যাত্রাশেষে (পর্ব-১০+১১)

#যাত্রাশেষে (পর্ব-১০+১১)
#হালিমা রহমান

মৃত্তিকা খাট ধরে দাঁড়িয়ে আছে।সে এখনো পুরোপুরি হাঁটতে পারে না।কোনো কিছু ধরে দাঁড়ায় ঠিকই, কিন্তু তা বেশিক্ষণের জন্য না।একটু দাঁড়ায়,কিছুক্ষণ পর আবার ধপ করে পরে যায়।মৃত্তিকাকে দাঁড় করিয়ে রেখে তুষার হাত-মুখ ধুতে গেছে।মেয়েটাকে রেখে কোথাও যেয়ে একটু শান্তি পায় না তুষার।সবসময় চিন্তায় থাকে।মৃত্তিকা বেশ দুষ্ট।স্থিরভাবে বসে থাকতেই পারে না।খালামনি ওকে সামলাতে পারল কি না,ঠিকমতো খাচ্ছে কি না,দাঁড়াতে যেয়ে পরে যাচ্ছে কি না–এসব চিন্তা করতে করতে একেবারে পাগল হয়ে যায় সে।বেশ কিছুক্ষণ মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিলো তুষার।রোদ তার সহ্য হয় না।অনেক্ষন রোদে থাকলেই চেহারা লাল হয়ে জ্বলতে থাকে।আজ সারাদিন মহুয়ার সাথে পার্কে বসা ছিল।কথায় কথায় যন্ত্রণা টের না পেলেও এখন বুঝতে পারছে।তুষার আরো কয়েকবার মুখে পানি দিয়ে বেড়িয়ে এলো।কিন্তু ঘরে এসেই তার চক্ষু চড়কগাছ।কোথায় মৃত্তিকা!যেখানে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল সেখানে পানিতে ভরে আছে।অবশ্য এগুলো যে পানি না তা বেশ বুঝতে পারছে তুষার।নিশ্চয়ই মৃত্তিকা প্রস্রাব করে, সরে গেছে।মেয়েটা ভেজা জায়গায় থাকতেই পারে না।তুষার একটা কাপড় দিয়ে জায়গাটা মুছে ফেললো।তারপর রান্নাঘরের দিকে গেল।সে নিশ্চিত মেয়ে এখন সেখানেই আছে।
তুষারের ভাবনাই ঠিক।মৃত্তিকা ঠিকই রান্নাঘরের ফ্লোরে বসে আছে।শুধু বসে নেই।রান্নাঘরে রাখা আলুর ঝুড়ি উল্টে ফেলে দিয়েছে।ফলস্বরূপ, সব আলু নিচে গড়াগড়ি খাচ্ছে।মৃত্তিকার হাতে একটা আলু।সে সবে একবার সেটাতে দাঁত বসিয়েছে।এখনই থেমে যাবে না।আলুর পুরো গায়ে দাঁত বসাবে মৃত্তিকা।তুষারের নজরে এসব আসতেই, সে তাড়াতাড়ি মেয়ের কাছে বসে পড়লো।মৃত্তিকার হাত থেকে আলু কেড়ে নিয়ে চোখ পাকিয়ে ধমক দিলো।

—” এই মেয়ে,এই এতো দুষ্ট কেন তুই?এটার গায়ে ময়লা নেই?তোর পেটে যাবে না।পেট খারাপ হলে কষ্ট কার হবে? আমার?ফাজিল মেয়ে।সবসময় দুষ্টামি।”

তুষার রান্নাঘর থেকে মেয়েকে বের করে দিলো।একটা একটা করে আলু তুলে রাখলো।শরীরটা ভেঙে আসছে তার।সারা বিকাল মহুয়ার সাথে কথা বলার পর সন্ধ্যার দিকে আবার দোকানে গিয়েছিল।সেখানে ঘন্টাখানেক কাজ-কর্ম দেখার পর আবার রুবিনা বেগমের বাসায় যেতে হয়েছে।সেখানে আধঘন্টা থাকার পর মৃত্তিকাকে নিয়ে বাড়ি আসতে হয়েছে।দু-দন্ড জিরিয়ে নেওয়ার ফুরসত মেলে নি।রান্নাঘর গুছিয়ে বেরিয়ে এলো তুষার।আজকে আর রান্নাবান্নার ঝামেলা নেই।রুবিনা বেগম খাবার দিয়ে দিয়েছেন।একটু পর মৃত্তিকাকে খাবার গরম করে খাইয়ে দিলেই হবে।তুষার এখন একটু বসতে চায়।রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আবারো এদিক-ওদিক তাকালো তুষার। মেয়েটা আবার কোথায় গেল?এদিক-ওদিক চোখ বুলাতেই মৃত্তিকাকে নজরে এলো।ফ্রিজের পাশে বসে কি যেন করছে সে।তুষার কপাল কুঁচকে সেদিকে গেল।এই মেয়েতো এরকম চুপচাপ বসে থাকার মেয়ে না।আবার কি করছে সে?মৃত্তিকা ফ্রিজের পাশে থাকা তারের দিকে তাকিয়ে আছে।তার চাহনী দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় সে এটা ধরতে চাইছে।হাত বাড়িয়ে যেই না ধরতে যাবে ওমনি মেয়ের হাত ধরে ফেললো তুষার।মেয়েকে কোলে নিয়েই আলতো হাতে চড় দিলো পিঠে।মুখে বললঃ”এতো ফাজিল কেন, মিত্তি তুই?এটায় কারেন্ট আছে না?কারেন্টের কাছে কি এতো?যদি শক করতো কেমন লাগতো তখন?”

বাবার কথা মৃত্তিকা কি বুঝলো কে জানে!তূষারের মতো সেও কিছুক্ষণ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।কিছুক্ষণ মাত্র।তারপর বাবার গালের উপর ঝাপিয়ে পরে কুট করে কামড় বসিয়ে দিলো।একটা মিষ্টি যন্ত্রণা। এই কাজটা মৃত্তিকা খুব ভালো পারে।তুষারের কোনো কথা বা কাজ অপছন্দ হলেই তুষারকে কামড়ে দেয়।তুষার মেয়েকে নিয়ে বিছানার কাছে এসে বিছানায় বসিয়ে দিলো।তারপর নিজেও মেয়ের মুখোমুখি বসলো।মেয়েকে কোলের কাছে টেনে এনে আহ্লাদী সুরে বললঃ”আমার মা কবে বড় হবে?মা এতো দুষ্টামি কেন করে? মা কি পচা?”

মৃত্তিকা হয়তো তুষারের আদর বুঝতে পেরেছে।সে বাবার দিকে আরো এগিয়ে যায়।বাবার কথার বিপরীতে ঠোঁট বাকা করে হাসে।মৃত্তিকা হাসলে দুই গালে টোল পরে।মহিমা হাসলেও গালে গর্ত হয়ে যেত।মায়ের এই বৈশিষ্ট্য প্রাকৃতিকভাবেই পেয়েছে মৃত্তিকা।তুষার মেয়ের দিকে একমনে চেয়ে থাকে।মহিমার এই সৌন্দর্যে বারবার মুগ্ধ হতো তুষার।মনে হতো যেন পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য আল্লাহ মহিমার হাসিতেই ঢেলে দিয়েছেন।মেয়েটাও একই রকম হয়েছে।হাসিটা তো পুরোই মায়ের।মৃত্তিকার চোখ দুটো শুধু তুষারের মতো।বাকি সবই মহিমার।

—” বা বা,বা বা,বা,বা।”

মেয়ের ডাকে সচেতন হয় তুষার।মৃত্তিকা তাকে এভাবেই ডাকে।তুষার মেয়েকে একদম কাছে টেনে আনে।হাসিমুখে প্রশ্ন করেঃ”কি হয়েছে আমার বাবার?তার কি কিছু লাগবে?আরো খেলনা লাগবে?”
মৃত্তিকা তুষারের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আবারো বলেঃ”বা বা,বা বা।”
তুষার দীর্ঘশ্বাস ফেলে।মেয়েকে পুরোপুরি দাঁড় করিয়ে দিয়ে বলেঃ” কবে বড় হবি মা তুই?একটু তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যা তো।আমি দেখে চোখ জুড়াই।”

***

মহুয়া খাবার টেবিলে বসে আছে।খাচ্ছে না,খাওয়ার ভান করছে।খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে মহুয়া খুবই অলস।একই সাথে খুতখুতেও খুব।এটা খেতে পারে না, ওটা খেতে পারে না।যেদিন সাবিনা বেগম শুধু সবজি রান্না করেন,সেদিন আর মহুয়া খেতে পারে না।শুধু সবজি দিয়ে আবার খাওয়া যায় নাকি?আবার স্কুল থেকে এসে যদি কিছু হালকা খাবার খায়, তখন আর দুপুরে ভাত খায় না।এই মেয়েকে নিয়ে সাবিনা বেগমের যন্ত্রণার শেষ নেই।তিনি মাঝেই মাঝেই ভাবেন,যদি তিনি বেঁচে না থাকতেন তবে হয়তো মহুয়া অনাহারেই মরে যেত।খাবারের সাথে আবার এতো ঢং কীসের?যা পাবি তাই খাবি।সব খাবারই আল্লাহর নেয়ামত।তাহলে আবার এটা খাব না,ওটা খাব না–এসব কথা বলার কী মানে?প্রায় বেলাই খেতে বসে মহুয়া মায়ের বকুনি অথবা চড় খায়।তবুও শুধরায় না।এই মেয়ের শরীরে কি লজ্জা-শরম কিছু নেই নাকি?এতো বড় হওয়ার পরেও মায়ের হাতে মার খায়,তবুও কোনো হেলদোল নেই।আশ্চর্য একটা মেয়ে!
সাবিনা বেগম খাবার খাওয়ার ফাঁকে মেয়েকে একমনে দেখছিলেন।মেয়ের খাবার খাওয়ার ধরন দেখে তিনি গর্জে উঠলেন।

—” মহুয়া,একটু ভাত যদি নষ্ট করেছিস তবে খবর আছে তোর।প্রতি বেলায় বেলায় ঢং করতে লজ্জা করে না তোর?রান্না করতে কষ্ট হয়।আমি কষ্ট করে রান্না করব আর তুমি ফেলে দিবে, তা কখনোই হবে না।চাল-ডাল কিনতে টাকা লাগে।তোমার বাবা কষ্ট করে এগুলো কিনে ফেলে দেওয়ার জন্য না।বুঝেছিস?”

মহুয়া অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।মা যে এখন প্রচন্ড রেগে আছে, তা তার কথা শুনেই বুঝা যাচ্ছে।সাবিনা বেগম যখন খুব রেগে থাকেন তখন তুই-তুমি একসাথে মিলিয়ে কথা বলেন।মহুয়া একটু পানি খেয়ে আবারো ভাত মুখে দিলো।একেবারেই খেতে ইচ্ছা করছে না।প্রতিদিন তিনবেলাই কি খাওয়া লাগে?দু-একবেলা না খেলে কি হয়?মানুষ মরে যায়?এরকম হলে তো দুর্ভিক্ষের দেশের সব কবেই মানুষ মরে যেত।মা যে কেন এতো অত্যাচার করে!

মহুয়া খাবার শেষ করে সবে ঘরে এসে বসেছে।কেন যেন ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না আজ।মাঝে মাঝেই এরকম হয় মহুয়ার।তখন সে সিনেমা দেখে রাত কাটিয়ে দেয়।অথবা কখনো কখনো তার প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্রের বই পড়ে।আজ এগুলো কিছুই করতে ইচ্ছে করছে না।মহুয়া মাথায় ওড়না দিয়ে বারান্দায় গেল।তার বারান্দাটা ছোট।তাদের পুরো ফ্ল্যাটে শুধু মহুয়ার ঘরেই বারান্দা আছে।তাই সাবিনা বেগম এখানে কাপড় শুকাতে দেন।এটা খুবই অপছন্দ মহুয়ার।মায়ের জন্য মহুয়া বারান্দাটা মনমতো সাজাতে পারে না।এমাথা-ওমাথা দড়ি টাঙানো থাকে। ঘরের হাজারটা কাপড় মেলে দেওয়া থাকে বারান্দায়।সূর্যের আলো আসে নাকি ঘরে?আলোর অভাবে মহুয়া কয়েকটা গাছও লাগাতে পারে না।মহুয়া বারান্দায় যেয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো।আকাশে আজ চাঁদ উঠেছে।ভরাট চাঁদ না।বাকানো একটুখানি চাঁদ।মহুয়ার পূর্ণিমা খুব পছন্দ।জ্যোৎস্না রাতে থালার মতো চাঁদটাকে কি সুন্দরই না দেখা যায়!মহুয়ার শৈশব কেটেছে মফস্বল একটা শহরে।আফজাল সাহেব দেশে ছিলেন না বলে, সাবিনা বেগম বেশিরভাগ সময় বাবার বাড়িতেই ছিলেন।মহুয়ার নানাবাড়ি বিশাল।আশেপাশে দৈত্যের মতো কোনো দালান নেই।তাই উঠোনে দাঁড়িয়ে সহজেই আকাশ দেখা যায়।ছোটবেলা থেকেই চাঁদ দেখার খুব শখ মহুয়ার।নানাবাড়ির বিশাল উঠোনে দাঁড়িয়ে আগে সবসময় সে চাঁদ দেখতো।এখন আর এসব হয় না।কবে পূর্ণিমা হয়, কবে অমাবস্যা হয়,কবে চাঁদ বাকা হয়ে যায়–এসব খবর এখন আর রাখা হয় না।মহুয়া এখন খুব ব্যস্ত।নিজের খবর রাখারই সময় হয় না আবার দূর আকাশের চাঁদের খবর! মহুয়া নিস্তব্ধ রাতে ছোট্ট বারান্দায় দাঁড়িয়ে, প্রাণভরে শ্বাস নেয়।শৈশব যদি সবসময় থাকতো!

—“মহুয়া, কোথায় তুই?”

আফজাল সাহেবের কন্ঠ শুনে মহুয়ার মুখে হাসি ফুটে।বাবার সঙ্গ তার খুব প্রিয়।সময়টা এখন বেশ ভালো যাবে।মহুয়া বারান্দা থেকে ঘরে এসে দাঁড়ায়।

—” এই তো, বাবা।ঘুম আসেনি তোমার?”
—“নারে মা।ইদানিং খুব কম ঘুম হয়।তুই এতো রাতে ওখানে কি করছিলি?”
—” ঘুম আসছিল না, তাই দাঁড়িয়ে ছিলাম।বসো তুমি।”

আফজাল সাহেব মেয়ের খাটের এককোনে পা তুলে বসেন।মহুয়া এসে তার বাবার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।আফজাল সাহেবের হাত টেনে নিজের মাথার চুলের উপর রাখে।আফজাল সাহেব মৃদু হাসেন।মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলেনঃ” এটা কি আমার চাকরি?”
—” হুম।চুলগুলো একটু টেনে দেও না, বাবা।তুমি চুল টেনে দিলে অনেক আরাম লাগে।”
—” তুই আমার মেয়ে।কোথায় তুই আমার সেবা করবি তা না।বুড়ো বয়সে আমাকে মেয়ের সেবা করতে হয়।হাহ! কপাল।”
—” তোমার জন্য দোয়া করব, বাবা”

আফজাল সাহেব কোমল হাতে মেয়ের চুল টেনে দেন।আরামে মহুয়ার চোখ বন্ধ হয়ে আসে।

—” হ্যাঁ রে মহুয়া,তুষারের সাথে কি এতো কথা বললি আজ।সেই দুপুরে গেলি,সন্ধ্যায় আসলি।”

মহুয়া চোখ বন্ধ করেই বলেঃ”তিনি আমার বিয়ের আগের ঘটনাগুলো জানতে চেয়েছেন।তাই বলেছি।”
—” শুনে কি বলল?”
—” কিছুই না।তাছাড়া,একটা ছোট-খাটো বোঝাপড়া হয়েছে আমাদের।এই।”
—” ওহ।”

আফজাল সাহেব মেয়ের চুলে হাত বুলাতে বুলাতে আবারো বললেনঃ” বিয়ের পরে কি তুই চাকরি করবি না?”
মহুয়া এক মুহূর্ত ভেবে বললঃ” না,বাবা।”
—” কেন?”
—” স্কুলের চাকরিটা ছেড় দেব, বাবা।তুমি তো জানোই আমার কম্পিউটারে ঝোক বেশি।ইচ্ছে আছে,বিয়ের পর আউটসোর্সিং এর চেষ্টা করব।আমার অনেক দিনের শখ এইটা।”

আফজাল সাহেব একমুহূর্ত ভাবলেন।তারপর বললেনঃ” আমার না বিলকিস বেগমকে বেগমকে দাওয়াত করতে মন চায়।”
চমকে উঠে বসে মহুয়া।অবাক গলায় বলেঃ” কেন?”
—” ওনার জন্য আমার খুব কষ্ট হয় বুঝলি।ওনাকে দেখলেই বুঝা যায়, ছেলের আচরণে খুব লজ্জিত তিনি।জানিস পৃথিবীতে সবচেয়ে হতভাগা কারা?যাদেরকে কুলাঙ্গার সন্তানের জন্য পদে পদে অপমানিত হতে হয়।”

মহুয়ারও মাঝে মাঝে ওই মানুষটার জন্য কষ্ট হয়।তিনি অনেক স্নেহ করতেন মহুয়াকে।মহুয়া মন খারাপ করে বললঃ” দরকার নেই, বাবা।ওই বাড়ির কারো সাথে যেন আর কখনো আমার দেখা না হয়।”
—” কেন?”
—” এমনিতেই। আমার ভালো লাগে না।”
—” কিন্তু আমি চাই,ওদের সাথে তোর আবার দেখা হোক।তুই সুখী হ।তোর সুখ দেখে আবরার হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরে যায়।”

মহুয়া হাসে।বাবা কি পাগল! আবরারের হিংসা কেন হবে?মহুয়ার প্রতি তো তার কোনো আকাঙ্খা ছিল না।সে মৃদু হেসে বলেঃ”আবরারের কেন হিংসা হবে বাবা?সে অনন্যার সাথে সুখে আছে।”
—” শোন মা,কর্মফল বলেও একটা কথা আছে। কর্মফল কখনো পিছু ছাড়ে না।”
মহুয়া প্রসঙ্গ বদলে ফেলতে চাইলো।তাই শান্ত গলায় বললঃ” জানো বাবা আজ আমি তুষার সাহেবকে বলেছি,তাকে আমার স্বার্থপর লাগে।”
—“তারপর? ”
—” তারপর অবশ্য আমার নিজেরই খারাপ লেগেছে।সেও তো আমার মতো একই পরিস্থিতির শিকার।”
—” কিন্তু,তোর মনের কথা বলে ভালো করেছিস।কারো সম্পর্কে কিছু ভাবলে, তা মনে মনে রাখবি না।তাকে বলে দিবি।”
মহুয়া ভ্রু কুঁচকে বললঃ” তাহলে মাকে যেয়ে বলি,মা আমার উপর খুবই অত্যাচার করে।তাই মায়ের উপর আমি খুবই বিরক্ত।আমি তাকে বয়কট করতে চাই।”
মেয়ের কথার বিপরীতে কুটিল হাসেন আফজাল সাহেব।মাথা নেড়ে বলেনঃ”ঠিক আছে।তোর মনের কথা যেয়ে তোর মাকে বল।কিন্তু এরপর যদি তোর মায়ের জুতো তোর শরীরের দিকে উড়ে আসে,তবে তার দায়ভার কিন্তু আমি নেব না।”
আফজাল সাহেবের কথায় মহুয়া খিলখিলিয়ে হাসে।গল্প-কথায় অলস সময় কোথা দিয়ে কেটে যায় তার খবর কেউ রাখে না।

#(পর্ব-১১)

আজ বিকালটা খুব সুন্দর।আকাশে কালো মেঘ নেই,সূর্যের প্রখর তাপ নেই।ঝিরিঝিরি বাতাস আছে আশেপাশে।সাবিনা বেগম এরকম আবহাওয়া খুব ভালোবাসেন।প্রকৃতির এমন সৌন্দর্য দেখলেই তার আগের দিনের কথা মনে পড়ে যায়।যখন তিনি মা ছিলেন না, কারো ঘরের বউ ছিলেন না,দায়িত্বের বেড়াজালে জীবন বন্দি ছিল না—এমনসব দিনের কথা।কি সুন্দর ছিল তখনকার দিনগুলো!
সাবিনা বেগম রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আছেন।তার দৃষ্টি চুলার উপরে থাকা পাতিলের উপর নিবদ্ধ।চা চাপিয়েছেন চুলায়।গরুর দুধ ঘন করে জ্বাল দিয়ে তাতে চাপাতি ঢেলে দিয়েছেন।এই রকম চা খুব পছন্দ মহুয়ার।গরুর দুধের এক কাপ চা হাতে পেলে সে বেশ আয়েশ করে তাতে চুমুক দেয়।স্বাদে তার দু-চোখ বন্ধ হয়ে আসে।এই দৃশ্যটি খুব পছন্দ সাবিনা বেগমের।মনে হয় যেন, তিনি বিশ্ব রাঁধুনী ও মহুয়া বিচারক।রান্নায় মুগ্ধ হয়ে প্রশংসায় ভেঙে পড়ছেন মহামান্য বিচারক।ইদানিং, সাবিনা বেগম অল্পতেই অস্থির হয়ে যান।ভিতরটা শুকিয়ে যায় হুটহাট।যখন-তখন চোখ ভিজে আসে।এই অদ্ভুত রোগের কারণ খুব ভালো করেই জানেন তিনি।মহুয়ার বিয়ের তারিখ এগিয়ে এসেছে।আর মাত্র পনেরো দিন বাকি।কলিজার টুকরাটা আবারো চলে যাবে।সাবিনা বেগম কখনো ভাবেননি তার মেয়ের সাথেই বিশ্রি একটা ঘটনা ঘটবে।মাত্র সাতাশ বছর বয়সেই দু-বার বউ সাজতে হবে মহুয়াকে।তিনি মা।তিনি তো জানেন, মেয়েটা কি থেকে কি হয়ে গিয়েছিল।তার দু-চোখ ভরা কতটা স্বপ্ন ছিল।সাবিনা বেগম বরাবরই মহুয়ার প্রতি দুর্বল।একটা মাত্র মেয়ে তার।কিন্তু,এই দুর্বলতা কখনো দেখাননি তিনি।আফজাল সাহেব বিদেশে ছিলেন বলে একা হাতেই সামলাতে হয়েছে সব।একহাতে সংসার, অন্যহাতে মেয়ে।ইচ্ছে করেই কখনো মহুয়ার সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করেননি।তার সাথে মহুয়ার সম্পর্ক ছিল অনেকটা উর্ধতন-অধস্তনের মতো।এর পিছনে অবশ্য একটা কারণও আছে।তিনি সবসময় ভয়ে থাকতেন মেয়েকে নিয়ে।মেয়ের সাথে খোলামেলা আচরণ করলে যদি মেয়ে কথা না শোনে।যদি বখে যায়।তাই তাদের মা-মেয়ের সম্পর্কের গন্ডি শাসনে সীমাবদ্ধ।মেয়েকে যত ভালোবাসেন তার চাইতে বেশি শাসন করেন।

সাবিনা বেগম যখন চায়ের কাপ নিয়ে মহুয়ার ঘরে ঢুকলেন,তখন মহুয়া তৈরি হচ্ছে।হয়তো কোথাও যাবে।সাবিনা বেগম চায়ের কাপ মহুয়ার টেবিলের উপর রেখে বললেনঃ”রেডি হচ্ছিস যে?কোথায় যাবি?”
—” রবীন্দ্র সরোবরে।”
সাবিনা বেগম বেশ অবাক হয়ে যান।এই সময়ে ওখানে কি?তিনি বেশ অবাক হয়েই বলেনঃ” এই সময়ে?”
—“হ্যাঁ, মা।”
—” কি দরকারে যাবি?”
—” তুষার সাহেবের সাথে দেখা করতে।”
সাবিনা বেগম কপাল কুঁচকে ফেলেন।বিয়ের আগে এতো দেখাশোনা কিসের? সেদিন না দেখা করতে গেল!তিনি খাটের কোনে বসতে বসতে বললেনঃ”আজকে আবার কেন?”
মহুয়ার তৈরি হওয়া প্রায় শেষ।কালো রঙের হিজাবে, কাঁধের কাছে একটা পিন আটকে মায়ের পাশে এসে বসলো।হাতে তার ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপ। এক চুমুক চা গিলে নিয়ে বললঃ”আজকে মৃত্তিকার সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবেন তিনি।তাই দেখা করতে বলেছেন।”
—” তোকে বলল আর তুইও চলে যাবি?বিয়ের আগে কি এতো দেখা করা ঠিক?”
—” হয়তো ঠিক না।কিন্তু অনেক আগেই বলেছিলেন, বিয়ের আগে আরেকদিন দেখা করবেন।এখন বলেছে আমি কি না করতে পারি?”
সাবিনা বেগম নাক-মুখ কুঁচকে বললেনঃ”এখনকার ছেলে-মেয়েদের আচরণ কিছুই মাথায় ঢুকে না আমার।বিয়ের আগে আবার এতো দেখা করতে হবে কেন?লাজ-লজ্জা কিছু নেই নাকি?দিন ছিল আমাদের সময়।তোর বাবার সাথে যেদিন বিয়ে ঠিক হয়েছিল, সেদিন থেকে আমি আর বাড়ির বাইরেই পা দিতাম না।খালি লজ্জা করত।যদি কেউ বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করে,কি বলব আমি?এই কথা ভেবে আর ঘর থেকেই বের হতাম না।অথচ, তোরা!আজ নিয়ে তিনদিন দেখা করতে যাচ্ছিস।কি একটা অবস্থা!”

মহুয়া চা শেষ করে মুচকি হাসলো। তার মা বেশ রক্ষণশীল। কাপ রাখতে রাখতে বললঃ” তোমাদের সময় আর এখনকার সময়ে অনেক পার্থক্য, মা।আজকে আর সময় নেই।এসে কথা বলব।এর আগের দুদিন তুষার সাহেব আমার জন্য অনেক্ক্ষণ অপেক্ষা করেছিলেন।আবার একই ঘটনা আজকেও ঘটুক, তা চাচ্ছি না।আসছি, আল্লাহ হাফেজ।”

***

মহুয়া আজকে তুষারের আগেই পৌঁছে গেছে।সরোবরের উত্তর দিকে দাঁড়িয়ে আছে সে।এই জায়গাটা খুব পছন্দ মহুয়ার।মানুষ থাকলেও খুব বেশি বিশৃঙ্খলা নেই।কেউ শরীরচর্চা করছে,কেউ আড্ডা দিচ্ছে,কেউ ঘুরতে এসেছে।কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না।এই জিনিসটাই খুব ভালো লাগে মহুয়ার।মহুয়ার থেকে খানিকটা দূরেই একটা দল বসে আছে।সাত-আটটা ছেলে-মেয়ে।খুব সম্ভবত এটা একটা বন্ধুর দল।একটা নিচু ঢিবির উপর গোল হয়ে বসে আছে সবাই।বেশ সুন্দর একটা ছেলের হাতে গিটার।সে কিছুক্ষণ আগে একটা সুর তুলেছে।এখনো সেই সুরেই গিটার বাজিয়ে যাচ্ছে।খুব পরিচিত একটা সুর।মহুয়া মনে করার চেষ্টা করল,এটা কোন গানের সুর হতে পারে।তার চিন্তার মাঝেই ছেলেটা তার সুন্দর কণ্ঠে গান ধরলো—

” ভুলিনি তো আমি
তোমার মুখের হাসি,
আমার গাওয়া গানে
তোমাকে ভালোবাসি।”

মহুয়া মুগ্ধ হয়ে গান শুনছে।ছেলেটার গলায় জাদু আছে বলতে হবে।আশেপাশের অনেকেই নজর দিচ্ছে ছেলেটার উপর।মহুয়া গানে এতোটাই মজে ছিল যে, কখন তুষার এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে তা বলতেই পারল না।

—” গানটা খুব সুন্দর,তাই না মহুয়া?”
—“হুম, খুবই সুন্দর”—বলতে বলতেই মহুয়ার চোখ যায় তুষারের উপর।অন্যান্য দিনের চাইতে আজকে একটু বেশিই পরিপাটি লাগছে মানুষটাকে।কালো রঙের টিশার্টে স্বাভাবিকের চাইতেও বেশি ফর্সা দেখাচ্ছে।তুষারের গায়ের রঙ হলুদ-ফর্সা।তাই হয়তো কালো রঙে বেশ মানিয়েছে তাকে।তুষারের কোলে মৃত্তিকার দিকে চাইতেই চওড়া হাসি ফুটে মহুয়ার ঠোঁটে।সাদা রঙের জামায় কি সুন্দর দেখাচ্ছে মেয়েটাকে!সে বাবার কোলে ভর দিয়ে আশপাশ দেখছে।

—” এই সাদা পরীটাকে কোথায় পেলেন?পরী তো দেখছি খুব কৌতূহলী।”
—” হুম। নতুন জিনিসে তার আগ্রহের শেষ নেই।এটাই আমার রাজকন্যা।”
তুষার মৃত্তিকাকে মহুয়ার দিকে ফিরায়।মৃত্তিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেঃ” এই যে মা,এদিকে তাকাও। এইটা মহুয়া।পরিচিত হও।মিত্তি,মিত্তি।”
মৃত্তিকার কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখা গেল না।সে আগের মতোই আশেপাশে নজর দিচ্ছে।তুষার আরো দুবার মেয়ের মাথা ঘুরিয়ে দিল।
—“এই যে মা,এদিকে তাকাও।এইতো এদিকে।”
মৃত্তিকা তার বাবার কথায় হয়তো খুব বিরক্ত হল।আরেকবার তুষার জোড়াজুড়ি করতেই “অ্যা” করে একটা চিৎকার দিল।এটা যে তার বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ, তা বেশ বুঝতে পারলো মহুয়া।তাই হেসে তুষারকে বললঃ”ওকে ওর মতোই থাকতে দিন।আপনার রাজকন্যা পালিয়ে যাচ্ছে না আর আমিও পালিয়ে যাচ্ছি না।সময় হলে নিজে নিজেই পরিচিত হবে।আপনিও একটা পাগল, তুষার সাহেব।একটা বাচ্চার সাথে এরকম জোর করার কি আছে?”
তুষার হাল ছেড়ে দিয়ে মহুয়ার দিকে তাকালো।এই প্রথম খুব সূক্ষ্মভাবে নজর দিল মহুয়ার মুখের দিকে।সবার আগেই তার নজর গেল মহুয়ার থুতনিতে।থুতনির নিচে আপেলের মতো একটা ভাজ।অনেকটা আপেলের নিচের অংশের মতো।কপালের মাঝে একটা টিপের মতো তিল।হঠাৎ করে দেখলে এটাকে টিপের মতোই দেখা যায়।চোখগুলো একটু বড় বড়।চেহারার সাথে মানিয়েছে বেশ।উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের নাকে সাদা রঙের নাক ফুল।ছোট্ট একটা পাথর যেন চেহারার ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে দিয়েছে।মেয়েটা যখন হাসে, তখন ঠোঁটের আধ ইঞ্চি নিচে একটু ভাঁজ পড়ে।সৌন্দর্যের দিক দিয়ে যে মহুয়ার কমতি নেই তা তাকে দেখলেই বুঝা যায়।
এইরকম রূপকেও কোনো পুরুষ ঠেলে দিতে পারে?আবরারকে দেখার খুব ইচ্ছা তুষারের।বিয়ের পর একদিন মহুয়াকে বলবে ছবি দেখাতে।মহুয়ার কাছে নিশ্চয়ই আবরারের কোনো না কোনো ছবি আছে।

—” তুষার সাহেব,এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন?”
—” নাহ,চলুন হাঁটি।মিত্তি এখনো শান্ত আছে।কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবে না।না হাঁটলেই কান্নাকাটি শুরু করবে।”

মহুয়া ও তুষার হাঁটা শুরু করলো।তুষারের পাশে মহুয়া, কোলে মৃত্তিকা।তার কাছে বেশ ভালো লাগছে।মনে হচ্ছে একটা ছোট্ট সুখী পরিবার।অলস বিকাল কাটাতে হাঁটতে বেড়িয়েছে।তুষার মনে মনে হাসে।দিন দিন তার নৈতিক অধঃপতন ঘটছে।একটা সুন্দরী মেয়েকে পাশে পেয়েই তাকে বউ ভাবতে শুরু করে দিল!আশ্চর্য!

—” মৃত্তিকার বাবা,আরো আগে দেখা করা উচিৎ ছিল আপনার।বিয়ের পনেরো দিন আগে কেউ দেখা করতে চায়?”

মহুয়ার সম্বোধন খুব ভালো লাগে তুষারের।কি ডাকলো মহুয়া? মৃত্তিকার বাবা?এরকম তো কখনো কেউ ডাকেনি তাকে।মহিমা সবসময় নাম ধরে ডাকত।এটাই নাকি এখন ফ্যাশন। তুষার খুশি মনে বললঃ”তুমি খুব সুন্দর করে ডাকলে আমাকে।এরকম ডাক কোথায় শিখেছ?”
কিরকম খাপছাড়া প্রশ্ন! কাকে কি বলে ডাকতে হয় তা কখনো শেখা লাগে?মহুয়া বললঃ”কেউ শিখিয়ে দেয়নি।আপনি আমার অনেকটাই বড়।আমি বড় কাউকে নাম ধরে ডাকতে পারি না।কেমন যেন লাগে।তাই ডাকলাম।আপনার কোনো আপত্তি আছে নাকি?”
—” আরে না,না। আমার খুব ভালো লাগলো।আমি অনেক আগেই তোমার সাথে দেখা করতাম।কিন্তু,এই কয়েকদিন বেশ ঝামেলায় ছিলাম।আমার ফ্ল্যাট পুরোপুরি তৈরি হয়ে গেছে।তার জন্য আসবাব কিনতে হয়েছে।বিয়ের জন্য কেনাকাটা করতে হয়েছে।তার উপর ব্যবসায়ের কাজ তো আছেই।এসবের চক্করে পড়ে একদম সময় পাইনি।”
—“ওহ।”
—” বাড়ির সবাই ভালো আছে?”
—” হুম।”
মহুয়া কোনো কথা খুঁজে পেল না।মনে মনে ভাবতে লাগলো কি বলা যায়।ভাব জমাতে খুব অপটু মহুয়া।
—” মহুয়া, বলো তো হিমু বেশিরভাগ একা একা হাঁটতো কেন?রূপাকে নিয়ে কেন হাঁটতো না?
প্রশ্নটা খুব ভালো বুঝতে পারলো না মহুয়া।তাই ভ্রু কুঁচকে বললঃ”মানে?”
—” আরে আমি হুমায়ূন আহমদের সৃষ্ট হিমু চরিত্রের কথা বলছি।পড়নি হিমু সবসময় একা একা রাস্তায় হাঁটতো?বলতো কেন?”
—” কি জানি।”
—” শোনো হিমু যদি সবসময় রূপাকে নিয়ে হাঁটতো,তবে কখনোই ভাবলেশহীনভাবে হাঁটতে পারত না।কারণ সুন্দরী রমনী নিয়ে হাঁটা যায় না।কেমন যেন একটা প্রেমিক প্রেমিক ভাব আসে শরীরে।এই যেমন এখন আমার মনে হচ্ছে।নিজেকে বিশ্বপ্রেমিক ভাবতে ইচ্ছে করছে।”
মহুয়া ভ্রু কুঁচকে বললঃ”আপনি যে মহাত্যাদড়, তা কিন্তু আপনাকে দেখলে বুঝা যায় না।এক বাচ্চার বাবা হয়ে আরেক মেয়ের সাথে বাদড়ামি করতে লজ্জা করছে না?তার উপর মেয়েটা আপনার কোলেই আছে।”
—” আরে আমি তো আর….
—” বা বা,বা বা, বা বা”
তুষার কথা শেষ করতে পারে না মৃত্তিকার জন্য।সে তার বাবার কোলেই খুব নড়াচড়া করছে আর পিছনদিকে ঠেলছে।তুষার থেমে পিছনে তাকালো।একটা হাওয়াই মিঠাইওয়ালা চলে যাচ্ছে।মৃত্তিকার এখন ওটা চাই।তার অঙ্গভঙ্গি দেখেই তুষার বুঝলো।সে মেয়ের গালে চুমু দিয়ে বললঃ”ঠিক আছে,বাবা এনে দিচ্ছি।”
মহুয়াও বুঝলো বাবা-মেয়ের কথা।সে তুষারকে বললঃ” ওকে আমার কাছে দিন।লোকটা তো দূরে চলে গেছে।ওকে নিয়ে ওখানে যাওয়ার দরকার নেই।আমি মিত্তিকে নিয়ে দাড়াচ্ছি এখানে।”

তুষার মৃত্তিকাকে মহুয়ার কোলে দিল।মৃত্তিকা বেশ গোল গোল চোখ করে চেয়ে রইলো।বুঝাই যাচ্ছে মহুয়ার কোলে সে আরাম পাচ্ছে না।বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর কেঁদে ফেললো।তুষার বেশ এগিয়ে গেছে ততোক্ষণে।মহুয়া মৃত্তিকাকে নিয়ে একটু এদিক-ওদিক হাঁটলো।মৃত্তিকার পিঠে হাত বুলিয়ে দিল।মহুয়ার হাত থেমে গেল মৃত্তিকার প্যাম্পার্সের কাছে এসে।বেশ ভারী হয়ে আছে এটা।মহুয়া একটু খুলে দেখলো।যা ভেবেছে তাই ঠিক।মৃত্তিকা মলত্যাগ করেছে।মহুয়া প্যাম্পার্স্টা খুলে দিল।মৃত্তিকাকে কোলে ও প্যাম্পার্সটাকে পাশে রেখে দাঁড়িয়ে রইলো।মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে।মহুয়া তাকে নিয়ে এদিক-ওদিক হাঁটতে হাঁটতে বললঃ” এই যে মা,কাঁদে না।তোমার বাবা এক্ষুনি এসে পড়বে।”
কিছুক্ষণের মধ্যে তুষার চলে আসলো।তার হাতে দুটো হাওয়াই মিঠাই।তুষারকে দেখতেই তার কোলে ঝাপিয়ে পড়লো মৃত্তিকা।তুষার মহুয়ার হাতে হাওয়াই মিঠাইগুলো ধরিয়ে দিল।

—ও কি খুব বিরক্ত…
তুষারের কথা থেমে গেল।কারণ তার পেটের দিকটা ভিজে গেল মৃত্তিকার জন্য।তুষার জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মহুয়ার দিকে তাকাতেই সে বললঃ”প্যাম্পার্সটা নষ্ট হয়ে গেছে বলে খুলে দিয়েছি।খুব বেশি ভিজে গেছেন আপনি?”

***

দেখতে দেখতে পনেরো দিন কেটে গেল।আজকে মাসের এক তারিখ।এক তারিখের রাতেই,মহুয়ার নাম জুরে গেল তুষারের সাথে।সে এখন তুষার আহমেদের বউ,মৃত্তিকা আহমেদের মা।বিয়ে শেষ হতে হতে রাত দশটা বেজে গেল।এতো দেরু হতো না।আজকে সকাল সকাল তুষারের খালু খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে।তাকে নিয়ে হাসপাতালে খুব দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে।তুষার ভেবেছিল আজকে বিয়েই করবে না।এতো বিপদের মধ্যে আবার বিয়ে করা যায় নাকি!কিন্তু,তুষারের এই ইচ্ছাপূরণ করতে দিলেন না রুবিনা বেগম।বিকালের দিকে তার স্বামী একটু সুস্থ হতেই তুষারকে পাঠিয়ে দিলেন মহুয়াদের বাড়ি।যেভাবেই হোক আজকে তার ঘরে বউ চাই।আর কি করার! তুষার চলে গেল বিয়ে করতে।বিয়েতে খুব বেশি আয়োজন ছিল না।একদম ঘরোয়া পরিবেশের বিয়ে।নানা নিয়ম-কানুন শেষ করে মহুয়াকে নিয়ে বেড়তে বেড়তে এগারোটা বেজে গেল।এইবারেও গাড়িতে ঘুমিয়ে গেছে মহুয়া।এমনিতেই কালকে ঘুমাতে পারেনি।তাছাড়া আজ বিদায়ের সময় খুব কেঁদেছে।তাই গাড়ির মধ্যে ক্লান্ত শরীরে, তুষারের কাঁধে মাথা দিয়ে খুব শীঘ্রই ঘুমিয়ে পড়লো।তুষার পড়েছে খুব বিপাকে।একদিকে বউ কাঁধে ঘুমিয়ে আছে অন্যদিকে মেয়ে বুকে ঘুমিয়ে আছে।বেচারা নড়াচড়াই করতে পারছে না।রাস্তায় খুব জ্যাম ছিল না।তাই খুব দ্রুতই পৌঁছে যায় ওরা।তুষার আস্তে আস্তে ডাক দেয় মহুয়াকে।
—” মহুয়া, মহুয়া। উঠো।”
মহুয়ার নড়েচড়ে বসে।মাথা উঠিয়ে বলেঃ”এসে পড়েছি?”
—” হুম।”
তুষার আগে গাড়ি থেকে নামে।এলাকায় নতুন ও।মৃত্তিকাকে এককোলে নিয়ে আরেক হাতে মহুয়াকে নামায়।মহুয়ার চোখে খুব ঘুম। এখানেই হাত-পা ছেড়ে ঘুমিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে।ঢুলুঢুলু চোখে কোনোমতে ঘরের সামনে যেয়ে দাঁড়ায় মহুয়া।ঘুমাতে না পারলে নিশ্চিত সে মরে যাবে।রুবিনা বেগম তৈরি ছিলেন।ছেলে,ছেলের বউকে আটকান না তিনি।মহুয়ার সাথে ভালো-মন্দ কথা বলে ওকে ঘরে পৌঁছে দেয়।ঘরে এসে হাফ ছাড়ে মহুয়া।ভেবেছিল এখানেও নিয়ম-কানুন পালন করতে হবে।পুরো ঘরে চোখ বুলায় একবার।ঘর নতুন সাজানো হয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে।আসবাবপত্রে ঠেসে আছে একদম।মহুয়া আর কোনোদিকে নজর না দিয়ে লাগেজ থেকে শাড়ি বের করে।তুষার আসার আগেই শাড়ি বদলে বিছানায় শুয়ে পড়ে।মৃত্তিকাও খাটের মাঝে শুয়ে আছে।ওকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমিয়ে যায় মহুয়া।বেঁচে থাকলে তুষারের সাথে পরেও কথা বলা যাবে।এখন যদি মহুয়া না ঘুমায় তবে হয়তো মাথাব্যথায় মরেই যাবে।খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না মহুয়াকে।দ্রুতই পাড়ি জমালো স্বপ্নরাজ্যে।
তুষার যখন ঘরে এসেছে তখন ঘড়ির কাটা সাড়ে বারোটার ঘরে।সে এসেই দেখলো মৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে মহুয়া।দৃশ্যটা খুব ভালো লাগলো তুষারের।সে এরকম কিছুই ভেবেছিল।মহুয়াকে দেখেই বুঝা যাচ্ছিল,তার খুব ঘুম পেয়েছে।তুষার হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে এসেছিল।মহুয়াকে ঘুমাতে দেখে খুব বেশি ভাবলো না সে।খাবারের প্লেট রেখে মৃত্তিকার আরেক পাশে ঘুমিয়ে পড়লো।সকাল থেকে খুব দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে।শরীর ভেঙে আসছে।না ঘুমালে চলবেই না।

খুব সকালে ঘুম ভাঙে মহুয়ার।চারপাশে আলো ফুটেছে।ঘুম পালিয়ে যাওয়ায় উঠে বসে মহুয়া।তারপাশেই তুষার ঘুমিয়ে আছে।তুষারের বুকের উপর মৃত্তিকা।মহুয়া মুচকি হাসে।কিভাবে ঘুমাচ্ছে এরা।তুষারের থেকে নিয়ে মৃত্তিকাকে বালিশে শোয়ায়।ঘুমের মধ্যেই নড়ে উঠে তুষার।মেয়ের দিকে ফিরে আবারো ঘুমিয়ে পড়ে।বারান্দার দরজাটা খোলা।মহুয়া নিচে নেমে শাড়ি ঠিক করে।টেবিলের উপর খাবারের প্লেট দেখেই ওর ক্ষিদে পেয়ে যায়।কালরাতে সেই নয়টা বাজে খেয়েছিল।মহুয়া হাতখোপা করতে করতে বারান্দার দিকে যায়।ওর বারান্দার প্রতি আলাদা আকর্ষণ আছে।বারান্দা মহুয়ার খুব পছন্দ।সদ্য ঘুম ভাঙা নিস্তেজ শরীর নিয়ে মহুয়া বারান্দায় দাঁড়ায়।ভোরের আলো তার শরীর ছুঁয়ে যায়।ভালোমতো চোখ মেলে সামনে তাকাতেই মহুয়ার চোখ বড় বড় হয়ে যায়।হৃৎপিন্ডের গতি তীব্র হয়।শরীরে কাঁপন ধরে।সামনের বারান্দায় ঠিক একই অবস্থা আবরারের।সেও ভূতের মতো চোখ মেলে মহুয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here