যাত্রাশেষে (পর্ব-১২+১৩)

#যাত্রাশেষে (পর্ব-১২+১৩)
#হালিমা রহমান

একটা নতুন ভোরেই এরকম একটা অপ্রত্যাশিত মানুষের মুখোমুখি হবে, তা কখনো ভাবেনি মহুয়া।আবরার তার সামনেই দাঁড়ানো।দুজনের মাঝে দূরত্ব বড়জোর দেড়হাত হবে।দুটো বাড়ির মাঝে এতটুকুই ফাঁক।মহুয়া কয়েক সেকেন্ড হতভম্ব চোখে দাঁড়িয়ে রইলো।কিছুক্ষণ পর সবটা বোধগম্য হতেই দ্রুতপায়ে ঘরের দিকে ছুটলো। কোনো পঁচা,নোংরা অতীতের মুখোমুখি হতে চায় না সে।মহুয়া ঘরে ঢুকে সশব্দে বারান্দার দরজা আটকে দেয়।হৃৎপিণ্ডের গতি তীব্র। মহুয়া দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়।খুলে যাওয়া চুলগুলো সুন্দর করে বেঁধে নেয়।নিজেকেই নিজে মনে মনে ধমক দেয়।প্রাক্তনকে দেখে এমন করার কি আছে? পৃথিবীটা ছোট।এখানে চলতি পথে মানুষের পাশাপাশি কতগুলো ইতরের সাথেও দেখা হবে এটাই স্বাভাবিক।তো?এতো থমকে যাওয়ার তো কোনো কারণ নেই।মহুয়া ধীরপায়ে খাটের কোনে বসে পড়ে।মৃত্তিকা ও তুষার এখনো ঘুমিয়ে আছে।মিনিট কয়েক বসে থাকার পরেই, হঠাৎ করে মহুয়ার মাথায় একটা ভাবনা খেলে যায়।সে আসলে আছে কোথায়?এটা কোন জায়গা?আবরার যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল,সেই জায়গাটা খুব পরিচিত মহুয়ার।এক সময়ে সে এখানে স্বর্গসুখ লাভ করতো।তবে কি? মহুয়া মৃত্তিকার উপর দিয়ে তুষারের কপালে হাত দেয়।হালকা ধাক্কা দিয়ে মৃদু গলায় ডাক দেয় তাকে।

—” মিত্তির বাবা,মিত্তির বাবা।এই মিত্তির বাবা।”
—” হুম”—ঘুমঘুম কন্ঠে উত্তর দেয় তুষার।এতোক্ষণ একপাশ হয়ে শুয়ে থাকলেও, এখন সোজা হয়ে শোয়।ডান চোখটা হালকা মেলে রাখে।
—” আমরা এখন কোথায় আছি?লক্ষ্মীবাজারে না?”
—” উঁহু।নয়া পল্টন।”
—” নয়া পল্টন কেন?আপনার বাড়ি না লক্ষ্মীবাজার?”
—” ফ্ল্যাটের কথা বলেছিলাম না তোমায়?ফ্ল্যাট নয়া পল্টনে।লক্ষ্মীবাজারে এতোদিন আমি ভাড়া থাকতাম।কালকে এখানে শিফট হয়েছি।তুমি উঠেছো কেন?ঘুমিয়ে থাক।”
—” আমার আর ঘুম আসবে না।”
—” তাহলে একটু কষ্ট করে মিত্তির প্যাম্পার্সটা খুলে দেও না।কাল রাত থেকে পরে আছে।অনেক ভারী হয়ে গেছে মনে হয়।”
—“ঠিক আছে।”

আবারো পাশ ফিরে ঘুমিয়ে যায় তুষার।তার ক্লান্তির রেশ যে এখনো কাটেনি তা দেখলেই বুঝা যায়।মহুয়ার মাথা ঝিমঝিম করছে।সে থম ধরে বসে থাকে কতক্ষণ। তার মানে এই সেই ফ্ল্যাট, যেটা আবরারদের ঘর থেকে সে উঁকি দিয়ে দেখতো!এটা খুব পছন্দ ছিল মহুয়ার।রুমগুলো, বারান্দাটা কত বড়।মহুয়া ঘাড় ঘুরিয়ে পুরো রুম দেখলো।সাদা-গোলাপি রঙ করা হয়েছে।রুমটা বেশ বড়।খাট,আলমারি,ড্রেসিং টেবিল,টেবিল,দুটো ফুলদানি,দেয়াল শোকেস সব একসাথেই এ ঘরে রাখা।তাই একটু দমবন্ধ হয়ে আসে।বাইরের রুমগুলোর কি অবস্থা, তা জানা নেই মহুয়ার।কাল রাতে চোখে ঘুম ছিল বলেই বোধহয় ঘরটা পরিচিত মনে হয়নি।মহুয়ার নিজের ভাগ্যের উপর এখন আর রাগ হয় না।আক্ষেপও হয় না।নিজের ভাগ্যের উপর খুব হাসি পায় তার।ঘুরে ফিরে এক জায়গায়ই কেন চলে আসে সে?আগের সবকিছু ভুলে মহুয়া নতুন করে সব শুরু করলো।আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো, যাতে আর কখনো অতীতের দেখা না পায়।অথচ বিয়ের পরের দিনই দেখে সে প্রাক্তনের চোখের সামনে এসে পড়েছে।মানে, এরকম আজগুবি জিনিস আর কার সাথে ঘটেছে?মহুয়া কি জীবনে খুব বেশি পাপ-টাপ করে ফেললো নাকি?নাকি আল্লাহ ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে?কে জানে!
পাশে মৃত্তিকা নড়েচড়ে উঠতেই সচেতন হয় মহুয়া।মেয়েটার বোধহয় খুব অস্বস্তি হচ্ছে।ঘুমের মধ্যেই খুব অস্থিরতা করছে।মহুয়া মৃত্তিকাকে নিজের কাছে টেনে আনে।আলতোহাতে প্যাম্পার্স খুলে দেয়।এই মেয়েটাকে খুব ভালো লাগে তার।মহুয়ার বরাবরই একটা বাচ্চার শখ।একদম ছোটবেলা থেকে।তার কেন কোনো ছোট ভাই-বোন নেই,এ নিয়ে প্রশ্ন করে সাবিনা বেগমকে কম বিরক্ত করেনি সে।বাচ্চাদের ধরতে,আদর করতে, কোলে নিতে খুব ভালো লাগে তার।বিয়ের পর ভেবেছিল আবারারের মাধ্যমে স্বপ্ন পূরণ করবে। কিন্তু বিধি বাম! সেখানেও ব্যর্থ।তুষারকে নিয়ে এখনো কোনোকিছু ভাবেনি মহুয়া।ভাবতেও চায় না।যেভাবে চলছে চলতে থাকুক।মহুয়ার কেবল এই বাচ্চা মেয়েটার প্রতি মায়া।একটা বাচ্চাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকা যায় না?অবশ্যই যায়।মহুয়া ঠিক এটাই করবে।সে কখনোই তুষারের প্রতি আগে আগেই দুর্বলতা দেখাবে না।আগে তুষারের মতিগতি বুঝবে।তারপর যা হবে দেখা যাবে।
মহুয়া মৃত্তিকার পাশ থেকে উঠে নিজের ফোন খুঁজে।কোথায় আছে কে জানে!কাল আসার পর বাড়িতে একবারও কথা বলা হয়নি।মা-বাবা অসুস্থ হয়ে গেছে নাকি আল্লাহ মালুম।বহু খুঁজেও ফোন পেল না মহুয়া।লাগেজের ভিতর,ব্যাগের ভিতর,তুষারের পাঞ্জাবীর পকেটে –কোথাও নেই।মহুয়ার চোখ যায় টেবিলের উপর।খাবারের প্লেটের পাশেই একটা ফোন।খুব সম্ভবত তুষারের।মহুয়া মুখ বেঁকিয়ে ভাবলো।ফোনটা কি ধরবে?তুষার তো ঘুমাচ্ছে।না বলে কারো ব্যাক্তিগত জিনিস কি ধরা উচিৎ? মহুয়া বেশ কিছুক্ষণ ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো, সে এখন তুষারের ফোনটাই ব্যবহার করবে।তুষারকে ঘুম থেকে তুলে অনুমতি নেবে।না বলে আরেকজনের জিনিস আবার কিভাবে ধরে?মহুয়া মোটেও অসামাজিক নয়।তাই মহুয়া ধীরে ধীরে তুষারের পাশে যেয়ে বসে।আবারো আস্তে আস্তে কপালে হাত ছোঁয়ায়।মৃদু স্বরে ঘুম থেকে ডেকে তুলে তুষারকে।

—” মিত্তির বাবা,এই মিত্তির বাবা।”
তুষার কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই চোখ মেলে তাকায়।তার কপালে বিরক্তির ভাঁজ।
—” আবার কি, মহুয়া?”—বেশ অসহায় শোনায় তুষারের কন্ঠ।
—” আপনার মোবাইলটা একটু নেই।আমারটা খুঁজে পাচ্ছি না।বাসায় ফোন দেব।”
বেশ অবাক হয়ে উঠে বসে তুষার।ক্ষীণ গলায় বলেঃ”এই জন্য আমাকে তুমি ডেকেছো?শুধুমাত্র এই সামান্য কারণে? ”
—“হ্যাঁ! ”
—“এটা অনুমতি নেওয়ার কি আছে, মহুয়া?আমার ফোন ধরলে কি আমি তোমায় বকা দেব?আশ্চর্য!মানুষ কিডনিও এভাবে চায় না।”
মহুয়া কিছু না বলে ফোন নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।গলায় বিরক্ত ফুটিয়ে তুলে —” আমাকে অসামাজিক ভেবেছেন?আমি কারো ব্যক্তিগত জিনিস না বলে ধরি না।আর বিরক্ত করব না।ঘুমিয়ে থাকুন।”
—“আরেকবার বিরক্ত করলে তোমাকে আমি খুন করে ফেলব।আগামী আধ-ঘন্টার আগে মোটেও ডাকবে না আমাকে।”

মহুয়াকে কথাগুলো বলে আবারো শুয়ে পড়ে তুষার।কাঁচা ঘুম ভাঙলে কেমন লাগে মানুষের?মৃত্তিকা নিজের জায়গা থেকে গড়িয়ে তার বাবার জায়গায় এসে পড়েছে।তুষার মেয়েকে জড়িয়ে ধরে।এটা তার স্বভাব।ঘুমের সময় মেয়েকে না জড়িয়ে ধরলে তার ঘুমই আসে না।তুষারের চোখে ঘুম নেমে আসার আগেই তা ভেঙে যায়।কারণ,ঘুমের মাঝেই মৃত্তিকা তার শরীর ভিজিয়ে ফেলেছে।তুষার চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে।পাশে মহুয়া এখনো দাঁড়ানো।তার দিন- দুনিয়া অন্ধকার করে হাসি আসছে।তুষারের চেহারাটা দেখার মতো হয়েছে।কিন্তু এখন মোটেও হাসা যাবে না।তুষার বেশ অনেক্ষণ অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকার ফট করে উঠে দাঁড়ায়।আজ দিনটাই খারাপ।তার বউ ও মেয়ে বিশ্বখারাপ।ঘুমাতেই দিলো না।অসহ্য।বিরবির করতে করতেই বাথরুমের দিকে ছুটে তুষার।

***

মহুয়া গোসল সেরে ঘর থেকে বেড়িয়ে এলো।কাল রাতে ঘুমিয়ে না গেলে আগেই গোসল করতো।গাড়ি থেকে নেমে গোসল না করলে খুব অসহ্য লাগে মহুয়ার।তাছাড়া, খুব ক্ষিদেও পেয়েছে।মহুয়া তার রুমে রাখা খাবারের প্লেট নিয়ে বেড়িয়ে এলো।খাবারগুলো নষ্ট হয়ে গেছে।তুষার বাইরে গেছে,মৃত্তিকা এখনো ঘুমায়।মহুয়া রুমের বাইরে পা দিয়ে কাউকে দেখলো না।বিয়েবাড়ি হলেও তুষারের বাড়িতে কোনো আমেজই নেই।এদের কি কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই?মহুয়া মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে রান্নাঘরের দিকে গেল।এখান থেকে পানির আওয়াজ আসছে।মহুয়া সেখানে যেয়ে দেখলো, রুবিনা বেগম চা বানাচ্ছেন।মহুয়া তার দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য গলায় হালকা কাশি তুলে।রুবিনা বেগম পিছু ফিরে মহুয়াকে দেখে মুচকি হাসে।

—” এসো মহুয়া।কখন উঠলে?”
—” একটু আগে।”
—” মিত্তি উঠেছে?”
—” জ্বি না।”
রুবিনা বেগমের চোখ যায় মহুয়ার হাতের প্লেটের দিকে।
—” ওটাতে কি?”
—” খাবার।কালকে রাতে মনে হয় মিত্তির বাবা নিয়ে গেছিল।নষ্ট হয়ে গেছে।”
—” খাওনি তোমরা রাতে!”
—” জ্বি না।খাওয়া হয়নি।”
—” ওমা এতোক্ষণ না খেয়ে কিভাবে থাকে মানুষ?চা হয়ে গেছে, চা খাও।তুষার নাস্তা আনতে গেছে।”
রুবিনা বেগম কাপে চা ঢালার আয়োজন করেন।মহুয়া একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে।কিছুক্ষণ পর বলেঃ” খালুর শরীরটা এখন কেমন?”
—” আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।”
—” কি হয়েছিল?”
—” হঠাৎ করেই কাল বুকে ব্যথা উঠেছিল।এখন অবশ্য অনেকটাই ভালো।ঘুমাচ্ছে।তোমার সাথে আলাপ হয়েছে?”
—” জ্বি না।”
—” ঘুম থেকে উঠলে পরিচয় করিয়ে দেব।এখন খাও তো।”

মহুয়ার চা খাওয়ার ফাঁকেই তুষার এসে পড়ে।মহুয়া ডাইনিংয়ে বসেছিল।তুষারও এসে ওর পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে।রুবিনা বেগমকে হাঁক দিয়ে বলে—” খালামনি,নাস্তা এনেছি।চা দেও।”
—” দিচ্ছি,অপেক্ষা কর।”
তুষার এক নজর মহুয়ার দিকে তাকায়।গোসল করায় বেশ সতেজ লাগছে মেয়েটাকে।গায়ে একটা নীল রঙের শাড়ি জড়ানো।শাড়ির সোনালী আঁচল মাথায় দেওয়া।তুষার বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করার পর নিচুস্বরে বললঃ” তোমাকে শাড়ি পড়লে অনেক বড় বড় দেখা যায়।”
—” আমি তো বড়ই।আমার সাতাশ চলছে,অষ্টাদশ নয়।”
—” হ্যাঁ, ঠিকাছে।কিন্তু এতোদিন এতো বড় দেখা যেত না।আজ দেখাচ্ছে।এখন থেকে পারলে শাড়িই পরো। ”
—” দেখি।আপনার এতো দেরি হলো যে?”
তুষার চেয়ারে হেলান দেয়।
—” আর বলো না,নতুন এলাকায় রাস্তা-ঘাট কিছুই চিনি না।হোটেল খুঁজতে খুঁজতেই দেরি হয়ে গেল।”
—“গলির মাথাতেই একটা দোকান আছে।ওখানে গেলেই পেয়ে যেতেন।”
তুষার সোজা হয়ে বসে।ভ্রু কুঁচকে বলেঃ”তুমি কি করে জানলে?”
—“আমি এই নয়া পল্টনেই ছিলাম।তাই অনেক কিছুই চিনি।আমার কথা ছাড়ুন। আপনি বলুন,দোকান কি করে খুঁজে পেলেন?”
—” ইশতিয়াক নামের একজন ভদ্রলোক সাহায্য করেছেন।উনিও নাকি এদিকেই থাকেন।তিনি না থাকলে আরো দেরি হতো।ভদ্রলোক বেশ অমায়িক, বুঝলে।আমাকে নিজে দোকানে নিয়ে গেল।”

ওদের আলাপচারিতা হয়তো আরো কিছুক্ষণ চলতে পারতো কিন্তু চললো না মৃত্তিকার জন্য।সে উঠে কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছে।তুষার উঠার আগেই মহুয়া উঠে পড়লো।মুখে বললঃ” আমি এখন মেয়ের সাথে ভাব জমাবো।আপনি কিন্তু আমাদের মাঝে আসবেন না।হয়তো মিত্তি কাঁদবে।তাও নাক গলাবেন না। বুঝেছেন?”
তুষার মাথা নাড়ে।মা-মেয়ের রাজ্যে সে এখন নিষিদ্ধ প্রানী।

***

বিকালে মহুয়া ও মৃত্তিকা বসেছিল ঘরে।মৃত্তিকা অনেকটাই চিনে গেছে মহুয়াকে।সকালবেলা মহুয়া তাকে নিয়ে এদিক-ওদিক হেঁটেছে,খাবার খাইয়ে দিয়েছে,দুপুরে গোসল করিয়ে দিয়েছে।মহুয়ার বুকের উপর ভর দিয়ে বসেছিল মৃত্তিকা।সে তার মায়ের কানের দুল নিয়ে খেলছে।এটা তার জন্য নতুন খেলা।সে বেশ আগ্রহী।ঘড়ির কাটায় সাড়ে পাঁচটার মতো বাজে।এমন সময় ঘরে ঢুকলো তুষার।সে আজ দোকানে যায়নি।বিয়ে উপলক্ষে কয়েকদিন কাজ থেকে দূরে থাকবে।তুষার এসে মহুয়ার পাশে বসে।মৃত্তিকাকে কোলে টেনে বলেঃ” আমার মা আমাকে ভুলে গেছে?”
মহুয়া বেশ বিরক্ত হয় এতে।সে আধশোয়া থেকে উঠে বসে। কপাল কুঁচকে বলেঃ” আমরা খেলছিলাম,মিত্তির বাবা।আপনি একটা ডিস্টার্ব। ”
—” খেলো, আমি কি মানা করেছি?”
—” হুহ।মেয়েকে নিয়ে গেছেন আপনি।”
তুষার মহুয়ার কথায় কিছু বলল না।আলমারি থেকে একটা শপিং ব্যাগ বের করে তা মহুয়ার হাতে দিল।
—” এই নেও।”
—” কি এটা?”
—” তোমার প্রথম রাতের উপহার।কালকে তো ঘুমিয়ে গিয়েছিলে,তাই দিতে পারিনি।দেখে বলো তো কেমন হয়েছে।”
মহুয়া শপিং ব্যাগ থেকে একটা বাক্স বের করলো।বেশ সুন্দর একটা চেইন আছে তাতে।পাশে আরেকটা ছোট্ট বাক্স।সেটা খুলে দেখলো, তাতে একজোড়া চুড়ি।মৃত্তিকার হাতের মাপের।দুটোই বেশ সুন্দর।
—” বাহ,বেশ সুন্দর তো।”
মহুয়া মুখ তুলে দেখলো তুষার নেই।তাকে দেখতে বলে বারান্দাতে চলে গেছে।সেখান থেকে তার কথা শোনা যাচ্ছে।মহুয়া মৃত্তিকাকে নিয়ে সেখানে গেল।লোকটা সত্যিই একটা পাগল।মহুয়া বারান্দায় যেয়ে দেখলো, তুষার সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা আবরারের সাথে কথা বলছে।মহুয়ার অস্তিত্ব টের পেতেই সে পিছু ফিরে। হাত বাড়িয়ে মহুয়ার কাঁধ টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসে।তারপর আবার আবরারকে উদ্দেশ্য করে বলেঃ”এই যে ইশতিয়াক ভাই,এটা আমার বউ মহুয়া।আর এটা মেয়ে মৃত্তিকা।আর মহুয়া উনি ইশতিয়াক আবরার।ওই যে সকালে ইশতিয়াক ভাইয়ের কথা বললাম না,উনিই তিনি।”

# (১৩)

মহুয়ার প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে।অস্বস্তির কারণ আবরার নয় তুষার।তুষারের হাত এখনো তার কাঁধের উপর।মহুয়ার মাথা তুষারের গলার কাছাকাছি।খুব সহজেই তুষারের পারফিউমের গন্ধ মহুয়ার নাকে ধাক্কা দেয়।তাদের মাঝে বন্ধুত্বের সম্পর্ক থাকলেও এতোটা ধরা-ছোঁয়ার সম্পর্ক নেই।তাই সারা শরীরে অস্বস্তিরা ভর করেছে।এই তুষার আবার তাকে আবরারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।হাহ!পৃথিবীতে কত আজব ঘটনাই না ঘটে।আবরারকে মহুয়ার চাইতে ভালো আর কে চিনে?এরকম হারামজাদা মহুয়া একটাই দেখেছে।তবে এবার আর আবরারের মুখোমুখি হয়ে থমকে গেল না মহুয়া।সকাল থেকেই নিজেকে যথেষ্ট প্রস্তুত করে নিয়েছে।আবরার শুধুমাত্র প্রাক্তন। বর্তমান তো আর নয়।তাছাড়া, আবরার মহুয়ার প্রতি আকৃষ্ট নয়।মহুয়াও আবরারের প্রতি দুর্বল নয়।তাহলে?অস্বস্তিতে ভোগার আর কারণই নেই।তাই তুষার পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর মহুয়া মুচকি হাসলো।বেশ প্রসন্ন গলায় বললঃ”আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।ভালো আছেন?”
—” হ্যাঁ। তুমি ভালো আছ?”—আবরারের কন্ঠ অপ্রস্তুত।চোখের দৃষ্টিতেও বিচলতার ছাপ।
—” আলহামদুলিল্লাহ, আমিও ভালো আছি।”
মহুয়া নিজের কাঁধ থেকে তুষারের হাত ছাড়িয়ে নেয়।তার কোলে থাকা মৃত্তিকা এদিক-ওদিক দেখছে।এই পরিবেশ তার জন্য সম্পূর্ণ নতুন।মহুয়া তুষারকে বললঃ” আমি ঘরে যাচ্ছি।”
—” আচ্ছা।”

মহুয়া পা বাড়ালেও মৃত্তিকা বেশ অস্থিরতা শুরু করে দেয়।তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে, সে এখন এখান থেকে যাবে না।মহুয়া আবারো তুষারের দিকে এগিয়ে আসে।
—” মিত্তির বাবা,বাবুকে রাখেন।ও এখন ঘরে যাবে না।”
—” দেও।”

মহুয়ার কোল থেকে মৃত্তিকাকে আলতোহাতে কোলে নেয় তুষার।তার ঠোঁটের কোনের হাসি ও মুখের অনবদ্য সুখের ছাপ আবরারের চোখ এড়ায় না।মহুয়া আগের থেকে অনেকটাই বদলে গেছে।আগে আরেকটু সুন্দর ছিল।এখন বেশ শুকিয়ে গেছে।মেয়েটাকে শাড়ি পরলে বেশ লাগে।শাড়ি সামলাতেও পারে খুব।একটা কথা আবরারের খুব জানতে ইচ্ছে করে।মহুয়ার বিয়ে হলো কবে?এতো বড় একটা মেয়েই বা কবে হলো?তবে দুজনকে মানিয়েছে বেশ।ওদের বাচ্চাটাও খুব সুন্দর।একদম তুলতুলে।ঠিক বিড়াল ছানার মতো।বিড়াল ছানার কথা মনে আসতেই মহুয়ার আবদারের কথা মনে পড়ে যায়।আবরারের কাছেও ঠিক এরকম একটা বিড়াল ছানার আবদার করেছিল মহুয়া।যার ছোট দুটো হাত থাকবে,দুটো পা থাকবে,ঘরজুরে ঘুরে বেড়াবে–এরকম একটা বিড়াল ছানা।মেয়েটার চাহিদাগুলোও কেমন অদ্ভুত ছিল।ময়না পাখি, গাছ-গাছালি,প্রশংসা আর আবরারের একটু সময়–এই কয়েকটা জিনিসই চেয়েছিল সে।কিন্তু তার একটাও দিতে পারেনি আবরার।দীর্ঘশ্বাসে তার ভিতরটা ভারী হয়ে আসে।মহুয়া যাওয়ার আগে কোনো অভিশাপ দিয়ে যায়নি ঠিকই,কিন্তু আবরারের ভিতর অনুশোচনার বীজ বুনে দিয়ে গেছে।এর যন্ত্রণা যে কি তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পায় আবরার।

—” বা বা,বা বা “—মৃত্তিকার কন্ঠে চিন্তার রাজ্যে ভাঙন ধরে আবরারের।মেয়েটা কথাও বলতে জানে!কি সুন্দর করে তার বাবাকে ডাকলো!আবরার খুব প্রশংসার সুরে বলেঃ” আপনার মেয়েটা ভারী মিষ্টি, তুষার ভাই।বয়স কত ওর?
—” একবছর হয়নি এখনো।একবছর হতে আর কয়েকদিন বাকি।”

একবছর?তাহলে কি এটা মহুয়ার নিজের মেয়ে না?আবরার বেশ ইতস্তত করে বলেঃ”মেয়ের মায়ের সাথে কিন্তু মেয়ের চেহারা মিলে না।মনেই হয় না যে এটা মহুয়ার মেয়ে।”
আবরারের ইঙ্গিতের ধারে কাছেও যায় না তুষার।মেয়ের গালে চুমু খেয়ে মুচকি হাসে।
—” চেহারা না মিললে কি হয়েছে এটা মহুয়ারই মেয়ে।আমার সাথেও তো চেহারা মিলে না।তো?এটা আমাদেরই মেয়ে।”
—” ওহ,আচ্ছা।”

তুষার মৃত্তিকাকে নিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটে।হাত দিয়ে এটা -ওটা দেখায়।বারান্দাটা খোলা।মহুয়ার না বারান্দা পছন্দ?তুষার অনেকগুলো গাছ এনে দেবে।অনেকগুলো বাহারি গাছ লাগানো যাবে এখানে।ছোট-খাটো একটা ময়না পাখিও এনে দেবে।মহুয়ার ইচ্ছেগুলো সব মনে আছে তুষারের।সামান্য ইচ্ছে পূরণ করে যদি কারো মুখে হাসি ফোটানো যায়,তবে মন্দ কি!

—” ইশতি,ইশতি।কোথায় তুমি?”
অনন্যার কন্ঠ কানে আসতেই সোজা হয়ে দাঁড়ায় আবরার।তুষারের থেকে বিদায় নেওয়ার উদ্দেশ্যে বলেঃ” আসছি, তুষার ভাই।মিসেস ডাকছে।আপনার সাথে পরে কথা হবে।”
—” আচ্ছা।একদিন আসবেন আমাদের বাড়ি।”
—” ঠিকাছে।”

মুখে সম্মতি জানালেও মনে মনে হাসে আবরার।তুষার বোধহয় জানে না, সে মহুয়ার প্রাক্তন ছিল।জানলেও কি একই কথা বলবে?কে জানে!
আবরার ঘরে যেয়ে দেখলো, অনন্যা দাঁড়িয়ে আছে।একদম তৈরি হয়ে আছে।হয়তো কোথাও যাবে।মেয়েটা পারেও বটে।অফিস থেকে ফিরেছে আধ-ঘণ্টাও হয়নি।অথচ,এর মাঝেই একেবারে হাত-মুখ ধুয়ে আবার বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।অনন্যা বেশ আধুনিক মেয়ে।সংসার,চাকরি সামলানোর পরে এখন আবার একটা মানবাধিকার সংগঠনের সদস্য হয়েছে।তাই সারাদিনে সে বেশ ব্যস্ত থাকে।আবরারের সাথে অফিস থেকে ফিরার পর, ঘরের কাজ-কর্ম শেষ করে কখনো বাড়ি থাকে আবার কখনো থাকে না।বেশিরভাগ সময়ই রাতের আগে অনন্যার চেহারা দেখার ভাগ্যও হয় না আবরারের।এসবকিছুই আবরার মেনে নিয়েছে।আজকাল বেশ শান্ত হয়ে গেছে সে।আগের সেই হঠাৎ হঠাৎ রেগে যাওয়ার বাতিক নেই।অবশ্য, অনন্যার সাথে কখনো রাগ দেখাতেও পারেনি আবরার।ইচ্ছে করেই দেখাতো না।অনন্যা তার বড় সাধের মানুষ।তার অর্ধাঙ্গিনী, প্রেয়সী।এরকম মানুষের সাথে রাগ দেখানো যায়?

—” ইশতি, খাবার রান্না করা আছে।একটু কষ্ট করে খাওয়ার আগে গরম করে নিও।”
—” আজকে না গেলে হয় না অনু?”
—” আরে না। আজ একটা সম্মেলন আছে।”
—” আচ্ছা,সন্ধ্যাবেলায় কিসের সম্মেলন থাকে প্রতিদিন?এইরকম সংগঠন জীবনেও দেখিনি আমি।”
ফুঁসে উঠে অনন্যা।এটা তার ভালোবাসার জায়গা।কটকটে গলায় উত্তর দেয়ঃ” যেটা বুঝো না, সেটা নিয়ে কথা বলবে না।চাকরিজীবী মহিলাদের জন্য এই ব্যবস্থা।তাছাড়া, আমি না থাকলে তোমার কি সমস্যা?আমি তো আর বাসা-বাড়ি কাঁধে তুলে নিয়ে যাচ্ছি না।”
—” সেটাই।তুমি না থাকলে আমার কি সমস্যা!আচ্ছা একটা কথা বলো,যদিই বিয়ের পর আমাকে সময়ই না দিতে পারো তবে বিয়ে করেছ কেন?তোমাকে মাঝে মাঝে আমি মিলাতে পারি না।তুমি আর আগের মতো নেই অনু।আগে তুমি আমার সঙ্গ পছন্দ করতে,সারাদিন কথা বলার পরেও কথা ফুরাত না,একদিন দেখা না করলে পাগল হয়ে যেতে–এরকম আরো কত পাগলামি করেছ।এসব কি একবারের জন্যও মনে পড়ে না?তুমি বদলে গেছ, অনু।”
শেষদিকে খুব অসহায় শোনায় আবরারের কন্ঠ।খানিকটা ক্ষোভও ফুটে উঠে গলায়।হয়তো অনন্যারও খারাপ লাগে।সে হাতের ব্যাগটা টেবিলের উপর রাখে।একপা-দুপা করে আবরারের দিকে এগিয়ে এসে তার চুল নেড়ে দেয়।বেশ আদুরে গলায় বলেঃ” তোমার অনু বদলায়নি,কখনো বদলাবেও না।সে শুধু একটু ব্যস্ত হয়ে গেছে।রাগ করো না, ইশতি।আজ খুব জলদি চলে আসব।প্রমিস।তুমিও আমার সাথে চলো।তোমার বেশ ভালো লাগবে।”
—” আমার ভালো লাগার দরকার নেই।তোমার ভালো লাগলেই চলবে।যাও,যেখানে যাচ্ছিলে।”

আবরার মুখ ফিরিয়ে নেয়।ভালো লাগে না তার এসব।নিজেকে এখন ব্যর্থ মনে হয়।বুঝতে পারে জীবনটা দীর্ঘশ্বাসে ভরে গেছে।জেনে-বুঝে দুটো নারীর মন ভেঙেছে।তাদের চোখের জল ঝরিয়েছে।এদের মূল্য তো চুকাতেই হবে।সৃষ্টিকর্তা কখনো ছেড়ে দেন না।

***

মহুয়া ঘর গোছাচ্ছিল।কালকে আসার পর আর গোছানো হয়নি।ফলস্বরূপ এখানে কাপড়, ওখানে কাপড়।সারাঘরে পোশাকের ছড়াছড়ি।গোছাতে গোছাতেই হাত আটকে যায় বিয়ের শাড়ির উপর।বিয়ের জন্য একটা সিঁদূর লাল রঙের শাড়ি কিনেছে তুষার।খুব ভারী শাড়ি না।সাধারনের মধ্যে অসাধারন।মহুয়ার একটুও কষ্ট হয়নি কাল।সাজগোজের বাহুল্যও ছিল না খুব।তুষারের পছন্দ আছে বলতে হবে।মহুয়ার শাড়ির সাথে মিল রেখে খুঁজে খুঁজে একই রঙের একটা জামা কিনেছে মৃত্তিকার জন্য।জামাটায় দারুন মানিয়েছে মৃত্তিকাকে।একদম একটা পুতুল।মাঝে মাঝেই মৃত্তিকাকে কামড়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে মহুয়ার।একটা বাচ্চা এতো ফুটফুটে কেন হবে?

—“এই মহুয়া, দেখেছিলে গয়নাগুলো?ভালো লেগেছে?”
তুষার মহুয়ার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।মৃত্তিকা খাটে বসা।তুষারকে দেখেই খুব বিরক্ত লাগলো মহুয়ার।জ্ঞানহীন লোক।যার না তার সাথেই নিজের বউয়ের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।ফাজিল কোথাকার।
মহুয়া নিজের বিরক্তি গিলে নিল।হাজার হলেও সে নতুন বউ।অযথা ঝামেলা করার কি দরকার?তাই হাতের কাপড়গুলো আলমারিতে রাখতে রাখতে বললঃ” হুম,ভালোই।”
—“পরেছো?”
—” না।”
—” কেন?”
—” ইচ্ছে করছে না।”

মহুয়ার কন্ঠস্বর তুষারের কানে খট করে বাজে।নিষ্প্রাণ কন্ঠ।মেয়েটার কি মন খারাপ?তুষার মহুয়ার পাশে যেয়ে দাঁড়ায়।তার হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে বিছানায় ছুঁড়ে দেয়।মহুয়ার কাঁধ ধরে নিজের দিকে ফিরায়।

—” মন খারাপ?বাড়ির জন্য খারাপ লাগছে।”
—” খানিকটা।”
—” মন খারাপ করো না।কালকে বৌভাতের পরেই তো যাব।আর কয়েকটা ঘন্টা মাত্র।”
—” আচ্ছা, আর মন খারাপ করব না।এখন ছাড়ুন।হয়েছে কি আপনার বলুন তো?যখন তখন কাঁধ জড়িয়ে ধরছেন।সরুন এখান থেকে।আমার অস্বস্তি হচ্ছে।”

তুষার হাত সরিয়ে নিলেও মহুয়ার পাশ থেকে সরে যায় না।বরং মহুয়ার গা ঘেসে আলমারির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়।মুখে হাসি টেনে বলেঃ”আজকে খুব প্রেম প্রেম পাচ্ছে,বুঝলে।বিয়ের পানি পেটে পরেছে।তাই কেমন যেন মাতাল মাতাল লাগছে নিজেকে।আমার কি দোষ বলো?”
—“আপনি চূড়ান্ত পর্যায়ের খারাপ।কথা-বার্তার কি ছিড়ি!আপনি আজকে ভয়াবহ একটা অন্যায় করেছেন।এর জন্য আপনাকে চরম শাস্তি দেওয়া উচিৎ। ”
তুষার সোজা হয়ে দাঁড়ায়।ভ্রু কুঁচকে বলেঃ”কি করলাম আমি?”
—” আপনি আমাকে যার-তার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন কেন?বউ বলেই কি সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে?”
—” সবার সাথে কোথায় পরিচয় করালাম?শুধু ইশতিয়াক ভাইয়ের সাথেই তো।আরে উনি একদম নাকের ডগার প্রতিবেশী। ব্যবহারও ভালো।এদের সাথে ভাব না জমালে…..
মহুয়া তেড়ে আসে তুষারের দিকে।দু-পা এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চেপে বলেঃ” খবরদার,মিত্তির বাবা।আর একবার যদি আপনার সাধের ইশতিয়াক ভাইয়ের নামে গুণগান করেছেন,খবর আছে আপনার।কসম, আমি আপনার গলায় ছুরি ধরব।”
মহুয়ার এরকম আগ্রাসী রূপ দেখে থমকে যায় তুষার।একদম কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকায় মহুয়ার চোখের হিংস্রতা নজর এড়ায় না।তার খটকা লাগে।কি ব্যাপার? ইশতিয়াক ভাইকে নিয়ে এতো সমস্যা কেন মহুয়ার?তারা কি পূর্ব পরিচিত?
তুষার মহুয়ার হাত টেনে খাটে বসায়।গ্লাসে পানি ঢেলে তা বাড়িয়ে দেয় মহুয়ার দিকে।
—” নেও পানি খাও।খেয়ে পুরো কথা খুলে বলো।ইশতিয়াক ভাই তোমার পরিচিত?”

মহুয়া এক নিঃশ্বাসে পানি খেয়ে নেয়।গলাটা শুকিয়ে গেছে একদম।মৃত্তিকাও ততোক্ষণে মহুয়ার কাছে এসে পড়েছে।মহুয়ার কাঁধে ভর দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়।মহুয়ার খোপা একটা কাঠি দিয়ে আটকানো।বেশ বাহারি জিনিস এটা।মাথায় আঁচল না থাকায়,সহজেই তা চোখে পড়ে মৃত্তিকার।মুহূর্তেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মায়ের খোপা নিয়ে।খেলতে খেলতে মুখ দিয়ে নানা ধরনের অর্থহীন শব্দ করে।এগুলো যে তার কথা বলার প্রচেষ্টা, তা বুঝতে বাকি থাকে না।
পানি খেয়ে মহুয়া লম্বা দম নেয়।এ যেন রাগ গিলে নেওয়ার কৌশল।মহুয়ার হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে নেয় তুষার।মহুয়ার পাশে বসে আশ্বস্তের ভঙ্গিতে বলেঃ” এবার বলো ঘটনা কি।ইশতিয়াক ভাইয়ের সাথে তোমার কি সম্পর্ক? ”
—” ইশতিয়াক আবরার!নামটা পরিচিত মনে হচ্ছে না আপনার?—খুব উত্তেজিত শোনায় মহুয়ার কন্ঠ।
“ইশতিয়াক আবরার” নামটাকে নিজের মনেই দুবার আওড়ে নেয় তুষার।দুবারের বেলায় জ্বিভ থমকে যায়।আবরার! তুষারের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।মহুয়ার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেঃ”তোমার প্রাক্তনের নাম আবরার না?এই কি সে?”
মহুয়া মাথা নাড়ায়।ইশারায় বুঝিয়ে দেয় এটাই সেই মানুষ।
অবাকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তুষার।এরকম একটা ঘটনাকে আসলে কি বলা যায়?কাকতালীয়?
—” আবরারকে দেখার খুব ইচ্ছে ছিল আমার।ইচ্ছেটা এত তাড়াতাড়ি পূরণ হবে তা কল্পনাও করিনি।”
—” এটাই সেই শয়তান আবরার।ব্যবহার দেখেছেন হারামজাদার?একে দেখে কেউ বলবে,এ একটা প্রতারক?”
মাথা নাড়ায় তুষার।চলনে-বলনে বেশ বিনয়ী আবরার।হঠাৎ করেই একটা কথা মাথায় আসে তুষারের।সে সোজা হয়ে বসে।মহুয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবুকের মতো বলেঃ”এখানে আসার পর আবরারের সাথে তোমার প্রথম কখন দেখা হয়েছিল?”
—” আজ সকালে।ঘুম থেকে উঠেই যখন আমি বারান্দায় গিয়েছিলাম তখন।”
—” ও আচ্ছা,এই জন্যই।”
তুষারের কথা বুঝতে পারে না মহুয়া।ভ্রু কুঁচকে বলেঃ” কি বলছেন?”
—“একটু আগে আমি যখন বারান্দায় গেলাম,তখন সেই আগে আমার সাথে কথা বলা শুরু করলো।এই ফ্ল্যাটে যে আমি থাকি তা হয়তো জানত না।আমাকে দেখে স্ত্রী-সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করলো।তখন তুমিও বারান্দায় গেলে।তাই তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিলাম।আবার তুমি চলে আসার পর কি বলল,জানো?”
—” কি বলল?”
—” বলে মিত্তির সাথে তোমার চেহারার মিল নেই।আমি তো তখন বুঝিনি। তাই তার ইঙ্গিত ধরতে পারিনি।তোমার বিয়ে হয়েছে কবে এটাই জানতে চেয়েছে বোধহয়।আমাকে তো আর সরাসরি প্রশ্ন করতে পারবে না।তাই আকার-ইঙ্গিতে জানতে চেয়েছে।”
—” দেখেছেন কত্ত বড় শয়তান!আমার কবে বিয়ে হয়েছে সেটা ওই বেয়াদব জেনে কি করবে?আবার, আমার আর মিত্তির মাঝে মিল খুঁজে!কেন? আমাদের সাথে ওর কি সম্পর্ক? নির্লজ্জ কুকুর একটা।”

মহুয়ার কন্ঠের উত্তেজনা খুব সহজেই চোখে পড়ে তুষারের।আবরারের করা পাপ নিয়ে এখনো এতো উত্তেজিত মহুয়া!এতোদিনেও ভুলে যেতে পারেনি?কথাটা ভেবেও আবার বাদ দিয়ে দেয় তুষার।নিজেকেই নিজে বুঝ দেয়,কেন ভুলবে?ভুলে যাওয়া কি এতোই সহজ?আবরার মহুয়ার জীবনে প্রথম প্রেম ছিল –সেটা তো মহুয়ার কথা থেকেই স্পষ্ট বুঝা যায়।বিয়ের আগেই তো এসব বলেছে মহুয়া।এখন বিয়ের পর আবারো আবরারের চোখের সামনে এসে পড়লো ওরা।এ যেন পুরোনো ক্ষতের রক্তক্ষরণ। খুব দরকার ছিল এসব?সৃষ্টিকর্তা আবার কি পরিকল্পনা করেছেন,কে জানে!আরেকবার বিরূপ ভাগ্যের শিকার হতে চায় না তুষার।বউ-বাচ্চা নিয়ে একটু শান্তিতে থাকতে চায়।যেরকম শান্তি সবাই চায়।কিন্তু তা কতটুকু সম্ভব আল্লাহ মালুম।চোখের সামনে প্রাক্তনের সাজানো সংসার দেখে মহুয়াই কি পারবে আবার সুন্দর করে সব শুরু করতে?দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে তুষারের।ব্যতিক্রম ভাগ্য বইতে বইতে ক্লান্ত সে।আর ভালো লাগে না এসব।

—” এই মিত্তির বাবা,কি ভাবছেন?”
মহুয়ার দিকে সচেতন হয়ে তাকায় তুষার।ভালোই লাগে মেয়েটাকে এখন।নিজের ভাবনাগুলো একপাশে ঠেলে দিয়ে,মুচকি হাসে।
—” ভাবছি তোমার কথা।তোমার মতো মহীয়সী নারী বাংলার ঘরে ঘরে দরকার।কি করে পারলে এটা করতে?”
—” কি করলাম আমি!”
—“তখন নিজের প্রথম প্রেমকে কি সুন্দর ভাইয়া ডাকলে।কয়টা মেয়ে পারে বলো তো?তোমার ভিতর দম আছে বলতে হবে।আমার খুব ভালো লাগছে, বুঝলে।যতবারই আবরারকে ভাইয়া ডাকার কথা মনে পড়ছে,ততোবারই খুব শান্তি শান্তি লাগছে।আমার কাছে নোবেল থাকলে, তোমাকে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার দিতাম।”
মহুয়ার পাশেই লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে তুষার।দু-হাত ভাঁজ করে তার উপর মাথা দেয়।উদাস গলায় বলেঃ”দুশ্চিন্তা না থাকলে পৃথিবীটা আরো সুন্দর হতো, তাই না মহুয়া?”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here