#এক_গুচ্ছো_কদম
#পর্বঃ৩
লিখাঃসামিয়া খান
“বাচ্চাটাকে কিন্তু সবাই অবৈধ বলবে মেহেলতা!একবার ভেবে দেখেছো কী?”
“না বাবা। বলবেনা!কারণ দুর্জয় আর সৃষ্টি বিবাহিত ছিল।তো অবৈধ হওয়ার প্রশ্নই উঠেনা”।
কথাটা শুনে তজবিটা পাশে রাখলো ইমাম সাহেব।
” মেহেলতা তুমি ভুল ভেবেছো।দুর্জয় আর সৃষ্টির বিয়েটা ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েজ না।”
“কিন্তু ওরা তো কবুল,,সাক্ষি সব,মেনে বিয়ে করেছে!”
“তোমাকে একটা হাদিস বলি মেহেলতা,,
আয়েশা(রা.) হতে বর্ণিত এক হাদিসের মধ্যে রাসুল (সা) বলেছেন ” যে কোন নারী তার অভিভাবক অনুমতি ব্যাতিত বিয়ে করবে তার বিয়ে বাতিল,তার বিয়ে বাতিল, তার বিয়ে বাতিল।(হাদিসটি তিরমিজি (১০২১)এবং অনান্য হাদিস গ্রন্থ থেকে সংকলিত)
“কিন্তু ইমাম চাচা সৃষ্টি একটা এতিম।ওর কোন অভিভাবক নেই”।
” কিন্তু দুর্জয়ের তো আছে।ওয়ালিমা ছাড়া কোন বিয়ে জায়েজ না”।
“হয়তো ওদের বিয়ে জায়েজ না বাবা! কিন্তু এখানে একটা ছোট বাচ্চার বাঁচা মরা ঝুলে আছে।আপনি কী চান দুর্জয়ের শেষ চিহ্ন সারাজীবন মানুষের চৌকাঠে চৌকাঠে লাথি খেয়ে বেরাক!”
একটা নিশ্বাস বেরিয়ে আসলো দুর্জয়ের বাবার বুক চিড়ে।
“এখন কী করতে বলো তুমি মেহেলতা”?
” বাবা আমি আজ থেকে পনের বছর আগে এ বাড়িতে বউ হয়ে এসেছি।মৃদুল, দুর্জয় তখন ছোট ছিল।কোনদিন মা হতে পারিনি কিন্তু ওদের সন্তানের মতো মানুষ করেছি।সে বিনিময়ে একটা জিনিস চাই শুধু বাচ্চাটাকে এই বংশের মর্যাদাটুকু দেন”।
“সেটা দিতে হবেই মেহেলতা।আমরা সমাজে বাস করি।হয়তো সমাজের চোখে নিচু হবো আমরা।কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু কাজ সমাজের উর্ধ্বে গিয়ে করতে হয়।যাতে সকলের কল্যাণ নিহিত।”
“তুই কোনদিন বড় হবিনা হিম তাইনা?”
“আর কতো বড় হতে বলো মৃদ!অনেক তো বড় হলাম।দেখো বড় হতে হতে আজ আমি বিধবা!”
“ঠাটিয়ে একটা চড় মারবো তোকে হিম!”
“তোমার এই স্বভাব কোনদিন যাবেনা তাইনা মৃদ।ছোটবেলায় কত মারতে আমাকে?দেখো মারের দাগগুলো এখনো আমার শরীরে আছে”।
” বেশ করেছি। তোর এই বেশী বোঝাটার জন্য তুই মার খাস”!
“নিজে খুব ভালো!”
“ভালোই তো। আমার মতো ভালো মানুষ আর কোথাও পাবি নাকী?”
“আহারে”
“ওইযে ঠিক বললে বলে আহারে”
“হুম”
“হিম রে একটু তো স্বাভাবিক হও।তিনদিন তো হয়ে গেলো প্রায়!”
“আমি স্বাভাবিক রয়েছি মৃদ”
“মোটেও না।আমার পুতুলটা কখনো এমন ছিলনা তো”?
” তোমার পুতুলটা পাল্টে গিয়েছে মৃদ! চার বছর কম সময় না?”
“খোঁটা দিচ্ছিস?”
“হয়তো”
আর কিছু বলতে যাবে মৃদুল তার আগে দরজায় একটা শব্দ হলো!
“আসতে পারি?”
মৃদুল কিছু বলার আগেই হিমাদ্রি জবাব দিল,,
“এসো সৃষ্টি,, ভেতরে এসো”
অনেকটা দ্বীধায় পরে সৃষ্টি রুমের ভেতরে প্রবেশ করলো।রুমে ঢুকে অনেকটা কাঁচুমাচু হয়ে হিমাদ্রির সামনে গিয়ে দাড়িয়ে রইলো।
“বসতে পারো সৃষ্টি এটা তোমার ও রুম।”
কথাটা শুনে অনেকটা অবাক হয়ে গেলো সৃষ্টি।
“কিন্তু এটা তো আপনার রুম?”
” না এটা দুর্জয়ের রুম।সে হিসেবে এটা তোমারও রুম।”
“ওহ”
বলে কপালে থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুজে দিলো সৃষ্টি। মৃদুল খেয়াল করলো হালকা পাতলা গড়নের মেয়ে সৃষ্টি। গায়ের রং টা শ্যামলা।কিন্তু সুন্দর আছে।একটু কনফিউজড হয়ে মৃদুল জিজ্ঞেস করলো,,
“তোমার বয়স কতো সৃষ্টি “?
” আঠার হয়েছে”।
চমকে উঠলো হিমাদ্রি।
“তাহলে তুমি তো আমার ছোট”!
” হুম ম্যাডাম”।
“আমাকে ম্যাডাম বলবেনা সৃষ্টি। আপু বলতে পারো।আর নিজেকে এতো ছোট ভেবেও না।তুমিও এবাড়ির বউ।তো নিজেকে আগে একটা দাম দিবে।”
সৃষ্টি মাথা নাড়ালো।কিছু একটা বলতে চাচ্ছে। বড্ড উসখুস করছে মেয়েটা। মৃদুল ব্যাপারটা বুঝতে পারলো
“কিছু বলবে সৃষ্টি “?
“হুম ”
“তো বলে ফেলো”!
” আমার বাবুটাকে নিজের নাম দিবেন আপু”।
“কেন আমি নিজের নাম কেনো দিবো।”
“দেন না আপু।তা নয় সবাই বাবুকে অবৈধ বলবে।ঠিক আমার মতো”।
কথাটা বলতে গিয়ে কেঁদে দিলো সৃষ্টি। হয়তো জীবনে অনেক কঠিন সময় পার করে এসেছে।হিমাদ্রি একটু সৃষ্টির কাছে এগিয়ে গেলো।ওর দুইহাত নিজের মধ্যে নিলো।
” কেও বলবেনা সৃষ্টি। বাবা সব ব্যাবস্থা করে দিবে।তোমার আর দুর্জয়ের নামে বড় হবে”!
“সত্যি!”
“সত্যি তো”!
হেসে দিলো সৃষ্টি। হিমাদ্রি খেয়াল করলো মেয়েটার খুশী হতে আহামরি কারণ লাগেনা।একটুতেই খুশী হয়ে যায়।এজন্যই হয়তো দুর্জয় এতো ভালোবেসে ছিল।
” হিম আমি একটু আসছি।”
“হুম”।
মৃদুলের যাওয়ার পথে হিমাদ্রি ও সৃষ্টি উভয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল।
“খেয়েছো সৃষ্টি? ”
“হুম।ভাবী খায়িয়ে দিয়েছে।ভাবী হয়তো ভালো”।
” হয়তো সৃষ্টি।কিন্তু কেও মন্দের ঊর্ধ্বে না। ভালো মন্দ মিলিয়ে তৈরী হয় মানুষ।যেমন তুমি আজকে ভাবীকে ভালো বলবে হয়তো কিছুদিন পরে কোন ব্যাবহারে খারাপ লাগবে।তখন তাকে ভালো বলতে কুণ্ঠাবোধ করবে”।
“আপনি অনেক সুন্দর করে কথা বলতে পারেন কিন্তু আমি পারিনা। তাও দুর্জয় কেনো আমাকে ভালোবাসতে গেলো?”
“সুন্দর কথার প্রেমে কেও পরেনা সৃষ্টি। ভালোবাসা এমনিতেই হয়ে যায়”।
” আপু আপনি হুমায়ন আহমেদের সেই কথাটা শুনেছেন,,
মানুষ জাতির স্বভাব হচ্ছে সে সত্যের চেয়ে মিথ্যার আশ্রয় নিরাপদ মনে করে”!
তেমনি দুর্জয় তোমাকে রেখে আমার মতো মেয়েকে ভালোবেসেছে।
“নিজেকে এতো ছোট ভাবতে নেই সৃষ্টি “।
” হিম দেখ কাকে নিয়ে এসেছি”।
হিমাদ্রি, সৃষ্টি উভয়ে দরজার দিকে তাকালো। মৃদুল দাড়িয়ে আছে তার পাশে একটা মেয়ে যার কোলে ছোট একটা মেয়ে বাবু।হাসিমাখা মুখে রুমে প্রবেশ করলো মৃদুল।
“হিম ও রোদসী। আমার স্ত্রী!আর এইযে এই ছোট্ট পুতুলটা হচ্ছে মাদিহা।আমার মেয়ে”!
হাতে থাকা সিগারেট ফিল্টারটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলল আহনাফ।
“এতো টেনশন করিস না আহনাফ! সব ঠিক হবে।”
“বা* হবে। একে তো হিমের টেনশন তার ওপর এই সৃষ্টির শক।আমার মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে যাবো।”
“আরে দোস্ত মাথা শান্ত রাখ।আর সৃষ্টি গেছে তো কী হয়েছে?আরো অনেক আছে।এরকম কতো আসে যায়।”
“তোদের মতো তো আমার প্রেম সস্তা না।ওই তোদের না সৃষ্টির ওপর নজর রাখতে বলেছিলাম। তোরা থাকতে দুর্জয় ওর কাছে কীভাবে যেতে পারলো।
” আসলে হয়েছে কী!!”
“থাক আপনাদের মহান বাণী আর দিতে হবেনা।আর কোনদিন টাকা চেয়ে আমার কাছে আসিস।তখন দেখবি!!”
আরেকটা সিগারেট টানতে টানতে চলে গেলো আহনাফ।
“ধুর কয়টা টাকা দেয় দেখে গোলাম পেয়ে নিয়েছে আমাদের”।
বোনকে ছাড়া কোনদিনও দূরে থাকেনি আহনাফ। তাইতো যখন মন চায় তখনি ছুটে যায় হিমাদ্রির কাছে।আরো সুবিধা আছে কারণ পাশাপাশি বাড়ি তাই।
হিমাদ্রির রুমে প্রবেশ করার আগে হাতে থাকা সিগারেটটা শেষ করে নিলো আহনাফ।রুমে ঢুকে দেখে বিছানার কেও শুয়ে আছে। একটু কাছে গিয়ে সেখানে কে শুয়ে আছে তা উপলব্ধি করতে পেরে দাড়িয়ে গেলো আহনাফ।এ যে সৃষ্টি। ঘুমিয়েছে আছে। কতো আশা ছিল সৃষ্টিকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখবে সে আশাটা পূরণ হলো কিন্তু তা অন্যভাবে।
” ভাইয়া ওকে ডাকিস না ঘুমাচ্ছে। ঘুমাতে দে”।
পিছন ফিরে আহনাফ দেখে হিমাদ্রি দাড়িয়ে আছে। কোলে একদম পুতুলের মতো একটা বাচ্চা।
“বাচ্চাটা কার রে হিম?”
“মৃদের। সুন্দর না অনেক। ”
“মৃদের!!দে তো একটু কোলে নেই।অনেক সুন্দর তো হয়েছে।ওর বউ এসেছে নাকী?”
“হুম একটু আগে এসেছে”।
” এখন এই বাবু নিয়ে বাসায় চলে যাবো।আর দিবোনা।ঠিক যেমন মৃদ করেছিল”।
“খালি ঝগরার কথা তাইনা ভাইয়া?”
“অবশ্যই মৃদ আমার চির শত্রু “।
” হুম তাইতো একে অন্যের বিপদে ঝাঁপিয়ে। ঠিক টম এন্ড জেরীর মতো”।
“মোটেও না।আচ্ছা কথা বলেনা “।
” না কিন্তু কয়দিন পরে ঠিকই বলবে।তখন তোকে চাচ্চু বলতে বলতে পাগল করে দিবে।আবার একজন আসছে যে তোকে মামা মামা করবে।”
“মানে কে বলবে?”
“কেন সৃষ্টির বাবু!”
কথাটা শুনে তাড়াতাড়ি মাদিহাকে হিমাদ্রির কোলে দিয়ে দিলো আহনাফ।
“কোন মামা বলবেনা।আমি কারোও মামা না”।
” দেখ ভাই ওদের কেও নেই।সেখানে যদি আমরা ওদের সাথে এমন করি তো কীভাবে চলবে বল”।
“আমার বাচ্চা নিয়ে কোন সমস্যা নেই।কিন্তু সৃষ্টির বাবু আমাকে মামা বলবেনা”।
” কেনো?”
“জানিনা কিন্তু বলবেনা সেটা জানি শুধু “!ইশ আসছে আমার মামা বলতে। যতোসব আজাইরা।”
ধপ ধপ করে পা ফেলে বেরিয়ে গেলো আহনাফ।
“আজব তো মামা বললে কী হবে।কিছুই তো বুঝলাম না”!তুমি বুঝেছো মাদিহা!”
ছোট্ট বাচ্চাটা কী বুঝলো কে জানে। কিছুক্ষণ অবাক হয়ে হিমাদ্রির দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর হঠাৎ করেই একটা ভুবন ভুলানো হাসি দিলো।যা দেখে হিমাদ্রির সব কষ্ট দূর হয়ে গেলো।
রোদসীর মেজাজটা চরম খারাপ হয়ে আছে মৃদুলের ওপর।সেই কখন থেকে মাদিহা হিমাদ্রির কাছে রয়েছে অথচ মৃদুলের কোন হেলদুল নেই।চরম মেজাজ খারাপ করে মৃদুলকে জিজ্ঞেস করলো রোদসী।
“বাবুকে নিয়ে আসছো না কেনো?সেই কখন থেকে ওই মেয়েটার কাছে রয়েছে”!
” ওর নাম হিমাদ্রি। হিমাদ্রি না বললেও হিম বলে ডেকো। তাও ওই মেয়ে ওই মেয়ে করবেনা।আর মাদিহা জলে পরে না যে এতো বারবার বলতে হবে এ কথা”!
“আমি এতো জানিনা আমাকে বাবুকে এনে দেও”।
” একটুও ওয়েট করতে পারলিনা পাগলী?আর আমার মা যে চার বছর অপেক্ষা করেছে!”
“না পারিনা।বাবুকে এনে দেও”।
” পারবো না।আর থাক না কিছুক্ষণ হিমের কাছে।তুই বরং আমার কাছে থাক।”
“তুমি সবসময় শুধু হিম হিম করো কেনো”।
” কারন ওটা আমার পুতুল তাই”।
“না বাবুকে এনে দেও”।
” উফ পাগলি এতো বেশী কথা বলিস কেনো?আস আমার বুকে আস। সুখ দুঃখের কথা বলি আমরা”।
মৃদুলের বুকে মাথা রাখলো রোদসী।
“আমাকে একদম তুই তুই করবেনা।আমার ভালো লাগেনা”।
” একশ বার বলবো। হাজার বার বলবো।তুই, তুই,তুই”।
“কিন্তু এখানে তো মাত্র তিনবার”।
” চুপ খালি লজিক খুঁজে কথায়।এখন চুপ করে বুকে মাথা দিয়ে ঘুমা।এমনিও রাতে বাবুর জন্য ঘুমাতে পারিসনা।
রোদসীর মাথটা মৃদুল নিজের বুকে চেপে রাখলো।আর রোদসী বুকে মাথা দিয়ে চোখ বুজে রাখলো।
সন্তান তো মা বাবার অংশ হয়।তাদের সংকেত বহন করে।কিন্তু মাদিহা নাম শুনে মনে হয় সে যেনো হিমাদ্রি আর মৃদুলেরই অংশ।
কথাটা মনে হতেই যেনো শরীরটা হিম হয়ে গেলো রোদসীর।
চলবে,,
বিঃদ্রঃকে কে ভেবেছিল মৃদুল বিবাহিত ও এক বাচ্চার বাবা😶😶