কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ১১
_______________
১।
দিদির বাড়িতে প্রথমবার এসেছে ঋষি। সবকিছু আনকোরা। গতকাল রাতে ঠিকমতো ঘুম হয়নি তার। খাবার টেবিলে বসে আছে আর দিদিকে লক্ষ করছে। তার জন্য খাবার তৈরি করছে দিদি। রুমের মধ্যে একা থাকতে ভালো লাগেনি, দিদির কাছে চলে এসেছে। ভাই আর বোন মিলে সামান্য গল্প করছিল, এমন সময় বারান্দা থেকে স্পষ্ট কর্কশ কন্ঠস্বর ভেসে আসলো। বৌমা, তাড়াতাড়ি বাবাকে চা দাও। সকাল আটটা হতে যায় কখন চা খাবে শুনি? তোমাদের কোনো কাজ সাজানো-গোছানো নয়। সব কাজে ঢিলেমি না করলে হয় না! বাড়িতে মাত্র পাঁচজন সদস্য, সামান্য কাজ, -এইটুকু করতে যদি এত সময় নিয়ে নাও তাহলে জয়েন ফ্যামিলিতে তোমরা টিকতে পারবে না। কাজ ঠিকঠাক করো কিন্তু কাজের রীতি ঠিকঠাক জানো না। আমরাও এমন বয়স পেরিয়ে এসেছি। শ্বশুর-শাশুড়িকে খাইয়েছি। কই, আমাদের তো এমন কথা কখনো শোনাতে পারিনি।সকালে তাড়াতাড়ি উঠে পড়বে দরকারি কাজগুলো দ্রুত শেষ করে ফেলবে, তা না করে……।
ঋষি মুখ ফিরে দেখল তার দিদি আর সেখানে নেই। রান্নাঘরে গিয়ে চা বানাতে শুরু করেছে। দিদির মুখ বিষন্নতায় ভরপুর। কোনো প্রতিবাদ নেই, নিশ্চুপে কাজে মগ্ন করে ফেলেছে নিজেকে। চুপচাপ বসে থাকলো সে। কিছুক্ষণের মধ্যে চা-বিস্কুট শ্বশুর-শাশুড়িকে দিয়ে আবার ঋষির কাছে ফিরে আসলো স্নেহা। ভাই কে খাবার দিল। খাবার না ছুঁয়ে ঋষি দিদিকে বলল,”তুই এই পনেরো দিনে কত পরিবর্তন হয়ে গেছিস। মা যখন আমাকে খাবার বেড়ে দিতে বলতো তখন তুই কত রাগ করতিস। হবে না, ভাই বড় হয়েছে নিজেকে বেড়ে খেতে বল। নিজের কাজ নিজে করা ভালো, অথচ আজ….।” দিদির চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। স্নেহা হালকা হাসলো।
“আসলে কি জানিস ভাই, তখন তুই আমার সঙ্গে সব সময় থাকতিস, একটু উদাসীন ছিলাম। এখন তোকে সব সময় পাবো না, তাই একটু বেশি আদর-যত্ন করছি।”
“সত্যি কি তাই!” স্নেহার দুটো চোখ ছল ছল করে উঠল। কিছুতেই বুঝতে দিল না তার বুক পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। জীবনে এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে কখনো ভাবেনি। কোথায় সকাল সাতটায় ঘুম থেকে ওঠা মেয়ে, আজ খুব ভোরে উঠে কাজ করার পরও শোনতে হচ্ছে, সে কাজ পারে না। তার ধৈর্য শক্তি অল্প। তবুও সহ্য করতে হয়। কথা এড়িয়ে গেল না স্নেহা। ভাই কে প্রতুত্তর করার জন্য উদ্যত হচ্ছিল তখনই ছাদ থেকে আর এক পুরুষ কন্ঠস্বর ভেসে আসলো।
“স্নেহা! কি গো! কোথায় গেলে? আমার টিফিন দাও!কাজে কখন যাবো? সময় তো বেরিয়ে যাচ্ছে। তুমি প্রচুর ঢিলে করো।”
“একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি।” স্নেহা ভাইকে উত্তর না দিয়ে স্বামীকে উত্তর দিল। তারপর সেখান থেকে উঠে গিয়ে রান্নাঘর থেকে টিফিন কৌটো নিয়ে ছাদে চলে গেল। কাজে যাওয়ার জন্য সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে গেছে। টিফিনের কৌটো ব্যাগের মধ্যে ভরে দিল।
“সাবধানে যেও, পৌঁছে ফোন করবে। বেশি রাত করবে না তাড়াতাড়ি চলে আসবে কেমন।” কোনো কথা না বলে স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরল। কপালে আলতো ঠোঁট স্পর্শ করল।
“সাবধানে থাকবে। বাড়ির বাইরে বেরোবে না। সাবধানে রান্না করবে। মন খারাপ হলে আমাকে ফোন করবে। দুপুরে একটু ঘুমিয়ে নেবে শরীর ঠিক থাকবে।” স্নেহা মৃদু হেসে মাথা নাড়ায়। তারপর বলল,” আমি কি বাচ্চা! বাড়ির বাইরে বেরোলে কেউ ধরে নিবে বুঝি? না,আমি কোনোদিন রান্না করিনি?”
“তবুও সাবধানতা অবলম্বন করা ভালো। আচ্ছা আমি আসছি দেরি হয়ে যাচ্ছে। সাবধানে থেকো।” দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলো। স্কুটার স্টার্ট দিল, হাত নাড়িয়ে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেল। স্নেহার খুব ভালো লাগলো। মানুষটি একদম আলাদা। প্রচন্ড রকমের খেয়াল রাখে, আদর-যত্নতে গাফিলতি করে না। বেশিরভাগ নারী স্বামীর আদর যত্ন আরেকটু ভালোবাসা পেলে মনে করে পৃথিবীর সবকিছু পেয়ে গেছে তারা। তাদের প্রত্যাশা খুব কম। তাইতো তারা গুণের তুলনায় ভাগের খাতায় বেশি থাকে।
স্কুটার চোখের আড়াল হতে বারান্দা থেকে আবার খাবার টেবিলের কাছে আসলো। ভাই সেরকম বসে আছে। এক টুকরোও খাবার মুখে তুলেনি। স্নেহা বড্ড আশ্চর্য হয়। ভাই না খেয়ে চুপচাপ বসে আছে কেন? কোন বিরুপ আচরনে মনোক্ষুন্ন হয়েছে সে? দ্রুত ভাইয়ের কাছে গিয়ে বসলো। মাথায় হাত বোলিয়ে বলল,”কি রে খাচ্ছিস না কেন? শরীর খারাপ নাকি!”
“না না, আমি ঠিক আছি।”
“বৌদি মনি, আমায় তাড়াতাড়ি কিছু খেতে দাও তো, কলেজ যাব দেরি হয়ে যাচ্ছে।” স্নেহা পেছনে ঘুরে দেখল তার একমাত্র ননদ দাঁড়িয়ে মুচকি হাসছে। আবার ভাইয়ের কথার উত্তরের জবাব দেওয়া হলো না। স্নেহা আবার সেখান থেকে উঠে গিয়ে রান্না ঘরে গেল, ননদের জন্য টিফিন তৈরি করতে লাগলো। ননদ পায়ের উপর পা তুলে সেখানে বসে মোবাইলে কি সব করলে রইল। ঋষি অবাক হয়ে বাড়ির সদস্যদের শুধু দেখে যাচ্ছে। কি তাজ্জব পরিবার! তাদের পরিবারের প্রায় প্রত্যেকে সকাল বেলায় পান্তা নয়তো মুড়ি খেয়ে কাটিয়ে দিত। এদের পরিবারে প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা খাবার তৈরি হয়। আলাদা আলাদা খাবার খাক অসুবিধা নেই, কিন্তু একজন মানুষের পক্ষে সবার জন্য আলাদা আলাদা খাবার বানাতে কতটা কষ্ট সাধ্য, তা কেউ বুঝছে না। কেউ তো এসে একটু সাহায্য করতে পারে। তা করছে না। ঋষিকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ননদ বলল,”কি ব্যাপার খাচ্ছ না কেন? লজ্জা পাচ্ছো নতুন বাড়িতে? লজ্জার কি আছে? এটাতো তোমার দিদির বাড়ি।”
“না না, লজ্জা পাচ্ছি না। দিদি আসলে একসঙ্গে খাবো, সেজন্য খাচ্ছি না।”
“বুঝলাম।” হাসিতে ভরে উঠলো মুখ। স্নেহা খাবার নিয়ে আসে টেবিলে রাখল। খুব দ্রুত খাওয়া শেষ করে উঠে গেল।যাওয়ার সময় বলল, তোমার ভাই নতুন এসেছে তাকে একটু আমাদের গ্রাম ঘুরে দেখিও। স্নেহা বলে উঠলো, এখানে সে নিজেই নতুন,ভাইকে কি করে ঘুরে দেখাবে?মাথা চুলকে বলে গেল, কলেজ থেকে ফিরলে দুজনকে তাদের গ্রাম ঘুরে দেখাবে। বাড়ির মধ্যে একা বসে থাকলে মন আপনা-আপনি খারাপ হয়ে যাবে। ঋষি লক্ষ করল দিদিকে আর দিদি লক্ষ করল ঋষিকে। দুজনের চোখাচোখি হতে একটু হেসে উঠলো। এত ঠান্ডার মধ্যেও কপালে ঘাম চিকচিক করছে, কানের কাছে ঘামের রেখা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। ঋষির বড্ড খারাপ লাগলো।
“আচ্ছা দিদি, তুইতো এই বাড়িতে পনেরো দিন হলো এলি, তার আগে এরা কি খেতো না? নিশ্চয়ই সবকিছু হোস্টেল থেকে কিনে আনতো না। নিজেরা রান্না করতো, আবার নিজেরা খাবার বেড়ে খেতো। তাহলে আজকে কেন করছে না?”
“জানিস না, মানুষ ঘোড়া দেখলে খোঁড়া হয়।এরাও ঘোড়া দেখে খোঁড়া হয়ে গেছে।”
“তাহলে কেন সবকিছু সহ্য করছিস? প্রতিবাদ করবি না! তুই তো সবাইকে বলতিস, যত মানিয়ে নিবি,তারা ততো চাপিয়ে দেবে। তাহলে আজকে তুই নিজের ক্ষেত্রে সেই কথা কেন প্রয়োগ করছিস না?” স্নেহা হাসলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে খাবার টেবিলে জমে থাকা থালা বাসন পত্র এক জায়গায় জড়ো করতে করতে বলল,”তোর মনে আছে ভাই, আমার বিয়ের দু-তিন মাস আগে মা মামার বাড়ি থেকে এসে কি বলেছিল?” ঋষি ভাবল, মা মামার বাড়ি থেকে এসে কি কথা বলেছিল। মনে করতে পারল না। বাসন গোছা শেষ হতে ভাইয়ের কাছে এসে বসলো। হাসিমুখে বলল,”সেবার মা মামার বাড়ি থেকে এসে মামীর কত দোষ খুঁজে বার করল। তিনি নাকি সব সময়ই রুমের মধ্যে থেকে বন্ধু-বান্ধবী বাপের বাড়ির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে। তাই মা মামীকে খুব অপছন্দ করেছিল। যদিও মামী এখনো মার পছন্দের মত হয়ে উঠতে পারেনি। কিন্তু আসল বিষয় কি জানিস, মা এখন আমার সঙ্গে ঘন্টার পর ঘন্টা ফোনে কথা বলে, কিন্তু আমায় এক বারের জন্যও বাধা দেয়নি। সেদিন যদি মামী দোষ করেছিল, তাহলে আজ আমিও সমান দোষ করছি। কিন্তু মা আমার দোষ খুঁজে পাচ্ছে না। কারণ আমি তার নিজের মেয়ে, আর মামী অন্য কারোর মেয়ে।”
“তাহলে তুই বলতে চাইছিস এই সবকিছুর পেছনে আমার নিজের মা দায়ী!”
“আরে না না… আমি কখন বললাম আমার মা সব কিছুতে দায়ী। আমার মা কিংবা তুই কিংবা আমি কিংবা এই বাড়ির কেউই দায়ী নয়, দায়ী আমরা সবাই।”
২।
দুদিনের মত হলো স্নেহের মন ভীষণ ভারাক্রান্ত। কারোর সঙ্গে ঠিকমতো কথা বলছে না। সবাইকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। কলেজও ঠিকঠাক যাচ্ছে না। স্বাভাবিক জীবনযাপনের মধ্যে অস্বস্তি, বিষন্নতা,একাকীত্ব, জড়তা আসা কোনো অস্বাভাবিক নয়। শনিবার ও রবিবার পেরিয়ে যাওয়ার পরও বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করল না সে। দিঘির জলে সাঁতার কাটতে গেল না। আকাশ আর নিলেশের মনে খটকা লেগেছে। স্নেহার কিছু একটা হয়েছে, যার জন্য সব কিছু এড়িয়ে যাচ্ছে সে। কয়েকদিন হলো গ্রামে বারোয়ারি মেলা বসেছে। স্নেহাকে অনেকবার ডাকার সত্ত্বেও উপস্থিত হয়নি । পরপর দু’দিন যাত্রা হয়েছে,যাত্রা দেখতে পছন্দ করে না তাই তার অনুপস্থিতি স্বাভাবিক ছিল।কিন্তু আজ ‘যেমন খুশি সাজো’ প্রতিযোগিতা রয়েছে তাছাড়া গ্রামের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা গান গাইবে,নাচবে, অথচ স্নেহা আসবে না বলে আগে থেকে জানিয়ে দিয়েছে। এই অনুষ্ঠানে নিলেশ এবং ঋষি দুজনেই পার্টিসিপেট করবে। তা সত্বেও স্নেহা আসতে চাইল না। মনের খটকা আরও জোরালো হলো।সন্ধ্যা হওয়ার পর থেকে মেলায় লোকের আগমন বাড়তে শুরু করেছে। আকাশ আর নিলেশ স্টেজের একদম সামনে খড় বিছিয়ে বসে রয়েছে। দুজনের মন একটু ভারাক্রান্ত, স্নেহার অনুপস্থিতিতে ভালো লাগছে না। নিলেশ আকাশকে একটু বসতে বলে উঠে চলে আসলো। আকাশ একটু শান্ত শিষ্ট ছেলে, বেশি ঝুট ঝামেলার মধ্যে পড়তে চায় না। নিলেশের কথায় খুব সহজেই রাজি হয়ে যায়। মেলা থেকে বেরিয়ে সোজা স্নেহার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। বাড়ির সামনে ল্যাম্পপোস্টের আলো মিটমিট করছে, আর বাড়ির ভেতর নিবিড় অন্ধকার বিরাজ করছে। নিলেশ বুঝতে পারে, বাড়ির সকলে মেলায় চলে গেছে। তবে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ, স্নেহার উপস্থিতির প্রবণতা জোরালো। দরজায় হাত চাপড়ে স্নেহাকে ডাকলো। বেশ কয়েকবার ডাকার পর,স্নেহা দরজা খুলে নিলেশকে দেখে আশ্চর্য হলো।
“কিরে এত রাতে আমাদের বাড়িতে! কোন অসুবিধা হয়েছে?”
“আটটা হয়নি, আর তোর কাছে গভীর রাত হয়ে গেল।” নিলেশ চটপট বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে আলো জ্বালিয়ে দিল। স্নেহার নিজের বাড়ি তবে অধিকারটা একটু বেশি যেন নিলেশের। স্নেহার হাসতে ইচ্ছে করলেও ভেতরের কষ্ট তার সেই ইচ্ছে টাকে দমিয়ে দিল। মৃদু কণ্ঠে বলল,”কি হয়েছে তোর? হঠাৎ আমার বাড়িতে উপস্থিত হলি যে।”
“তুই আমাদের সঙ্গে নেই কিছু ভালো লাগছে না, চল না রে আমাদের সঙ্গে। টিকলি বাপের বাড়ি এসেছে সামনাসামনি দেখা হলো কিন্তু কথা বলল না। বরের হাত ধরে এগিয়ে গেল। যেন আমি তার কত অপরিচিত। কোনদিন আমাদের মধ্যে পরিচয় ছিল না।” স্নেহা কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ালো। তাকে নিরুত্তর দেখে নিলেশ আবার বলল,”যাবি না তুই! আমি আকাশকে বলেছি দুজনের জায়গা রাখতে। বাবার কাছ থেকে পয়সা নিয়েছি তোকে তেলেভাজা খাওয়াবো। চল না রে…..।”
“আমার কিছু ভালো লাগছে না। তোরা গিয়ে দেখ।”
“আবার এক কথা…। ভালো লাগছে না কেন?”
“এমনি,এমনি….।”
“দূর,চল না রে। শেষ পর্যন্ত থাকতে হবে না, একটুখানি দেখে পালিয়ে আসবি।” নিলেশের বারবার অনুরোধ স্নেহা ফেলতে পারল না। হাসিমুখে বলল,”একটু অপেক্ষা কর আমি ওড়নাটা নিয়ে আসছি।” স্নেহা ছুটে ছাদে নিজের রুমে চলে গেল। ভীষণ খুশি হলো নিলেশ। সে জানতো তার কথা কিছুতেই ফেলতে পারবে না স্নেহা। এক মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে স্নেহা আবার ফিরে আসলো। তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই, যেমন পোশাক পরেছিল তেমন পোশাক পরে আছে -শুধু ওড়না নিয়ে এসেছে। তার অবস্থা দেখে হা হা করে হেসে ওঠে নিলেশ।
“তোর আবার কি হলো? পাগলের মত হাসছিস কেন?”
“তুই এই অবস্থায় মেলায় যাবি? নতুন পোশাক পর। মাথায় চিরুনি দে।”
“ওই গুলো নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না।এত রাতে আমায় কেউ দেখবে না।” হাত দিয়ে চুল ঠিক করতে করতে কথাগুলো বলল স্নেহা। নিলেশ আর কিছু বলল না, শুধু হাসলো। বাড়ির দরজা বন্ধ করে মেলার মধ্যে পৌঁছলো। আকাশ তাদের জন্য জায়গা রেখেছে। একসঙ্গে তিনজন বসলো। নিলেশও নিজের কথা রাখলো। সে সবার জন্য তেলেভাজা কিনে এনেছে। স্নেহা একটার বেশি খেলো না, -তাও আবার আকাশ আর নিলেশের জোরজবস্তিতে। নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়ে অনুষ্ঠান এগিয়ে যেতে লাগলো। অনুষ্ঠানের প্রতি একদমই মন নেই স্নেহার। চুপচাপ বসে মাটির দিকে তাকিয়ে থাকলো। অজান্তেই কখন নিলেশের কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়ল -বুঝতে পারল না। এখন শান্ত নিরব এক শিশু। বিষয়টি খেয়াল করল না আকাশ এবং নিলেশ উভয়ই।
স্নেহার কাছে বন্ধুত্বের মানে ভিন্ন, তা বারবার প্রমাণ করেছে।প্রথমদিন আর্য সাথে ফোনে কথা বলার পর নিয়মিত ফোন করেছে আর্যকে। কখনো কল্পনা আবার কখনো বাস্তব তাদের গল্পে স্থান করে নিয়েছে। স্নেহার মাধ্যমে আর্য ঠোঁটে বারবার ফুটে উঠেছে এক চিলতে হাসি। আবার কখনো দূর হয়েছে মনের গভীরে গুমোট অন্ধকার। পরস্পরকে বুঝতে তাদের বেশি সময় লাগে না।মুখের ভাষাও একে অপরের কাছে অনেক প্রিয় এবং মিষ্টি। সেদিন থেকে প্রতিদিন গোধূলি লগ্নে প্রথম ফোনটা স্নেহার এসেছে। তারপর কত মন খারাপের গল্প, চোখ ভেজানোর গল্প, আবার ঠোঁটে হাসি ফুটে ওঠার গল্প একে অপরকে শুনিয়েছে। তারা যে বন্ধু, স্কুলের বেস্ট ফ্রেন্ড। বাইরের দিক দিয়ে বহু দূরে হলেও আত্মার দিক থেকে খুব কাছে।ভোরে উঠে বই খুলে পড়তে বসেছে আর্য। শহরের অধিকাংশ ছেলেমেয়েদের রাত জেগে পড়ার অভ্যাস থাকে। তারা বেশিরভাগ পড়া রাতে কমপ্লিট করে। কিন্তু গ্রামের ছেলেরা এমনটা করতে পারে না। তারা বেশি রাত জাগে না। তারা সন্ধ্যা সময় আবার সকালে এই দুবেলা পড়তে বসে। গ্রামের সমস্ত ছেলে এমনটা না করলেও আর্য বরাবর এমনটা করে এসেছে। তবে বেশ কয়েকদিন এমন রুটিনের আগাগোড়া পরিবর্তন হয়েছে। সন্ধ্যা হওয়ামাত্র স্নেহার ফোন চলে আসে, গল্পগুজবে মেতে ওঠে। পড়াশোনা কম হচ্ছে বুঝতে পেরেছে। একটু বেশি ফাঁকি মারছে সে। বইয়ের তিন চার অক্ষর পড়তে না পড়তে ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলো, -স্নেহা ফোন করেছে। আজ পর্যন্ত কখনো সকালে ফোন করেনি সে। তবে গতকাল রাতে মেলায় যাওয়া সামান্য কথা হয়েছে। সেজন্য হয়তো সকালে ফোন করেছে। আর্য ফোন রিসিভ করল। কোন বিশেষ দরকারে ফোন করেনি স্নেহা। মন ভালো লাগছে না তাই ফোন করেছে। আর্যর ভালো লাগলো। নিশ্চয়ই স্নেহা তার সাথে কথা বলতে ভালো লাগে। তাই তার মন খারাপের সময় সঙ্গী করে নিয়েছে আর্যকে। ক্ষণিকের মধ্যে হারিয়ে গেল আর্য।এই মুহূর্তগুলো কত সুন্দর বলে বোঝাতে পারবে না সে। এক একটা মুহূর্ত ঠিক এক একটা জীবনের মত বড়। স্নেহা আজ তাকে কলেজ যেতে বারণ করে। তার মন অতিরিক্ত খারাপ, তার সঙ্গে সারাদিন বসে কথা বলতে বলল। আর্য খুব সহজে রাজী হয়ে যায়। ‘না’ বলতে জানে না। তার ডিকশনারিতে সম্ভবত ‘না’ শব্দটি নেই। সকাল গড়িয়ে দুপুর,দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে রাত, যেন খুব তাড়াতাড়ি সময়গুলো পেরিয়ে গেল। খাওয়া-দাওয়া হলো খুব অল্প, শুধু গল্প আর গল্প…।
রাতে কথা বলতে বলতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি। রাত প্রায় দুটো। হঠাৎ আর্যর ঘুম ভেঙ্গে যায়। ফোনের স্ক্রিনে লক্ষ পড়তে চমকে ওঠে। এখনো কল কাটেনি স্নেহা। বার তিনেক ডাকার পরও সাড়া পেল না তার। আর্য বুঝতে পারে স্নেহা ঘুমিয়ে পড়েছে। রুমের মধ্যে এদিক-ওদিক পায়চারি করতে শুরু করলো। এমন কি হলো স্নেহার? সবাইকে ভুলে তার সঙ্গে কথা বলছে। তবে সে কি আর্যকে পেতে চায়? আর্যর মতো তার মনেও শুধু প্রেম নয় ভালোবাসা রয়েছে? আর্যর মনে পুলকের ছোঁয়া স্পর্শ করল। খুশির জোয়ারে ভাসছে। বারবার অজান্তেই হাসির খোরাক ফুটে উঠছে ঠোঁটে। সে রাতে আর ঘুমোতে পারলো না। জীবনে প্রথম এত আনন্দের সন্ধান পেয়েছে। এই প্রথম কোনো প্রাণ-উজ্বল মুহূর্ত রাতের ঘুম কেড়ে নিল।
নির্দিষ্ট সময়ে ফোন আপনা আপনি কেটে গেছে। গতকাল কলেজ যায়নি আজ না গেলে প্রবলেমে পড়বে। সকালে নিজের কাজগুলো তাড়াতাড়ি সেরে ফেলল। তারপর চুপচাপ বসে স্নেহার কলের জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর স্নেহার ফোনে চলে আসলো। আবার গল্পে মেতে ওঠে। তবে আজকে স্নেহা তাকে বাড়িতে থাকতে বলল না। কলেজে যেতে বলল। আর্য কলেজের নিয়মকানুন সম্পর্কে অনেক আগেই অবগত হয়েছে। অযথা কলেজ কামাই করলে ভোগান্তিতে পড়তে হবে। বন্ধুর ভোগান্তি চায় না সে। রুমের মধ্যে ফোন রেখে কলেজে চলে যায়। কলেজে বার তিনেক ঘোরার পর একটা বড় ধরনের ধাক্কা খায়। কাল আইয়াপ্পা পুজো। কলেজের 90% ছাত্র-ছাত্রী অনুপস্থিত। তার ক্লাসমেটের মধ্যে মাত্র পাঁচজন মেয়ে এবং একটি ছেলে এসেছে। তাদের মধ্যে কাউকেই চেনে না সে। একটা ক্লাস হওয়ার পর কোনো ম্যাডাম ক্লাস নিতে আর আসলো না। ভালো লাগছে না কিছুই। কলেজ না আসলেই ভালো হতো। স্নেহা সঙ্গে অনেক গল্প করা হতো। আবার একদিকে মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে। অনেক দিনের পর স্কুল লাইফ ফিরে পেয়েছে। কোনো অনুষ্ঠানের আগে স্কুলের ছেলেমেয়েরা সব সময় স্কুল বন্ধ করে দিত। একটা সুযোগ পেয়েছে ছাড়বে কেন? এখানেও তেমন হলো। ক্লাস রুমের মধ্যে কেউ না থাকায় একা বসতে ভালো লাগলো না। লাইব্রেরীর দিকে এগিয়ে গেল। সেখানেও প্রায় একই অবস্থায়। সব সময় ভর্তি থাকা লাইব্রেরিটি আজ সম্পূর্ণ ফাঁকা। ক্লাসমেট একটা কোণে চুপচাপ বসে আছে। তার পাশে গিয়ে বসল আর্য। ছেলেটি একটা প্রসন্ন হাসি দিয়ে আবার চুপচাপ হয়ে গেল। আর্য ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল দুজন মেয়ে আলপনা দিচ্ছে। লাইব্রেরীর মধ্যে আলপনা দেখে একটু অবাক হয়। সম্ভবত লাইব্রেরীর মধ্যে কোনো অনুষ্ঠান হয়; কিংবা সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য আলপনা দিয়ে রেখেছে। ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা কম হওয়ায় লাইব্রেরীতে আনাগোনা সম্ভাবনা কম, তাই ম্যাডামের আদেশ তারা দুজন আলপনা দিচ্ছে। তাদের আলপনা দেওয়ার কৌশল লক্ষ করল দুজন। কিছুক্ষণ পর সামনে থাকা মেয়েটি কর্নাটকা ভাষায় কিছু বলল। আর্য এবং তার ক্লাসমেট একে অপরকে চোখ মেলে দেখলো। কোনো উত্তর দিতে পারল না। আর্য বুঝল ছেলেটি এখানকার নয়। এখানে বাড়ি হলে, এখানকার ভাষা অবশ্যই জানতো। তাদের কোনো উত্তর না পেয়ে মেয়েটি ইংলিশে তার কাছে আসতে বলল। দুজন গুটি গুটি পায়ে মেয়েটির কাছে এগিয়ে গেল। দুজনকে অতিরিক্ত শান্তশিষ্ট দেখে একটু বেশি পুলকিত হয় মেয়েটি। সে হালকা হেসে বলল,”অফিস রুম থেকে চক নিয়ে এসো তো। এক কালার নয়, ভিন্ন ভিন্ন কালারের আনবে।” মেয়েটির কথা শেষ হতেই দুজন ছুট দিল অফিস রুমের দিকে।
“এই আর্য তুমি কোথায় যাচ্ছ? চক কি এত ভারী যে দুজনকে তুলে আনতে হবে?”
মেয়েটির কৌতুক কথায় হাসি পেল না আর্যর বরং চমকৃত হলো। মেয়েটি কি করে তার নাম জানল? পেছনে ঘোরে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি বিনিময় করল। মেয়েটিকে ভালো করে প্রখর করল। ঠিক রিম্পির মতো শ্যামবর্ণ, ঠোঁটে চাপা আনন্দের হাসি, দয়ালু মাখা এক মুখশ্রী, মাথাভর্তি ঘন কালো চুল। রিম্পি চুলের বেনিতে কখনো রজনীগন্ধার মালা বাঁধতো না, আর এই মেয়েটি চুলের মধ্যে মালা বেঁধেছে; পার্থক্য শুধু এইটুকু। মেয়েটিকে খুব ভালো লাগলো আর্যর। এই অপরিচিতা তার মনে স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিল। তার কথা বলার ছন্দের প্রাগড় অনুভব করল। কালবৈশাখী পর যেমন শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা তিনটি ঋতু মুহূর্তের জন্য এক সঙ্গে মিলিত হয়, এখন তেমন একটা মুহূর্ত তৈরি হয়েছে। চিনতে অসুবিধা হলো না। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী সে। তবে কোন দিন কথা হয় নি।
“তুমি এখানকার ছেলে?”
“না, আমি বাঙালি।”
“ও ও।”
“তুমি কার্নাটাকা, তাই না!” মেয়েটি মুখ পেঁচিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল। তার মুখে প্রসন্ন হাসি মুহূর্তের মধ্যে মিলিয়ে গেল। আর্য বুঝতে পারল মেয়েটি তার প্রশ্নটা ভালোমতো নেয়নি। সে যখন নেপালি ছেলে দুটোকে নেপালি বলেছিল তখন তারাও এমন রিঅ্যাক্ট করেছিল। কি আশ্চর্য! নেপালি ছেলেটিকে নেপালি বলায় রাগ করেছিল, এখন এই কার্নাটকা মেয়েটিকে কার্নাটকা বলায় রাগ করল, অথচ আর্যকে বাঙালি বলায় রাগ করল না, বরং গর্ব বোধ করল।
পর্ব ১২ আসছে