সূর্য ডোবার আগে পর্ব-৬

0
1875

#সূর্য_ডোবার_আগে
পর্ব-৬
লেখিকা ~ #সুমন্দ্রামিত্র
কঠোরভাবে প্রাপ্তমনষ্কদের জন্য।
.
.
.
.

রোববারের সকাল।

সপ্তাহের এই একটি দিন তিন্নি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। মিসেস বিয়াঙ্কা – তিন্নির সেই বেড়াল, সেও এই সুযোগের যথার্থ সদ্ব্যবহার করে মানে তিন্নির সাথে এক্সট্রা ঘুমোনোর সুযোগ আর কি! তিন্নি যখন স্কুলে পড়তো, ওদের বাড়ির গেটের সামনে ছোট্ট এই বেড়ালছানাটাকে কে যেন ফেলে গিয়েছিলো। নরম কাঁথায় জড়িয়ে ড্রপার দিয়ে দুধ খাওয়ানো সেই ছোট সাদা তুলোর বল আজ নয় নয় করে সাত বছরের বুড়ি। সারাদিন ওর পাত্তা পাওয়া যায় না, শুধু তিন্নি ঘুমোলেই রাতের বেলা জানলা বেয়ে চলে আসে কখন। কোনোদিন ভুল করেও জানলা বন্ধ করে রাখলে তার সে কি রাগ!! ম্যাঁও ম্যাঁও করে সারা বাড়ি তো দুর, সারা পাড়া জাগিয়ে তুলবে যতক্ষণ না তিন্নি ওই জানলা খুলে দেবে। তাই বলে মিসেস বিয়াঙ্কা মোটেও মিশুকে নয়। তিন্নিকে আদর অবধি করতে দেয় না। মাঝে মাঝে গায়ে হাত বোলানো অবধি ঠিক আছে তবে ওকে কোলে নিতে গেলেই হিসসস্ করে ওঠে অথবা আঁচড়ে রক্ত অবধি বার করে দেবে! শুধু তিন্নি ঘুমোলে ওর পায়ের কাছে চুপটি করে শুয়ে থাকে মিসেস বিয়াঙ্কা। আজও তার অন্যথা হয় নি, তিন্নি যেই বিছানা ছেড়ে উঠলো, মিসেস বিয়াঙ্কা খোলা জানলা দিয়ে পগারপার। বাসি বিছানা ঝেড়ে ঘরটা পরিপাটি করে রাখলো তিন্নি। রান্নাঘর থেকে লুচি ভাজার ম ম গন্ধ ভেসে আসছে, ঠিকে কাজের লোক মালতিমাসিকে মা কিসব বলছে….. পা টিপে টিপে তিন্নি চলে এলো বারান্দায়। অন্যান্য দিনের মতো আজও রঞ্জনবাবু বারান্দায় হুইলচেয়ারে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন, তিন্নিকে দেখে মুখ তুলে হাসলেন।

— ঘুম ভেঙে গেলো? আজ একটু বেলা করে উঠতে পারতিস তো।

ভোরের সদ্য ঝরে পড়া শিউলিফুলের মতো ঝকঝকে হাসি হাসলো তিন্নি — অভ্যেস হয়ে গেছে! আজকের হেডলাইন কি?

— আজকের হেডলাইন এই যে…. একটু থেমে একটু ড্রামাটিকভাবে রঞ্জনবাবু বললেন — তোদের ঘুরতে যাওয়া নিয়ে তোর মাকে রাজি করিয়ে ফেলেছি, এবার শুধু তুই বললেই হবে।

গোল গোল চোখে চেয়ে রইলো তিন্নি! কানে ঠিক শুনছে ও??? আনন্দে রিয়্যাক্ট করতেও ভুলে গেল তিন্নি — কি করে বাবা? এক রাতের মধ্যে এমন অসাধ্যসাধন কি করে করলে?

রঞ্জনবাবু হাসলেন — ওরে! তোর মা হলো ঝুনো নারকোলের মতো। বাইরেটা শক্ত হলে কি হবে, ভেতরে জল ভর্তি। তবে তোর ওপর একটু রেগে আছে, কষ্টও পেয়েছে। যে… তুই আমাকে বলেছিস অথচ তোর মা’কে জানাসনি।

অপরাধীর মতো মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো তিন্নি, নীচু গলায় বললো — তুমি তো জানো বাবা, কেন বলি নি!

— তুই আর তোর মা একদম একরকম, দুজনেই তোরা বড্ডো অভিমানী আর বড্ডো জেদি! কথা বলে নে যা, তোর মা রান্নাঘরে আছে! আর শোন, বেড়াতে যে যাবি, হাতে টাকা পয়সা আছে না সবটাই তোর মা’র হাতে তুলে দিয়েছিস?

–না না, আছে। এই বছরের বোনাসের টাকাগুলো এখনো সব খরচ হয় নি, তোমার জয়েন্ট একাউন্ট এ রাখা আছে, তুলে নেবো দরকার পড়লে!

চলে যেতে যেতেও ঘুরে দাঁড়ালো তিন্নি, হাঁটু গেঁড়ে বসে রঞ্জনবাবুকে জড়িয়ে ধরে বললো — থ্যাংক ইউ বাবা।

মেয়ের মাথার উস্কোখুস্কো নরম চুলগুলো স্নেহভরে ঘেঁটে দিলেন রঞ্জনবাবু। — পাগল মেয়ে একটা, যা এবার মায়ের রাগ ভাঙা।

পা টিপে টিপে তিন্নি এবার রান্নাঘরের দিকে গেল! মালতিমাসি ওকে দেখে একটু হাসলো, তিন্নিও হাসলো। ভাস্বতীদেবী পিছন ফিরে আগের মতই কাজে ব্যস্ত ছিলেন, গলা খাঁকরি দিলো তিন্নি —- ইয়ে ….. বলছিলাম যে…. অফিসের অনেকে মিলে একটা ট্রিপ প্ল্যান করেছে …. বাবা বলছিলো….

একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন ভাস্বতীদেবী! কবে থেকে মেয়ে এত দুরের হয়ে গেল যে মা’র সাথে কথা বলতেও এত বাধো বাধো করে?

*****************************__**************************
.
.
.

ছুটি শেষ হয়ে এল, কাল চলে যেতে হবে ডিউটিতে। পিহু – অভিমন্যুর আজকের বিকেলবেলাটা কাটছিল ফোটো আ্যলবাম দেখে।
পুরোনো অ্যালবাম মানেই পুরোনো স্মৃতি, অতীতের পদচারণা। কিছু সাদাকালো কিছু রঙিন, কিছু ধূসর, হাসি কান্নায় মেশানো। কাজে ফিরে যাওয়ার দিনটিতে পুরোনো অ্যালবাম নিয়ে বসেছিল অভিমন্যু আর পিহু………. কতো ছবি!!! – অভিমন্যুর ছোটবেলা, অন্নপ্রাশনে ছোট্ট পিহুকে কোলে নিয়ে বসে থাকা একটু বড়ো অভিমন্যু, পিহুর পুঁচকে মুখে ধ্যাবড়া করে কাজল পড়ানো, মা’র বিয়ের ছবি ….সাদাকালো, বা রঙিন। সেপিয়া রঙে রাঙানো ঘরভর্তি ছোটবেলার মাঝে হাসিমুখে হুইলচেয়ারে বসে থাকা বছর সতেরোর পিহুকে পুরো, মায়ের বিয়ের সময়কার তোলা ফোটোতে মতোই দেখতে লাগছে – ভাবলো অভিমন্যু ।
.
.
.

কোন এক সময়, আর পাঁচটা সাধারণ বাচ্চার মতো পিহুও ছোটবেলায় হাঁটতে পারতো, খেলতে পারতো, দৌড়োতে পারতো, হাসি খুশি সুন্দর দিন কেটে যেত ওদের। অভিমন্যু পিহুর থেকে এগারো বছরের বড়ো, নিজের প্রাণের থেকেও বেশি বোনুকে ভালোবাসতো, আজও তাই। কিন্তু যে অভিশপ্ত দিনে খবর এলো অভিমন্যুর বাবা, মেজর জেনারেল অর্জুন সেন শহীদ হয়েছেন, সেইদিনই বাড়িভর্তি লোকের ভিড়ে কাজের লোকের অসাবধানতায় সবার চোখের আড়ালে পিহু গড়িয়ে পড়ে যায় দোতলার সিঁড়ি থেকে। পুরোনো দিনের সাবেকি বাড়ি ওদের, মার্বেলে বাঁধানো অতগুলো সিঁড়ি গড়িয়ে পড়ে পিহুর মাথা ফেটে গিয়েছিল। আর ওর মাথায় স্টিচ করতে গিয়ে কেউ পিহুর পায়ের দিকে নজরও দেয় নি। দুইজন ডাক্তারের তিরিশ মিনিটের গাফিলতিতে একটা পাঁচ বছরের মেয়ে সারাজীবনের জন্য প্রতিবন্ধী, “বিশেষ ভাবে সক্ষম” – এই ট্যাগে চিহ্নিত হয়ে গেলো। পাঁচ বছরের এক নিষ্পাপ অবোধ শিশু যে হুইলচেয়ারের বানানও জানতো না, সারা জীবনের জন্য তাতে বন্দি হয়ে গেলো।

এর পর পরই অভিমন্যুর মা’ও কেমন যেন হয়ে গেলেন, মেজর জেনারেল অর্জুন সেনের শহীদ হওয়ার শোক সামলে ওঠার আগেই বাচ্চা মেয়েটার এতবড় দুর্ঘটনা…. স্বামীহারা একাকী নারী মনে মনে পিহুর এ অবস্থার জন্য হয়তো নিজেকেই দায়ী করতেন। খাওয়া দাওয়া করতেন না, কোনো অনুভূতি নেই, নিষ্প্রাণ জড় হয়ে গিয়েছিলেন। ছায়ার মতো চুপচাপ নিজের কর্তব্যটুকু করে যেতেন, ছেলেমেয়েদের সাথেও হেসে কথা বলতেন না। তারপর তো অভিমন্যু সুদূর রুরকী কলেজ চলে যাওয়ার বছর দুইয়ের মধ্যেই এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করলেন উনি, নয় বছরের পিহুকে অভিমন্যু আর ওর দাদুর জিম্মায় রেখে।
.
.
.

ভারী একটা শ্বাস পড়লো অভিমন্যুর। মা বড্ড নরম স্বভাবের ছিলেন। এ বাড়ির পাথর হৃদয় পুরুষদের মধ্যে মা ছিলেন জ্যৈষ্ঠের দুপুরের বটগাছের ছায়া। আজ বেঁচে থাকলে অভিমন্যুকে কিছুতেই আর্মি জয়েন করতে দিতেন না। পিহুর জন্য কষ্ট হয় অভিমন্যুর, বাবা কি জিনিষ তা তো বুঝলোই না, মা’ও চলে গেলেন অকালে, তারপর দাদু! আর অভিমন্যু সে কবে থেকেই ঘরছাড়া। পিহুও ঠিক মায়ের স্বভাব পেয়েছে। নিজের কান্নাগুলো লুকিয়ে সবাইকে আদরে হাসিতে ভরিয়ে রাখে। কিন্তু বড্ড নরম মন, সরল। তাই এই বারের ছুটিতে এসে অভিমন্যু এক মোক্ষম স্টেপ নিয়েছে পিহুকে গড়ে তোলার। পিহুকে যে স্বাবলম্বী হতেই হবে।
.
.
.
.

*****************************__**************************

আজ শুক্রবার, কলকাতা থেকে অভিমন্যুর বিদায় নেওয়ার পালা, তিন সপ্তাহের লম্বা ছুটি শেষ। সকাল থেকে আকাশের সাথে পাল্লা দিয়ে পিহুরও মুখ ভার। আজ দাদাভাই চলে যাবে ওর কাজের জায়গায়, আবার সেই ডিসেম্বরে আসা। এতো বড়ো বাড়িতে আগামী ছয় মাস একা একা পড়ে থাকবে পিহু আর নীলিমা আন্টি। কেন যে ছুটির দিনগুলো জলদি চলে যায়? দাদাভাই যদিও প্রমিস করেছে প্রতিদিন অন্তত ঘন্টাখানেক কথা বলবে পিহুর সাথে। তবে লম্বা ছুটির মধ্যে দাদাভাই একটা জিনিস শিখিয়েছে পিহুকে হুইলচেয়ারে বসেও পিস্তল চালানো!

ট্রেনিংয়ের প্রথম দিনই দাদাভাই বলেছিলো — “দেখ পিহু, আর পাঁচটা সাধারণ লোকের মতো পিস্তল চালানো তোর পক্ষে সহজ হবে না, কিন্তু কষ্ট হলেও তোকে শিখতে হবেই, কবে কখন কোন ট্রেনিং কাজে লেগে যায় কেউ বলতে পারে না! তার ওপর এতো বড়ো বাড়িতে তুই একা থাকিস।কখনও কিছু হলে নিজেকে প্রটেক্ট করতে পারবি আর নীলিমাদি’কেও।“!

প্রথম প্রথম পিহুর হাতে লাগতো ট্রিগার টানতে, ব্যাথায় কেঁদে ফেলে বলতো “আমি পারবো না দাদাভাই”, কিন্তু অভিমন্যু হাল ছাড়ে নি! কিভাবে সোজা হয়ে হুইলচেয়ারে বসতে হবে, কিভাবে বন্দুক ধরতে হবে- হাতে ধরে শিখিয়েছে, এমনকি নতুন একজন ফিজিওথেরাপিস্টও ঠিক করে এনেছে অভিমন্যু, যে নিয়মিত এসে পিহুকে বিভিন্ন ফিজিক্যাল এক্সারসাইজ করাবে যাতে ওর আপার বডি আরো স্ট্রং হয়! নীলিমা আপত্তি করেছিলেন …. কি দরকার এইটুকু মেয়েকে এইসব শেখানোর কিন্তু অভিমন্যু কান দেয় নি, আত্মরক্ষা করার সব রকম উপায় ও পিহুকে শেখাতে চায়! দাদু বেঁচে থাকলে উনিও এটাই করতেন।

বারবার পিহুকে বলেছে অভিমন্যু
-– “বোনু, তোর সবচেয়ে বড়ো খামতি হবে যদি কেউ তোকে আক্রমণ করতে আসে তার প্রথম লক্ষ্য হবে কি করে তোকে হুইলচেয়ার থেকে ফেলে দেওয়া যায়। আর সেই জন্যই তোকে রিফ্লেক্স আরো স্ট্রং করতে হবে যাতে প্রথম আঘাতটা তুই-ই হানতে পারিস।“

তাই ট্রেনিংয়ের সাথে সাথে অভিমন্যু বার বার পিহুকে প্র্যাক্টিস করাচ্ছে “সিচুয়েশনাল আওয়ার্নেস”, গোদা বাংলায় — সম্ভ্যাব্য পরিস্থিতির অভিনয়!

বলতে গেলে সারা ট্রেনিং পিরিয়ডে এই অংশটাই পিহুর সবচেয়ে ভালো লেগেছে।ছোটবেলার লুকোচুরি খেলার মতো দাদাভাই যখনতখন লুকিয়ে থাকে ঘরের এখানে ওখানে, পর্দার আড়ালে, সিঁড়ির তলায়।আর হুইলচেয়ারে পিহু। দাদাভাই পিহুকে পেছন থেকে খুঁজে বার করার আগেই পিহুকে ধরে ফেলতে হবে! দুজনের একটু আধটু চোটও লেগেছে এসব করতে করতে কিন্তু দাদাভাই বলেছে, যত চোট লাগবে পিহু ততটাই ভালো শিখতে পারবে! আজকাল দুপুর হলেই ও আর দাদাভাই টিপ্ প্র্যাক্টিসেও নেমে পড়ে, হুইলচেয়ার থেকে নামিয়ে দাদাভাই ওকে কোলে করে নিয়ে যায় ছাদে, তারপর ছাদে ঝোলানো সার সার মাটির কলসী ঝুলিয়ে সারা দুপুর চলে ওদের প্র্যাক্টিস। একেবারে নিখুঁত না হলেও এরমধ্যেই পিহু হুইলচেয়ারে বসেই বেশ চলনসই ভাবে নিশানায় মারতে পারছে, মানে উল্টোনো মাটির কুঁজোতে মারতে গিয়ে পাশের হাঁড়ির পেটে মারছে, কিন্তু অভিমন্যু জানে, এভাবেই হবে। Practice makes perfection. পিহুকে ট্রেনিং দেওয়ার পিছনে আর একটা কারণও যে আছে।

দিন কতক আগেই হেডকোয়ার্টার থেকে সিক্রেট মেলে খবর এসেছে আর্মির পরিজনদের ওপরও হামলা হওয়া অসম্ভব নয়। এমনিতেই অভিমন্যুর স্পেশাল জব প্রোফাইলের জন্য দুজন সাদা পোশাকের পুলিশ সবসময় ওকে দূর থেকে ফলো করে কিন্তু অভিমন্যুর ভয় পিহুকে নিয়ে। পিহু এখনো বড্ডো সরল, একা একা বড়ো হয়ে ওঠার জন্য সবসময় মানুষের সঙ্গ চায়, চট করে অজানা লোককেও বিশ্বাস করে ফেলে, তার ওপর আশেপাশের সবাই জানে পিহুর প্রতিবন্ধকতা আর এতবড়ো বাড়িতে একা থাকার ব্যাপারটা। যেকোনো স্লিপারসেল এজেন্টের জন্য পিহু খুব সহজ টার্গেট! সে কারণেই স্পেশাল পারমিশন নিয়ে এসেছে অভিমন্যু, ও ফিরে গেলেই দুজন সাদা পোশাকের পুলিশ যেন সর্বদা এ বাড়ির ওপর নজর রাখে। তবুও তো সাবধানের মার নেই, তাই অভিমন্যু নিজে পিহুকে তৈরী করছে যেকোনো পরিস্থিতির মোকাবিলা করার, একা! পিহুর কিছু হয়ে গেলে অভিমন্যু নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
.
.
.

অভিমন্যুর এবারের গন্তব্য আর অরুণাচল প্রদেশ নয়, হিমালয়ের কোলে ছোট্ট একটি রাজ্য – তিন তিনটি প্রতিবেশী দেশের সাথে বর্ডার শেয়ার করে আছে। কাল রাতেই অর্ডার পেয়েছে অভিমন্যু, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সূত্র অনুযায়ী বেশ কিছু আনউজুয়াল একটিভিটি ধরা পড়েছে ওখানে ,যত শীঘ্র সম্ভব ওকে পৌঁছতে হবে এবং ডিপার্টমেন্টাল রিপোর্ট করতে হবে।
পাতলা কালো একটা টি শার্ট আর ঢিলা ট্রাউজার্স পড়ে বিকেল ৫টা নাগাদ ভাড়ার ট্যাক্সিতে বেরিয়ে পড়লো অভিমন্যু, কাঁধে ফেলে রাখলো ওর বহুব্যবহৃত জংলা প্রিন্ট মিলিটারি জ্যাকেটটা। আর ঘন্টা দেড়েকের মধ্যেই ওদের স্পেশাল ট্রেন ছাড়বে। পিহু ঘরের দরজা বন্ধ করে ছিলো, কাঁদতে কাঁদতে দাদাভাইকে বিদায় দেয় না ও কোনোবার। অভিমন্যু বেরোনোর ঘন্টাখানেক আগেই হাসিমুখে প্রতিবার বলে — “জলদি আসিস দাদাভাই, আমি অপেক্ষা করে থাকবো”। বলে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়, নীলিমাদেবীও ঢুকতে পারেন না আর সেই ঘরে। একটা ছোট্ট মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখে পিহু। যতক্ষণ না অভিমন্যু ওর কাজের পোস্টে ফিরে পিহুকে খবর দিচ্ছে, ততক্ষন সেই প্রদীপ জ্বলতে থাকবে, পিহু নিভতে দেবে না। ওর মা’ও তাই করতো – শহীদ মেজর জেনারেল অর্জুন সেনের উদ্দেশ্যে।
.
.
.
.

স্টেশনের উদ্দেশে রওনা দিয়ে মনটা ভারী হয়ে রইলো অভিমন্যুর, বোনুকে করা প্রমিসটার জন্যই তো ওকে আরো সাবধানে ডিউটি পালন করতে হবে! ও ছাড়া যে পিহুর এ পৃথিবীতে আর কেউ নেই!

*****************************__**************************

.

এখনো বিশ্বাস হয় না তিন্নির, মা কি করে অত জলদি ওর বেড়াতে যাওয়াতে বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছিল। বাবা ঠিক “কি” বুঝিয়েছে মা কে, তিন্নি জানে না, কিন্তু সেদিনের পর থেকে মা একটু হলেও তিন্নির সাথে নরম ব্যবহার করছে! গত দুই দিন সকালে অফিস যাওয়ার আগে ভাতের থালার পাশে এখন আর শুধুই আলুসেদ্ধ নেই, একবাটি ডালও আছে! এর মধ্যে ভাইয়ের সাথে কিছু খিটিমিটি লেগেছে মায়ের, গত ভাইফোঁটায় তিন্নির কিনে দেওয়া অত দামি মোবাইল ফোনটা নাকি শুভর পুরোনো লাগে! কি বিশ্রী ভাষায় ভাই মা’র সাথে আজকাল কথা বলে, তিন্নি জানতোই না!
ওরা দুজনেই ভুলে গিয়েছিলো বোধহয়, সোমবার তিন্নির অফিস থাকে না! ওদের ঝগড়ার মাঝে তিন্নি ঢুকে পড়াতে মা কেমন অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছিলো, সেই প্রথম মা’র চোখে তিন্নি দেখেছিলো কেমন একটা কুন্ঠা ভাব, যেন তিন্নিকে জানতে দিতে চায় না এসব কথা! অবাক হয়েছিল তিন্নি, তার সাথে সাথে রাগও হয়েছিল ভাইয়ের ওপর! সরাসরি বলে দিয়েছিলো নতুন ফোন আর কিনে দেওয়া হবে না, না পোষালে ভাই যেন তিন্নির স্ক্রীনভাঙা ফোনটা নিয়ে নেয়, তিন্নি ভাইয়েরটা নিয়ে নেবে! অবাক হয়ে গিয়েছিলো শুভ! দিদি এমন বলতে পারে যেন ওর ধারণাই ছিলো না, কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ বেরিয়ে গিয়েছিলো ঘর থেকে।
.
.
.

শুক্রবার, শেষ মিনিটের টুকটাক জিনিষে ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছিলো তিন্নি। শুভর ট্যাবটা নিয়েছে অনেকগুলো গল্পের বই আর কবিতার পিডিএফ কপিতে ভর্তি, টিরেনে পড়বে। প্রথমে তিন্নি ভেবেছিলো অফিস থেকেই সোজা শিয়ালদা চলে যাবে, সন্ধ্যে ৬:৩০য়ে ট্রেন। কিন্তু মা বললো আজকের দিনটা ছুটি নিয়ে বিকেল দিকে একেবারে ধীরেসুস্থে বেরোতে। এমনিতেও তিন্নির প্রচুর ছুটি জমে আছে। অফিসেও এই নিয়েই ঝামেলা হলো ওদের টিম লিড মিথিলেশের সাথে। তিন্নি ভেবেই রেখেছিলো এই ট্রিপটায় ওর আর যাওয়া হবে না, তাই আগে থেকে কিছু উচ্চবাচ্য করে নি। তবে সায়কের জোরাজুরিতে যে তিনমাস আগে থেকেই ও যে লিভপ্ল্যানের এক্সেলে ছুটিগুলো ভরে রেখেছিলো, সেটা তিন্নির সাথে সাথে মিথিলেশও ভুলে গিয়েছিলো! সায়কই মনে করালো। মঙ্গলবার যখন তিন্নি অফিস গিয়ে বললো যে শেষ অবধি ছুটিটা ও নেবে, মিথিলেশ রাগারাগি শুরু করে – যেহেতু সায়ক আর তিন্নি একই শিফ্টে কাজ করে তাই একসাথে ছুটি নিতে পারে না নাকি! অনেক ঝগড়া ঝামেলার পর কোনোরকমে সায়কের কথায় অবশেষে মিথিলেশ রাজি হলো, তবে তিন্নিকে ওয়ার্নিং দিয়েছে, এরপর থেকে যেন ওরা দুজনে একসাথে কোনো প্ল্যান না করে! অবাক হয়ে গিয়েছিলো তিন্নি, মিথিলেশ একা “ওকেই” কেন ওয়ার্নিং দিলো? সায়কও তো ওরই সাথে লিভ আ্যপ্লাই করেছিল কই সায়ককে তো কিছু বললো না?
সত্যিই অফিস পলিটিক্স!!
.
.
.
.
সায়করা অফিস থেকে বেরোনোর আগে তিন্নিকে জানিয়ে দিয়েছিলো বোধহয় ইঞ্জিন থেকে ৩টে কামরা পরই ওদের কামরাটা পড়বে, তিন্নি যেন একটু দেখে নেয়! সায়কের পাঠানো অনলাইন টিকেটটার স্ক্রিনশট মুঠোফোনে নিয়ে রাখলো তিন্নি, যদি দরকারের সময় ইন্টারনেট না ধরে? বেশী লাগেজ নেই ওর সাথে, মাত্র তিনদিনের তো ব্যাপার! কাঁধে একটা রুকস্যাক, আর একটা হ্যান্ডব্যাগ। কালো পাফ স্লীভ একটা টপ- ব্লু জিন্স, আর চুলটা চুড়ো করে বেঁধে নিয়েছে মাথায়, বাড়ি থেকে ভারী লাঞ্চ করে, তিন্নি যখন বেরোলো, আকাশে হালকা মেঘ থাকলেও বৃষ্টির কোনো সম্ভাবনা ছিলো না, কিন্তু শ্রীরামপুর স্টেশন পৌঁছতে পৌঁছতে দশ মিনিটের মধ্যেই মুষুলধারে বৃষ্টি শুরু হলো! এখান থেকে দুবার ট্রেন চেন্জ করতে হবে ওকে। প্রথম ট্রেনে উঠে গিয়ে ভেবেছিলো আর কোনো বিপত্তি হবে না, কিন্তু পরের ট্রেনে উঠে দেখলো শিয়ালদা লাইনে বৃষ্টির জন্য সব লোকাল ট্রেন দাঁড়িয়ে! এদিকে সায়করা পৌঁছে গেছে, ফোন করছে বারে বারে তিন্নি আর কতদুর! ঘন্টাখানেক অপেক্ষা করে তিন্নি দেখল এভাবে চললে আজ আর সাড়ে ছয়টার আগে ও শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছতে পারবে না! কোনোরকমে লোকাল ট্রেন থেকে নেমে একের পর এক বাস, ট্যাক্সি পর পর চেঞ্জ করে যতক্ষনে ও শিয়ালদা স্টেশনে পৌঁছলো, ট্রেন ছাড়তে আর মাত্র মিনিটকয়েক বাকি! ফোনের ওপাশ থেকে সায়ক চেঁচাচ্ছে তখন “কোথায় তুই? ট্রেন তো ছেড়ে দিলো!!”
,
.
.
ডেলি প্যাসেন্জারি করে অভ্যস্ত তিন্নি! তাও শিয়ালদা স্টেশনের এমন ভিড় ও জন্মে দেখে নি। একে ঠেলে, ওর পা মাড়িয়ে সতেরো নম্বর প্ল্যাটফর্মে যখন এসে পৌঁছলো, দুর থেকে দেখল রাতের নর্থবেঙ্গল মেল-ট্রেন ততক্ষনে নড়ে ওর সামনে দিয়ে ধীর গতিতে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। চোখে জল এসে গেল তিন্নির, এত করেও বেড়াতে যেতে পারবে না ও? মরিয়া হয়ে পা চালালো, এসওয়ান কম্পার্টমেন্ট, ইন্জিনের তিনটে কামরা পরেই হওয়া উচিত। উঠতে গিয়ে দেখলো ওটা জেনারেল বগি, তারপরের গুলো এসি কোচ! মাথায় হাত দেওয়ার অবস্থা তিন্নির। কোথায় এসওয়ান!
ট্রেনের জানলা, দরজার কাছে অনেকে দাঁড়িয়ে, দেখছে ওকে তবু কেউ হাত বাড়াচ্ছে না! ছোট্ট একটা স্প্রিন্ট নিল তিন্নি, কোনোরকমে যেকোনো একটা দরজার হাতল ধরতে পারলেই ট্রেনে উঠে যেতে পারবে ও! কিন্ত ট্রেন ততক্ষনে গতি নিয়ে নিয়েছে। দৌড়তে দৌড়তে তিন্নি দেখলো ওর পায়ের নীচে সিমেন্টের মেঝে ক্রমশ ঢালু হতে শুরু করেছে অর্থাৎ প্ল্যাটফর্ম প্রায় শেষ হতে চলেছে! ওদিকে যে স্পীডে ও দৌড়চ্ছে, বৃষ্টি কাদায় পিছল প্ল্যাটফর্মে এখন আর থামার উপায় নেই। অনেকজন হইহই করে উঠলো দুর থেকে, চরম পরিণতির সম্মুখীন হতে ভয়ে চোখদুটো বন্ধ করে নিল তিন্নি। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর, দম বন্ধ হয়ে আসছে………আবার কি ব্ল্যাকআউট হয়ে যাবে? অনেকদিন আগের ডাক্তারের সাবধানবাণী মনে পড়ে গেলো – “ভুল করেও কখনো দৌড়োতে যাবে না”। ততক্ষনে পায়ের তলায় শূণ্য মাটি, তিন্নি কি হাওয়ায় উড়ছে? আর ঠিক তখনই
.
.
.
.

ঠিক তখনই ট্রেনের লাস্ট কামরাটার দরজা দিয়ে বলিষ্ঠ একটা হাত যেন বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে প্ল্যাটফর্ম থেকে তুলে নিল ওর পাতলা শরীরটাকে। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসার আগে তিন্নি এটুকু বুঝতে পারলো একটা পাথরে কোঁদা সুঠাম শক্ত শরীর ওকে নিজের বুকে মিশিয়ে নিয়েছে। অচেনা অজানা লোকটার বলিষ্ঠ হাতে নিজেকে ছেড়ে দিয়ে ওখানেই জ্ঞান হারিয়ে ফেললো তিন্নি।

 

ক্রমশঃ

© সুমন্দ্রা মিত্র। ভালো লাগলে নামসহ শেয়ার করবেন।

*************************__******************************

কি দাবী সবার? কাল দেবো? নাকি পরশু? কমেন্টে জানান। আর একটু বেশি বেশি শেয়ার করুন?🙏❤️

সকল পর্বের লিঙ্ক~
Video Teaser
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145475543838322/?vh=e&d=n
Part 1
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145129087206301/?d=n
Part 2
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/145859077133302/?d=n
Part 3
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146221053763771/?d=n
Part 4
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/146595433726333/?d=n
Part 5
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/147293876989822/?d=n
Part 6
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148075966911613/?d=n
Part 7
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148530310199512/?d=n
Part 8
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/148951006824109/?d=n
Part 9
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/149405760111967/?d=n
Part 10
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/150313546687855/?d=n
Part 11
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151106323275244/?d=n
Part 12
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/151923336526876/?d=n
Part 13
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/152353663150510/?d=n
Part 14
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/154065792979297/?d=n
Part 15
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/156163186102891/?d=n
Part 16
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157132182672658/?extid=QdVQFGSjLzQUsE31&d=n
Part 17
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/157444422641434/?extid=fI3jIc0PCiYXDa0N&d=n
Part 18
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158095955909614/?extid=1E2JOZfMCmqscBoi&d=n
Part 19
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/158831902502686/?extid=R8zo6L2l274CIQ7r&d=n
Part 20
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/159626782423198/?extid=0e8jrLLhsuLqgsQX&d=n
Part 21
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160047349047808/?extid=e9DIdFXAkqxTg77U&d=n
Part 22
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/160963752289501/?extid=EgYDh0z3hVr5TCBY&d=n
Part 23
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/161833698869173/?extid=gRK0HHMoLW0bu0gK&d=n
Part 24
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/162740122111864/?extid=KIR9o3zetBHgH9mt&d=n
Part 25
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163061178746425/?extid=fhzBxEjnlA7n6Ulu&d=n
Part 26
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/163695728682970/?extid=tm0Y81ykORQhpsq9&d=n
Part 27
https://www.facebook.com/110448980674312/posts/164305438621999/?extid=WsYE2BjXkYvPmqyF&d=n

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here