Child_Of_Night Part-29

0
1019

#Child_Of_Night
Writer : Tanjima Islam
.
_________________[29]_______________
.
.
.
শীত চলে গেছে। বরফ গলে ধুয়ে গেছে রাস্তাঘাট। লোকজনের চলাচল বেড়েছে। সন্ধ্যা নামার বেশি দেরি নেই। বিষন্নতায় ঘেরা ধূসর রং চলে গিয়ে প্রকৃতিতে সতেজতা ফিরে এসেছে। জার্মানিতে এখন বসন্তকাল।

থমসনদের বাসার সামনে একটা ট্যাক্সি এসে দাড়ালো। ভেতর থেকে নেমে এলো নীরা। হসপিটাল থেকে ফিরেছে সে। গেটের মুখে দাড়িয়ে কিছুক্ষণ বাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলো।

এই বাড়িটা একদিন হাসিখুশিতে ভরপুর ছিলো। নবদম্পতির ভালবাসায় সাজানো ছিলো বাড়িটা। তাদের ঘর আলো করে এসেছিলো ফুটফুটে সন্তান! অথচ এখন! তারা কেউ নেই! না লিও, না মীরা আর না মিলিয়ান!

নীরা’র বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। পরক্ষণেই সে নিজেকে সামলে অন্যদিকে তাকাতেই চোখে পড়ল, পলদের বাড়িটা। নানান রকম সুগন্ধি ফুলগাছে ঘেরা বাড়িটা দেখতে দারুণ লাগে।

বিশেষ করে গেটের পাশ বেয়ে ওঠা বাগানবিলাস গাছটা! কি সুন্দর গোলাপি রঙের ফুল ধরে! সারাবছর ফুল থাকে গাছটায়। শুধু শীতকাল বাদে।

এগিয়ে গেলো নীরা। কিন্তু ঢুকতে পারলোনা। গেটে তালা ঝোলানো। ভেতরে উঁকি মেরেও কাউকে দেখতে পেলোনা। বোধহয় কেউ বাড়িতে নেই। সারলোটের আকস্মিক মৃত্যুতে বেশ অবাক হয়েছে নীরা। মেয়েটা হটাৎ কিভাবে মারা গেলো!?

সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ফিরে এসে বাড়ির গেট খুলে ভেতরে ঢুকল নীরা। লন পেরিয়ে এসে সদরদরজা খুলল। ভেতরে গুমোট অন্ধকার। আজ কতদিন বাড়িটাতে জীবন্ত কারো আসা-যাওয়া ছিলো না। নীরা ড্রয়িংরুমের বোর্ডসুইচ চেপে লাইট অন করল।

মুহুর্তেই অন্ধকার কেটে ছড়িয়ে পড়ল এক ঝলক কৃত্রিম আলো। নিশ্চুপ পরিবেশ। নীরা পায়ে-পায়ে হেটে মিলিয়ানের রুমের দরজাটা খুলল। লাইট অন করতেই রুমটা আলোকিত হয়ে গেছে। বেডটা অগোছালো, সে রাতে এখান থেকেই মিলিয়ানকে কোলে তুলে নিয়ে গেছিলো নীরা।

পড়ার টেবিলটা পরিপাটি করে সাজানো। পাশে রাখা ড্রয়িং স্ট্যান্ড আর পেইন্ট ব্রাশ সেট রাখা। নীরা ফোনটা বেড টেবিলের ওপর রেখে মিলিয়ানের বেডে শুয়ে পড়ল। এই বেডে সে কতরাত মিলিয়ানকে কোলে নিয়ে ঘুমিয়েছে। বেডে শুয়ে মিলিয়ানের শরীরের ঘ্রাণ পাচ্ছে নীরা। কোনো এক অচেনা ফুলের মিষ্টি সুবাস! সাথে মিশে আছে বাচ্চাবাচ্চা সুগন্ধি!
.
.
___________________________
.
.
.
.
এক ঘুমে রাত পার দিয়েছে নীরা। সেই সন্ধ্যায় মিলিয়ানের রুমে ঘুমিয়ে তারপর ঘুম ভেঙেছে আজ ভোরে। হসপিটালে ঠিকমতো ঘুম হয়নি তার। চরম অস্বস্তি আর আতংকে কেটেছে প্রতিটি রাত। যেন বহুকাল পরে সে একটু শান্তিতে ঘুমিয়েছে।

ঘড়িতে পাঁচটা পয়তাল্লিশ বাজে। নীরা ফজরের নামাজ পড়ে কিচেনে এসে ঢুকল। স্টোভে পানি গরম করতে দিয়ে তাতে আদা কুচি আর তেজপাতা ছেড়ে দিল। রঙ চা খেতে মন চাচ্ছে তার। গত রাতে কিছু খায়নি সে, অথচ ক্ষিদে পাচ্ছেনা। কি একটা অস্বস্তি হচ্ছে ভেতরে ভেতরে।

রেগেন্সবূর্গে এসেছিলো ফ্রেডরিক। নিশ্চয়ই অনেক কিছুই জানতে পেরেছিলো। তাই তো সে রাতেই আবার হসপিটাল ফিরে গেছিলো নীরা’র কাছে। নীরা তো ভেবেই নিয়েছিলো, সব শেষ। কিন্তু সেই মেয়েটা! সে কেন ফ্রেডরিককে খুন করল? তার কি ফ্রেডরিক এর সাথে কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা ছিলো? নাকি অন্য কোনো কারণে হত্যা করেছে? আর দানিয়ুবের ঘটনা টার প্রকৃত সত্যিই বা কি?

পানি টগবগ করে ফুটছে। নীরা এক চামচ চা’য়ের গুড়া ঢেলে দিল ফুটন্ত পানিতে। সাথেসাথেই পানিটা রক্তবর্ন ধারন করল। কপালে চিন্তার ভাজ পড়ল নীরা’র। দানিয়ুব’এর ঘটনাটা প্রিপ্ল্যান ছিলো।

যে দু’জন পুলিশকে খুন করা হয়েছে তারা দুজনই ফ্রেডরিক এর সাথে মিলে এই কেসটার তদন্ত চালাচ্ছিলো। মিউনিখ ফ্রেডরিক এর মৃত্যু আর দানিয়ুব এ পুলিশ দু’জনের মৃত্যু একই পরিকল্পনার অংশ!

কাপে চা আর চিনি নিয়ে চামচ দিয়ে নাড়তে নাড়তে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো নীরা। কাজটা যে বা যারাই করে থাকুক তারা যে নীরা’কে বাচানোর জন্যই এসব করেছে তা বুঝতে বাকি নেই নীরা’র। কিন্তু তারা কারা!? ওরহানের কেউ? নাকি ওরহানই!

চায়ের কাপ নিয়ে লনে এসে বসল নীরা। মাথায় তার নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সেদিন কি ওরহান সত্যিই মিলিয়ানের হাতে ধ্বংস হয়েছিলো? নাকি কটেজ থেকে কোনোভাবে পালিয়ে গেছিলো সে!?

পুলিশ সেই পঞ্চভুজাকৃতি কক্ষ থেকে শুধু তাদের তিনজনকেই পেলো, তাহলে বাকিরা গেলো কোথায়!? ভ্যাম্পায়ার তো জীবন মৃতের মাঝামাঝি একটা সত্ত্বা। তাদের ধ্বংস করলে কি তাদের অস্তিত্বের অবশিষ্ট কিছুই থাকেনা!?

নীরা ভাবছে সে আবার মিউনিখ যাবে। ফেরিঙ্গাসি লেকের সেই কটেজটাতে! যদি কিছু খুজে পাওয়া যায়! ফোনে টেক্সট আসার শব্দে ভাবনায় ছেদ পড়ল নীরার। ফোন স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল ভার্সিটি খোলার ডেট দিয়েছে। ক্লাস শুরু হবে! ভ্যাকেশন শেষ!

সোফিয়ার কথা মনে পড়ল নীরা’র। একসাথে আর ভার্সিটি যাবেনা তারা। ক্লাসে পাশাপাশি বসবে না। ক্যাম্পাসে বসে আর আড্ডা দেবেনা! আর কখনোই না! একমাত্র বেস্টফ্রেন্ডকে নীরা সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলেছে!

সাড়ে ছয়টা বাজে। ফুরফুরে বাতাস বইছে চারিদিকে। নীরা বুক ভরে একটা শ্বাস নিল। লোকজন হাটতে বেরিয়েছে। ট্যাক্সির শব্দ শোনা যাচ্ছে থেকে থেকে। ঘুমন্ত নগরীতে রাত কেটে গিয়ে লোকজনের কোলাহলে মুখরিত হচ্ছে চারিদিক।

নীরা লন থেকে উঠে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। ব্রেকফাস্ট করতে বাইরে যেতে হবে, কেনাকাটা করতে হবে অনেক কাজ বাকি। ঘরদোর ঝেড়ে নীরা বাবাকে কল দিল। কয়েকবার রিং বাজতেই রিসিভ করল মুহিদুল,

—–” হ্যালো! আব্বু!

—–” হ্যাঁ নীরা’মা। ঘুম থেকে উঠেছিস?

—–” হ্যাঁ, উঠেছি আগেই। এখন বাইরে যাবো। আম্মু কেমন আছে এখন?

—–” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। তোর ছোট মামা মামি এসেছে আজ। বাসা থেকে রান্না করে এনেছে।

—–” ও আচ্ছা। তুমিও একটু সাবধানে থেকো আব্বু।

—–” হুম সে থাকবো। তা তুই যে এতদিন পর বাসায় ফিরলি, মিলিয়ান কার কাছে ছিলো?

মিলিয়ানের কথা শুনে থমকে গেল নীরা। এখন কি বলবে সে? আর বাবা হটাৎ মিলিয়ানের কথা কেন জিজ্ঞেস করছে!? অবশ্য জিজ্ঞেস করাই স্বাভাবিক। সে তো আর জানেনা, মিলিয়ান এর জন্যই এসব হয়েছে!

—–” নীরা!

—–” আম্মু তোমাকে বলেনি? আমি তো ওকে অরফানেজ এ রেখে এসেছি।

—–” ও আচ্ছা!

কিছুটা মনক্ষুণ্ণ শোনালো মুহিদুলের কন্ঠঃ। সে বোধহয় আশা করেনি যে, তার মেয়ে মিলিয়ানকে অরফানেজ এ দেবে।

—–” আব্বু! বলছি যে, আমার কিছু টাকা লাগবে।

—–” ওহ! হুম, তুই আসবি শুনে আর টাকা পাঠাইনি এ মাসে। তুই এমাউন্ট বল আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

বাবা-র সাথে কথা বলে কল কেটে দিল নীরা। মিলিয়ান বেচে থাকতে তাকে নিয়ে কত অস্বস্তি ছিলো তার বাবা-মায়ের। আর আজ যখন মিলিয়ান নেই, তখন তার খোজ নিচ্ছে!
.
.
.
_________________________
.
.
.
.
.
.
নীরা’র বাবা টাকা পাঠিয়েছে। নীরা টাকা তুলে আগে ব্রেকফাস্ট সেরে নিল। এখন সে শপিং করবে। অনেক কেনাকাটা বাকি। শুকনো খাবার কাচা বাজার আরও অনেক কিছু।

‘র’ মার্কেট এ ঢুকে কাচা সবজি, প্যাকেটজাত মাছ, মাংস কিনলো। চাল, ডাল, মসলা কিনে এবার মল এ ঢুকল নীরা। ট্রলি নিয়ে ঘুরতে লাগল। কিছু স্ন্যাকস আর কুকিজ কিনেছে সে। আর কি নেবে বুঝতে পারছেনা। অথচ বাসায় গেলে মনে পড়বে সে কি কি নেয়নি।

হটাৎ মনে হল কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে! কে? নীরা ঘাড় ফেরালো। আশেপাশে কাস্টমাররা কেনাকাটা নিয়ে ব্যস্ত। কেউ তো তার দিকে তাকিয়ে নেই! নীরা আবার কেনাকাটায় মন দিল। কিন্তু বেশিক্ষণ মনোযোগ ধরে রাখতে পারলো না। তার ষষ্ঠইন্দ্রিয় বলছে, কেউ তাকে দেখছে! খুব কাছ থেকে তাকিয়ে আছে তার দিকে!

নীরা এবার উদ্বিগ্ন হয়ে চারপাশে তাকালো! এবারও কিছুই তার চোখে পড়ল না। নীরা’র এবার ভয় হতে লাগল। কে দেখছে তাকে!? পুলিশ! নাকি অন্য কেউ!? অন্য কেউ কে হতে পারে!?

নীরা দ্রুত কেনাকাটা সেরে মল থেকে বেরিয়ে এলো। ট্যাক্সি ডেকে উঠে বসল তাতে। ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল, ” ম্যাম কোথায় যাবেন?

—–” আপনি ড্রাইভ করুন, বলছি।

নীরা বারবার পেছন ফিরে দেখছে কেউ মল থেকে বেরিয়ে তাকে খুজছে কিনা। কিন্তু এমন কাউকেই দেখতে পেলো না সে। ট্যাক্সি চলছে। চলতে চলতে নীরা’র চোখে পড়ল, রাস্তার পাশে একটা বিলবোর্ডে দানিয়ুবের ছবি দিয়ে কিসের যেন এডভারটাইজ চলছে।

—–” দানিয়ুব সী সাইডে চলুন!

নীরা’র কথা শুনে ড্রাইভার মাথা নাড়ল। মানে হ্যাঁ। ট্যাক্সি ঘুরিয়ে সে সী সাইডের দিকে এগিয়ে চলল। নীরা হটাৎ সী সাইডে কেন যেতে চাইলো নিজেও জানেনা। শুধু তার মন চাচ্ছে সেখানে যেতে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ট্যাক্সিটা দানিয়ুব নদীর তীরে এসে দাড়ালো। নীরা জিনিসপত্র ট্যাক্সিতে রেখে, ড্রাইভারকে বলল তার জন্য অপেক্ষা করতে। ড্রাইভার ট্যাক্সিটা সাইডে দাড় করালো।

দানিয়ুবের তীর ধরে এগিয়ে চলেছে নীরা। নদীর ওপর দিয়ে ভেসে চলা লঞ্চের শব্দ কানে আসছে। সেইসাথে পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ! নীলাভ পানির ওপর দিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে সীগাল! পেজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে আকাশে! কি দারুণ দৃশ্য!

নদীর ওপর দিয়ে ভেসে আসা দমকা হাওয়ায় নীরা’র খোলা চুলে ঢেউ খেলে যাচ্ছে। নীরা চুল গুলোকে সামলাতে পারছেনা। তবে তার বিরক্তও লাগছেনা। কেমন যেন শান্তি লাগছে। নদীর পাড়ে এসে নাকি অন্য কোনো কারণে তা বুঝতে পারছেনা সে। বুঝতে চাচ্ছেও না।

হাটতে হাটতে ওরহানের সেই দোতলা কাঠের বাড়িটার সামনে এসে দাড়ালো নীরা। বিশাল এক লোহার তালা মারা গেইটে। সামনে সাইনবোর্ডে লেখা ” বাড়িটি বিক্রয় করা হবে”

কি আশ্চর্য! বাড়িটা হটাৎ বিক্রি করছে কে? ওরহান? নাকি তার অনুপস্থিতিতে কতৃপক্ষ করছে? নীরা দেখল সাইনবোর্ডের নিচে যোগাযোগ এর জন্য ফোন নম্বর দেওয়া। নীরা দ্রুত ফোন বের করে নম্বরটা সেভ করে নিল। সেখানেই দাঁড়িয়ে কল দিল নম্বরটায়। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল, প্রথমবার রিং বেজেই অফ হয়ে গেলো নম্বর! নীরা কতবার কল দিল! প্রত্যেকবার বলছে ফোন অফ!

নীরা না পেরে প্রতিবেশীদের কাছে খোজ নিল। তারা কেউই বাড়িটার ব্যাপারে কথা বলতে চাইলো না! কিন্তু কেন!? তারাও কি ওরহানের ব্যাপারে কিছু জানে!? দুয়েকজন বৃদ্ধের কাছ থেকে যা জানতে পারলো তা সংক্ষেপে এমন,

” কিছুদিন আগেই মিউনিখ থেকে পুলিশ এসেছিলো একটা কেসের তদন্ত করতে।
তাদের ধারণা সেই কেসের সাথে এই বাড়ির মালিক কোনো না কোনোভাবে জড়িত।
তারা এলাকায় অনেককে জিজ্ঞাসাবাদ করল। তারপর চলে গেলো।
কিন্তু তার পরদিন রাতেই সেই পুলিশদের দু’জন আবার এসেছিলো বাড়িটাতে।
তাদেরকে অনেকেই ভেতরে যেতে দেখেছে। কিন্তু বের হতে কেউ দেখেনি।
পরদিন ভোরে সেই পুলিশ দুটোর রক্তশূণ্য মরদেহ ভেসে উঠেছিলো দানিয়ুবের তীরে।
তারপরই পুলিশ বাড়িটাকে রেস্ট্রিকটেড করে। কিন্তু সন্দেহজনক কিছু পায়নি।
পরে আজ সকালে কে যেন এসে এই সাইনবোর্ড লাগিয়ে গেছে!

নীরা ট্যাক্সির কাছে ফিরে এলো। বেলা গড়িয়েছে। তাকে বাসায় ফিরতে হবে। এখানে ঘুরেফিরে কোনো লাভ হবে না। নীরা ট্যাক্সিতে উঠে বসতেই ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিল। গাড়িটা সী সাইড ছেড়ে শহরে চলে যেতেই সেই দোতলা কাঠের বাড়িটার ছাদ থেকে এক অতিকায় বাদুড় উড়ে গেলো ব্ল্যাক ফরেস্ট এর গহীনে।
.
.
___________________________
.
.
.
.
.
নীরা’র ক্লাস শুরু হয়েছিলো বসন্তের মাঝামাঝি। বসন্ত চলে গেলো, এলো গ্রীষ্ম। জনজীবন অতিষ্ঠ করে তোলা খরতাপ চলে গিয়ে এলো বর্ষা। কি বৃষ্টি সারাদিন! রেইনকোট পরে আসা-যাওয়া করেও প্রচন্ড জ্বর আর সর্দিতে ভুগল নীরা।

এর মাঝে নীরা’র বাবা-মা এসেছিলো জার্মানিতে। মেয়ে যায়নি তাই তারাই চলে এলো শেষে। এক সপ্তাহ থেকে চলে গেছে তারা। নীরা বলেছে, সে গ্রাজুয়েশন শেষ না করে দেশে যাবে না।

নীরা’র বাবা-মা চলে গেলো শীতের কদিন আগে। আবার শীত এলো। এবারের ভ্যাকেশন এ ছুটি পেয়ে নীরা গেছিলো মিউনিখে। সেই ফেরিঙ্গাসি কটেজের পুরাতন কটেজে।

কিন্তু সে পুরো কটেজ ঘুরেও কিছুই পায়নি। পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে কটেজটা। গার্ডেনারের কাছে খোজ নিতে গিয়ে শুনেছে, শীতের শেষেই নাকি কটেজটাকে ভেঙে ফেলা হবে!

হতাশ হয়ে ফিরে এলো নীরা। মন দিল পড়াশোনায়। ধীরে ধীরে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পড়াশোনা নিয়ে। ক্লাস, প্রেজেন্টেশন, এক্সাম নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে। মাসের পর মাস কেটে গেলো!

দেখতে দেখতে কেটে গেলো দুটো বছর! নীরা গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করে ফিরে এলো দেশে। এক মাস ছুটি কাটিয়ে সে আবার ফিরে যাবে জার্মানিতে, এমএসসি করতে।

—–” বলছি, তুই কি আমার কথা গুলো শুনতে পাচ্ছিস নীরা!?

বিরক্ত কন্ঠে বলল নাজনীন। নীরা তাদের ছাদবাগানের গাছ গুলোতে পানি দিতে ব্যস্ত। কদিন ধরেই তার মা মাথা খারাপ করে দিচ্ছে বেড়াতে যাওয়া নিয়ে।

ছোট থেকেই পরিবারের সাথে নীরা বহু জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে। বলা চলে দেশের টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া কোনো জায়গাই তার ঘুরে বেড়ানো বাদ নেই। তাই তার বাবা-মা ঠিক করেছে এবার দেশের বাইরে বেড়াতে যাবে।

নীরা’র এতে কোনো আপত্তি হত না, যদিনা তাদের অন্য কোনো মতলব থাকতো। নীরা খুব ভালো করে জানে তার বাবা-মা কোন উদ্দেশ্যে এমন করছে। এদেশের মানুষের মতে মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি। সেখানে তাদের মেয়ে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করা থুত্থুরে বুড়ি! এখন তাকে যেভাবেই হোক বিয়ে দিয়েই নিশ্চিন্ত হবে তারা!

নীরা’র মামি’র এক চাচাতো বোন পড়াশোনা করতে তুরস্কে গিয়ে সেখানকার এক ছেলেকে বিয়ে করে সেটেল হয়েছে বহু বছর আগে। তাদের ছেলেমেয়েরাও তুর্কিশ। নানুবাসা এদেশে হলেও কোনোদিন এসেছে বলে জানা নেই নীরা’র। সে নিজেও তাদের কোনোদিন চোখে দেখেনি, আত্নীয়স্বজনের কাছে শুনেছে শুধু।

মামির সেই বোনকে নীরা’র বাবা-মা আর বোন দেখেছে। কিন্তু নীরা কখনও দেখেনি। যে কয়বার তারা দেশে এসেছিলো সে কয়বারই নীরা’র ফাইনাল এক্সাম, এসএসসি, এইচএসসি এক্সাম ছিলো। তাই সে যেতে পারেনি। বাসায় দাদা দাদুর সাথে থেকে এক্সাম দিয়েছে।

তো মামির সেই চাচাতো বোনের ছেলের সাথে নীরা’র বিয়ে দেওয়ার কথা ভাবছে নীরা’র মা আর মামি। নীরা তো কিছুতেই রাজি না। ছেলেটা বিদেশে বলে সমস্যা না, যদি এদেশের ছেলেও হত তাও নীরা রাজি হত না।

নীরা নিজেও জানেনা, সে কেন বিয়ে করবে না। বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই তার চোখে ওরহান আর মিলিয়ানের চেহারা ভাসে। তারাই নীরা’র না হওয়া স্বামী আর সন্তান!

—–” শুনতে পাচ্ছি আম্মু! কিন্তু আমি এটা বুঝতে পারছিনা যে মামির কোন দুঃসম্পর্কের বোন যে কি না আরেক দেশে থাকে সেখানে কেন বেড়াতে যেতে চাচ্ছো!?

—–” তোকে বুঝতে হবে না। আমার অনেক দিনের শখ তুরস্কে বেড়াতে যাবো।

বেশ রসিকতা করে বলল নাজনীন। নীরা হেসে বলল,” তো যাও না! আব্বু আর তুমি যাও! না করেছে কে!?

মুহুর্তেই নাজনীনের মুখটা অন্ধকার হয়ে গেলো। মেয়েটা তার বড্ড অবাধ্য। যেটা করতে বলবে না সেটাই করবে আর যেটা করতে বলবে সেটা তো দুনিয়া থেমে গেলেও করবে না!

—–” শোনো মেয়ের কথা! আমরা যাবো আর তুই কি বাসায় একা থাকবি!? চল না একটু ঘুরে আসি! মাত্র তো এক সপ্তাহ!

—–” আম্মু! এতদিন পর আমি দেশে ফিরলাম, এখানে একটু বেড়াতে দাও আমায়! তোমরা তুরস্কে যাও, আমি সেই কদিন দাদুবাসা আর নানুবাসা থেকে বেড়িয়ে আসবো! ইশ! কত্তদিন গ্রামে যাইনা, পুকুরে ডুব দিয়ে গোসল করিনা!

—–” এহহ! সাতারই পারিস না তা পুকুরে গিয়ে কি ডোবার ধান্দা!?

মায়ের রাগ মিশ্রিত চাহনি দেখে হেসে ফেলল নীরা। মাকে রাগাতে তার বেশ লাগে।

—–” আচ্ছা, ঠিকাছে আম্মুটা! আমি যাবো, তবে শুধু এক সপ্তাহ। এর বেশি কিন্তু না!

খুশিতে গদগদকণ্ঠে নাজনীন বলে উঠল, ” আচ্ছা আচ্ছা! তাহলে চল শিগগিরই ব্যাগপত্র প্যাক করে নিই।

—–” হুম চলো।

নীরা পানির স্প্রে রেখে মায়ের সাথে নিচে নেমে গেলো। সে মায়ের মনে কষ্ট দিতে চায়না। তাই না চাইতেও সে যাবে। কিন্তু যেয়ে এমন কিছু করবে যাতে বিয়ের ব্যাপারটা আর না এগোয়।
.
.
.
.
.
_______________চলবে]_____________
বিঃদ্রঃ জানি ছোট হয়েছে। পরবর্তী অংশ বড় করে দেবো❤️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here