বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :৫১

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৫১

অ্যালার্ম ডংডং আওয়াজে সেহেরের ঘুম ভাঙল ধরফরিয়ে উঠে বসে চারদিকে চোখ বুলিয়ে আশনূহাকে খুঁজতে লাগল ।রাতের কথা মনে করে থেমে গেল। মন ভার করে হাত পা গুটিয়ে চুপ করে বসে রইল।চোখ জলে টুইটুম্বুর। এই বুঝি বৃষ্টি হয়ে ঝরঝর করে নামবে।গায়ে চাদর দেখে চমকাল! কই রাতে তো গায়ে চাদর ছিলো নাহ ,এখন কী করে?
ভাবনার মাঝেই কান্ত ভারী শরীর নিয়ে উঠে দাঁড়াল।ঘুম ঘুম চোখ তুলে জানালার পাশে তাকাল । অন্ধকারে কারো অস্বচ্ছ আবছায়া দৃশ্যমান ।মানুষটা আরাম করে ছোট সোফায় বসে। কে সে! সেহের গুটিসুটি পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। দু’চার কদম যেতেই।থেমে যায় শরীর বরফ খণ্ডের মত জমে যায়। এক কদম ও সামনে বাড়ছে না। নিজ চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না! এটা কি সত্যি আরহাম?
আরহাম অবক্র সিধা হয়ে বসে।চোখজোড়া ফোনের স্ক্রিনে স্থির । সেহেরের উপস্থিতি এখনো টের পায়নি । এতো সকাল সকাল এখানে ? সব কেড়ে কি নিতে এসেছে আবার ?
সেহেরের ভাবনায় টোকা মেরে আরহাম বলল,” সরি সকাল সকাল বিরক্ত করার জন্য । কিছু ইম্পরট্যান্ট কথা ছিলো। মেইন ডোর খোলা ছিলো , কাউকে পাচ্ছিলাম না তাই ভিতরে চলে এলাম ! তুমি কি ফ্রি? ”
আরহামের এমন ভদ্র শান্ত আচরণে সেহের ভীষণরকম বিস্মিত ।আরহামের কথা কেন যেন সেহেরের বিশ্বাস হচ্ছে না। চোখমুখ আর বসে থাকার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সারারাত এখানেই ছিলো । তাও জেগে ।
আরহাম আওয়াজ করে বলল,”তুমি কি ফ্রি আছো? ”
সেহের নড়ে উঠল।”হ্যাঁ ” সূচক মাথা নাড়িয়ে বলল,” আপনি ড্রইং রুমে বসুন ,আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি । ”
আরহাম এক সেকেন্ড থামল না। বড় বড় পা ফেলে ড্রইং রুমের দিকে অগ্রসর হলো । সেহের বেশ কিছুক্ষণ আরহামের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল।এতো শান্ত স্বভাবের আরহাম নয়। আরহামের বদমেজাজ সম্পর্কে সেহেরের স্পষ্ট ধারণা আছে।তবে কি পাঁচবছরে পরিবর্তন হয়েছে? এতোটা পরিবর্তন কি করে সম্ভব ?
সেহের ফ্রেশ হয়ে ড্রইং রুমে যেতে আরহামকে দেখল গভীর মন দিয়ে মোবাইলে কিছু একটা করছে।সেহের সামনের সোফায় জড়সড় ভাবে বসলো ।সকাল সকাল আরহামের এখানে আসা সেহেরকে ভীষণ ভাবাচ্ছে । কি এমন জরুরী তলব! গলায় ক্রোধের রেশ রেখে সেহের ভারী আওয়াজ করে বলল,”সবতো কেড়ে নিয়েছেন ,এখন আবার কি চাই! ”
আরহাম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে উত্তর দিলো ,”তোমাকে ”
সেহেরের ভ্রু কুঁচকে আসলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আরহামের পানে তাকাল।আরহাম গলা ঝেড়ে বলল,”আই মিন নূহার তোমাকে চাই ”
“তাহলে ফিরিয়ে দিন আমার মেয়েকে আমার কাছে !”
“সাহস দেখে অবাক হচ্ছি! নূহা আমারো মেয়ে ,তুমি পাঁচ বছর দূরে রেখেছ ।এখন আবারো দূরে সরাতে চাও? ”
সেহের বিব্রত স্বরে বলল,”আপনার কাছে থাকাটা নিরাপদ মনে করি না! ”
সেহেরের কথায় আরহাম রাগল তেজি স্বরে বলল,”আমি আমার মেয়েকে আঘাত করবো? আমি? এই নিম্ন চিন্তাধারা তোমার? নূহা আমার মেয়ে আমার অংশ! হৃদয়হীন তো তুমি যে জন্মের পূর্বে গর্ভে খুন করতে চেয়েছ! ”
আরহামের রাগের প্রতাপে সেহের গুটিসুটি মেরে গেছে।সোফার সাথে লেগে বসে। এই শীতে তুষারপাতের ভেতর আরহামের ঘাম ছুটেছে।জ্যাকেটের চেইন খুলে বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে। রাগী ফোঁসফোঁস আওয়াজ শব্দহীন বিরান ঘরের চার দেয়ালে বাড়ি খাচ্ছে। খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে শান্ত করল।আরহাম আগের মত নেই । আগের মত রাগে নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে জিনিসপত্র ভাঙচুর করছে না।বিষয়টা সেহেরের চোখ এড়ায়নি।আরহামের কথার ধাঁচে বেশ পরিবর্তন ।
আরহামকে শান্ত দেখে সেহের নিচু স্বরে বলল,”কিছু বলতে এসেছিলেন! ”
আরহাম কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে বলল,”নূহার আয়া প্রয়োজন! তুমি কি ইন্টারেস্টেড? ”
আরহামের কথায় সেহের অগ্নিগিরির লাভার মত ক্ষেপে গেল।বাজখাঁই আওয়াজ তুলে বলল ,”আমি আশুর মা! আপনি আয়া করে নিতে চাচ্ছেন? এখন আমার মেয়ের সাথে দেখা করতে আয়া হয়ে যেতে হবে? আশুর উপর আমারো ততটা অধিকার আছে যতটা আপনার। আপনি এমন অন্যায় করতে পারেন না।”
আরহাম সেহেরের কথা কানে তুলল নাহ।বলল,”তুমি কি ইন্টারেস্টেড? ”
সেহের ক্ষিপ্ত স্বরে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ল ,” আপনার ওয়াইফ কি আমার মেয়ের খেয়াল রাখতে অক্ষম? নাকি সে আশুকে চাইছে না! ”
আরহাম বাঁকা হাসলো।বলল ,”নূহার নতুন মা না, তার মাম্মামকেই চাই! সাথে বাবাইকেও ! ”
কিছুটা থেমে আবার বলল,” নূহার জেদ সম্পর্কে তোমার স্পষ্ট ধারণা আছে। আমি চাইনা নূহা নিজের কোন ক্ষতি করে বসুক ,তাই পাঁচ মিনিট সময় দিলাম ভেবে উত্তর দাও। উত্তর যেন হ্যাঁ- ই হয়! ”
সেহের চুপ থাকল।আরহামের কথা ফেলে দেওয়া নয় । নূহা ভীষণ জেদি।গতবছর বার্থডেতে তার বাবাই কে চাই বলে জেদ করেছিল।বাবাইকে না পাওয়ায় কেক ফেলে সব কিছু এলোমেলো করে সারা সন্ধ্যা দরজা লক করে বসে ছিল। সেহের তো ভয়ে জমে গিয়েছিল ,কেঁদে কেটে একাকার ।সেই অনেক মিছে বাহানা দিয়ে দরজা খুলিয়েছিল।
“পাঁচ মিনিট শেষ , তো কখন যাচ্ছো? ”
আরহামের কথায় সেহেরের টনক নড়ল ।আরহাম বলল,”আমার কিছু শর্ত আছে! ”
সেহের শান্ত দৃষ্টিতে আরহামের দিকে তাকাল।সব যদি নিজেই ঠিক করে দেয় তবে এই ভাবাভাবির নাটক কেন?
বিরক্তির স্বরে বলল,”কিসের শর্ত? ”
“তোমাকে আমাদের সাথে বাংলাদেশ ফিরতে হবে , আমার কথা মত চলতে হবে! ”
“আপনি এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি করছেন!”
” আশনূহা তার পুরো পরিবারের সাথে থাকবে , তাছাড়া দেশে বাড়ি ঘর বিজনেস ছেড়ে সারাজীবন এখানে পরে থাকতে পারবো না ”
সেহের ক্ষিপ্ত চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে রইল।বাবা বাড়ি ফিরতে বাবাকে সবটা জানিয়ে ব্যাগপত্র গুছিয়ে বেরিয়ে গেল। আরহাম সেহেরের বাবা মুখোমুখি হলো ।দুজন দুজনাকে এড়িয়ে গেল।সেহেরের বাবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি আরহামের উপর!

আশনূহা তার মাকে দেখে তড়িৎ বেগে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে। সেহেরেরও একই দশা।ঝরঝর করে চোখের জল গড়িয়ে পরছে যেন কত কাল পর মা মেয়ের সাক্ষাৎ! আশনূহা মায়ের শরীরে ঘ্রাণে মাখামাখি করছে। এই ঘ্রাণ তার ভীষণ প্রিয়।সেহের মেয়ের কপাল গাল চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে।আশনূহা মাম্মামের গালে ছোট ছোট হাত ছুঁয়িয়ে দিয়ে বলে ,” মাম্মাম ,আশু মিস ইউ লট! ”
সেহের কান্নার মাঝে মুচকি হেসে বলল,”মাম্মাম অলসো! ”
আশু তার মাম্মামের হাত টেনে নিজের নতুন রুম দেখাতে নিয়ে গেছে।চোখে মুখে উল্লাসের আভা।আজ তার পরিবার পূর্ন ।আরহাম মা মেয়ের হাসি উজ্জ্বল মুখ দেখে মুচকি হাসে । সেহের আশু রুমে যেতেই হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে। পুরো রুম জুড়ে খেলনা পুতুলে ভরপুর।সেহের সামান্য অল্প আয়ের একটা চাকরি করে ।এই এক ঘরে যা আছে একবছরের ফুল ইনকামেও সেহের এতো কিছু এফোর্ট করতে পারবেনা ।
বিছানার দিকে সেহেরের চোখ আটকায়।আরহাম সেহেরের বিয়ের ছবিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ।ছবি গুলো এখনো কত সুন্দর যত্নে রাখা। আরহাম তো সেহেরকে ঘৃণা করে! তবে কেন এসব যত্ন করে রেখেছে? আচ্ছা ,মিহির কি এসব দেখে আরহামের উপর রাগ হয়নি ? কি জানি! হয়তো আশনূহার সামনে তার বাবা প্রমাণ করতে এসব রেখেছে!

রাতে খাবার টেবিলে আরহাম সেহের মিহি আশনূহা বসে।মিহি আশনূহা আরহামের দু পাশে বসে।সেহের ঠিকশনূহার পাশের চেয়ারটায় বসে ।আরহাম মিহি খাবার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক কথা বলছে।সেহের আশুকে খায়িয়ে দিচ্ছে । আরহাম আশুকে খায়িয়ে দিতে চাইলে আশু জেদ ধরে।মায়ের হাতেই সে খাবে! আশু আরহামের পছন্দ অপছন্দ এক! দুজনের লাইটলি ডিনার পছন্দ ।রাতে ভারী খাবার মুখে তুলবে না। সেহের সেই সকাল থেকে না খাওয়া মিহি কাজের লোক খাবারের কথা কয়েকবার বলেছে।সেহের আরহামের উপর রাগ দেখিয়ে না করেছে।আরহাম এসব নিয়ে মাথা ঘামায় নি। এখানে আসার পর একবারও কথা বলেনি। না তাকিয়েছে!
সেহের তো এমনটাই চেয়েছে তবে কেন এই চিনচিন ব্যথা? মিহি আরহামের বর্তমান ,সবটা জেনে মানতে পারছে না কেন? তাদের এক সাথে দেখে বুকের বাঁ পাশ এমন জ্বলে উঠে কেন ?
এই পাঁচ বছরে সত্যিই কি সব পাল্টে গেছে? নাকি এখনো কিছু অবশিষ্ট আছে!

চলবে…❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন 😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here