হিমি
লেখনী- সৈয়দা প্রীতি নাহার
১১.
তাহির বসার ঘর অতিক্রম করতেই হনহন করে ঘরে ঢোকেন মায়মুনা আর ওনার ভাইঝি হৃদি। রাগে, অপমানে মায়মুনার গা জ্বলছে। ফুসফুস করে শ্বাস ছেড়ে ছেলেকে দেখলেন তিনি। তাহির ভ্রু কুঁচকে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,
‘এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে যে? আমি এক্ষুনি বেরুচ্ছিলাম।’
হিমির উপরের সমস্ত রাগ ঝপাং করে তাহিরের উপর এসে পরলো। মায়মুনা জামান গম্ভীর গলায় বললেন,
‘যাওয়ার হলে এতক্ষনে যেতে তুমি। যেতে চাও নি বলেই হসপিটাল থেকে ঘরে ফিরেছো।’
তাহির মায়ের কথায় জমে যায়। হালকা কেশে বলে,
‘তা নয়। সত্যি আজ শরীর খারাপ করছিলো। তাই আজকের সব এপোয়েন্টম্যান্ট ক্যানসেল করে বাড়িতে রেস্ট নিতে এসেছিলাম। ফোনে তো বলেছিলাম মা। দেখো আমি রেডিও হয়েছি। কিন্তু, দেরি হয়ে গেছে না বেশি? তোমরা কেনাকাটা করেছো তো? ব্যাগ কোথায়? হৃদি তুই,,,,’
তাহিরের কথার মাঝেই বড় বড় পা ফেলে উপর তলায় নিজ ঘরে চলেন মায়মুনা। কিছুক্ষন থম মেরে থেকে তাহির হৃদির দিকে তাকায়। মায়মুনার শোবার ঘরের দরজা বন্ধ হওয়ার আওয়াজ পেয়েই চোখ বোজে লম্বা শ্বাস টানে হৃদি। হ্যান্ড ব্যাগ টেবিলে রেখে সোফায় গা এলিয়ে বসে। তাহির উল্টোদিকের সোফায় বসে কৌতুহলী গলায় প্রশ্ন করে,
‘মায়ের কি হয়েছে হৃদি? আমি যাই নি বলে রেগে আছে?’
হৃদি হালকা মাথা দুলিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকিয়ে উচু গলায় ডেকে উঠে ফুলের নাম। কালো রঙের ময়লাটে জামা গায়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে ফুল। বিনীত ভঙ্গীতে বলে উঠে,
‘জি আফা?’
হৃদি বিরক্তির শীষ তুলে বলে,
‘হুয়াট আফা? কতোবার তোকে,,,, ছার ঠান্ডা পানি খাওয়া তো। গ্লাস ভর্তি ঠান্ডা পানি।’
মেয়েটি আবারও দ্রুত পা ফেলে ফ্রিজ খোলে পানির বোতল বের করে। পরিষ্কার গ্লাসে বোতল থেকে পানি ঢেলে হৃদির হাতে ধরিয়ে নিজ কাজে ফিরে। হৃদি ঢকঢক করে পানি খায়। একবারেই পুরো গ্লাস ফাঁকা করে টেবিলে নামিয়ে রাখে। শান্ত গলায় বলে,
‘তুমি যাও নি বলেই নয় শুধু আরো অনেক কাহিনী আছে।’
তাহির ভ্রু নাচায়। হৃদি মায়মুনার ঘরের দিকে চোখ বুলিয়ে ফিসফিস করে বলে,
‘তোমার আসতে দেরি হচ্ছে বলে ফুপি আমায় নিয়ে মল থেকে বেরিয়ে আসছিলেন। ঠিক ওইসময় আরেকটা মেয়ে ঢুকছিলো। তোমার চিন্তায় বা রাগে ফুপি অন্যমনস্ক। মেয়েটাও তাড়ার মাঝে ছিলো হয়তো। ব্যাস! যা হওয়ার হলো।’
তাহির স্মিত গলায় বললো,
‘কি হলো?’
‘ধাক্কা। এদিক থেকে ফুপি ওদিক থেকে ওই মেয়ে। একদম মুখোমুখি সংঘর্ষ।’
তাহির ছোট্ট নিঃশ্বাস টেনে বললো,
‘মা নিশ্চয় খুব রেগেছে মেয়েটির উপর!’
হৃদি ঘাড় বাঁকিয়ে বললো,
‘তা আর বলতে? ফুপির রাগ তখন আসমান ছুঁই ছুঁই। রাগের মাথায় মেয়েটাকে যাচ্ছেতাই বলছিলেন। মেয়েটাও কম না! কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিয়েছে। তারপর থেকেই ফুপির অপমান অপমান বোধ হচ্ছে।’
হৃদির কথা বলার ভঙ্গী দেখে মৃদু হাসলো তাহির। কপালে আঙুল ডলে বললো,
‘তুই যা ফ্রেশ হয়ে নে। আমি দেখছি মাকে।’
হৃদি মাথা দুলিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আফসোসের সুর তোলে বললো,
‘আমার মেয়েটার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে জানোতো!’
‘কেনো?’
‘মেয়েটার তো কোনো দোষই ছিলো না। শুধু শুধু ওতো কথা শুনতে হলো বেচারিকে। জানো, ফুপির সাথে ধাক্কা খেয়ে শপিং মলের দরজায় গিয়ে পিঠ ঠেকেছিলো তার। বা হাতে মেই বি ব্যাথা পেয়েছে। কিন্তু কিছুই বলে নি বিপরীতে!’
তাহির সন্দিহান গলায় বললো,
‘একটু আগেই না বললি কয়েকটা কথা শুনিয়েছে মাকে?’
‘আরেহ, ফুপি যখন ওর মা বাবার শিক্ষা আদব হেন তেন নিয়ে কথা বলছিলেন থুক্কু অপমান করছিলেন তখনই তো কথা বললো সে। ইন ফ্যাক্ট ও যেসব কথা বলেছে তার জন্য ক্ষমাও চেয়েছিলো। কিন্তু তুমি তো চেনো তোমার মা জননীকে! কোনো কথাতেই কাজ হলো না। বরং রাগ বেড়ে সপ্তম আসমান ছুঁয়েছিলো।’
তাহির পকেটে ডান হাত গুজলো। মায়ের এমন ব্যবহার খুব পুড়াচ্ছে তাকে। মায়ের সাথে কথা বলা উচিত এ ব্যাপারে। হৃদি হ্যান্ড ব্যাগ হাতে তুলতে তুলতে বললো,
‘আসলে ফুপির রাগটা অন্য জায়গায় ছিলো।’
তাহির রাগি গলায় বললো,
‘আশ্চর্য! এক এক বার এক এক কথা বলছিস কেনো তুই? একবারে সুষ্ঠু ভাবে সব কথা বলতে পারিস না?’
হৃদি অসহায় মুখ করে বললো,
‘সব গুলিয়ে যায় তো। আর তাছাড়াও ফুপি এ কথা আমায় গাড়িতে বসে বলেছেন। পুরোটা রাস্তা মেয়েটার আদব কায়দা আর পোষাকের কথা বলে বলেই মাথা চাপড়াচ্ছিলেন।’
তাহির গমগমে গলায় বললো,
‘মা এমনই। ওনার মতে বাঙালী মেয়েরা বাঙালীর মতো থাকবে। তাদের পোশাকে বাঙালী বাঙালী ভাব থাকবে, আচার আচরণে উচ্চ বংশের পরিচয় থাকবে। কোনো মেয়ে যদি ওয়েস্টার্ণ পরে মায়ের কথার জবাব দেয় তবে সে আন ডাউটেডলি আনকালচার্ড প্লাস বেয়াদব। যেমন তুই!’
হৃদি চোখ মুখ অন্ধকার করে বললো,
‘ভাইয়া প্লীজ। জন্মের পর থেকে বিদেশে বড় হয়ে দেশে এসে যদি বাঙালী সাজতে বলা হয় তাহলে সেটা আমার পক্ষে অসম্ভব। ওয়ান মোর থিঙ, আমি কখনোই ফুপির কথার জবাব দেই না। খালি শুনি।’
তাহির মাথা ঝাঁকিয়ে সিড়ির দিকে পা বাড়াতেই হৃদি তাচ্ছিল্য মাখা গলায় বলে,
‘মেয়েটার জামা আমার মতো ছিলো না বাই দ্যা ওয়ে। কিছুটা তোমার মতো ছিলো। টি শার্ট, তার উপর শার্ট, প্যান্ট, কেড্স, হাতে ঘড়ি, বেল্ট। চুলগুলো যদিও মেয়েদের মতো। কোঁকড়ানো। পোশাকের সাথে চুলের মিল নেই খুব একটা। অদ্ভুত।’
তাহিরের পা অটোমেটিক থেমে গেলো। নিজের মনেই বলে উঠলো একটা নাম ‘হিমি’। আবার ভাবলো পৃথিবীতে একইরকম চুল, পোষাকের স্টাইল থাকে। এই দেশে একইরকম হাজার হাজার মেয়ে না হলেও দু একজন থাকতে পারে। প্রয়োজন নয় সেই একজন হিমিই হবে। হতে পারে মায়ের সাথে অন্য কোনো মেয়ের ধাক্কা লেগেছে।
.
.
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একের পর এক শাড়ি, ড্রেস নিজের উপর রেখে দেখছে অথৈ। সবগুলোই দূর্দান্ত। কিন্তু পরতে হবে যেকোনো একটা। এটাতেই সমস্যা। হিমির পছন্দ অনুযায়ি হলুদ, মেহেদীর আউটফিট কেনা হয়েছে বলে এখন আর সেগুলো দেখতে হবে না। মুশকিল তো এঙ্গেইজমেন্টের রাতে কি পরবে সেটা নিয়ে। দেখতে এসে ছেলের মা আঙটি পরালেও ছেলের কথা সে এঙ্গেইজমেন্ট করবে। শ্বাশুরির থেকে আঙটি পরা হয়েছে বরের থেকে তো নয়! বর বউকে আঙটি পরাবে এটাই তো নীতি। কিন্তু এ দেশে সব উল্টো হয়। মা বাবা অথবা গুরুজনরা বিয়ের রিং কনের হাতে পরিয়ে দেয়। এর মানে হলো কনের এঙ্গেইজমেন্ট বরের পরিবারের সাথে হয়েছে। ইয়াসির এর সম্পূর্ণ বিরধীতা করে। ফলস্বরুপ নতুন করে আরো একটি অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। অথৈর অবশ্য এতে লাভই হলো। ছোট বেলা থেকেই আর সব মেয়েদের মতো রুপকথার স্বপ্ন দেখেছে। নিজেকে রাজকুমারী ভাবে নি যদিও, ভাবে নি তার রাজকুমার সাদা ঘোড়ায় চরে আসবে। তবে ভেবেছে তার বরকে সে রাজকুমার বলেই সম্বোধন করবে। তার বিয়েতে সপ্তাহব্যাপী আয়োজন চলবে। হ্যান্ডসাম কিউট করে একটা ছেলে তার বর হবে, যার মুখের দিকে তাকিয়েই সারাজীবন পার করা যাবে। অতিরিক্ত ভালোবাসা, দেখভাল, শাসন এসব তো থাকতেই হবে অথৈর প্রতি। একদম সিনেমার হিরো। আজ যখন সেই রুপকথা বাস্তব হচ্ছে তখন নিজের পছন্দসই হওয়া চাই সব। অথৈ গাঢ় বেগুনি রঙের লেহেঙ্গা গায়ে লাগিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখছিলো নিজেকে। অথৈ কোথায় শুনেছিলো মানুষ নিজেকে যতোটা সুন্দর মনে করে অন্যের কাছে তার সৌন্দর্য দুই গুন বেশি থাকে। অর্থাৎ তার উচিত নিজের পছন্দ নয় অন্যের পছন্দ যাচাই করা। হিমি অনাহিতার কাজে হাত লাগাতে চলে গেছে অনেক আগে। অথৈর রুমে এই মুহুর্তে এক মাত্র মিশ্মি আছে। অথৈর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা জামা গুলোর ভাজ ঠিক করে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখছে সেগুলো।
‘মিশু? এটায় ভালো লাগবে আমাকে? বল না!’
মিশ্মি একপলক দেখলো। মৃদু গলায় বললো,
‘তোকে সব কিছুতেই ভালো লাগে। যা ইচ্ছে পরতে পারিস।’
অথৈ কিছুটা খুশি হলো মিশ্মির কথায়। তবে খুশি জাহির করলো না। গলা কেশে বললো,
‘যা ইচ্ছা বললে হয় না কি? এঙ্গেইজমেন্টে এমন কিছু পরা উচিত যাতে সবাই তাক লেগে যায়। বল না কোনটা পরবো।’
মিশ্মি সোজা হয়ে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অথৈকে দেখে খাটে পরে থাকা বাকি পোশাকের দিকে তাকালো। সাদা রঙের গাউন হাতে উঠিয়ে অথৈর গায়ে ঠেকালো মিশ্মি। ভালো করে আগাগোড়া নিরক্ষন করে মিষ্টি করে হেসে বললো,
‘পারফেক্ট! তুই কাল এটাই পর। বিয়েতে তো লেহেঙ্গাই পরবি। রিং সিরেমনিতে গাউনটাই বেস্ট। একদম রাজকুমারি লাগবে।’
অথৈ গোল গোল চোখে গাউনটার দিকে তাকালো। উল্টো ঘুরে আয়নায় নিজেকে দেখে গাল ফুলিয়ে বললো,
‘কিন্তু এটার সাথের জুয়েলারি কিনি নি তো? কি করে পরবো?’
মিশ্মি অভয় দিয়ে বললো,
‘আমি কিনে আনবো।’
‘তুই? কোথা থেকে আনবি?’
‘কোথা থেকে আবার জুয়েলারির দোকান থেকে! আমার ওই পুরাতন রুপার ব্রেসলেইটের কথা মনে আছে? পাথর পরে গেছিলো বলে পরতেই পারি নি আমি। ভাবছি আজ গিয়ে সেটা ঠিক করিয়ে আনবো। সাথে তোর গাউনের সাথে ম্যাচিং জুয়েলারি। হবে?’
.
.
দরজায় টোকা পরতেই লক খোলে বেরোন মায়মুনা জামান। চিন্তিত গলায় বলেন,
‘তোমার সত্যি শরীর খারাপ করছিলো তাহির? কেমন লাগছে এখন? রাগের মাথায় খেয়ালই করি নি তোমার কথা। ইশ! কিছু খেয়েছো বাড়ি ফিরে? আব্দুল ফুল ওরা খোঁজ নিয়েছে তোমার?’
মায়ের কথায় মৃদু হাসে তাহির। মাকে শান্ত করে ঘরে গিয়ে বসে। ফিচেল গলায় বলে,
‘তেমন কিছু হয় নি মা। অস্বস্তি হচ্ছিলো। যা গরম পরেছে তাই হয়তো!’
‘তুমি কিছু খেয়েছো কি না সেটা বলো!’
‘হ্যাঁ মা খেয়েছি। বাড়ি ফিরতেই আব্দুল কোল্ড কফি আর স্ন্যাক্স দিয়ে গেছিলো।’
মায়মুনা জামান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলেন,
‘এখন ভালো লাগছে?’
তাহির মাথা নাড়ে। মায়মুনা জামান হাসি মুখে বলেন,
‘আমি নামাজ পরে ফেলি। দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমি যাও, রেস্ট নাও। হৃদি ফ্রেশ হয়েছে?’
তাহির মাথা দুলিয়ে বললো,
‘হয়তো।’
কিছু বলবে বলবে করেও বলতে পারে না তাহির। ধীর পায়ে ঘরের বাইরে আসতে নিলেই মা বলে উঠেন,
‘আজ কি হয়েছে জানো?’
তাহির ঝটপট মাথা নাড়লো। অর্থাৎ সে জানে না। মায়মুনা জামান উৎসাহিত গলায় বললেন,
‘সামিয়া এসেছিলো শপিংএ। তবে বেশিক্ষন থাকে নি। ও ভেবেছিলো তুমি থাকবে। কিছু কথা টথা বলতো হয়তো। তুমি যাও নি বলে চলে গেলো। শাড়ি, লেহেঙ্গা কিছুই দেখে নি। যেদিন তোমার সময় হবে বলো, মেয়েটাকেও ডেকে নেবো। বিয়ের কেনাও হবে আর কথাও বলতে পারবে।’
তাহির সায় জানালো। মায়মুনা গর্ব করে বললেন,
‘মনের মতো মেয়ে পেয়েছি। রুপ গুন মাশা আল্লাহ! আচার আচরণ তো আর বলার অপেক্ষা রাখে না।’
মুহুর্তেই থমথমে গলা করে বললেন,
‘আরো তো আছে। ফর্সা, সুন্দরী তবুও বড়দের সম্মান করতে জানে না। চেহারা দেখে কে বলবে বেয়াদব! একদম নিষ্পাপ। ফুলের মতো চেহারা।’
তাহির অবাক হওয়া গলায় বললো,
‘কার কথা বলছো মা? ফুলের মতো চেহারা মানে? আমাদের ফুলের মতো?’
মায়মুনা জামানের ধ্যান ভাঙে। তাচ্ছিল্য হেসে বললেন,
‘কতজনই তো আছে। ছারো ওসব! তুমি বুঝবে না। যাও যাও, রেস্ট নাও।’
তাহিরের মুঠোফোন বেজে উঠে। হাসপাতাল থেকে ফোন এসেছে। তাহির দ্রুত পা ফেলে বাইরে আসে। ফোন উঠিয়ে কানে ঠেকায়। ওপাশের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘আসছি।’
চলবে,,,,,,,,,