বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর) পর্ব :৫২

বিষাক্ত প্রেমের অনুভূতি

উর্মি প্রেমা (সাজিয়ানা মুনীর)

পর্ব :৫২

রুমের ছাদের দিকে তাকিয়ে আছে সেহের। পেটে ক্ষুধায় চোঁ চোঁ শব্দ হচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ শক্ত ভাবে পেট চেপে শুয়ে থাকে। কিন্তু কোন লাভ নেই । চোখের পাতায় কিছুতেই ঘুম নামছে না।পেটে ইঁদুর ফুটবল খেলছে ।নিজের উপর সেহেরের ভীষণ রাগ হচ্ছে কেন যে রাগ দেখিয়ে ‘খাবো না ‘ বলতে গেল! এখন কী করবে? চেয়ে খাবে? উহু ,কখনোই না!
আবারো শক্ত করে চোখ বুঝে রইল।বাহিরে তুষারপাত হচ্ছে।রুমে হিটার চলছে । এতো শীতের ভেতর উষ্ণ উষ্ণ হালকা গরম ছোঁয়া! ভীষণ আরামদায়ক।এতো আরামে যদি ঘুম না হয় তবে আর কি করার।আশু সেহেরের গা ঘেষে ঘুমিয়ে আছে।আশু একদম তার বাবার মত ঘুমিয়ে আছে।বিয়ের পর আরহামও সেহেরের গায়ের সাথে মিশে ঘুমাত।সেহের হাজার ছাড়াতে চেয়েও পারতো না। আরহাম ঘুম জড়ানো গলায় আদুরে মুখ করে বলতো ,”তোমার ঘ্রাণে মেখে থাকতে ভালো লাগে, সতেজ মিষ্টি মিষ্টি ঘ্রাণ! ইচ্ছে করে খেয়ে ফেলি। ”
“কাকে? আমাকে নাকি ঘ্রাণ ? ”
“দুটোই ”
আরহামের এমন উদ্ভট কথাবার্তায় সেহের তখন খুব হাসতো।আচ্ছা ,আরহাম এভাবে- ই কি মিহির ঘ্রাণে মিশে থাকে? হয়তো!
সেহের ভারী নিশ্বাস ফেলল।পাশ ফিরতে যেয়েও ফিরল না। আশু ঘুমে বিক্ষুব্ধ হচ্ছে।কপাল ভ্রু কুঁচকে নিয়েছে। সেহের চুপচাপ বেশ কিছুক্ষণ শুয়ে থাকার চেষ্টা করল কিন্তু হচ্ছে না।প্রেগন্যান্সির সময়কাল থেকে সেহেরের এমন সমস্যা শুরু হয়েছে ।আগে খাওয়া দাওয়া না করে অনায়াসে দিন পার করতে পারতো ,কিন্তু এখন না খেয়ে একদম থাকতে পারে না। একবেলা না খেলেই শরীর নেতিয়ে পরে।আজ তো পুরো দিন উপাস । মাথা ঝিমঝিম করছে।আরো মিনিট দশেক ভেবে সেহের বিছানা ছেড়ে দাঁড়ালো। চুপি চুপি পা তুলে কিচেনের দিকে গেল। পুরো বাড়ি অন্ধকারে ঢাকা ।জায়গা জায়গায় ছোট ছোট অল্প আঁচের আলো জ্বলছে । পুরো কিচেন তল্লাসি করে খাবার যোগ্য কিছু মিলল না। সব কিছু ফাঁকা।সেহের মুখ ভার করে যেতে নিলে চোখ আটকায় চুলার পাশে ঢাকা প্লেটের দিকে। দ্রুত পায়ে সেদিকে যায়। উপরের ঢাকন সরাতেই গরম গরম চিকেন চাউমিনে চোখ পড়ল ।সেহের খুশিতে লাফিয়ে উঠতে যেয়েও থেমে গেল।চাউমিন থেকে গরম ধোঁয়া উড়ছে ।যেন মাত্র- ই রান্না হয়েছে। এতো রাতে কে রান্না করেছে। কুক চলে গেছে সেই অনেকক্ষণ ।তবে কি মিহি? মিহি কি করে রান্না করবে তারা তো ঘুমাচ্ছে । যেই রান্না করুক তাতে সেহেরের কি ,তার ক্ষুধা লেগেছে সামনে খাবার পেয়েছে সে খাবে!
সেহের দাঁড়িয়েই গপাগপ খেতে শুরু করে।ভীষণ ক্ষুধার্ত সে!
তাড়াতাড়ি খাওয়ায় খাবার গলায় আটকেছে । শ্বাস নিতে ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।চোখ লাল হয়ে টপটপ পানি ঝরছে। এমন সময় কেউ মুখের সামনে পানি ধরে । সেহের মানুষটার চেহারা না দেখে পানির গ্লাসটা নিয়ে নেয়। ঢকঢক করে পুরোটা শেষ করে।দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে মুখে বিশ্ব জয়ের হাসি ফুটিয়ে “থ্যাংকইউ ” বলে যেই পিছনে ফিরে অমনি থমকে যায়। ভূত দেখার মত তাকিয়ে বলে “আপনি? ”
আরহাম ম্লান হাসলো।বলল,” হ্যাঁ ,আমি! এতো রাতে কিচেনে কি করো? ওহ খাচ্ছো! তুমি যে বললে ক্ষিধে নেই । ”
সেহের চোখমুখ খিঁচে নেয়।লজ্জা অপমানে সেহেরে গাল লাল হয়ে উঠে। আমতা আমতা স্বরে বলে,”ক্ষিধে নেই- ই তো । কিচেনে পানি খেতে এসেছিলাম সামনে চাউমিন দেখলাম তাই নষ্ট হবে ভেবে টেস্ট করলাম ”
“আচ্ছা? ”
সেহের দুবার হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাঁকাল । আরহাম ধীরে ধীরে সেহেরের কাছে এসে টেবিলের দুপাশে হাত রেখে সেহেরকে আটকাল।মুখের দিকে ঝুঁকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ” ভাঙবে তবুও মচকাবে না । এই পাঁচ বছরে কিছু পাল্টায়নি! না তুমি ,না তোমার রাগ জেদ! সবটাই আগের মত! ”
সেহেরে ছোট ছোট চোখ করে আড়দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখল আরহাম চোখ বন্ধ করে বড় বড় শ্বাস টানছে । ধীরে ধীরে সেহেরের ঘাড়ের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে।সেহের সেই প্রথমবার কাছে আসার মত থর‍থর কাঁপছে ।বুকটাও ভীষণরকম ধুকধুক করছে।সেহের চোখ বন্ধ করে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল,” কি করছেন? মিহি দেখলে ভুল বুঝবে!”
সেহেরের কথায় আরহামের হুশ ফিরল।তড়াক করে চোখ খুলে সেহেরের দিকে কোণাকোণি চোখে তাকাল।শান্ত স্বরে বলল,” মিহি তোমার মত ইমম্যাচিউর বাচ্চা না! সে যথেষ্ট বুদ্ধিমতী , সামান্য কারণে সে একা ফেলে যাবেনা! ”
আরহামের মুখে মিহির প্রশংসা বাক্য শুনে সেহের অগ্নিগিরির তপ্ত আগুন খন্ডের মত পুড়তে লাগল।ক্ষিপ্ত চোখে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হেসে বলল, ” কি অদ্ভুত তাই না? একটা সময় ছিল যখন আপনি আমার এই বাচ্চামো স্বভাবেই মুগ্ধ ছিলেন !”
“সেটা অতীত ছিল। এখন তো আর তোমার প্রতি ইন্টারেস্টেড না তাই না? ”
“সত্যি মানুষ গিরগিটির থেকে অতি দ্রুত রঙ বদলায়। ”
“এক বাচ্চার মা হয়েছো এখনো বাচ্চা রয়ে গেছো , সময় আছে চিন্তাধারা বদলাও! ”
সেহের পিটপিট চোখে আরহামের দিকে তাকাল । আরহাম সরে গিয়ে রুমের দিকে পা বাড়াল। কিছুটা এগিয়ে থামল । আওয়াজ করে বলল,” মিস. ন্যানি ,কিচেন থেকে চুরি করে খাওয়ায় এক হাজার টাকা পে- কাট।!
আরহাম কি বলল ‘মিস ন্যানি? ‘এখন কি নিজের মেয়ের কাছে ন্যানি হয়ে থাকতে হবে? সেহের রাগে লজ্জায় চেঁচিয়ে উঠল।
“থামুন, থামুন ! কি বললেন আপনি? ন্যানি? আমি ন্যানি? আর আপনার কাছে স্যালারি কে চেয়েছে? চাইনা আপনার স্যালারি আপনি রাখেন! ”
সেহেরের চেঁচামেচিতে আরহাম থামল । পিছন ফিরে এক পকেটে হাত রেখে বলল ,” তোমার কাছে টাকার গাছ আছে? স্যালারি না পেলে চলবে কি করে?
তোমাকে কি বলবো ? আমার ওয়াইফ তো নও । এক্স- ওয়াইফ বলে ডাকবো ? ”
সেহের ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে আরহামের দিকে তাকাল ।আরহাম দ্বিধাহীন বলল,”আমার কাছে তুমি আমার মেয়ের ন্যানি- ! ”
আরহাম চলে গেল। সেহের আহত চোখে আরহামের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ।

নিউইয়র্কের সকাল । অন্যদিনের মত আজও সারা শহর বরফে ঢাকা। গরম কাপড় মুড়িয়ে জীবিকার তাগিদে বেরিয়েছে , কেউ বা সময়টাকে উপভোগ করতে । সবাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে। টেবিলের অপর পাশ থেকে মিহি আশনূহাকে গভীর দৃষ্টিতে দেখছে মিটমিট করে হাসছে ।যে কেউ আশনূহাকে দেখে বলবে ‘ছোট সেহের’ ।মুখের গড়ন ,হাসি ,তাকানো পুরোটাই সেহেরের।কিছু আচরণের কথা বলা পছন্দ অপছন্দ সবটা আরহামের।চলনবলন দেখে- ই বলে দিতে পারবে আরহাম কন্যা!
মিহি একবার আরহামকে দেখছে আরেকবার আশনূহাকে । দুজন প্রথমে গ্লাসের জুসটা হাতে নেয় ।এক চুমুক খেয়ে রেখে দেয়।ক্রিমি টোস্ট শেষ করে আরহাম ছুড়ি কাটা চামচ হাতে নিয়ে অমলেটের দিকে হাত বাড়ায় , আশনূহাও তাই আলতো হাতে ছুঁড়ি কাটা চামচ নিয়ে অমলেট কেটে খাচ্ছে । বাবার মতই পার্ফেক্ট! এই গ্রহে একটা আরহামই যথেষ্ট নয় কি? বড় হয়ে আশনূহা তার বাবার মেজাজ না পেলেই হয়! তাহলে যেই হিংস্রতার গাছ মিহি গোড়া থেকে কেটেছে সেই হিংস্রতা এক নতুন রূপ নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়াবে!
অন্যদিকে সেহের ঘিয়েভাজা তেলে টইটুম্বুর পরোটা খাচ্ছে ।ঠোঁটের কাছে খানিকটা লেগেও আছে।এখনো বাচ্চামো রয়ে গেছে ,কাজকর্মে এখনো বাচ্চা! কে বলবে এই বাচ্চা মেয়ের একটা মেয়েও আছে? আরহাম আশনূহা যতটা পার্ফেক্ট সেহের ঠিক ততটাই এলোমেলো আর বেখেয়ালি!
কিন্তু এই এলোমেলো মেয়েটাই পৃথিবীর একদম ব্যতিক্রম জিনের দুজন পার্ফেক্ট মানুষের প্রাণ ভোমরা! খুব গভীর ভাবে দুজনের সাথে জড়িত।একজনের সাথে রক্তের সম্পর্ক অন্যজনের সাথে মায়া ভালোবাসায় বাঁধা!
মিহির ভাবনায় ছেদ পরে আরহামের আওয়াজে।বলল,”রবার্ট কখন ফিরছে? ”
“এই তো নেক্সট উইক ”
দুজন আবার খাবারে মন দিলো । সেহের ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রবার্ট কে? এর আগে তো কখমো নাম শুনেনি! পাশ থেকে আশুর আদুরে আওয়াজ ভেসে আসে। মায়ের কাছে আদুরে স্বরে বায়না ধরল ,” মাম্মাম ! তুমি বলেছিলে আমরা আজ ঘুরতে যাবো ”
“আজ কি করে যাবো মা ? নানুভাই যে ব্যস্ত! ”
“নানাভাই না ,আশু মাম্মাম আর বাবাই যাবে ”
সেহের একবার আরহামের দিকে তাকাল, পরক্ষণেই চোখ ফিরিয়ে মিহির দিকে তাকাল ,মিহির এসব নিয়ে বিন্দু পরিমাণ ভ্রুক্ষেপ নেই। সে বেশ আরাম করে নাস্তা করছে। সেহের আশনূহার দিকে ঝুঁকে বলল,” না মা ,আজ না কাল যাবো! ”
“না আশু বাবাই আর মাম্মামের সাথে- ই যাবে! ”
আশনূহা জেদ শুরু করে ।সেহের হালকা ধমক দিতে- ই ডাইনিং ছেড়ে সোফায় বসে। মায়ের কথায় রেগে মুখ ফুলিয়ে নেয়! আরহাম বেশ বুঝতে পারছে সেহের আরহামের কথা শুনে যেতে মানা করছে। আরহাম মেয়েকে কোলে তুলে বলে ,” অবশ্যই যাবো! আজ বিকালে নূহা বাবাই আর মাম্মাম বেড়াতে যাবে! কেমন? ”
কথাটা নূহাকে বললেও উদ্দেশ্য সেহেরকে। আশনূহা খুশিতে নেচে উঠে।সেহের অসহায় দৃষ্টিতে বাপ মেয়ের দিকে তাকিয়ে , এদের সামনে সেহেরের কোন কথা চলে না। বাপ বেটি দুজন সমপরিমাণ জেদি যা বলে তা করিয়ে ছাড়ে!

চলবে …..❣️

ভুল ত্রুটি ক্ষনার দৃষ্টিতে দেখবেন । প্লিজ সবাই সবার মতামত জানাবেন😊😊😊।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here