#Child_Of_Night
Writer : Tanjima Islam
__________________[26]_________________
দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে। সূর্যের প্রখরতা কমে গিয়ে বইছে শীতল হাওয়া। দানিয়ুব এর নীল জলের ওপর দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে সীগাল। নদীর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এবার ব্ল্যাক ফরেস্ট এর দিকে তাকালো ফ্রেডরিক।
দানিয়ুবের তীর ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল জঙ্গলটা। পাশ দিয়ে সরু লম্বা রাস্তা চলে গেছে। ওরহান উজুন নামের ব্যক্তিটির সেই দোতলা কাঠের বাড়িটা রাস্তার পাশেই।
আসা মাত্রই বাড়িটাতে তল্লাশি চালিয়েছে ফ্রেডরিক। কিন্তু বাদ্যযন্ত্র আর ঘরোয়া জিনিসপত্র ব্যতীত সে কিছুই পায়নি। আশপাশের লোকজনও জানেনা বাড়ির মালিক এখন কোথায়। তাদের সাথে কথায় কথায় যা জানতে পেরেছে তা সংক্ষেপে এমন যে,
” বাড়িটায় আগে এক নিঃস্বন্তান দম্পতি বাস করতো। অনেক ডক্টর দেখিয়েও তাদের বাচ্চা হয়নি।
পরে নাকি এখানকার কোন এক বৃদ্ধার কাছে শোনে যে, ব্ল্যাক ফরেস্ট এর গহীনে একটা মাঝারি পাহাড়ের গুহায় শতবর্ষী এক সন্যাসী রয়েছে।
সে এ ব্যাপারে তাদের সাহায্য করতে পারবে। এই কথা শুনে সেই দম্পতি একদিন ব্ল্যাক ফরেস্ট এ সেই সন্ন্যাসীর খোজে যায়।
সন্নাসীর খোজ তারা পেয়েছিলো কি না কেউ জানে না। তবে সেখান থেকে ফেরার পর শোনা যায় যে, সেই নারী নাকি সন্তানসম্ভবা।
বছর পেরিয়ে যায়। তাদের একটা মেয়ে সন্তান হয়। কিন্তু তারপর প্রায়ই তাদের চিৎকার চেচামেচি শোনা যেতো। রাত নেই দিন নেই স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া লেগেই থাকতো।
স্বামী বলতো,” এ বাচ্চা আমার না! আবার স্ত্রীও বলতো, এ আমার বাচ্চা না। তবে বাচ্চার কান্নাকাটি কখনো শোনা যেতো না।
এভাবে চলতে চলতে, হটাৎ এক রাতেই বাচ্চাসহ তারা কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়।
তাদেরকে এরপর আর এ এলাকায় দেখা যায়নি। এমনকি এলাকার কেউ তাদেরকে এলাকা ছেড়ে যেতেও দেখেনি।
সেই থেকে বাড়িটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়েছিলো। গত চার কি পাঁচ বছর আগে এক বিদেশি ভদ্রলোক বাড়িটা কিনে নেন। তবে সে বাড়িটায় তেমন থাকে না।
বছরে একবার, বিশেষত শীতের সময় এসে থাকে। আর সেই কদিন, কিছু ছেলেমেয়েদের বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখায়।
লোকটা পেশায় ব্যবসায়ী, এদেশ ওদেশ ঘুরে বেড়ায়। এজন্য এলাকার লোকের তার সাথে তেমন আলাপ হয়না। তার কাজের মহিলাকেও খুব কমই দেখা যায়।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ফ্রেডরিক। ব্যাপারটা বড্ড ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। এক রহস্য উদঘাটন করতে গিয়ে আরেক রহস্যের বেড়াজালে আঁটকে যাচ্ছে সে। এই ওরহান উজুন লোকটা আসলে কে!?
কোথা থেকে এসেছে!? কি তার পরিচয়!? এতকিছু জানতে হলে তাকে লোকটার কাছে বাদ্যযন্ত্র বাজানো শিখতে আসা প্রত্যেকটা বাচ্চার কাছে খোজ নিতে হবে। কিন্তু কোথায় পাবে তাদের খোজ?
ফোনের রিংটোন পেয়ে চমকে উঠল ফ্রেডরিক। ফোন স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল লুকাস কল দিচ্ছে। নিশ্চয়ই জরুরি কিছু। দ্রুত কল রিসিভ করল ফ্রেডরিক। ওপাশ থেকে লুকাস বলে উঠল,
—–” স্যার! আপনি কি এখনও রেগেন্সবূর্গ এ আছেন?
—–” হ্যাঁ, আছি। কেন কি হয়েছে?
—–” ভিক্টিম ৩ জনের ইনফরমেশন পেয়েছি। আপনি কি একটু গিয়ে দেখবেন?
—–” ইনফরমেশন গুলো এখনই আমাকে মেইল করো। আমি এখন রেগেন্সবূর্গ থানায় যাচ্ছি।
—–” ওকে স্যার!
কল কেটে দিল লুকাস। ফ্রেডরিক একবার দানিয়ুবের দিকে তাকিয়ে দ্রুত গাড়িতে উঠে বসল। মনে হচ্ছে কালকের আগে এখানের কাজ শেষ হবে না।
_____________________________
ঘুম ভেঙেছে নীরার। বেডে হেলান দিয়ে সে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। নখ দিয়ে চাদর খোটাচ্ছে আর ভাবছে, সোফিয়া কিভাবে মারা গেলো? তাকেও কি মিলিয়ান মেরেছে নাকি অন্য কেউ?
আর মরিস? সে কেমন আছে!? নার্সকে মরিসের ব্যাপারে তখন জিজ্ঞেস করেছিলো নীরা। প্রতিত্তোরে নার্স শুধু বলেছে, সাড়ে চারটার দিকে ডক্টর আসবে। বলেই চলে গেলো! চলে যাওয়ার আগে তার চুল বেনী করে দিয়েছে নার্স।
নীরা আরেকবার ঘড়িতে তাকালো। চারটা তেত্রিশ বাজে। ডক্টর তো এখনও এলো না! আচ্ছা, তার বাসায় কি কেউ খবর দিয়েছে? কি করে দেবে? তারা তো দেশে। খবরটা না শুনলেই ভালো। নয়তো বাবা-মা ভীষণ দুশ্চিন্তা করবে।
নীরা’র সাতপাঁচ ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে কেবিনের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল ডক্টর জোনাস। নীরা সোজা হয়ে বসল। জোনাস পাশ থেকে একটা টুল নিয়ে বসে বলল,
—–” গুড আফটারনুন মিস নীরা!
—–” গুড আফটারনুন ডক্টর।
—–” শরীর কেমন আছে এখন?
—–” ভালো।
নীরা মাথা নিচু করে চাদর খুটিয়েই চলেছে। ডক্টর তার হাবভাব বোঝার চেষ্টা করছে। নীরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে উঠল,
—–” ডক্টর! সোফিয়া কি মারা গেছে?
মৃদু কেপে উঠল নীরা’র কন্ঠঃ। ডক্টর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ” হুম।
ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে রাখল নীরা। মুহুর্তের জন্য সোফিয়ার মুখটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে। সোফিয়া তার বেস্টফ্রেন্ড ছিলো। এই দেশে আসার আগেও কখনো ভাবেনি, এখানে কেউ তার বেস্টফ্রেন্ড হবে।
নতুন জায়গা, নতুন মানুষের মাঝে নিজেকে ভিনগ্রহের প্রাণী ব্যতীত কিছুই মনে হত না নীরা’র। ঠিক সেই সময় সোফিয়াই ছিলো তার পাশে। নিজে থেকে নীরা’র সাথে পরিচিত হয়ে, নীরা’কেও মিশিয়ে নিয়েছিলো নিজেদের মাঝে।
এখানকার রাস্তাঘাট, চলাফেরা, মানুষের সাথে কথা বলা, এদেশের কালচার সবই সোফিয়ার কাছেই শিখেছিলো নীরা। সোফিয়াকে বাংলাদেশে ঘুরতে নিয়ে যাবে বলেছিলো সে। বেস্টফ্রেন্ডকে নিজের দেশের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। অথচ আজ সে নেই! চিরতরে চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে।
—–” আর মরিস!?
নীরা’র কান্না গলায় আঁটকে আছে। সেই কান্না, ধারালো ছুরির মতো ফালাফালা করে দিচ্ছে তার গলা। জোনাসের মনে নানানরকম প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। সে কি অফিসার ফ্রেডরিক এর জন্য অপেক্ষা করবে? নাকি নিজেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করবে!?
—–” উনি বেচে আছেন। কিন্তু ওনার এখনও জ্ঞান ফেরেনি। আশা করছি খুব শীঘ্রই ফিরবে।
নীরা চোখ বুজল, সাথেসাথে গড়িয়ে পড়ল এক ফোটা নোনাজল। বুকের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা দীর্ঘশ্বাস। যাতে মিশে আছে সন্তান, ভালবাসা আর বন্ধু হারানোর বেদনা।
—–” মিস নীরা! জানি এটা প্রশ্ন করার সঠিক সময় নয়। তবে জানতে পারলে, অপরাধীদের ধরতে সুবিধা হবে।
নীরা কিছু বলল না। সে নিজেকে যতটা সম্ভব সামলানোর চেষ্টা করছে। জোনাস এবার একটু নড়েচড়ে বসে বলল,
—–” আপনি আর আপনার বন্ধুরা কি একটা গাড়িতেই কটেজে গেছিলেন? নাকি আলাদা আলাদা?
ভ্রু কোচকালো নীরা। ডক্টর হটাৎ গাড়ির কথা জিজ্ঞেস করছে কেন? পরক্ষণেই তার মনে পড়ল নিউজ পেপারে লেখা ছিলো যে, কটেজের বাইরে দুটো গাড়ি পেয়েছে পুলিশ। তারমধ্যে একটা ওরহানের। পুলিশ কি তাহলে ওরহানকে খুজছে!? মনেমনে হাসল সে। যে মানুষটাই আর নেই, তাকে কোথায় খুজবে পুলিশ!?
—–” মিস নীরা!?
—–” হ্যাঁ, মরিস আর সোফিয়া একটা গাড়িতে এবং আমি আর ওরহান আলাদা একটা গাড়িতে গেছিলাম।
—–” ওরহান আপনার কে হন?
চুপ হয়ে গেলো নীরা। এবার কি বলবে সে!? ঘটনাটা ধামাচাপা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই তার। সে তো আর বলতে পারবে না যে, তার ছেলে একটা ডেমন আর তার ভালবাসা একজন ভ্যাম্পায়ার!
কি একটা অবস্থা! সে কি কখনো ভেবেছিলো, একদিন তার জীবনে এমন অদ্ভুত ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবে!? স্বাভাবিক জীবন মুহুর্তেই মোড় নেবে ভিন্ন জগতের দিকে! নীরা অনেক ভেবে বলল,
—–” ওরহান আমার খুব কাছের একজন।
—–” যেমন?
বিরক্ত হল নীরা। কিন্তু প্রকাশ করলো না। ডক্টর তাকে পুলিশের মতো জেরা করছে। নিশ্চয়ই এসব গিয়ে পুলিশকে জানাবে। সে যদি এখন সন্দেহজনক কিছু করে বসে তো, তাকেই অপরাধী ভেবে বসবে এরা। নীরা নিজেকে শান্ত রেখে বলল,
—–” আপনি ঠিক কি জানতে চাইছেন সোজাসুজি বলুন। এভাবে ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলবেন না!
জোনাস বেশ থতমত খেয়ে বলল, ” আ’ম স্যরি নীরা। কিছু মনে করবেন না। আসলে, এই কেসটা যে অফিসার দেখছেন তিনিই আমাকে বলেছেন আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। যদি আপনি আমাকে বলতে না চান, তো জোর করবো না। উনিই আপনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।
চলে গেলো জোনাস। নীরা একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ” যাক! পুলিশ আসার আগে ভাবার জন্য কিছুটা সময় পাওয়া যাবে।
__________________________
জানালা দিয়ে আরেকবার আশপাশটা দেখে নিল আন্দ্রেস। নাহ, কেউ নেই। একেবারে নিরিবিলি প্রাকৃতিক পরিবেশ। এখানে লোকজনের সমাগম নেই বললেই চলে।
ডাকাউ শহর থেকে বেশ দূরে জায়গাটা। বহুদূর পরপর ঘরবাড়ি চোখে পড়ে। সেগুলোর বেশিরভাগই পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে বহুবছর ধরে। আন্দ্রেস সেরকমই একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে এসে উঠেছে।
একতলা বাড়িটার দেয়ালে জায়গায় জায়গায় সিমেন্ট খসে পড়েছে। ওপরে টালির ছাদ। দুয়েক জায়গায় ফাক ফোকর দিয়ে বাইরের আলো আসছে ভেতরে। পাশাপাশি দুটো ঘর।
একটাতে হসপিটালের বেডের মতো সরু লম্বা তোশক বিছানো। বালিশ, কাথা নেই। এদিক সেদিক বাটি ঘটি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আগে যারা এখানে থাকতো, তাদের জিনিসপত্র। চলে তো গেছে কিন্তু এসব আর সাথে নিয়ে যায়নি।
আন্দ্রেস এর অবশ্য এতে ভালই হয়েছে। আজ রাতটা অন্তত শোয়ার ব্যবস্থা আছে এখানে। ফাকা ঘরটার মেঝেতে লাশের বস্তাটা রেখে চারপাশে গোল করে একটা মন্ত্রপূত গন্ডি বানিয়ে দিল আন্দ্রেস।
এবার বাকি কাজ সারতে হবে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বেশ কিছুদূর হেটে একটা দোকান দেখতে পেলো। এটা সে ট্যাক্সিতে আসার সময় দেখেছে।
গীর্জা থেকে মোমবাতি এনেছে ঠিকই, কিন্তু দেশলাই আনতে ভুলে গেছে। দোকানে ঢুকে দেখল, একজন বৃদ্ধ বসেবসে সিগারেট ফুকছে। আন্দ্রেসকে দেখেই একরকম লাফিয়ে উঠল।
আন্দ্রেসকে সে চেনেনা। কিন্তু পোশাক আশাকে বুঝতে বাকি নেই যে, সে একজন বিশপ। কিন্তু এখানে কি করছে!? সে তো ডাকাউ এর বিশপ না!
—–” এক প্যাকেট দেশলাই দিন তো।
বিরক্তির সুরে বলল আন্দ্রেস। বৃদ্ধ পড়ি কি মরি হয়ে হাত থেকে সিগারেট ফেলে এক প্যাকেট দেশলাই নিয়ে এগিয়ে দিল আন্দ্রেসের দিকে। আন্দ্রেস টাকা দিয়ে চলে আসতে নিতেই লোকটা জিজ্ঞেস করল,
—–” আপনি কি আমাদের নতুন বিশপ!?
আন্দ্রেস হ্যাঁ না কিছু না বলেই হাটা ধরল। এখানকার লোকজন খুবই কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুক্তিবোধহীন ধরনের। যদি সন্দেহজনক কিছু দেখে তো না জেনেশুনেই তাকে সবাই মিলে পিটিয়ে সোজা ওপরে পাঠিয়ে দেবে। তাই বেশি সময় নেওয়া যাবে না। কাজটা শেষ হলেই এখান থেকে কেটে পড়তে হবে তাকে।
সূর্যের তেজ কমে গেছে। শীত লাগছে বেশ। সন্ধ্যা নামবে বোধহয়। বাড়ির দরজার সামনে এসে আন্দ্রেস হাতঘড়িতে তাকিয়ে দেখল, বিকেল পাঁচটা সতেরো বাজে। অন্ধকার হতে বেশি দেরি নেই।
ঘরে ঢুকে ভালো করে ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিলো সে। দেশলাই ঠুকে পুরো ঘর জুড়ে মোটা মোটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল। জানালা দরজা বন্ধ ঘরটা মুহুর্তেই আলোকিত হয়ে উঠেছে।
দেশলাইটা রেখে এবার গন্ডির ভেতর ঢুকল আন্দ্রেস। বস্তা থেকে লাশ বের করে শুইয়ে দিল মেঝেতে। গন্ডির চারপাশে চারটা কাঠের ক্রুশ রেখে তাতে হলি ওয়াটার ছিটিয়ে দিল। শীতের রাত অনেক বড়, তাই খাবারের পর্ব এখনই সেরে নিতে হবে।
আন্দ্রেস ব্যাগ খুলে একটা পাউরুটি, কলা আর এক বোতল পানি বের করে খেতে লাগল। ঘড়িতে এখন পাঁচটা সাতান্ন বাজে। খেয়েদেয়ে আরামছে কিছুক্ষণ ঘুম পড়া যাবে। পরে উঠে যা করার করবে সে।
__________________________
সোফিয়ার বাসা থেকে বেরিয়ে মরিসের বাসার দিকে রওনা হয়েছে ফ্রেডরিক। সাথে আছে রেগেন্সবূর্গ থানার ভারপ্রাপ্ত অফিসার নিকোলাস আর তার সহকর্মী। সোফিয়ার বাবা-মা গত রাতেই মিউনিখ চলে গেছে মেয়েকে শেষ দেখা দেখার জন্য। আশপাশের প্রতিবেশিদের থেকেও বিশেষ কিছু জানা যায়নি।
কিছুক্ষণ আগে ডক্টর জোনাস এর কল পেয়েছিলো ফ্রেডরিক। জোনাস জানিয়েছে যে, নীরার জ্ঞান ফিরেছে। সে যেন যত দ্রুত সম্ভব এখানকার কাজ মিটিংয়ে মিউনিখ ফিরে যায়।
কলিং বেলের শব্দ পেয়ে চমকে উঠল ফ্রেডরিক। তারা এখন মরিসের বাসার গেইটে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর একজন মেইড এসে দরজা খুলে দিল। হটাৎ পুলিশ দেখে বেশ ভয় পেয়েছে মনে হচ্ছে। সে আমতা-আমতা করে বলল,
—–” জ্বি! কাকে চাই!?
—–” মি. ম্যাক্স আছেন বাড়িতে!?
—–” না, উনি তো আজ ভোরেই ছেলেকে দেখতে মিউনিখ চলে গিয়েছেন।
বিরক্তর নিঃশ্বাস ফেলল ফ্রেডরিক। এখানে খোজ নিতে আসাই তার বোকামি হয়েছে। বরং তখনই মিউনিখ ফিরে গেলে আর এতো ঝামেলা পোহাতে হত না। নিকোলাস বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
—–” নেক্সট, মিস নীরা’র বাসা।
ফ্রেডরিক যাওয়ার ইচ্ছে বোধ করলো না। সেখানে গিয়েও বিশেষ কোনো লাভ হবে বলে মনে হচ্ছে না তার। নীরা বাঙালি, পড়াশোনার জন্য এদেশে এসেছে। তার পরিবার থাকে বাংলাদেশে। এখানে কার কাছে কি খোজ নেবে তারা!? নিকোলাস আবার ডেকে উঠল। ফ্রেডরিক এগিয়ে এসে বলল,
—–” এখানে আমার আর কাজ নেই অফিসার। মিস নীরা’র পরিবার বাংলাদেশে। এখানে কার কাছে গিয়ে কি জিজ্ঞেস করবো!? মনে হয়না গিয়ে কোনো লাভ হবে।
নিকোলাস মাথা নেড়ে বলল,” বেশ, আপনি তাহলে ফিরে যান। আমরা নাহয় দেখি গিয়ে।
—–” আচ্ছা।
নিকোলাসকে বিদায় জানিয়ে মিউনিখ ফেরার জন্য রওনা দিল ফ্রেডরিক। সোজা হসপিটালে যাবে সে। নীরা’র সাথে আগে কথা বলতে হবে। ঐ বলতে পারবে আসলে কি ঘটেছে!
____________________________
খুটখাট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আন্দ্রেসের। আস্তেধীরে চোখ মেলে দেখল সে গন্ডির পাশে শুয়ে আছে। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল আন্দ্রেস। দ্রুত চারপাশে তাকিয়ে দেখল, দরজা জানালা সব বন্ধ আছে।
কয়েকটা মোমবাতি নিভু নিভু প্রায়। শোয়া ছেড়ে উঠে নতুন কয়েকটা মোমবাতি জ্বালিয়ে দিল আন্দ্রেস। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল রাত সাড়ে নয়টা বাজে। এবার শুরু করা যাক।
ব্যাগ থেকে বাইবেল বের করে একটা বড় রূপোর তৈরি ক্রুশ হাতে নিল। পৃষ্ঠা খুলে ধীরেধীরে পাঠ করতে লাগল সে। বাইবেল পড়তে পড়তে হলি ওয়াটার ছিটিয়ে দিচ্ছে গন্ডির ভেতর। একমনে বাইবেল পড়তে পড়তে হটাৎ ঘাড় মটকানোর মতো শব্দে সচকিত হয়ে তাকালো আন্দ্রেস। সারলোট উঠে বসেছে। তার চোখ বন্ধ।
আন্দ্রেস আবার বাইবেল পড়ায় মনোযোগ দিল। অনুচ্ছেদটা একটানা পড়ে শেষ করে সামনে তাকাতেই দেখল, হামাগুড়ি দেওয়ার মতো করে আন্দ্রেসের দিকে তাকিয়ে বসে আছে সারলোট। তার চোখ জোড়া চুনি পাথরের ন্যায় টকটকে লাল!
ঠোটে একটা আলগা হাসি লেগে আছে। ভয়ংকর লাগছে দেখতে! যেন নরক থেকে উঠে এসেছে একটা শয়তান! শুকনো কয়েকটা ঢোক গিলল আন্দ্রেস। ক্রুশটা হাতে চেপে ধরে বলল,
—–” তুমি কে!?
কোনো উত্তর এলো না। আন্দ্রেসের কথা শেষ হতেই কেমন যেন নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে চারপাশে। হটাৎ খেয়াল করল, সে সারলোটের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছে না। সম্ভবত সে তাকে সম্মোহন করার চেষ্টা করছে। আন্দ্রেস দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে মোমবাতির প্রজ্বলিত শিখায় তাকিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল,
—–” কে তুমি!?
—–” সারলোট পল!
ফিসফিস করে বলল সারলোট। আন্দ্রেস দৃষ্টি আবদ্ধ রেখেই ধমকে উঠল, ” সারলোট তো মারা গেছে! সত্যি করে বলো তুমি কে!?
খিলখিলিয়ে হেসে উঠল সারলোট। সেই হাসির ঝংকারে কেপে উঠল পুরো বাড়িটা। মোমবাতির শিখা দুলতে লাগল। আন্দ্রেস আবারও ধমকে উঠল,
—–” কে তোমাকে রক্তচোষা পিশাচে পরিণত করেছে!?
মুহুর্তেই হাসি থেমে গেলো সারলোটের। থমথমে মুখে সে আন্দ্রেসের দিকে তাকালো। স্পষ্ট ক্ষোভ ফুটে উঠেছে তার চোখেমুখে। আন্দ্রেস তাকিয়ে আছে মোমবাতির শিখায়। সারলোট এবার দাতে দাত পিষে বলে উঠল,
—–” লামিয়ার ছেলে মিলিয়ানকে নিতে ভ্যাম্পায়ারদের পাঠিয়েছিলো কেইন! আমি দেখেছিলাম! আমি দেখে ফেলেছিলাম ওদের!
একটু থেমে আবার চেচিয়ে উঠলো সারলোট,” কেইন! কেইন কোনো স্বাক্ষী রাখেনা! তাই আমাকেও!
চমকে উঠল আন্দ্রেস। কেইন!? লামিয়া!!? মিলিয়ান!!!? বিড়বিড় করে নাম গুলো আওড়ালো কয়েকবার। পরক্ষণেই পতপত শব্দে দৃষ্টি সরিয়ে সামনে তাকাতেই আরেক দফা আঁতকে উঠল সে।
সারলোট বাদুড় আকৃতি ধারণ করে পুরো ঘরময় উড়ে বেড়াচ্ছে! তার অতিকায় ডানার ঝাপটায় নিভে যাচ্ছে সব মোমবাতি। আন্দ্রেস দ্রুত বাইবেলের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পড়তে লাগল। প্রায় সাথেসাথেই অন্ধকারে ডুবে গেল পুরো বাড়িটা।
সেই অন্ধকারে ভূতের মতো বসে রইলো আন্দ্রেস। ডানা ঝাপটানোর শব্দটা আর শোনা যাচ্ছে না। সারলোট কি তাহলে পালিয়ে গেলো!? বাইবেল রেখে ব্যাগ থেকে দেশলাই বের করল আন্দ্রেস। আতংকে তার বুক ধড়ফড় করছে। যদি সত্যিই সারলোট পালিয়ে যায় তো, তাকে ধরতে বেশ বেগ পেতে হবে। সেই সাথে চলতে থাকবে এই হত্যালীলা!
আন্দ্রেস কাপা কাপা হাতে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে ক্রুশটা হাতে চেপে আস্তে-ধীরে উঠে দাড়ালো। মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় দেখল, ঘরের জানালা দরজা সব হাট করে খোলা!
দম বন্ধ হয়ে এলো আন্দ্রেসের। সে ভয়ংকর একটা ভুল করে ফেলেছে। বাকিদের ধরতে গিয়ে সে আরেকটা পিশাচকে মুক্ত করে দিয়েছে! এন্ড্রুর কথা গুলো কানে বাজতে লাগল আন্দ্রেসের,
—–” বিশপ! আপনি যা করতে চাচ্ছেন তা ভয়ংকর বিপদ বয়ে আনতে পারে। তারচেয়ে কতৃপক্ষকে জানিয়ে দিন। ওনারাই যা করার করবে।
আন্দ্রেস তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল, ” অনেক দেরি হয়ে গেছে এন্ড্রু! এখন কিছুই আমার হাতে নেই। সারলোট মুক্ত হয়ে গেছে!
ঠিক তখনই অনুভব করল তার কানের পাশ দিয়ে কি যেন একটা সা করে উড়ে গেলো! দ্রুত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো আন্দ্রেস। হাতে ধরা মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় দেখল, এক অতিকায় বাদুড় উড়ে আসছে তার দিকে!
_________[চলবে]________