Sunday, December 14, 2025
Home Blog Page 2038

ধ্রুব অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ৮

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৮

ছুটিতে ধ্রুব বাসায় এলে ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন শুরু হলো। আমার চোখের সামনেই। আমি অসহায়ের মত চেয়ে চেয়ে সবই দেখলাম। না দেখে উপায় নেই কারণ আন্টি রোজ আমাকে ডেকে পাঠান তাঁকে হেল্প করার জন্য। আমি গিয়ে কাজ শেষে আবার চলে আসি। তবে ধ্রুবর সাথে আমার খুব কমই দেখা হয়। ইনফেক্ট ও বেশিরভাগ সময়ই বাসার বাইরে থাকে। তাতে আমার সুবিধেই হলো। ও বাসায় থাকলে আমার সংকোচ বোধ হয়, অস্বস্তি হয়। ওকে আর তরুকে একসাথে দেখলে চিৎকার করে কাঁদতে মন চায়। তাই ও বাসায় না থাকলেই আমার সুবিধে।

ওর হলুদের দিন সন্ধ্যা থেকেই আমার শরীর খারাপ ছিলো। রাতের দিকে একশো চার ডিগ্রী জ্বর উঠলো। মাকে জানাই নি। মা ধ্রুবদের বাসায় ছিলো। আন্টিকে হেল্প করছলো। বাসায় আমি একা। আমাকে রেডি হয়ে রাত দশটায় ছাদে চলে যেতে বলা হলো। কারণ তখন অনুষ্ঠান শুরু হবে। আমি গেলাম না। বিছানা ছেড়ে উঠার শক্তি আমার নেই। জ্বরের চোটে বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার দশা। এগারোটার দিকে আন্টি নিজে চলে এলেন আমাকে ডাকতে। আমার তখলো একশো চার ডিগ্রী জ্বর। জ্বরে কাঁতরাচ্ছি। আন্টি আমার অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলেন। মাকে খবর পাঠিয়ে তিনি নিজে বসে গেলেন আমার মাথায় পানি ঢালতে। আমি বারবার করে বাধা দিলাম এসবের প্রয়োজন নেই। আজকে তার ছেলের হলুদ তার সেখানে থাকা উচিৎ, তিনি শুনলেন না। কাজের মেয়ে তাকে ডাকতে আসলে তিনি গেলেন না। খবর শুনে মা নিচে নেমে এলেন। এসেই হুলস্থুল কান্ড।

কতক্ষন অচেতন ছিলাম আমি জানি না। জ্ঞান ফিরতে আবছা আবছা কানে এলো আমাকে হস্পিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। নিচে গাড়ি এসে গেছে। আমি চোখ খুলে দেখার চেষ্টা করলাম। আমার পাশে মা এবং আন্টি বোরখা পরে বসে আছেন। ঘরভর্তি লোকজন। ধ্রুব কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছিলো। ওর পরনের হলুদের পাঞ্জাবি! গালে হলদে ভাব। খুব কিউট লাগছিলো। ফোন রেখে আমার মুখের ওপর ঝুঁকে টেম্পারেচার চেক করলো। আমি যেন স্বপ্ন দেখছিলাম। আমার স্বপ্নের রাজকুমার মায়াভরা চোখে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমার কানের কাছে মুখ লাগিয়ে ফিসফিস করে বলছে,”ভয় নেই। আমি আছি তো।” কিন্তু এসব কিছুই হল না। আমার স্বপ্নের রাজকুমার আমাকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরলো। আমি জ্বরের ঘোরে কেবল বললাম,”তোমার আজকে হলুদ। আমাকে নিয়ে ব্যস্ত হচ্ছো কেন?”ধ্রুব আমায় কোন কথা বললো না। সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করলো। তার পেছন পেছন মা, আন্টি আরো অনেকেই নামছে। বিয়ের বাড়ির অনেকেই হয়ত বুঝতে পারছে না সবাই এত ব্যস্ত হচ্ছে কেন? সামান্য জ্বর! তা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কি আছে। কিন্তু, ঘটনাটা হচ্ছে আমি যখন আধোচেতন, আধোজাগরণ অবস্থায় ছিলাম তখন নাকি আমার নাক দিয়ে টুপটুপ করে রক্ত পড়ছিলো। এবং মাকে কেউ একজন বলেছে নাক দিয়ে রক্ত পড়া ক্যান্সারের লক্ষণ। তারপর থেকেই মা পাগলের মত আচরণ করছেন। বিলাপ করে কাঁদছেন। আমি যে তাকে একটু সান্ত্বনা দেবো সেই জোরটুকুও হারিয়ে ফেলেছি। শরীর প্রচন্ড দুর্বল। ধ্রুব আমাকে গাড়িতে বসিয়ে দিলো। আমার পাশে মা আর আন্টি বসলো, ধ্রুব বসলো ড্রাইভারের পাশে। আমি রুগ্ন কন্ঠে বারবার ওকে আর আন্টিকে বারণ করতে লাগলাম, ওদের যাওয়ার কোন দরকার নেই। কিন্তু ধ্রুব কিংবা আন্টি কেউ আমার কথা শুনলো না। মা তখন এসব শোনার অবস্থায় নেই। তিনি ক্রমাগত কেঁদে চলেছেন। এবং আন্টি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলেছেন। এদিকে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিলো, আমি শরীরে ঝাঁকুনি অনুভব করছিলাম। খিঁচুনি শুরু হলো। মাথার ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছিলো। পরিনামে আবার জ্ঞান হারালাম।

হস্পিটালে পৌঁছাতেই আমাকে কেবিনে শিফট করা হলো। এবং অক্সিজেন দিয়ে শুইয়ে রাখা হলো। মা আমার পাশে বসে রইলেন। ডাক্তারদের সাথে যাবতীয় কথাবার্তা ধ্রুবই বললো। কথা শেষে মা ওকে ডেকে এনে বললেন,”তুমি এবার বাসায় ফিরে যাও বাবা। আজকে তোমার হলুদ! তরু বারবার ফোন দিচ্ছে।” মায়ের কথার জবাবে ধ্রুব স্পষ্ট জানিয়ে দিলো ডাক্তার রিপোর্ট দেওয়ার আগে সে যাচ্ছে না। মা মনে মনে খুশি হলেন। কারণ বাবা ঢাকার বাইরে কিন্তু এই মুহূর্তে একজন পুরুষমানুষ সাথে থাকা খুবই প্রয়োজন। কিন্তু চক্ষুলজ্জায় তিনি ধ্রুবকে আটকেও রাখতে পারছেন না আবার জোর করে চলে যেতে বলতেও পারছেন না। তবুও বললেন,”তোমার হলুদ অনুষ্ঠান। তুমি না থাকলে খুবই খারাপ দেখাবে।”

—“হলুদ লাগানো তো শেষ।”

—“কিন্তু অনুষ্ঠান?”

মায়ের প্রশ্নের উত্তর আন্টি দিলেন। বললেন,” এই অবস্থায় কি অনুষ্ঠানে মন বসবে? আগে মানুষের জীবন তারপর অনুষ্ঠান। বেঁচে থাকলে এমন বহু অনুষ্ঠান করা যাবে। মেয়েটা অসুস্থ। এখন ওর কথা ভাবুন। এখন এসব কথা থাক। তাছাড়া নিশাতের বাবা ঢাকার বাইরে এইমুহূর্তে একজন পুরুষ মানুষ তো হস্পিটালে থাকা প্রয়োজন। ওষুরপত্র আনার জন্যে হলেও তো লাগবে? ধ্রুব থাক।”

মা কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে আন্টির দিকে তাকালেন। এবং বিগলিত চিত্তে আন্টিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন। আন্টির প্রতি আমার শ্রদ্ধা আরো বেড়ে গেলো। আমার চিন্তায় মা খুবই ভেঙ্গে পড়েছেন। আন্টি না থাকলে এইমুহূর্তে মায়ের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যেত। ধ্রুবর দিকে চোখ পড়তেই দেখলাম ও বারবার ফোন কেটে দিচ্ছে। শেষে ফোন রিসিভ করে বাইরে চলে গেলো।
মা ওজু করে নামাজে বসলেন। আর আন্টি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। আমি চোখবন্ধ শুয়ে রইলাম।
আনুমানিক দশমিনিট পর ধ্রুব ফিরে এলো। আন্টি ভেবেছে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি। ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলো কে ফোন করেছে। আমার তখন হুঁশ ছিলো আমার ছিলো না। কেমন যেন একটা আচ্ছন্নভাব। ধ্রুব গম্ভীরমুখে বললো,”তরু।” আন্টি জিজ্ঞেস করলেন,”কি বলেছে?”

—“বললো, বাসায় সবাই আমাদের জন্য ওয়েট করছে।”

—“তুই বলিস নি আমরা এখন ফিরবো না?”

—“বলেছি।”.

—“ও কি বলেছে?”

—“কি আর বলবে। মন খারাপ করেছে।”

আন্টি কিছুক্ষন নিরবে ধ্রুবর মুখের দিকে চেয়ে থেকে বললেন,” তুই ওকে ফোন দে, আমি বুঝিয়ে বলছি।”

ধ্রুব ফোন বের করে তরুর নাম্বারে ডায়াল করলো। আন্টি ওর সাথে কথা বললেন। ধ্রুব আমার পাশেই বসে ছিলো। আন্টি ফোন রেখে ধ্রুবকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”তুই ওর সাথে রাগারাগি করেছিস কেন? বুঝিয়ে বললেই তো হতো? জবাবে ধ্রুব শুধু বললো,”আমি বুঝিয়েই বলেছি।”
ওদের কথার মাঝখানেই আমার আবার চোখমুখ অন্ধকার হয়ে আসতে শুরু করলো। আবার শুরু হলো কাঁপুনি। নিশ্বাস ক্রমাগত উঠানামা করছিলো। খবর পেয়ে নার্স এসে ইঞ্জেকশন পুস করলো। মা মোনাজাতে বসে কাঁদছেন। আন্টি কাঁদোকাঁদো গলায় ধ্রুবকে বললেন,”মেয়েটার হঠাৎ কি হলো বলতো? বেশতো ভালোই ছিলো।

ইঞ্জেকশন পুশ করার ঘন্টাখানেক বাদে আমার কন্ডিশন মোটামুটি স্টেবল হলো। আমি খেয়াল করলাম ধ্রুবর হলুদ নিয়ে আন্টির কোন চিন্তা নেই তার যাবতীয় চিন্তা কেবল আমাকে নিয়ে। নার্স এসে জানালো কালকের আগে রিপোর্ট পাওয়া যাবে না। কালকে দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

নার্স চলে গেলে মা ধ্রুবকেও চলে যেতে বলে বাবার সাথে কথা বলতে বলতে কেবিনের বাইরে বেরিয়ে গেলো। আন্টির কাছেও বারবার বাসা থেকে ফোন আসছিলো। আন্টি ফোন নিয়ে একপাশে সরে গেলেন। ধ্রুব আমার পাশে বসে রইলো।

একরাতেই ওর চেহারা বেশ পরিবর্তন হয়ে গেছে। ওকে অনেক বেশি রোগা দেখাচ্ছে। আমার পাশে চেয়ার টেনে বসলো। আমি মনে মনে দুঃখ পেলাম। বেচারা আমার জন্য নিজের হলুদটাও ঠিক মত এঞ্জয় করতে পারে নি। বললাম,”তুমি যাও নি কেন?”

—“তোমার রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। এবার যাবো।”

—“হ্যাঁ যাও। কালতো আবার বিয়ে। পরে আবার শরীর খারাপ করবে।”

—“যাবো।”

—“আর শোনো তরুকে বলো আমি ওর কাছে ক্ষমা চেয়েছি। আমার জন্যই তোমাদের হলুদ প্রোগ্রামটা নষ্ট হয়ে গেলো। ”

—“বলবো।”

—“তুমি কিন্তু না এলেও পারতে।”

—“হুম।”

আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলাম আকাশ ফরসা হয়ে এসেছে। বললাম,”সকাল হয়ে এসেছে তাই না?”

—“হ্যাঁ!”

—“আর দেরী করা ঠিক হবে না। এবার বেরিয়ে পড়ো।”

ধ্রুব হোলদোল দেখালো না। নিরাসক্ত কন্ঠে বললো,”যাবো।”

—“কখন যাবে?”

—“এইতো যাবো।”

—“হুম, যাও। গিয়ে একটা হট শাওয়ার নাও। তোমাকে দেখে তো চেনাই যাচ্ছে না। রোগী রোগী লাগছে।”

ধ্রুব আপনমনেই বলে উঠলো,”রোগী লাগছে? মিথ্যে কথা!”

—“আমি শুধু শুধু মিথ্যে বলতে যাবো কেন?”

—“কী জানি!”

—“তোমার বিশ্বাস হলো না তো। ঠিক আছে বাসায় গিয়ে আয়নায় একবার নিজের চেহারাটা দেখো , তারপর বুঝবে কি হাল হয়েছে।”

—“আচ্ছা।”

আমি অবাক হয়ে ধ্রুবর মুখের দিকে চেয়ে রইলাম। ধ্রুবকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আমার কোন কথাই ও ঠিকমত শুনছে না। মনে হচ্ছে কি যেন ভাবছে!

ভোর পাঁচটায় আন্টিকে নিয়ে ধ্রুব চলে গেলো। আমি বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম। চোখ বন্ধ করতেই কাল রাতের ঘটনাটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ধ্রুব আমাকে কোলে নিয়ে একেরপর এক সিঁড়ি বেয়ে নামছে। তখন ওর চোখেমুখে কি উৎকণ্ঠাই না ছিলো। একমুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিলো বুঝি ধ্রুব নিজেও জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। আমি জানি না ওর আমার জন্য এই উৎকণ্ঠা আমি কি হিসেবে ধরে নেবো। ভালোবাসা নাকি মানবিকতা, নাকি দায়িত্ববোধ। কিন্তু আমি মনে প্রাণে সেই জিনিসটাকে উপভোগ করেছি। বুকের ভেতর একসাথে আনন্দ, বেদনা হাহাকার শুরু হলো।চিনচিন করে করে উঠলো। কাছে পেয়েও মানুষটাকে আমি পেলাম না। সে আজকে সারাজীবনের জন্য আরেকজনের সাথে বাধা পড়বে। তাঁর সঙ্গে সারাজীবন একসাথে পাড়ি দেওয়ার অঙ্গিকার গ্রহণ করবে ভাবতেই কান্না চলে এলো। আমি ফের চোখ বন্ধ করে কান্না আটকালাম। মা আমার পাশে বসে মাথায় হাত বুলাচ্ছিলো। আর দোয়াদরুদ পড়ে ফুঁ দিচ্ছিলো।

দুইদিন বাদে আমি হস্পিটাল থেকে রিলিজ পেলাম। এই দুইদিনে আর ধ্রুবর আমার দেখা হয় নি। এমনকি আন্টিও আমাকে আমাকে দেখতে আসে নি। আমি মনে মনে দুঃখ পেলাম। আন্টির কাছ থেকে এটা আসা করি নি। পরে ভাবলাম নতুন বউ নিয়ে ব্যস্ত হয়ত।

তিনচার দিন বাদে হঠাৎ একদিন ছাদে ধ্রুবর সাথে দেখা হলো। সাথে তরুও আছে। তরুর পরনে শাড়ি। শুকনো জামাকাপড় নিতে এসেছে। আমার বুকটা ধক করে উঠলো। বিয়ের পর তরু খুব সুন্দর হয়ে গেছে। দুজনকে একসঙ্গে মানাচ্ছিলোও বেশ। আমি ওদের দিকে তাকিয়ে ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে রইলাম। আমাকে দেখে তরুর মুখ ভার করে ফেললো। পাঁচসাত মিনিট পরে তরু শুকনো জামাকাপড় নিয়ে নেমে গেলো। কিন্তু ধ্রুব নামলো না। তরু নেমে যাওয়ার পর আমিও নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ধ্রুব আমার পাশে এসে দাঁড়ালো,”কেমন আছো?”

আমি কোনরকমের নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,”ভালো।”

—“জ্বর পুরোপুরি সেরেছে?”

আমি ম্লান মুখে বললাম,”হ্যাঁ। তোমার কি খবর? আন্টি কেমন আছে?”

—“মা ভালো আছেন।”

তারপর অনেক্ষন নিরবতা। দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। নিরবতা ভেঙ্গে আমিই ইতস্তত করে বললাম,”একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

—“কি?”

—“আন্টিকে অনেকদিন দেখি না। তুমি কি আন্টিকে আমাদের বাসায় আসতে বারণ করে দিয়েছো? না মানে আমি তো এখন তোমাদের বাসায় যাই না।”

ধ্রুব অবাক হয়ে বলল,”মা তোমাদের বাসায় যান না? কই আমাকে তো কিছু বলেন নি? তাছাড়া আমি কেন বারণ করতে যাবো?”

—“না মানে তরু…!”.

—“তরু বারণ করে নি।”

আমার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। আমি ভেবেছিলাম আন্টিকে হয়ত ওরা নিষেধ করার তিনি আমাকে দেখতে আসেন নি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি তিনি নতুন বউ পেয়ে আমাকে ভুলে গেছেন। ধ্রুব ছাদ থেকে নেমে গেলো। আমি মনে মনে আশ্চর্য হলাম। ধ্রুব আমার রিপোর্টের কথাও একটাবার জিজ্ঞেস করলো না। যেই রিপোর্টের জন্য সেদিন ও নিজের হলুদ প্রোগ্রাম ক্যান্সেল করে দিয়েছিলো অথচ আজ তা জানবার প্রয়োজনও মনে করলো না! মানুষ কত তাড়াতাড়ি পরিবর্তন হয়ে যায়! দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমিও নিচে নেমে গেলাম।

পরেরদিন আন্টির সাথে দেখা হয়ে গেলো ছাদে। তরুও আছে। আমি আন্টিকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”কেমন আছেন আন্টি।” আন্টি সংক্ষেপে উত্তর দিলেন তিনি ভালো আছেন। তারপর আর আমার সাথে তেমন কথা বললেন না। যেটা আমার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত। তিনি এবং তরু নিজেদের মত করে গল্প করে যাচ্ছেন। আমার খুব কষ্ট হলো। খুব খারাপ লাগলো। মনে মনে ভাবলাম, আন্টি যখন একা ছিলেন তখন আমার দরকার ছিলো। এখন আর আমার প্রয়োজন নেই। এখন তার নতুন সঙ্গী জুটেছে। কিন্তু তাই বলে কি ভালো করে দুটো কথাও বলা যায় না? হায়রে মানুষ! এত তাড়াতাড়ি বোধহয় গিরগিটিও তার রঙ পরিবর্তন করে না যত তাড়াতাড়ি মানুষ তার রূপ বদলায়! আমি সেদিনও চুপচাপ নিচে চলে এলাম।

ধ্রুব ছুটি শেষ হলে ও চলে গেলো। এবং ধ্রুব চলে যাওয়ার পর আজকে তিনমাস আমি ওদের বাসায় যাই নি। আন্টির সাথেও কোন দেখা সাক্ষাৎ হয় নি। একদিন দুপুর বেলা আমি ভার্সিটি থেকে ফিরছিলাম। সিঁড়িতে আন্টির সাথে দেখা। তিনি মার্কেট থেকে ফিরছিলেন। আমাকে দেখে হাসলেন। সেদিন বিকেলে ছাদের ঘটনা মনে পড়ে গেলো। আমি তার পেছন পেছন নিরবে উঠে গেলাম। একটা কথাও বললাম না তার সাথে। তাদের বাসার সামনে আসতেই তিনি আমার হাত চেপে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। আমি বিরক্তমুখে বললাম,”কি ব্যাপার আন্টি? এভাবে টেনে নিয়ে এলেন কেন?”

—“তোর সাথে আমার কথা আছে।”

—“তাই বলে এভাবে টেনে নিয়ে আসতে হবে?”

—“বেশ করেছি। তুই আমাকে দেখে মুখ ফিরিয়ে নিলি কেন?”

আমি অভিমানী গলায় বললাম, “আমি কোথায় মুখ ফিরিয়ে নিলাম। আপনি তো আর আগের মত আমার সাথে কথা বলেন না।”

আন্টির আমার গালটা টেনে দিয়ে বললেন,”তাই বুঝি রাগ করে আমাদের বাসায় আসিস না?”

—“আপনিও তো যান না।”

—“আমি তো সারাদিন ব্যস্ত থাকি। আমার কত কাজ। তরু মা হতে যাচ্ছে সব কাজ তো আমাকেই করতে হয়।”

আন্টির কথা শুনে আমি কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। তরু এসে চা দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ও প্রেগন্যান্ট। এরপরে আন্টি কি কথা বললেন সেসব কিছুই আমার কানে গেলো না।আমার চারদিকটা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। আমার ভেতরের আমিটা চিৎকার দিয়ে জানান দিচ্ছিলো, “অনেক হয়েছে নিশাত। এবার ধ্রুবর ঘোর থেকে বেরিয়ে এসো। আর পাগলামি নয়। এবার নিজেকে সময় দাও! বেরিয়ে এসো ধ্রুবর ঘোর থেকে!” আমি মৌনমুখে বললাম,”আন্টি আজকে আমি আসি।”

আন্টি আমার হাত চেপে ধরে বললেন,”সে কি। তোর সাথে আমার কত কথা আছে। আমি ভাবলাম খেয়ে দেয়ে দুজনে জমিয়ে আড্ডা দেবো।”

—“আজকে না আন্টি অন্যদিন। আমি আসি।”

বাসার সিঁড়ি কীভাবে পার করলাম আমি জানি না। কেউ যেন আমার চলৎশক্তি কেড়ে নিয়ে নিয়েছিলো। আমার পা দুটো টেনে আটকে দিচ্ছিলো। দরজা খুলে মা আমার মুখ দেখে চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন আমার কি হয়েছে? আমি জবাব না দিয়ে ঘরে চলে গেলাম। মা আমার পেছন পেছন ঢুকলেন। তাঁর চোখে ভয়। আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,”তোর কি হয়েছে মা? চোখমুখ এমন দেখাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”

—“কিছু না মা। একটু টায়ার্ড লাগছে। আমি একটু রেস্ট নেবো।”

মা সন্দিগ্ধ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি আত্মসংবরণ করতে পারলাম না। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললাম। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,”আমি মরে যেতে চাই মা! আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না।”
মা চোখ সরু করে ফেললো। সান্ত্বনা না দিয়ে বললো,,”তোর কি কাউকে পছন্দ আছে? থাকলে আমাদের বল!”

মায়ের এমন প্রশ্নে আমি রীতিমত অবাক হয়ে গেলাম। তিনি কি কোন ভাবে টের পেয়ে গেছেন আমি ধ্রুবকে ভালোবাসি! আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,”হঠাৎ করে এমন প্রশ্ন?”

—“এমনি, তোর বাবা জিজ্ঞেস করছিলেন। যদি পছন্দ থাকে বল, আমরা খোঁজখবর নিয়ে দেখবো। এভাবে কান্নাকাটি করিস না! ”

—“সত্যি করে বলো কি হয়েছে মা? হঠাৎ বাবা এসব কেন জিজ্ঞেস করেছে?”

—“কেন জিজ্ঞেস করবে আবার? তুই বড় হয়েছিস, তোকে বিয়ে দিতে হবে না? তাই। আজকে বিকেলে ছেলেপক্ষ তোকে দেখতে আসছে।”

আমি আবারো অবাক হলাম। হুট করে ছেলেপক্ষ দেখতে আসার মানে কি? মা আমাকে আগে জানালো না কেন? মাকে জিজ্ঞেস করতেই বললো ছেলেপক্ষ অনেকদিন থেকেই মেয়ে দেখতে চাইছে। বাবা সব খোঁজখবর নেওয়া ছাড়া মেয়ে দেখাতে রাজি ছিলেন না। তাই এতদিন কাউকে কিছু জানানো হয় নি। আমি চুপ করে রইলাম। মা ফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন আমার কোন পছন্দ আছে কি না। আমি না বলে দিলাম।

এই উত্তরে মা মনে মনে খুশি হলেন। এইমুহূর্তে মাকে ঘর থেকে বের করার জন্য বাধ্য হয়ে আমাকে কথাটা বলতে হলো। তা না হলে তিনি জেরা করতে করতে আমার জান বের করে দিতেন। আর চাইলেও মাকে সবটা বলা আমার পক্ষে অসম্ভব। মা চলে গেলে আমি চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে রইলাম। ধ্রুবর সাথে আমার প্রথম দেখা, লুকিয়ে চুরিয়ে প্রেম করার স্মৃতিগুলো এক এক করে মনে পড়তে শুরু করলো। তখন আমি বেশ ঝগড়ুটে এবং মেজাজি ছিলাম। প্রথম কয়েকমাস প্রেমের নতুন নতুন ক্রেজ থাকলেও এর পর রোজ ঝগড়া হতো আমাদের। তারপর দুজনেই রাগ করে ব্রেকাপ করলাম। প্রায় একবছরের মত কোন যোগাযোগ ছিলো না। তারপর একদিন ধ্রুবরা আমাদের বাসায় ভাড়াটিয়া হয়ে এলো। কত কিছু ঘটে গেলো! এখন ধ্রুব বাবা হতে চলেছে। সুখে সংসার করছে তরুকে নিয়ে.. আর কিছু ভাবতে পারলাম না। না পাওয়ার তীব্র বেদনা আমাকে তিলে তিলে যন্ত্রনা দিয়ে শেষ করে দিচ্ছিলো। একটা কথা খুব ভালো করে বুঝতে পারলাম ধ্রুব বা ধ্রুব জড়িত ঘটনা গুলো যতক্ষণ আমার চোখের সামনে থাকবে ততদিন আমি ধ্রুবকে ভুলতে পারবো না। তাই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। হয়ত বিয়ের মাধ্যমেই ধ্রুবকে ভোলা সম্ভব।
.
.
.
চলবে

ধ্রুব অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ৭

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৭

আশ্চর্যজনকভাবে মায়ের মুখ থেকে এখন আর ধ্রুবর নিন্দে শোনা যায় না। বরং রোজ দুবার করে আমার কানের কাছে ধ্রুবকীর্তন চলে। তাঁর দৌলতেই জানতে পারলাম ধ্রুব এবং তরুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনের মাসেই বিয়ে। বিয়ের আগেই ওরা বাসা চেইঞ্জ করে ফেলবে। খবরটা শোনার পর আমার হৃদপিন্ডে খামচি মেরে উঠলো। কলিজায় ধক করে উঠলো, তবুও আমি চুপচাপ মায়ের মুখ থেকে সবটা শুনলাম। আমার ভেতরে কি হচ্ছে সেটা আমি মাকে বুঝতে দিলাম না। এবং সেদিন একটু বেশিই হাসলাম। সবার সাথে বেশ ভালো ব্যবহার করলাম। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম ধ্রুব চলে গেলে ভালোই হবে। ওকে ভুলে যেতে পারবো। সব আবার আগের মত হয়ে যাবে। কিন্তু ভেতরের কষ্টটা কিছুতেই কমাতে পারছিলাম না।

এদিকে আন্টির অসুস্থতার জন্য ধ্রুবদের বাসা চেইঞ্জ করা হলো না। ডাক্তার স্ট্রেট নিষেধ করে দিলেন। বাসা চেইঞ্জ করলে খাটাখাটনি বাড়বে, অসুস্থ শরীরে আন্টির এত ধকল সইবে না। সুতরাং ধ্রুবর বিয়ে পর্যন্ত আন্টিরা এই বাসাতেই থাকবেন। খবর পেলাম গত সপ্তাহে ধ্রুবর বড় বোন তাঁর বরের সাথে আমেরিকা চলে গেছে। সে বিয়েতে থাকতে পারবে না। আন্টি খুব মন খারাপ করলেন। সেই খবর শুনেই নাকি তরু হোস্টেল থেকে বাসায় চলে এসেছে। আমি অবশ্য তরুর আসার খবর জানতাম না। হস্পিটাল থেকে ফেরার পর প্রায়ই আন্টির সাথে দেখা করতে যেতাম। উনার হাতে হাতে টুকটাক কাজ করে দিতাম। তবে সেটা ধ্রুব অলক্ষ্যে। আমি চাই নি ধ্রুব এসব জানুক। কারণ আন্টির সাথে আমার সম্পর্ক সবকিছু বাইরে। এই মানুষটা আমার কাছে একেবারে আলাদা। বিকজ দ্যা লেডি লাভস মি আনকন্ডিশনালি! তিনি আমাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছেন। একেবারে নিজের মেয়ের মত!
বস্তুত আমি খুব বেশি মিশুক প্রকৃতির মেয়ে না। যদিও সমবয়সীদের সাথে আমার মোটামুটি ভালোই জমে। তবে বয়স্কদের আমি এড়িয়ে চলি। কিন্তু আন্টির সঙ্গে জমে গেলো। অ্যান্ড অফকোর্স দ্যা ক্রেডিট গোজ টু হার। তিনি আমাকে বাধ্য করেছেন তাঁকে ভালোবাসতে। দিনের ভেতর চারপাঁচবার আমাকে ডেকে পাঠান। আমাকে নিয়ে মার্কেটে যান, বাজার করেন। পছন্দমত কিছু রান্না করলে আমার জন্য পাঠান। আমি অসুস্থ শুনলে ছুটে আসেন আমার খবর নিতে। তাই আমি কেবল আন্টির জন্য ধ্রুবদের বাসায় যাই।

সেদিন রান্নাঘরে আন্টি তরকারি কাটছিলেন। আমি তার পাশে বসে গল্প করছিলাম। আন্টি আমাকে ফ্রিজ থেকে মুরগী বের করতে বললেন। আমি তখনো জানতাম না বাসায় তরু আছে। ডাইনিংয়ে ওর সাথে দেখা হলো। আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এলো। কুশল বিনিময় করলো। রান্নাঘরে আমাদের সাথে তারকারি কাটতে বসে গেলো। আন্টির ওর কাছে আমার নানারকম প্রশংসা করছিলেন, ও খুব হাসিমুখেই শুনছিলো। আমি মনে মনে লজ্জা পাচ্ছিলাম। আন্টিকে বারণ করলাম এসব না বলতে। কিন্তু তিনি এবং তরু মিলে আমার মজা নিতে শুরু করলেন। একপর্যায়ে আমরা তিনজনই হেসে ফেললাম। হাসাহাসির মাঝখানে নয় দশ বছরের একটা মেয়ে এসে বললো ধ্রুব তার পেনড্রাইভ খুঁজে পাচ্ছে না।
তরুকে ডাকছে। তরু উঠে চলে গেলো। আন্টি আর আমি বসে বাকি কাটাকাটি শেষ করে নিলাম। এরপর আমি আন্টির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসছিলাম। হঠাৎ মনে হলো তরুকেও বলে যাই। এর আগে ওর সাথে কখনো এই সহজভাবে মেলামেশার সুযোগ হয় নি। কিন্তু আজকে বুঝতে পারলাম মেয়েটা সত্যিই ভীষণ ভালাও। ধ্রুব ঘরের দরজায় টোকা দিতে যাবো তখন তরু আর ধ্রুবর কথোপকথন আমার কানে এলো।

ধ্রুব কম্পিউটার টেবিলে বসে কি যেন টাইপ করছে। তরু ওর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। কিছুটা উপেক্ষার স্বরে বললো, “আচ্ছা নিশাতের সাথে ফুপুর এত ভাব কি করে হলো? ফুপু কি ওকে আগে থেকেই চিনতো।”

ধ্রুব টাইপ করতে করতেই পালটা প্রশ্ন করলো,”তাই নাকি? ভাব? কই আমি জানি তো না। হলেও হতে পারে। মা প্রায়ই ওর কথা বলে।”

আমি বুঝতে পারছিলাম না তরু হঠাৎ কেন এই কথা জিজ্ঞেস করলো। দরজায় দাঁড়িয়ে এভাবে আড়িপেতে কথা শুনতে খুব অস্বস্তি লাগছিলো। কিন্তু কৌতূহল দমন করতে পারলাম না। তরু ধ্রুব চুলে খুব যত্ন করে বিলি কেটে দিতে দিতে বলল,”না মানে, ও যে এত ঘনঘন তোমাদের বাসায় আসে কেউ কিছু মনে করে না? আফটার অল সি ইজ ম্যারিজেবল! এভাবে যখন তখন বাসায় চলে আসাটা কি ঠিক? বাসায় তুমি থাকো…”

ধ্রুব কন্ঠে বিস্ময়ের আভাস পেলাম। অবাক হয়ে বললো,”ঘন ঘন আসে? কই আমি তো ওকে দেখি না। তোমাকে কি কেউ কিছু বলেছে?”

—“না। কিন্তু বলতে কতক্ষন। বদনাম রটলে সত্য মিথ্যে তো কেউ যাচাই করবে না। ”
আমার বুকটা দুরুদুরু করছিলো ধ্রুব কি বলে তা শোনার জন্য। নতুন অপমানের আশঙ্কায় মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। ধ্রুব টাইপ শেষ। উরুতে একটা চাপড় মেরে নিজের কাজের সন্তুষ্টি প্রকাশ করলো। তরুর কথার জবাবে বললো,”তোমার সাথে কি ওর কিছু হয়েছে?” তরুর কৌশলে প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে বললো,”তোমার কি ধারণা আমি ওর সাথে ঝগড়া করে তোমার কাছে নালিশ করতে এসেছি?”
ধ্রুব কথা বাড়ালো না। বললো,”ঠিক আছে আমি ওকে আসতে বারণ করে দেবো।”

তরু বাধা দিয়ে বলল, “ছি!ছি! তুমি বারণ করতে যাবে কেন? তোমার সঙ্গে তো ওর ভালোমত পরিচয়ই হয় নি। তাছাড়া তুমি বললে বেচারি মনে কষ্ট পাবে।”

—“তাহলে মাকে বলবো ওকে আসতে বারণ করতে? মা কি আমার কথা শুনবে?”

তরু বোধহয় মনে মনে এটাই চাইছিলো। মুখে হাসি ফুটে উঠলো। আমি আর একমুহূর্তও দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। ছুটে বেরিয়ে গেলাম। একটা মানুষের সহজ, সরল, ভালো সেজে থাকার মাঝেও যে কতটা দুমুখোপনা থাকতে পারে তা ভেবে খুব কষ্ট পেলাম। এর চাইতে তরু যদি সামনাসামনি আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করতো তাহলেও বোধহয় আমার এতটা খারাপ লাগতো না। প্রচন্ড ঘৃনা হচ্ছিলো ওর প্রতি। কতটা কুরুচিপূর্ন মনমানসিকা! কিন্তু একটা প্রশ্নই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো ও ধ্রুবকে এসব কথা কেন বললো? ও কি আমার এবং ধ্রুবর সম্পর্কের কথা জানে? জেলাসি নাকি অন্যকিছু!

তারপর থেকে আজকে পাঁচদিন আমি ধ্রুবদের বাসায় যাই নি। আন্টি কয়েকবার তাদের কাজের লোককে দিয়ে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমি যাই নি। তারপর দিন আন্টি নিজে এলেন। ধ্রুব হলুদের জন্য কেনাকাটা করতে মার্কেটে যাবেন আমাকে সাথে নিয়ে। আমি তাঁর মুখের ওপর বারণ করতে পারলাম না। পাছে কেউ কিছু সন্দেহ করে। মা এমনিতেই বারবার জিজ্ঞেস করছিলো আন্টি এতবার করে ডেকে পাঠাচ্ছেন আমি যাচ্ছি না কেন? তাই রেডি হয়ে আন্টির সাথে শপিং করতে বেরোলাম। শপিং শেষে আন্টি আমাকে জোর করে তাঁদের বাসায় নিয়ে গেলো দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। আমি মনে মনে দোয়া করছিলাম আল্লাহ তরু যেন বাসায় না থাকে। আমার প্রার্থনা কবুল হলো। তরুর পরীক্ষা। গতকাল বিকেলে হোস্টেলে ফিরে গেছে। দরজা খুললো ধ্রুব। ওকে দেখ সংকোচ আরো বেড়ে গেলো। ও হাসিমুখেই জিজ্ঞেস করলো,”কেমন আছো?”

আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,”ভালো।” আন্টি রান্নাঘরের দিকে চলে গেলেন। ধ্রুব সোফায় আমার পাশে বসে বললো,”কি কি শপিং করেছো দেখাও এবার? দেখে তো মনে হচ্ছে পুরো মার্কেট কিনে নিয়ে এসেছো !” আমি হাসিমুখে একএক করে সব জিনিসপত্র ধ্রুবকে দেখালাম। ধ্রুব আগ্রহ নিয়ে দেখলো। দেখানো শেষে একসাথে তিনজনে খেতে বসলাম। খেতে বসেও ধ্রুব আমাদের শপিং নিয়ে করলো।

খাওয়া শেষে আন্টি তার ঘরে রেস্ট নিতে চলে গেলেন। আমি আর ধ্রুব সোফায় বসে ছিলাম। জানিনা কেন আজকে ধ্রুবকে একটু বেশিই ভালো লাগছে। এতদিনের আড়ষ্টতা অনকেখানিই কেটে গেছে। মনে মনে ওর প্রতি খুশি হলাম। তরুর কথা সে কানে নেয় নি। কিন্তু বেশ কিছুক্ষন গল্প ধ্রুব হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলো। বলল,”তোমাকে একটা কথা বলার ছিলো নিশাত।”

আমি সহজ সরলভাবেই বললাম,”বলোনা!”
কিন্তু ধ্রুব ইতস্তত করছিলো। বললো,”বুঝতে পারছি না কীভাবে বলবো?”
আমি ফের স্বতঃস্ফূর্তভাবে বললাম, “এত সংকোচ করছো কেন? বলো কি বলবে?”

ধ্রুব জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বললো,”মা তোমাকে খুব বিরক্ত করছে তাই না? আসলে মা এমনই যাকে তার পছন্দ হয় সারাক্ষণ তাকে জ্বালাতে থাকেন।” আমি ওকে বাধা দিয়ে বললাম, “এভাবে কেন বলছো? আন্টির সাথে গল্প করতে বেশ ভালোই লাগে।”

ধ্রুব আমার কথা গ্রাহ্য করলো না। তরুর তার মনে যে বিষাক্ত আভাস ঢুকিয়ে দিয়েছে তার পথ অনুসরণ করেই বললো,”আমি জানি তোমার মায়ের সাথে গল্প করতে ভালো লাগে। হয়ত তিনি আমার মা বলেই তুমি তার প্রতি বিরক্ত হচ্ছো না। কিন্তু আমি জানি মা খুব জ্বালান। তাই বলছিলাম এবার থেকে মা ডাকলে তুমি কোন কাজের অযুহাত দিয়ে তাঁকে না বলে দিও। কথাগুলো আমি মাকেই বলতাম, কিন্তু বলে কোন লাভ হবে না। তিনি তোমাকে বেশ পছন্দ করেন।”

রাগে আমার চোখমুখ লাল হয়ে গেলো। জ্বালাভরা কন্ঠে বললাম,”সেটা কি আমার দোষ?” ধ্রুব আমার রাগের পরোয়া না করে বললো,”আমি বলছি না তোমার দোষ। কিন্তু তুমি তাকে এত বেশি স্পেস দাও বলেই তিনি পেয়ে বসেছেন। এমনকি আমাদের হলুদের শপিংয়ে তিনি তরুকে নিয়ে না গিয়ে তোমাকে নিয়ে গেলেন? তরু খুব মন খারাপ করেছে। মাকে খুব ভালোবাসে তাই কিছু বলে নি। কিন্তু ব্যাপারটা তো সত্যিই খারাপ হলো তাই না? তাছাড়া আমি চাই না তোমার সম্পর্কে তরুর কোন খারাপ ধারণা হোক। ”

আমার মনে পড়লো আন্টি শপিংয়ে যাওয়ার সময় নিজে আমাকে বলেছেন তরুর সাথে ফোনে কথা হয়েছিলো। তার পরীক্ষা, সে যেতে পারবে না। অতএব ঘটনা পরিষ্কার। ধ্রুবকে এসব কিছুই জানায় নি সে। এবং ধ্রুবকে দিয়ে এসব কথা সে-ই বলাচ্ছে। এইমুহূর্তে লজ্জায়, অপমানে জর্জরিত হয়ে গেলাম। আন্টিকে ডেকে ধ্রুবর সামনে তরুর কুৎসিত রুপটা প্রকাশ করে দিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু কিচ্ছু বললাম না। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম,”তুমি কি আমাকে আসতে বারণ করছো?”

ধ্রুব নরম গলায় বললো, “না। তুমি আসবে। অবশ্যই আসবে। তবে মা যদি ভুলভাল কিছু করে তাহলে একটু দেখো। এসব নিয়ে কোন মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হোক আমি চাই না।”

আমি দাঁতেদাঁত চেপে রাগ ঠেকালাম। বললাম,”ঠিক আছে। এবার কি আমি যেতে পারি?” ধ্রুব লজ্জিত কন্ঠে “তুমি কি আমার কথায় দুঃখ পেয়েছো?”

আমি হাসলাম। বললাম,” না। কিন্তু তুমি একটা কথা খুবই ভুল বলেছো, আন্টিকে পছন্দ করি কারণ তিনি তোমার মা বলে এটা তোমার সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আন্টি যদি তোমার মা নাও হতো তাহলেও আমি তাকে ঠিক এখনকার মতই পছন্দ করতাম। তাই আন্টি যতদিন নিজে আমাকে বারণ না করবেন ততদিন আমি আসবো। পারলে তুমি কথাগুলো আন্টিকে বলো।”

এরপর থেকে আমি আন্টি ডেকে পাঠালে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে যেতাম যেন ধ্রুবর সাথে দেখা না হয়। আমি গেলেই আন্টি বিয়ের কেনাকাটা, আয়োজন নিয়ে গল্প শুরু করে দিতেন। আমি চুপচাপ শুনে যেতাম। কোনপ্রকার উৎসাহ দেখাতাম না। মনে মনে চাইতাম আন্টি বুঝুক আমি আসতে চাই না। কিন্তু আন্টি বুঝতেন না। আমিও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারতাম না। উনি আমার সাথে এতটা আপনভাবে কথা বলতেন যে ধ্রুবর সাথে সম্পর্ক না থাকলেও উনাকে এড়িয়ে যেতে পারলাম না।

দুই তিনদিন বাদে একদিন সন্ধ্যায় সুমাইয়া এসে হাজির। বললো, ধ্রুব এবং তরুর বিয়ে উপলক্ষ্যে ধ্রুব সবাইকে ট্রিট দিচ্ছে। আন্টি আমাকে যেতে বলেছেন। পরশু ধ্রুবর ছুটি শেষ। কাল চলে যাচ্ছে সে। তাই আজকে সবাইকে ট্রিট দিচ্ছে।” আমি সুমাইয়াকে বললাম আমি যাবো না। কারণ আমি জানি, আমি গেলে তরু খুশি হবে না। এতসব কিছুর পর নতুন করে আর কোন ঝামেলায় জড়াতে চাইলাম না। কিন্তু আন্টির জন্য কিছুই সম্ভব হলো না। কিছুক্ষন পর আন্টি নিজেই এলেন আমাকে ডাকতে। মাও বারবার ফোর্স করছে যাওয়ার জন্য। না গেলে অসামাজিক দেখাবে। জোর করে আমাকে রেডি করালেন। আমি রেডি হয়ে গিয়ে দেখলাম শুধু আমি না সীমা,সীমার বর ওরাও আছে। বেশ কয়েকটা ছেলেও আছে। একজনকে আমি চিনি। রাফি ভাই,ধ্রুবর বন্ধু। বাকিদের কাউকে চিনি না। ধ্রুবর বন্ধুবান্ধবই হবে।
ড্রয়িংরুমে বসে সবার জন্য অপেক্ষা করছিলাম না। ধ্রুব আমাকে দেখে অবাক হয়ে গেলো। বোধহয় ভাবতে পারে নি আমি যাবো! তবে বিরক্ত হলো না। মনে মনে শান্তি পেলাম। ওর চোখে চোখ পড়তেই খেয়াল করলাম ওকে বেশ সুন্দর লাগছে। কালো শার্টের ওপর ব্রাউন জ্যাকেটে দারুণ মানিয়েছে। তার সাথে হাতে কালো ঘড়ি! দুহাতের আঙ্গুল দিয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলো। আর শব্দ করে তরুর নাম ধরে ডাকছিলো। মিনিট পাঁচেক বাদে তরু বেরিয়ে গেলো। ও আমাকে দেখে খুশি হয়েছে নাকি বিরক্ত হয়েছে বুঝতে পারলাম না। আমিও এ নিয়ে বেশি মাথা ঘামালাম না।

রেস্টুরেন্টে ঢোকার পথে একটা অঘটন ঘটে গেলো। প্রচন্ড জোরে আমি হোঁচট খেলাম। পায়ের ব্যথা ভুলে তাড়াতাড়ি আশেপাশে খেয়াল করলাম কেউ দেখেছে কি না! কিন্তু না, সবাই যার যার মত ব্যস্ত। আমি দ্রুত হাঁটছিলাম। দোতলা বেয়ে উঠতে গিয়ে মনে হলো আমার জুতোর পাট্টা আলগা হয়ে গেছে। হাঁটার গতি মন্থর হয়ে গেলো। পা টেনে টেনে হাঁটছিলাম। যার ফলে আমি বাকি সবার থেকে পিছিয়ে পড়লাম। আমার অবস্থা তখন খুব খারাপ। খুবই বিব্রত বোধ করছিলাম। ওয়েটার দুজন আমার দিকে চেয়ে আছে।
আমার সামনে ধ্রুব আর রাফি ভাই কথা বলতে বলতে হাঁটছিলো। বাকিরা সবাই টেবিলে বসে গেছে। কি লজ্জাজনক পরিস্থিতি। ইতোমধ্যে ধ্রুব এবং রাফিও বাকিদের সাথে যোগ দিয়েছে। সামনে তাকাতেই ধ্রুবর চোখ চোখ পড়ে গেলো। আমি লজ্জায় চোখ নামিয়ে ফেললাম। চোখ নামিয়ে ফেললেও ধ্রুব যে আমার দিকেই চেয়ে আছে তা আমি বুঝতে পারছিলাম। ও চুপচাপ আমার পায়ের দিকে লক্ষ্য করছিলো। ওর দেখাদেখি রাফি ভাইও খেয়াল করলো। দুজনেই উঠে এলো। ধ্রুব আমার পায়ের দিকে ইশারা করে বললো,” কি হয়েছে?”
সেদিনের ঘটনার পর থেকে ধ্রুবর সাথে আমার কথা বন্ধ ছিলো। কিন্তু এইমুহূর্তে চুপ করে থাকা অসম্ভব। অসহায় কন্ঠে বললাম,”আমার জুতো ছিড়ে গেছে।”

রাফি ভাই উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”কীভাবে?” আমি বললাম, ভেতরে ঢোকার সময় হোঁচট খেয়েছিলাম।”

ধ্রুব আমার কথার পুনরুক্তি করে বলল,”হোঁচট খেয়েছিলাম। না দেখে হাঁটলে এমনই হবে।”

ওর কন্ঠে সূক্ষ্ম অবজ্ঞাটুকু টের পেতে আমার অসুবিধে হলো না। খুব লজ্জা লাগছিলো।
এত অস্বস্তিকর অবস্থায় বোধহয় আর কখনো পড়তে হয় নি। সামান্য জুতো ছিড়ে যাওয়াটাও যে মানুষের কতবড় অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে নিজে এই অবস্থায় না পড়লে বুঝতে পারতাম না। আমি করুন মুখে রাফি ভাইকে উদ্দেশ্য করে বললাম,”আমাকে বাসায় যাবো ভাইয়া।”

বলেছি ঠিকই কিন্তু এই অবস্থায় বাসায় যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। কারণ ছেঁড়া জুতো নিয়ে দোতলা বেয়ে নামার অবস্থায় আমি নেই। নিজের ওপর রাগ হলো। সত্যিই তো, এতগুলো মানুষ কারো কিছু হলো না। আমার সাথেই এসব হতে হলো! রাফি ভাই আমাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন,” রিলেক্স নিশাত। এত ঘাবড়ে যাচ্ছো কেন? অ্যাক্সিডেন্ট তো অ্যাক্সিডেন্টই! ” আমি তবুও গোঁ ধরে বললাম, “আমার ভালো লাগছে না রাফি ভাই। আমি বরং বাসায় চলে যাই।” ধ্রুব আমার পায়ের কাছে বসে কিছুটা বিরক্ত স্বরে বলল,” দেখি, জুতা খোলো।”

আমি হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমাকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে ধ্রুব আবারো তাড়া দিলো। অবশেষে জড়তা নিয়ে জুতোটা খুলে দিলাম। ও জুতোর আলগা হয়ে যাওয়া অংশটা টেনে আলাদা করে দিলো। রাফি ভাই আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আশেপাশের সবাই ধ্রুবর কান্ড দেখছে। এত লোকের সামনে রেস্টুরেন্টের মাঝখানে বসে জুতো নিয়ে টানাটানি করাটা খুবই লজ্জাজনক। কিন্তু ধ্রুব এসব কিছুরই কেয়ার করলো না। নিঃসংকোচে আমার অস্বস্তি দূর করে দিলো। আলগা পার্টটা নিয়ে বাইরে বিনে ফেলে দিলো। আমি রীতিমত অবাক হয়ে ওর দিকে চেয়ে ছিলাম। ওর স্বচ্ছতা, সুন্দর মনটা আবারো আমাকে ওর প্রতি দুর্বল করে দিছিলো। ধ্রুব হাত ধুয়ে এসে বললো,”নিচের পার্ট খুলে দিয়েছি। একটু উঁচুনিচু লাগবে। করার কিছু নেই। বাসায় না যাওয়া পর্যন্ত এভাবেই থাকতে হবে।”

টেবিলে বসে সীমা আমার জুতোর কন্ডিশন দেখে সন্দিগ্ধ কন্ঠে বললো,” জুতোর অবস্থা তো বেশি ভালো নয়। ছিঁড়ে যাবে মনে হচ্ছে।”

আমি অসহায় চেহারা নিয়ে ধ্রুবর দিকে চাইলাম। ধ্রুব সীমার কথায় পাত্তা না দিয়ে বললো,” ছিঁড়বে না।” কিন্তু আমার চিন্তা গেলো না। রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোনোর সময় যদি ছিঁড়ে যায়! তাহলে হয় আবার আমাকে টেনে টেনে হাঁটতে হবে নতুবা খালি পায়ে! রাফি ভাই আমার চেহারা দেখে হেসে ফেললেন। বললেন,”সিরিয়াসলি জুতোর টেনশনে তোমার চোখমুখ একেবারে ছোট হয়ে গেছে নিশাত। এত টেন্সড হওয়ার কিছু নেই নিশাত। ছিঁড়ে গেলে আমি আর ধ্রুব পালা করে তোমাকে কোলে নিবো নামবো। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।”
.
.
.
চলবে

ধ্রুব অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ৬

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৬

পরেদিন দুপুর বেলা ইউনিভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরতেই দারোয়ান জানালো আমার আপুর শ্বাশুড়ি মারা গেছে। আপু যেহেতু দেশে নেই। বাবা মা দুজনকেই চিটাগাং যেতে হলো। আমি ইউনিভার্সিটিতে ছিলাম বিধায় বাসার চাবি আন্টির কাছে দিয়ে গেছেন। দারোয়ান আমাকে ধ্রুবদের বাসা থেকে চাবি নিয়ে নিতে বললো।

আমি চাবি নেওয়ার জন্য ধ্রুবদের বাসায় গেলাম। দরজা খুললো ধ্রুব। ভেতরে ঢোকার পর জানতে পারলাম আন্টি মার্কেটে গেছেন। ফিরতে সময় লাগবে। ধ্রুব আমাকে বসতে বললো। কিন্তু আমি বেরিয়ে যাবো ভাবছিলাম। একা বাসায় ধ্রুবর সাথে থাকতে আমার সংকোচ বোধ হচ্ছিলো। এদিকে বাসায় তালা বন্ধ! গিয়ে বসবো কোথায়? দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম।

তাই দাঁড়িয়েই রইলাম। ধ্রুব সদর দরজা খুলে সোফায় বসে টিভি অন করলো। ওর হাতে ফোন, টিভি সে দেখছে না। ফোন নিয়েই ব্যস্ত! আমি দ্বিধাগ্রস্তভাবে ওর অপজিট সোফায় বসলাম। ও আমার দিকে রিমোট বাড়িয়ে দিয়ে বললো,”বোর হলে টিভি দেখতে পারো।” আমি রিমোট নিলাম। টিভিতে আমার মন নেই। আমি আড়চোখে ধ্রুবকে লক্ষ্য করছিলাম। দেখতে দেখতে হিপনোটাইজড হয়ে যাচ্ছিলাম! ওর মায়াভরা মুখটা আমার ভেতরে হাহাকারের বন্যা বইয়ে দিলো। একদিন যেই মানুষটার সমগ্র এটেশনের কারণ ছিলাম আমি আজ সেই মানুষটাই আমার প্রতি সবচেয়ে বেশি অনাসক্ত ! কি করি সহ্য করবো আমি! চোখের পানি নিঃশব্দে গাল গড়িয়ে নিচে পড়লো।
চোখ মুছে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ধ্রুব মনোযোগ দিয়ে ফোন স্ক্রল করছিলো। আমাকে ভূতগ্রস্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, “কি?”
ওর চোখে চোখ পড়তেই ফের কান্না চলে এলো। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। ধ্রুব সোজা হয়ে বসলো। অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে থেকে বললো,”কাঁদছো কেন?” আমি কান্নারত কন্ঠে বললাম, “আমার ভুল হয়ে গেছে ধ্রুব। আই এম সরি! ”

ধ্রুবর বিস্ময়ভাব কেটে গেলো। চেহারায় কষ্টের ছাপ দেখা দিলো। বোধকরি, আমার কান্নার হেতু সে বুঝতে পেরেছে। তবুও নিরবে চেয়ে রইলো কেবল। আমার কান্নার বেগ তাতে আরো বেড়ে গেলো। আমি অসহায় ভাবে কেঁদে চললাম। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,”আমি তোমাকে ভালোবাসি ধ্রুব। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।”

আমার কান্না, আমার আকুলতা কোনটাই মিথ্যে নয়। সেইজন্যই বোধহয় ধ্রুবর চোখে কোন অবিশ্বাস নেই। ও আমাকে বিশ্বাস করছে। আশার আলো খুঁজে পেলাম। কিন্তু মুহূর্তেই সেই ক্ষীণ আলো নিভে আমার সমস্ত পৃথিবীটাকে অন্ধকার হয়ে গেলো তখন ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—“আই এম সরি নিশাত! আমার পক্ষে তরুকে ঠকানো সম্ভব নয়। আমি ওকে ভালোবাসি।”

আমার কান্না থেমে গেলো। স্তব্ধ হয়ে ধ্রুবর দিকে চেয়ে রইলাম। ধ্রুব নরম গলায় বললো,”তরু খুব ভালো মেয়ে। আমি ওকে মাঝপথে ছেড়ে দিতে পারি না।”

লজ্জায়, অপমানে বিবর্ণ হয়ে গেলাম। জর্জরিত হয়ে গেলাম প্রত্যাখানের আঘাতে! এরপর আর কিছু বলার থাকে না। ফর দ্যা লাস্ট টাইম আমি পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করলাম ধ্রুবকে আমি সত্যিই হারিয়েছি। ওকে পাওয়ার অধিকার আমার চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গিয়েছে। সেই অধিকার এখন তরুর! অনুতপ্ত কন্ঠে বললাম,”ইট’স ওকে। ভুল আমারই। আমার বোঝা উচিৎ ছিল এখন এসব বলে কোন লাভ নেই। তোমার আমার সম্পর্কতো অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।”

ধ্রুব মায়াভরা কোমল কন্ঠে বললো,” আমি তো ভেবেছিলাম তুমি সত্যিই নতুন করে শুরু করতে চাইছিলে। তোমাকে হার্ট করার কোন ইন্টেশন আমার ছিলো না।”

যথার্থই এখন আর এসব বলে কোন লাভ নেই সেটা বুঝতে আমার কোন অসুবিধে হলো না। ধ্রুব তার অতীতটাকে মেমোরি কার্ডের মতনই পুরোপুরি ফরমেট করে সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করেছে। সুতরাং আমার সেখানে প্রবেশ অশোভন। চাপা কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিলো তথাপি প্রসঙ্গ বদলাবার চেষ্টা করে বললাম,”আন্টি কখন আসবেন?”

তাতে অবশ্য কাজ হলো। ধ্রুব স্থিরদৃষ্টিতে কিছুক্ষন আমার দিকে চেয়ে থেকে আন্টির নাম্বারে ডায়াল করলো। আমি ভেতরে চলে গেলাম।

আন্টি আসা পর্যন্ত আমি ভেতরের রুমেই বসে রইলাম। একটু আগে যা ঘটেছে তারপর আর ধ্রুব মুখোমুখি বসে থাকা চলে না। লজ্জায়, অপমানে সমস্ত শরীর নুইয়ে আসছে। যুক্তিহীন, ভিত্তিহীন, কথাবার্তা মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হচ্ছে ধ্রুব হয়ত ভেতরে ভেতরে আমাকে নিয়ে পরিহাস করছে! মজা নিচ্ছে! ওয়াশরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। ঘন্টাখানেক বাদে আন্টি আসলেন।
ধ্রুবকে দরজা খোলা রেখে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বললেন,”কি রে তুই বাসার দরজা হাঁ করে বসে আছিস কেন?”

ধ্রুব আন্টিকে জানালো বাসায় আমি আছি। আন্টির ভেতরে ঢুকে আমার চোখমুখের অবস্থা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। চিন্তিত মুখে বললেন,” তোর চেহারার এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে?”
ধ্রুব আন্টির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। ওর চোখে সহানুভূতি। লজ্জা, গ্লানি আমার ভেতরটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে দিচ্ছিলো। ওর চোখের সামনে থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো। ওর প্রত্যাখ্যান আমি সইতে পারলেও সিমপ্যাথি পারছিলাম না। কারণ ঐ জিনিসটা বারবার আমাকে নিজের কাছে ছোট করে দিচ্ছিলো। আমি আন্টিকে বললাম, আমার শরীর খারাপ লাগছে আমি বাসায় যেতে চাই। কিন্তু আন্টি আমাকে কিছুতেই উপরে যেতে দিলেন না। জোর করে আটকে রাখলেন। নিজের হাতে খাবার খাওয়ালেন। মাথা ব্যথার ওষুধ লাগিয়ে দিলেন। সবশেষে উনার ঘরে আমাকে নিরিবিলি শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। ঐমুহূর্তে যেটা আমার জন্য খুব দরকারি ছিলো। ধ্রুবকে হারানোর দমবন্ধ অনুভূতি সামলে নিতে একা থাকার বিকল্প কিছু নেই। আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলাম! সেদিন মা,বাবা ফিরলেন না। আমি ধ্রুবদের বাসায় রয়ে গেলাম।
সেই ঘটনার পর আমি খেয়াল করলাম ধ্রুব আমার সাথে কথা বলতে চাইতো। আমার সাথে সহজ হওয়ার চেষ্টা করতো। কিন্তু আমি সুযোগ দিতাম না। দূরে দূরে সরে থাকতাম। পরেরদিন বাবা মা ফিরলে আমি বাসায় চলে গেলাম।

ওদের বাসা থেকে চলে আসার পর আমার একটাই উদ্দেশ্য হয়ে উঠলো। সেটা হলো ধ্রুবকে ভুলে যাওয়া। এবং আবারো ব্যর্থ হলাম! ধ্রুব আমার মনের আকাশে ধ্রুবতারার ন্যায়
জ্বলজ্বল করতে লাগলো। আমার আঁখিপল্লবে অশ্রু হয়ে দেখা দিতো ধ্রুবর স্মৃতি!
তবুও পারতপক্ষে আমি ধ্রুবর সামনে যেতাম না। কিন্তু আন্টির সাথে রোজই দেখা হত। কখনো কখনো আন্টি নিজে আসতেন আবার কখনো কখনো ধ্রুব বাসায় না থাকলে আমিই যেতাম।

তিনচারদিন বাদে একদিন আমি ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরছিলাম। বাসার গেটে ধ্রুবর সাথে দেখা হয়ে গেলো। না চাইতেও আমার দৃষ্টি ওর ওপর গিয়ে পড়লো। ওকে খুব টায়ার্ড আর অস্থির লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো খুব তাড়ায় আছে। আমি নির্লিপ্ত থাকতে পারলাম না। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে? কোন সমস্যা?”

ধ্রুব আমার কথার জবাব না দিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। আগের মত হলে অপমানিত বোধ করতাম কিন্তু এখন সব সয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীরেসুস্থে উঠে বাসায় গেলাম। বাসায় ঢুকতেই সুলতানা জানালো আন্টি অসুস্থ, কন্ডিশন সিরিয়াস! মা ধ্রুবদের বাসায়। আমি ব্যাগ রেখে একছুটে ধ্রুবদের বাসায় চলে গেলাম।

নিচে অ্যাম্বুলেন্স এসেছে আন্টিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ধ্রুবর বোন এখনো এসে পৌঁছায় নি। তাঁর জন্য অপেক্ষা করার সময় নেই। অতএব ডিরেক্ট হস্পিটালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো তাঁকে। মা জানালো তিনি যাচ্ছেন আন্টির সাথে। আমি মায়ের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে দিলাম। ধ্রুব আর মা মিলে আন্টিকে হস্পিটালে নিয়ে গেলো।

রাত আটটার দিকে মায়ের কাছে ফোন করে জানতে পারলাম আন্টির কন্ডিশন এখন আগের চাইতে ভালো। হার্টঅ্যাটাক ছিলো। বিপদ এখনো পুরোপুরি কাটে নি। তাই কিছুদিন অভজারবেশনে রাখতে হবে। আজকে রাতে মা আন্টির কাছেই থাকবেন। ধ্রুব আর ওর বোন বাসায় আসছে। আমাদের বাসায় খাবে। আমি যেন ওদের জন্য রান্না করে রাখি। খাওয়ার পর ধ্রুব হস্পিটালে খাবার নিয়ে যাবে।

আমি আর সুলতানা মিলে সব রান্নাবান্না করে টিফিনে ভরে রাখলাম। ধ্রুব এলো সাড়ে নয়টার দিকে। ওদের ফ্ল্যাটে গিয়ে গোসল সেরে উপরে উঠলো। আমি আন্টির খোঁজখবর জিজ্ঞেস করে টেবিলে খাবার দিয়ে ভেতরে ঘরে গিয়ে বসে রইলাম। পরে মনে হলো কাউকে খেতে দিয়ে এভাবে চলে আসাটা খুবই অভদ্রোচিত হবে। তাই ডাইনিং টেবিলে ওর অপজিটে চেয়ার টেনে বসলাম। ও একটা কথাও বললো না। চুপচাপ খাওয়া শেষে টিফিন বক্স নিয়ে হস্পিটালে চলে গেলো।

আন্টিকে চারদিনের মত হস্পিটালে রাখা হয়েছিলো। ধ্রুবর বড় বোন প্রেগন্যান্ট! তাই বাসার সব কাজ, রান্নাবাড়া, এমনকি হস্পিটালে আন্টির জন্য নিয়ে যাওয়া কাপড়চোপড় সব আমিই ধুয়ে দিতাম। মা রোজ সকালে যেতো। সারাদিন হাসপাতালে আন্টির কাছে থেকে রাতে ধ্রুবর সাথে ফিরতো। খাবার নিয়ে ধ্রুব আবার হস্পিটালে চলে যেত। আমি ওর সামনে খুব একটা যেতাম না। সংকোচ বোধ হত। খাবার দাবার সব সুলতানাকে দিয়েই পাঠাতাম। তবে মাঝেমাঝে ও নিজেই এটা ওটা নিতে আসতো। কোনকিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে খবর পাঠাতো।

চারদিন বাদে আন্টিকে রিলিজ করা হলো। আমি আর মা আন্টিকে দেখতে গেলাম। মা ভেতরে ঘরে বসে আন্টির সাথে গল্প করছিলো। আমি কিছুক্ষন থাকার পর আন্টির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাদের বাসায় চলে আসছিলাম, সদর দরজা পেরোবার আগেই আচমকা হাতে টান অনুভব করলাম। ধ্রুব আমাকে টেনে ওর রুমে নিয়ে গেলো। এবং আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই হি কিসড মি ফর থার্টি সেকেন্ডস! ধ্রুব আচমকা এমন কাজ করতে পারে তা আমি স্বপ্নেও ভাবি নি! থর থর করে কাঁপতে শুরু করলাম আমি! বুকের ভেতর তখন অদ্ভুত রকমের ধুপধাপ শব্দ শুরু হলো। জীবনে এই প্রথমবার কেউ আমাকে চুমু খেয়েছে!

ধ্রুব যখন আমাকে ছাড়লো তখন আমি দুহাতের মুঠোয় ওড়নার কোনা চেপে ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। লজ্জায় মাথা তুলতে পারছিলাম না। ধ্রুব আমার মাথাটা টেনে ওর বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,”আই লাভ ইউ!”

কথাটা ধ্রুব একবারই বলেছিলো। কিন্তু আমার কানে হাজারবার, লক্ষবার হয়ে ইকো হলো। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম! কিংকর্তব্যবিমূঢ়! ঠিক সেইমুহূর্তেই ধ্রুব অসহায় কন্ঠে বললো,”আমার খুব হেল্পলেস লাগছে নিশাত। আমি কি তরুকে ঠকালাম?”

ধ্রুবকে বাস্তবিকই খুব উদ্ভ্রান্ত এবং দিশেহারা দেখাচ্ছিলো। দোটানায় ভুগছিলো সে। অসহায় বোধ করছে। আমি ধ্রুবকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম। ওর ওপর আমার কোন রাগ হলো না। তরুর ওপরও হলো না। আমি জানি তরু খুব ভালো মেয়ে! ও ধ্রুবকে ভালোবাসে। আমিও বাসি!
আমি ধ্রুবকে শান্ত করে বসালাম। দরজা খুলে পানি নিয়ে এলাম ওর জন্য। হাত দিয়ে ওর কপালের চুলগুলো গুছিয়ে দিলাম। ও শূন্য দৃষ্টিতে আমার কাজকর্ম দেখে যাচ্ছিলো। আমি মিষ্টি হেসে বললাম,”তুমি খামোখা কষ্ট পাচ্ছো। তুমি তরুকে ঠকাতে যাবে কেন? তুমি তো ওকে ভালোবাসো।”

ধ্রুব গম্ভীর গলায় বললো,”আই নেভার কিসড হার!”

আজকের আগ পর্যন্ত আমি নিজেও জানতাম না ধ্রুবকে আমি এতটা ভালোবাসি। ভেবেছিলাম তরুর সাথে ওকে দেখে ঈর্ষাবোধ হচ্ছিলো, জেলাস ফিল করছিলাম, আমাকে ভুলে এত তাড়াতাড়ি ও নতুন রিলেশনে যেতে পারে ভেবে কিঞ্চিৎ অপমান বোধও হয়েছিলো সেই জন্যেই তরুর সাথে একটা কম্পারিজন চলে এসেছিলো মনের ভেতর। মনে মবে সন্দেহ ছিলো তরুর প্রতি জেলাসি থেকেই বোধহয় ধ্রুবকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্কা করছিলাম। কিন্তু আজ বুঝতে পারলাম আমি ধ্রুবকে ঠিক কতটা ভালোবাসি! ওর জন্য নিজের জায়গা কেন আমি আমার সমস্ত পৃথিবীটা ছেড়ে দিতে পারি। ওর অসহায় চেহারা আমার কাছে শূলবেদনার চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক!
আমি স্মিত হেসে বললাম,”তাতে কি হয়েছে? ঝোঁকের বশে একটা চুমু খেয়ে ফেলেছো বলে তরুকে ঠকানো হয়ে গেলো? এটা কোন কথা?”

ধ্রুব বিমূঢ়, বিভ্রান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,”ঝোঁকের বশে?” আমি বললাম,”হ্যাঁ। ঝোঁকের বশে।”

ধ্রুব যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলো। বলল,”কিন্তু কেন?”

আমি খুব একটু হাসার ভান করে বললাম,”তার কারণ তুমি ইদানীং আমাকে নিয়ে খুব ভাবছিলে। আমার জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছিলো।”

ধ্রুব চুপ করে রইলো। কথাটা যে সত্যি তা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বললাম,”আমি সেদিন তোমাকে কথাগুলো বলেছিলাম বলেই তুমি এমন কান্ড করেছো।”

ধ্রুব অবিশ্বাসী কন্ঠে ফের প্রশ্ন করলো,”তুমি সিউর?” আমি দ্বিধাহীন ভাবে বললাম,”হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিউর। তুমি তরুকেই ভালোবাসো।”
ধ্রুব ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে রইলো। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বললাম,আচ্ছা, একটা কথা বলোতো সেদিন আমি কথাগুলো বলার আগ পর্যন্ত কি তোমার আমার কথা মনে হয়েছিলো?”

ধ্রুবর চোখমুখ করুণ হয়ে এলো। এর মানে আমার কথাটাই ঠিক। সেদিনের আগ পর্যন্ত ধ্রুবর আমার কথা মনে হয় নি। আমি এবার বেশ জোর দিয়েই বললাম, “তো? তুমি খামোখা এসব চিন্তা করছিলেন। আসল কথাটা হচ্ছে আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ায় আমার প্রতি একটা সিমপ্যাথি তৈরী হয়েছে তোমার। এবং তুমি সেটাকে ভালোবাসা ভেবে বসে আছো। তার অবশ্য কারণও আছে।আন্টির অসুস্থ অবস্থায় আমার সাথেই সবচেয়ে বেশি মেলামেশা হয়েছে তোমার। আমি তোমাদের বিপদে সহায়তা করেছি তাই আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার তোমার মনে খানিকটা অপরাধবোধ তৈরী হয়েছে। তুমি ভাবছো তুমি আমার সাথে অন্যায় করছো।”

—“তারমানে তুমি সিউর আমি তরুকে ভালোবাসি?”, দ্বিধাগ্রস্ত গলায় প্রশ্ন করলো ধ্রুব।

—“হ্যাঁ। তার কারণ তুমি আমার কাছে থাকা সত্ত্বেও তরুকে নিয়ে ভেবেছো।”

ধ্রুব আর কোন কথা বললো না। বেরিয়ে গেলো। আমি ভেতরের তরু নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে শুরু করলো। যাকে ফিরে পাবার জন্য এত আয়োজন ফের তাকে হারানোর আক্ষেপে গুমড়ে কেঁদে উঠলো। তবুও চাইছিলাম না ধ্রুব কোন দোটানায় থাকুক। আমার জন্য কোনরকম কষ্ট পাক! হ্যাঁ! আমি চাইলে এইমুহূর্তে হয়ত ধ্রুবর সুযোগ নিতে পারতাম। সেই সুযোগ আমার ছিলো কারণ এইমুহূর্তে আমি যা বলতাম ধ্রুব ঠিক তাই করতো। আমি যদি তরুকে ছেড়ে দিতে বলতাম ও তরুকে ছেড়ে দিতো। কারন ওর কাছে এইমুহূর্তে তরুকে ভালোবাসার চাইতে আমার প্রতি অপরাধবোধ বেশি প্রবল। ঠিক সেই কারনেই ধ্রুব আমার কাছে ছুটে এসেছে। কিন্তু আমি জানি এক সময় না একসময় ধ্রুব ঠিকই বুঝতো সে তরুর সাথে অন্যায় করেছে। ঐ একটা সত্যি আমাদের দুজনের সম্পর্কের মাঝে সীমাহীন দূরত্ব সৃষ্টি করে দিতো। ধ্রুব মুখে আমাকে মেনে নিলেও হয়ত সারাজীবন অপরাধবোধে ভুগতো। দুটো মানুষ পাশাপাশি থাকবে অথচ তাদের মনের মিল থাকবে না, এমন সম্পর্ক আমার চাই না। চাই না আমার এমন ধ্রুব যে আমার কাছে থাকা সত্ত্বেও অন্য কাউকে নিয়ে ভাববে। তাই আমি যা করেছি ঠিক করেছি।
.
.
.
চলবে

ধ্রুব অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ৫

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৫

বৌভাতের দিন মা আমাকে জোর করে সীমার শ্বশুরবাড়ি নিয়ে গেলো। আমি যেতে চাইছিলাম না। কারন ওখানেই গেলেই ধ্রুবর সাথে দেখা হবে। হয়ত তরুও সাথে থাকবে। আমি সহ্য করতে পারবো না। ওদের দুজনকে একসাথে দেখলে আমার ভেতরটা অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত জ্বলে উঠে। ভীষণ কষ্ট হয় আমার! কিন্তু আমার কোন অযুহাতই মা শুনলো না। বাধ্য হয়ে আমাকে যেতে হলো।

আমাদের জন্য যেই গাড়ি ব্যবস্থা করা হয়েছে তাতে আমি, মা, আন্টি,তরু, সুমাইয়া আরো অনেকেই ছিলো। কিন্তু ধ্রুবকে কোথাও দেখলাম না। মনে মনে খুশি হলাম। কিন্তু কে জানতো এই খুশিটুকু কেবল নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যই! সীমার শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে যখন ওকে দেখলাম না তখন ভেতরে ভেতরে আমার অস্থিরতা শুরু হয়ে গেলো। মনে প্রাণে চাইছিলাম ধ্রুব যেন আসে। একবার যেন ওর দেখা পাই। চারদিকে চোখ। বুলিয়ে শুধু ওকেই খুঁজছিলাম। ওর দেখা পেলাম খাওয়াদাওয়ার পর্ব শেষে।

আমি মায়ের সাথে ভেতরের একটা রুমে বসে রেস্ট নিচ্ছিলাম। আন্টি আর তরুও ছিলো। বসে থাকতে থাকতে বোর হচ্ছিলাম বিধায় সুমাইয়াকে বললাম,” চল, আশপাশটা ঘুরে আসি।” ও রাজি হয়ে গেলো। রুম থেকে বেরিয়ে কিছুদূর এগোতে দেখলাম ধ্রুব এদিকে আসছে। দেখে মনে হচ্ছে খুব তাড়ায় আছে। দশবারো বছরের একটা ছেলে রুমের কাছে ঘুরঘুর করছিলো। ধ্রুব ঐ ছেলেটার হাতে নিজের সেলফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বললো, “তরুকে বল ভাইয়ার ফোনের চার্জ শেষ। চার্জ দিতে হবে। ওর ব্যাগে ভাইয়ার চার্জার আছে।” ছেলেটা ফোন নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। ধ্রুব জড়িত ঘটনাগুলো আমার জীবনে এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ালো যে এই সামান্য ঘটনাটাও তখন আমার মনে ঈর্ষা জাগিয়ে দিলো। বিদ্রোহ ঘোষণা করলো তরুর প্রতি। ধ্রুব পাশে তরুর নামক কোন অস্তিত্ব আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। ভেতরটা জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছিলো।

কিন্তু আফসোফের বিষয় এই যে আমি চাইলেও কিছুই করতে পারছিলাম না। নিতান্ত রাগে দুঃখে আমি মায়ের কাছে গিয়ে বললাম, আমি এখুনি বাসায় যেতে চাই। মা তখন গল্পের আসর জমিয়ে ফেলেছে তাই রাজী হলো না। সবার সাথে একসাথে ফিরবে বললো। আমার মেজাজ তখন এতটাই খারাপ পারলে একা বেরিয়ে আসি। হঠাৎ আন্টি বললেন তার শরীর খারাপ লাগছে তিনি বাসায় ফিরে যাবেন। ধ্রুবকে খবর দেওয়া হলো। ধ্রুব এলে আন্টি রেডি হয়ে নিলেন বাসায় যাওয়ার জন্য। যাওয়ার সময় তিনি আমাকে সাথে যাওয়ার জন্য বললেন। আমি না করে দিলাম। তিনি শুনলেন না। ধমক দিয়ে বললেন,”এই মেয়ে,তোর যখন এখানে খারাপ লাগছে বসে থেকে কি করবি? তারচেয়ে আমার সাথে চল, বাসায় গিয়ে রেস্ট নিবি। তোর মা যখন ইচ্ছে ফিরুক।” মা-ও আমাকে আন্টির সাথে যাওয়ার জন্য জোর করলেন। অতঃপর আমি আন্টির সাথে বাসায় চলে এলাম। ধ্রুব আর তরুও ছিলো। ওদের দেখে ।না পারছিলাম সইতে না পারছিলাম কিছু বলতে এতটাই খারাপ অবস্থা ছিলো আমার।

বাসায় আসার কিছুক্ষন পর ধ্রুবকে দেখলাম আবার বেরিয়ে যেতে। ফিরলো একেবারে রাত সাড়ে দশটার দিকে। আমি আন্টির রুমে বসে গল্প করছিলাম। ধ্রুব ফ্রেশ হলে আন্টি টেবিলে খাবার দিলেন। টেবিলে তরুও ছিলো। আন্টি আমাকে জোর করে ওদের সাথে বসিয়ে দিলেন। ওদের দুজনের সাথে এক টেবিলে বসতে আমার খুব অকওয়ার্ড লাগছিলো। কিন্তু কিছু করার ছিলো না।

খাওয়ার সময় আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ওদের দুজনকে পর্যবেক্ষণ করলাম। কিন্তু বাড়াবাড়ি ধরনের কিছু চোখে পড়লো না। দুজনেই দুজনের মত খাচ্ছে। তরুর খাওয়া আগে শেষ হলে ও উঠে গেলো। টেবিলে তখন আমি আর ধ্রুব। শুরু হলো আমার হৃদযন্ত্রের বেসামাল ধুকপুকুনি। তীব্র থেকে তীব্রতর স্পন্দন! আমি আধখাওয়া প্লেট রেখে উঠে গেলাম। ধ্রুব খাওয়া শেষ করে ধীরেসুস্থে উঠলো।

খাওয়া শেষে তরু ড্রয়িংরুমে টিভি দেখতে বসলো। আমি একপাশে চুপচাপ বসে ছিলাম। আন্টি ভেতরের ঘরে শুয়ে ছিলেন।ধ্রুবর ঘরের বাতি নেভানো। একবার ভাবলাম উঁকি দেই। কিন্তু সাহস হলো না। উঠে আন্টির কাছে চলে গেলাম।

এগারোটার দিকে বাবা মা ফিরলেন। আমি তখন ভেতরের রুমে বসে ছিলাম। তরু বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলো। দরজা খুললো ধ্রুব। সে-ই আমাকে জানালো, মা দরজায় অপেক্ষা করছে। মা আসার খবর শুনে আমি আর আন্টি দুজনেই একসঙ্গে বেরিয়ে এলাম। ধ্রুব নিজের ঘরে চলে গেলো। আমিও আন্টির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে এলাম। কিন্তু তারপর থেকে সারাদিন সারারাত ধ্রবকে ভেবে পার করতে লাগলাম। আমার অলস দিনগুলোর একমাত্র আনন্দঘন মুহূর্ত হয়ে উঠলো ধ্রুবকে নিয়ে ভাবনার সময়টুকু! আমি বারবার করে চেয়েও নিজেকে ওর কথা ভাবা থেকে সরাতে পারি নি। আগে বুঝতে পারি নি ওকে অন্য কারো সাথে দেখলে আমার এত কষ্ট হবে! নতুবা আমি কখনোই ওকে ফিরিয়ে দিতাম না। কখনো না! কিন্তু এই কথাটা ওকে কি করে বোঝাবো! ও তো আমাকে ভুলেই গেছে।

পরেরদিন সকালে ইউনিভার্সিটিতে যাচ্ছিলাম। তরুকে ব্যাগপত্র নিয়ে বেরোচ্ছে। আন্টিকে জিজ্ঞেস করতেই বললো,”তরু হোস্টেলে ফিরে যাচ্ছে।” জীবনে এত খুশি বোধহয় কোনদিন হই নি যতটা খুশি এই খবরটা শুনে হয়েছি।

রাতের বেলা মনের আনন্দে ছাদে উঠলাম হাওয়া খেতে। তরু নেই। ভাবতেই বুকটা কেমন হালকা লাগছিলো। হঠাৎ ছাদের পশ্চিম পাশে চোখ পড়তেই ধ্রুবকে দেখলাম হাঁটতে হাঁটতে ফোনে কথা বলছে। ও আমাকে দেখতে পায় নি। আমার মাথায় কোন ভূত চাপলো জানি না, আমি আড়ালে চলে গেলাম। আমি অন্ধকারে পানির টাংকির পাশে গা ঢাকা দিয়ে রইলাম।

এদিকে আমাদের নতুন কাজের মেয়েটা আমাকে খুঁজতে ছাদে চলে এলো। নিশ্চই মা পাঠিয়েছে। ছাদের দরজায় দাঁড়িয়ে জোরে জোরে ‘নিশাত আফা’, ‘নিশাত আফা’ করে ডাক দিলো। আমি নড়লাম না। চুপচাপ পানির টাংকির পেছনে দাঁড়িয়ে রইলাম। ধ্রুব সুলতানার কাছে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,”কি হয়েছে?”

সুলতানা ছাদে আসতে ভয় পাচ্ছিলো বোধহয়। ভয়ে ভয়ে বললো,” নিশাত আফারে আম্মা ডাকে। হ্যায় একলা কাউরে না জানায়া ছাদে উইঠ্যা আসছে। আফনে একটু দ্যাখবেন ভাইজান?” ”

ধ্রুব ফোনের টর্চ অন করে ছাদের চারপাশ ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করলো। বিপাকে পড়ে গেলাম! আবার ওর মুখোমুখি পড়তে হবে ভেবে বুকের ভেতর তীব্র মাত্রার ভাইব্রেশন চালু হয়ে গেলো। ও এদিকটায় আসার আগেই আমি নিজে থেকেই বেরিয়ে গেলাম। ও চমকে উঠে বলল,”তোমাকে সুলতানা কতবার করে ডাকছে শুনতে পাও নি?”

ভাগ্য ভালো আমার হাতে ফোন আর হেডফোন ছিলো। গান শুনবো বলে নিয়ে এসেছিলাম। আমি হেডফোন দেখিয়ে বললাম,”গান শুনছিলাম। তাই শুনতে পাই নি।”

ধ্রুব বিরক্ত বোধ করলো। বোধ করি আমার একা একা ছাদে দাঁড়িয়ে থাকাটা ও ভালোভাবে নেয় নি। বললো,”আন্টি তোমাকে ডাকছেন। তাড়াতাড়ি নিচে যাও।”

আমিও আর দাঁড়ালাম না। সুলতানার সাথে নিচে নেমে গেলাম। নিচে নামার পরের স্মৃতিও খুব একটা সুখকর নয়। একা একা ছাদে যাওয়ার অপরাধে মা খুব বকাবকি করলো। যদিও মায়ের এসব বকাবকি কিছুই আমার কানে ঢুকছিলো না। আমি শুধু ভাবছিলাম ধ্রুব নিশ্চই ফোনে তরুর সাথে কথা বলছিলো। এই কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছিলো। পাগল পাগল লাগছিলো। এতদিনের থম মেরে থাকা কান্নাটা ভারী বর্ষণের ন্যায় বেরিয়ে এলো। আমি বুঝতে পারলাম ধ্রুবকে আমি হারিয়েছি। ধ্রুব আমার চেয়েও অনেক বেশি জেদী। ও যদি একবার কিছু ঠিক করে নেয়, তার থেকে ওকে ফেরানো অসম্ভব!

কিন্তু আমার ব্যাকুল হৃদয় বারবার শুধু একটা কথাই বলছিলো ধ্রুবকে আমার চাই। যেভাবেই হোক চাই! আমি জানি না এটা ভালোবাসা নাকি ঈর্ষা, আমি শুধু জানি ওকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। কিছুতেই পারবো না। ওকে ফিরে পেলে আমি কি করে বাবা মায়ের সামনে মুখ দেখাবো,তাও আমি জানি না কিন্তু এইমুহূর্তে শুধু একটা কথাই আমি জানি, তা হলো ধ্রুবকে আমার চাই। নয়ত আমি মরে যাবো।
.
.
.
চলবে

ধ্রুব অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ৪

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৪

বাবা খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারলো আমার হবু বরের বাবা মানে আমার হবু শ্বশুর দুই বিয়ে করেছেন। ছয় বছর সংসার করার পর তিনি তার প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। আমার হবু বর দ্বিতীয় পক্ষের। প্রথম পক্ষে একটা কন্যা সন্তানও আছে। কন্যাসমেত প্রথম স্ত্রীকে কোন এক অজ্ঞাত কারনে বাড়ি থেকে বের করে দেন তাঁর বাবা। অতএব এখানে সম্বন্ধ ক্যান্সেল। এমন পরিবারে বাবা মেয়ের বিয়ে দেবেন না। ছোটমামা খুব করে বোঝালো ছেলে খুবই ভালো। কিন্তু বাবাকে কোনভাবেই রাজী করানো গেলো না। তিনি কিছুতেই সম্মত হলেন না। সুতরাং বিয়ে ক্যান্সেল।

খবরটা শুনে আমি উচ্ছ্বাস কিংবা উদ্বেগ কোনটাই প্রকাশ করলাম না। আমি আমার মত করে চলছিলাম। তবে মনে মনে আমিও খুশি হয়েছি। কারণ এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার কোন ইচ্ছে আমার নেই! নিজেকে আরেকটু চেনার বাকি আছে, জানার বাকি আছে। হঠাৎ করেই কোন দায়িত্ব কাধে নিতে চাই না।

বিয়ে ক্যান্সেল হওয়ার মাসখানেক বাদে একদিন মায়ের কাছে শুনলাম সীমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। পাত্র ভূমি অফিসার। তাইজন্যই সীমাকে অনেক দিন দেখি না। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় সীমা আর তার মা এলো আমাদের দাওয়াত দিতে। বিয়ে এই বাসাতেই হবে। আগামী পরশু গায়ে হলুদ। সীমা বারবার করে জানালো আমি যেন হলুদের দিন সকালেই ওদের বাসায় পৌঁছে যাই। দেরী করলে চলবে না। আমি ওকে আশ্বস্ত করে বললাম আমি ঘুম থেকে উঠেই ওদের বাসায় চলে যাবো।

বিয়ে উপলক্ষ্যে আবার পুরো বাড়িটা প্রাণবন্ত হয়ে উঠলো। লাইটিং এর আলো আর মেহমানদের আনাগোনায় চারদিক সরব। একেবারে উৎসবমুখোর পরিবেশ। ভালোই লাগছিলো। তবে এই কয়দিনে আমার একবারও ধ্রুবর সাথে দেখা হয় নি। ও আছে কি নেই তাও জানি না। অবশ্য এত তাড়াতাড়ি যাওয়ার কথাও নয়। আন্টি বেশ কয়েকবার আমাদের বাসায় এসেছিলো। চলে গেকে নিশ্চই উনি বলতেন। সুতরাং ধরে নেওয়া যায় ধ্রুব বাসায় আছে।

অবশেষে, হলুদের দিন সন্ধ্যাবেলায় ছাদে ধ্রুবর দেখা পেলাম। কালো পাঞ্জাবি আর সাদা চুড়িদার পরে হিরো সেজে এসেছে। হাতে ক্যামেরা। দারূণ লাগছিলো ওকে। ও আমাকে খেয়াল করে নি। এসেই স্টেজের দিকে চলে গেলো।

আমি ওর কাছ থেকে দূরে দূরে সরে রইলাম। সেদিনের পর থেকে ওর মুখোমুখি হতে অস্বস্তি হচ্ছিলো। তাই অনুষ্ঠান শুরু হলে মেহমানদের ভিড়ে গিয়ে বসে রইলাম। ধ্রুব ঘুরে ঘুরে সবার ছবি তুলে দিচ্ছিলো। আমি যখন সীমাকে হলুদ লাগাতে গিয়ে ওর মুখোমুখি হলাম আমি। ও বিনা সংকোচে অন্য সবার মত আমাদেরও ছবি তুলে দিলো। হলুদ পর্ব শেষ হতেই শুরু হলো নাচ গানের পালা। আমাদের ভাড়াটিয়া কয়েকটা মেয়ে, তরু, সীমার দুটো কাজির স্টেজে কয়েকটা হিন্দি বাংলা গানের সাথে নাচলো। ধ্রুবকে দেখলাম ক্যামেরা হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরে ভিডিও করছে। আমি নাচ, গান কিছুই করলাম না। মেহমানদের মত চুপচাপ বসে অনুষ্ঠান উপভোগ করলাম। আর মাঝে মাঝে আড়চোখে ধ্রুবর কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করছিলাম।

অনুষ্ঠান শেষে একে একে সবাই নিচে নেমে গেলো। আমিও নেমে যাচ্ছিলাম হঠাৎ একটা জিনিস দেখে থমকে গেকাম। ধ্রুব ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তরুর সাথে কথা বলছে। আমার সাথে সুমাইয়া ছিলো। ও আমাকে ইশারা দিয়ে বললো,”ঐ যে ধ্রুব ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড! চেনেন আপনি?” আজ আর আমি সেদিনের মত নির্লিপ্ত থাকতে পারলাম না কারণ আজকে ওদের দুজনকে একেবারে অন্যরকম লাগছে। সেদিনের ধ্রুব এবং তরুর সাথে আজকের ধ্রুব এবং তরুর অনেক তফাত!
মনের মধ্যে খচখচ করে উঠলো। ওদের মাঝে কি সত্যিই কিছু চলছে? আমি কৌশলে সুমাইয়ার কাছ থেকে জানতে চাইলাম সে কি করে ধ্রুব এবং তরুর সম্পর্কের কথা জানলো। সুমাইয়া জানালো, তরুই নাকি ওকে আর সীমাকে তার এবং ধ্রুব রিলেশনের কথা জানিয়েছে। সে নাকি ধ্রুবকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতো। অবশেষে অনেক দিন অপেক্ষা করার পর ফাইনালি তারা দুজন এক হয়েছে।

আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সব মিথ্যে বলে মনে হচ্ছিলো। হঠাৎ আমার মনে পড়লো তরু যখন স্টেজে উঠেছিলো তখন কেউ একজন ‘ধ্রুবর’ নাম ধরে চেঁচিয়ে উঠেছিলো। আমার মাথা ঝিমঝিম করে উঠলো। বুকের ভেতর প্রবল ধাক্কা অনুভব করলাম। ধ্রুব আর তরু কি তাহলে সত্যি সত্যি..! আর কিছু ভাবতে পারলাম না। তীব্র হতাশা অনুভব করলাম।

ওদের দুজনকে এদিকে এগিয়ে আসছিলো। ধ্রুব আমাদের কাছে এসে খুব স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করলো,”কি ব্যাপার তোমরা নিচে নামবে না?”

প্রতিউত্তরে আমি এবং সুমাইয়া মুচকি হাসি দিলাম। সুমাইয়া কেন হেসেছে আমি জানি না কিন্তু আমি হাসলাম ধ্রুবর সামনে নিজেকে স্বাভাবিক প্রমাণ করার জন্য। তরু এসে আমাদের পাশে দাঁড়ালো। সুমাইয়ার সাথে দুষ্টুমি করছিলো। মেয়েটার কথাবার্তা শুনে মনে হলো বেশ ম্যাচিউর। বয়সে বোধহয় আমার চেয়ে একটু বড় হবে। আমি ভালোভাবে খেয়াল করে দেখলাম বাচ্চাসুলভ কোন পাগলামি নেই তাদের দুজনের মাঝে। থাকলে হয়ত আমি খুশিই হতাম। নিজেকে বোঝাতে পারতাম এরা দুজন ন্যাকা! এদের থেকে দূরে থাকাই ভালো। কিন্তু সেরকম কিছুই আমার চোখে পড়লো না! ওদের প্রেমটা খুব গাঢ় মনে হচ্ছে। ধ্রুবর মুখ দেখে আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম আমার ওপর রাগ কিংবা অভিযোগ করে নয় ধ্রুব সত্যি সত্যিই নতুন করে শুরু করেছে। ওর মাঝে কোন পাগলামি নেই। ধ্রুব বরাবরই বিচক্ষণ এবং স্ট্রং পার্সোনালিটির একজন মানুষ। আজ আবারও সেটা প্রমাণ করে দিলো সে। ও বলেই হয়ত সবকিছু পজেটিভলি নিয়ে নতুন করতে শুরু করতে পেরেছে। অন্য কেউ হলে এত সহজে সবকিছু ভুলতে পারতো না। এই প্রথম আমি কিছু হারানোর অনুভূতি উপলব্ধি করলাম। অথচ ওর সাথে ব্রেকাপের পরেও কখনো এই ফিলিংস হয় নি।

আমি ধ্রুবকে তরুর সাথে সহ্য করতে পারছিলাম না আবার মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছিলাম মা। উভয় সংকটে পড়লাম। ওর সাথে সম্পর্কে জড়ানোর সাহসও আমার নেই আবার ওর সাথে অন্য কাউকে সহ্য করার ক্ষমতাও নেই। নিজেকে খুব অসহায় লাগছিলো। সে সাথে অপমানবোধও হচ্ছিলো। ধ্রুব এত সহজে আমাকে ভুলে গেলো! অথচ আমার মনে একবারের জন্যেও প্রশ্নটা জাগলো না সেদিন আমিও তো নিষ্ঠুরভাবে ধ্রুবর মুখের ওপর না বলে দিয়েছিলাম। নিঃসংকোচে, অকপটে স্বীকার করে নিয়েছিলাম আমি ওকে ভালোবাসি না! তাহলে ও কেন পারবে না? একমুহূর্তেই আমার ভেতরটা ধ্রুবকে ফিরে পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। পিপাসায় উন্মুখ হয়ে উঠলো নিজের হারানো জায়গা ফিরে পাওয়ার জন্য। কিন্তু কি করলে ওকে ফিরে পাবো বুঝতে পারছিলাম না। দুর্ভেদ্য কান্নাটাকে ঠেকিয়ে রাখতে তাড়াতাড়ি নিচে নেমে গেলাম। সারারাত বিছানায় শুয়ে ছটফট করলাম, কিন্তু কোন কূলকিনারা খুঁজে পেলাম না। বারবার মনে হচ্ছিলো আমি অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। কি করলে সেই ভুল সংশোধন করতে পারবো দিনরাত তাই ভেবে চলছিলাম।

বিয়ের দিন আমি পার্লারে গিয়ে সাজলাম। খুব সাজলাম। সাজ শেষে তৃপ্ত চোখে নিজেকে দেখলাম। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছি আমি সুন্দরী। কখনো এমনভাবে নিজেকে দেখি নি। কিন্তু আজ দেখলাম! আমার সাথে অন্যরা যারা পার্লারে সাজতে এসেছে তারাও আমার সাজ দেখে খুব প্রশংসা করলো। এমনকি পার্লারের মহিলা যিনি সাজাচ্ছিলেন তিনিও বললেন সবার চাইতে আমাকেই বেশি সুন্দর লাগছে। আমাকে কখন সুন্দর লাগে তা আমি বুঝতে পারি। সুতরাং আজকের সাজ দেখে আমি বুঝতে পারলাম সবাই মিছেমিছি প্রশংসা করছে না। আমাকে সত্যিই সুন্দর লাগছে।

বউ নিয়ে পার্লার থেকে বাসায় ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে গেলো। ঘরে ঢুকতেই সবাই আমাকে নিয়ে পড়লো। আগে কখনো আমাকে এত সাজতে কেউ দেখে নি। সমবয়সীরা নানারকম ইশারা ইঙ্গিতে জানতে চাইলো আজকে কাকে দেখানোর জন্য আমি এত সেজেছি? সবার অবস্থা দেখে আমার খুব লজ্জা লাগছিলো। আমি সেখান থেকে উঠে বাইরে চলে এলাম।

কিন্তু ধ্রুবকে কোথাও দেখতে পেলাম না। হঠাৎ খেয়াল করলাম সবাই নিচে ছবি তুলছে। আমি নেমে গেলাম। ফটোগ্রাফার ধ্রুব! ছবি তোলার সময় আমি তরুর সাথে নিজেকে কম্পেয়ার করে দেখলাম। নিজের প্রশংসা নয়, বাস্তবিকই তরুর চাইতে আমাকে অনেক বেশি সুন্দর দেখাচ্ছিলো। ধ্রুবকে যখন ছবি তুলে দিতে বললাম ও নিঃসংকোচে রাজী হয়ে গেলো।

ছবি তোলা শেষে আমরা সবাই গোল হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। তরুও আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। ধ্রুব দাঁড়িয়েছিল অপরপাশে। হঠাৎ কেউ একজন ধ্রুবকে ইশারায় তরুকে দেখালো। প্রতিউত্তরে ধ্রুব মুচকি হাসলো। আমার কলিজায় খামচি মেরে উঠলো। এত সাজগোজ সব বেকার মনে হলো। ধ্রুব কোন বাড়াবাড়ি করে নি তরুকে নিয়ে। কিন্তু ঐ একটু মুচকি হাসিই আমাকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তরুর প্রতি ঈর্ষা বোধ করলাম। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম ধ্রুব আমার ওপর কোন প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য এসব করছে না। হি ইজ সিরিয়াস! কারণ ওর মাঝে কোন পাগলামি নেই। আমার ভয়টা আরো দ্বিগুন বেড়ে গেলো। খেতে বসে কিছুই খেতে পারলাম না। সবকিছু বিষাদ মনে হচ্ছিলো। শরীর খারাপের অযুহাত দিয়ে বাসায় চলে এলাম।
.
.
.
চলবে

ধ্রুব অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ৩

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৩

আমার সম্মতি পেয়ে বাবা ছেলের সব খোঁজখবর নেওয়ার জন্য লোক লাগিয়ে দিলেন। প্রায় রাতেই তিনি এবং মা মিলে গভীর আলোচনায় বসতেন। মাঝেমাঝে ছোটমামার কাছে টেলিফোন করে কিসব খবরাখবর নিতেন। আমার সেসব নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কারণ সেমিস্টার ঘনিয়ে এসেছে। অতএব পড়াশোনা করতে হবে। তাই মন দিয়ে পড়াশোনা করছিলাম। যদিও আমি খুব ভালোছাত্রী নই। কিন্তু তাই বলে তো পরীক্ষার সময় হাত পা গুটিয়ে থাকলে চলবে না। তাই পরীক্ষার আগের দিনগুলো পড়াশোনাতেই ব্যয় করলাম।

দেড়মাস বাদে পরীক্ষা শেষ হলো। ধ্রুব গিয়েছে প্রায় ছয়মাসের মত হয়ে গিয়েছে। শুনেছি বাসায় এসেছে তবে আমার সাথে দেখা হয় নি। আমি ওদের বাসায় যাই না। বেশ কয়েকদিন বাদে একদিন বিকেলে দিকে ছাদে দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছিলাম। অকস্মাৎ হাতে টান অনুভব করতেই চমকে উঠলাম! ধ্রুব আমার হাত চেপে ধরেছে। ও ছাদে উঠেছে কখন আমি খেয়াল করি নি। আমি প্রকৃতি দেখতে ব্যস্ত ছিলাম। বিকেলবেলা ছাদে ফুরফুরে বাতাস থাকে। বসে থাকতে খুব ভালো লাগে। আমি নিঃশব্দে উপভোগ করছিলাম। ওকে আচমকা আমার হাত ধরতে দেখে ভয়ে ভয়ে আশেপাশে তাকালাম। তার কারণ কেউ দেখে ফেললে আমার মানসম্মান সব শেষ! আমি ওর হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট শুরু করলাম। ও আমাকে টেনে সিঁড়িপথে নিয়ে এলো। বিরক্তমুখে জিজ্ঞেস করলো আমার এসব পাগলামির উদ্দেশ্যে কি?

আমি বুঝতে পারছিলাম ও হয়ত আমার বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করছে। তবুও না বোঝার ভান করে বললাম,”কোনসব পাগলামি?”

আমি যে খুব সহজে কোন প্রশ্নের উত্তর দেবো না সেটা বুঝতে পেরেই ধ্রুব সরাসরি প্রশ্ন করলো,”তোমার বিয়ে?”

আমি অবাক হওয়ার ভান করে বললাম,”আশ্চর্য! এখানে পাগলামির কি হলো? আমার বাসা থেকে আমার বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। সেটাকে আপনার পাগলামি মনে হচ্ছে কেন?”

ধ্রুব আমার নাটকে পাত্তা দিলো না। বললো,”হচ্ছে। কারণ তুমি আমাকে ভালোবাসো। আমি তো এটাই বুঝতে পারছি না তুমি বাধা দিচ্ছো না কেন?”

আমি পুনরায় অবাক হয়ে বললাম,”আমি বাধা দেবো ? কেন? আমার কি বাধা দেওয়ার কথা ছিলো?”

এই কথা শুনে ধ্রুব অগ্নিদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। পরোক্ষনেই আত্মসংবরণ করে বললো,”তোমার বাধা দেওয়ার কথা ছিলো না?”

আমি দৃঢ় কন্ঠে বললাম,”না। আর থাকলেও আমি বাধা দিতাম না। বাবা মায়ের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।”

ভেবেছিলাম কথাটা বলার পর ধ্রুব হয়ত রেগে যাবে। আমাকে অনেক কথা শোনাবে। ও সেসব কিছুই না করে বললো,”ঠিক আছে। তোমার তুমি বলতে না পারো তো আমি কথা বলবো তোমার বাসায়!”

আমি বাধা দিয়ে বললাম,”আপনি কেন বলবেন?”

—“কেন বলবো আবার? আমি তোমাকে ভালোবাসি তাই।”

আমি পূর্বের চেয়ে দ্বিগুণ দৃঢ় কন্ঠ বললাম,”না। আপনি কিচ্ছু বলবেন না।”

ধ্রুব রেগে গেলো। চোখলাল করে বললো,”না কেন? তুমি নিজেও বলবে না, আমাকেও বলতে দেবে না কেন?”

—“কারণ আপনার সাথে আগেই আমার সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। এখন আপনি আমার কাছে শুধুমাত্র আমার এক্স!”

—“তুমি আমাকে ভালোবাসো না?”

—“না।”

ধ্রুব অবাক করা দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার অস্বস্তি হচ্ছিলো। আমি ছাদ থেকে নেমে আসতে চাইলাম। ধ্রুব পথ অবরোধ করে দাঁড়ালো। আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,”তুমি সিউর, তুমি আমাকে ভালোবাসো না?”

আমি একই রকমভাবে বললাম,”না। বাসি না।”

ধ্রুব ফের প্রশ্ন করলো, “বাসো না?” ওর চোখেমুখে স্পষ্টত অবিশ্বাস। আমি জোর দিয়ে বললাম, “বললাম তো বাসি না।”

ধ্রুব তখনো আমার হাত ধরে ছিলো। নরম গলায় বললো,”আমি যে তোমার জন্যই এসেছিলাম!”

—“কেন এসেছেন? আমি কি আপনাকে আসতে বলেছি? বলি নি। তাহলে কেন এলেন? আপনার সাথে তো সেই কবেই আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। ইনফেক্ট ঐ সম্পর্কটার কথা আমি ভুলেই গেছি।”

ধ্রুব একদৃষ্টিতে আমার দিয়ে চেয়ে রইলো কিছুক্ষন। ওর সেই দৃষ্টি সার্চলাইটের মত আমার সমগ্র মুখে বিচরণ করছিলো। আমি অস্বস্তি লাগছিলো। ওর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি থেকে নিজেকে লুকাতে মাথা নিচু করে ফেললাম।
ধ্রুব অবিশ্বাসী কন্ঠে বললো,”তুমি অনেক বদলে গেছো নিশাত। এই নিশাতকে আমি কখনো ভালোবাসি নি।” তারপর আমার হাত ছেড়ে দিলো। ও এত সহজে রাজী হয়ে যাবে আমি ভাবতে পারি নি। আমার একটু খারাপ লাগলো। নরম গলায় বললাম,”সরি! আমি তোমাকে হার্ট করতে চাই নি। কিন্তু আমার কিছু করার নেই।”

সত্যিই এইমুহূর্তে আমার কিছু করার নেই। কারণ বাবা মা যদি ঘুণাক্ষরেও টের পায় ধ্রুবর সাথে আমার রিলেশন আছে কিংবা ছিলো তাহলে তারা খুব কষ্ট পাবে। পাত্র হিসেবে তারা ধ্রুবকে পছন্দ করলেও মেয়ে হিসেবে তাদের কাছে আমি খুব ছোট হয়ে যাবো। আমার প্রতি তাদের বিশ্বাসের জায়গাটা সারা জীবনের জন্য নড়বড়ে হয়ে যাবে। ছোটবেলায় জেদের কারণে তারা আমাকে কখনো বিশ্বাস করতে পারে নি। অনেক কষ্টে বিশ্বাসের জায়গাটা তৈরী করেছি। ধ্রুবর জন্য আমি সেই জায়গা হারাতে চাই না। তাই ধ্রুবকে ফিরিয়ে দেওয়া ছাড়া আমার কাছে আর কোন উপায় নেই। তবে ধ্রুবর জন্য আমার খারাপ লাগছিলো।

ধ্রুব আমাকে খুব অবাক করে দিয়ে বললো,”ইটস ওকে! সময়ের সাথে সাথে মানুষ পুরোনো অনেক কিছুই ভুলে যায়। তুমিও ভুলে গেছো। এটাই প্রকৃতির নিয়ম। হয়ত আমারও ভুলে যাওয়া উচিৎ ছিলো। কিন্তু কি করবো বলো? তোমাকে ভুলে যাওয়ার কথাটা এতদিনে একবারের জন্যেও মাথায় আসে নি। তবে এবার আর ভুল হবে না। কারণ তুমি নিজমুখে স্বীকার করেছো তুমি আমাকে ভালোবাসো না তাই এইমুহূর্ত থেকে তোমার সাথে আমার সব সম্পর্ক শেষ।”

খুবই অপ্রত্যাশিত সহজভাবে কথাগুলো বললো ধ্রুব। আমি আশ্চর্য হলাম। খেয়াল করে দেখলাম ওর চোখে কোন রাগ কিংবা অভিযোগ নেই। সম্পূর্ণ ধীরস্থির সৌম্যমূর্তি! যেন এই অল্পকিছুক্ষনের মধ্যেই নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করে ফেলেছে সে। আমি হতভম্ভ হয়ে চেয়ে রইলাম। আমার অবস্থা দেখে ধ্রুব একটু হাসলো। বললো,” আমি ভালোবাসা প্রাপ্তিতে বিশ্বাসী, ব্যর্থতায় নই। তুমি আমাকে ভালোবাসো না তারমানে আমি কোনদিন তোমাকে ততটা গভীরভাবে ভালোবাসতেই পারি নি যতটা গভীরভাবে ভালোবাসলে তুমি আমাকে ভালোবাসতে। সুতরাং তোমাকে পাওয়ার অধিকার আমার নেই। আজ থেকে আমার সাথে তোমার আর কোন সম্পর্ক রইলো না। দ্যা রিলেশনশীপ ইজ ওভার ফ্রম নাউ! আমাদের নতুন করে শুরু করা উচিৎ। আশাকরি এতে আমাদের দুজনেরই ভালো হবে। উইশ ইউ আ ভেরি গুড লাক! আসি আমি!”

আমি স্তব্ধ হয়ে ধ্রুব চলে যাওয়া দেখলাম। ও আমাকে আর একটা কথাও বলার সুযোগ দেয় নি। আমাকে রেখেই নিচে চলে গেলো। আমি সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। দারূণ ভাবে ইনসাল্ট ফিল করছিলাম। সবকিছু কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। ভয় করতে শুরু করলো আমার। কারণ আমি জানি ধ্রুবর এইমাত্র বলে যাওয়া কথাগুলো একটাও মিথ্যে নয়। সে যা বলেছে তাই করবে।
.
.
.
চলবে

ধ্রুব অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ২

# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ২

মেয়েটার নাম তরু। হিরো মহাশয়ের মামাতো বোন। তবে অনাথ। ছোট বেলায় মা বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তরু ধ্রুবর মায়ের কাছেই বড় হয়েছে। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ওদের বাসাতেই ছিলো। ইউনিভার্সিটিতে উঠার পর হোস্টেলে শিফট হয়ে যায়। বর্তমানে হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করছে। বিয়ে উপলক্ষ্যে বোধহয় বাসায় এসেছে। ধ্রুবর সাথে ওকে দেখে সীমা আর সুমাইয়া ধ্রুবর গার্লফ্রেন্ড ভেবে বসে আছে। তবে তরু ভীষণ সুন্দরী। মেকাপে ওকে যতটা সুন্দর লেগেছিলো নরমালি তার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর। গলার স্বরটাও দারুণ মিষ্টি। জিনিসপত্র নামাতে ধ্রুবকে হেল্প করছিলো। আমি আড়চোখে ওদের দেখছিলাম। জিনিসপত্র নিয়ে নিচে নামার সময় হিরো মহাশয়ের সাথে চোখে চোখ পড়ে গেলো। আমি তাড়াতাড়ি চোখ নামিয়ে ফেললাম। ওরা নিচে নেমে গেলো।

অনেক রাত হয়ে গেছে। আমিও সুমাইয়া আর সীমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিচে নেমে গেলাম। বাসায় ঢুকে দেখলাম অলরেডি তিনটা বেজে গেছে। দৌড়াদৌড়ি চেইঞ্জ করে শুয়ে পড়লাম। সকালেও তো তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। কিন্তু ঘুম আসছিলো না। বারবার মনে হচ্ছে ধ্রুবকে একটা সরি বলা আসা উচিৎ ছিলো। আমার জন্যই বেচারার পায়ে ব্যথা পেলো। পরে ভাবলাম আমি তো আর ইচ্ছে করে পাড়া দিই নি। অ্যাক্সিডেন্টলি হয়ে গেছে। যে কারো সাথেই হতে পারতো। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন ঘুমিয়ে পড়লাম বলতে পারবো না।

পরেরদিন সকালে মা ঘুম থেকে ডেকে তুলে দিলো। আন্টিরা নিচে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। রেডি হতে হবে। আমি মাকে আগে পাঠিয়ে দিয়ে ধীরেসুস্থে রেডি হয়ে নিচে নামলাম। বারোটার দিকে সেন্টারে পৌছে গেলাম সবাই। বিয়ে পড়ানো হলো যোহরের নামাজের পর। এরপর শুরু হল খাওয়া দাওয়া পর্ব। তারপর কনে বিদায়। কনের সাথে যাওয়ার জন্য তরুকে পাঠানো হলো। ওর সাথে আরো দুটো মেয়েও গেলো। আমি চিনি না। আত্মীয় হবে বোধহয়।

কনে বিদায় শেষে আমরা বাসার ফিরলাম। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গেলো। আন্টি খুব কান্নাকাটি করছিলেন। মা আন্টির কাছে বসে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলো আর নিজেও কাঁদছিলো। হয়ত নিজের মেয়ের ভবিষ্যৎ বিয়ের দিন কল্পনা করেই কাঁদছিলো। আমি কাছেই বসে ছিলাম। এত কিছুর মাঝখানে ধ্রুবকে একবারও দেখলাম না। হয়ত ব্যস্ত। আমার বসে থাকতে অস্বস্তি হচ্ছিলো। আন্টিদের বাসায় এখনো প্রচুর মেহমান। আমি মাকে বলে আমাদের বাসায় চলে এলাম। তারপর আর নিচে নামি নি। বৌভাতের দিন আমার শরীর খারাপ ছিলো তাই যাওয়া হয় নি।

বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে সব আবার আগের মত শান্ত হয়ে গেলো। এক এক করে মেহমানরাও সবাই চলে গেলো। কিন্তু একটা ব্যাপার খেয়াল করলাম এই বিয়ে উপলক্ষ্যে মায়ের সাথে আন্টির খুব ভালো মেলামেশা তৈরী হয়ে গিয়েছে। মা এখন আর ধ্রুবকে নিয়ে কোন সতর্কবাণী করে না। আমি মনে মনে খুশি হলাম। যাক এবার নিশ্চিন্তে ছাদে ওঠা যাবে।

একদিন সন্ধ্যা বেলায় মা আন্টির সাথে গল্প করতে ধ্রুবদের বাসায় গেলো। অনেকক্ষন হয়ে যাওয়ার পরেও ফিরছিলেন না দেখে আমি ডাকতে গেলাম। কলিংবেল চাপতেই ধ্রুবদের কাজের লোক এসে দরজা খুলে ভেতরে ঢোকার জায়গা করে দিলো। আমি আন্টির ঘরে গিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম। সে জানালো মা এবং আন্টির দুজনে মিলে মার্কেটে গেছে। ফিরতে দেরী হবে। আন্টির বিছানায় দেখলাম তেরো চৌদ্দ বছরের একটা ছেলে ঘুমিয়ে আছে। একে আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হয় না। যাইহোক ওকে নিয়ে মাথা ঘামিয়ে আমার কোন লাভ নেই। তাই বেরিয়ে এলাম। ধ্রুব ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় মিউজিকের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি মাকে খোঁজার বাহানায় চুপিচুপি তাঁর ঘরে উঁকি দিলাম। দরজা খোলাই ছিলো। ধ্রুব চেয়ারে বসে কম্পিউটারে কি যেন টাইপ করছে। চুপিচুপি আবার বেরিয়ে আসার সময় গানের লিরিকসগুলো আমার কানে আসলো। থমকে গেলাম।
‘সখি, ভাবনা কাহারে বলে?
সখি, যাতনা কাহারে বলে?
তোমরা যে বল,
দিবস-রজনী, ভালবাসা, ভালবাসা।
সখি, ভালবাসা কারে কয়?
সে কি কেবলই যাতনাময়?
খেয়াল করে দেখলাম ধ্রুবকে আজকে অন্যরকম লাগছে। কেমন যেন একটা আচ্ছন্ন ভাব। আমার ঘোর লেগে যাচ্ছিলো। হার্টবিট বন্ধ হয়ে আসছিলো। বুকটা ধকধক করে উঠলো। আমি মনে মনে অনুভব করতে পারছিলাম আমি ওর প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। মনে মনে দোয়া করছিলাম,”হে খোদা এমনটা যেন না হয়। তুমি রক্ষা করো মাবুদ।”
হঠাৎ ইংলিশ গানের সফট মিউজিক বেজে উঠতেই চমকে উঠলাম। ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকাতে দেখলাম ধ্রুব তখনো মন দিয়ে টাইপ করছে। বুকে থুথু দিলাম। আগের গানটা কখন বন্ধ হয়ে গেছে খেয়ালই করি নি। এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা বিপজ্জনক। ধ্রুব দেখার আগেই আমি দ্রুত সরে পড়লাম।

সেদিনের পর থেকে আর ধ্রুবকে দেখি নি। আমিও আর ওদের বাসায় যাই নি। ছাদে যাওয়ার সুযোগ থাকলে যেতাম না। আন্টি মাঝে মাঝে আমাদের বাসায় আসতেন। আন্টির কাছে থেকেই জানতে পারলাম, ধ্রুবর ছুটি শেষ। সে চলে গেছে। আমি মনে মনে খুশি হলাম। ধ্রুব না থাকলেই ভালো। বস্তুত এভাবে ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়াটা আমি নিজেও সহ্য করতে পারছিলাম না। অসহ্য লাগছিলো।

ধ্রুব চলে যাওয়ার পর আমার ছাদে উঠতে কোন অসুবিধে রইলো না। নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়েছিলাম। তারপর ভালোই চলছিলো দিনকাল। রোজ নিয়ম করে ভার্সিটিতে যাই। ঘোরাফেরা করি। বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেই। হঠাৎ একদিন ইউনিভার্সিটি থেকে ফেরার পর দেখলাম বাসায় ছোটমামা এসেছে। ভেবেছিলাম আমাদেরকে দেখতে এসেছে। কিন্তু বিকেলবেলা ড্রয়িংরুমে বসে তিনি এবং বাবা, মায়ের গোপন আলোচনার কিছুটা কানে আসতেই আমার বুঝতে বাকি রইলো না ছোটমামা আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে।
রাতেই অবশ্য মা নিজেই আমাকে সব জানালো। ভালো একটা প্রপোজাল এসেছে। ছেলে কলেজের প্রফেসর। তারা আমাকে দেখতে আসতে চায়। পছন্দ হলে বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হবে। সেই সাথে মা কাল ইউনিভার্সিটিতে যেতে নিষেধ করে দিলো। আমি বিরক্ত হলেও চুপ করে রইলাম।

পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকেই উঠে দেখলাম মা ইতোমধ্যে রান্নাবান্নার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। ছেলেপক্ষ দুপুরে আমাকে দেখতে এলো। সাজুগুজু করে তাদের সামনে গেলাম। তাদের প্রশ্নের জবাব দিয়ে ভেতরে চলে এলাম। প্রচন্ড মাথাব্যথা করছিলো। ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর চিন্তা করলাম। ঘুম আসলো না বরং মাথার ভেতর হাবিজাবি চিন্তা ঘুরছিলো। তবুও চোখ বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে রইলাম।

রাতে মা জিজ্ঞেস করলো, ছেলে আমার পছন্দ হয়েছে কি না? আমি গোমড়ামুখে বসে রইলাম। ছেলে অবশ্য দেখতে শুনতে খারাপ না। কিন্তু তাই বলে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করার ইচ্ছে আমার নেই। মাকে সে কথা জানাতে তিনি বললেন, বিয়ে এখন হচ্ছে না। তোর পরীক্ষা শেষে আকদ করা হবে। তারপর সময় সুযোগ মত বিয়ে।”

প্রতিউত্তরের কোন সুযোগ না পেয়ে আমি বিরক্তমুখে বসে রইলাম। মা কিন্তু থেমে থাকলেন না। নিরলসভাবে ঐ ছেলের গুণকীর্তন চালিয়ে গেলেন। পরদিন তার সাথে আন্টিও যোগ দিলেন। বিয়ে যখন করতেই হবে তখন ভালোছেলে হাতছাড়া করা উচিৎ হবে না। বাবা রাতে তার ঘরে ডেকে মতামত জিজ্ঞেস করলেন। সেই সাথে ছেলে, ছেলের পরিবারের খুব প্রশংসা করলেন। ছেলের পরিবারে ছোট ছেলে। তিনভাই এবং দুই বোনেদের মধ্যে সবার বিয়ে হয়ে গেছে। ঝামেলা নেই, এইসব হাবিজাবি কথাবার্তা!

আমার মাথায় তখন অন্যচিন্তা ঘুরছিলো। আমি বিয়েতে সম্মতি দিয়ে দিলাম। দুটো কারণে আমি বিয়েতে সম্মতি দিলাম। প্রথম কারণটা হলো এতে বাবা মা খুশি হবে। আর দ্বিতীয় কারণটা হলো ধ্রুব! ইয়েস ধ্রুব! মাই এক্স! যার সাথে প্রায় দুবছর আগে আমার একটা সম্পর্ক তৈরী হয়েছিলো। একবছর আগে সেই সম্পর্কের ইতিও ঘটেছিলো।

কিন্তু আমি জানি ধ্রুব আমার জন্যই এখানে ভাড়াটিয়া হিসেবে এখানে উঠেছে। আমাকে ইম্প্রেস করার জন্যই এতসব কিছু করছে।
ও ভেবেছে এসব করলে আমি ওর কাছে ফিরে যাবো। বাট সেটা কিছুতেই হতে দেওয়া যাবে না। হি ওয়াজ অনলি মাই এক্স অ্যান্ড অলওয়েজ বি মাই এক্স। আই রিয়েলি ডোন্ট কেয়ার এবাউট হিম!
.
.
.
চলবে

গল্পের লাইব্রেরি ডট কম ,Golper Library.com,

গল্পের লাইব্রেরি, Golper Library,গল্পের লাইব্রেরি ডট কম,GolperLibrary.com,
Bangla Library,Golper Library new story,
ভালোবাসার গল্প,
ভালোবাসার গল্প কাহিনী,
আবেগি ভালোবাসার গল্প,
ভালোবাসার গল্প পড়তে চাই,
না বলা ভালোবাসার গল্প,
মজার ভালোবাসার গল্প,
ভালোবাসার গল্প 2021
বিয়ের পর ভালোবাসার গল্প,
রোমান্টিক বিয়ের গল্প,
হঠাৎ বিয়ের রোমান্টিক গল্প,
বাসর রাতের রোমান্টিক গল্প,
ভালোবাসার গল্প কাহিনী,
ধারাবাহিক গল্প,
রোমান্টিক ধারাবাহিক গল্প,
রোমান্টিক প্রেমের গল্প ,
অসমাপ্ত গল্প,
ধারাবাহিক গল্প 2020,
ধারাবাহিক গল্প,

ধ্রুব- অরিত্রিকা আহানা পর্বঃ১

ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ১

ছোটবেলায় আমি প্রচন্ড ত্যাড়া প্রকৃতির ছিলাম। আমার যেটা ভালো লাগতো আমি তাই করতাম। আমাকে যখন কোন কিছু করতে নিষেধ করা হত তখন আমি সম্মতি সূচক মাথা নাড়াতাম। আপাতদৃষ্টিতে মনে হত পারে আমি হয়ত কাজটি করবো না কিংবা নিষেধ শুনেছি। কিন্তু আমি তার উল্টোটাই করতাম। তাই বাবা মা ছোটবেলা থেকে শাসন, অনুশাসন কায়দা কৌশলে আমার এই বদ অভ্যেসটা তাড়িয়েছেন। এখন যদিও ছোটবেলার মত অত জেদ নেই, কিন্তু এখনো বাবা মা মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না কোন কাজটি আমি করবো, কোনটি করবো না।

যাইহোক, বর্তমানে আমাদের সুখি পরিবার। আমি বাবা মায়ের দুইমাত্র কন্যা। বড় বোন বিয়ের পরে হাজবেন্ডের সাথে বিদেশে স্যাটেল। আর আমি সবে অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিয়েছি। সবাই আমাকে ভালো মেয়ে বলেই জানে। মানে বাবা মায়ের বাধ্য মেয়ে বলতে যা বোঝায় সেই টাইপ আরটি।
আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে আজকে চারদিন। মুক্ত জীবন উপভোগ করছি। ভালোই লাগছে।

আমাদের নিজেদের বাসা। পাঁচতলা বিল্ডিং।আমরা থাকি পঞ্চমতলায়। তার কারণ ছাদ। ছাদ আমার খুব পছন্দ। আমার মুখ চেয়েই বাবা মাকে পাঁচ তলায় থাকতে রাজী হতে হলো। বিকেলবেলা ছাদে দাঁড়িয়ে মায়ের সাথে গল্প করছিলাম মা জানালো এই মাসে আমাদের দোতলায় নতুন ভাড়াটিয়া আসছে। আসুক, সেটা কোন ব্যাপার না। কারণ নতুন, পুরাতন কোন ভাড়াটিয়া নিয়েই আমার কোন মাথাব্যথা নেই, কোনরকম দখলদারি আমি পছন্দ করি না। ঠিক সেই কারনে তাদের সাথে আমার মেলামেশাও কম। সো কে এলো, কে গেলো তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।

ঠিক এক তারিখেই নতুন ভাড়াটিয়ারা বাসায় উঠলো। মা গিয়ে দেখা করে আসলেন। ফিরে এসে জানালেন আমাদের নতুন ভাড়াটিয়া আন্টির ইয়াং একটা ছেলে আছে। নাম ধ্রুব। ম্যারিন ইঞ্জিনিয়ার। ছয়মাসের ছুটিতে দেশে এসেছে। তাই আমাকে কড়াকড়ি ভাবে নিষেধ করা হলো আমি যেন সাবধানে থাকি। তার সাথে যদি কদাচিৎ দেখা হয় আমি যেন তাকে এড়িয়ে যাই। আমি এক কান দিয়ে শুনলাম অপর কান দিয়ে বের করে দিলাম।

কিন্তু সমস্যা হলো মা প্রায় দুই একদিন বাদেই আমাকে এই নিয়ে সাবধান করতে শুরু করলেন।।
আমি মনে মনে রাগ হলেও চুপচাপ শুনে যেতাম। কারণ প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে থাকলে সব বাবা মায়েদেরই একটা চিন্তা থাকে। মেয়ে কখন, কোথায়, কীভাবে কার সাথে জড়িয়ে যায়।আমার বাবা মাও তার ব্যতিক্রম নয়। সুতরাং এসব নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো।

একদিন সন্ধ্যাবেলা আমার এক বান্ধবীর বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে ফিরছিলাম, সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় প্রথমবারের মত সেই ছেলেটার সাথে আমার দেখা হয়ে গেলো। আমি তাকে দেখা মাত্রই চোখ সরিয়ে নিলাম। সেও একঝলক তাকিয়ে ব্যস্তভাবে নিচে নেমে গেলো। কিন্তু ঐ একঝলকেই আমার যা হওয়ার হয়ে গেলো। রহস্যজনক ভাবে ঐ একঝলকেই আমি তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লাম! তার সাথে তার মা মানে আমাদের নতুন ভাড়াটিয়া আন্টিও ছিলো। আমি তার সাথে কুশল বিনিময় করে উপরে উঠে গেলাম। কিন্তু সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। পুরো একটা রাত আমি নির্ঘুম কাটিয়ে দিলাম। পরেরদিন মা আমার চেহারা দেখে চিন্তিত গলায় বারবার জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে। আমি এড়িয়ে গেলাম।

তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ছাদে উঠতে শুরু করলাম। মায়ের কাছে শুনেছিলাম সে নাকি রোজ ছাদে উঠে। আমি তাঁকে ছাদে উঠতে দেখলেই কিছুক্ষন পর নেমে যেতাম। কখনো কখনো মাকেও সাথে নিয়ে উঠতাম। মাকে সাথে নেওয়ার কারণ তার মনে যেন আমাকে নিয়ে কোন সন্দেহ তৈরী না হয়। এতে অবশ্য লাভই হয়েছে। খেয়াল করলাম আমার প্রতি তার কিঞ্চিৎ ইন্টারেস্ট দেখা দিয়েছে। আড়চোখে প্রায়ই আমাকে লক্ষ্য করতো। আমি চোখে চোখ পড়তেই মুখ ফিরিয়ে নিতাম। আর বাহ্যত অর্থ,”আপনার প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। আমি হাওয়া খেতেই ছাদে আসি।”

কিন্তু একদিন আমার মনোভাবকে সম্পূর্ণ উল্টো করে দিলেন তিনি। আমি ছাদের একপাশে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখছিলাম আর প্রহর গুনছিলাম কখনো তিনি আসবেন। তিনি এলেন, আমাকে দেখলেন এবং নেমে গেলেন। খানখান হয়ে গেলো বুকের ভেতরটা। এরপর থেকে যতদিন আমাকে দেখেছেন প্রতিদিনই ছাদ থেকে নেমে গেছেন। আমি অবাক হতাম। তার এভাবে চলে যাওয়ার মানে ‘হি ডাজেন্ট কেয়ার এবাউট মি!’ কিন্তু আমার বোকা মাথায় এটা ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি তার প্রতি ইন্টারেস্ট বাড়ানোর জন্যই তিনি উল্টো চাল দিয়েছেন। আমি একটু একটু করে তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছিলাম! উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের সুদর্শন পুরুষ! ফিট বডি! হাসলে গালে টোল পড়ে। সম্মোহিত চাহনী! নিজেকে কতক্ষন ধরে রাখা যায়?

তবে আশার কথা হলো মা বাবা আমাকে নিয়ে কোন সন্দেহ করছেন না। তার কারণ আমার নির্লিপ্ত স্বভাব। ঠিক এই কারণেই আমি মাকে বোঝাতে সক্ষম হলাম ঐ ছেলের প্রতি আমার কোন আগ্রহ নেই।

একদিন বিকেলে আমি ছাদ থেকে নেমে যাচ্ছিলাম তিনি তখন উপরে উঠছিলাম। পাশাপাশি যখন দুজনে ক্রস করে গেলাম তখন তিনি আমাকে ডাক দিলেন,”এক্সকিউজমি?”

—“জি?”

—“আপনাকে কোথায় দেখেছি বলুন তো?”

উনার প্রশ্নের জবাবে আমি একেবারে ইনোসেন্ট একটা ফেইস বানিয়ে ঢং করে বললাম,”কেন ভাইয়া?”

আমি যতটা আশা নিয়ে ভাইয়া ডেকেছিলাম ততটা রিয়েক্ট তার কাছ থেকে পাই নি। আমার ভাইয়া ডাকটা তিনি খুব সহজেই হজম করে নিলেন। হাসিমুখে বললেন,”না মানে, প্রথমদিন থেকেই চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু মনে করতে পারছি না। ডু আই নো ইউ?”

আমি তার দিকে অগ্নিদৃষ্টি বর্ষণ করে নিচে নেমে গেলাম। সেদিনের পর থেকে অনেক দিন আর তার কোন দেখা সাক্ষাৎ পায় নি। কারণ আমি ছাদে উঠা বন্ধ করে দিয়েছিলাম। একদিন মায়ের কাছে শুনলাম তাঁর ছোটবোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ের পরপরই নাকি স্বামী স্ত্রী দুজনেই দেশের বাইরে চলে যাবে। বিয়ের আয়োজন খুব ধুমধাম করে করা হলো। বিয়ে উপলক্ষ্যেই আমাদের বিল্ডিংটা খুব জাঁকজমকভাবে সাজানো হলো। হিরো মহাশয় নিজে দাঁড়িয়ে সব কাজ তত্ত্বাবধান করলেন।

বৃহস্পতিবার, হলুদের দিন আমি সেজেগুজে আন্টির রুমে বসে রইলাম। চারদিকে সুন্দরী রমনীরা সব তাঁদের ড্রয়িংরুমে আনাগোনা করছিলো। সবার ছবি তুলে দিচ্ছিলেন হিরো মহাশয়। আমি ভেতরের রুমেই বসে রইলাম। ছবি তোলা শেষে তিনি বারবার এটা সেটা নেওয়ার জন্য ভেতরে আসছিলেন। আমি বসেছিলাম দরজার দিকে মুখ করে, তার ঘনঘন আসা যাওয়া দেখে উলটো দিকে ফিরে বসে রইলাম। কারণ বারবার তার সাথে চোখে চোখ পড়ে যাচ্ছিলো। যেটা আমার জন্য বড়ই অস্বস্তিকর ব্যাপার! হঠাৎ তিনি ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক কি যেন খুঁজলেন তারপর একেবারে আমার পেছন বরাবর এসে দাঁড়ালেন। আমি যেই চেয়ারে বসেছিলাম, তিনি তার হাতল চেপে দাঁড়িয়ে তার মায়ের সাথে কথা বলছিলেন! তিনি কি বলছিলেন তা আমার কানে গেলো না। ধরা পড়ে গেলাম,পড়ে গেলাম, টাইপ অনুভূতি! বুকের ভেতর ডামাডোল বাজচ্ছিলো। এত জায়গা থাকতে তাকে কেন আমার পেছনে দাঁড়িয়েই কথা বলতে হবে?
তিনি জানালেন মেহমানদের জন্য ব্যবস্থা করা চেয়ারের শর্ট পড়েছে, বাড়তি চেয়ারের প্রয়োজন। আশেপাশে কারো বাসা থেকে ধার করতে হবে।
আমি মনে মনে ভাবলাম তার সামনে আমি স্বাভাবিক আছি সেটা প্রমাণ করতেই হবে। তাই নিজেকে স্বাভাবিক জাহির করার জন্য আমি আন্টিকে উদ্দেশ্য করে বললাম আমাদের বাসায় বাড়তি চেয়ার আছে। আমার কথা শুনে আন্টি উনাকে নিয়ে আমাদের বাসায় থেকে চেয়ার নিয়ে আসতে বললেন।

অতঃপর রুম থেকে বেরিয়ে উনি আগে আগে হাঁটছিলেন আমি পেছন পেছন। আমার অস্বস্তি হচ্ছিলো। তিনি সেটা বুঝতে পেরে আমাকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে ড্রয়িংরুম তাঁর চারবছরের ভাগনীর সাথে কিছুক্ষন দুষ্টুমি করলেন। সেই ফাঁকে আমি বেরিয়ে পাঁচতলায় উঠে গেলাম। কিন্তু আবারো ইম্প্রেসড হলাম। যদিও আমি জানি, হি ইজ নট মাই টাইপ!” কিন্তু তবুও আমি তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লাম। তাঁর সবকিছুই আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করছিলো। কিন্তু সেটা তো তার সামনে প্রকাশ করা যাবে না। উলটো এমন ভান করে থাকতে হবে যেন আমি তার প্রতি ইন্টারেস্টেড নই। আমি চেয়ার বের করে বাইরে দরজার সামনে রেখে দিলাম। নিজে বেরোলাম না। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে নিজের ঘরে বসে কতক্ষন টিভি দেখলাম। তারপর প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে নিচে নামলাম। আন্টি মানে উনার মা আমাকে বললেন হলুদ প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে, সবাই ছাদে।

ছাদে উঠে দেখলাম হলুদ প্রোগ্রাম আসলেই শুরু হয়ে গেছে। আমি মাকে খুঁজতে শুরু করলাম। কারণ এনাদের আত্মীয়স্বজন কাউকেই আমার চেনা নেই। আর বাকি ভাড়াটিয়া যারা আছে তাদের সাথেও আমার তেমন মেলামেশা নেই। স্টেজের সামনে সারিবদ্ধভাবে চেয়ারে মেহমানদের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মা আমাকে দেখে হাত নেড়ে ইশারা করলেন তার কাছে যাওয়ার জন্য। আমি ভিড় ঠেলে চিপাচাপা জায়গা বের করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। মা যেখানে বসেছেন তার দুসারি পেছনে ফাঁকা জায়গা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় তাড়াহুড়োর কারণে আমি কারো পায়ে পাড়া দিয়ে ফেলি। আমার হিলের পাড়া খেয়ে কঁকিয়ে উঠলেন আহত ব্যক্তি। তাকে সরি বলতে গিয়ে খেয়াল করলাম তিনি আর কেউ নয়, হিরো মহাশয়। ব্যথায় মুখ কালো করে ফেলেছেন। মুহূর্তেই তার দুপাশের সবাই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আমার বিব্রতমুখে বললাম,” সরি ভাইয়া আমি খেয়াল করি নি। বেশি লেগেছে?”

—“না ঠিক আছে।”

আমি কিছুক্ষন দুঃখিত মুখ করে তার পায়ের দিকে চেয়ে রইলাম। এর মানে ‘আপনাকে ব্যথা দিয়ে আমি ভীষণ কষ্ট পেয়েছি।’ দুঃখ প্রকাশ শেষে মায়ের কাছে চলে গেলাম। পুরো অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত জায়গা থেকে নড়লাম না। অনুষ্ঠান শেষে সব গোছানোর আয়োজন চলছিলো। হিরো মহাশয়কে দেখলাম স্যু খুলে স্যান্ডেল পায়ে হাঁটছেন। আঙ্গুলে ব্যান্ডেজ। আমার একটু খারাপ লাগলো। এতটা ইনজুর্ড হবে ভাবতে পারি নি।

আমাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তার কাজকর্ম দেখছিলাম এমন সময় আমাদের নিচতলার ভাড়াটিয়া দুটো মেয়ে এগিয়ে এলো। সীমা এবং সুমাইয়া। এরাও নতুন। খুব বেশিদিন হয় নি এসেছে। হাসিমুখে বললো,”আপু এসেছেন? আমরা তো ভেবেছিলাম। আপনি আসবেন নি।”

আমি সম্মতিসূচক মুচকি হাসলাম। কারণ মেলামেশা নেই, পরিচিত কেউ নেই এমন কারো অনুষ্ঠানে যেতে আসলেই আমার অস্বস্তি হয়। এসব অনুষ্ঠানে যাওয়া মানে পুতুলের মত একজায়গায় বসে থাকা নতুবা মায়ের পেছন পেছন ঘোরা। দুটোই খুব বিরক্তিকর।

কথা বলতে বলতে সুমাইয়া এবং সীমা ওদের দুজনের সাথে বেশ ফ্রি হয়ে গেলাম। আমরা ছাড়াও ছাদের আরো অনেকেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলো। ধ্রুব এবং তার বন্ধুরা তখন ছাদ থেকে সোফা, চেয়ার এসব নামাচ্ছিলো। সুমাইয়া আর সীমা সেদিকে তাকিয়ে হাসছিলো আর নানারকম কথাবার্তা বলছিলো। আমি খুব বেশি তাকাচ্ছিলাম না। মাঝে মাঝে তাদের কাজকর্ম দেখছিলাম। এরমাঝে একটা মেয়েকে দেখলাম চেইঞ্জ করে ছাদে উঠে এলো। সুমাইয়া ফিসফিস করে বললো,”ধ্রুব ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড।” আমি ভালো করে খেয়াল করে দেখলাম। মনে হলো মেয়েটাকে আমি চিনি।
.
.
.
চলবে

পিশাচ_দেবী . ৫ম এবং শেষ পর্ব

পিশাচ_দেবী
.
৫ম এবং শেষ পর্ব
.
সেই সময়েই ঘনকালো একটা মেঘের টুকরো সূর্যকে ঢেকে দিল। অন্ধকার হয়ে এলো চারপাশ। আকলা চিৎকার থামাচ্ছে না। তার কন্ঠস্বর যেন প্রতিধ্বনিতো হয়ে বারবার ফিরে আসছে গোষ্ঠীর লোকেদের কাছে। হারমা! হারমা! তার ওপর আবার হঠাৎ করেই এই আধার। সবাই আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়লো। মানজা বু এর শরীরও কেঁপে উঠলো সামান্য। যে লোকটা মশাল হাতে এগিয়ে আসছিল তার হাত থেকে মশাল পরে গিয়ে আগুন নিভে গেলো। মানজা বু হঠাৎ কান খাড়া করতেই আৎকে উঠলেন। বুঝতে পারলেন শুধু আকলা নয়। গোষ্ঠীর আরো অনেকেই নিজের অজান্তে বিড়বিড় করে বলছে ” হারমা, হারমা , হারমা ” !

কণ্ঠের সর্ব শক্তি দিয়ে চিৎকার করে সবাইকে থামতে বললেন মানজা বু। বৃদ্ধকে এত উত্তেজিত এর আগে কেউ দেখেনি। সবাই থতমত খেয়ে গেল। এখন আর গোষ্ঠীর লোকদের ভেতর থেকে কোনো গুঞ্জন আসছে না। আকলা যদিও তখনো চিৎকার করে দেবী হারমাকে স্মরণ করতে লাগলো। মানজা বু কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে মশাল বহনকারী লোকটাকে তার কাজ করতে বলতেই লোকটা পুনরায় মশালে আগুন ধরিয়ে কাঁপা কাঁপা হাত-পা নিয়ে আকলার সামনে হাজির হলো।

আকলা চোখ বন্ধ করে এক মনে হারমাকে ডেকে চলেছে। এমন সময় চঞ্চলতা শুরু হলো গোষ্ঠীর মানুষদের ভেতর। তারাও কেউ কেউ চেঁচিয়ে উঠছে , এ হতে পারে না! এ অন্যায় ! যুগ পাল্টেছে , এখন সেই পুরোনো নিষ্ঠুর নিয়মে মানুষকে পুড়িয়ে মারা ঠিক না! বু , ভুল করছেন! নিজেরা সামনে বাড়তে চাইলো। লাঠিয়াল বাহিনী তাদের থামানোর চেষ্টা করতেই তারা ক্ষেপে উঠলো আরো বেশি। তলোয়ার দিয়ে যুবকের ঘাড় চেপে রাখা এক লাঠিয়ালকে হঠাৎ অন্যমনস্ক পেয়ে উরুসন্ধিতে ঘুষি মেরে দিল যুবক। চাইলো সরে যেতে। লাঠিয়াল আর্তনাদ তুলে আর এক মুহূর্ত চিন্তা না করেই তলোয়ার চালিয়ে দিল যুবকের গলায়। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতেই লুটিয়ে পরলো যুবক মাটিতে। সবাই হতভম্ব হয়ে গেল এবার!

এবার গোষ্ঠীর বাকি সবাই পুরো ক্ষেপে গেল। এক লোক বড় একটা পাথর ছুঁড়ে দিল লাঠিয়াল লোকটার মাথা বরাবর। ঠিক জায়গায় লেগে সাথে সাথেই মাথা ফেটে মগজ বেরিয়ে গেল লাঠিয়ালের। মারা গেল সে। চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়লো দ্রুত।

শুরু হলো এবার আঘাত-প্রতিঘাত । গোষ্ঠীর লোকেরা যে এত ক্ষেপে যাবে তা কল্পনাও করেনি বু বা তার লোকেরা। বা এমন খুন খারাবি হবে। তাদের মানুষিক ভাবে খেপিয়ে তোলার জন্য যে পিশাচ হারমা এর হাত আছে তা আন্দাজ করতে পারে মানজা বু। নাহলে হঠাৎ করেই এত নিষ্ঠুর, বর্বর হয়ে উঠলো কেন ওরা!

গোষ্ঠীর লোকেরা যে যা পাচ্ছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লো লাঠিয়াল বাহিনীর ওপর। একটা কুঠার এর ডগা বিদ্ধ করলো এক লাঠিয়ালের বুক। আরেক লাঠিয়াল সুনিপুন ভাবে তলোয়ার চালিয়ে গোষ্ঠীর নিরস্ত্র ৩ যুবককে সাথে সাথেই খুন করে ফেলল।

কখন মশাল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার শরীরে তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে গোষ্ঠীর দুই তরুণ তা খেয়ালই করার সুযোগ পেলো না মানজা বু। আকলা মুক্ত হয়ে কোথায় চলে গেল তারও খোঁজ রাখলো না কেউ। ভয়ঙ্কর মারামারি শুরু হয়ে গেল , একের পর এক নির্মম চিৎকার , মানুষের শরীর ছিন্নভিন্ন করার পর উল্লাস, চোখ উপরে ফেলার দৃশ্য, লাঠি, কোদাল , তলোয়ারের আঘাত খেয়ে মৃত্যুর আগ মুহূর্তের আর্তনাদ , মেয়ে- বাচ্চা এর কান্নার শব্দ , আর্তনাদ মুহূর্তেই আরো ভয়ঙ্কর করে তুললো পরিবেশ। আকাশে জমা মেঘের মতো অন্ধকার করে দিল গত দুই যুগ ধরে বহন করা গোষ্ঠীর সংস্কার, শান্তি।

হতবিহ্বল হয়ে চারপাশে তাকাতে লাগলেন মানজা বু। পাথরের মূর্তি হয়ে গেছেন তিনি। এ কী ঘটছে ! তিনি স্বপ্ন দেখছেন নাকি ! মৃত লাঠিয়ালের তলোয়ার তুলে নিয়ে একজন যুবক যখন তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তার ঠিক কাঁদ বরাবর কোপ দেওয়ার জন্য তলোয়ার উঁচু করলো তখন তার হুস ফিরলো। আঘাতটা যদিও তার শরীরে পড়ার আগেই ছিমন এসে এক কোপে ছেলেটার ধর থেকে মাথাটা আলাদা করে ফেলল। রক্তে মুখ লেপ্টে গেল মানজা বু এর। ছিমন বলল , বু আপনাকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। সবাই ক্ষেপে গেছে আপনার ওপর।

কেউই ধারণা করতে পারেনি এই তাণ্ডবের পেছনে পিশাচটা দায়ী। তবে এমন ঘটনা ঘটতে পূর্বেও দেখেছে বু। মানজা বু ছিমনকে হুকুম দিলেন , পবিত্র ঘর থেকে পবিত্র পাথর আর ঢোলটা নিয়ে আসো। দ্রুত! এখনো দেরি হয়ে যায়নি !

ছিমন এর অর্থ বুঝলো। আরেক লাঠিয়ালকে বু এর পাশে রেখে এক ছুটে গিয়ে পবিত্র ঘর থেকে পাথর আর ঢোল নিয়ে এলো। এই পাথরের সাহায্যে ঢোলে আঘাত করতে হবে। ভয়ংকর শব্দ সৃষ্টি হবে তাতে। অবশ্যই সেই শব্দ পবিত্র। এই শব্দ যত দূর যাবে কোনো পিশাচ তার মায়ার প্রভাব খাটাতে পারবে না ততদূর।

ছিমন , বু এর আদেশে শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে পাথরটা আঘাত করতে লাগলো বড় ঢোলটার দু-পাশে , তালতালে। বিশাল ঘুরুম , ঘুরুম শব্দে কেঁপে উঠলো যেন চারপাশ। নেমে এলো অদৃশ্য আশীর্বাদ। কালো মেঘ ভেসে গেলো। সূর্যের আলোয় ঝকমক করছে চারপাশ। গোষ্ঠীর সবাই তাদের জ্ঞান ফিরে পেলো। চারপাশে এত লাশ , মানুষের শরীরের অংশ আর নিজেদের রক্তে ভেজা শরীর দেখে তারাই যেন শিউরে উঠলো। হতভম্ব হয়ে ফেলে দিল যার যার হাতের অস্ত্র। নিজেরা কী করেছে বুঝতে পেরে হাটু মুড়ে বসে পড়লো মাটিতে। দুই হাতে মুখ ঢেকে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো।

ঢোলের শব্দ আরো বাড়তে লাগলো। পুরোপুরি ক্ষেপে গেছে ছিমন। পাগলের মতো পাথরটা দিয়ে আঘাত করছে ঢোলটায়। কান ফাটিয়ে পিশাচ টাকে মারাই যেন তার উদ্দেশ্য! মানজা বু আবার ভয়ে ভয়ে আতঙ্কে চারপাশে তাকালেন । তারা হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করেছে দেখেও শান্তি পেলেন না। ভয়ঙ্কর এক শিহরণে মাটিতে বসে পড়লেন তিনি । এ কী হলো ! কত মানুষ মারা গেল এই এক মুহূর্তে! অথচ সে কিছুই করতে পারলো না! পিশাচটাই জিতে গেলো ! এই গোষ্ঠীর নিরাপত্তার দায়িত্ব তার , সেই তো বু ! একজন ব্যর্থ বু। তার পূর্বপুরুষের কাছে মুখ দেখাবে কী করে সে! লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা করছে তার!

আর কোনো বিপদ নেই বুঝতে পেরে এক লাঠিয়ালের সাহায্য নিয়ে ধীরে ধীরে নিজের কুটিরে ফিরে গেলেন মানজা বু। ছিমন তখনো উন্মাদের মতো ঢোল পিটিয়ে যাচ্ছে।

প্রায় শেষ বেলায় মানজা বু নিজের বিছানায় শুয়ে আছেন। তারপাশে এক সেবাকারী। ঘরের বাইরে দুজন লাঠিয়াল। ছিমন ঘরে ঢুকতেই সেবাকারী মেয়ে টা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ছিমন কন্ঠে বিনয় আর শ্রদ্ধা মিশিয়ে মানজা বু কে বলল:

সমস্ত আয়োজন করা হয়েছে বু। কবর খোঁড়া হয়েছে । লাশগুলোকে কলাপাতা দিয়ে আবৃত করে গোরস্থানে নেওয়া হয়েছে। যারা মারা গিয়েছে তাদের আত্মীয়দের শোক অবশ্য কাটেনি। আপনার অনুমতি পেলে কবর দেওয়া শুরু করবো বু।

কথা বলতে গিয়ে মানজা বু অনুভব করলেন গলা দিয়ে আগের মতো শব্দ বের হচ্ছে না। হাত ইশারায় ছিমনকে কাছে ডাকতে গিয়ে আরো মুষড়ে পড়লেন। হাত নড়ানোর শক্তি নেই, পুরো দেহ অবশ হয়ে গেছে। তবে বু এর ছটফটানি দেখে ছিমন তার কাছে এগিয়ে গিয়ে তার মাথার পাশে হাটু মুড়ে বসলো। মানজা বু বিড়বিড় করে বললেন :

আকলাকে খুঁজে পেয়েছ ?

না, বু। সেরম করে খোঁজার সময় পায়নি। তবে গোষ্ঠীর অনেকেই খুঁজছে। যারা ওকে পুড়ানোর প্রতিবাদ করেছিল তারাও তার ওপর রেগে আছে আর সব কিছুর পেছনে তাকেই দায়ী মনে করছে। ওকে খুঁজে পেলে এবার পোড়ানোর আগে আপনার অনুমতিও চাইবে না তারা।

আমি আকলাকে ক্ষমা করলাম।

বু!

যা বলছি মনোযোগ দিয়ে শোনো। এই পিশাচের পাল্লা থেকে আমাদের সবাইকে রক্ষা পেতে হবে। আজ যে হত্যাযজ্ঞ হলো , তাতো কেবল শুরু। আরো অনেক প্রাণ যাবে। পিশাচটার বিশ্বস্ত কেউই পারে আমাদের রক্ষা করতে।

দীর্ঘ বাক্য বলার পর গলাটা আবার লেগে এলো মানজা বু এর। চিচি শব্দ করে কিছুক্ষণ , আবার শুরু করলেন।

এখন এই পিশাচের কবল থেকে আকলাই আমাদের রক্ষা করতে পারবে। যেভাবেই পারো ওকে খুঁজে আনো এখানে। জঙ্গলেই গেছে ও। ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয়। ওকে নিয়ে এসো। আর নতুন পুরোহিতকে আমার ঘরে পাঠিয়ে দাও। মৃতরা যাতে কষ্ট না পায় ছিমন। পবিত্র মাটিতে শুইয়ে দাও ওদের। আমার দায়িত্ব আজ তুমি পালন করো। দেখতেই তো পাচ্ছ আমার অবস্থা।

ছিমন মাথা নুইয়ে উঠে দাঁড়ালো। ঘুরে দরজার দিকে এগোতেই মানজা বু চি চি করে বললেন , গভীর রাতের আগে ওই ঢোলের শব্দ বন্ধ করো না । সে যাতে কিছুতেই ফিরে আসতে না পারে।

সেই সময় ঘুরুম করে শব্দ ভেসে এলো ঢোলের। ছিমন আশ্বস্ত করলো শব্দ বন্ধ হয়নি, দেখতেই পাচ্ছেন।

এরপরে কঠিন কাজে নেমে গেল ছিমন। গোষ্ঠীর ১৭ জন মানুষ মারা গেছে আজ। তার বাহিনীর ৬ জন সহ। সবাইকে লাঠিয়াল বাহিনী আর গোষ্ঠীর লোকের সাহায্যে পবিত্র গোরস্থানে শুইয়ে দিল। কবর দেওয়ার পর তার লোকজন জঙ্গলে তল্লাশি চালিয়ে আকলাকে খুঁজে বের করলো। গোষ্ঠীর সবাই তাকে দেখেই ক্ষেপে উঠলো। কিন্তু মানজা বু এর আদেশে , নিরাপদে , সম্মানের সাথেই বু এর ঘরের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে। গোষ্ঠীর লোকেরা মানজা বু আকলাকে ক্ষমা করে দিয়েছে শুনতে পেরে বেশ বিস্মিত হয়েছে। তাছাড়া ছিমনকে সবাই ভয় আর শ্রদ্ধা করে। তাই তার বিপক্ষে গিয়ে কেউ আর আকলার ওপর হামলা করলো না।

প্রায় অচেতন হয়ে বিছানায় শুয়ে আছেন মানজা বু। আকলা ঘরে ঢুকেই বু এর পায়ের কাছে গিয়ে পড়লো।

আমাকে শাস্তি দিন বু! আমার জন্যই এইসব খুন-খারাবি , রক্তপাত হলো। আমাকে পুড়িয়ে মারার হুকুম দিন আবার! আমিই সব নষ্টের মূল।

মানজা বু চোখ মেলে তাকিয়ে ইশারা করতেই ছিমন সহ ঘরের সবাই বাইরে চলে গেল। ঘরের ভেতর দুটো হারিকেন জ্বলছে। সেই আলোয় বৃদ্ধ আকলার মুখের দিকে তাকালেন। চিচি করতেই আকলা তার মাথার কাছে চলে গেল। বু বললেন :

তোমায় আরো বড় শাস্তি দেব মা। আমার মৃত্যুর পর এই গোষ্ঠীর দায়িত্ব তোমাকে নিতে হবে।

না , বু! অমন কথা বলবেন না!

এই গোষ্ঠীকে পিশাচদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে তোমাকেই। নিজের মৃত্যু পর্যন্ত খেয়াল রাখবে কেউ যাতে পিশাচ সাধনার অধীনে না যায়। আমি কি না করেছি গোষ্ঠীর লোকদের জন্য , যাতে তাদের অভাব না দেখা দেয় আর আশ্রয় না নিতে হয় অলৌকিক শক্তির। কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি!

আমি আপনাকে ব্যর্থ করেছি বু!

তোমার ওপর সব দোষ চাপিয়ে নিজেকে আমি নির্দোষ বানাতে পারবো না মা আকলা। এখন শোনো ওই পিশাচটাকে আজ রাতের মধ্যেই দুনিয়া ছাড়া করতে হবে!

কিন্তু সেতো অমর!

ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ অমর নয় মা। আমাদের পূর্ব-পুরুষেরা খুবই বুদ্ধিমান ছিলেন। তারাও আমাদের মতো এমন পিশাচের পাল্লায় পড়ে গোষ্ঠীর ধ্বংস হতে দেখেছেন। তাই তারা পিশাচ হত্যা করার নানান পথ আবিস্কার করেছেন। তুমি সাহায্য করবে বলো ?

জান দিয়ে দিব বু।

তাহলে শোনো। ঢোলের শব্দ থেমে গেছে দেখতেই পাচ্ছ। পিশাচটা আবার জঙ্গলে ফিরে আসছে। এখন যদি কেউ একটা মৃত শরীর বয়ে নিয়ে যায় জঙ্গলে তাহলে পিশাচটা তার আহ্বানে সাড়া দেবে। নতুন পুরোহিতকে আমি সেই পবিত্র প্রাণীর রক্ত জোগাড় করতে বলেছি যে রক্তের স্পর্শে শূন্যে মিলিয়ে ধ্বংস হয়ে যায় দুনিয়ার সমস্ত পিশাচ। সেই রক্ত রাজ বংশের একজন লোককে পান করতে হবে। তখন তার শরীরও পবিত্র রক্তে ভরে যাবে! এবং লোকটা অচেতন হয়ে যাবে। সেই লোকটাকে জঙ্গলে বয়ে নিয়ে গিয়ে পিশাচটার সামনে হাজির করতেই পিশাচটা যখন তার শরীরে কামড় দেবে। তার শরীরের রক্ত পিশাচটার মুখ স্পর্শ করবে সাথে সাথে ধ্বংস হয়ে যাবে সে।

চিচি করে , ছাড়া ছাড়া ভাবে কথাগুলো বু বললেও প্রতিটা কথা বুঝতে পারলো আকলা। ভয়ে তার মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

পিশাচটার সাথে তো তাহলে রাজ রক্ত বহন করা লোকটাও মারা যাবে বু!

একটা প্রাণের বিনিময়ে রক্ষা পাবে পুরো গোষ্ঠী।

কে পান করবে পবিত্র রক্ত ?

আমি।

না, বু! এ কিছুতেই হতে পারে না! পাপ করেছি আমি। আমার শরীরেও বু এর রক্ত বইছে। আমি প্রাণ দেব!

জিদ করো না মা আকলা! তাহলে এই গোষ্ঠী , দেখবে কে? আমি আর কদিন বাঁচবো ! আমার অচেতন শরীর নিয়ে তুমিই জঙ্গলে যাবে পিশাচটাকে বধ করতে।

কিন্তু বু, সেতো অন্তর্যামী !

অন্তর্যামী তাই জানতে পারে যা আমরা জানাতে চাই! তোমার মনে যা তাই অন্তর্যামী শোনে আর বিশ্বাস করে। তুমি যদি এই পরিকল্পনার কথা মনে না আনো এক মনে , মনের সমস্ত জোর দিয়ে শুধু পিশাচটার কথা চিন্তা করো তাহলে সে কিছুই টের পাবে না।

আমি আপনাকে হারাতে চাই না , বু!

আর কোনো উপায় নেই মা! দেরি করো না । আর শুনো সেদিন হয়তো সত্যিই ডাকাতের খপ্পরে পড়েছিলে তুমি । পিশাচটা দেবী পরিচয়ে তোমাকে রক্ষা করে। কিন্তু মনে রেখ , প্রকৃত দেবী সাহায্যের পরে কোনো বিনিময় চায় না। তারা ভক্তের ভক্তিতেই সন্তুষ্ট হয়।

জ্বী , বু।

আর তোমার স্বামী হিসেবে ছিমন কে তুমি বাছাই করতে পারো আমার মৃত্যুর পর। সেই সবচেয়ে দায়িত্ববান পুরুষ এই গোষ্ঠীর। তাছাড়া তুমি নিজের পছন্দমত কাউকে বেঁচে নিতে পারো।

মানজা বু এবার ছিমনকে ডাক দিলেন। তার ইশারায় পবিত্র মন্ত্র পড়া , পবিত্র প্রাণীর রক্ত নিয়ে পুরোহিত ঢুকলেন ঘরে। মানজা বু এর ওঠার শক্তি নেই। পুরোহিত মন্ত্র পড়তে পড়তে রক্তটুকু ঢেলে দিলেন বু এর মুখে। খুকখুক করে কেশে অজ্ঞান হয়ে গেলেন বু।

মানজা বু আগেই ছিমনকে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। জঙ্গলের পাশে পর্যন্ত বু এর অচেতন দেহ পৌঁছে দিল লাঠিয়াল বাহিনী। আকলা ভয়ে কাঁপছে। যার শুরু সে করেছিল তার শেষ সে করতে পারবে তো! ধরা পড়ে যাবে না তো ! বু এর প্রানের মূল্য দিতে পারবে তো ! এই গোষ্ঠীর ভবিষ্যত এখন তার হাতে।

একটা পাটিতে করে বেঁধে বু এর শরীর টেনে নিয়ে যাচ্ছে আকলা। এক হাতে হারিকেন, ওপর হাতে পাটির মাথায় বাধা দড়ি। একমনে পিশাচ দেবী হারমার নাম নিতে নিতে এগোচ্ছে আকলা। প্রায় আধ-ঘন্টা হাটার পর হারিকেনের আলোতে গুহা মুখ দেখতে পেল আকলা। তার আহ্বানে সাড়া দিয়েছে হারমা । ভয়ঙ্কর কুৎসিত একটা নগ্ন শরীর বেরিয়ে এলো গুহার ভেতর থেকে। হিসহিস করে বলল:

আমাকে ভুলে যাসনি! মাথা নুয়া। আমি তোর দেবী!

হাটু গেড়ে বসলো আকলা। এক মনে হারমার নাম জপে যাচ্ছে । ধীরে ধীরে লাশটার দিকে এগিয়ে এলো হারমা। উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলো । বিনিময়! লাফিয়ে উঠে পাটি সরিয়ে কামড় বসালো মানজা বু এর হৃদপিণ্ড বরাবর। এক কামড়ে ছিড়ে মুখে নিল খণ্ডটি। মুখ রক্তে ভরে গেল তার। পরমুহূর্তেই গগনবিদারী চিৎকার বেরিয়ে এলো পিশাচটার গলা থেকে! বুঝতে পারলো কিছু একটা বেঠিক ঘটেছে।কঠিন চোখে আকলার দিকে তাকিয়ে বললো:

আমি অমর , অবিনশ্বর । আমি আবার ফিরে আসবো এখানে ! আমাকে কেউ আটকাতে পারবে না! তোর আর তোর বংশ ধরের মৃত্যু হবে আমার হাতে!

শূন্যে মিলিয়ে গেল সে!

• * * * * * সমাপ্ত * * * * *

লেখা: #Masud_Rana

[ গল্প যতক্ষন লেখি ততক্ষণ গল্পে ডুবে থাকি। লেখা শেষ হলেই এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগে মনে। গল্পটা পড়ে পাঠকরা কী অনুভূতি প্রকাশ করবে তা জানতে মন উসখুস করে। পাঠকদের জন্যই তো গল্প । তাদের গঠনমূলক মন্তব্যই তো অনুপ্রেরণা দেয় লেখার। যারা প্রথম পর্ব থেকে এই পর্যন্ত আগ্রহের সাথে পড়েছেন সবার জন্য ভালোবাসা। ]

আগের পর্বের লিংক :

পিশাচ_দেবী . ৪র্থ পর্ব

পিশাচ_দেবী
.
৪র্থ পর্ব
.
এখন থেকে প্রায় ২ যুগ আগের ঘটনা। গোষ্ঠীর প্রধান পুরোহিত ছিলেন লায়ন মাও । এক রাতে তাকে ঘুম থেকে ডেকে তোলে সেই সময়ের গোষ্ঠী প্রধান হানজা বু এর ছোট ভাই মানজা। তাকে বের করতে বলে সেই পবিত্র পাথরটা। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই পাথরটা বাক্স থেকে বের করে লায়ন মাও। পবিত্রঘরে মানজা বু সেদিন একা আসেনি। এসেছিল এক তরুণী এবং তার কোলে ছিল নবজাতক বাচ্চা একটা মেয়ে।

মানজা এর ইশারায় বাচ্চাটা কোলে নেয় লায়ন মাও। মানজা এর আদেশে তরুণীটি এবার পাথর স্পর্শ করে। চোখে-মুখে তরুণীর ক্লান্তি ভাব , তখনো ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মানজা তাকে আদেশ করে পাথর স্পর্শ করে শপথ করতে, মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সে এই নবজাতক এর পিতার নাম কারো কাছে প্রকাশ করবে না। তরুণী কাঁপা কাঁপা হাতে পাথর স্পর্শ করলো বিড়বিড় করে বলল , আমার স্বামী হানজা বু এর আত্মা শান্তি পাক। আমি এই পবিত্র পাথর ছুঁয়ে শপথ করছি , হানজা বু আর আমার বিয়ের কথা কেউ জানবে না। আমার মেয়ে হবে পিতৃপরিচয়হীন।

এই বলেই ঢুকরে কেঁদে ওঠে তরুণী। পুরোহিত বড় বড় চোখ করে চেয়ে থাকে মানজা, তরুণীর আর নবজাতক শিশুটির দিকে। যেন নিজের কানকে আর বিশ্বাস করতে পারছে না। হানজা বু শেষ বয়সে এই তরুনীকে বিয়ে করেছিল , কাউকে না জানিয়ে! মানজা পুরোহিতের কাঁধে হাত রেখে একটু চাপ দেয়। চোখের ভাবে লায়ন মাও বুঝতে পারে এই ঘটনার কথা জাতে গোষ্ঠীর আর কেউ জানতে না পারে সেই অনুরোধ করছে মানজা। সেও চোখ ইশারায় তাকে আস্বস্ত করে।

ধীরে ধীরে মানজা , তরুনীকে সাথে নিয়ে পবিত্র ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। তরুনিকে ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে সে ফিরে যায় তার ঘরে। এটা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না মানজার। এই মুহূর্তে মানজা এর মতো নিঃস্ব মানুষ আর এই গোষ্ঠীতে নেই। সে আগামীকাল গোষ্ঠীর বু হিসেবে শপথ নেবে। কিন্তু এই পদ চায় কে? কিসের বিনিময়ে ? গতকালই এই গোষ্ঠীর প্ৰধান, তার বড় ভাই “হানজা বু” কে আগুনে পুড়িয়েছে গোষ্ঠীর সবাই মিলে। সব দোষ সেই পিশাচ , ডাইনি হারমা এর। সেই এই গোষ্ঠীতে ত্রাস সৃষ্টি করেছে ব্যাপক ভাবে। হত্যা , হানা-হানি , অনাচার এর পুনর্জন্ম দিয়েছে। প্রলুব্ধ করেছে অর্ধেক গোষ্ঠীকে তার অনুসারী হতে। যার পরিণয় হয়েছে এই ভয়ংকর পরিণতি। গোষ্ঠীকে বাঁচাতে হত্যা করতে হয়েছে অনেক আপন মানুষকে।

তার মধ্যেও তার ভাইও ছিল, যদিও সে গোষ্ঠী প্রধান। কিন্তু এই আইন সবার জন্য সমান। এই পিশাচ পুজো বন্ধ করার আর কোনো উপায় ছিল না তাকে আগুনে পুড়িয়ে না মারা পর্যন্ত। এটা যে অন্যায় , মৃত মানুষের শান্তি নষ্ট করার শাস্তি যে মৃত্যু, লাশের বিনিময়ে পিশাচের কাছে যাওয়া যে পাপ তা প্রমাণ করার জন্য হলেও হানজা বু এর শাস্তির প্রয়োজন ছিল।

তাই গত দিন টেনে এনে সবার সামনে জ্যান্ত আগুনে পোড়ানো হয় হানজা বু কে। মানজা ভবিষ্যত গোষ্ঠী প্রধান হয়েও বাঁচাতে পারেনি ভাইকে। এর আগের সব স্ত্রী – সন্তান মারা গিয়েছিল হানজা বু এর। হানজা বু মৃত্যুর আগে শুধু মানজা এর কানে কানে বলে যায় সেই তরুণীর কথা। শেষ বয়সে যাকে সে বিয়ে করেছে গোপনে, তরুণীর গর্ভে তার সন্তান। নিয়ম অনুসারে পিশাচ সাধনা যে করবে তাকে পুড়িয়ে মারতে হবে এবং তার স্ত্রী সন্তানকে বিতাড়িত করতে হবে গোষ্ঠী থেকে।

হানজা বু এর মৃত্যুর পর তাই মানজা সিদ্ধান্ত নেয় তার ভাইয়ের শেষ সন্তান , আর শেষ স্ত্রীকে দূরে যেতে দেবে না সে। তার গর্ভের পিতার পরিচয় মানুষেরা না জানলে সে হয়তো লাঞ্ছনার শিকার হবে। কিন্তু থাকতে পারবে এই গোষ্ঠীতে। মানজাও বু হওয়ার পর নজরে রাখতে পারবে ভাইয়ের কন্যাকে।

সেই মেয়েটাই আকলা। মানজা বুও প্রথম স্ত্রী আর সন্তানের মৃত্যুর পর আর বিয়ে করেননি। তাই বলা যায় আকলাই তাদের বংশের শেষ বংশধর। তবুও মানজা বু সিদ্ধান্ত নেয় আকলার পরিচয় ফাঁস করবে না সে। একবার যদি সবাই জানতে পারে নিজের লোক বলে পিশাচ সাধনার অপরাধের আইনে একটু নড়চড় হয়েছে তখন সবাই এই নীতিমালা থেকে মুখ গুঁড়িয়ে নেবে এবং পরবর্তীতে এই পিশাচ সাধণার অভিযোগে কাউকে শাস্তি দিতে গেলে তারা প্রশ্ন তুলবে হাজারটা!

বর্তমান সময়।

মানজা বু চিন্তিত ভাবে তার ঘরের বিছানায় শুয়ে আছেন। চোখ-আধভোজা। তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে তার লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান এবং পরামর্শক ছিমন আমলা। সেও চিন্তিত। শান্ত কণ্ঠে বু কে প্রশ্ন করল:

সবইতো আপনি শুনেছেন বু , সব কিছু প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। সকাল থেকেই গোষ্ঠীতে শোরগোল শুরু হয়ে গেছে থামবে বলে মনে হয় না! এত বছরের গোপন কথাটা ফাঁস হয়ে গেছে!

হু।

এটা আমাকে প্রথমে বিস্মিত করেছিল, বু। এখন সবটাই বুঝতে পারছি। আজ সকালে কিছু একটা দেখে ভয়ঙ্কর ভাবে ভয় পেয়ে যায় আমাদের পুরোনো বৃদ্ধ পুরোহিত লায়ন মাও। ছুটতে ছুটতে গোষ্ঠীর একদল লোকের কাছে গিয়ে বলে দেয় , আকলার জীবন বৃত্তান্ত। আকলা যে আপনার ভাইয়ের কন্যা তা তারপর থেকে এক ঘর , দুই ঘর করে পুরো গোষ্ঠীর মানুষ এতক্ষণে জেনে গেছে।

হু।

আমি প্রথমে ভেবে পাইনি এত বছর ধরে পুরোহিত লায়ন মাও যে কথাটি লুকিয়ে রেখেছেন , কী এমন দেখে ভয় পেয়ে আজ সে এটা প্রকাশ করে দিল! এখন সবটাই পরিষ্কার। এ সেই অলৌকিক পিশাচের সাহায্য ছাড়া সম্ভব না। সেই তার মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে। আকলা পিশাচের আশ্রয় নিয়েছে।

বৃদ্ধ মানজা বু শুধু মাথা ঝাকিয়ে যাচ্ছেন। এর মানে বলে যাও।

আজ সকালে আমার লাঠিয়াল বাহিনীর আরুল আমাকে জানায় গত রাতে নাকি সে একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে একটা মেয়ে লোকের অবয়বকে জঙ্গলে ঢুকতে দেখেছিল। তারপর সেও রওনা হয় মেয়ে লোকটা কোথায় যাচ্ছে দেখতে। কিন্তু চারপাশ খুঁজে, ডেকেও কাউকে দেখতে পায় না। আরুল রাতে নেশাগ্রস্ত থাকে বলে তার কথার মূল্য দেইনি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি সব। সকাল বেলা গোরস্থানে গিয়ে উদ্ধার করি আমরা যে গতদিন যে মেয়েটাকে কবর দিয়েছিলাম তার লাশ উধাও হয়ে গেছে। তারমানে নিশ্চই জানেন আপনি বু। আকলা বিনিময়ে অংশ নিয়েছে। লাশের বদলে উপকার !

মানজা বু এর পুরো শরীর কেঁপে উঠলো ! এর থেকে নিষ্ঠুর ঘটনা আর কী হয়! নিস্তার নেই কারো! আবার সে ফিরে এসেছে এই গোষ্ঠীতে। এর কারণে কত লোককে হারাতে হয়েছে তার আর গোষ্ঠীকে। কত লাশ নিজ হাতে কবরে শুইয়েছেন তিনি। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললেন বৃদ্ধ:

ছিমন , সেই সময়ে তোমার বয়স কম থাকলেও তুমি এই পিশাচের ভয়াবহতা দেখেছ আর জানো। যেকোনো মূল্যে সেই পিশাচের নাম আবার ভুলিয়ে দিতে হবে গোষ্ঠীকে।

আরুল একটা আসতো গাধা , বু। সে আকলার লাশ নিয়ে জঙ্গলে ঢোকার বিষয়টা শুধু আমাকে না। গোষ্ঠীর আরো অনেকের সাথে বলেছে। কথাটাও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। সবাই জেনে গেছে আকলার দেওয়া লাশ পেয়ে তৃপ্তি পেয়েছে পিশাচটা , তাই তার মনের ইচ্ছা পূরণ করেছে। একটা লাশ নিয়ে পিশাচটার নাম জপতে জপতে জঙ্গলে গিয়ে রাখলেই যে পিশাচ সবার মনের ইচ্ছা পূরণ করবে কথাটাও তাই রাজ্য হয়ে গেছে। এই কাজ যে আরো অনেকেই করতে চাইবে লোভে!

কী ভয়ঙ্কর দিন আসছে ছিমন ! আমিই না জানি কবে তার ফাঁদে পড়ি!

এখন আপনার পরামর্শ কী বু ? কী করতে বলেন আমাকে ?

যা নিয়ম তাই করতে হবে। সবাইকে বোঝাতে হবে পিশাচ সাধনার কী ভয়ঙ্কর পরিণতি আর শাস্তি। আকলাকে গোষ্ঠীর সবার সামনে খুঁটিতে বেঁধে পুড়িয়ে মারতে হবে।

কিন্তু! সেতো আপনার বংশের শেষ রক্ত !

তাতে কিছুই গেলো না। এছাড়া আর উপায় নেই।

মাথা নুইয়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ছিমন। মানজা বু একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন। নিজের অজান্তেই গাল বেয়ে পানি পরতে লাগলো। কেন আকলা ? এমন কেন করলো। সব দোষ তার। সেই যদি মেয়েটার আসল পরিচয় জানিয়ে দিত তাহলে আজ এই দিন এতনা। কিন্তু এখন অনেক দেরি হয়ে গেছে।

গত দুই যুগ ধরে এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের দেখা পায়নি গোষ্ঠিবাসী। সবার চোখে- মুখে আতংক আর ভয়। উৎসুক দৃষ্টিতে ঘিরে আছে আকলাকে বেঁধে রাখা খুঁটির চারপাশে। লাঠিয়াল বাহিনী ছড়িয়ে আছে চারপাশে। অনেক দিন পর তাদের হাতে শোভা পাচ্ছে লোহার তলোয়ার। কোনো রকম উশৃঙ্খলা যাতে কেউ সৃষ্টি করতে না পারে। মানজা বু উপস্থিত আছেন।

আকলার চেহারায় সর্বহারা দৃষ্টি। সে বাঁচার জন্য কাকুতি করছে না । হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে রইলো চারপাশের লোকজনের দিকে। তার সঙ্গে কী হবে তা তার মাথাতেই ঢুকছে না।

ছিমন চেঁচিয়ে সবাইকে চুপ করতে বলল। সাথে সাথেই সব শোরগোল বন্ধ হয়ে গেল। সে চিৎকার করে বলতে লাগলো :

এই রীতি আমাদের পূর্বপুরুষ এবং তাদের পূর্বপুরুষের। যারা আমাদের জন্য তৈরি করেছেন শান্তির নীতিমালা। যে এই নীতিমালা মানবে সেই থাকবে গোষ্ঠীতে বাকিরা বিদায় নেবে। পিশাচ সাধনা মানে রক্তপাত , মৃত মানুষের কষ্ট বাড়িয়ে দেওয়া , জীবিতদের মাঝে অনাচার সৃষ্টি করা। এর এক মাত্র শাস্তি মৃত্যু। সবাই সাবধান , নিজেদের এমন অবস্থায় দেখতে না চাইলে । ধ্বংস হোক শয়তান ও তার অনুসারীরা!

কথা শেষে মানজা বু এর দিকে তাকাতেই তিনি অনুমতি দিলেন আকলাকে পোড়ানোর। তেল জাতীয় একটা জিনিস আকলার পুরো শরীরে ঢেলে দেওয়া হলো। মশালে আগুন ধরালো একজন।

সকালে , আকলা বর্তমান বু এর গোষ্ঠীর শেষ বংশধর জানার পর গোষ্ঠীর কিছু তরুণ বিয়ের প্রস্তাব দেয় আকলাকে। কারণ সেই হিসেবে মানজা বু এর মৃত্যুর পর গোষ্ঠীর প্রধান হবে আকলার স্বামী । তারমধ্যে কয়জন যুবক প্রতিবাদ জানায় এর।

মানজা বু এর সামনে এক যুবক এসে করা কণ্ঠে বলে:

এ আপনি কিছুতেই হতে দিতে পারেন না , বু ! আকলা দোষ করেছে ঠিকই , তাকে তাড়িয়ে দিতে পারেন গোষ্ঠী থেকে। কিন্তু আগুনে পুড়িয়ে মারা! আমারতো আপনাকেই পিশাচ মনে হচ্ছে!

সাথে সাথে দুজন লাঠিয়াল এসে যুবকটার উরুর পেছনে বারি মেরে হাটু গেড়ে বসিয়ে কাঁধে চাপ দিয়ে মাটির সঙ্গে শুইয়ে দেয়। সাথে সাথে আরো কিছু যুবক উশৃঙ্খল হয়ে ওঠে। তাদের ওপরেও চড়াও হয় লাঠিয়াল বাহিনী। মাটির সঙ্গে চেপে ধরে রাখে। হাতে তলোয়ার এমন ভাবে ধরা যে উঠতে গেলেই রক্তের বন্যা বইয়ে যাবে।

এবার গুঞ্জন শুরু হলো গোষ্ঠীর সাধারণ মানুষের মধ্যে। এ কেমন ব্যবহার তাদের সাথে , এ কেমন স্বৈরাচারীতা! একজন লোক বলে ওঠে :

বু, আকলা আপনার বংশের শেষ রক্ত বইছে । তাকে এভাবে মারবেন ?

বৃদ্ধ মানজা বু লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। কয়েক মুহূর্তে তার মুখের ভাব কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। এবার হাতের লাঠি ছুড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করলো সে। সাথে সাথেই হতভম্ব হয়ে সবাই চুপ করে গেল। বৃদ্ধকে এমন জেদের সঙ্গে অনেক দিন কথা বলতে শোনেনি কেউ। ঝাঁঝের সাথে শুরু করলেন :

শুনো তোমরা গোষ্ঠী বাসী! আমার বংশের রক্ত না শুধু! আমি তোমাদের আদেশ দিচ্ছি তোমরা যদি আমাকেও কোনো ভাবে পিশাচ পূজার সঙ্গে জড়িত পাও তবে প্রথমে আমার হাত কেটে আমার চোখের সামনে পুড়িয়ো। তারপর যন্ত্রনা দিয়ে আমার পা কেটে ফেলো। ছুরি ঢুকিয়ে আমার চোখ উপরে ফেলে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিও সুতো দিয়ে, মরার আগেই আমার পেট কেটে নাড়িভুঁড়ি বের করে নিও। হে নির্বোধ ! তোমরা কী তোমাদের পূর্ব পুরুষকে হারাওনি এই ডাইনি , শয়তান , পিশাচটার জন্য ? সবাই ভুলে গেলে সেইসব দিনের কথা ? আমাদের পূবপুরুষেরা বুবুয়ান ( স্বর্গ) থেকে আমাদের ধিক্কার করছে না? আমরা কী হাউলার ( নড়ক ) এর দিকে পা বাড়াচ্ছি না! সাবধান সবাই ! এই পিশাচ এর একমাত্র ক্ষমতা মানুষের মনকে কব্জা করতে পারে। যত মানুষ তাকে মনে করবে তত তার শক্তি বাড়বে। তাই ভুলে যাও এইসব অনাচার!

এবার আকলার মুখের সব রক্ত শুকিয়ে গেল। সে বিশ্বাস করতে পারছে না এটা তার সাথে হচ্ছে! এমনতো হওয়ার কথা ছিল না। মশাল হাতে লোকটা তার দিকে এগিয়ে আসছে। মশালের মাথা তার শরীর স্পর্শ করলেই জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে সে , বুঝতে পারলো। দেবী হারমা তো এমন কিছু হওয়ার ইঙ্গিত দেননি ! দেবী হারমার কথা স্মরণ হতেই ভয় কিছুটা কেটে গেলো তার। চুয়াল শক্ত করে কঠিন দৃষ্টিতে চাইল মশাল বহন করা লোকটার দিকে। চিৎকার করে ডাকতে লাগলো , দেবী , হারমা! দেবী হারমা! দেবী হারমা! হারমা! হারমা! হারমা! ……………..”

সেই সময়েই ঘনকালো একটা মেঘের টুকরো সূর্যকে ঢেকে দিল। অন্ধকার হয়ে এলো চারপাশ। আকলা চিৎকার থামাচ্ছে না। তার কন্ঠস্বর যেন প্রতিধ্বনিতো হয়ে বারবার ফিরে আসছে গোষ্ঠীর লোকেদের কাছে। হারমা! হারমা! তার ওপর আবার হঠাৎ করেই এই আধার। সবাই আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়লো। মানজা বু এর শরীরও কেঁপে উঠলো সামান্য। যে লোকটা মশাল হাতে এগিয়ে আসছিল তার হাত থেকে মশাল পরে গিয়ে আগুন নিভে গেলো। মানজা বু হঠাৎ কান খাড়া করতেই আৎকে উঠলেন। বুঝতে পারলেন শুধু আকলা নয়। গোষ্ঠীর আরো অনেকেই নিজের অজান্তে বিড়বিড় করে বলছে ” হারমা, হারমা , হারমা ” !……………………………………..
.
.
. . . . . চলবে . . . . .
.
.
লেখা: #Masud_Rana