Child Of Night part-10

0
1575

#Child_Of_Night
Writer : Tanjima Islam

[11]

একটা দুঃস্বপ্নের মধ্যে ঘুম ভেঙে গেল সারলোটের। ঘুমের ঘোরেই বুকের নিচে নেমে আসা কম্বলটা টেনে তুলল মাথা পর্যন্ত।
কিন্তু পাশ ফিরতে গিয়েই টের পেল রাত শেষ হয়ে গেছে। পাখির কলকাকলির শব্দ এসে কানে বাজল তার।
গায়ের ওপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে উঠে বসল সারলোট।
আর তখনই অনুভব করল, গলার পাশটায় একটা টনটনে ব্যথা।
আনমনে ওর একটা হাত উঠে এল গলার পাশের ব্যথার জায়গাটায়।
সঙ্গে সঙ্গে চমকে উঠল সারলোট। টের পেল জায়গাটা কেমন যেন ফুলে গেছে – একটা ক্ষতচিহ্নও যেন আঙুলে ঠেকছে।

সম্ভবত শক্ত কিছুর খোঁচা খেয়ে অমন ক্ষত হয়েছে। ক্ষতের ওপর আঙুল বোলাতে বোলাতে সারলোট ভেবে পেল না শক্ত কিছুর খোঁচা লাগল কখন।
সহসা বিদ্যুৎ চমকের মতো সন্দেহটা ছায়া ফেলল মনের মধ্যে। জানলা ফুঁড়ে ভোরের ঝাপসা আলো প্রবেশ করছে ঘরে।
সেই আলোয় আবছা ভাবে ঘরের ভেতর কিছুটা চোখে পড়ছে। কিন্তু আলমারির কোণার দিকে দৃষ্টি পৌঁছচ্ছে না তার।
বাদুড়টা সেখানে তখনো পর্যন্ত ঝুলে আছে কিনা বুঝতে পারল না সারলোট।
কিন্তু স্বভাব ভীতু প্রাণী বাদুড় তো মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়েই চলে।
ঘরের অন্ধকার কোণ ছেড়ে তো তার এপাশে আসবার কথা নয়।

সন্দেহটা প্রবল হয়ে উঠল সারলোটের মনে। ঘন ঘন আঙুল বোলাল কয়েকবার ক্ষতটার ওপরে।
বেশ টনটনে ব্যথার অনুভূতি। আলমারির দিকে আবারও তাকাল একবার।
না, স্পষ্ট করে কিছু চোখে পড়ছে না। বিছানা ছেড়ে নেমে জানলার দিকে এগিয়ে গেল সারলোট।
কিন্তু জানলার ছিটকিনি খুলতে গিয়ে অবাক হয়ে গেল। ছিটকিনি খোলা!
সামান্য ফাঁক হয়ে আছে পাল্লাদুটো! নিজের বোকামি আর অন্যমনস্কতার কথা চিন্তা করতে করতে হাট করে খুলে দিল পাল্লাদুটো।

ভাবল, তাড়াহুড়ো করে জানলা বন্ধ করতে গিয়ে হয়তো খেয়ালই করেনি, তাই ছিটকিনিটাও ভাল করে বন্ধ করা হয়নি।
হাওয়ার টানে জানলাটা খুলে গিয়েই বোধহয় এমন ফাঁক সৃষ্টি হয়ে গেছে।
ততক্ষণে ভোরের আলোয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ঘরটা। সারলোট মন্থর পদক্ষেপে এগিয়ে গেল আলমারির দিকে। না, বাদুড়টা নেই।
এপাশ ওপাশ, খাটের তলা, আলমারির পেছন – সম্ভাব্য সব জায়গায় অনুসন্ধান করল।
শেষে নিজের মনে সিদ্ধান্তে পৌঁছল, জানলা খোলা পেয়ে হয়তো পালিয়ে গিয়েছে ভীতু প্রাণীটা।

সারলোট এবারে আর না ভেবে পারল না – পালাবার আগে অন্ধকারে নিশ্চয়ই কয়েকবার চক্কোর খেয়েছিল ঘরে।
সেই সময়েই হয়তো ওটার নখ লেগে গিয়েছিল তার গলায়। কে জানে – হয়তো দেয়ালে ঠোক্কর খেয়ে তার গলার ওপরেই আছড়ে পড়েছিল প্রাণীটা।
তবু রক্ষা – অল্পের ওপর দিয়ে গেছে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবল সারলোট-চোখ মুখের ওপর পড়লে একটা বড় রকম দুর্ঘটনাই ঘটে যেত।
ভীতু প্রাণীটা পালাবার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল নিশ্চয়ই খুব। বন্দি হয়ে পড়েছিল ঘরে। মনে মনে হাসিই পেল সারলোটের দৃশ্যটা কল্পনা করে।

আশ্রয়দাত্রীর ঘাড়ে আছড়ে পড়ে নিশ্চয় বেজায় রকম অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল বেচারা!
কিন্তু ঘরের বাইরে পা রাখতেই হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল সারলোটের। চোখের সামনে যেন অজস্র আলোর ফুলকি ঠিকরে উঠল।
সামনের দেয়াল ধরে ফেলল হাত বাড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে, দাঁড়িয়ে পড়ল।
কিন্তু তাতেও শেষরক্ষা হল না। পা টলে গিয়ে কাত হয়ে পড়ে গেল মেঝের ওপর।
বেশ কিছুক্ষণ পর যখন তার জ্ঞান ফিরে এল, তখনো সারলোট উঠে বসতে পারল না।
সমস্ত শরীরে একটা অবশ করা ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। গভীর অবসাদে যেন ভেঙে পড়ছে শরীর। হৃদস্পন্দন দ্রুততর।

মেঝেয় শুয়ে থেকেই শিথিল শরীরের অবস্থাটা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারল সারলোট। একরাতের মধ্যে এমন দুর্বল সে কি করে হয়ে পড়ল, কিছুতেই ভেবে পেল না সে।
নানা চিন্তায় অধীর হয়ে সারলোট ধীরেধীরে উঠে বসল। তারপর অবসন্ন শরীর টেনে বিছানায় ফিরে গিয়ে বালিশে মাথা এলিয়ে দিল।
ঠিক সেই সময়েই চোখ পড়ল আলমারির ওপর, আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল গতরাতের সেই বাদুড়টার কথা।
সারলোটের মনে হল, বাদুড় তো অশুভ প্রাণী। কি দরকার ছিল ওর ওপর দয়া দেখানোর।

সারলোটের এও মনে পড়ল,ভ্যাম্পায়ার বাদুড়ের কথা বইতে পড়েছে সে- রাতের অন্ধকারে মানুষের রক্ত শুষে খায় ওরা।
এসব কথা মনে হতেই সন্দেহ আর দ্বন্দে দুলতে শুরু করল সারলোটের মন।
ভয় আর অজানা আশঙ্কা ছায়া ফেলল মনে। তবে কি না জেনে কোনও ভ্যাম্পায়ারকে ঘরে ঢুকিয়ে ছিল সে? আর সুযোগ বুঝে রাতের অন্ধকারে রক্ত শুষে খেয়েছে সেই বাদুড়টা?
নানান চিন্তায় বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল সারলোট। গলার পাশে ব্যথার জায়গাটায় আলতো করে হাত বুলোতে লাগল সে। তারপর একসময় আবার ঘুমিয়ে পড়ল।

_________________________
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
বেডের ওপর খালি লাগেজ পড়ে আছে। অন্য পাশে কাপড়চোপড়। নীরা ঘরের মধ্যে অস্থির হয়ে পায়চারি করছে।
মিলিয়ান ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে যেতেই নীরা আলমারি থেকে লাগেজ আর কাপড়চোপড় বের করেছে।
আজ সকাল নয়টা পয়তাল্লিশ এ তাদের বাংলাদেশ যাওয়ার ফ্লাইট। এখন বাজে আটটা দশ। নীরা ভেবে পাচ্ছেনা মিলিয়ান কি আদৌ যাবে?
আর যদি না যায় তাহলে সে তার মা’কে কি বলবে? মায়ের মানসিক অবস্থারও কি অবস্থা কে জানে।

মিলিয়ান ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে দেখল, নীরা পুরো ঘরময় পায়চারি করছে।
বেডের ওপর লাগেজ আর কাপড়চোপড় বের করা। কোথায় যাচ্ছে নীরা? মিলিয়ান অবাক হয়ে বলল,

” মাম্মাম! তুমি কি কোথাও যাচ্ছো?

মিলিয়ানের কন্ঠঃ পেয়ে নীরা চমকে পেছনে ফিরল। মিলিয়ান বেডে ছড়ানো কাপড়চোপড় এর দিকে তাকিয়ে আছে। নীরা হাসার চেষ্টা করে বলল,

” তুমি ফ্রেশ হয়ে এসেছো! নাও রেডি হয়ে নাও শিগগিরই। আমি ব্রেকফাস্ট রেডি করছি।

নীরা দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। মায়ের জন্য খুব চিন্তা হচ্ছে তার।
একবার স্বচক্ষে না দেখা পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না। নীরা কিচেনে ঢুকে ব্রেকফাস্ট রেডি করতে লাগল।
ওদিকে মিলিয়ান নীরার কথা মতো রেডি হয়ে গেছে। চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ে সে রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
নীরা ডাইনিং এ ব্রেকফাস্ট সাজাচ্ছে। ইনস্ট্যান্ট রুটি, অমলেট আর আঙুরের জ্যুস।
মিলিয়ান একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। নীরা তার দিকে প্লেট এগিয়ে দিয়ে গোগ্রাসে গিলছে।
মিলিয়ান খাচ্ছে কম, নীরার অদ্ভুত আচরণ দেখছে আর অবাক হচ্ছে। আজ নীরার হয়েছেটা কি!

নীরা খেয়ে উঠে রেডি হতে নিজের রুমে চলে এলো। ঘড়িতে নয়টা সতেরো বাজে।
কাপড়চোপড় গোছানোর সময় নেই। নীরা সব গোটোবাটো করে নিয়ে লাগেজে পুরতে লাগল।
তার আর মিলিয়ানের কাপড়ে ঢ্যাপসা হয়ে গেছে লাগেজটা।
নীরা লাগেজ নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দেখল মিলিয়ান ডাইনিং এ নেই। সে আবার কোথায় গেলো? নীরা ব্যস্তভঙ্গীতে হাক ছাড়ল,

” মিলিয়ান!

কোনো সাড়াশব্দ পেলো না। মিলিয়ানের রুমের দরজা খোলা। আবার রুমে গেছে বোধহয়।
নীরা লাগেজটা মেইন ডোরের সামনে রেখে মিলিয়ানকে ডাকতে তার রুমে এসে ঢুকল। মিলিয়ান রুমে নেই। এবার বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো নীরা।
মেইন ডোর তো লক। তাহলে মিলিয়ান কোথায়?
নীরা রুম থেকে বেরিয়ে আসতে যেই না পা বাড়াবে ঠিক তখনই ওয়াশরুমের ভেতর থেকে অদ্ভুত ঘড়ঘড়ে আওয়াজ শুনে সে চমকে উঠল।
ওয়াশ রুমের দরজা ভেজানো। মিলিয়ান কি তাহলে ওয়াশরুমে!
নীরা মন্থর পদক্ষেপে এগিয়ে গেল ওয়াশরুমের দিকে। ঘড়ঘড় আওয়াজটা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।

নীরা এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে ওয়াশ রুমের ভেতর উঁকি দিতেই আরেক দফা চমকে উঠল।
দু’পায়ে ভর দিয়ে ফ্লোরে বসে কমোডের ভেতর বমি করছে মিলিয়ান। নীরা হন্তদন্ত হয়ে মিলিয়ানের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,

” মিলিয়ান কি হয়েছে?

মিলিয়ান প্রায় সাথেসাথেই চমকে পেছনে ফিরল । মিলিয়ানের মুখভর্তি রক্তের ধারা দেখে আঁতকে উঠল নীরা। রক্তমাখা মুখে মিলিয়ানকে ভয়ংকর লাগছে দেখতে।
মিলিয়ানের চোখেমুখেও স্পষ্ট আতংক ছড়িয়ে পড়েছে। ফ্লোরের ভেজা টাইলসে টাল সামলাতে না পেরে নীরা উলটে পড়ল ফ্লোরের ওপর।
তার আর্তনাদের শব্দ দ্বিগুণ বেড়ে প্রতিধ্বনি তুলছে পুরো ওয়াশরুমের ভেতর।
নীরাকে পড়ে যেতে দেখে মিলিয়ান ছুটে এলো নীরার কাছে। মিলিয়ানকে দেখে নীরার তো প্রাণ যায়যায় অবস্থা। সে পাগলের মতো হাত-পা ছোড়াছুড়ি করতে করতে বলছে,

” না! না! না! বাচাও! আমাকে কেউ বাচাও!

মিলিয়ান ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বলল, ” মাম্মাম! ভয় পেয়োনা মাম্মাম! আমি মিলিয়ান, তোমার মিলিয়ান!

নীরা কোনো কথা শুনছেনা। ভয়ে আতংকে তার মুখ থেকে রক্ত সরে গেছে।
মিলিয়ান কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। সে নীরাকে টেনে তুলতে গেলে নীরা নিজেকে মিলিয়ানের থেকে ছাড়াতে গিয়ে আছড়ে পড়লো বাথটাবের মধ্যে।
পানিশূন্য বাথটাবের মধ্যে পড়েই মাথায় আঘাত পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে নীরা।
মিলিয়ান আতংকিত চোখে তাকিয়ে আছে নীরার দিকে। বেশ কিছুক্ষণ পরও নীরার নড়নচড়ন নেই দেখে সে আরও ভয় পেয়ে গেছে।
একপর্যায়ে মিলিয়ান ধীর পায়ে বাথটাবের পাশে বসে আস্তে-ধীরে নীরার গলায় হাত রাখল।
________________________
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
ঘুম ভেঙে গিয়েছিল অনেক আগেই। তবু বিছানা আঁকড়ে পড়ে আছে সারলোট।
শরীর এত অবসন্ন হয়ে পড়েছে যে সামান্য নড়াচড়া করলেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছে।
বুকটা হাপড়ের মতো ওঠানামা করছে ক্রমাগত। আজ সকালে তাদের মিউনিখ যাওয়ার উদ্দেশ্য ছিলো।
কিন্তু সারলোটের মা হেনা সারলোটকে ডাকতে এসে দেখে, সারলোট মড়ার মতো বেডে পড়ে আছে।
তার অসম্ভব ফ্যাকাশে শরীর দেখে মনে হচ্ছিলো যেন, একটা আস্তো মড়া পড়ে আছে তার সামনে। সাথেসাথেই চিৎকার দিয়ে রবার্টকে ডেকে এনেছে হেনা। রবার্ট তখন রেডি হয়ে মাত্র ব্রেকফাস্ট করতে বসেছিলো।

মেয়ের রুমে এসে সেও দেখল, একই অবস্থা। এক রাতেই যেন সারলোটের সব জীবনীশক্তি হারিয়ে গেছে।
মুখের লাবণ্যতা সরে গিয়ে পাংশুটে বিবর্ন হয়ে গেছে শরীরটা। হটাৎ কি হল সারলোটের?
গতরাতেও তো সে দিব্যি হেসেখেলে বেড়িয়েছে। মেয়ের হটাৎ এমন অসুস্থতায় মিউনিখ যাওয়ার প্ল্যান ক্যান্সেল করেছে রবার্ট।
ডক্টরকে কল করেছে কিন্তু ক্লিনিক থেকে বলেছে ডক্টর এলে জানাবে আর খুব আর্জেন্ট হলে হসপিটালে নিয়ে যেতে বলেছে। সারলোটকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হবে।

হেনা সারলোটের রুমে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। মেয়ের অস্বাভাবিক ও আকস্মিক এই দুর্বলতার কারণ এখনও অস্পষ্ট তার কাছে।
রবার্ট বাইরে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সির অপেক্ষা করছে। টাক্সি এলেই সারলোটকে নিয়ে বেরিয়ে যাবে তারা।জানলার দিকে চোখ রেখে শুয়ে আছে সারলোট।
সে ভেবে পাচ্ছেনা তার হটাৎ এমন অসুস্থতার কারণ কি। গত রাতের সেই বাদুড়টা সম্পর্কে সন্দেহ নিয়ে মনে মনেই নানাভাবে নাড়াচাড়া করছে সে।
এখনো কাউকে প্রকাশ করতে পারেনি কিছু। বাদুড়ের ভাবনার সঙ্গে প্রচ্ছন্ন একটা চিন্তা রয়েছে মনে তার।
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
[চলবে]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here