, মহুয়া?সেদিন পার্কে আমি সব বলিনি তোমাকে?তোমার মনে এরকম কোনো চিন্তা-ভাবনা থাকলে সেদিনই বলতে।আমি তোমাকে বিয়ের আগে দেখিনি?আমি জানি না যে তুমি চাকরিজীবী মেয়ে?চাকরি করায় আপত্তি থাকলে আমি তো তখনই বলতাম তোমাকে। মেয়ে-বউকে সময় দেওয়ার জন্য একটা দোকান ভাড়া দিয়ে দিলাম।দোকানে কর্মচারী বাড়িয়ে ফেললাম।এতে কতো খরচ বেড়েছে জানো তুমি?তবুও সবকিছু মেনে নিলাম।বউ চাকরিতে জয়েন করলে যেন মেয়েকে সময় দিতে পারি, এজন্য আগেভাগেই সব গুছিয়ে রাখছি।এতো কিছুর পরেও কিভাবে বললে এমন কথা?আজ এটা বলেছ।মৃত্তিকার প্রতি আকর্ষণ কমে গেলে তখন কি বলবে?তখন তো বলবে, মিত্তির জন্য তোমার ক্যারিয়ার হলো না।এসব তো আমি মেনে নিব না।আজ থেকে মেয়েকে প্রয়োজনের বাইরে ধরারও দরকার নেই।আমার মেয়েকে আমি নিজেই রাখতে পারব।”

আশ্চর্যের বিষয় হলো, মহুয়া একবারো শোয়া থেকে উঠলো না।সে শুধু চুপচাপ তুষারের মুখের দিকে চেয়ে রইলো।তুষারের মুখে গভীর বিষাদের ছাপ।চোখদুটো যেন অভিমানে ভরে গেছে।খুব রাগ করেছে তুষার?কিন্তু খুব বেশি সময় এমন নির্বিকারভাবে থাকতে পারলো না মহুয়া।যখন তুষার মহুয়ার গায়ের উপর থেকে মৃত্তিকাকে টেনে নিয়ে গেল,তখন লাফ দিয়ে উঠে বসলো।এই লোক এতো পাষণ্ড কেন!মহুয়া পিছন থেকে টেনে ধরলো তুষারের হাত।

—” এতো রাগ করছেন কেন?আমার কথা শুনুন। আমি একটা কারণে এমন….”

তুষার শুনলো না মহুয়ার কথা।মহুয়ার হাত সরিয়ে, মেয়েকে নিয়ে ধপধপ করে ঘর ছাড়লো।হতাশ হয়ে বসে পড়লো মহুয়া।কি দরকার ছিল আগুন লাগানোর?মাঝে মাঝে তার কি যে হয়!!!

***

মেয়েকে নিয়ে রাস্তায় বেড়িয়েছে তুষার।কড়া রোদ আকাশে।তুষারের চোখ-মুখ জ্বলে যাচ্ছে।এমনিতেই রোদ সহ্য করতে পারে না সে।মৃত্তিকা আশপাশ দেখছে।এই মেয়েটার কৌতুহলের শেষ নেই!মহুয়ার সাথে ঝামেলা না হলে কোনোভাবেই এরকম গরমে বাইরে বের হতো না তুষার।মেয়েকে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে কখন যে বাজারে চলে এলো তার খেয়ালই নেই।আশেপাশে মানুষ গিজগিজ করছে।সারি সারি মাছ বিক্রেতা বসেছে মাছের পাতিল নিয়ে।বড় বড় কৈ মাছ দেখে চোখ আটকে গেল তুষারের।কৈ মাছ সে খুব একটা পছন্দ করে না।কিন্তু মহুয়ার খুব পছন্দ।এর মাঝে একদিন কিনেছিল এই মাছ।মহুয়া কড়কড়া করে ভেজে রেখেছিল সব মাছ।তুষারের পাতে মাছ দিলেও নিজের পাতে নেয়নি।ভাত খাওয়ার পরে হেঁটে হেঁটে মাছ খেয়েছে।বিড়ালের মতো কাঁটাসহ চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়েছে।মহুয়ার এতো পছন্দ দেখে তুষার রাতে আর খায়নি।তার ভাগের মাছটাও মহুয়ার জন্য রেখে দিয়েছিল।রাতে শোয়ার আগে আবারো একইভাবে খেয়েছে।সেদিনই বুঝেছিল মহুয়ার খুব পছন্দ এই মাছ।কয়েক কেজি কিনে নিবে?বেশ তাজা মাছগুলো।

—” ভাই,সরেন।রাস্তার মাঝে খাড়ায়া আছেন কেন?”

এক লোকের বিরক্তিমাখা গলার স্বরে বিব্রত হলো তুষার।ভুল স্বীকার করে তাড়াতাড়ি সরে দাঁড়ালো রাস্তা থেকে।আবারো মহুয়ার উপর রাগ উঠলো।মেয়েটা নিশ্চিত একটা জাদুকরী।নাহয় সারাক্ষণ মনে পড়বে কেন ওর কথা?সামান্য কৈ মাছ দেখেই রাস্তার মাঝে মহুয়ার কথা মনে পড়ে গেল?আজব!ঘর,মন, মাথা সবকিছু একদম দখল করে রেখেছে।
“ফাজিল মেয়ে।সবকিছুতে দখলদারি।বেয়াদব।”—মনে মনে আরো কয়েকটা ভদ্র, নরম, আদুরে গালি দিল মহুয়াকে।কপাল কুঁচকে মেয়েকে নিয়ে বাজারের বাইরে পা বাড়ালো।কিন্তু মনটা খচখচ করতে লাগলো খুব।কৈ মাছ কিনে নিলে খুব ভালো হতো না?মহুয়া তো খুব পছন্দ করে।

***

বেলা বারোটা বাজলেও যখন তুষার মেয়েকে নিয়ে ফিরলো না, তখন খুব খারাপ লাগলো মহুয়ার।খুব বেশি করে ফেলেছে, সেটা নিজেই বুঝতে পেরেছে।একবার ফোন দিয়েই দেখা যাক তুষারকে।কোথায় ঘুরছে কে জানে!মহুয়া রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো।বাইরে প্রখর রোদ।মেয়েকে নিয়ে বাইরে বাইরে ঘুরার দরকার আছে?ঘর-বাড়ি নেই?মহুয়া কি পুরো ঘর দখল করে রেখেছে?চুলার আঁচ কমিয়ে মহুয়া ফোন হাতে নিল।কিন্তু পাঁচবারের সময়ও যখন তুষার ফোন ধরলো না, তখন বিরক্তিতে ভিতরটা তেতো হয়ে গেল মহুয়ার।রাগ দেখিয়ে যাবি,যা।কিন্তু মেয়েকে নিয়ে যেতে হবে জেন তোর?মৃত্তিকার এই সময়ে ক্ষুধা পায়।এটা তার নুডলস খাওয়ার সময়।খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।অথচ, এই লোক বলদের মতো মেয়েকে নিয়ে বিশ্বভ্রমনে বেড়িয়েছে।আজব!
টানা আটবারের বেলায় ফোন ধরলো তুষার।মহুয়ার বিরক্তি তখন রাগের রূপি নিয়েছে।পুরুষ মানুষের আবার এতো ঢং কীসের।তাই ফোন ধরতেই ঝাঝালো গলায় বললঃ” কোথায় আপনি?”
—” তোমার কি দরকার?”
—” যা জিজ্ঞেস করেছি তা বলুন।মেয়েকে নিয়ে রোদে রোদে কেন ঘুরছেন?বাড়ি আসুন।মেয়ের খাওয়ার সময় না এখন?যদি কান্না করেছে, খবর আছে আপনার।”—মহুয়ার গলায় আলাদা অধিকারবোধ।
—” আসব না এখন।”
—” ঠিক আছে, তাহলে আমিও বেড়িয়ে যাচ্ছি।ঘরের চাবি পাশের ঘরে।খাইষ্টা লোক।”

খট করে ফোন রেখে দেয় মহুয়া।মনে মনে তুষারকে আরো জঘন্য কিছু গালি দেয়।সবকিছু বেশি বুঝে।অসহ্য একটা মানুষ।

তুষার বাড়ি ফিরলো পৌনে একটায়।হাতে কেজি কয়েক মাছ,কোলে ঘর্মাক্ত মৃত্তিকা।মহুয়া তখন সবে গোসলে ঢুকছিল।তুষারকে দেখে মেয়েকে খপ করে নিয়ে নেয়।শাড়ির আঁচল দিয়ে মেয়ের মুখ মুছে দেয়।আড়চোখে একবার তাকায় তুষারের দিকে।থমথমে মুখ পুরো লাল হয়ে আছে।টিশার্টের সামনে-পিছনে অর্ধেকটাই ভিজে গেছে।মহুয়া তাকালেও তুষার তাকালো না।মাছের পলিথিন ঠাস করে মেঝেতে ফেলে গটগট করে বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিল।মাছ দেখে মহুয়া হেসে ফেললো।বউয়ের সাথে রাগ করে বউয়ের পছন্দের মাছই নিয়ে এসেছে।আবার কষ্ট যাতে না হয় তাই কেটে এনেছে।ব্যাটা আবুল! এ কেমন রাগ!
দুপুর হওয়ায় মৃত্তিকাকে গোসল করিয়ে খাইয়ে,ঘুম পাড়িয়ে দিল।পা ব্যাথা কমেনি মহুয়ার।আজকাল কি সব ঔষধ যে বাজারে আসে।কোনো কাজেরই না।ব্যাথার তীব্রতায় মৃত্তিকার পাশে কিছুক্ষণ শুয়ে রইলো মহুয়া।পায়ের ব্যাথা সারবে না জানলে আজ আর কাপড়গুলো সাবানে ভিজাতো না।তুষারের এইসব ভারী জামা-কাপড় ধুতে আজ বেশ কষ্ট হবে।এদিকে তুষার এখনো বের হচ্ছে না।কি করছে এতোক্ষণ বাথরুমে?মহুয়া উঠে কয়েকবার দরজায় আঘাত করলো।গলা উঁচিয়ে ডাকলো বেশ কয়েকবার।

—” মিত্তির বাবা,আজ আর বের হবেন না?খাবার-দাবার দিয়ে যাব এখানে?ভাত ঘুমের জন্য বালিশও
দেই।খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়বেন এখানেই।দেব?”

মহুয়ার কথায় বিরক্তিতে দম আটকে আসলো তুষারের। কি হয়েছে আজ তার?ভূতে-টুতে ধরলো নাকি।একরাশ বিরক্তি আর হাতের বালতি ভর্তি কাপড় নিয়ে বের হলো তুষার।কাপড়গুলো ধুতেই এতো সময় লাগলো।মহুয়ার পা ব্যাথার কথা মনে আছে তার।বাইরে বেড়িয়ে মহুয়াকে দেখেই নাকের পাটা ফুলিয়ে ফেললো তুষার।তুষারের হাতে কাপড় দেখে বেশ স্বস্তি পেল মহুয়া।যাক জ্ঞান-বুদ্ধি আছে তাহলে।তুষারের দিকে তাকিয়ে মহুয়া মুচকি হাসলো।

—” রেগে থাকলে এতো কাজ করেন আপনি!বাহ!দারুন ব্যক্তিত্ব।আজ থেকে আপনি সারাক্ষণ রেগে থাকবেন,প্লিজ।আমি শুধু মেয়েটাকে নিয়ে থাকব।”

মহুয়ার দিকে অগ্নিচোখে তাকিয়ে ঘর ছাড়লো তুষার।যদি চোখে সত্যিকার আগুন থাকতো তবে নিশ্চিত আজ মহুয়া পটল তুলতো।

জুমার নামাজ শেষ করে তুষার যখন ঘরে ঢুকলো, তখন মহুয়া নামাজ পড়ছে।তাই সেদিকে আর গেল না তুষার।মেয়েটাকে আজ ভিন্ন লাগছে।তুষারের কাছে মহুয়া ছিল গম্ভীর,বুদ্ধিমতি।কিন্তু,আজ ওর আচরণ যেন ভিন্ন।সদ্য কৈশোরে পা দিলে কিশোরীরা যেমন প্রাণোচ্ছল হয়ে ওঠে,মহুয়াও ঠিক তেমন।হঠাৎ করে প্রাণের সন্ধান কোথায় পেলো সে?
তুষার মৃত্তিকার পাশ ঘেষে শুয়ে পড়লো।বেশ কিছুক্ষণের মধ্যে চোখ লেগে আসে তার।আবার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুম ভেঙেও যায়।মহুয়া এসে পাশে বসেছে।শুধু বসেনি, তুষারের কাঁধে রীতিমতো ধাক্কা দেওয়া শুরু করেছে।তুষার চরম বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে।

—” কি সমস্যা, মহুয়া?”
—” ক্ষুধা পেয়েছে।ভাত খাব।”
—” আমি কি ভাত-তরকারি নিয়ে বসে আছি?খেয়ে নেও।”
—“আপনিও খাবেন। চলুন।এখন কীসের ঘুম?ভাত খেয়ে ঘুমাবেন।”

খুন বিরক্ত হয় তুষার। উঠে একদম মুখোমুখি বসে মহুয়ার।

—” আমি তোমার উপর রেগে আছি,বুঝতে পারছো?”
—” রাগ আমার উপর।ভাত কি করলো?ভাত খাবেন না কেন?”
—” খাব না আমি।তুমি খেয়ে নেও।”
—-” ঠিকাছে, চলুন নিজেদের মাঝে সব ঠিক করে নেই।আমার ওই কথা নিয়েই রাগ তো?ওটা আমি একটা উদ্দেশ্য নিয়ে বলেছিলাম।কাল খালামনি যাওয়ার আগে আমাকে আপনার সম্পর্কে অনেক কথা বলে গেছেন।আপনি সহজে রাগেন না। কিন্তু রেগে গেলে তখন আর হুশ থাকে না, এরকম আর কি।আমিও ভাবলাম,একবার রাগের পরিধি যাচাই করেই নেই।দেখি, আমি সহ্য করতে পারি নাকি।কিন্তু,আজ যা দেখলাম তাতে আমি খুবই আশাহত।
আপনি রেগে থাকলেই আমার লাভ।এই যে আজকে কতো কাজ করে দিলেন।সারাদিন শুয়ে বসেই কেটেছে আমার।তাছাড়া, চাকরি করার ইচ্ছা আমার নেই।আমার নেশা আউটসোর্সিংয়ে। এজন্য গ্রাফিক্স ডিজাইনের উপর একটা কোর্সও করেছিলাম প্রায় দু-বছর আগে।এখন কয়েকদিন আবারো চর্চা করলেই হয়ে যাবে।ধরা বাধা চাকরি আমার ভালো লাগে না।আমি নিজের স্বাধীন মতো কাজ করব।তাই চাকরি করার ইচ্ছা অনেক আগেই বাদ দিয়ে দিয়েছি।এবার বুঝলেন?সকালের বিষয়টা ইচ্ছাকৃত ছিল।তবুও যদি দুঃখ পেয়ে থাকেন, তবে সরি।”

তুষার কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো।কয়েক সেকেন্ড মাত্র।তারপর হুট করে হাঁটুতে ভর দিয়ে মহুয়ার দিকে এগিয়ে গেল।মহুয়ার টিপের মতো তিলটাতে দুই নখ দিয়ে কুট করে চিমটি দিল।

—” সমস্যা কি মিত্তির বাবা?”
—” আরেকদিন এরকম করলে আছাড় দিয়ে নাড়ী-ভুরি বের করে ফেলব,ফাজিল মহিলা।”
—” নাড়ী রশির মতো হয় না?আপনাকেই আমি ছেড়ে দেব ভেবেছেন?আমার নাড়ী-ভুরি আপনার গলায় পেঁচিয়ে আপনাকেও মেরে দেব।আমি মহুয়া,হুহ।খেতে আসুন।”

তুষার মহুয়ার গমনপথে চেয়ে রইলো।নিজের চাইতে বড় স্বামীকে কে এমন হুমকি দেয়!!!

চলবে…..

যাত্রাশেষে (পর্ব-১৫)

# যাত্রাশেষে (পর্ব-১৫)
# হালিমা রহমান।

চারপাশে গুমোট আবহাওয়া।বৃষ্টি হবে হবে ভাব কিন্তু হচ্ছে না।বাতাসের ছিটেফোঁটাও নেই।মহুয়ার গলার কাছে ঘাম জমে।ঠোঁটের উপর, নাকের উপরেও মুক্তোদানার মতো ঘামবিন্দু স্থান করে নেয়।কালো শাড়ির কালো আঁচল দিয়ে তা মুছে নেয় মহুয়া।দূর থেকে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে।নাইট গার্ডের বাঁশির আওয়াজও বেশ স্পষ্ট। মহুয়ার পাশে তুষার দাঁড়ানো।সে এখনো নীরব।তুষারের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে কি না, তা জানে না মহুয়া।সে শুধু জানে,তুষারকে এখন সময় দিতে হবে।তুষারের সাথে একান্তে কিছু সময় কাটাতে হবে,যাতে সে দুঃখের অতলে ডুবে না যায়।মহুয়া তুষারের দিকে দু-পা এগিয়ে যায়।অন্ধকারেই হাতড়ে হাতড়ে তুষারের ডান হাতের কনুই জড়িয়ে ধরে।

—” মিত্তির বাবা,চলুন একটু বসি।ওখানে বসার জায়গা আছে।”
—” চলো।”

তুষারের পকেটে ফোন ছিল।ফোনের লাইটের আলোতে বেঞ্চের কাছে যেয়ে পৌঁছায় তারা।বেঞ্চটা ছোট।দুজন বসলে একটু চাপাচাপি হয়।মহুয়া ও তুষার বসে পড়ে সেখানে।মহুয়া পা উঠিয়ে বসে।পা ঝুলিয়ে বসতে ওর অসহ্য লাগে।মানুষ আরামের জন্য বসে।কিন্তু বসার পর যদিই হাঁটুই এভাবে ঝুলিয়ে রাখতে হয়,তবে আরাম হলো কোথায়?

—” মিত্তির বাবা,মহিমাকে খুব বেশি মনে পড়ছে?”

—” চোখ বন্ধ করতে পারছি না আমি।চোখের উপর শুধু ভাসছে।কিন্তু এরকম হওয়ার কোনো কারণ ছিল না মহুয়া।মহিমাকে আমি নিজের চিন্তা থেকে দূর করে দিয়েছি অনেক আগেই।তাকে নিয়ে ভুলেও ভাবতাম না।কিন্তু,আজ দেখ।খবরটা শোনার পর এক মুহূর্তের জন্য ওকে মন থেকে সরাতে পারছি না।বারবার মনে হচ্ছে আল্লাহ ওকে এতো কঠিন শাস্তি কেন দিল?অথচ,মহিমার অপরাধ কিন্তু আমি জানি। তবুও এরকম যে কেন হচ্ছে!এ এক জঘন্য যন্ত্রণা। ”

—” পৃথিবীতে সবচেয়ে শক্তিশালী অনুভূতির নাম কি জানেন?”

—” না।”

—” মায়া।আপনি একসময় মহিমাকে ভালোবাসতেন।মহিমা চলে যাওয়ার পর হয়তো ভালোবাসা কর্পূরের মতো উবেও গেছে।কিন্তু মায়া থেকেই গেছে।এই কারণে এমন হচ্ছে।মহিমাকে আপনি জোর করে মন থেকে সরাতে চাইলেও পারবেন না।তার চেয়ে ওকে নিয়ে একটু গল্প করা যাক।আমার সব কথাই তো আপনি জানেন।কিন্তু আমি আপনাদের সম্পর্কে কিছুই জানি না।একটু একটু করে বলুন তো আমায়।”

তুষার আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।বলার মতো কোনো গল্প আছে?না, নেই।তিন বছরের সংসারের সবগুলো দিনেই হাসি ছিল, কান্না ছিল,অভিমান ছিল,রাগ ছিল আর ছিল একটু বোঝাপড়া। এ তো বলার মতো কোনো গল্প নয়।সব পরিবারেই তো এগুলো থাকে।তবে মৃত্তিকা আসার পরের তিনটা মাস খুব সুখী ছিল ওরা।ব্যবসায়ে ক্ষতি,মায়ের মৃত্যু, সংসারের টানাপোড়েন —এতো কিছুর মাঝেও মৃত্তিকা ছিল একমুঠো সুখ ও স্বস্তি।তাদের সংসারটাও রূপকথার মতো একটা সাজানো গল্প হতে পারতো।যেখানে রাজা থাকবে,রানী থাকবে আর থাকবে একটা ছোট্ট রাজকন্যা। মিষ্টি, আদুরে।কিন্তু এসব কিছুই হলো না।সুখ রাজ্যের গদ্য রচনা করার আগেই পাতা ফুরিয়ে গেল।মেয়েকে নিয়ে মুখ থুবড়ে পরে গেল তুষার।কারণ?আজ আর কারণ খুঁজতে ইচ্ছে করে না তুষারের।একজন মৃত মানুষকে দোষারোপ করতে ইচ্ছে করে না।ভাগ্যের দোহাই দেয় তুষার।এসব ভাগ্যেই ছিল।
তুষারের কাঁধে আলতোভাবে নিজের মাথা এলিয়ে দেয় মহুয়া।এ যেন অস্তিত্বের বার্তা।মহুয়ার এটুকু আত্নসমর্পণ তুষারকে নিজের বর্তমান মনে করিয়ে দেয়।তুষার একা নয়।তার বউ আছে,বাচ্চা আছে।আর আছে নতুন করে স্বপ্ন দেখার ইচ্ছা।অতীত নিয়ে চিন্তা করার সময় তার নেই।সুখ রাজ্যের গদ্যে রানী যদি মহুয়া হয়, তবে ক্ষতি কি?তুষার নাহয় আরেকবার চেষ্টা করবে।নতুন পাতা বুনবে।এতোক্ষণের জমিয়ে রাখা চিন্তাগুলো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দেয় তুষার।মহিমার জন্য মনের একাংশে খচখচ করছে।নিজের অবস্থা দেখে নিজেই অবাক হয়ে যায়। এরকম হওয়ার কোনো কথা ছিল?নাকি তুষার সঠিকভাবে নিজের খোঁজ নিতে পারেনি?

—” মিত্তির বাবা,আপনি ভুলতে চাইলেও পারবেন না।একজন মানুষকে ভুলতে অনেক সময় লাগে।হোক সে ভালো অথবা মন্দ।মহিমার সাথে আপনার বিচ্ছেদের বয়স এক বছরও হয়নি।এই অল্প সময়ে মানুষের মায়া ছাড়ানো যায়?”

এ যেন তুষারের নিজস্ব চিন্তাগুলোর সমাধান।ঠিকই তো।মানুষ ভুলার জন্য এক বছর অনেক কম সময়।তাছাড়া,মহিমা তো যে সে ছিল না।তিনটে বছর সে তুষারের প্রেয়সী ছিল,স্বপ্ন ছিল,অর্ধাঙ্গিনী ছিল।এখন হয়তো নেই কিন্তু তখন তো ছিল।থাকুক তার স্মৃতি মনের এককোনে।তুষার পাত্তা না দিলেই তো হয়।মহুয়ার মাথা নিজের কাঁধ থেকে বুকের উপর রাখে তুষার।এক হাত দিয়ে মহুয়ার কাঁধের পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে।অন্যহাতে সামনে জড়িয়ে ধরে।
তুষারের গন্ডি এটুকুই।মনের একাংশের স্মৃতি তার মতোই থাকুক।তুষার সেদিকে নজর দেবে না।মনে না করলে স্মৃতিও ফিকে হয়।আজ অনেকদিন পর খুব মনখোলা হতে ইচ্ছে করে তুষারের।ক্ষমা করতে ইচ্ছে করে।
” তোমার বিরুদ্ধে আর কোনো অভিযোগ নেই, মহিমা।আল্লাহ তোমায় ক্ষমা করুক।শেষ বিচারের দিন, তিনি তোমায় অপরাধী হিসেবে না দাঁড় করাক”— নিজের মনেই আওড়ে নেয় তুষার।লক্ষ করে এতোক্ষণের মন খারাপ পালিয়ে গেছে।নিজের এই পরিবর্তনে নিজেই অবাক হয়ে যায় সে।ক্ষমার এতো ক্ষমতা!এরকম জানলে অনেক আগেই মহিমাকে ক্ষমা করে দিত।

—” আমি আপনাকে কি বললাম আর আপনি কি করছেন?গল্প শোনানোর জায়গায় জড়িয়ে ধরে বসে আছেন।এটা কি ঠিক?গরম লাগছে না আপনার?”

—” উঁহু। ”

— ” কিন্তু আমার লাগছে।কাঁধ পর্যন্তই ঠিক ছিল।আবার এভাবে জড়িয়ে ধরার মানে কি?অস্থির লাগছিল বলে বাইরে এসে বসেছেন।নিজের অস্থিরতার সাথে সাথে আমাকেও অস্থির বানিয়ে ফেলছেন।দেখি,ছাড়ুন।আমার অস্বস্তি হয়।”

—” তুমি কি আমাকে সন্ন্যাসী ভাবো, মহুয়া?আমার সুন্দরী বউ পাশে বসে আছে অথচ আমি তাকে স্পর্শ করব না,এটা সম্ভব?আমি কোনো সংসারত্যাগী সন্নাসী নই।”

মহুয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। অবশেষে তুষার সহজ হয়েছে।কিন্তু কিছু কথা তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।মহিমা হঠাৎ ঢাকায় কেন আসতে যাবে?আর মহিমার ভাই কেন তার বোনের প্রাক্তনের কাছে এসেছিল?মহিমার এক্সিডেন্ট হলে তার স্বামীর কি খবর?সেও কি স্পট ডেড?মহুয়া মুখ বাকিয়ে তুষারের টিশার্টের কাপড় খুটে।জিজ্ঞেস করবে?না থাক। আবার হয়তো তুষারের মনে পড়ে যাবে।কিন্তু, নিজের ভিতর কোনো কথা জমিয়ে রাখার গুণ মহুয়ার নেই।তাই জিজ্ঞেস করবে না করবে না ভেবেও করেই ফেললো।

—” মিত্তির বাবা,মহিমার ভাই কি বলল আপনাকে?মহিমা কেন ঢাকায় আসছিলো, সেগুলো কিছু বলেনি?”

—” মহিমা পালিয়ে যাওয়ার পর ওর বাবার বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ ছিল না।সবাই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।মহিমা চট্টগ্রাম ছিল।সেও যোগাযোগের চেষ্টা করেনি।কিন্তু ওর বড়ভাই খুব দুর্বল ছিল ওর প্রতি।বুঝতেই পারছো একটা বোন।সে কিছুদিন আগে অনেক কষ্ট করে মহিমার সাথে যোগাযোগ করেছে।বোনকে ঢাকায় আসতে বলেছে।মহিমাও রাজি ছিল।অনেকদিন হয়তো বাড়ির সাথে যোগাযোগ নেই বলে হাঁপিয়ে গিয়েছিল।সম্পর্ক সহজ করার লোভেই স্বামীকে নিয়ে ঢাকার বাসে উঠেছিল।মাঝপথেই আরেক গাড়ির সাথে মুখোমুখি সংঘর্ষ।আর সেখানেই স্পট ডেড। ”

—” ওর স্বামী?”

—” মরে না গেলেও মরার মতো বেঁচে আছে।সারা শরীরে ক্ষত আর দুটো পায়ের খুব খারাপ অবস্থা।খুব সম্ভবত হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হবে।সে এখনো চিকিৎসাধীন।”

—” মহিমার ভাই কেন এসেছিল?এই খবর দিতে?”
—“না।মহিমার নামে মিলাদ পড়িয়েছিল আজ।আমার সাথে করা অন্যায় তার মাথায় ছিল।তাই আমার কাছে এসেছিল ক্ষমা চাইতে।যাতে আমি ক্ষমা করে দেই তার বোনকে।”

—” দিয়েছেন?”

—” তোমার স্বামী পাষাণ নয়।তার দয়ার শরীর।”

—” তাহলে আমার দয়ালু স্বামীর কাছেই সবিনয় নিবেদন করছি,আপনার নিরাপত্তা বেষ্টনী সরান।আমাকে অস্বস্তি থেকে মুক্তি দিন।”

কপাল কুঁচকে ফেলে তুষার।একটু জড়িয়ে ধরলেই ‘অস্বস্তি লাগছে,অস্বস্তি লাগছে ‘বলে পাগল হয়ে যায়।সমগ্র মেয়ে জাতির অস্বস্তি কি এই মেয়ের মধ্যেই দিয়ে দিয়েছে আল্লাহ?
মহুয়া নড়াচড়া করতেই হাতের বাধন শক্ত করে ফেলে তুষার।

—-” মহুয়া,আরেকবার দাপাদাপি করলে কঠিন শাস্তি দেব তোমায়।”

শান্ত হয়ে যায় মহুয়া।তুষারের শক্তির সাথে সে পারবে না।তাই গলায় খানিক বিরক্তি ফুটিয়ে বলেঃ”আপনার সাথে এখানে এসেই আমার ভুল হয়েছে।এর চেয়ে ঘরে ফ্যানের নিচে ঘুমিয়ে থাকতাম, সেটাই ভাল হতো।শয়তান লোক একটা।আপনার জন্য আমার চুলগুলোও শুকায়নি।ভিজা চুল বেঁধে রেখেছি।একদম গন্ধ হয়ে যাবে।”

—” বেঁধে রেখেছো কেন?আমি তোমাকে বলেছি বাঁধতে? খুলে দেও।”

—” আপনার যা বুদ্ধি।এতো রাতে এই খোলা মাঠে আমি চুল ছাড়ব! আশেপাশের যতো জ্বিন-ভূত সব আমার চুল বেয়ে উপরে উঠবে। ”

—” কেন?চুল ছাড়া তোমার শরীরে আর অঙ্গ-প্রতঙ্গ নেই?ওগুলো বেয়ে উঠতে পারবে না?যত্তসব আজাইরা কথা-বার্তা।চুল খোলো।”

মহুয়ার আগে তুষার নিজেই মহুয়ার চুলের কাঠি খুলে দেয়।মুহূর্তেই ঝর্ণার পানির মতো তুষারের হাতের উপর বেয়ে পড়ে মহুয়ার চুলের গোছা।মেয়েটার চুলগুলো কুচকুচে কালো নয়।গোছাও খুব বেশি ভারী নয়।হালকা লালচে রঙের পাতলা কয়েক গাছি চুল।তবে ছেড়ে রাখলে ভালোই মানায় চেহারার সাথে।তুষারের নাকে আসে মহুয়ার চুলের তীব্র ঘ্রাণ। কি শ্যাম্পু দেয় এই মেয়ে?সব মেয়ের চুল থেকেই কি এরকম ঘ্রাণ পাওয়া যায়?নাকি শুধু বউয়ের চুল থেকেই এরকম তীব্র ঘ্রাণ আসে?এই বিতর্কের উত্তর নেই তুষারের।কয়েকটা মেয়ের চুলে নাক ডুবিয়ে দেখলে ভালো হতো।তবেই এই ভয়াবহ বিতর্কের সমাধান পাওয়া যেত।
এসব দুর্দান্ত কথা মনে আসতে নিজেই অবাক হয়ে যায় তুষার।বউয়ের মাথা বুকে রেখে অন্য মেয়েদের চিন্তা করছে!
“আসতাগফিরুল্লাহ,আসতাগফিরুল্লাহ”—নিজের মনেই আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে সে।নিজের নৈতিক অধঃপতনে লজ্জিত হয়।ভাগ্যিস মনের কথা পৃথিবীর কেউ শুনতে পায় না।মহুয়া যদি এসব কথা জানতে পারত,তবে কি হতো এতোক্ষণে?জুতোপেটা করে এলাকা ছাড়া করতো।
অন্ধকারেই বউয়ের পায়ের দিকে তাকায় তুষার।পায়ে জুতো আছে নাকি বাড়িতে রেখে এসেছে???

চলবে….

যাত্রাশেষে (পর্ব-১৪)

#যাত্রাশেষে (পর্ব-১৪)
# হালিমা রহমান।

গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বসে আছে মহুয়া।পরনে পাকা বাঙ্গি রঙের একটা শাড়ি।শাড়ির নিচে কুঁচির দিকটা একটু এলোমেলো হয়ে আছে।ইচ্ছে করেই ঠিক করছে না।সিল্কের শাড়ি একদম পরতে পারে না সে।পরতে ভালোও লাগে না।পেটের দিকটা কেমন উঁচু হয়ে থাকে।আজ বৌভাত উপলক্ষে এই শাড়িটা পরেছে মহুয়া।ফল হিসেবে বাঙ্গিকে খুব বেশি পছন্দ না করলেও, পোশাক হিসেবে বাঙ্গির রঙ খুব পছন্দ তার।এই বিয়ে নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই মহুয়ার।কারণ এইবার অযথা ভিড়-ভাট্টা নেই,খুব বেশি লৌকিকতা নেই,সাজগোজের বাহুল্য নেই।তাই মহুয়ার এইবার কষ্টও হয়নি।আজ বৌভাতেও মাত্র বিশ-পঁচিশ জনের আয়োজন ছিল।
সিটে হেলান দেওয়ার কারণে ঘাড়টা ধরে গেছে।মহুয়া সোজা হয়ে বসে জানালা দিয়ে একবার বাইরে তাকালো।তারা এখনো নয়া পল্টনেই আছে।মহুয়ার বাবার বাড়ির মেহমান আরেকটা গাড়িতে করে চলে গেছে।এই গাড়িটা শুধু তাদের জন্য।অনেক আগেই গাড়ি ছেড়ে দিত।কিন্তু তুষারের জন্য হচ্ছে না।গাড়িতে উঠার আগ মুহূর্তে তুষারকে কে যেন কল দিয়েছে।তার সাথেই দেখা করতে গেছে সে।মৃত্তিকাকেও নিয়ে গেছে সাথে।বলেছিল মাত্র দশমিনিট লাগবে।কিন্তু,সময় গড়াতে গড়াতে এখন পৌনে একঘন্টা হয়েছে।বসে বসে বিরক্ত হয়ে গেছে মহুয়া।কোমড়টাও লেগে গেছে।গাড়িতে সে একা।একটু বের হতেও পারছে না।এই এলাকার প্রায় অনেকেই মহুয়াকে খুব ভালো করে চিনে।তাই বাইরে বের হলেই সবাই এটা-ওটা প্রশ্ন করবে।গাড়িতে উঠার সময় অনেকেই তাকিয়ে ছিল।এলাকার মহিলা মহলে খুব পরিচিত ছিল মহুয়া।বিলকিস বেগম প্রায়ই এবাড়ি-ওবাড়ি ঘুরতে যেতেন।বাড়ির কর্ত্রীদের সাথে ছেলের বউয়ের সুনাম করতেন।সবাইকে বুক ফুলিয়ে প্রচার করতেন,কিরকম লক্ষ্মী একটা বউ পেয়েছেন তিনি।তার বউ ঘরের কাজও পারে,বাইরের কাজও পারে।এসব সুনাম শুনে কত মানুষ যে বাড়ি বয়ে ওকে দেখতে এসেছিল, তার ইয়ত্তা নেই।কোনো কোনো ঈর্ষান্বিত মহিলা মাঝে মাঝে বাড়িতে এসে তার ভুলও ধরতো।মহুয়া কিছু বলত না।তবে বিলকিস বেগম তার দাঁতভাঙা জবাব দিতেন।তার বাড়িতে এসে আরেকজন তার বউয়ের ভুল ধরবে কেন? ভুল ধরার জন্য কি তিনি নেই?তিনি কি মরে গেছেন?
সেসব কথা মনে পড়লে এখন কোনো অনুভূতি তৈরি হয় না মহুয়ার।তবে বিলকিস বেগমের জন্য খুব খারাপ লাগে তার। এই মানুষটাকে সে মায়ের চোখেই দেখত।তিনি মহুয়ার দ্বিতীয় মা ছিলেন।পাশাপাশি বাড়ি হলেও একবারের জন্যও বিলকিস বেগমকে দেখেনি মহুয়া।আবরারকে দেখেছে,অনন্যার কথা শুনেছে কিন্তু বিলকিস বেগমের অস্তিত্ব টের পায়নি।এই বুড়ো বয়সে কেমন আছেন, কে জানে!
প্রায় একঘন্টা পর গাড়িতে আসলো তুষার।বসে থাকতে থাকতে মহুয়ার অবস্থা ততোক্ষণে নাজেহাল।তুষারকে গাড়িতে বসতে দেখে হাফ ছাড়লো মহুয়া।এতোক্ষণে আসার সময় হলো জনাবের।শুধু শুধু মহুয়া তুষারকে জ্ঞানহীন বলে?
গাড়ি চলতে শুরু করলে আবারো মহুয়া সিটে হেলান দিল।তুষারের দিকে তাকিয়ে ক্ষোভের সাথে বললঃ “এই আপনার দশমিনিট? ”
—” কথা বলতে বলতে দেরি হয়ে গেল।”
—” কে এসেছিল?”
—” চিনবে না তুমি।”

তুষারের কন্ঠস্বরের উদাসীনতা স্পষ্ট টের পায় মহুয়া।লোকটার কি মন খারাপ?তুষারের সাথে পরিচিত হওয়ার পর থেকে কখনোই এমন কন্ঠস্বর শুনেনি মহুয়া।তাই সে বেশ উদ্বিগ্ন গলায় বললঃ” আপনার কি কিছু হয়েছে?”
—” না।মিত্তিকে একটু তোমার কাছে রাখতে পারবে?আমি একটু ঘুমাই।অস্থির লাগছে খুব।”
—” আচ্ছা।”

মৃত্তিকাকে মহুয়ার কোলে দিয়ে সিটে হেলান দেয় তুষার।মাথার রগগুলো দপদপ করে জ্বলছে।ঘাড়টাও ব্যাথা খুব।আজকের দিনেই কি এতোকিছুর দরকার ছিল? তুষার ক্লান্তির শ্বাস ছাড়ে।পৃথিবীতে কোথায় একটু শান্তি পাওয়া যাবে?
মহুয়া দেখলো তুষার শুধু অস্থিরতা করছে।একবার সিটের ডানদিকে মাথা দিচ্ছে আবার বামদিকে।মহুয়ার যখন মাথাব্যথা করে তখন সেও এমন করে।মহুয়া মৃত্তিকাকে একপায়ের উপর রেখে তুষারের দিকে আরেকটু চেপে বসলো।তুষারের চুলে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে টেনে দিল।মহুয়ার যখন মাথাব্যথা করে তখন তার বাবাও এমন করে।খুব আরাম পায় মহুয়া।তুষার একবার চোখ মেলে তাকালো মহুয়ার দিকে।এরকম একটু সেবার সত্যিই খুব দরকার ছিল।তুষার আরো একটু চেপে বসে মহুয়ার দিকে।মহুয়ার হাত নিজের মাথার উপর আরেকটু চেপে ধরে।মহুয়ার কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয়।
—” মহুয়া, এই যে ডানদিকের চুলগুলো একটু ভালোভাবে টেনে দেও তো।কষ্ট হলেও দেও।ঘুম থেকে উঠলে তোমাকে ধন্যবাদ দেব।এখন আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।তাছাড়া,আমার মনটাও খুব খারাপ।থেমে যেও না কিন্তু।দিতেই থাক, দিতেই থাক।”

মহুয়া দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।মাঝে মাঝেই যে তুষার এরকম অসংলগ্ন কথা বলে, তা এই কয়েকদিনে বেশ ভালো করে জানা হয়ে গেছে তার।কপালে একটা পাগল জুটিয়ে দিয়েছে আল্লাহ।

***

সাবিনা বেগমের দম ফেলার ফুরসৎ নেই।নতুন জামাই এসেছে বলে কথা।মহুয়ার বিয়ের দিন খুব অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।কালকেও অনেক অসুস্থ ছিলেন।সারাদিন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেননি।অথচ,আজ মহুয়া-তুষার এসেছে বলে তড়াক করে উঠে গেছেন।তাকে দেখলে কেউ বলবেই না,এই মানুষটা কালকে এতো অসুস্থ ছিল।মহুয়ার ছোট চাচি ছাড়া বাকি সবাই সন্ধ্যার দিকেই চলে গেছে।সবার অফিস খোলা।চাচাতো ভাই-বোনের স্কুল-কলেজ খোলা।মহুয়ারা শেষ বিকালে এসেছে।মৃত্তিকা আফজাল সাহেবের সাথে খেলছে।কিভাবে যেন মিশে গেছে সে।তুষার এসে কিছুক্ষণ সবার সাথে কথা বলে আবারো ঘুমিয়ে গেছে।ঘুমানোর আগে মহুয়া বিছানার এককোনে বসে জিজ্ঞেস করেছিলঃ” আপনার এখনো মন ভালো হয়নি?”
—” উঁহু। আজ আমার খুব মন খারাপ, মহুয়া।এতো সহজে ভালো হবে না।”
কথা বলতে দেরি,বালিশে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে যেতে দেরি হয়নি।মহুয়া কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তুষারের দিকে তাকিয়ে থাকে।তখন থেকে মন খারাপ, মন খারাপ বলছে।কিন্তু,কেন মন খারাপ সেটাই বলছে না।আশ্চর্য!
মহুয়া শাড়ি বদলে রান্নাঘরে যায়।সাবিনা বেগম ব্যস্ত ভঙ্গিতে কি যেন রান্না করছেন।সে যেয়ে মায়ের গা ঘেষে দাঁড়ায়।

—” মা,কি রান্না করো?”
—” গরুর মাংস।জামাই কই?তুই টইটই করছিস কেন?”
—” তোমাদের জামাই ঘুমায়।তার নাকি মন খারাপ।”—বলেই মুচকি হাসে মহুয়া।
সাবিনা বেগম ভ্রু কুঁচকে ফেলেন।
—” কি জন্য মন খারাপ?
—” আরে নিজের বাড়ি ছেড়ে শ্বশুড় বাড়ি এসেছে,তাই।বাড়ি ছেড়ে আসলে সবারই মন খারাপ থাকে।বিয়ের দিন আমারো খুব মন খারাপ হয়েছিল।”
—“ফাইজলামি করবি না, মহুয়া। তুই কিছু করেছিস?”
—” হাহ! সব জায়গায় তুমি আমার দোষ কেন খুঁজো, মা।দুইদিনে কি করব আমি তার সাথে?”
—” তোকে বিশ্বাস নেই আমার।আচ্ছা যা এখন এখান থেকে।অনেক গরম এখানে।”
—” মা, আলু ভর্তা বানিয়ো একটু।বেশি করে শুকনো মরিচ দিয়ো।আর একটা কড়া করে ডিম ভেজে নিয়ো,প্লিজ।”
—” এগুলো দিয়ে কি হবে?”
—” খাব রাতে।এই কয়েকদিন মাংস-টাংস খেয়ে একদম পেট পঁচে গেছে আমার।শরীর থেকেও এখন মাংসের গন্ধ পাই।”
—” আচ্ছা বানাবো। যা এখন।”

মহুয়া রান্নাঘর থেকে আবার বাবা-মায়ের ঘরের দিকে গেল।বিছানার উপর আফজাল সাহেব ও মৃত্তিকা খেলছে।খাটের উপর অনেকগুলো খেলনা।এগুলো সব মহুয়ার ছোটবেলার।বাবা খুব যত্ন করে তুলে রেখেছিলেন।তার খুব শখ ছিল, এগুলো দিয়ে তিনি নাতি-নাতনীদের সাথে খেলবেন।এতোদিনে শখ পূরণ হলো।মহুয়া ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠে।দুজনে কি সুন্দর করে খেলছে!
মহুয়াও যেয়ে খাটের উপর পা তুলে বসে।

—” বাবা,আমাকে তুমি ভুলেই গেছ।”—বেশ আদুরে শোনায় মহুয়ার কন্ঠ।
আফজাল সাহেব মহুয়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন।
—” তোকে ভুলিনি,মনেই আছে।কিন্তু এখন তোকে পাত্তা দেব না।তোর মেয়েটা অনেক দুষ্টু মা।দুটো গাড়ি ভেঙে ফেলেছে।একটু খেলার পরেই খেলনা ছুড়ে ফেলে দেয়।”
—” হ্যাঁ, একটু দুষ্ট ও।বাবা,নয়া পল্টনের ঘটনা দেখেছ?মিত্তির বাবা ওই হারামজাদার ঘরের সামনে যেয়ে ফ্ল্যাট কিনেছে।কি একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার! ”
—” এখানে বিচ্ছিরি হওয়ার কি আছে?তোর তো খুশি হওয়ার কথা।ঐ ফ্ল্যাটটা তোর খুব পছন্দ ছিল না?”
—“তবুও।”
—” তুই কি এখনো আবরারের প্রতি আকৃষ্ট, মহুয়া?”
নাক-মুখ কুঁচকে ফেলে মহুয়া।কি বলল বাবা এটা!
—” তুমি কি পাগল,বাবা?আমি সিরিয়ালের নায়িকা না যে, ওই শয়তানটাকে দেখে আমার আগের প্রেম জেগে উঠবে।”
—” এই তো আমার মেয়ের মতো কথা।শোন মা,তোকে একটা উপদেশ দেই।খুব বেশি ঘরের বারান্দা বা জানালার কাছে যাওয়ার দরকার নেই।কখনো আবরারের সাথে কথা বলারও দরকার নেই।তুষারের আগের বউয়ের সাথে প্রেমঘটিত একটা সমস্যা হয়েছিল না?”
—” হুম।”
—” তুষার কিন্তু ঘরপোড়া গরু।তাই তোকে নিয়ে খুব সচেতন থাকবে,ভয়ে থাকবে।তার উপর আবার আবরার তোর ঘরের কাছেই।সুতরাং, বুঝতেই পারছিস।তুষার এগুলো নিয়ে কতটা চিন্তায় থাকবে।কখনো তোদের মাঝে সন্দেহ শব্দটাকে টেনে আনিস না।সন্দেহ একটা বিষ।বুঝলি?”

মহুয়া মাথা নাড়ায়।বাবা যে কি বুঝাতে চেয়েছে,তা খুব ভালোভাবেই বুঝে গেছে সে।বাবার কথাগুলো খুব বেশি খারাপ নয়।চিন্তায় পড়ে যায় মহুয়া।তুষারকে এতোদিনে যতটুকু দেখেছে তাতে এসব কথা কখনোই আসেনি মহুয়ার মাথায়।আবরারের বিষয়টা নিয়ে কি তুষার কখনো সন্দেহ করবে?আবরার আর মহুয়াকে জড়িয়ে —আর ভাবতে পারে না মহুয়া।তার গা ঘিনঘিন করে উঠে।ওই অমানুষটার সাথে নাম জড়ানোর চাইতে নির্বাসন ঢের ভালো।

***

রাতের খাবার খেয়ে আবারো শুয়ে পড়েছে তুষার।ভিতরের অস্থিরতা এখনো কমেনি।ঔষধের কারণে এতোক্ষণ ঘুমিয়েছে ঠিকই।কিন্তু এখন কি করবে?আজকের জন্য বোধহয় আর ঘুম আসবে না।জেগেও যে থাকতে পারবে না সে।জেগে থাকলে নিশ্চিত অস্থিরতায় মরে যাবে।তুষার কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করলো।শক্ত করে মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরলো।কিন্তু না,ঘুমের কোনো লক্ষণ নেই।মৃত্তিকার পাশেই মহুয়া চোখ বন্ধ করে আছে।সে ঘুমিয়ে আছে না জেগে আছে তা জানে না তুষার।তুষার চোখ বন্ধই কর‍তে পারছে না।চোখ বন্ধ করলেই চোখের উপর ভাসছে সেই মুখ।সেই হাসি,সেই চোখ।কানে শুধু তার কন্ঠস্বর ভাসছে।তুষার না পেরে উঠে বসে।এরকম হওয়ার কারণ সে জানে।কিন্তু জানলেও উপশমের ব্যবস্থা নেই।তুষার বসে দু হাতে মাথা চেপে ধরে।আবারো ব্যাথা করছে।ঘরের একদিকের জানালা খোলা।রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলো এসে পড়ছে মহুয়ার মুখের উপর।শান্ত-ঘুমন্ত একটা মুখ।তুষার মহুয়ার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়।

—” মহুয়া এই মহুয়া।মহুয়া।”
নড়েচড়ে উঠে মহুয়া।চোখটা সবে লেগে এসেছিল।ভ্রু-কুঁচকে বলেঃ” কি?”
—” ঘুমিয়ে গেছ?”
অবাকের আতিশয্যে উঠে বসে মহুয়া।গলায় বিস্ময় ও বিরক্ত ফুটিয়ে বলেঃ” ঘুমের মানুষকে জাগিয়ে বলছেন, ঘুমিয়েছে কি না!আপনি চূড়ান্ত খারাপ, মিত্তির বাবা।”
—” এখন তো ঘুমাচ্ছ না।চলো না আমরা একটু হেঁটে আসি।”
—” এতোরাতে! কোথায় যাবেন?”
—” তোমাদের বাড়ির সামনে একটা মাঠ দেখেছিলাম।ওখানে বসার জায়গাও আছে।চলো।ওখানে যাই।প্লিজ না করো না।আমার ঘুম আসছে না আবার জেগেও থাকতে পারছি না।এরকম অবস্থায় থাকলে আমি নিশ্চিত মরে যাব।”

তুষারের এই উদ্ভট আবদারে মানা করতে পারে না মহুয়া।সত্যি মানুষটাকে কেমন যেন লাগছে।মহুয়া মৃত্তিকাকে মায়ের ঘরে দিয়ে আসে।তারপর তুষারকে নিয়ে পা বাড়ায় গেটের বাইরে।তাদের বাড়ির কয়েক পা সামনেই একটা মাঠ আছে।মাঠের একপ্রান্তে আবার বসার জন্য একটা সিমেন্টের পাকা বেঞ্চও আছে।বাইরে বেড়িয়ে বড় করে শ্বাস নেয় তুষার।বদ্ধ ঘরে যেন দম বন্ধ হয়েছিল তার।এদিকটায় ল্যাম্পপোস্ট নেই।অন্ধকারেও মহুয়া তুষারের চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকে।মিনিট কয়েকের নীরবতা ভেঙে বলেঃ”একটা কথা বলব?”
—” বলো।”
—” আপনার আজ মহিমাকে খুব মনে পড়ছে,তাই না?”
চমকে তাকায় তুষার।মহুয়া কি করে বুঝলো?ওর তো টের পাওয়ার কথা নয়!
—” তুমি কি করে জানলে!”
—” আপনার অস্থিরতা দেখে হঠাৎ করে মাথায় এলো।আমি কি ভুল?”
—” উঁহু। বিকালে গাড়িতে উঠার আগে মহিমার ভাইয়ের সাথে কথা বলতে গিয়েছিলাম।তারপর থেকেই এই অবস্থা।যতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম, ততোক্ষণ শান্তিতে ছিলাম।ঘুম থেকে উঠার পর থেকেই খুব মনে পড়ছে ওর কথা।”
—” কোথায় আছে মহিমা?জিজ্ঞেস করেছিলেন ওর ভাইকে?”
হঠাৎ করেই খুব উদাসীন হয়ে যায় তুষার।কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থাকার পরে গম্ভীর গলায় বলেঃ”তিনদিন আগে ঢাকায় আসার পথে মহিমার এক্সিডেন্ট হয়েছে।একদম স্পট ডেড।সে এখন পোকার দখলে।”

শেষদিকে তুষারের কন্ঠ খুব ভারী শোনায়।নিস্তব্ধ রাতে তুষারের পাশে দাঁড়িয়ে মহুয়ার একটা প্রশ্নই মাথায় আসে।মানুষটা কি কাঁদছে???

চলবে…..

যাত্রাশেষে (পর্ব-১২+১৩)

#যাত্রাশেষে (পর্ব-১২+১৩)
#হালিমা রহমান

একটা নতুন ভোরেই এরকম একটা অপ্রত্যাশিত মানুষের মুখোমুখি হবে, তা কখনো ভাবেনি মহুয়া।আবরার তার সামনেই দাঁড়ানো।দুজনের মাঝে দূরত্ব বড়জোর দেড়হাত হবে।দুটো বাড়ির মাঝে এতটুকুই ফাঁক।মহুয়া কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব চোখে দাঁড়িয়ে রইলো।কিছুক্ষণ পর সবটা বোধগম্য হতেই দ্রুতপায়ে ঘরের দিকে ছুটলো। কোনো পঁচা,নোংরা অতীতের মুখোমুখি হতে চায় না সে।মহুয়া ঘরে ঢুকে সশব্দে বারান্দার দরজা আটকে দেয়।হৃৎপিণ্ডের গতি তীব্র। মহুয়া দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।খুলে যাওয়া চুলগুলো সুন্দর করে বেঁধে নেয়।নিজেকেই নিজে মনে মনে ধমক দেয়।প্রাক্তনকে দেখে এমন করার কি আছে? পৃথিবীটা ছোট।এখানে চলতি পথে মানুষের পাশাপাশি কতগুলো ইতরের সাথেও দেখা হবে এটাই স্বাভাবিক।তো?এতো থমকে যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই।মহুয়া ধীরপায়ে খাটের কোনে বসে পড়ে।মৃত্তিকা ও তুষার এখনো ঘুমিয়ে আছে।মিনিট কয়েক বসে থাকার পরেই, হঠাৎ করে মহুয়ার মাথায় একটা ভাবনা খেলে যায়।সে আসলে আছে কোথায়?এটা কোন জায়গা?আবরার যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল,সেই জায়গাটা খুব পরিচিত মহুয়ার।এক সময়ে সে এখানে স্বর্গসুখ লাভ করতো।তবে কি? মহুয়া মৃত্তিকার উপর দিয়ে তুষারের কপালে হাত দেয়।হালকা ধাক্কা দিয়ে মৃদু গলায় ডাক দেয় তাকে।

—” মিত্তির বাবা,মিত্তির বাবা।এই মিত্তির বাবা।”
—” হুম”—ঘুমঘুম কন্ঠে উত্তর দেয় তুষার।এতোক্ষণ একপাশ হয়ে শুয়ে থাকলেও, এখন সোজা হয়ে শোয়।ডান চোখটা হালকা মেলে রাখে।
—” আমরা এখন কোথায় আছি?লক্ষ্মীবাজারে না?”
—” উঁহু।নয়া পল্টন।”
—” নয়া পল্টন কেন?আপনার বাড়ি না লক্ষ্মীবাজার?”
—” ফ্ল্যাটের কথা বলেছিলাম না তোমায়?ফ্ল্যাট নয়া পল্টনে।লক্ষ্মীবাজারে এতোদিন আমি ভাড়া থাকতাম।কালকে এখানে শিফট হয়েছি।তুমি উঠেছো কেন?ঘুমিয়ে থাক।”
—” আমার আর ঘুম আসবে না।”
—” তাহলে একটু কষ্ট করে মিত্তির প্যাম্পার্সটা খুলে দেও না।কাল রাত থেকে পরে আছে।অনেক ভারী হয়ে গেছে মনে হয়।”
—“ঠিক আছে।”

আবারো পাশ ফিরে ঘুমিয়ে যায় তুষার।তার ক্লান্তির রেশ যে এখনো কাটেনি তা দেখলেই বুঝা যায়।মহুয়ার মাথা ঝিমঝিম করছে।সে থম ধরে বসে থাকে কতক্ষণ। তার মানে এই সেই ফ্ল্যাট, যেটা আবরারদের ঘর থেকে সে উঁকি দিয়ে দেখতো!এটা খুব পছন্দ ছিল মহুয়ার।রুমগুলো, বারান্দাটা কত বড়।মহুয়া ঘাড় ঘুরিয়ে পুরো রুম দেখলো।সাদা-গোলাপি রঙ করা হয়েছে।রুমটা বেশ বড়।খাট,আলমারি,ড্রেসিং টেবিল,টেবিল,দুটো ফুলদানি,দেয়াল শোকেস সব একসাথেই এ ঘরে রাখা।তাই একটু দমবন্ধ হয়ে আসে।বাইরের রুমগুলোর কি অবস্থা, তা জানা নেই মহুয়ার।কাল রাতে চোখে ঘুম ছিল বলেই বোধহয় ঘরটা পরিচিত মনে হয়নি।মহুয়ার নিজের ভাগ্যের উপর এখন আর রাগ হয় না।আক্ষেপও হয় না।নিজের ভাগ্যের উপর খুব হাসি পায় তার।ঘুরে ফিরে এক জায়গায়ই কেন চলে আসে সে?আগের সবকিছু ভুলে মহুয়া নতুন করে সব শুরু করলো।আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো, যাতে আর কখনো অতীতের দেখা না পায়।অথচ বিয়ের পরের দিনই দেখে সে প্রাক্তনের চোখের সামনে এসে পড়েছে।মানে, এরকম আজগুবি জিনিস আর কার সাথে ঘটেছে?মহুয়া কি জীবনে খুব বেশি পাপ-টাপ করে ফেললো নাকি?নাকি আল্লাহ ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে?কে জানে!
পাশে মৃত্তিকা নড়েচড়ে উঠতেই সচেতন হয় মহুয়া।মেয়েটার বোধহয় খুব অস্বস্তি হচ্ছে।ঘুমের মধ্যেই খুব অস্থিরতা করছে।মহুয়া মৃত্তিকাকে নিজের কাছে টেনে আনে।আলতোহাতে প্যাম্পার্স খুলে দেয়।এই মেয়েটাকে খুব ভালো লাগে তার।মহুয়ার বরাবরই একটা বাচ্চার শখ।একদম ছোটবেলা থেকে।তার কেন কোনো ছোট ভাই-বোন নেই,এ নিয়ে প্রশ্ন করে সাবিনা বেগমকে কম বিরক্ত করেনি সে।বাচ্চাদের ধরতে,আদর করতে, কোলে নিতে খুব ভালো লাগে তার।বিয়ের পর ভেবেছিল আবারারের মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু বিধি বাম! সেখানেও ব্যর্থ।তুষারকে নিয়ে এখনো কোনোকিছু ভাবেনি মহুয়া।ভাবতেও চায় না।যেভাবে চলছে চলতে থাকুক।মহুয়ার কেবল এই বাচ্চা মেয়েটার প্রতি মায়া।একটা বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা যায় না?অবশ্যই যায়।মহুয়া ঠিক এটাই করবে।সে কখনোই তুষারের প্রতি আগে আগেই দুর্বলতা দেখাবে না।আগে তুষারের মতিগতি বুঝবে।তারপর যা হবে দেখা যাবে।
মহুয়া মৃত্তিকার পাশ থেকে উঠে নিজের ফোন খুঁজে।কোথায় আছে কে জানে!কাল আসার পর বাড়িতে একবারও কথা বলা হয়নি।মা-বাবা অসুস্থ হয়ে গেছে নাকি আল্লাহ মালুম।বহু খুঁজেও ফোন পেল না মহুয়া।লাগেজের ভিতর,ব্যাগের ভিতর,তুষারের পাঞ্জাবীর পকেটে –কোথাও নেই।মহুয়ার চোখ যায় টেবিলের উপর।খাবারের প্লেটের পাশেই একটা ফোন।খুব সম্ভবত তুষারের।মহুয়া মুখ বেঁকিয়ে ভাবলো।ফোনটা কি ধরবে?তুষার তো ঘুমাচ্ছে।না বলে কারো ব্যাক্তিগত জিনিস কি ধরা উচিৎ? মহুয়া বেশ কিছুক্ষণ ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো, সে এখন তুষারের ফোনটাই ব্যবহার করবে।তুষারকে ঘুম থেকে তুলে অনুমতি নেবে।না বলে আরেকজনের জিনিস আবার কিভাবে ধরে?মহুয়া মোটেও অসামাজিক নয়।তাই মহুয়া ধীরে ধীরে তুষারের পাশে যেয়ে বসে।আবারো আস্তে আস্তে কপালে হাত ছোঁয়ায়।মৃদু স্বরে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তুষারকে।

—” মিত্তির বাবা,এই মিত্তির বাবা।”
তুষার কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই চোখ মেলে তাকায়।তার কপালে বিরক্তির ভাঁজ।
—” আবার কি, মহুয়া?”—বেশ অসহায় শোনায় তুষারের কন্ঠ।
—” আপনার মোবাইলটা একটু নেই।আমারটা খুঁজে পাচ্ছি না।বাসায় ফোন দেব।”
বেশ অবাক হয়ে উঠে বসে তুষার।ক্ষীণ গলায় বলেঃ”এই জন্য আমাকে তুমি ডেকেছো?শুধুমাত্র এই সামান্য কারণে? ”
—“হ্যাঁ! ”
—“এটা অনুমতি নেওয়ার কি আছে, মহুয়া?আমার ফোন ধরলে কি আমি তোমায় বকা দেব?আশ্চর্য!মানুষ কিডনিও এভাবে চায় না।”
মহুয়া কিছু না বলে ফোন নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।গলায় বিরক্ত ফুটিয়ে তুলে —” আমাকে অসামাজিক ভেবেছেন?আমি কারো ব্যক্তিগত জিনিস না বলে ধরি না।আর বিরক্ত করব না।ঘুমিয়ে থাকুন।”
—“আরেকবার বিরক্ত করলে তোমাকে আমি খুন করে ফেলব।আগামী আধ-ঘন্টার আগে মোটেও ডাকবে না আমাকে।”

মহুয়াকে কথাগুলো বলে আবারো শুয়ে পড়ে তুষার।কাঁচা ঘুম ভাঙলে কেমন লাগে মানুষের?মৃত্তিকা নিজের জায়গা থেকে গড়িয়ে তার বাবার জায়গায় এসে পড়েছে।তুষার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে।এটা তার স্বভাব।ঘুমের সময় মেয়েকে না জড়িয়ে ধরলে তার ঘুমই আসে না।তুষারের চোখে ঘুম নেমে আসার আগেই তা ভেঙে যায়।কারণ,ঘুমের মাঝেই মৃত্তিকা তার শরীর ভিজিয়ে ফেলেছে।তুষার চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে।পাশে মহুয়া এখনো দাঁড়ানো।তার দিন- দুনিয়া অন্ধকার করে হাসি আসছে।তুষারের চেহারাটা দেখার মতো হয়েছে।কিন্তু এখন মোটেও হাসা যাবে না।তুষার বেশ অনেক্ষণ অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকার ফট করে উঠে দাঁড়ায়।আজ দিনটাই খারাপ।তার বউ ও মেয়ে বিশ্বখারাপ।ঘুমাতেই দিলো না।অসহ্য।বিরবির করতে করতেই বাথরুমের দিকে ছুটে তুষার।

***

মহুয়া গোসল সেরে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো।কাল রাতে ঘুমিয়ে না গেলে আগেই গোসল করতো।গাড়ি থেকে নেমে গোসল না করলে খুব অসহ্য লাগে মহুয়ার।তাছাড়া, খুব ক্ষিদেও পেয়েছে।মহুয়া তার রুমে রাখা খাবারের প্লেট নিয়ে বেড়িয়ে এলো।খাবারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।তুষার বাইরে গেছে,মৃত্তিকা এখনো ঘুমায়।মহুয়া রুমের বাইরে পা দিয়ে কাউকে দেখলো না।বিয়েবাড়ি হলেও তুষারের বাড়িতে কোনো আমেজই নেই।এদের কি কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই?মহুয়া মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে রান্নাঘরের দিকে গেল।এখান থেকে পানির আওয়াজ আসছে।মহুয়া সেখানে যেয়ে দেখলো, রুবিনা বেগম চা বানাচ্ছেন।মহুয়া তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য গলায় হালকা কাশি তুলে।রুবিনা বেগম পিছু ফিরে মহুয়াকে দেখে মুচকি হাসে।

—” এসো মহুয়া।কখন উঠলে?”
—” একটু আগে।”
—” মিত্তি উঠেছে?”
—” জ্বি না।”
রুবিনা বেগমের চোখ যায় মহুয়ার হাতের প্লেটের দিকে।
—” ওটাতে কি?”
—” খাবার।কালকে রাতে মনে হয় মিত্তির বাবা নিয়ে গেছিল।নষ্ট হয়ে গেছে।”
—” খাওনি তোমরা রাতে!”
—” জ্বি না।খাওয়া হয়নি।”
—” ওমা এতোক্ষণ না খেয়ে কিভাবে থাকে মানুষ?চা হয়ে গেছে, চা খাও।তুষার নাস্তা আনতে গেছে।”
রুবিনা বেগম কাপে চা ঢালার আয়োজন করেন।মহুয়া একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে।কিছুক্ষণ পর বলেঃ” খালুর শরীরটা এখন কেমন?”
—” আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।”
—” কি হয়েছিল?”
—” হঠাৎ করেই কাল বুকে ব্যথা উঠেছিল।এখন অবশ্য অনেকটাই ভালো।ঘুমাচ্ছে।তোমার সাথে আলাপ হয়েছে?”
—” জ্বি না।”
—” ঘুম থেকে উঠলে পরিচয় করিয়ে দেব।এখন খাও তো।”

মহুয়ার চা খাওয়ার ফাঁকেই তুষার এসে পড়ে।মহুয়া ডাইনিংয়ে বসেছিল।তুষারও এসে ওর পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে।রুবিনা বেগমকে হাঁক দিয়ে বলে—” খালামনি,নাস্তা এনেছি।চা দেও।”
—” দিচ্ছি,অপেক্ষা কর।”
তুষার এক নজর মহুয়ার দিকে তাকায়।গোসল করায় বেশ সতেজ লাগছে মেয়েটাকে।গায়ে একটা নীল রঙের শাড়ি জড়ানো।শাড়ির সোনালী আঁচল মাথায় দেওয়া।তুষার বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর নিচুস্বরে বললঃ” তোমাকে শাড়ি পড়লে অনেক বড় বড় দেখা যায়।”
—” আমি তো বড়ই।আমার সাতাশ চলছে,অষ্টাদশ নয়।”
—” হ্যাঁ, ঠিকাছে।কিন্তু এতোদিন এতো বড় দেখা যেত না।আজ দেখাচ্ছে।এখন থেকে পারলে শাড়িই পরো। ”
—” দেখি।আপনার এতো দেরি হলো যে?”
তুষার চেয়ারে হেলান দেয়।
—” আর বলো না,নতুন এলাকায় রাস্তা-ঘাট কিছুই চিনি না।হোটেল খুঁজতে খুঁজতেই দেরি হয়ে গেল।”
—“গলির মাথাতেই একটা দোকান আছে।ওখানে গেলেই পেয়ে যেতেন।”
তুষার সোজা হয়ে বসে।ভ্রু কুঁচকে বলেঃ”তুমি কি করে জানলে?”
—“আমি এই নয়া পল্টনেই ছিলাম।তাই অনেক কিছুই চিনি।আমার কথা ছাড়ুন। আপনি বলুন,দোকান কি করে খুঁজে পেলেন?”
—” ইশতিয়াক নামের একজন ভদ্রলোক সাহায্য করেছেন।উনিও নাকি এদিকেই থাকেন।তিনি না থাকলে আরো দেরি হতো।ভদ্রলোক বেশ অমায়িক, বুঝলে।আমাকে নিজে দোকানে নিয়ে গেল।”

ওদের আলাপচারিতা হয়তো আরো কিছুক্ষণ চলতে পারতো কিন্তু চললো না মৃত্তিকার জন্য।সে উঠে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে।তুষার উঠার আগেই মহুয়া উঠে পড়লো।মুখে বললঃ” আমি এখন মেয়ের সাথে ভাব জমাবো।আপনি কিন্তু আমাদের মাঝে আসবেন না।হয়তো মিত্তি কাঁদবে।তাও নাক গলাবেন না। বুঝেছেন?”
তুষার মাথা নাড়ে।মা-মেয়ের রাজ্যে সে এখন নিষিদ্ধ প্রানী।

***

বিকালে মহুয়া ও মৃত্তিকা বসেছিল ঘরে।মৃত্তিকা অনেকটাই চিনে গেছে মহুয়াকে।সকালবেলা মহুয়া তাকে নিয়ে এদিক-ওদিক হেঁটেছে,খাবার খাইয়ে দিয়েছে,দুপুরে গোসল করিয়ে দিয়েছে।মহুয়ার বুকের উপর ভর দিয়ে বসেছিল মৃত্তিকা।সে তার মায়ের কানের দুল নিয়ে খেলছে।এটা তার জন্য নতুন খেলা।সে বেশ আগ্রহী।ঘড়ির কাটায় সাড়ে পাঁচটার মতো বাজে।এমন সময় ঘরে ঢুকলো তুষার।সে আজ দোকানে যায়নি।বিয়ে উপলক্ষে কয়েকদিন কাজ থেকে দূরে থাকবে।তুষার এসে মহুয়ার পাশে বসে।মৃত্তিকাকে কোলে টেনে বলেঃ” আমার মা আমাকে ভুলে গেছে?”
মহুয়া বেশ বিরক্ত হয় এতে।সে আধশোয়া থেকে উঠে বসে। কপাল কুঁচকে বলেঃ” আমরা খেলছিলাম,মিত্তির বাবা।আপনি একটা ডিস্টার্ব। ”
—” খেলো, আমি কি মানা করেছি?”
—” হুহ।মেয়েকে নিয়ে গেছেন আপনি।”
তুষার মহুয়ার কথায় কিছু বলল না।আলমারি থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করে তা মহুয়ার হাতে দিল।
—” এই নেও।”
—” কি এটা?”
—” তোমার প্রথম রাতের উপহার।কালকে তো ঘুমিয়ে গিয়েছিলে,তাই দিতে পারিনি।দেখে বলো তো কেমন হয়েছে।”
মহুয়া শপিং ব্যাগ থেকে একটা বাক্স বের করলো।বেশ সুন্দর একটা চেইন আছে তাতে।পাশে আরেকটা ছোট্ট বাক্স।সেটা খুলে দেখলো, তাতে একজোড়া চুড়ি।মৃত্তিকার হাতের মাপের।দুটোই বেশ সুন্দর।
—” বাহ,বেশ সুন্দর তো।”
মহুয়া মুখ তুলে দেখলো তুষার নেই।তাকে দেখতে বলে বারান্দাতে চলে গেছে।সেখান থেকে তার কথা শোনা যাচ্ছে।মহুয়া মৃত্তিকাকে নিয়ে সেখানে গেল।লোকটা সত্যিই একটা পাগল।মহুয়া বারান্দায় যেয়ে দেখলো, তুষার সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা আবরারের সাথে কথা বলছে।মহুয়ার অস্তিত্ব টের পেতেই সে পিছু ফিরে। হাত বাড়িয়ে মহুয়ার কাঁধ টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে।তারপর আবার আবরারকে উদ্দেশ্য করে বলেঃ”এই যে ইশতিয়াক ভাই,এটা আমার বউ মহুয়া।আর এটা মেয়ে মৃত্তিকা।আর মহুয়া উনি ইশতিয়াক আবরার।ওই যে সকালে ইশতিয়াক ভাইয়ের কথা বললাম না,উনিই তিনি।”

# (১৩)

মহুয়ার প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে।অস্বস্তির কারণ আবরার নয় তুষার।তুষারের হাত এখনো তার কাঁধের উপর।মহুয়ার মাথা তুষারের গলার কাছাকাছি।খুব সহজেই তুষারের পারফিউমের গন্ধ মহুয়ার নাকে ধাক্কা দেয়।তাদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকলেও এতোটা ধরা-ছোঁয়ার সম্পর্ক নেই।তাই সারা শরীরে অস্বস্তিরা ভর করেছে।এই তুষার আবার তাকে আবরারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।হাহ!পৃথিবীতে কত আজব ঘটনাই না ঘটে।আবরারকে মহুয়ার চাইতে ভালো আর কে চিনে?এরকম হারামজাদা মহুয়া একটাই দেখেছে।তবে এবার আর আবরারের মুখোমুখি হয়ে থমকে গেল না মহুয়া।সকাল থেকেই নিজেকে যথেষ্ট প্রস্তুত করে নিয়েছে।আবরার শুধুমাত্র প্রাক্তন। বর্তমান তো আর নয়।তাছাড়া, আবরার মহুয়ার প্রতি আকৃষ্ট নয়।মহুয়াও আবরারের প্রতি দুর্বল নয়।তাহলে?অস্বস্তিতে ভোগার আর কারণই নেই।তাই তুষার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর মহুয়া মুচকি হাসলো।বেশ প্রসন্ন গলায় বললঃ”আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।ভালো আছেন?”
—” হ্যাঁ। তুমি ভালো আছ?”—আবরারের কন্ঠ অপ্রস্তুত।চোখের দৃষ্টিতেও বিচলতার ছাপ।
—” আলহামদুলিল্লাহ, আমিও ভালো আছি।”
মহুয়া নিজের কাঁধ থেকে তুষারের হাত ছাড়িয়ে নেয়।তার কোলে থাকা মৃত্তিকা এদিক-ওদিক দেখছে।এই পরিবেশ তার জন্য সম্পূর্ণ নতুন।মহুয়া তুষারকে বললঃ” আমি ঘরে যাচ্ছি।”
—” আচ্ছা।”

মহুয়া পা বাড়ালেও মৃত্তিকা বেশ অস্থিরতা শুরু করে দেয়।তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে, সে এখন এখান থেকে যাবে না।মহুয়া আবারো তুষারের দিকে এগিয়ে আসে।
—” মিত্তির বাবা,বাবুকে রাখেন।ও এখন ঘরে যাবে না।”
—” দেও।”

মহুয়ার কোল থেকে মৃত্তিকাকে আলতোহাতে কোলে নেয় তুষার।তার ঠোঁটের কোনের হাসি ও মুখের অনবদ্য সুখের ছাপ আবরারের চোখ এড়ায় না।মহুয়া আগের থেকে অনেকটাই বদলে গেছে।আগে আরেকটু সুন্দর ছিল।এখন বেশ শুকিয়ে গেছে।মেয়েটাকে শাড়ি পরলে বেশ লাগে।শাড়ি সামলাতেও পারে খুব।একটা কথা আবরারের খুব জানতে ইচ্ছে করে।মহুয়ার বিয়ে হলো কবে?এতো বড় একটা মেয়েই বা কবে হলো?তবে দুজনকে মানিয়েছে বেশ।ওদের বাচ্চাটাও খুব সুন্দর।একদম তুলতুলে।ঠিক বিড়াল ছানার মতো।বিড়াল ছানার কথা মনে আসতেই মহুয়ার আবদারের কথা মনে পড়ে যায়।আবরারের কাছেও ঠিক এরকম একটা বিড়াল ছানার আবদার করেছিল মহুয়া।যার ছোট দুটো হাত থাকবে,দুটো পা থাকবে,ঘরজুরে ঘুরে বেড়াবে–এরকম একটা বিড়াল ছানা।মেয়েটার চাহিদাগুলোও কেমন অদ্ভুত ছিল।ময়না পাখি, গাছ-গাছালি,প্রশংসা আর আবরারের একটু সময়–এই কয়েকটা জিনিসই চেয়েছিল সে।কিন্তু তার একটাও দিতে পারেনি আবরার।দীর্ঘশ্বাসে তার ভিতরটা ভারী হয়ে আসে।মহুয়া যাওয়ার আগে কোনো অভিশাপ দিয়ে যায়নি ঠিকই,কিন্তু আবরারের ভিতর অনুশোচনার বীজ বুনে দিয়ে গেছে।এর যন্ত্রণা যে কি তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পায় আবরার।

—” বা বা,বা বা “—মৃত্তিকার কন্ঠে চিন্তার রাজ্যে ভাঙন ধরে আবরারের।মেয়েটা কথাও বলতে জানে!কি সুন্দর করে তার বাবাকে ডাকলো!আবরার খুব প্রশংসার সুরে বলেঃ” আপনার মেয়েটা ভারী মিষ্টি, তুষার ভাই।বয়স কত ওর?
—” একবছর হয়নি এখনো।একবছর হতে আর কয়েকদিন বাকি।”

একবছর?তাহলে কি এটা মহুয়ার নিজের মেয়ে না?আবরার বেশ ইতস্তত করে বলেঃ”মেয়ের মায়ের সাথে কিন্তু মেয়ের চেহারা মিলে না।মনেই হয় না যে এটা মহুয়ার মেয়ে।”
আবরারের ইঙ্গিতের ধারে কাছেও যায় না তুষার।মেয়ের গালে চুমু খেয়ে মুচকি হাসে।
—” চেহারা না মিললে কি হয়েছে এটা মহুয়ারই মেয়ে।আমার সাথেও তো চেহারা মিলে না।তো?এটা আমাদেরই মেয়ে।”
—” ওহ,আচ্ছা।”

তুষার মৃত্তিকাকে নিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটে।হাত দিয়ে এটা -ওটা দেখায়।বারান্দাটা খোলা।মহুয়ার না বারান্দা পছন্দ?তুষার অনেকগুলো গাছ এনে দেবে।অনেকগুলো বাহারি গাছ লাগানো যাবে এখানে।ছোট-খাটো একটা ময়না পাখিও এনে দেবে।মহুয়ার ইচ্ছেগুলো সব মনে আছে তুষারের।সামান্য ইচ্ছে পূরণ করে যদি কারো মুখে হাসি ফোটানো যায়,তবে মন্দ কি!

—” ইশতি,ইশতি।কোথায় তুমি?”
অনন্যার কন্ঠ কানে আসতেই সোজা হয়ে দাঁড়ায় আবরার।তুষারের থেকে বিদায় নেওয়ার উদ্দেশ্যে বলেঃ” আসছি, তুষার ভাই।মিসেস ডাকছে।আপনার সাথে পরে কথা হবে।”
—” আচ্ছা।একদিন আসবেন আমাদের বাড়ি।”
—” ঠিকাছে।”

মুখে সম্মতি জানালেও মনে মনে হাসে আবরার।তুষার বোধহয় জানে না, সে মহুয়ার প্রাক্তন ছিল।জানলেও কি একই কথা বলবে?কে জানে!
আবরার ঘরে যেয়ে দেখলো, অনন্যা দাঁড়িয়ে আছে।একদম তৈরি হয়ে আছে।হয়তো কোথাও যাবে।মেয়েটা পারেও বটে।অফিস থেকে ফিরেছে আধ-ঘণ্টাও হয়নি।অথচ,এর মাঝেই একেবারে হাত-মুখ ধুয়ে আবার বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।অনন্যা বেশ আধুনিক মেয়ে।সংসার,চাকরি সামলানোর পরে এখন আবার একটা মানবাধিকার সংগঠনের সদস্য হয়েছে।তাই সারাদিনে সে বেশ ব্যস্ত থাকে।আবরারের সাথে অফিস থেকে ফিরার পর, ঘরের কাজ-কর্ম শেষ করে কখনো বাড়ি থাকে আবার কখনো থাকে না।বেশিরভাগ সময়ই রাতের আগে অনন্যার চেহারা দেখার ভাগ্যও হয় না আবরারের।এসবকিছুই আবরার মেনে নিয়েছে।আজকাল বেশ শান্ত হয়ে গেছে সে।আগের সেই হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়ার বাতিক নেই।অবশ্য, অনন্যার সাথে কখনো রাগ দেখাতেও পারেনি আবরার।ইচ্ছে করেই দেখাতো না।অনন্যা তার বড় সাধের মানুষ।তার অর্ধাঙ্গিনী, প্রেয়সী।এরকম মানুষের সাথে রাগ দেখানো যায়?

—” ইশতি, খাবার রান্না করা আছে।একটু কষ্ট করে খাওয়ার আগে গরম করে নিও।”
—” আজকে না গেলে হয় না অনু?”
—” আরে না। আজ একটা সম্মেলন আছে।”
—” আচ্ছা,সন্ধ্যাবেলায় কিসের সম্মেলন থাকে প্রতিদিন?এইরকম সংগঠন জীবনেও দেখিনি আমি।”
ফুঁসে উঠে অনন্যা।এটা তার ভালোবাসার জায়গা।কটকটে গলায় উত্তর দেয়ঃ” যেটা বুঝো না, সেটা নিয়ে কথা বলবে না।চাকরিজীবী মহিলাদের জন্য এই ব্যবস্থা।তাছাড়া, আমি না থাকলে তোমার কি সমস্যা?আমি তো আর বাসা-বাড়ি কাঁধে তুলে নিয়ে যাচ্ছি না।”
—” সেটাই।তুমি না থাকলে আমার কি সমস্যা!আচ্ছা একটা কথা বলো,যদিই বিয়ের পর আমাকে সময়ই না দিতে পারো তবে বিয়ে করেছ কেন?তোমাকে মাঝে মাঝে আমি মিলাতে পারি না।তুমি আর আগের মতো নেই অনু।আগে তুমি আমার সঙ্গ পছন্দ করতে,সারাদিন কথা বলার পরেও কথা ফুরাত না,একদিন দেখা না করলে পাগল হয়ে যেতে–এরকম আরো কত পাগলামি করেছ।এসব কি একবারের জন্যও মনে পড়ে না?তুমি বদলে গেছ, অনু।”
শেষদিকে খুব অসহায় শোনায় আবরারের কন্ঠ।খানিকটা ক্ষোভও ফুটে উঠে গলায়।হয়তো অনন্যারও খারাপ লাগে।সে হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখে।একপা-দুপা করে আবরারের দিকে এগিয়ে এসে তার চুল নেড়ে দেয়।বেশ আদুরে গলায় বলেঃ” তোমার অনু বদলায়নি,কখনো বদলাবেও না।সে শুধু একটু ব্যস্ত হয়ে গেছে।রাগ করো না, ইশতি।আজ খুব জলদি চলে আসব।প্রমিস।তুমিও আমার সাথে চলো।তোমার বেশ ভালো লাগবে।”
—” আমার ভালো লাগার দরকার নেই।তোমার ভালো লাগলেই চলবে।যাও,যেখানে যাচ্ছিলে।”

আবরার মুখ ফিরিয়ে নেয়।ভালো লাগে না তার এসব।নিজেকে এখন ব্যর্থ মনে হয়।বুঝতে পারে জীবনটা দীর্ঘশ্বাসে ভরে গেছে।জেনে-বুঝে দুটো নারীর মন ভেঙেছে।তাদের চোখের জল ঝরিয়েছে।এদের মূল্য তো চুকাতেই হবে।সৃষ্টিকর্তা কখনো ছেড়ে দেন না।

***

মহুয়া ঘর গোছাচ্ছিল।কালকে আসার পর আর গোছানো হয়নি।ফলস্বরূপ এখানে কাপড়, ওখানে কাপড়।সারাঘরে পোশাকের ছড়াছড়ি।গোছাতে গোছাতেই হাত আটকে যায় বিয়ের শাড়ির উপর।বিয়ের জন্য একটা সিঁদূর লাল রঙের শাড়ি কিনেছে তুষার।খুব ভারী শাড়ি না।সাধারনের মধ্যে অসাধারন।মহুয়ার একটুও কষ্ট হয়নি কাল।সাজগোজের বাহুল্যও ছিল না খুব।তুষারের পছন্দ আছে বলতে হবে।মহুয়ার শাড়ির সাথে মিল রেখে খুঁজে খুঁজে একই রঙের একটা জামা কিনেছে মৃত্তিকার জন্য।জামাটায় দারুন মানিয়েছে মৃত্তিকাকে।একদম একটা পুতুল।মাঝে মাঝেই মৃত্তিকাকে কামড়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে মহুয়ার।একটা বাচ্চা এতো ফুটফুটে কেন হবে?

—“এই মহুয়া, দেখেছিলে গয়নাগুলো?ভালো লেগেছে?”
তুষার মহুয়ার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।মৃত্তিকা খাটে বসা।তুষারকে দেখেই খুব বিরক্ত লাগলো মহুয়ার।জ্ঞানহীন লোক।যার না তার সাথেই নিজের বউয়ের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।ফাজিল কোথাকার।
মহুয়া নিজের বিরক্তি গিলে নিল।হাজার হলেও সে নতুন বউ।অযথা ঝামেলা করার কি দরকার?তাই হাতের কাপড়গুলো আলমারিতে রাখতে রাখতে বললঃ” হুম,ভালোই।”
—“পরেছো?”
—” না।”
—” কেন?”
—” ইচ্ছে করছে না।”

মহুয়ার কন্ঠস্বর তুষারের কানে খট করে বাজে।নিষ্প্রাণ কন্ঠ।মেয়েটার কি মন খারাপ?তুষার মহুয়ার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়।তার হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে দেয়।মহুয়ার কাঁধ ধরে নিজের দিকে ফিরায়।

—” মন খারাপ?বাড়ির জন্য খারাপ লাগছে।”
—” খানিকটা।”
—” মন খারাপ করো না।কালকে বৌভাতের পরেই তো যাব।আর কয়েকটা ঘন্টা মাত্র।”
—” আচ্ছা, আর মন খারাপ করব না।এখন ছাড়ুন।হয়েছে কি আপনার বলুন তো?যখন তখন কাঁধ জড়িয়ে ধরছেন।সরুন এখান থেকে।আমার অস্বস্তি হচ্ছে।”

তুষার হাত সরিয়ে নিলেও মহুয়ার পাশ থেকে সরে যায় না।বরং মহুয়ার গা ঘেসে আলমারির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।মুখে হাসি টেনে বলেঃ”আজকে খুব প্রেম প্রেম পাচ্ছে,বুঝলে।বিয়ের পানি পেটে পরেছে।তাই কেমন যেন মাতাল মাতাল লাগছে নিজেকে।আমার কি দোষ বলো?”
—“আপনি চূড়ান্ত পর্যায়ের খারাপ।কথা-বার্তার কি ছিড়ি!আপনি আজকে ভয়াবহ একটা অন্যায় করেছেন।এর জন্য আপনাকে চরম শাস্তি দেওয়া উচিৎ। ”
তুষার সোজা হয়ে দাঁড়ায়।ভ্রু কুঁচকে বলেঃ”কি করলাম আমি?”
—” আপনি আমাকে যার-তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন কেন?বউ বলেই কি সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে?”
—” সবার সাথে কোথায় পরিচয় করালাম?শুধু ইশতিয়াক ভাইয়ের সাথেই তো।আরে উনি একদম নাকের ডগার প্রতিবেশী। ব্যবহারও ভালো।এদের সাথে ভাব না জমালে…..
মহুয়া তেড়ে আসে তুষারের দিকে।দু-পা এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলেঃ” খবরদার,মিত্তির বাবা।আর একবার যদি আপনার সাধের ইশতিয়াক ভাইয়ের নামে গুণগান করেছেন,খবর আছে আপনার।কসম, আমি আপনার গলায় ছুরি ধরব।”
মহুয়ার এরকম আগ্রাসী রূপ দেখে থমকে যায় তুষার।একদম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকায় মহুয়ার চোখের হিংস্রতা নজর এড়ায় না।তার খটকা লাগে।কি ব্যাপার? ইশতিয়াক ভাইকে নিয়ে এতো সমস্যা কেন মহুয়ার?তারা কি পূর্ব পরিচিত?
তুষার মহুয়ার হাত টেনে খাটে বসায়।গ্লাসে পানি ঢেলে তা বাড়িয়ে দেয় মহুয়ার দিকে।
—” নেও পানি খাও।খেয়ে পুরো কথা খুলে বলো।ইশতিয়াক ভাই তোমার পরিচিত?”

মহুয়া এক নিঃশ্বাসে পানি খেয়ে নেয়।গলাটা শুকিয়ে গেছে একদম।মৃত্তিকাও ততোক্ষণে মহুয়ার কাছে এসে পড়েছে।মহুয়ার কাঁধে ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়।মহুয়ার খোপা একটা কাঠি দিয়ে আটকানো।বেশ বাহারি জিনিস এটা।মাথায় আঁচল না থাকায়,সহজেই তা চোখে পড়ে মৃত্তিকার।মুহূর্তেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মায়ের খোপা নিয়ে।খেলতে খেলতে মুখ দিয়ে নানা ধরনের অর্থহীন শব্দ করে।এগুলো যে তার কথা বলার প্রচেষ্টা, তা বুঝতে বাকি থাকে না।
পানি খেয়ে মহুয়া লম্বা দম নেয়।এ যেন রাগ গিলে নেওয়ার কৌশল।মহুয়ার হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে নেয় তুষার।মহুয়ার পাশে বসে আশ্বস্তের ভঙ্গিতে বলেঃ” এবার বলো ঘটনা কি।ইশতিয়াক ভাইয়ের সাথে তোমার কি সম্পর্ক? ”
—” ইশতিয়াক আবরার!নামটা পরিচিত মনে হচ্ছে না আপনার?—খুব উত্তেজিত শোনায় মহুয়ার কন্ঠ।
“ইশতিয়াক আবরার” নামটাকে নিজের মনেই দুবার আওড়ে নেয় তুষার।দুবারের বেলায় জ্বিভ থমকে যায়।আবরার! তুষারের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।মহুয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেঃ”তোমার প্রাক্তনের নাম আবরার না?এই কি সে?”
মহুয়া মাথা নাড়ায়।ইশারায় বুঝিয়ে দেয় এটাই সেই মানুষ।
অবাকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তুষার।এরকম একটা ঘটনাকে আসলে কি বলা যায়?কাকতালীয়?
—” আবরারকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল আমার।ইচ্ছেটা এত তাড়াতাড়ি পূরণ হবে তা কল্পনাও করিনি।”
—” এটাই সেই শয়তান আবরার।ব্যবহার দেখেছেন হারামজাদার?একে দেখে কেউ বলবে,এ একটা প্রতারক?”
মাথা নাড়ায় তুষার।চলনে-বলনে বেশ বিনয়ী আবরার।হঠাৎ করেই একটা কথা মাথায় আসে তুষারের।সে সোজা হয়ে বসে।মহুয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবুকের মতো বলেঃ”এখানে আসার পর আবরারের সাথে তোমার প্রথম কখন দেখা হয়েছিল?”
—” আজ সকালে।ঘুম থেকে উঠেই যখন আমি বারান্দায় গিয়েছিলাম তখন।”
—” ও আচ্ছা,এই জন্যই।”
তুষারের কথা বুঝতে পারে না মহুয়া।ভ্রু কুঁচকে বলেঃ” কি বলছেন?”
—“একটু আগে আমি যখন বারান্দায় গেলাম,তখন সেই আগে আমার সাথে কথা বলা শুরু করলো।এই ফ্ল্যাটে যে আমি থাকি তা হয়তো জানত না।আমাকে দেখে স্ত্রী-সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করলো।তখন তুমিও বারান্দায় গেলে।তাই তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম।আবার তুমি চলে আসার পর কি বলল,জানো?”
—” কি বলল?”
—” বলে মিত্তির সাথে তোমার চেহারার মিল নেই।আমি তো তখন বুঝিনি। তাই তার ইঙ্গিত ধরতে পারিনি।তোমার বিয়ে হয়েছে কবে এটাই জানতে চেয়েছে বোধহয়।আমাকে তো আর সরাসরি প্রশ্ন করতে পারবে না।তাই আকার-ইঙ্গিতে জানতে চেয়েছে।”
—” দেখেছেন কত্ত বড় শয়তান!আমার কবে বিয়ে হয়েছে সেটা ওই বেয়াদব জেনে কি করবে?আবার, আমার আর মিত্তির মাঝে মিল খুঁজে!কেন? আমাদের সাথে ওর কি সম্পর্ক? নির্লজ্জ কুকুর একটা।”

মহুয়ার কন্ঠের উত্তেজনা খুব সহজেই চোখে পড়ে তুষারের।আবরারের করা পাপ নিয়ে এখনো এতো উত্তেজিত মহুয়া!এতোদিনেও ভুলে যেতে পারেনি?কথাটা ভেবেও আবার বাদ দিয়ে দেয় তুষার।নিজেকেই নিজে বুঝ দেয়,কেন ভুলবে?ভুলে যাওয়া কি এতোই সহজ?আবরার মহুয়ার জীবনে প্রথম প্রেম ছিল –সেটা তো মহুয়ার কথা থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায়।বিয়ের আগেই তো এসব বলেছে মহুয়া।এখন বিয়ের পর আবারো আবরারের চোখের সামনে এসে পড়লো ওরা।এ যেন পুরোনো ক্ষতের রক্তক্ষরণ। খুব দরকার ছিল এসব?সৃষ্টিকর্তা আবার কি পরিকল্পনা করেছেন,কে জানে!আরেকবার বিরূপ ভাগ্যের শিকার হতে চায় না তুষার।বউ-বাচ্চা নিয়ে একটু শান্তিতে থাকতে চায়।যেরকম শান্তি সবাই চায়।কিন্তু তা কতটুকু সম্ভব আল্লাহ মালুম।চোখের সামনে প্রাক্তনের সাজানো সংসার দেখে মহুয়াই কি পারবে আবার সুন্দর করে সব শুরু করতে?দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে তুষারের।ব্যতিক্রম ভাগ্য বইতে বইতে ক্লান্ত সে।আর ভালো লাগে না এসব।

—” এই মিত্তির বাবা,কি ভাবছেন?”
মহুয়ার দিকে সচেতন হয়ে তাকায় তুষার।ভালোই লাগে মেয়েটাকে এখন।নিজের ভাবনাগুলো একপাশে ঠেলে দিয়ে,মুচকি হাসে।
—” ভাবছি তোমার কথা।তোমার মতো মহীয়সী নারী বাংলার ঘরে ঘরে দরকার।কি করে পারলে এটা করতে?”
—” কি করলাম আমি!”
—“তখন নিজের প্রথম প্রেমকে কি সুন্দর ভাইয়া ডাকলে।কয়টা মেয়ে পারে বলো তো?তোমার ভিতর দম আছে বলতে হবে।আমার খুব ভালো লাগছে, বুঝলে।যতবারই আবরারকে ভাইয়া ডাকার কথা মনে পড়ছে,ততোবারই খুব শান্তি শান্তি লাগছে।আমার কাছে নোবেল থাকলে, তোমাকে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার দিতাম।”
মহুয়ার পাশেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে তুষার।দু-হাত ভাঁজ করে তার উপর মাথা দেয়।উদাস গলায় বলেঃ”দুশ্চিন্তা না থাকলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর হতো, তাই না মহুয়া?”

চলবে….

যাত্রাশেষে (পর্ব-১০+১১)

#যাত্রাশেষে (পর্ব-১০+১১)
#হালিমা রহমান

মৃত্তিকা খাট ধরে দাঁড়িয়ে আছে।সে এখনো পুরোপুরি হাঁটতে পারে না।কোনো কিছু ধরে দাঁড়ায় ঠিকই, কিন্তু তা বেশিক্ষণের জন্য না।একটু দাঁড়ায়,কিছুক্ষণ পর আবার ধপ করে পরে যায়।মৃত্তিকাকে দাঁড় করিয়ে রেখে তুষার হাত-মুখ ধুতে গেছে।মেয়েটাকে রেখে কোথাও যেয়ে একটু শান্তি পায় না তুষার।সবসময় চিন্তায় থাকে।মৃত্তিকা বেশ দুষ্ট।স্থিরভাবে বসে থাকতেই পারে না।খালামনি ওকে সামলাতে পারল কি না,ঠিকমতো খাচ্ছে কি না,দাঁড়াতে যেয়ে পরে যাচ্ছে কি না–এসব চিন্তা করতে করতে একেবারে পাগল হয়ে যায় সে।বেশ কিছুক্ষণ মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিলো তুষার।রোদ তার সহ্য হয় না।অনেক্ষন রোদে থাকলেই চেহারা লাল হয়ে জ্বলতে থাকে।আজ সারাদিন মহুয়ার সাথে পার্কে বসা ছিল।কথায় কথায় যন্ত্রণা টের না পেলেও এখন বুঝতে পারছে।তুষার আরো কয়েকবার মুখে পানি দিয়ে বেড়িয়ে এলো।কিন্তু ঘরে এসেই তার চক্ষু চড়কগাছ।কোথায় মৃত্তিকা!যেখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সেখানে পানিতে ভরে আছে।অবশ্য এগুলো যে পানি না তা বেশ বুঝতে পারছে তুষার।নিশ্চয়ই মৃত্তিকা প্রস্রাব করে, সরে গেছে।মেয়েটা ভেজা জায়গায় থাকতেই পারে না।তুষার একটা কাপড় দিয়ে জায়গাটা মুছে ফেললো।তারপর রান্নাঘরের দিকে গেল।সে নিশ্চিত মেয়ে এখন সেখানেই আছে।
তুষারের ভাবনাই ঠিক।মৃত্তিকা ঠিকই রান্নাঘরের ফ্লোরে বসে আছে।শুধু বসে নেই।রান্নাঘরে রাখা আলুর ঝুড়ি উল্টে ফেলে দিয়েছে।ফলস্বরূপ, সব আলু নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে।মৃত্তিকার হাতে একটা আলু।সে সবে একবার সেটাতে দাঁত বসিয়েছে।এখনই থেমে যাবে না।আলুর পুরো গায়ে দাঁত বসাবে মৃত্তিকা।তুষারের নজরে এসব আসতেই, সে তাড়াতাড়ি মেয়ের কাছে বসে পড়লো।মৃত্তিকার হাত থেকে আলু কেড়ে নিয়ে চোখ পাকিয়ে ধমক দিলো।

—” এই মেয়ে,এই এতো দুষ্ট কেন তুই?এটার গায়ে ময়লা নেই?তোর পেটে যাবে না।পেট খারাপ হলে কষ্ট কার হবে? আমার?ফাজিল মেয়ে।সবসময় দুষ্টামি।”

তুষার রান্নাঘর থেকে মেয়েকে বের করে দিলো।একটা একটা করে আলু তুলে রাখলো।শরীরটা ভেঙে আসছে তার।সারা বিকাল মহুয়ার সাথে কথা বলার পর সন্ধ্যার দিকে আবার দোকানে গিয়েছিল।সেখানে ঘন্টাখানেক কাজ-কর্ম দেখার পর আবার রুবিনা বেগমের বাসায় যেতে হয়েছে।সেখানে আধঘন্টা থাকার পর মৃত্তিকাকে নিয়ে বাড়ি আসতে হয়েছে।দু-দন্ড জিরিয়ে নেওয়ার ফুরসত মেলে নি।রান্নাঘর গুছিয়ে বেরিয়ে এলো তুষার।আজকে আর রান্নাবান্নার ঝামেলা নেই।রুবিনা বেগম খাবার দিয়ে দিয়েছেন।একটু পর মৃত্তিকাকে খাবার গরম করে খাইয়ে দিলেই হবে।তুষার এখন একটু বসতে চায়।রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আবারো এদিক-ওদিক তাকালো তুষার। মেয়েটা আবার কোথায় গেল?এদিক-ওদিক চোখ বুলাতেই মৃত্তিকাকে নজরে এলো।ফ্রিজের পাশে বসে কি যেন করছে সে।তুষার কপাল কুঁচকে সেদিকে গেল।এই মেয়েতো এরকম চুপচাপ বসে থাকার মেয়ে না।আবার কি করছে সে?মৃত্তিকা ফ্রিজের পাশে থাকা তারের দিকে তাকিয়ে আছে।তার চাহনী দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় সে এটা ধরতে চাইছে।হাত বাড়িয়ে যেই না ধরতে যাবে ওমনি মেয়ের হাত ধরে ফেললো তুষার।মেয়েকে কোলে নিয়েই আলতো হাতে চড় দিলো পিঠে।মুখে বললঃ”এতো ফাজিল কেন, মিত্তি তুই?এটায় কারেন্ট আছে না?কারেন্টের কাছে কি এতো?যদি শক করতো কেমন লাগতো তখন?”

বাবার কথা মৃত্তিকা কি বুঝলো কে জানে!তূষারের মতো সেও কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।কিছুক্ষণ মাত্র।তারপর বাবার গালের উপর ঝাপিয়ে পরে কুট করে কামড় বসিয়ে দিলো।একটা মিষ্টি যন্ত্রণা। এই কাজটা মৃত্তিকা খুব ভালো পারে।তুষারের কোনো কথা বা কাজ অপছন্দ হলেই তুষারকে কামড়ে দেয়।তুষার মেয়েকে নিয়ে বিছানার কাছে এসে বিছানায় বসিয়ে দিলো।তারপর নিজেও মেয়ের মুখোমুখি বসলো।মেয়েকে কোলের কাছে টেনে এনে আহ্লাদী সুরে বললঃ”আমার মা কবে বড় হবে?মা এতো দুষ্টামি কেন করে? মা কি পচা?”

মৃত্তিকা হয়তো তুষারের আদর বুঝতে পেরেছে।সে বাবার দিকে আরো এগিয়ে যায়।বাবার কথার বিপরীতে ঠোঁট বাকা করে হাসে।মৃত্তিকা হাসলে দুই গালে টোল পরে।মহিমা হাসলেও গালে গর্ত হয়ে যেত।মায়ের এই বৈশিষ্ট্য প্রাকৃতিকভাবেই পেয়েছে মৃত্তিকা।তুষার মেয়ের দিকে একমনে চেয়ে থাকে।মহিমার এই সৌন্দর্যে বারবার মুগ্ধ হতো তুষার।মনে হতো যেন পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য আল্লাহ মহিমার হাসিতেই ঢেলে দিয়েছেন।মেয়েটাও একই রকম হয়েছে।হাসিটা তো পুরোই মায়ের।মৃত্তিকার চোখ দুটো শুধু তুষারের মতো।বাকি সবই মহিমার।

—” বা বা,বা বা,বা,বা।”

মেয়ের ডাকে সচেতন হয় তুষার।মৃত্তিকা তাকে এভাবেই ডাকে।তুষার মেয়েকে একদম কাছে টেনে আনে।হাসিমুখে প্রশ্ন করেঃ”কি হয়েছে আমার বাবার?তার কি কিছু লাগবে?আরো খেলনা লাগবে?”
মৃত্তিকা তুষারের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আবারো বলেঃ”বা বা,বা বা।”
তুষার দীর্ঘশ্বাস ফেলে।মেয়েকে পুরোপুরি দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলেঃ” কবে বড় হবি মা তুই?একটু তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যা তো।আমি দেখে চোখ জুড়াই।”

***

মহুয়া খাবার টেবিলে বসে আছে।খাচ্ছে না,খাওয়ার ভান করছে।খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে মহুয়া খুবই অলস।একই সাথে খুতখুতেও খুব।এটা খেতে পারে না, ওটা খেতে পারে না।যেদিন সাবিনা বেগম শুধু সবজি রান্না করেন,সেদিন আর মহুয়া খেতে পারে না।শুধু সবজি দিয়ে আবার খাওয়া যায় নাকি?আবার স্কুল থেকে এসে যদি কিছু হালকা খাবার খায়, তখন আর দুপুরে ভাত খায় না।এই মেয়েকে নিয়ে সাবিনা বেগমের যন্ত্রণার শেষ নেই।তিনি মাঝেই মাঝেই ভাবেন,যদি তিনি বেঁচে না থাকতেন তবে হয়তো মহুয়া অনাহারেই মরে যেত।খাবারের সাথে আবার এতো ঢং কীসের?যা পাবি তাই খাবি।সব খাবারই আল্লাহর নেয়ামত।তাহলে আবার এটা খাব না,ওটা খাব না–এসব কথা বলার কী মানে?প্রায় বেলাই খেতে বসে মহুয়া মায়ের বকুনি অথবা চড় খায়।তবুও শুধরায় না।এই মেয়ের শরীরে কি লজ্জা-শরম কিছু নেই নাকি?এতো বড় হওয়ার পরেও মায়ের হাতে মার খায়,তবুও কোনো হেলদোল নেই।আশ্চর্য একটা মেয়ে!
সাবিনা বেগম খাবার খাওয়ার ফাঁকে মেয়েকে একমনে দেখছিলেন।মেয়ের খাবার খাওয়ার ধরন দেখে তিনি গর্জে উঠলেন।

—” মহুয়া,একটু ভাত যদি নষ্ট করেছিস তবে খবর আছে তোর।প্রতি বেলায় বেলায় ঢং করতে লজ্জা করে না তোর?রান্না করতে কষ্ট হয়।আমি কষ্ট করে রান্না করব আর তুমি ফেলে দিবে, তা কখনোই হবে না।চাল-ডাল কিনতে টাকা লাগে।তোমার বাবা কষ্ট করে এগুলো কিনে ফেলে দেওয়ার জন্য না।বুঝেছিস?”

মহুয়া অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।মা যে এখন প্রচন্ড রেগে আছে, তা তার কথা শুনেই বুঝা যাচ্ছে।সাবিনা বেগম যখন খুব রেগে থাকেন তখন তুই-তুমি একসাথে মিলিয়ে কথা বলেন।মহুয়া একটু পানি খেয়ে আবারো ভাত মুখে দিলো।একেবারেই খেতে ইচ্ছা করছে না।প্রতিদিন তিনবেলাই কি খাওয়া লাগে?দু-একবেলা না খেলে কি হয়?মানুষ মরে যায়?এরকম হলে তো দুর্ভিক্ষের দেশের সব কবেই মানুষ মরে যেত।মা যে কেন এতো অত্যাচার করে!

মহুয়া খাবার শেষ করে সবে ঘরে এসে বসেছে।কেন যেন ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না আজ।মাঝে মাঝেই এরকম হয় মহুয়ার।তখন সে সিনেমা দেখে রাত কাটিয়ে দেয়।অথবা কখনো কখনো তার প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্রের বই পড়ে।আজ এগুলো কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না।মহুয়া মাথায় ওড়না দিয়ে বারান্দায় গেল।তার বারান্দাটা ছোট।তাদের পুরো ফ্ল্যাটে শুধু মহুয়ার ঘরেই বারান্দা আছে।তাই সাবিনা বেগম এখানে কাপড় শুকাতে দেন।এটা খুবই অপছন্দ মহুয়ার।মায়ের জন্য মহুয়া বারান্দাটা মনমতো সাজাতে পারে না।এমাথা-ওমাথা দড়ি টাঙানো থাকে। ঘরের হাজারটা কাপড় মেলে দেওয়া থাকে বারান্দায়।সূর্যের আলো আসে নাকি ঘরে?আলোর অভাবে মহুয়া কয়েকটা গাছও লাগাতে পারে না।মহুয়া বারান্দায় যেয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো।আকাশে আজ চাঁদ উঠেছে।ভরাট চাঁদ না।বাকানো একটুখানি চাঁদ।মহুয়ার পূর্ণিমা খুব পছন্দ।জ্যোৎস্না রাতে থালার মতো চাঁদটাকে কি সুন্দরই না দেখা যায়!মহুয়ার শৈশব কেটেছে মফস্বল একটা শহরে।আফজাল সাহেব দেশে ছিলেন না বলে, সাবিনা বেগম বেশিরভাগ সময় বাবার বাড়িতেই ছিলেন।মহুয়ার নানাবাড়ি বিশাল।আশেপাশে দৈত্যের মতো কোনো দালান নেই।তাই উঠোনে দাঁড়িয়ে সহজেই আকাশ দেখা যায়।ছোটবেলা থেকেই চাঁদ দেখার খুব শখ মহুয়ার।নানাবাড়ির বিশাল উঠোনে দাঁড়িয়ে আগে সবসময় সে চাঁদ দেখতো।এখন আর এসব হয় না।কবে পূর্ণিমা হয়, কবে অমাবস্যা হয়,কবে চাঁদ বাকা হয়ে যায়–এসব খবর এখন আর রাখা হয় না।মহুয়া এখন খুব ব্যস্ত।নিজের খবর রাখারই সময় হয় না আবার দূর আকাশের চাঁদের খবর! মহুয়া নিস্তব্ধ রাতে ছোট্ট বারান্দায় দাঁড়িয়ে, প্রাণভরে শ্বাস নেয়।শৈশব যদি সবসময় থাকতো!

—“মহুয়া, কোথায় তুই?”

আফজাল সাহেবের কন্ঠ শুনে মহুয়ার মুখে হাসি ফুটে।বাবার সঙ্গ তার খুব প্রিয়।সময়টা এখন বেশ ভালো যাবে।মহুয়া বারান্দা থেকে ঘরে এসে দাঁড়ায়।

—” এই তো, বাবা।ঘুম আসেনি তোমার?”
—“নারে মা।ইদানিং খুব কম ঘুম হয়।তুই এতো রাতে ওখানে কি করছিলি?”
—” ঘুম আসছিল না, তাই দাঁড়িয়ে ছিলাম।বসো তুমি।”

আফজাল সাহেব মেয়ের খাটের এককোনে পা তুলে বসেন।মহুয়া এসে তার বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।আফজাল সাহেবের হাত টেনে নিজের মাথার চুলের উপর রাখে।আফজাল সাহেব মৃদু হাসেন।মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেনঃ” এটা কি আমার চাকরি?”
—” হুম।চুলগুলো একটু টেনে দেও না, বাবা।তুমি চুল টেনে দিলে অনেক আরাম লাগে।”
—” তুই আমার মেয়ে।কোথায় তুই আমার সেবা করবি তা না।বুড়ো বয়সে আমাকে মেয়ের সেবা করতে হয়।হাহ! কপাল।”
—” তোমার জন্য দোয়া করব, বাবা”

আফজাল সাহেব কোমল হাতে মেয়ের চুল টেনে দেন।আরামে মহুয়ার চোখ বন্ধ হয়ে আসে।

—” হ্যাঁ রে মহুয়া,তুষারের সাথে কি এতো কথা বললি আজ।সেই দুপুরে গেলি,সন্ধ্যায় আসলি।”

মহুয়া চোখ বন্ধ করেই বলেঃ”তিনি আমার বিয়ের আগের ঘটনাগুলো জানতে চেয়েছেন।তাই বলেছি।”
—” শুনে কি বলল?”
—” কিছুই না।তাছাড়া,একটা ছোট-খাটো বোঝাপড়া হয়েছে আমাদের।এই।”
—” ওহ।”

আফজাল সাহেব মেয়ের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে আবারো বললেনঃ” বিয়ের পরে কি তুই চাকরি করবি না?”
মহুয়া এক মুহূর্ত ভেবে বললঃ” না,বাবা।”
—” কেন?”
—” স্কুলের চাকরিটা ছেড় দেব, বাবা।তুমি তো জানোই আমার কম্পিউটারে ঝোক বেশি।ইচ্ছে আছে,বিয়ের পর আউটসোর্সিং এর চেষ্টা করব।আমার অনেক দিনের শখ এইটা।”

আফজাল সাহেব একমুহূর্ত ভাবলেন।তারপর বললেনঃ” আমার না বিলকিস বেগমকে বেগমকে দাওয়াত করতে মন চায়।”
চমকে উঠে বসে মহুয়া।অবাক গলায় বলেঃ” কেন?”
—” ওনার জন্য আমার খুব কষ্ট হয় বুঝলি।ওনাকে দেখলেই বুঝা যায়, ছেলের আচরণে খুব লজ্জিত তিনি।জানিস পৃথিবীতে সবচেয়ে হতভাগা কারা?যাদেরকে কুলাঙ্গার সন্তানের জন্য পদে পদে অপমানিত হতে হয়।”

মহুয়ারও মাঝে মাঝে ওই মানুষটার জন্য কষ্ট হয়।তিনি অনেক স্নেহ করতেন মহুয়াকে।মহুয়া মন খারাপ করে বললঃ” দরকার নেই, বাবা।ওই বাড়ির কারো সাথে যেন আর কখনো আমার দেখা না হয়।”
—” কেন?”
—” এমনিতেই। আমার ভালো লাগে না।”
—” কিন্তু আমি চাই,ওদের সাথে তোর আবার দেখা হোক।তুই সুখী হ।তোর সুখ দেখে আবরার হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরে যায়।”

মহুয়া হাসে।বাবা কি পাগল! আবরারের হিংসা কেন হবে?মহুয়ার প্রতি তো তার কোনো আকাঙ্খা ছিল না।সে মৃদু হেসে বলেঃ”আবরারের কেন হিংসা হবে বাবা?সে অনন্যার সাথে সুখে আছে।”
—” শোন মা,কর্মফল বলেও একটা কথা আছে। কর্মফল কখনো পিছু ছাড়ে না।”
মহুয়া প্রসঙ্গ বদলে ফেলতে চাইলো।তাই শান্ত গলায় বললঃ” জানো বাবা আজ আমি তুষার সাহেবকে বলেছি,তাকে আমার স্বার্থপর লাগে।”
—“তারপর? ”
—” তারপর অবশ্য আমার নিজেরই খারাপ লেগেছে।সেও তো আমার মতো একই পরিস্থিতির শিকার।”
—” কিন্তু,তোর মনের কথা বলে ভালো করেছিস।কারো সম্পর্কে কিছু ভাবলে, তা মনে মনে রাখবি না।তাকে বলে দিবি।”
মহুয়া ভ্রু কুঁচকে বললঃ” তাহলে মাকে যেয়ে বলি,মা আমার উপর খুবই অত্যাচার করে।তাই মায়ের উপর আমি খুবই বিরক্ত।আমি তাকে বয়কট করতে চাই।”
মেয়ের কথার বিপরীতে কুটিল হাসেন আফজাল সাহেব।মাথা নেড়ে বলেনঃ”ঠিক আছে।তোর মনের কথা যেয়ে তোর মাকে বল।কিন্তু এরপর যদি তোর মায়ের জুতো তোর শরীরের দিকে উড়ে আসে,তবে তার দায়ভার কিন্তু আমি নেব না।”
আফজাল সাহেবের কথায় মহুয়া খিলখিলিয়ে হাসে।গল্প-কথায় অলস সময় কোথা দিয়ে কেটে যায় তার খবর কেউ রাখে না।

#(পর্ব-১১)

আজ বিকালটা খুব সুন্দর।আকাশে কালো মেঘ নেই,সূর্যের প্রখর তাপ নেই।ঝিরিঝিরি বাতাস আছে আশেপাশে।সাবিনা বেগম এরকম আবহাওয়া খুব ভালোবাসেন।প্রকৃতির এমন সৌন্দর্য দেখলেই তার আগের দিনের কথা মনে পড়ে যায়।যখন তিনি মা ছিলেন না, কারো ঘরের বউ ছিলেন না,দায়িত্বের বেড়াজালে জীবন বন্দি ছিল না—এমনসব দিনের কথা।কি সুন্দর ছিল তখনকার দিনগুলো!
সাবিনা বেগম রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছেন।তার দৃষ্টি চুলার উপরে থাকা পাতিলের উপর নিবদ্ধ।চা চাপিয়েছেন চুলায়।গরুর দুধ ঘন করে জ্বাল দিয়ে তাতে চাপাতি ঢেলে দিয়েছেন।এই রকম চা খুব পছন্দ মহুয়ার।গরুর দুধের এক কাপ চা হাতে পেলে সে বেশ আয়েশ করে তাতে চুমুক দেয়।স্বাদে তার দু-চোখ বন্ধ হয়ে আসে।এই দৃশ্যটি খুব পছন্দ সাবিনা বেগমের।মনে হয় যেন, তিনি বিশ্ব রাঁধুনী ও মহুয়া বিচারক।রান্নায় মুগ্ধ হয়ে প্রশংসায় ভেঙে পড়ছেন মহামান্য বিচারক।ইদানিং, সাবিনা বেগম অল্পতেই অস্থির হয়ে যান।ভিতরটা শুকিয়ে যায় হুটহাট।যখন-তখন চোখ ভিজে আসে।এই অদ্ভুত রোগের কারণ খুব ভালো করেই জানেন তিনি।মহুয়ার বিয়ের তারিখ এগিয়ে এসেছে।আর মাত্র পনেরো দিন বাকি।কলিজার টুকরাটা আবারো চলে যাবে।সাবিনা বেগম কখনো ভাবেননি তার মেয়ের সাথেই বিশ্রি একটা ঘটনা ঘটবে।মাত্র সাতাশ বছর বয়সেই দু-বার বউ সাজতে হবে মহুয়াকে।তিনি মা।তিনি তো জানেন, মেয়েটা কি থেকে কি হয়ে গিয়েছিল।তার দু-চোখ ভরা কতটা স্বপ্ন ছিল।সাবিনা বেগম বরাবরই মহুয়ার প্রতি দুর্বল।একটা মাত্র মেয়ে তার।কিন্তু,এই দুর্বলতা কখনো দেখাননি তিনি।আফজাল সাহেব বিদেশে ছিলেন বলে একা হাতেই সামলাতে হয়েছে সব।একহাতে সংসার, অন্যহাতে মেয়ে।ইচ্ছে করেই কখনো মহুয়ার সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করেননি।তার সাথে মহুয়ার সম্পর্ক ছিল অনেকটা উর্ধতন-অধস্তনের মতো।এর পিছনে অবশ্য একটা কারণও আছে।তিনি সবসময় ভয়ে থাকতেন মেয়েকে নিয়ে।মেয়ের সাথে খোলামেলা আচরণ করলে যদি মেয়ে কথা না শোনে।যদি বখে যায়।তাই তাদের মা-মেয়ের সম্পর্কের গন্ডি শাসনে সীমাবদ্ধ।মেয়েকে যত ভালোবাসেন তার চাইতে বেশি শাসন করেন।

সাবিনা বেগম যখন চায়ের কাপ নিয়ে মহুয়ার ঘরে ঢুকলেন,তখন মহুয়া তৈরি হচ্ছে।হয়তো কোথাও যাবে।সাবিনা বেগম চায়ের কাপ মহুয়ার টেবিলের উপর রেখে বললেনঃ”রেডি হচ্ছিস যে?কোথায় যাবি?”
—” রবীন্দ্র সরোবরে।”
সাবিনা বেগম বেশ অবাক হয়ে যান।এই সময়ে ওখানে কি?তিনি বেশ অবাক হয়েই বলেনঃ” এই সময়ে?”
—“হ্যাঁ, মা।”
—” কি দরকারে যাবি?”
—” তুষার সাহেবের সাথে দেখা করতে।”
সাবিনা বেগম কপাল কুঁচকে ফেলেন।বিয়ের আগে এতো দেখাশোনা কিসের? সেদিন না দেখা করতে গেল!তিনি খাটের কোনে বসতে বসতে বললেনঃ”আজকে আবার কেন?”
মহুয়ার তৈরি হওয়া প্রায় শেষ।কালো রঙের হিজাবে, কাঁধের কাছে একটা পিন আটকে মায়ের পাশে এসে বসলো।হাতে তার ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ। এক চুমুক চা গিলে নিয়ে বললঃ”আজকে মৃত্তিকার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবেন তিনি।তাই দেখা করতে বলেছেন।”
—” তোকে বলল আর তুইও চলে যাবি?বিয়ের আগে কি এতো দেখা করা ঠিক?”
—” হয়তো ঠিক না।কিন্তু অনেক আগেই বলেছিলেন, বিয়ের আগে আরেকদিন দেখা করবেন।এখন বলেছে আমি কি না করতে পারি?”
সাবিনা বেগম নাক-মুখ কুঁচকে বললেনঃ”এখনকার ছেলে-মেয়েদের আচরণ কিছুই মাথায় ঢুকে না আমার।বিয়ের আগে আবার এতো দেখা করতে হবে কেন?লাজ-লজ্জা কিছু নেই নাকি?দিন ছিল আমাদের সময়।তোর বাবার সাথে যেদিন বিয়ে ঠিক হয়েছিল, সেদিন থেকে আমি আর বাড়ির বাইরেই পা দিতাম না।খালি লজ্জা করত।যদি কেউ বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করে,কি বলব আমি?এই কথা ভেবে আর ঘর থেকেই বের হতাম না।অথচ, তোরা!আজ নিয়ে তিনদিন দেখা করতে যাচ্ছিস।কি একটা অবস্থা!”

মহুয়া চা শেষ করে মুচকি হাসলো। তার মা বেশ রক্ষণশীল। কাপ রাখতে রাখতে বললঃ” তোমাদের সময় আর এখনকার সময়ে অনেক পার্থক্য, মা।আজকে আর সময় নেই।এসে কথা বলব।এর আগের দুদিন তুষার সাহেব আমার জন্য অনেক্ক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন।আবার একই ঘটনা আজকেও ঘটুক, তা চাচ্ছি না।আসছি, আল্লাহ হাফেজ।”

***

মহুয়া আজকে তুষারের আগেই পৌঁছে গেছে।সরোবরের উত্তর দিকে দাঁড়িয়ে আছে সে।এই জায়গাটা খুব পছন্দ মহুয়ার।মানুষ থাকলেও খুব বেশি বিশৃঙ্খলা নেই।কেউ শরীরচর্চা করছে,কেউ আড্ডা দিচ্ছে,কেউ ঘুরতে এসেছে।কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না।এই জিনিসটাই খুব ভালো লাগে মহুয়ার।মহুয়ার থেকে খানিকটা দূরেই একটা দল বসে আছে।সাত-আটটা ছেলে-মেয়ে।খুব সম্ভবত এটা একটা বন্ধুর দল।একটা নিচু ঢিবির উপর গোল হয়ে বসে আছে সবাই।বেশ সুন্দর একটা ছেলের হাতে গিটার।সে কিছুক্ষণ আগে একটা সুর তুলেছে।এখনো সেই সুরেই গিটার বাজিয়ে যাচ্ছে।খুব পরিচিত একটা সুর।মহুয়া মনে করার চেষ্টা করল,এটা কোন গানের সুর হতে পারে।তার চিন্তার মাঝেই ছেলেটা তার সুন্দর কণ্ঠে গান ধরলো—

” ভুলিনি তো আমি
তোমার মুখের হাসি,
আমার গাওয়া গানে
তোমাকে ভালোবাসি।”

মহুয়া মুগ্ধ হয়ে গান শুনছে।ছেলেটার গলায় জাদু আছে বলতে হবে।আশেপাশের অনেকেই নজর দিচ্ছে ছেলেটার উপর।মহুয়া গানে এতোটাই মজে ছিল যে, কখন তুষার এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে তা বলতেই পারল না।

—” গানটা খুব সুন্দর,তাই না মহুয়া?”
—“হুম, খুবই সুন্দর”—বলতে বলতেই মহুয়ার চোখ যায় তুষারের উপর।অন্যান্য দিনের চাইতে আজকে একটু বেশিই পরিপাটি লাগছে মানুষটাকে।কালো রঙের টিশার্টে স্বাভাবিকের চাইতেও বেশি ফর্সা দেখাচ্ছে।তুষারের গায়ের রঙ হলুদ-ফর্সা।তাই হয়তো কালো রঙে বেশ মানিয়েছে তাকে।তুষারের কোলে মৃত্তিকার দিকে চাইতেই চওড়া হাসি ফুটে মহুয়ার ঠোঁটে।সাদা রঙের জামায় কি সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে!সে বাবার কোলে ভর দিয়ে আশপাশ দেখছে।

—” এই সাদা পরীটাকে কোথায় পেলেন?পরী তো দেখছি খুব কৌতূহলী।”
—” হুম। নতুন জিনিসে তার আগ্রহের শেষ নেই।এটাই আমার রাজকন্যা।”
তুষার মৃত্তিকাকে মহুয়ার দিকে ফিরায়।মৃত্তিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেঃ” এই যে মা,এদিকে তাকাও। এইটা মহুয়া।পরিচিত হও।মিত্তি,মিত্তি।”
মৃত্তিকার কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখা গেল না।সে আগের মতোই আশেপাশে নজর দিচ্ছে।তুষার আরো দুবার মেয়ের মাথা ঘুরিয়ে দিল।
—“এই যে মা,এদিকে তাকাও।এইতো এদিকে।”
মৃত্তিকা তার বাবার কথায় হয়তো খুব বিরক্ত হল।আরেকবার তুষার জোড়াজুড়ি করতেই “অ্যা” করে একটা চিৎকার দিল।এটা যে তার বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ, তা বেশ বুঝতে পারলো মহুয়া।তাই হেসে তুষারকে বললঃ”ওকে ওর মতোই থাকতে দিন।আপনার রাজকন্যা পালিয়ে যাচ্ছে না আর আমিও পালিয়ে যাচ্ছি না।সময় হলে নিজে নিজেই পরিচিত হবে।আপনিও একটা পাগল, তুষার সাহেব।একটা বাচ্চার সাথে এরকম জোর করার কি আছে?”
তুষার হাল ছেড়ে দিয়ে মহুয়ার দিকে তাকালো।এই প্রথম খুব সূক্ষ্মভাবে নজর দিল মহুয়ার মুখের দিকে।সবার আগেই তার নজর গেল মহুয়ার থুতনিতে।থুতনির নিচে আপেলের মতো একটা ভাজ।অনেকটা আপেলের নিচের অংশের মতো।কপালের মাঝে একটা টিপের মতো তিল।হঠাৎ করে দেখলে এটাকে টিপের মতোই দেখা যায়।চোখগুলো একটু বড় বড়।চেহারার সাথে মানিয়েছে বেশ।উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের নাকে সাদা রঙের নাক ফুল।ছোট্ট একটা পাথর যেন চেহারার ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে দিয়েছে।মেয়েটা যখন হাসে, তখন ঠোঁটের আধ ইঞ্চি নিচে একটু ভাঁজ পড়ে।সৌন্দর্যের দিক দিয়ে যে মহুয়ার কমতি নেই তা তাকে দেখলেই বুঝা যায়।
এইরকম রূপকেও কোনো পুরুষ ঠেলে দিতে পারে?আবরারকে দেখার খুব ইচ্ছা তুষারের।বিয়ের পর একদিন মহুয়াকে বলবে ছবি দেখাতে।মহুয়ার কাছে নিশ্চয়ই আবরারের কোনো না কোনো ছবি আছে।

—” তুষার সাহেব,এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন?”
—” নাহ,চলুন হাঁটি।মিত্তি এখনো শান্ত আছে।কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবে না।না হাঁটলেই কান্নাকাটি শুরু করবে।”

মহুয়া ও তুষার হাঁটা শুরু করলো।তুষারের পাশে মহুয়া, কোলে মৃত্তিকা।তার কাছে বেশ ভালো লাগছে।মনে হচ্ছে একটা ছোট্ট সুখী পরিবার।অলস বিকাল কাটাতে হাঁটতে বেড়িয়েছে।তুষার মনে মনে হাসে।দিন দিন তার নৈতিক অধঃপতন ঘটছে।একটা সুন্দরী মেয়েকে পাশে পেয়েই তাকে বউ ভাবতে শুরু করে দিল!আশ্চর্য!

—” মৃত্তিকার বাবা,আরো আগে দেখা করা উচিৎ ছিল আপনার।বিয়ের পনেরো দিন আগে কেউ দেখা করতে চায়?”

মহুয়ার সম্বোধন খুব ভালো লাগে তুষারের।কি ডাকলো মহুয়া? মৃত্তিকার বাবা?এরকম তো কখনো কেউ ডাকেনি তাকে।মহিমা সবসময় নাম ধরে ডাকত।এটাই নাকি এখন ফ্যাশন। তুষার খুশি মনে বললঃ”তুমি খুব সুন্দর করে ডাকলে আমাকে।এরকম ডাক কোথায় শিখেছ?”
কিরকম খাপছাড়া প্রশ্ন! কাকে কি বলে ডাকতে হয় তা কখনো শেখা লাগে?মহুয়া বললঃ”কেউ শিখিয়ে দেয়নি।আপনি আমার অনেকটাই বড়।আমি বড় কাউকে নাম ধরে ডাকতে পারি না।কেমন যেন লাগে।তাই ডাকলাম।আপনার কোনো আপত্তি আছে নাকি?”
—” আরে না,না। আমার খুব ভালো লাগলো।আমি অনেক আগেই তোমার সাথে দেখা করতাম।কিন্তু,এই কয়েকদিন বেশ ঝামেলায় ছিলাম।আমার ফ্ল্যাট পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেছে।তার জন্য আসবাব কিনতে হয়েছে।বিয়ের জন্য কেনাকাটা করতে হয়েছে।তার উপর ব্যবসায়ের কাজ তো আছেই।এসবের চক্করে পড়ে একদম সময় পাইনি।”
—“ওহ।”
—” বাড়ির সবাই ভালো আছে?”
—” হুম।”
মহুয়া কোনো কথা খুঁজে পেল না।মনে মনে ভাবতে লাগলো কি বলা যায়।ভাব জমাতে খুব অপটু মহুয়া।
—” মহুয়া, বলো তো হিমু বেশিরভাগ একা একা হাঁটতো কেন?রূপাকে নিয়ে কেন হাঁটতো না?
প্রশ্নটা খুব ভালো বুঝতে পারলো না মহুয়া।তাই ভ্রু কুঁচকে বললঃ”মানে?”
—” আরে আমি হুমায়ূন আহমদের সৃষ্ট হিমু চরিত্রের কথা বলছি।পড়নি হিমু সবসময় একা একা রাস্তায় হাঁটতো?বলতো কেন?”
—” কি জানি।”
—” শোনো হিমু যদি সবসময় রূপাকে নিয়ে হাঁটতো,তবে কখনোই ভাবলেশহীনভাবে হাঁটতে পারত না।কারণ সুন্দরী রমনী নিয়ে হাঁটা যায় না।কেমন যেন একটা প্রেমিক প্রেমিক ভাব আসে শরীরে।এই যেমন এখন আমার মনে হচ্ছে।নিজেকে বিশ্বপ্রেমিক ভাবতে ইচ্ছে করছে।”
মহুয়া ভ্রু কুঁচকে বললঃ”আপনি যে মহাত্যাদড়, তা কিন্তু আপনাকে দেখলে বুঝা যায় না।এক বাচ্চার বাবা হয়ে আরেক মেয়ের সাথে বাদড়ামি করতে লজ্জা করছে না?তার উপর মেয়েটা আপনার কোলেই আছে।”
—” আরে আমি তো আর….
—” বা বা,বা বা, বা বা”
তুষার কথা শেষ করতে পারে না মৃত্তিকার জন্য।সে তার বাবার কোলেই খুব নড়াচড়া করছে আর পিছনদিকে ঠেলছে।তুষার থেমে পিছনে তাকালো।একটা হাওয়াই মিঠাইওয়ালা চলে যাচ্ছে।মৃত্তিকার এখন ওটা চাই।তার অঙ্গভঙ্গি দেখেই তুষার বুঝলো।সে মেয়ের গালে চুমু দিয়ে বললঃ”ঠিক আছে,বাবা এনে দিচ্ছি।”
মহুয়াও বুঝলো বাবা-মেয়ের কথা।সে তুষারকে বললঃ” ওকে আমার কাছে দিন।লোকটা তো দূরে চলে গেছে।ওকে নিয়ে ওখানে যাওয়ার দরকার নেই।আমি মিত্তিকে নিয়ে দাড়াচ্ছি এখানে।”

তুষার মৃত্তিকাকে মহুয়ার কোলে দিল।মৃত্তিকা বেশ গোল গোল চোখ করে চেয়ে রইলো।বুঝাই যাচ্ছে মহুয়ার কোলে সে আরাম পাচ্ছে না।বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর কেঁদে ফেললো।তুষার বেশ এগিয়ে গেছে ততোক্ষণে।মহুয়া মৃত্তিকাকে নিয়ে একটু এদিক-ওদিক হাঁটলো।মৃত্তিকার পিঠে হাত বুলিয়ে দিল।মহুয়ার হাত থেমে গেল মৃত্তিকার প্যাম্পার্সের কাছে এসে।বেশ ভারী হয়ে আছে এটা।মহুয়া একটু খুলে দেখলো।যা ভেবেছে তাই ঠিক।মৃত্তিকা মলত্যাগ করেছে।মহুয়া প্যাম্পার্স্টা খুলে দিল।মৃত্তিকাকে কোলে ও প্যাম্পার্সটাকে পাশে রেখে দাঁড়িয়ে রইলো।মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে।মহুয়া তাকে নিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটতে হাঁটতে বললঃ” এই যে মা,কাঁদে না।তোমার বাবা এক্ষুনি এসে পড়বে।”
কিছুক্ষণের মধ্যে তুষার চলে আসলো।তার হাতে দুটো হাওয়াই মিঠাই।তুষারকে দেখতেই তার কোলে ঝাপিয়ে পড়লো মৃত্তিকা।তুষার মহুয়ার হাতে হাওয়াই মিঠাইগুলো ধরিয়ে দিল।

—ও কি খুব বিরক্ত…
তুষারের কথা থেমে গেল।কারণ তার পেটের দিকটা ভিজে গেল মৃত্তিকার জন্য।তুষার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মহুয়ার দিকে তাকাতেই সে বললঃ”প্যাম্পার্সটা নষ্ট হয়ে গেছে বলে খুলে দিয়েছি।খুব বেশি ভিজে গেছেন আপনি?”

***

দেখতে দেখতে পনেরো দিন কেটে গেল।আজকে মাসের এক তারিখ।এক তারিখের রাতেই,মহুয়ার নাম জুরে গেল তুষারের সাথে।সে এখন তুষার আহমেদের বউ,মৃত্তিকা আহমেদের মা।বিয়ে শেষ হতে হতে রাত দশটা বেজে গেল।এতো দেরু হতো না।আজকে সকাল সকাল তুষারের খালু খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে।তাকে নিয়ে হাসপাতালে খুব দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে।তুষার ভেবেছিল আজকে বিয়েই করবে না।এতো বিপদের মধ্যে আবার বিয়ে করা যায় নাকি!কিন্তু,তুষারের এই ইচ্ছাপূরণ করতে দিলেন না রুবিনা বেগম।বিকালের দিকে তার স্বামী একটু সুস্থ হতেই তুষারকে পাঠিয়ে দিলেন মহুয়াদের বাড়ি।যেভাবেই হোক আজকে তার ঘরে বউ চাই।আর কি করার! তুষার চলে গেল বিয়ে করতে।বিয়েতে খুব বেশি আয়োজন ছিল না।একদম ঘরোয়া পরিবেশের বিয়ে।নানা নিয়ম-কানুন শেষ করে মহুয়াকে নিয়ে বেড়তে বেড়তে এগারোটা বেজে গেল।এইবারেও গাড়িতে ঘুমিয়ে গেছে মহুয়া।এমনিতেই কালকে ঘুমাতে পারেনি।তাছাড়া আজ বিদায়ের সময় খুব কেঁদেছে।তাই গাড়ির মধ্যে ক্লান্ত শরীরে, তুষারের কাঁধে মাথা দিয়ে খুব শীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়লো।তুষার পড়েছে খুব বিপাকে।একদিকে বউ কাঁধে ঘুমিয়ে আছে অন্যদিকে মেয়ে বুকে ঘুমিয়ে আছে।বেচারা নড়াচড়াই করতে পারছে না।রাস্তায় খুব জ্যাম ছিল না।তাই খুব দ্রুতই পৌঁছে যায় ওরা।তুষার আস্তে আস্তে ডাক দেয় মহুয়াকে।
—” মহুয়া, মহুয়া। উঠো।”
মহুয়ার নড়েচড়ে বসে।মাথা উঠিয়ে বলেঃ”এসে পড়েছি?”
—” হুম।”
তুষার আগে গাড়ি থেকে নামে।এলাকায় নতুন ও।মৃত্তিকাকে এককোলে নিয়ে আরেক হাতে মহুয়াকে নামায়।মহুয়ার চোখে খুব ঘুম। এখানেই হাত-পা ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।ঢুলুঢুলু চোখে কোনোমতে ঘরের সামনে যেয়ে দাঁড়ায় মহুয়া।ঘুমাতে না পারলে নিশ্চিত সে মরে যাবে।রুবিনা বেগম তৈরি ছিলেন।ছেলে,ছেলের বউকে আটকান না তিনি।মহুয়ার সাথে ভালো-মন্দ কথা বলে ওকে ঘরে পৌঁছে দেয়।ঘরে এসে হাফ ছাড়ে মহুয়া।ভেবেছিল এখানেও নিয়ম-কানুন পালন করতে হবে।পুরো ঘরে চোখ বুলায় একবার।ঘর নতুন সাজানো হয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে।আসবাবপত্রে ঠেসে আছে একদম।মহুয়া আর কোনোদিকে নজর না দিয়ে লাগেজ থেকে শাড়ি বের করে।তুষার আসার আগেই শাড়ি বদলে বিছানায় শুয়ে পড়ে।মৃত্তিকাও খাটের মাঝে শুয়ে আছে।ওকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে যায় মহুয়া।বেঁচে থাকলে তুষারের সাথে পরেও কথা বলা যাবে।এখন যদি মহুয়া না ঘুমায় তবে হয়তো মাথাব্যথায় মরেই যাবে।খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না মহুয়াকে।দ্রুতই পাড়ি জমালো স্বপ্নরাজ্যে।
তুষার যখন ঘরে এসেছে তখন ঘড়ির কাটা সাড়ে বারোটার ঘরে।সে এসেই দেখলো মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে মহুয়া।দৃশ্যটা খুব ভালো লাগলো তুষারের।সে এরকম কিছুই ভেবেছিল।মহুয়াকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল,তার খুব ঘুম পেয়েছে।তুষার হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে এসেছিল।মহুয়াকে ঘুমাতে দেখে খুব বেশি ভাবলো না সে।খাবারের প্লেট রেখে মৃত্তিকার আরেক পাশে ঘুমিয়ে পড়লো।সকাল থেকে খুব দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে।শরীর ভেঙে আসছে।না ঘুমালে চলবেই না।

খুব সকালে ঘুম ভাঙে মহুয়ার।চারপাশে আলো ফুটেছে।ঘুম পালিয়ে যাওয়ায় উঠে বসে মহুয়া।তারপাশেই তুষার ঘুমিয়ে আছে।তুষারের বুকের উপর মৃত্তিকা।মহুয়া মুচকি হাসে।কিভাবে ঘুমাচ্ছে এরা।তুষারের থেকে নিয়ে মৃত্তিকাকে বালিশে শোয়ায়।ঘুমের মধ্যেই নড়ে উঠে তুষার।মেয়ের দিকে ফিরে আবারো ঘুমিয়ে পড়ে।বারান্দার দরজাটা খোলা।মহুয়া নিচে নেমে শাড়ি ঠিক করে।টেবিলের উপর খাবারের প্লেট দেখেই ওর ক্ষিদে পেয়ে যায়।কালরাতে সেই নয়টা বাজে খেয়েছিল।মহুয়া হাতখোপা করতে করতে বারান্দার দিকে যায়।ওর বারান্দার প্রতি আলাদা আকর্ষণ আছে।বারান্দা মহুয়ার খুব পছন্দ।সদ্য ঘুম ভাঙা নিস্তেজ শরীর নিয়ে মহুয়া বারান্দায় দাঁড়ায়।ভোরের আলো তার শরীর ছুঁয়ে যায়।ভালোমতো চোখ মেলে সামনে তাকাতেই মহুয়ার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।হৃৎপিন্ডের গতি তীব্র হয়।শরীরে কাঁপন ধরে।সামনের বারান্দায় ঠিক একই অবস্থা আবরারের।সেও ভূতের মতো চোখ মেলে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

চলবে….

যাত্রাশেষে (পর্ব-৮+৯)

যাত্রাশেষে (পর্ব-৮+৯)
#হালিমা রহমান

মহুয়া এখন পাক্কা গৃহিণী।সকালে ঘুম থেকে উঠার পর থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত তার সব চিন্তা সংসারকে ঘিরেই।কি করে আবরার ভালো থাকবে,অফিসে যাওয়ার আগে আবরারকে কতোটুকু সাহায্য করতে হবে,ঘরে কোনদিন কি লাগবে,কোন তেল মালিশ করলে বিলকিস বেগমের কোমড়ের ব্যাথা কমবে,বারান্দায় কোন গাছে পানি দিতে হবে,কোন গাছে একটু সার দিতে হবে— এসব চিন্তা-ভাবনা করতে করতেই মহুয়ার বুড়ো হওয়ার জোগাড়।তাকে দেখলে কিছুতেই বোঝার উপায় নেই,এই মেয়ে একসময় বাইরের কাজে পটু ছিলো।ঘরের কাজে ছিলো আমড়া কাঠের ঢেকি।চাকরি কি জিনিস তা তো এখন মহুয়া চিনেই না।চাকরি করার চিন্তা-ভাবনাও নেই ।মহুয়া এখন সংসারকেই উপভোগ করে।একটু একটু করে প্রত্যেকদিন আবিষ্কার করে।রান্না শেষ হওয়ার পর ধোঁয়া উঠা তরকারি থেকে প্রাণভরে ঘ্রাণ নেয়।কোন সবজি কোন মাছ দিয়ে রাঁধলে ভালো হবে,কোন মশলা কিভাবে ব্যবহার করতে হয়,কিভাবে কাপড় কাঁচলে ধবধবে সাদা হয়,কিভাবে ঘর-দোর সবচেয়ে বেশি পরিষ্কার থাকে—এসব বোধহয় মহুয়ার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না।মহুয়া হাজারবার ঘর পরিষ্কার করে।শাড়ির আঁচল দিয়ে একটু একটু করে আবরারের সবগুলো বইয়ে জমে থাকা ধুলো পরিষ্কার করে।আয়না মুছে,কাপড় গোছায়,বিছানার চাদর লক্ষবার ঠিক করে।আবরারের সাথে সম্পর্ক এখন বেশ ভালো।আবরারকে মহুয়ার খুব ভালো লাগে।দিনে লক্ষবার প্রেমে পড়ে মহুয়া।আবরারকে দু-চোখ ভরে দেখে।সভ্য-অসভ্য হাজারটা স্বপ্ন বুনে তাকে নিয়ে।আবরারের রাগ অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গেছে মহুয়ার।আবরারের খুব উগ্র মেজাজ।এই দেখা যায় মহুয়াকে সে ভালোবেসে জীবন দিয়ে দিচ্ছে।আবার ক্ষনিকেই রেগে যাচ্ছে।তখন কি চোটপাটটাই না করে মহুয়ার সাথে!মহুয়ারও রাগ বেশি।অনেক সময় আবরারের সাথে সাথে সেও রেগে যায়।মহুয়া এই পর্যন্ত একসেট সিরামিকের প্লেট ভেঙেছে।দুটো কাচের জগ আছড়ে ভেঙেছে রাগের মাথায়।এতো কিছুর পরেও মহুয়া এই সংসারকেই ভালোবাসে।ভালো-খারাপ মিলিয়েই তার দিন কেটে যায়।দেখতে দেখতে বিয়ের আটমাস কেটে গেছে।ছুটির দিনগুলো খুব ভালো কাটে এখন।আবরার সারাদিন বাসায় থাকে।কখনো কখনো মহুয়ার রান্নার কাজে সাহায্য করে।বিকেলগুলো হয় আরো রোমাঞ্চকর।বিলকিস বেগম ছুটির দিনের বিকালগুলো আফিয়ার বাসায় কাটান।আফিয়ার দুটো ছেলে-মেয়ে আছে।নাতি-নাতনীদের সাথে বেলা কাটাতে ভালোই লাগে তার।মহুয়া-আবরার ঘরেই থাকে।ছুটির দিনের বিকালে আসরের নামাজ পড়েই খুব সুন্দরভাবে পরিপাটি হয় মহুয়া।দুজনের জন্য দু-কাপ ঘন করে চা বানায়।তারপর সেই ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় বসে যায়।মহুয়া বারান্দাটাকে খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে।আগে তো শুধু কাঠগোলাপের গাছ ছিলো।এখন পুঁইশাক থেকে শুরু করে ক্যাকটাস -বহু প্রকার গাছ আছে বারান্দায়।আবরার ও মহুয়া দুজনে মিলে বারান্দার মেঝেতে লেপ্টে বসে অলস বিকাল দেখে।চা শেষ করে কখনো কখনো মহুয়া তার মাথা এলিয়ে দেয় আবরারের কাঁধে।মুখে ফুটায় হাজার কথার ফুলঝুরি। এই তো সেদিনের কথা।মহুয়ার এলোমেলো চুলগুলো পড়ে ছিলো আবরারের বুকে।তার মাথা হেলানো ছিলো আবরারের কাঁধে।পাশে ছিলো সদ্য শেষ করে রাখা খালি চায়ের কাপ।মহুয়া সামনের বাড়ির দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললঃ”ঐ বাড়িটা কাদের?শেষ করে না কেন?”
—” ওইটা অন্য এলাকার মানুষেরা করছে।ওই যে সমতির মাধ্যমে ফ্ল্যাট করে না এখন,ওইরকম আর কি।”
—” ওহ।এই দো-তলার ফ্ল্যাটটা অনেক সুন্দর।সুন্দর করে সাজানো যাবে।”
আবরার মহুয়ার চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলেঃ” তুমি কি করে জানলে?”
—” আমি জানালা দিয়ে দেখেছি।বারান্দাটাও তো এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে।”
—” দেখে কি লাভ? তোমার স্বামীর এতো টাকা নেই যে এরকম একটা ফ্ল্যাট কিনতে পারবে।”
মহুয়া মাথা উঁচু করে ভ্রু কুঁচকে বলেঃ” আমি কি বলেছি, আমি ওখানে থাকব?আমি শুধু বললাম ফ্ল্যাটটা সুন্দর।তাছাড়া, আমার ঘরই বেশি সুন্দর।ওই খালি ফ্ল্যাটের চাইতে আমার এই ছোট্ট ঘরে বেশি শান্তি।”
আবরার মুচকি হাসে।হাসিমুখে বলেঃ” মানলাম তোমার কথা।মায়ের কাছে শুনলাম তুমি নাকি ডাক্তারের কাছে যাবে?”
—” হ্যাঁ, মাইগ্রেনের ব্যাথাটা বেড়েছে ইদানিং।”
—” কবে যাবে?”
—” দেখি কাল-পরশু যাব।আপনার কি আমাকে নিয়ে বাইরে যাওয়ার সময় হবে একদিন?”
—” কেন?”
—” বিছানার চাদর লাগবে।কিছু মশলাও লাগবে।এগুলো কিনব।”
—” আগামী শুক্রবারের আগে সময় হবে না।ওইদিন নিয়ে যাই?”
—” আচ্ছা।”
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে দুজনে।কয়েক মিনিটের নিরবতা ভেঙে মহুয়া আবার বলেঃ” আমাকে একটা ময়না পাখি কিনে দিবেন?”
—” ময়না পাখি দিয়ে কি হবে?”
—” আমার অনেক শখ একটা ময়না পাখি পালার।আমি সারাদিন ওকে কথা শিখাব।কিনে দিবেন?”
আবরার মহুয়ার এলোমেলো চুলে আঙুল চালাতে চালাতে মুচকি হাসে।মাথা নেড়ে বলেঃ”ঠিক আছে, দেব।”
মহুয়া শরীরের সবটুকু ভার ছেড়ে দেয় আবরারের বলিষ্ঠ বুকে।আদুরে গলায় আবরারের চুলগুলো নেড়ে দিয়ে বলেঃ” আপনি খুব ভালো টুকুনের আব্বু।”
—” টুকুন কে?”
—” একটা ছোট্ট মেহমান,একদম বিড়াল ছানার মতো তুলতুলে।”
আবরার ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।মহুয়া তা দেখে মুচকি হেসে বলেঃ” আরে আমি ভবিষ্যতের কথা বলছি।নিচের ফ্ল্যাটের পুষ্পা ভাবি আছে না,ওনার একটা মেয়ে হয়েছে।দারুন দেখতে।আমাদের ঘরেও একদিন একটা ছোট্ট অতিথি আসবে,ঠিক আছে?ওকে আমরা টুকুন বলে ডাকব।একজোড়া নরম পা আমাদের ঘরে ঘুরে বেড়াবে।ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে আমাকে ছুঁবে,আপনাকে ধরবে…
মহুয়ার সুখ স্বপ্নে বাধা দেয় আবরার।ভারী গলায় বলেঃ” এতো স্বপ্ন দেখতে নেই মহুয়া।অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়।”
মহুয়া চোখ-মুখ কুঁচকে ফেলে।লোকটা কোনো পরিস্থিতি বোঝে না।অসহ্য!

***

মহুয়ার সংসার নাটকের সমাপ্তির শুরু বিয়ের নয় মাসের মাথায়।নাটক নয় নাটিকা ছিলো মহুয়ার সংসার,সাজানো স্বপ্নগুলো।তাই যবনিকাপাতে খুব বেশি সময় লাগেনি।কালবৈশাখীর দমকা হাওয়ায় ধসে পড়া ঘরের মতো মহুয়ার স্বপ্নগুলোও ভেঙে যায় হুট করেই।মহুমার বিয়ের তখন নয় মাস চলছে।সেদিন ছিলো রবিবার।শুক্র-শনি বন্ধের পর রবিবার থেকেই আবরারের অফিস শুরু হয়।সেই রবিবারে সকাল থেকেই প্রচণ্ড বৃষ্টি ছিলো।বর্ষাকাল নয় তবুও কি বৃষ্টিটাই না হয়েছিলো কয়েকটা দিন! মহুয়াদের গলির মোড়ে এক হাঁটু পানি জমে গিয়েছিলো প্রায়।আবরার অফিসে যাবে অথচ মহুয়া বিছানা থেকেই উঠতে পারছে না।সকাল থেকেই তার মাইগ্রেনের ব্যাথা শুরু হয়েছে।ব্যাথার তীব্রতায় দু-বার বমি করেছে মহুয়া।বিলকিস বেগম বাড়ি নেই।আবরারের মামা মারা গিয়েছিলো এক সপ্তাহ আগে।ভাইয়ের মৃত্যু উপলক্ষেই গ্রামে গিয়েছিলেন বিলকিস বেগম।আবরারের অফিস দশটা থেকে।আবরার অফিসে যাওয়ার উদ্যোগ নিতেই বিছানা থেকে তার হাত টেনে ধরে মহুয়া।কাতর গলায় বলেঃ” আজ না গেলে হয় না?আমার অনেক যন্ত্রণা হচ্ছে।মনে হচ্ছে মরেই যাব।”
আবরার বিছানার এককোনে বসে মহুয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।সান্ত্বনার সুরে বলেঃ” আজ সপ্তাহের প্রথম দিন, মহুয়া।একটু সহ্য করো।আমি পুষ্পা ভাবিকে বলে যাচ্ছি তোমার খেয়াল রাখার কথা।চিন্তা করো না।যদি পারি লাঞ্চের সময় ছুটি নিয়েই চলে আসব।”

মহুয়া সান্ত্বনা দিয়ে প্রবল ঝড়-বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বেড়িয়ে পড়ে আবরার।ব্যাংকে না গেলে তার চলবেই না।
তখন বোধহয় বেলা এগারোটা বাজে।আবরার কাজ করছিলো একমনে।এর মাঝে একবার বাড়িতে ফোন দিয়ে মহুয়ার খবর নিয়েছিলো।মহুয়া বলেছে সে ঠিক আছে।সকালের খাবার খেয়ে ঔষধ খাওয়ার পর নাকি ব্যাথা অনেকটাই কমে গেছে।আবরার কাজের মাঝে আরো একবার ব্যাংকের নির্দিষ্ট স্থানে চোখ বুলালো।কিন্তু,যাকে দেখার জন্য নজর ঘুরিয়েছিলো তাকে দেখলো না।ভিতরটা মুহূর্তেই তেতো হয়ে গেল আবরারের।আজ আসলো না কেন?
মিনিট কয়েকের মাঝে কোথা থেকে দৌড়ে এলো রাফি।সে আবরারের সবচেয়ে ভালো বন্ধু।তারা দুজন একইসাথে কাজ করে।রাফি আবরারের কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললঃ” আবরার, খবর শুনেছিস?”
আবরার বন্ধুর এই অবস্থা দেখে বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায়।ওকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে কাঁধে হাত রেখে বললঃ” শান্ত হ।কি খবর?”
—” অনন্যা আবারো আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে।ভাগ্য ভালো কিছু হয়নি।হাসপাতালে ভর্তি এখন।তোরা কি আবার ব্রেকাপ করেছিলি?”
পিলে চমকে উঠে আবরারের।খবরটা কি সত্যি?আরো একবার অনন্যার চেয়ারে চোখ বুলায়।মেয়েটা হাসপাতালে ভর্তি বলেই কি আজ আসতে পারেনি??

আবরারের বুকে মৃতের মতো পড়ে আছে অনন্যা।মরে নি কিন্তু নেতিয়ে গেছে অনেকটাই।অনন্যার ফর্সা মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।মেয়েটা বোধহয় গলায় ফাঁস দেওয়ার চেষ্টা করেছিলো।গলায় মোটা করে দাগ বসে গেছে।গলার নিচটা কালচে হয়ে গেছে একদম।আবরার দু-হাতের আজলায় প্রেয়সীর মুখ তুলে নেয়।কপালে তীব্র আবেগে উষ্ণ চুমু এঁকে দেয়।দু-দিন আগে কথা কাটাকাটি হয়েছিলো দুজনের মাঝে।রাগের মাথায় আবরার অনন্যাকে একটা বেফাঁস কথা বলে ফেলেছিলো।বলেছিলো,মহুয়াকে রেখে অনন্যার মতো মেয়েকে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না।এই ছোট্ট কথার জেরে অনন্যা আত্মহত্যার চেষ্টা করবে,তা স্বপ্নেও ভাবেনি।আবরার অনন্যার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেঃ” এরকম পাগলামি কেন করো অনু?তুমি কি ছোট?”
—” ধরবা না তুমি আমাকে।ছাড়ো,যাও মহুয়ার কাছে যাও।আমি তো কেউ না।আমি মরলেই কি আর বাঁচলেই কি?”
আবরারের শক্ত হাতের বাধন থেকে বের হতে চায় অনন্যা।কিন্তু,আবরারের বলিষ্ঠ হাতের সাথে তার মতো অসুস্থ মেয়ে পারবে কেন?অনন্যা হার মেনে নেয় সহজেই।নেতিয়ে যাওয়া ফুলের মতো আবারো আবরারের বুকে ঢলে পড়ে।আবরার অনন্যাকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।অনন্যাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে বলেঃ” তুমিই তো সব।মরবে কেন তুমি?আমাকে আর দুটো মাস সময় দেও,অনু।সব ঠিক করে ফেলব।প্লিজ,অনু আর রাগ করো না।মহুয়ার সাথে সব বোঝা-পড়া শেষ করতে অন্তত মাস দুয়েক তো লাগবেই।তুমি ততোদিন আরেকটু অপেক্ষা করো, প্লিজ।”
কথা শেষ করে আবারো অনন্যাকে চুমু দেয় আবরার।অনন্যার এলোমেলো চুলে পরম যত্নে ঠোঁট বুলিয়ে দেয়।

অনন্যাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যেতে বেশ সময় লেগেছে।পুরোটা সময় আবরার তার পাশে ছিলো।অনন্যাকে বাড়িতে পৌছে,ঔষধ খাইয়ে,ঘুম পাড়িয়ে আবরার যখন নিজের বাড়িতে এসেছে তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।মাথা ব্যাথায় ছিঁড়ে যাচ্ছে আবরারের।একটু বিছানায় শরীর না দিলে চলবেই না।আবরার বাড়ি ফিরে দেখলো শোবার ঘর ছাড়া সব ঘরের বাতি নিভানো।কপাল কুঁচকে ফেললো আবরার।কি ব্যাপার?মহুয়ার শরীর কি বেশি খারাপ নাকি?নিজেদের শোবার ঘরে পা দিতেই মহুয়াকে দেখলো আবরার।ঘরের জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।চুলগুলো এলোমেলো।আবরার মহুয়ার পিছনে যেয়ে দাঁড়ায়।কাঁধে হাত দিয়ে নিজের দিকে ফিরাতে ফিরাতে বলেঃ” ব্যাথা কমেনি,মহু….”কথা বন্ধ যায় আবরারের।মহুয়ার চোখ-মুখ ফুলে একেবারে মিষ্টি কুমড়োর মতো হয়ে আছে।চোখ দুটো পুরো লাল টুকটুকে হয়ে গেছে।আবরার আঁতকে উঠে বলেঃ”তোমার কি হয়েছে মহুয়া?ব্যাথা কি এখনো কমেনি?”
মহুয়া চুপ করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে।কয়েক সেকেণ্ডের জন্য মাত্র।তারপরেই আবরারের হাত সরিয়ে দেয় নিজের কাঁধ থেকে।
—” আপনি বোধহয় অনেক ক্লান্ত।হাত-মুখ ধুয়ে আসুন।আমি চা করে আনছি।”
মহুয়া চলে যেতে চাইলেও বাধা দেয় আবরার।হাত টেনে ধরে বলেঃ” চা লাগবে না আমার।তোমার এই অবস্থা কেন বললে না তো?অসুস্থ শরীরে…”
—” হাত ছাড়ুন।আমার অসুস্থতার কথা ভাবতে হবে না।আপনার সাথে কিছু কথা আছে আমার।খুব বেশি সময় লাগবে না।আপনি প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হোন।”
হতভম্ব আবরারকে পিছনে ফেলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে যায় মহুয়া।রান্নাঘরে যেয়ে চুলার কাছে দাঁড়ায়।বুক ভরে শ্বাস নেয়।এতোক্ষণ খুব কষ্টে কান্না আঁটকে রেখেছিলো।আর বোধহয় সম্ভব না।একদিকে মাথা ব্যাথা অন্যদিকে ভিতরের অস্থিরতা।দুটো মিলে একেবারে কাবু করে ফেলেছে তাকে।মহুয়া চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে রান্নাঘরের জানালা খুলে দেয়।মুহূর্তেই এক পশলা হিমেল হাওয়া ছুঁয়ে দেয় মহুয়ার মুখ।বৃষ্টির ঝাপটা মুখ ভিজিয়ে দেয়।মহুয়া গলা বাড়িয়ে বাইরেটা দেখে।সুনসান রাস্তাগুলোকে ভিজিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির পবিত্র পানি।এরকম এক সন্ধ্যায় মহুয়া যা পরিকল্পনা করে রেখেছে তা যদি না করতে হতো,তবে মহুয়া হয়তো বেঁচে যেতো।এই বৃষ্টিমুখর সময় উপভোগ করতে হয়।অলসতার চাদরে নিজেকে মুড়িয়ে নিতে হয়।অথচ,আজ কি করতে হবে মহুয়াকে? সে পারবে তো?এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ে মহুয়ার চোখ থেকে।তারপর আরো একফোটা, আরো একফোটা।ফোটায় ফোটায় পড়া চোখের পানি চায়ের পাতিলায় পড়ে।মহুয়া নিচের দিকে তাকিয়ে চোখ মুছে নেয়।এরকম সন্ধ্যা কোনো মেয়ের জীবনে না আসুক।

আবরার হাত-মুখ ধুয়ে, পোশাক পাল্টে বিছানায় গা এলিয়ে দিল।আজ সে সত্যি খুব ক্লান্ত।সকাল থেকে কম দৌড়- ঝাপ করতে হয়নি।ঘরে বউ আর বাইরে প্রেমিকা সামলানো কি চাট্টিখানি কথা!নরম বালিশে মাথা দিয়ে আরামে চোখ বুজে আসে আবরারের।বালিশটা থেকে মহুয়ার চুলের ঘ্রাণ আসছে।মহুয়ার চুল থেকে অন্য এক ধরনের ঘ্রাণ পায় সে।মেয়েটা কি শ্যাম্পু দেয় কে জানে!শ্যাম্পুর ঘ্রাণ নাকে গেলেই সুড়সুড়ি দেয়া শুরু করে।আবরারের ঘুমটা পাকাপোক্ত হওয়ার আগেই তাকে জাগিয়ে দেয় মহুয়া।আবরার বিরক্তভরা চোখ নিয়ে তাকায়।মেয়েটা হাতে চায়ের কাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আবরার চোখ- মুখ কুঁচকে আবারো ঘুমানোর উদ্যোগ নিতেই বাধা দেয় মহুয়া।গলা উঁচিয়ে বলেঃ”তাড়াতাড়ি উঠুন।চা নিন।আপনার সাথে আমার কথা আছে।উঠুন।”
—” এখন না মহুয়া।আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।যন্ত্রণা দিও না ঘুমাতে দেও।”
আবরার চোখ বন্ধ করার আগেই ঠাস করে কিছু ভাঙার আওয়াজ পায়।লাফিয়ে উঠে আবরার।কি হলো?চোখ খুলে দেখে মহুয়া চায়ের কাপটা আছড়ে ভেঙে ফেলেছে। হতভম্ব হয়ে যায় আবরার।মহুয়াকে কি আজকে ভূতে-টূতে ধরলো নাকি?সে বিস্মিত কন্ঠেই বললঃ”সমস্যা কি তোমার মহুয়া?”
মহুয়া উত্তর দেয় না।বরং, গলায় দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলেঃ” অনন্যা কে?”
একটা প্রশ্ন।মাত্র দুই শব্দের একটা প্রশ্নে চমকে যায় আবরার।ঘুম কোথায় পালিয়ে গেছে তা আর খুঁজে পায় না।সহসা কথা বলার মতো কোনো শব্দও খুঁজে পায় না।
—” কি ব্যাপার? কথা বলছেন না কেন? আমি প্রশ্ন করলাম অনন্যা কে?”
আবরার বহু কষ্টে গলায় আওয়াজ তুলে বলেঃ” অনন্যাকে তুমি কি করে চিনলে?”আবরারের কন্ঠস্বর অনেকটা আর্তনাদের মতো শোনায়।তার চোখ দুটো মনে হয় যেন কোটর থেকে বেড়িয়ে আসবে।মহুয়া তা দেখে একবার চোখ বন্ধ করে।লম্বা করে দম নেয়।এখন রাগার সময় নয়।কান্না আসছে খুব।কিন্তু মহুয়া কাঁদবে না।চোখের পানি কি এতো সস্তা নাকি, যে একটা প্রতারকের জন্য তা ঝরবে?প্রতারকদের জন্য অশ্রু নয় শুধু ঘৃণাই কাম্য।মহুয়া শান্ত গলায় বলেঃ”অনন্যাকে আমি কি করে চিনি তা আপনার জানার দরকার নেই।আপনি শুধু আমার প্রশ্নের উত্তর দিন।আজ হাসপাতালে আমি অনেক কিছু দেখেছি,নিজের কানেও অনেক কিছু শুনেছি।আমার সাথে তাই মিথ্যা বলবেন না।আপনি তো অনন্যার থেকে দু-মাস সময় চেয়েছেন সবকিছু ঠিক করার জন্য।দুমাস পরেই যা ঘটবে,তা আজ ঘটতে সমস্যা কি?”
—” তুমি হাসপাতালে গিয়েছিলে?তোমার ব্যাথা না কমে গেছিল!”
এতো কষ্টেও মৃদু হাসে মহুয়া।ম্লান হেসে বলেঃ”আপনাকে ফোনে মিথ্যা বলেছিলাম।আমি ভেবেছিলাম আমার স্বামীটা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করছে।তাকে শুধু শুধু টেনশন দেওয়ার কি দরকার?তারচেয়ে আমি বরং হাসপাতালে যাই।ডাক্তার দেখাই।বিশ্বাস করুন, হাসপাতালে যেয়ে আজ খুব উপকার হয়েছে।সেখানে না গেলে তো আমি জানতামই না, আমি যাকে বীরপুরুষ ভাবি সে আসলে কাপুরুষ।সে পরনারীতে আসক্ত।”
মহুয়ার কন্ঠে তাচ্ছিল্য ঝরে পড়ে।আবরার মাথা নিচু করে ফেলে।মহুয়া তো মিথ্যা কিছু বলছে না।তাহলে?এতো খারাপ লাগছে কেন? সত্যের স্বাদ কি তেতো হয়?
বহুক্ষণ চুপ থাকার পর আবরার ধীরে ধীরে বলা শুরু করল।
—” অনন্যা আমার প্রথম প্রেম।তার সাথে সম্পর্কের বয়স চার বছর।একই ভার্সিটিতে পড়েছি আমরা।ভাগ্যক্রমে একই ব্যাংকে চাকরিও হয়েছে।অনন্যার বাবা নেই।ওর আয়ের উপরেই ওদের সংসার চলে।তাই এতো তাড়াতাড়ি বিয়ের চিন্তা-ভাবনা ছিলো না ওর।এ নিয়ে আমাদের ঝামেলাও কম হয়নি।আমি বিয়ে করতে চাইলেও সে সবসময় উদাসীন ছিলো।আমাদের বিয়ের আগেও ওর সাথে আমার খুব বিশাল ঝামেলা হয়েছিলো।ওর উপর রাগ করেই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম আমি।বিয়ের পর চারবার আত্মহত্যা করতে গেছে ও।ভাগ্যক্রমে প্রতিবার বেঁচে গেছে অনু।”
মহুয়া নিশ্চল তাকিয়ে রইলো।কিছু বলার নেই যেন।আবরার কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারো বললঃ” বিয়ের পর থেকে অনুকে ভুলতে চেয়েছি আমি।কিন্তু পারিনি।অনু আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে মহুয়া।আমাদের বিয়ের পর অনু যেন আরো বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়লো আমার উপর।সেও আমাকে ছাড়তে চাইলো না।আর আমি তো আগে থেকেই ওর সাথে মিশে ছিলাম।সবকিছু ছাড়তে পারলেও অনুকে আমি কিছুতেই ছাড়তে পারব না।সে আমার প্রথম প্রেম।সংসারের মায়ায় তাকে আমি কিছুতেই বিসর্জন দিতে পারব না।”
—” তাহলে আমি কে?”
আবরার মলিন চোখে তাকায় একবার।নিচু মাথাটাকে আরো নিচু করে বলেঃ” তুমি বোধহয় আমার মোহ মহুয়া।এমন এক মোহ যাকে আমি ছাড়তে চাই কিন্তু পারছি না।”

#পর্ব-৯

বিশাল আকাশ থেকে সূর্য বিদায় নিচ্ছে।আকাশটা পুরো লাল-কমলা রঙে রাঙা হয়ে উঠেছে।ঢাকা শহরে সচরাচর সূর্যাস্ত দেখা যায় না।অবশ্য সময় নিয়ে কেউ দেখেও না।ব্যস্ত মানুষের জীবনে এতো সময় কোথায়?মহুয়ার দিনই ভালো লাগে।দিনের বেলা নানা কাজে ব্যস্ত থাকা যায়।তাই অতীতগুলো সহসা হানা দেয় না।কিন্তু রাত যত গভীর হয়,মহুয়ার অস্থিরতা ততোই বাড়ে।তাদের ছোট্ট ঘরের দূর্বল দেয়ালগুলোও যেন ফিসফিসিয়ে ঘোষণা দেয়—“মহুয়া তুই সত্যিই একা।”
পার্কের অশ্বত্থ গাছের নিচে রাখা বেঞ্চে বসে আছে মহুয়া।তুষার নেই তার পাশে।কোথায় যেন গেছে।সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে দেখে পার্ক ক্রমশ খালি হচ্ছে।কপোত-কপোতীরা বেড়িয়ে যাচ্ছে একে একে।মহুয়া বেঞ্চের গায়ে হেলান দিয়ে বসলো।হাত ঘড়িতে নজর বুলিয়ে নিলো একবার।সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।বাসায় ফিরতে হবে।তুষার না আসা অবধি উঠতে পারবে না মহুয়া।তাই অলস নজরে বয়স্ক অশ্বত্থ গাছের বিস্তৃত ডালের দিকে চেয়ে রইলো।ডালে দুটো ছোট ছোট পাখি দেখা যাচ্ছে।মহুয়ার পাখি সংগ্রহের খুব শখ।কিন্তু,সে দু-তিনটা পাখি ছাড়া খুব বেশি পাখি চিনে না।শুধু নাম জানে।এই দুটোও যে কি পাখি তা মহুয়া বুঝতে পারছে না।

—” মহুয়া, পানি খেয়ে নিন।আপনার গলা নিশ্চয়ই শুকিয়ে গেছে।”
তুষারের কথায় মহুয়া পাখি দেখায় বিরতি দিল।তুষারের হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে,বোতলের মুখ খুলতে খুলতে বললঃ” পানি আনতে গিয়েছিলেন আপনি?”
—” হুম।”
মহুয়া ঢকঢক করে প্রায় অর্ধেক বোতল পানি খেয়ে ফেললো। সেই বিকাল থেকে একটানা কথা বলছে।গলাটা সত্যিই খুব শুকিয়ে গেছে।মহুয়া পানি খাওয়া শেষ করে বললঃ” পানির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।”
—” ধন্যবাদ দেওয়া লাগবে না।আজ যেই গরম পরেছে।আমারই ভুল হয়েছে। আজকে আপনাকে এখানে না ডাকলেই ভালো হতো।”
মহুয়ার নজর ঘুরে ফিরে বারবার অশ্বত্থ গাছের ডালে চলে যাচ্ছে।হলদে রঙা পাখি দুটো কি সুন্দর!মহুয়া আঙুলের ইশারা দিয়ে তুষারকে প্রশ্ন করলোঃ” ওই দুটো কি পাখি?”
—” খুব সম্ভবত বেনে-বৌ পাখি।”
—” আপনি নিশ্চিত?”
—” অনেকটাই।আগে আমাদের গ্রামে অনেক দেখা যেত।মহুয়া,চলুন একটু হাঁটি।একটানা বসে থেকে আমার হাঁড়-মাংস লেগে গেছে একদম।আর বসতে পারব না।”
—” চলুন।”
মহুয়া উঠে আগে হাত-পা ঝারা দিলো।বসে থাকতে থাকতে কোমড় ব্যাথা হয়ে গেছে একদম।কিছুক্ষণ হাত-পা নড়াচড়া করার পর তুষারের সাথে পা বাড়ালো সামনে।আজকে গরম পড়েছে খুব।ঘামে তুষারের শার্ট ভিজে গেছে।মহুয়া তুষারের থেকে একপা পিছিয়ে আছে।তুষার একটু থেমে পিছু ফিরে বললঃ” মহুয়া, এরপর কি হয়েছিলো? বললেন না তো।”
—” এরপর আর কি।সেই ঝড়-বৃষ্টির সন্ধ্যায়, আমি আমার প্রাক্তনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।তখন বাইরে ছিল প্রবল বৃষ্টি,আমার শরীরে ছিল তীব্র অসুস্থতা আর মনের অবস্থা ছিল আরো নাজুক।বুঝতেই পারছেন কি বিচ্ছিরি অবস্থা ছিল আমার।”

—” তখনই বেরিয়ে আসার কি দরকার ছিল?আপনি সেই রাতটুকু তো সেখানেই থাকতে পারতেন।”
তুষারের কথায় খুব অবাক হলো মহুয়া।কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বললঃ”আপনি কি পাগল, তুষার সাহেব?আমি এতোকিছুর পরেও ওই হারামজাদার সাথে থাকতাম! ওইদিন যদি আর এক মুহূর্তের জন্য আমি সেখানে থাকতাম, তবে নিশ্চিত কুকুরটাকে খুন করে ফেলতাম।”
মহুয়ার কন্ঠে রাগ ও ঘৃণা একসাথে ঝরে পড়ে।তুষার বুঝতে পারে, মহুয়া এখনো আবরারকে ক্ষমা করতে পারেনি।অবশ্য, এইরকম অপরাধ ক্ষমা করাও যায় না।রাগের মাথায় বিয়ে করে ফেলেছে–এটা কোনো কথা?বিয়ে কি কোনো ছেলেখেলা? আবরারের উপর তুষারের খুব রাগ হচ্ছে।মেয়েটার কত স্বপ্ন ছিল।একটা মেয়ের স্বপ্ন ভাঙার অধিকার আবরারকে কে দিল?
—” তুষার সাহেব,কি ভাবছেন?”
মহুয়ার কথায় ভাবনার সুতা ছিড়ে যায় তুষারের।হাত দুটো বুকের উপর ভাঁজ করে হাঁটতে হাঁটতে বলেঃ”কিছুই ভাবছি না।”
—” আজকে অনেক সময় নষ্ট করলাম আপনার।আসলে, আমি শর্ট-কার্টে কথা শেষ করতে পারি না।”
—” কে বলল আপনি সময় নষ্ট করেছেন?এখানে তো আমিই আপনাকে ডেকেছি।আচ্ছা,মহুয়া আপনি যখন এতো অসুস্থতার ভিতরেও ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন তখন আবরার আপনাকে থামায়নি?”
—” উঁহু। ”
ভীষণ অবাক হয়ে যায় তুষার।আবরার কি মানুষ নাকি অমানুষ?যার শরীরে মানুষের রক্ত আছে, সে কিভাবে একটা মেয়েকে দুর্যোগের রাতে একা বেড়োতে দেয়?তুষার কন্ঠে বিস্ময় নিয়ে বলেঃ”আপনাকে একবারের জন্যও নিষেধ করেনি!আপনাকে সেই রাতে একা আসতে দেওয়া উচিত হয়নি।যদি পথে কোনো দুর্ঘটনা ঘটতো?”
তুষারের কথায় মলিন হাসে মহুয়া।অবিচল চোখে সামনে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলেঃ” আমাদের সম্পর্কে আমি ছিলাম অনেকটা অ্যাপেনডিক্সের মতো।আমাদের শরীরে যেমন এটার কোনো গুরুত্ব থাকে তেমনি আমারো কোনো গুরুত্ব ছিল না।সবাই মিলে আমাকে জুরে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু আবরারের সবটা জুরে আমি ছিলাম না।শুনলেন না, সে আমাকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেছিল।আমি নাকি তার মোহ ছিলাম।বিয়ের নয় মাসের মাথায় এসে আমি জানতে পারি, আমি একজন মানুষের মায়া নয় মোহ।হাহ!এটাকে কি বলা যেতে পারে তুষার সাহেব?দূর্ভাগ্য? ”
উত্তর নেই তুষারের কাছে।সে নিজেও তো একটা প্রতারণার শিকার।হয়তো মহুয়ার মতো তুষারের চোখ ভরা এতো স্বপ্ন ছিল না।কিন্তু,মহিমা ও মৃত্তিকাকে নিয়ে একটা সুন্দর পরিবার গড়ার ইচ্ছে তো ছিল।মহিমা যে কেন এরকম প্রতারণা করলো!মাঝে মাঝেই তুষারের মনে একটা প্রশ্ন জাগে।আচ্ছা,মহিমা কি তাদের কথা মনে করে?তার একটা মেয়ে আছে,মেয়েটা ছোট, নিজের কাজ নিজে করতে পারে না,মা ছাড়া মেয়েটা অসহায়–এসব কথা কি মহিমার মনে পড়ে?তুষার-মৃত্তিকা এদের জন্য কি কখনোই মহিমার মন খারাপ হয় না?দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুষার।যদি তাদের কথা মহিমা চিন্তা করতো তবে কখনোই এমন কাজ করতে পারতো না।প্রতারকরা কেন বেঁচে থাকে পৃথিবীতে? তারা কিভাবে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নেয়,চলাফেরা করে?তাদের কি কখনো কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা হয় না?খারাপ কাজের জন্য দম বন্ধ হয়ে আসে না?

—” তুষার সাহেব,সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে।আমাকে বাড়ি যেতে হবে।চলুন,বেড়িয়ে যাই।”
মহুয়ার কথায় তুষার তার দিকে তাকায়।মহুয়া তার পাশাপাশি হাঁটছে।দুজনের মাঝে অবশ্য দূরত্ব আছে।তুষারের হাঁটতে খারাপ লাগছে না।শেষ বিকালের নরম আলোয় মেয়েটার সঙ্গ বেশ উপভোগ করছে সে।অনেকদিন পর আজ তুষার কারো সাথে এতো কথা বলল।আজকাল কারো সাথে মন খুলে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।তাছাড়া,সারাদিন কাজ শেষ করে রাতে মৃত্তিকাকে সময় দিতে হয়।মেয়ের খাবার রান্না করতে হয়,তার সাথে খেলতে হয়,মৃত্তিকার অব্যক্ত সব কথা বুঝে নিতে হয়,কথা শিখাতে হয়।কারো সাথে দু-দন্ড কথা বলার সময় কোথায়?

—” তুষার সাহেব,কি ভাবছেন?”
—” না, কিছু না।”
—” আমার সম্পর্কে আর কিছু জানার আছে আপনার?”
—” হ্যাঁ, আরেকটা কথা।আপনাদের সম্পর্কে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত কার ছিল?”
—” দুজনেরই।আমি চলে আসার পর ওই বাড়ির সাথে আর কোনো সম্পর্ক ছিল না।কারো সাথে কোনো কথা-বার্তাও হয়নি।এভাবে তিনমাস চলেছে।এরপর বিয়ের প্রায় এক বছরের মাথায় বিচ্ছেদ।আবরারের সাথে আমার শেষ দেখা হয়েছে উকিলের চেম্বারে,ডিবোর্সের সময়।”
—” কোনো কথা হয়নি আপনাদের মাঝে?”
—” নাহ।সেও চেষ্টা করেনি, আমিও বলিনি।কথা কেন বলবে?গলার কাটা নেমে গেলে কি কেউ আর কাটার কথা মনে রাখে?”
—” আচ্ছা,একটা কথা বলুন।আবরার অনন্যাকে জান-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতো, তাই তো?”
—” হুম।”
—” তাহলে,আপনার সাথে কেন সম্পর্কে জড়ালো?মানলাম বিয়েটা নাহয় রাগের মাথায় করে ফেলেছে।কিন্তু, আপনার কথা মতো সে বিয়ের এক-দেড় মাস পর থেকেই খুব স্বাভাবিক ছিল।যে তার প্রেমিকাকে খুব ভালোবাসে, সে কেন আরেক মেয়ের সাথে এতোটা স্বাভাবিক থাকবে?বিষয়টা কেমন গোলমেলে না?
মহুয়া হাসে।তুষার কি বোকা?এটা বুঝার জন্য প্রশ্ন করতে হয়?এমনিই তো বুঝে ফেলা যায়।
—” তুষার সাহেব,আপনি স্যার উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘এজ ইউ লাইক ইট ‘ নাটকটা পড়েছেন?”
মহুয়ার তাল ছাড়া কথায় খুব অবাক হলেও তা প্রকাশ করলো না তুষার।মাথা নেড়ে বললঃ”না।ইংরেজি সাহিত্যে খুব বেশি বিচরণ নেই আমার।”
—” আমি পড়েছি।অবশ্য নাটকের অনুবাদটা পড়েছি আরকি।সেখানে একটা সংলাপ ছিল।সংলাপটা অনেকটা এরকম-চোরদেরকে রূপার চাইতে রূপ বেশি প্রলুব্ধ করে।আবরারের সাথেও হয়তো এমনটাই হয়েছিল।আমাদের সবারই কিন্তু
বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ থাকে।দুটো নারী-পুরুষ একসাথে একঘরে থাকবে অথচ তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক তৈরি হবে না,এটা শুধু নাটক-সিনেমাতেই সম্ভব।বিয়ের পর অনন্যা খুব বেপরোয়া আচরণ করতো আবরারের সাথে।আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিল।বুঝতেই পারছেন, অনন্যার কাছে তখন স্বস্তি পেত না আবরার।যেখানে শান্তি থাকে না সেখানে ভালোবাসা ফিকে হয়ে যায়।অন্যদিকে,আমি তো তাকে এতোটা যন্ত্রণা দিতাম না।বরং, বিয়ের পর থেকেই তার সাথে যথেষ্ট ভালো ব্যবহার করে এসেছি। তাই হয়তো আমার দিকেই ঝুকে পড়েছিল।”
—” মহুয়া,কারো প্রতি অভিযোগ নেই আপনার?”
—” কার প্রতি অভিযোগ করব, বলুন তো?আমার বাবা আমার ব্যাপারে খুব সচেতন।আমার জন্য একজোড়া জুতো কিনার আগেও বাবা তিন-চারটা দোকান ঘুরে।যেই দোকানে সবচেয়ে ভালো জুতো পায় সেটাই কিনে নিয়ে আসে।অথচ,বিয়ের আগে আবরারের সম্পর্কে শুধু এলাকাতেই খোঁজ-খবর নিয়েছে।অফিসে যেয়ে কোনো খবর নেয়নি।অফিসের প্রায় সবাই অনন্যা-আবরারের সম্পর্কের কথা জানতো।অফিসে যেয়ে খোঁজ -খবর নেওয়া কি উচিৎ ছিল না?এক্ষেত্রে, দোষ তো অনেকটা আমাদেরও ছিল।তারপর আবার আমার প্রাক্তন শ্বাশুড়ির কথাই চিন্তা করুন।তিনি কিন্তু ছেলের সম্পর্কের কথা জানতেন।তবুও, তিনি আমাকে ছেলের বউ করে নিয়ে গেলেন।দোষ তো তাকেও দেওয়া যায়।”
তুষার কপাল কুঁচকে ফেললো।তারমানে আবরারের মা সব জানতো!
—” তিনি যদি সবই জানতেন,তবে অনন্যাকে কেন বউ করে আনলেন না?অনন্যাকে তার পছন্দ ছিল না?”
—” না।অনন্যার চলাফেরা অনেকটাই উগ্র।তাই আমার প্রাক্তন শ্বাশুড়ি তাকে পছন্দ করতেন না।আমার বিয়ের আগে যখন তিনি দেখলেন আবরার ও অনন্যার মাঝে ঝামেলা হচ্ছে,তখনই ঝোপ বুঝে কোপ মারেন।আমাকে বউ করে নিয়ে যান।তিনি ভেবেছিলেন বিয়ের পর হয়তো আবরার বদলে যাবে।”
—” আপনি কি করে জানলেন এসব?”
—” আফিয়া আপা একদিন ফোনে এসব বলেছিল আমায়।তাহলে এখন বলুন, আমি কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করব?সবাই তো একটু-আকটু দোষী।তার চেয়ে ভাগ্যের দোহাই দেওয়াই ভালো।এসব আমার ভাগ্যেই ছিল।নাহয়,আমার সাথেই কেন এতো এমন হলো?”

চারদিকে আলো-আধারের লুকোচুরি খেলা চলছে।এখনই হয়তো ঝুপ করে একমুঠো সন্ধ্যা নেমে আসবে।তুষারের পাশ দিয়ে একটা বাদামওয়ালা হেঁটে চলে গেল।তাকে থামিয়ে বেশ খানিকটা বাদাম কিনে নিলো তুষার।মহুয়া একটা আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে রইলো।তুষার ফিরে এসে মহুয়ার মুখোমুখি দাঁড়ায়।
—“মহুয়া,নিন বাদাম খান।”
তুষারের প্রস্তাব হাসিমুখে নাকচ করে দেয় মহুয়া।
—” আপনি খান।আমি খাব না।”
—” না করবেন না প্লিজ।নিন।”
—“বিব্রত হবেন না তুষার সাহেব।বাদামের খোসা ফেলে খেতে ইচ্ছে করছে না এখন।আমি আবার এসব বিষয়ে খুবই অলস।”
মুচকি হাসে তুষার।হাতের মুঠোয় বাদাম নিয়ে খোসা ফেলতে ফেলতে বলেঃ”ওহ,এই কথা।আগে বলবেন না।আমি ছিলে দিচ্ছি আপনি খান।এতে সমস্যা নেই তো?”
মাথা নাড়ায় মহুয়া।তুষার মহুয়ার হাতে বাদাম তুলে দিয়ে কুন্ঠিত গলায় প্রশ্ন করেঃ”আপনি বোধহয় আমার থেকে বয়সে অনেকটাই ছোট,তাই না?”
—” আমার সাতাশ চলছে।আপনার?”
—” একত্রিশ।তাহলে আপনাকে তুমি করে বলি?আমি কাউকে খুব বেশিক্ষণ আপনি করে বলতে পারি না।”
মহুয়া হেসে ফেলে।অনুমতি দিয়ে বলেঃ” ঠিক আছে, বলবেন।এ আর এমন কি কথা।”
—” মহুয়া,তুমি আমাকেও বিশ্বাস করতে পারছ না।বিয়েটা তুমি স্বেচ্ছায় করছো না।পরিবারের চাপে করছো, তাই না?”
মহুয়া অবাক হয়ে তাকায় তুষারের দিকে।তুষারের কথা সম্পূর্ণ ঠিক।কিন্তু মহুয়া তো এমন কোনো আচরণ করেনি, যাতে করে তুষার বুঝতে পারবে।তুষার মহুয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল। তাই তুষারের মুখের দিকে তাকাতে বেগ পেতে হয় না।মানুষটা নিচের দিকে তাকিয়ে হাসছে।এই প্রথম মহুয়া ভালোভাবে তুষারকে দেখলো।ইনিও যথেষ্ট সুপুরুষ।আগে হয়তো আরো বলিষ্ঠ ছিল।এখন স্বাস্থ্য ভেঙে গেছে তা চেহারা দেখলেই বোঝা যায়।তুষারের একটা গেজ দাঁত আছে।হাসলে সেটা দেখা যায়।

—” কি হলো বললে না যে?”
—” ঠিক ধরেছেন।কোনো পুরুষকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না।আপনাকেও আমার ভালো লাগে।অনেকটা স্বার্থপরের মতো লাগে।”
তুষার সরাসরি মহুয়ার চোখের দিকে তাকায়।শান্ত গলায় প্রশ্ন করেঃ” কেন?”
—” মনে আছে,প্রথম দিনের কথা?আপনি সেদিন আমাকে বলেছিলেন, আপনি মৃত্তিকার জন্য আমাকে বিয়ে করছেন।এর মানে কী দাঁড়ায়?আপনার জীবনে আমার প্রয়োজন নেই।আপনার মেয়ের প্রয়োজনেই আপনি বিয়ে করছেন।এই কথার মাধ্যমে কিন্তু পরোক্ষভাবে আপনি মৃত্তিকাকে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিলেন।আপনি নিজেই চিন্তা করুন, আপনার এই কথার পরেও কি মৃত্তিকার প্রতি আমার ভালো ব্যবহার আসবে?ওকে দেখলেই আমার হিংসা হবে।মনে হবে, ওর জন্যই আমার অধিকার খর্ব হচ্ছে।আপনার ওই কথার পর থেকেই আপনাকে স্বার্থপর মনে হয়।যে নিজের দিকটা ষোলো আনা দেখছে।কিন্তু,আমার দিক এক আনাও দেখছে না।”
তুষার মহুয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।তারপর হুট করেই প্রশ্ন করলোঃ”হিজাব বেধে টিপ কেন পরো? ”
অবাক হয়ে যায় মহুয়া। সে কি বললো আর তুষার কি বলল! মহুয়া বিস্মিত গলায় বলেঃ” মানে!”
—” মানে হচ্ছে, তুমি হিজাব পরেছো আবার কপালে টিপও দিয়েছ।বিষয়টা কি ঠিক হলো?”
—” এটা টিপ না তিল।ছোট থেকেই টিপের মতো একটা তিল আছে আমার।”–ভোতা মুখে উত্তর দেয় মহুয়া।
—” ওহ।তুমি কিন্তু আবার কিছু মনে করো না।আচ্ছা, আসল কথায় ?