বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :৪৫

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৪৫

শীতের প্রবণতা কেটেছে । ঋতুরাজ বসন্ত এসেছে ,তার সৌন্দর্যের ঝুড়ি নিয়ে। চারদিক নতুন ফুল নতুন পাতায় সেজে।গাছে গাছে রঙিন ফুল। সুবাসিনী প্রকৃতি সুবাস ছড়াতে মগ্ন।
ফ্লাইট টেকঅফ করতে আর মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধান।সেহের আরহামের পাশে বসে উদাসী চোখে জানালার বাহিরে তাকিয়ে।ইটপাথরের শহর ছেড়ে তরঙ্গের ভিড়ে ‘ কক্সবাজার ‘ পাড়ি জমাচ্ছে।আরহামের ভাষ্যমতে সব ঝামেলার জট এই শহর। এই শহর থেকে ছোট একটা ব্রেক নেওয়া উচিত । কিছুদিন শহরের বাহিরে খোলা পরিবেশে দিন কাটালে মনের জড়তা কাটবে । জায়গা পরিবর্তনের সাথে সাথে মনের আকাশের মেঘটাও কেটে যাবে!
বিমান টেকঅফের সময় সেহের আরহামের দিকে কিছুটা হেলে পরে।ভয়ে চোখ মুখ খিচে হাত খামচে ধরে।আরহাম হাত আলগে সেহেরের নিজের সাথে মিশিয়ে পিঠে আলতো হাত বুলিয়ে বলে,” ডোন্ট বি এফরেড , আই এম উইথ ইউ! “সেহের চোখ খুলে মাথা উঁচু করে তাকাল । আরহামের ঠোঁটের কোণে মিহি হাসি। এই হাসিতে ভয় কাটানোর বিশেষ কোন এক জাদু আছে!
চল্লিশ মিনিটের মাথায় ফ্লাইট কক্সবাজার ল্যান্ড করল।নামার সময় বিমানের ঝাঁকুনিতে সেহের ভয়ে কেঁপে উঠে আরহাম কোনরকম আশ্বস্ত করে।
এয়ারপোর্ট থেকে লাগেজ নিয়ে বের হবার সময় আরহাম আবাস পেল কেউ তাদের অনুসরণ করছে।আরহাম থেমে যায়। চারদিকে চোলহ ঘুরিয়ে বিচক্ষণ ভাবে লক্ষ করে।দূর গাড়ির কাছে উডি মাস্ক পরিধান এক লোক দাড়িয়ে। আরহাম সেহেরের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে।আরহামের সাথে চোখাচোখি হতেই লোকটা দ্রুত গাড়িতে চড়ে বেরিয়ে পড়ে। আরহামের মনে গাঢ় সন্দেহের ছাপ পরে।এরা ব্লাকমেইলার নয় তো? যেই ভয়ে সেহেরকে সবার চোখে আড়াল করতে ঢাকা থেকে কক্সবাজার নিয়ে এসেছে।এখানেও তারা পৌঁছে গেছে? তবুও ঠিক সময়! কি করে সম্ভব তা? এখানে আসার কথা বাড়ির মানুষ ছাড়া অন্যকেউ জানেনা। তবে কি বাড়ির কেউ ব্লাকমেইলারের সাথে জড়িত !

সমুদ্র পাহাড়ের মাঝবরাবর রাস্তা।দূর থেকে বড় বড় ঢেঊ পাড়ে আছড়ে পরছে।সেহের জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে পাহাড় সমুদ্রের খেলা দেখছে। আরহাম নীরবে গাড়ি চালাচ্ছে! এই তো আর সামান্য পথ তারপর গেস্ট হাউজ। গেস্ট হাউজটা মালিহা খানমের। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া।সেহেরের এমন উদাসীন ভাব দেখে তিনিই আরহামকে এখানে পাঠিয়েছে।আরহাম সেহেরের এখানে আসার খবর মালিহা ছাড়া অন্যকেউ জানেননা ।আরহাম এর আগেও বেশ কয়েকবার এখানে এসেছে। কিন্তু এবারের আসা বিশেষ , সেহের সাথে কিনা!
দীর্ঘ পথ পাড় করে গাড়ি গেস্ট হাউসের সামনে থামল।সমুদ্রের পাড়ে বিশাল বাড়ি।চারদিকে গাছ পালায় ঘেরা।গোল গোল চোখ সেহের চারদিকে ঘুরাচ্ছে।অজানা অচেনা জায়গাটাও ভীষণ পরিচিত লাগছে।নির্ভেজাল বিশুদ্ধ হাওয়া। শরীর মন নিমিষে হালকা হয়ে গেছে।সেহের ঘাড় ফিরিয়ে সামনের দিকে তাকাতে নড়ে উঠে। আরহাম গাড়ির দরজা মেলে দাঁড়িয়ে।সেহের নামতে পা বাড়ালে আরহাম আচমকা কোলে তুলে নেয়।ততক্ষণে কেয়ারটেকার চলে এসেছে । মিটমিট করে হেসে গাড়ি থেকে লাগেজ নামিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরেছে।সেহের ফিসফিস আওয়াজে বলে,”কি করছেন , উনি দেখছে,”
সেহেরের কথা আরহাম কানে নিলো না। সামনের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে বলল,”দেখলে দেখুক! ইট’স নরমাল । আমরা হাসবেন্ড ওয়াইফ এখানে হানিমুনে এসেছি।”
সেহের কোন প্রত্যুত্তর দিলো না।এই লোকটার সাথে সে কোনদিন পেরে উঠবে না।সব প্রশ্নের বেগবান উত্তর তৈরি থাকে।
আরহাম কোলে করে দোতলার রুমে নিয়ে যায়।বিছানায় বসিয়ে জিজ্ঞেস করে ,”তোমার কিছু চাই? কোল্ড ড্রিংকস বা অন্য কিছু? ”
“উহু,কিছু চাইনা! শুধু ঘুম চাই তার আগে ফ্রেশ হতে চাই । ”
“ঐদিকে ওয়াশরুম ফ্রেশ হয়ে নেও ,আমি নিচ থেকে ঘুরে আসছি ”
আরহাম নিচে চলে গেল। সেহের লাগেজ থেকে কাপড় নামিয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো।বেশ সকালে ঘুম থেকে উঠেছে সারাদিনের জার্নি ক্লান্তি সেজে মাথায় চড়ে থৈথৈ করে নাচছে।ধপধপ মাথা ব্যথা করছে।সেহের চার হাতপা মেলে এলোমেলো ভাবে বিছানায় শুয়ে থাকে।চোখে তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব এসেছে। বেশকিছুক্ষণ পর অনুভব করে পেছন থেকে কেউ শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে।গায়ের ঘ্রাণ তীব্রভাবে জানান দিচ্ছে ‘ আরহাম ‘।পিঠে টুপটুপ করে চুমু এঁকে দিচ্ছে । সেহের নিদ্রাতুর আলতো স্বরে বলল,”উফ আরহাম! একটু ঘুমাতে দিন ! রাতে ঘুম হয়নি সকালেও জলদি বেরিয়েছি ।আমি ঘুমাবো! ”
আরহাম পেছন থেকে মাথা তুলে সেহেরের দিকে তাকায়।কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে অভিযোগের স্বরে বলল,”হানিমুনে কেউ ঘুমাতে আসে? ”
সেহের চোখ মেলল না।আগের মত ঘুম ঘুম স্বরে বলল,”আমি ঘুমাবো …একদম জ্বালাবেন না! আপনি খুব জ্বালান খুব! আপনি…”
ধীর স্বরে আরো অনেক কিছু বলল।শেষের কথা গুলো আরহামের কান অবধি আসে না।সেহের আস্তে আস্তে গভীর ঘুমে ডুবে যায়।আরহাম মুচকি হেসে সেহেরের কপালে গাঢ় এক চুমু আঁকে ।বিছানায় ঠিকঠাক শুইয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

সেহেরের ঘুম কাটল দেরী করে।আঁধার নেমে এসেছে ।ঘুটঘুটে অন্ধকার রুম। কতক্ষণ ঘুমালো? দু থেকে তিন ঘন্টা তো হবেই! আরহাম হয়তো একা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।আরহামের কথা মাথায় আসতেই খুঁজতে নিচে চলে গেল।কিচেনের দিক থেকে থালাবাসনের বিকট শব্দ আসছে।কাঠে বাড়ি হওয়ায় সবটাই স্পষ্ট শুনা যাচ্ছে।আরহামের বিরবির করে কথা গুলোও!
আরহাম ডিনার রেডি করছে। পুরো কিচেন এলোমেলো হয়ে আছে।ফ্লোরে চামচ হলুদ মরিচ মশলায় একাকার ।

“কি হাল করে রেখেছেন? এটা কিচেন নাকি ময়লার ডাস্টবিন! ”

সেহেরের কথায় আরহাম ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়।কৃত্রিম হাসি টেনে বলে,” তুমি উঠে গেছো? যাও ডাইনিং টেবিলে বসো আমি ডিনার নিয়ে আসছি! ”

“জীবনে কোনদিন কিচেনে ঢুকেছেন? ”

আরহাম বাচ্চাদের মত ঠোঁট উল্টিয়ে ইনোসেন্ট ভাবে “না” সূচক মাথা নাড়াল।সেহের ফিক করে হেসে দেয়।সেহের বলল,”আমাকে ডাকতেন বা কেয়ারটেকারকে ব্যবস্থা করে দিতে বলতেন! ”
“তুমি ঘুমাচ্ছিলে আর কেয়ারটেকারকে দিনে একবার আসতে বলেছি। সকালে। শুধু বাজার দিয়ে চলে যাবে!
আমি চাইনা আমাদের প্রাইভেট টাইমে কেউ ডিস্টার্ব করুক! ”
আরহামের এমন কথায় সেহের আবারো হাসল। হাসি চেপে বলল,”ডিনারে কি খাবেন? ”
আরহাম মাথা চুলকে বলল, “লাইটলি কিছু! ”
“থাই স্যুপ , চাউমিন,ফিস ফ্রাই চলবে? ”
“দৌড়াবে! বাট আই হ্যাভ আ কন্ডিশন,ডিনার একত্রে তৈরি করবো ।রাজি? ”
“ডান ”
দুজন খুনসুটি করতে করতে ডিনার রেডি করল।ডিনার শেষে বাগানে খোলা আকাশের নিচে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিলো।নিসন্দেহে দুজন সুখী মানুষ!
তখনো অজানা আগামীকাল তাদের জীবনে এক বড় ঝড় বয়ে আসছে।খুব দ্রুত তাদের ভালোবাসার নীড় ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে ভেসে যাবে!

গভীর রাতে কারো ফিসফিস আওয়াজে সেহেরের ঘুম ভাঙে । পুরুষালি আওয়াজ । কোন কিছু নিয়ে দুজনার মাঝে তর্কবিতর্ক হচ্ছে। আওয়াজটা বারান্দার দিক থেকেই আসছে।বেশ কিছুক্ষণ খেয়াল করে সেহের উঠে বসে। মনে ভয় চেপেছে । আরহামটাও পাশে নেই। অপর পাশ খালি। এতো রাতে কোথায় গিয়েছে?
সেহের বুকে সাহস জুগিয়ে বারান্দার দিকে পা বাড়ায়।ঐতো আরহাম । চাঁদের আলোয় ছায়া ফুটে আছে। বিরবির করে একা একাই কিছু একটা বলছে। সেহের ধীর স্বরে ডাকল ,”আরহাম ”
সেহেরের গলার আভাস পেয়ে আরহাম ছিটকে যায়। তড়াক করে ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে তাকায়।সেহেরকে দেখে অপ্রস্তুত স্বরে বলে ,”সে..সেহের! তুমি এখানে? ”
“এতো রাতে কার সাথে কথা বলছেন? কে এখানে? ”
“কই কেউ নেই তো । ”
“আমি স্পষ্ট কারো আওয়াজ শুনলাম ”
“তুমি হয়তো ভুল শুনেছ , আমিই ছিলাম। ফোনে কথা বলছিলাম! ”
” আপনার আওয়াজ আমার চেনা। সেটা অন্যকেউ ছিলো। গম্ভির গলার কেউ! ”
আরহাম থতমত স্বরে বলে,”ফোন স্পিকারে ছিলো! ”
সেহের নিশ্চিন্ত স্বরে বলে ,”তাই বলুন ,আমি তো ঘাবড়ে গেছিলাম! ”
আরহাম প্রশান্ত নিশ্বাস ছাড়ল।সেহেরকে বুকে টেনে বলল,”অনেক রাত হয়েছে বিছানায় চলো ,ঘুমাবো! ”
সেহের হেলতে দুলতে বিছানায় আসল।আরহাম বুকে টেনে এনে চুলে বিলি কেটে দিতে থাকল ।সেহের ধীরেধীরে নিদ্রায় তলিয়ে যায়। আরহাম কোন এক গভীর চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটাল।

চলবে…❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here