রুপ_আহরণ💚পর্ব_৪
#লেখক:হৃদয় আহমেদ
বাসর ঘরে দুজন পরপরুষকে দেখে চমকে উঠলো আরোহী। বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী দুজনের দৃষ্টি তিক্ন! স্থির আরোহীতে। আরোহী ভয়ে বিছানার চাদর খামচে ধরলো। কিছুক্ষণ আগে আরোহীকে ফুলে সাজানো বিছানায় বসিয়ে সবুজ ডিমলাইট জ্বালিয়ে চলে গেছে মেঘা আর রুপায়নের মা। সেই মৃদু সবুজ আলোতেই দুজন লোককে স্পষ্ট চোখে দেখছে আরোহী। ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। আরোহী পা জোড়া আরও গুটিয়ে নিলো। লোকগুলো এগোতে লাগলো আরোহীর সামনে। আরোহী কিছু বলার আগেই পেছন থেকে আরেকজন যে কি না বিছানার পিছনে লুকিয়ে ছিলো সে রুমাল দিয়ে চেপে নিলো মুখ। আরোহীর শুরু হওয়া সংসারের প্রথমেই লুটিয়ে পড়লো বিছানায়। এরপর আরোহীকে গাড়িতে তুললো লোকগুলো। তাদের মাঝে কেউ বললো,
— শাস্তি প্রাপ্য তোমার আরোহী! প্রাপ্য!
লোকগুলো মিলে গাড়িতে উঠে চলে গেলো। অকেজো আরোহীর কিছুটা যেতেই গাড়ির ঝাঁকুনিতে চোখ মেলে তাকায়। ঔষধের পরিমান অত্যান্ত কম থাকায় আরোহীর জ্ঞান ফেরে। বুঝাই যাচ্ছে কোন কাঁচা কেউ কাজটা করেছে। কিডন্যাপার নয়!চুপচাপ আরোহী রাস্তা দেখতে থাকে।
এদিকে শেখ বাড়ির তিনতলার উত্তরের রুমে কেউ থমকে গেলো। রুপায়ন পুরো রুম খুজেও আরোহীর কোন তল্লাসি পেলো না। অথচ, সে রুম থেকেই বেরোয়নি। বুক মোচড় দিয়ে উঠলো রুপায়নের। নিচে গিয়ে সবাইকে রুপায়ন সবটা বলে সোফায় বসে কেঁদে দেয়। সদ্য বিবাহীত বউয়ের জন্য কান্না দেখে মেঘা টিটকারি দিয়ে বলে,
— আহারে ভাইটু, চিন্তা করিস না। হি হি হি!
কানে তুললো না কেউ। এখন মজার সময় নয়। মৃদুল শেখ পুলিশে ইনফর্ম করেন। কোন হদিস মেলেনা তবুও।
__
প্রথম দুদীন পোড়া রুটি জুটলেও আজ তিন দিন আরোহী শুধু পানি খেয়ে আছে। একটু পরপর একটা লোক এসে ধমকে যাচ্ছে। আরোহী কম চেষ্টা করেনি বেরোনোর। কড়া সিকিউরিটির জন্য সে কিছুই করতে পারেনি।
— খিদে পেয়েছে মিস. আরোহী খন্দকার? পানি খাবেন? ঢেলে দি?
বাইরে থাকা আসা আলোর ছিটেয় অস্পষ্ট কারো ছায়ামূর্তি দেখলো আরোহী। এই লোকটাই তাকে শাশাচ্ছে একটু পরপর। আরোহীকে একটা কাঁচের গ্লাস এগিয়ে দিলেন লোকটা। মুখে মাস্ক। কিছুই নজরে আসলো না। যা দিয়ে একটু চেনা যায়। আরোহী নিশ্চুপ ভদ্র মেয়ের মতো গ্লাসটা নিয়ে নিলো। লোকটি পেছন ফিরে বলতে লাগলো,
— বিয়ের সখ মিটেছে মিস. আরোহী খন্দকার? কি মনে করেছিলেন, কাউকে কাঁদিয়ে নিজে সুখি থাকবেন? কখনো সম্ভব নয় এটা! রিভেঞ্জ অফ নেচার বলেও কিছু আছে যা সত্য! সে তো পিছু ছাড়বে না তোমার।
এদিকে আরোহী আস্তে করে কাঁচের গ্লাসটা ভেঙে ফেললো। শব্দ কানে আসতেই লোকটি যেইনা পেছোনে তাকাবে তখনি আরোহী অর্ধভাঙা কাঁচের টুকরো হাতের পেশিতে বসিয়ে দিলো। ব্যথায় আহ্ বলে চেঁচিয়ে উঠলো লোকটি। আরোহী প্রানপনে ছুটতে লাগলো চেনা রাস্তা অনুযায়ী।
সন্ধ্যা ৬.৪৫ মিনিট…
আরোহীর কানে দুর থেকেই ভেসে আসছে সাউন্ড সিস্টেমের আওয়াজ। এটা রুপায়নদের বাড়ি থেকেই। রাস্তায় থামে আরোহী। সন্ধ্যা লাগায় বেশি সময় লাগেনি আরোহী নিজেকে বাঁচাতে। ওখানে দাড়িয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিতে লাগলো আরোহী। পাশ দিয়ে একটা লোক যেতেই আরোহী হাঁপানো কন্ঠে বলে,
— চাচা, ওই পাশে কিসের এতো আওয়াজ?
— আরে এসব কি বলেন, শেখ বাড়ির একমাত্র ছেলের বিয়ে। কিছুদিন আগেও একটা হয়েছে বুঝলে? তা সেই মেয়ে বাসর ছেড়ে পালিয়েছে। আজ তার আরেকটা বিয়ে। কেন তুমি কে মা? আগে দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না!
আরোহীর আটকে আছে ‘ শেখ বাড়ির ছেলের বিয়ের কথাটা শুনে ‘ হঠাৎই বুকটা ধুক করে উঠলো আরোহীর। আবার নিজের সবটা দিয়ে দৌড়াতে লাগলো আরোহী। কিছুটা যেতেই আরোহী শেখ বাড়ির দারগোড়ায় পৌছে গেলো। বাড়িতে বেশ জমকালো ভাব নিয়ে বিয়ে হচ্ছে। দৌড়ে বিয়ের মঞ্চের সামবে যেতেই রুপায়নকে বর বেশে দেখে আরোহী গলা ফাটা চিৎকার দিয়ে বলে সেদিনের কথাটা। রুপায়ন সাইন করতে যাচ্ছিলো রেজিস্ট্রি পেপারে। করা হয়নি সে সাইন!
••••••
শেখ পরিবারে আবারো হট্টগোল। এ বাড়িতে আরোহীর মা বাবা আর আরোহীর সিমি আপু এসেছে। ওনাদের এ বাড়িতে আসায় আফসিয়া খানম কমোড় বেঁধে নেমেছে ঝগড়া করতে। কিন্তু আরোহীর মা বাবার চোখ অন্যকিছুই খুজছে। তাদের মেয়েকে দেখার তীব্র ইচ্ছা জেগেছে মনে। একদিকে ক্ষুব্ধও হয়ে আছেন!
মেঘা, মিনা শেখ, আরোহীর শাশুড়ী নিচে নেমে এলো। মেঘা পুরোটা পর্যবেক্ষন করে বললো,
— আর কি অঘটন ঘটাতে এসেছেন শেখ বাড়িতে?
মেঘার কথায় বুকে চেত করে উঠলো ওনাদের। রুপায়নের মা মেঘাকে রাগ দেখিয়ে বললো,
— এসব কিরকম ব্যাবহার মেঘা? আমাদের কখনো এভাবে কারো সাথে কথা বলতে দেখেছো? কই থেকে শিখছো এসব?
মেঘা মুখ ভেঙচে বিরবির করে বলে,
— খালামনি যখন ডাকিনীর ন্যায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলে তখন কিছু নেই। নিজের বোন হয় যে। আর আমি বললেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে!
মেঘা বিরবির করে বললেও তা কানে পৌছায় তাসফিয়া আনম শেখ এর।(রুপায়নের মা) রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তার বোনের উপর। তার থেকেই এসব শিখছে ছোট মেয়েটা। তাসফিয়া আনম মেঘাকে বলে,
— তুমি এখন এখান থেকে যাও মেঘা।
— ক্ আমি ক্ কি করলাম?
— আমি বলেছি যাও এখান থেকে! (চেঁচিয়ে)
মেঘা চলে যায়। তাসফিয়া আনম আরোহীর পরিবারের সামনে গিয়ে বলেন,
— আপনারা হঠাৎ এখানে?
আরোহীর বাবা আমতা আমতা করে বলে,
— আমার মেয়েকে একপলক দেখতে এসেছি বেয়া…
–দাড়ান দাড়ান দাড়ান। মেয়ে? কার মেয়ে? আপনার মেয়ে তো মারা গেছে আজ সপ্তাহ খানেক হলো। তাহলে আপনারা ঠিক কোন মেয়েকে দেখতে এসেছেন বলুনতো? আপনাদের বাড়ির পাশেই তো আপনারা মেয়ে আছে, তাহলে এখানে কি চাই আপনার?
লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো আরোহীর বাবা। গোটা শেখ পরিবারের সবার সামনে তাকে অপমানিত হতে হবে তা বুঝেছেন উনি। কিন্তু এর জবাব সে আরোহীর থেকে নেবে। তার জন্যই আসা।আসফিয়া আনম আরোহীর মায়ের সামনে আসলেন। পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বললেন,
— ভিখিরি দের বাড়িতে এই জন্যই আমি বারবার নিষেধ করেছিলাম আব্বাডার বিয়া না দিতে। বিয়ে দেওয়া লাগবে, এটা ঠিক! কিন্তু এতটা তারাহুরো করে বিয়ে দিয়ে শেষে কিনা মরা বউকে তাজা করে পাঠালেন? ধন্নী মানুষ আপনারা।
— তা নয়তো কি? দেখেছো, কেমন মুখের ভাব করে আছে। আশ্চর্য! যেন কিছুই জানে না বোঝে না। এতে যেন ওনাদের হাতই নেই। যত্তসব ফাউল লোকজন!
আরোহীর বাবা আর আরোহীর মা মাথা নিচু করে নিলো। এসব তাদের প্রাপ্য ছিলো যেন। আসফিয়া আনম আবার বললেন,
— ওতো আদেক্ষেতা করে কোন লাভ নেই। মেয়েকে দেখতে পাবেন না।নিজেরি সাজানো গোছানো পরিকল্পনা অনুযায়ী আপনারা সফল হয়েছেন। চলে গেলে তাতেই মঙ্গল।
— আমরা এসবের কিছুই জানতাম না বিশ্বাস করুন।
— এ্যাএএ ন্যাকা! জানতো এখান থেকে।
তাসফিয়া আনম শেখ তার বোনকে ধমকে থামিয়ে দিলেন। চুপ করলো আসফিয়া আনম। রুপায়নের মা বললেন,
— তাহলে আপনারা কিভাবে জানলেন আপনাদের মেয়ে এখানে আছে?
— আমি ডেকেছি!
সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে নামতে কথাটা বললো রুপায়ন। সাথে আরোহীও আছে। সবাই তাকালো সেদিকে। আরোহী নিচে নামতেই তার মাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। কেঁদে দিয়ে বললো,
— তোমরা এসেছো? এ বাড়ির সবাই আমায় অপমান করছে মা। কলঙ্কের দাগ দিচ্ছে।
আরোহীর মা নিজেকে ছাড়িয়ে কোষে একটা থাপ্পড় দিলেন আরোহীকে। আরোহী একটু দূরে গিয়ে ছিটকে পড়লো। আরোহীর মা বললো,
— মুখপুরি কোথায় গিয়েছিলিস? তোর জন্য কত অপমান সহ্য করতে হয়েছে, হচ্ছে। তা বুঝবি কোনদিন? কেন আমি তোকে নিজের গর্ভে ধারন করেছিলাম? কেন?
আরোহীর মা কেঁদে দিলেন। রুপায়ন এগিয়ে এসে বললো,
— দেখুন এতে আরোহীর কোন দোষ নেই।
পরিবারের সবাইকে সবটা বললো রুপায়ন। আসফিয়া আনম মুখ ভেঙচে চলে গেলেন ওখান থেকে। সাথে মিনা শেখও। যাওয়ার আগে বলে গেলেন, ‘এসব মিথ্যে বলছে ওরা। বিশ্বাস করিস না রুপায়ন। করিসনা বিশ্বাস। ‘
আরোহীর বাবা সবটা শুনে ভ্রু কুঁচকে বললেন,
— তাহলে ওই কবর? যা আমাদের দেখালো।
সত্যিই তো। কবর কে দেখালো আরোহীর পরিবারকে। প্রশ্ন তো একটা থেকেই যায়। নাকি আরোহীর বাড়ির কেউই এসবে জড়িত?
#চলবে…