Child_Of_Night Part-18

0
1224

#Child_Of_Night
Writer: Tanjima Islam

_________________[18]____________________

নীরার গলা কাপছে। অনেক বড় একটা শক খেয়েছে সে। ওরহান ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। নীরা’কে সত্যিটা বলা উচিৎ হয়নি।
কিন্তু তার ভীষণ হালকা লাগছে। যেন কতবড় একটা বোঝা আঁটকে ছিলো তার মধ্যে। কিন্তু এখন, অজানা এক স্বস্তি পাচ্ছে সে। নীরা কিছু একটা ভেবে বলল,

—–” কিন্তু এসবে মিলিয়ানের দোষটা কোথায়? ও তো কারোর ক্ষতি করেনি। তাহলে আপনারা কেন ওকে আঁটকে রেখেছেন?

—–” মিলিয়ান এখনও জানেনা সে কে। নিজের অশুভ শক্তির ব্যাপারে কোনো ধারণাই নেই তার। কিন্তু যেদিন ও জানতে পারবে, সেদিন ওকে থামানো অসম্ভব হয়ে যাবে!

নীরা অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো ওরহানের দিকে। সে বুঝতে পারছেনা কি বলবে। মিলিয়ানকে সে কখনোই বোনের ছেলে ভাবেনি, মনে করতো সে তার নিজের ছেলে। মীরা মারা যাওয়ার পর সে আর দেশে ফিরে যায়নি। শুধুমাত্র মিলিয়ান এর জন্য।
এতটুকু বাচ্চা’কে কিভাবে একা রেখে যেতো সে। মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে নীরা’র। শেষবার যখন কথা হয়েছিলো, তার মা ছোট বাচ্চার মতো কাদতে কাদতে বলছিলো,

—–” আমি দেখলাম একটা খোলা প্রান্তরে তুই একা দাঁড়িয়ে আছিস। আমাকে বারবার ‘মা’ ‘মা’ বলে ডাকছিস! আমি যেই তোর কাছে যেতে নিলাম। ঠিক তখনই সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেলো। কিচ্ছু দেখতে পেলাম না। আমি তোকে কত ডাকলাম। কিন্তু তোর কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না। নীরা মা! তুই বাড়ি ফিরে আয়। আমার কেমন যেন লাগছে। ভয় হচ্ছে খুব।

মীরা মারা যাওয়ার আগেও তার মা এমন অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে মাঝরাতেই উঠে কান্নাকাটি করতো। নীরার বুঝতে আর বাকি নেই, খুব শীঘ্রই তার সাথেও ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলেছে।
সেজন্যই ওরহান তাকে দেশে পাঠিয়ে দিতে চায়। কিন্তু সে কি করে ফিরে যাবে? সে তো মিলিয়ানকে প্রমিজ করেছে, সবসময় সে তার পাশে থাকবে।

ওরহান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” মিলিয়ানই প্রথম নয়। এর আগেও লামিয়ার আরও সন্তানকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নীরা দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকালো। সে কল্পনাও করতে পারছেনা তার ছোট্ট মিলিয়ানের কি পরিণতি হতে চলেছে।
মনে হচ্ছে পুরোটাই একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন। ঘুম ভাংলেই সব আগের মতো ঠিক হয়ে যাবে। ওরহান নীরার হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে বলল,

—–” ফিরে যাও নীরা। নিজের পরিবারের কাছে। তোমার বাবা-মায়ের এখন তোমাকে খুব দরকার। মীরা’র মতো ভুল তুমিও করো না। তুমি ছাড়া ওদের আর কেউ নেই।

—–” আপনি কেন আমাকে বাচাতে চাইছেন ওরহান?

মুহুর্তেই ওরহানের ভেতরটা ধ্বক করে উঠল। কি বলবে সে? নীরা কি জানেনা? বুঝতে পারেনা তার অনুভূতি!? পরক্ষণেই মনেমনে হেসে ফেলল ওরহান।
তার কি আদৌ কোনো অনুভূতি আছে!? নীরা কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ওরহান স্মিত হেসে বলল,

—–” তোমার বিশ্বাস হবে না।

ভ্রুকুটি করল নীরা। কি বিশ্বাস হবে না তার? ওরহান কোন বিশ্বাসের কথা বলছে?

—–” তোমার তো আমার অস্তিত্ব নিয়েও সন্দেহ আছে। ভাবছো এসব একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র।

ওরহানের কন্ঠে কেমন যেন একটা টান অনুভব করছে নীরা। যেন একটুখানি সুখের পিপাসায় কাতর এক প্রেমিক পুরুষ তাকিয়ে আছে তার দিকে।
নীল সাগরের মতো চোখ জোড়ায় ফুটে উঠেছে তীব্র আকুলতা। তার হিমশীতল হাতের মুঠোয় আবদ্ধ নীরার হাতটা মুহুর্তের জন্য কেপে উঠল।

—–” আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার কাছে এসব একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্নের মতই। আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছিনা যে, মিলিয়ান মীরা’পুর ছেলে না। বিশ্বাস করতে পারছিনা আপনি আমার বা আর সবার মতো সাধারণ কেউ না!

শেষের কথাটা বলতে গিয়ে নীরা একরকম চেচিয়ে উঠলো। তার চোখেমুখে স্পষ্ট রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটলেও তার আড়ালে ফুটে ওঠা কষ্টটা ওরহানের দৃষ্টি এড়ালো না। নীরা কষ্ট পাচ্ছে।
তার জন্য পাচ্ছে, মিলিয়ানের জন্যও পাচ্ছে। নীরা ওরহানের হাত থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,

—–” পারছিনা মানতে। কষ্ট হচ্ছে আমার। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে!

ওরহান নিশ্চুপ দৃষ্টিতে নীরার দিকে তাকিয়ে আছে। নীরা হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছতে লাগল। বুকের ভেতরটা মোচড় দিচ্ছে তার। দম বন্ধ হয়ে আসছে মনে হচ্ছে। ওরহান নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

—–” তুমি সব ভুলে যাবে।

চমকে উঠল নীরা। ওরহান সেদিকে না তাকিয়েই দ্রুত পায়ে হল রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। কি বলে গেলো সে? নীরা সব ভুলে যাবে মানে!?

______________________________

শ্বেতপাথরের তৈরি সমাধিফলকের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে হেনা। ফলকের ওপর খোদাই করে বড়বড় জার্মান ভাষায় লেখা “সারলোট পল”।
রেগেন্সবুর্গ সিমেট্রির বাম পাশে প্রাচীরের ধারে সমাধিস্থ করা হয়েছে সারলোটকে। রবার্ট আর হেনার একমাত্র সন্তান আজ শায়িত এই সদ্য খোড়া মাটির নিচে।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফাদার এন্ড্রুর সাথে কথা বলছে রবার্ট। ফাদারের কথা গুলো তার কানে যাচ্ছে কি না কে জানে। সে মাথা নিচু করে ভেজা মাটিতে জন্মানো ঘাসের দিকে তাকিয়ে আছে।
একমাত্র মেয়ের মৃত্যু তার ভেতরটাকে ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিয়েছে। সবকিছু কেমন যেন শূন্য মনে হচ্ছে তার। বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে।

তার সদ্য ফোটা ফুলের মতো মেয়েটার অকালে ঝরে পড়ার কারণ খুজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু কোথায় পাবে সে ই উত্তর? ডক্টর জানেনা সারলোটের হটাৎ রক্তশূন্যতার কারণ কি। চিকিৎসা শুরু হতে না হতেই সারলোটের অস্বাভাবিক ভয়ংকর মৃত্যু।
কি হয়েছিলো সারলোটের সাথে? তার এমন অকস্মাৎ মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? সারলোটের অবস্থা না বুঝেও ভুল চিকিৎসা করা ডক্টর? নাকি তার বাবা যে কি না, রাত জেগে মেয়েকে পাহারা দিতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো?

—–” আচ্ছা সারলোটের কি স্লিপ ওয়াকিং ডিজিজ ছিলো? বা এমন কোনো কারণ, যাতে করে ও রাতবিরেত বাড়ির বাইরে যেতো?

ফাদার এন্ড্রুর প্রশ্নে রবার্ট এর ভাবনার সুতো ছিড়ে গেলো। রবার্ট মুখ তুলে ফাদারের দিকে তাকিয়ে বলল, ” মানে?

—–” না মানে, ওর ঘাড়ে দুটো ছিদ্র খেয়াল করেছো?

ফাদারের এমন অদ্ভুত প্রশ্নে রবার্ট ধৈর্য্য হারিয়ে বলল,” কি বলতে চাচ্ছেন ফাদার? কার ঘাড়ে কিসের ছিদ্র!?

—–” না, কিছু না। আমার একটা জরুরি কাজ আছে। আসি।

ফাদার এন্ড্রু দ্রুত প্রস্থান করল। মনে হল সে যেন পালিয়ে গেলো। রবার্ট একমুহূর্ত সেদিকে তাকিয়ে পরক্ষণেই আকাশের দিকে তাকালো।
বেলা গড়িয়েছে। কিন্তু সূর্যের দেখা নেই। পুঞ্জীভূত কুয়াশায় ছেয়ে আছে প্রকৃতি। সিমেট্রির শতাব্দী প্রাচীন গাছপালার ভিড়ে সহস্র সমাধির সারি। সেই সারিতে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছে সারলোট। যে ঘুম কোনোদিন ভাংবেনা।

রবার্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেয়ের সমাধির দিকে এগিয়ে চলল। তাকে শক্ত হতে হবে। অন্তত স্ত্রী হেনার সামনে তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না।
মেয়ের মৃত্যুতে জীবন্ত পাথরের মতো হয়ে গেছে হেনা। একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি এই অব্দি। রবার্ট পাশে এসে দাড়াতেই হেনা চিন্তিত গলায় বলে উঠল,

—–” আচ্ছা ওর কি শীত লাগছে!? গায়ে তো গরম কাপড়ও নেই। সর্দি লেগে যাবে না তো ওর!?

সাথেসাথেই রবার্টের চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পড়ল। অসহ্যকর কষ্ট হচ্ছে তার। কিভাবে সামলাবে সে হেনা’কে? তাদের এই কষ্টের শেষ কোথায়!?

____________________

ঘড়িতে বেলা বারোটা তেইশ বাজে। ফোনস্ক্রিনে তাকিয়ে আছে নীরা। কল লিস্টে ওপরে মায়ের নাম্বার উঠে আছে। নীরা কল দেবে কি দেবে না ভেবে পাচ্ছেনা।
দিয়েও বা কি বলবে যে, সে ফিরে যাচ্ছে!? কোথায় ফিরে যাবে নীরা!? মিলিয়ানকে ছেড়ে নিজেকে বাচাতে সে কিভাবে পালিয়ে যাবে!?

আর ওরহান! তাকে ছেড়ে সে কিভাবে যাবে? ওরহানের প্রতি তার মনে জমতে থাকা সুপ্ত অনুভূতি গুলো যেন মুহুর্তেই বিস্ফোরণের মতো ছিটকে বেরিয়েছে আজ।
ওরহানের চাহনি, স্পর্শ সবকিছুতেই অদ্ভুত ভালো লাগা অনুভব হচ্ছিলো নীরার। কিন্তু সেই সাথে তার মনের দ্বিধাদ্বন্দ্ব আরও প্রগাঢ় হয়ে উঠছে। ওরহান তো সাধারণ কেউ নয়। তাহলে তার প্রতি এমন অনুভূতি হওয়ার কারণ কি?

ফোনের রিংটোন পেয়ে চমকে উঠল নীরা। ফোনস্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল মরিস কল দিচ্ছে। মনেমনে বিরক্ত হতে গিয়েও হল না।
মনে হচ্ছে সে যেন একরাশ অন্ধকারের মাঝে একচিলতে আশার আলো দেখতে পেয়েছে। নীরা দ্রুত কল রিসিভ করতেই, ওপাশ থেকে মরিস বলে উঠল,

—–” হ্যালো! নীরা! থ্যাংক গড তুমি রিসিভ করেছো। তোমাকে কতবার কল দিয়েছি দেখেছো? তোমার বাসায়ও গেছিলাম। কিন্তু তালা মারা। কোথায় তুমি নীরা?

—–” মরিস! আমি খুব বিপদে পড়েছি। তুমি কি আসতে পারবে প্লিজ!?

—–” মানে? কিসের বিপদ? কোথায় তুমি? আমাকে এখনই লোকেশন সেন্ড করো।

নীরা কল কেটে মরিসকে লোকেশন সেন্ড করে দিল। সে একটা চেষ্টা করবে। শেষ চেষ্টা। মিলিয়ানকে যে উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করা হোক, তাতে মিলিয়ানের কোনো দোষ নেই। সে নিষ্পাপ। হয়তো মিলিয়ান নীরার নিজের সন্তান না। কিন্তু নীরা’ই মিলিয়ানের মা। আর মা হয়ে সন্তানকে রক্ষা করার দায়িত্ব থেকে সে কিছুতেই পিছুপা হবে না।

________________[চলবে]_________________

বিঃদ্রঃ জানি একটু ছোট হয়ে গেছে। নেক্সট থেকে বড় করে দেওয়ার চেষ্টা করবো 😇

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here