অজানা পর্ব-২৩

0
802

#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–২৩

💖

কিচেনের সামনে চেয়ার নিয়ে বসে আছে আরশ। একবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে তো একবার কিচেনে আরিবার দিকে তাকাচ্ছে। সেই যে ২ঘন্টা আগে আরিবা রান্না ঘরে গেছে আর বের হওয়ার নাম নিচ্ছেনা। এটা ওটা করেই যাচ্ছে আরিবা কিন্তু এত কি করছে সেটাই বুঝতে পারছেনা আরশ। এত সময় লাগার তো কথা না। এখন নিজের উপরেই বিরক্ত হচ্ছে আরশ। তখন আরিবার কান্না দেখে কেনো যে গলে গেলো। তবুও আরশ ওকে শাস্তি দিয়েছে। ও আরিবাকে দিয়ে বিরিয়ানী রান্না করাচ্ছে। কাউকে হেল্প করতে দিচ্ছেনা। আরশের খারাপ লাগছেনা ও বেশ উপভোগ করছে। আরিবা কোমড়ে ওড়না বেধে রান্না করছে। গরমের কারনে বিরক্ত হয়ে ওর লম্বা চুল খোপা করে রেখেছে। তবুও কিছু চুল সামনে এসে কপালে গালে ঘামের সাথে লেগে আছে। আরিবার ঘামাক্ত চেহারা। তাপের কারনে ধবধবে সাদা চেহারা হালকা হালকা লাল রং ধারন করেছে। দেখতে খুব ভালো লাগছে। আরশ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে ওর মায়াপরীর মাধুর্যতা। আরশ যেনো এক ভাবনার জগতে চলে গেলো।

আরিবা রান্না শেষে চুলা টা অফ করলো। হাতটা ধুয়ে ঘাড় বাকিয়ে আরশের দিকে তাকালো। দেখলো আরশ এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইতস্তত বোধ করলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে আরশের কাছে এসে বললো।

“ভাইয়া খাবেন না?”

আরিবার কথায় আরশের ধ্যান ভাঙলো। আরশ আমতা আমতা করে বললো।

“তুই টেবিলে গিয়ে বস! আমি সার্ভেন্টদের খাবার সার্ভ করতে বলছি।”

আরিবা ডাইনিং টেবিলের দিকে চলে গেলো। আরশ সার্ভেন্টদের বলে নিজেও চলে এলো। আরিবা টেবিলে বসতে না বসতেই বাড়ির সবাই চলে এলো। মি. জাকির চেয়ারে বসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন।

“আজ আমার মা রান্না করছে। আমি পেট ভরে খাবো। কতদিন মায়ের হাতে রান্না খাইনা। এক মা গেছে তো কি হইছে? আল্লাহ আমায় আরেক মা দিয়েছে তো!”

কথাটা বলতে বলতে আরিবার বাবার চোখে পানি এসে গেলো। আরিবা নিজের বাবাকে কাঁদতে দেখে ঠোঁট উল্টালো। বাবাকে জড়িয়ে ধরে বললো।

“আব্বু! তুমি কান্না করলে আমি নিজেও কাঁদবো। না খেয়েই চলে যাবো কিন্তু। তখন জোর করেও খাওয়াতে পারবেনা। এখনি হাসো! নাহলে গেলাম!”

“জাকির! চোখ মোছ! মামনি আদেশ দিয়েছে। রাজকন্যার কথা অমান্য করলেই গর্দান যাবে।”

কথাটা বলেই মি. আফজাল হেসে ফেললেন। তার সাথে সবাই হাসলো। আরিবার বাবা চোখের পানি মুছে মুচকি হাসলেন। এই মেয়ের কাছেই সে জিরো। এত বড় বিজনেসম্যান, এত ক্ষমতা সব বাইরে মেয়ের কাছে এসব কিছুই না। বাবা মেয়ের এমন ভালোবাসা দেখে আরিবার মাও তৃপ্তির হাসি হাসলেন। সার্ভেন্ট খাবার বাড়ছে। মিসেস তারিন তাড়া দিয়ে নললেন।

“হইছে হইছে! কথা পড়ে হবে এখন সবাই রিবা মামনির হাতের রান্না টেস্ট করো।”

সবাই তার কথায় সায় দিয়ে তাড়াতাড়ি খাওয়া শুরু করলো। আরিবা মুখে দিয়েই ঠোঁট উল্টালো। ওর একটুও ভালোলাগেনি। তবে সবাই অনেক প্রশংসা করেছে। তাদের কাছে নাকি মজা হয়েছে। আরিবা জানে এটা ওকে খুশি করতে বলছে। সবাই খুব ভালোবাসে ওকে তাই। আসলেই একটুও মজা হয়নি। ইউটিউব দেখে রান্না কতই ভালো হবে? আর ও তো কখনোও রান্না করেনি।

——————————–

পার্কের বেঞ্চে বসে আছে আরশ, জিসান, শাহীন ও তৃনা। এইদিনের পর থেকে তৃনা আরশকে অতটা জালায়নি। আবার ছেড়েও দেয়নি। দূর থেকে অনেক কে দিয়ে এটা ওটা বলছে। জিসান তৃনাকে ওর ভালোবাসা বুঝানোর অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু তৃনা মানতে রাজি না ও আরশের পিছেই পরে আছে। জিসান অসহায় হয়ে ধমে গেলো। আরশ বলছিলো। “ভালোবাসার মানুষের পিছু কখনও ছাড়তে নেই”। জিসান টলটলে চোখে বলেছিলো। “যে অল্প কথায় আমার অনুভুতি বোঝে না। তাকে রচনা লিখে দিলেও বুঝবেনা।” জিসানের টলটলে চোখ দেখে শাহীন আর আরশের খুব কষ্ট হচ্ছিলো। বন্ধু হয়ে কখনো বন্ধুর কষ্ট দেখতে পারেনা। তাই আরশ আজ সবাইকে এই পার্কে ডেকেছে। তখন থেকে সবাই চুপচাপ। জিসান মাথা নিচু করে বসে আছে। তৃনা নিরবতা ভেঙে গলাটা ঝেড়ে বললো।

“কেনো ডেকেছেন আমায়? কোনো জরুরী বিষয় হলে তাড়াতাড়ি বলুন না হয় আমায় যেতে দিন। আমাকে আমার এক ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টিতে যেতে হবে।”

আরশ মুচকি হেসে তৃনার দিকে তাকিয়ে বললো।

“তুমি আমাকে ভালোবাসো তাইনা? আমি কি তোমায় ভালোবাসি?”

তৃনা ছোট করে উত্তর দিল “নাহ”

আরশ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো।

“আমি তোমাকে ভালোবাসিনা। ধরো তুমি যদি আমায় বিয়ে করো আমি তো তোমায় ভালোবাসবো না। আমার পছন্দ মতো আরেকজনকে বিয়ে করবো। তোমার সামনে তাকে ভালোবাসবো তখন তোমার কেমন লাগবে?”

তৃনা কিছুই বললো না। আরশ ওর দিকে ফিরে বললো।

“তৃনা! আমি মেয়েদের সম্মান করি। এভাবে আমার পিছে ঘুরে নিজের সম্মান নষ্ট করো না। নারীর সম্মান বজায় রাখো। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি তৃনা। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে নিয়ে ভাবা আমার পক্ষে অসম্ভব। তোমাকে আমি বোনের চোখে দেখি। ভাই হিসেবে তোমাকে একটা উপদেশ দেই?”

যাকে ভালোবাসে তার মুখে বোন ডাকটা সত্যি কষ্টের। তৃনা অনেক কষ্টে নিজেকে ঠিক রেখে বললো।

“জি বলেন!”

“জানো! আমরা যাকে ভালোবাসি তাকেই বিয়ে করতে চাই। এজন্যই প্রতি নিয়ত আমাদের দেশে হাজার হাজার সংসার ভাঙে? ঘরে একজন বউ রেখে অন্যজনকে বিয়ে করে। এটা কিন্তু এসব কারনেই হয়। আমাদের উচিত কি জানো? যে আমাদের ভালোবাসে তাকেই বিয়ে করা উচিত। আমরা যাকে ভালোবাসি তাকে না। কারন যাদের আমরা ভালোবেসে বিয়ে করি তারা আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারে। কিন্তু যে আমাদের ভালোবাসে বিয়ে করবে সে কিন্তু ছেড়ে যাবে না। সে চাইবে ভালোবেসে সবসময় আগলে রাখতে। আশা করি তুমি বুঝতে চেষ্টা করবে। আসলে এটা আমাদের বিবেক বুঝলেও মন কিন্তু বুঝেনা। যে বুঝতে পারে তার জন্যই ভালো।”

শেষের কথাটা বলতে গিয়ে আরশ হেসে ফেললো। তৃনা কিছুই বললো না। আস্তে করে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। শাহীন জিসানের পিঠে হাত রেখে বললো।

“এই তুই তো পোলা গো মান সম্মান সব ডুবাবি। তাও পঁচা ড্রেনের পানিতে। মাইয়া মাইনষের মতো কান্দোছ কেনো?”

জিসান বিরক্ত নিয়ে ওর দিকে তাকালো। ও কষ্টে বাঁচেনা আর ওর বন্ধু ওকে নিয়ে মজা করছে। আরশ মুচকি হেসে বললো।

“জিসান! একদম ফিট থাক দেখবি সব ঠিক। আজ যেই ডোস দিছি দেখবি আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা আছি না কিসের চিন্তা তোর? হাসতো এবার! গোমরা মুখে তোকে মানায় না।”

আরশের কথা শুনে জিসান হালকা হাসলো। শাহীন ওকে শুড়শুড়ি দিতে লাগলো। শুরু হলো তিন বন্ধুর হাসি ঠাট্টা।

——————————

আরিবা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। ওদের কলেজ থেকে এবার সাজেক ভ্যালী টুরে যাচ্ছে। সাজেক ভ্যালী ওর খুব প্রিয় জায়গা। আরিবা ফ্যামিলির সাথে অনেক জায়গায় ঘুরতে গিয়েছিলো। সিলেট, কক্সবাজার, কুয়াকাটা আরও অনেক জায়গায় কিন্তু সাজেক ভ্যালী যায়নি। এই জায়গা সম্পকে অনেক শুনেছে ও। ইউটিউবে দেখছে এটা অনেক সুন্দর জায়গা। যেখানে মেঘেরা পাহারের গা ঘেঁষে লুকোচুরি খেলে। সেখানে যাবে শুনে ও খুব আনন্দ নিয়ে বাড়ি আসছিলো। কিন্তু ঘরে ঢুকেই ওর সব আনন্দ শেষ। আরশ শোনার সাথে সাথেই না করে দিলো। ও কিছুতেই আরিবাকে একা যেতে দিবে না। আরিবা অনেক অনুনয় বিনিনয় করেছিলো কিন্তু তাতে আরশের মন গললো না। পরে বলছিলো ওর সাথে বডিগার্ড বা আরশকে সাথে যতে বলছে। তাতেও আরশ রাজি না। সামনে ওর ফাইনাল এক্সাম তাই ও পড়ালেখা নিয়ে খুব বিজি। তাই আরিবা ওর রুমে এসে গাল ফুলিয়ে ফন্দি আটছে। হঠাৎ করে লাফিয়ে উঠলো। ঠোঁটে কামর দিয়ে হেসে নিজে নিজেই বললো।

“একমাত্র আব্বুই আমার কথা শুনে। কেঁদে কেঁদে বাবাকে বললে আব্বু অবশ্যই যেতে দিবে। এখন শুধু আব্বু আসার অপেক্ষা।”

এসব ভেবেই আরিবা উড়াধুড়া নাচা শুরু করলো। কে জানে ওর এই খুশি কদিন থাকবে।

রাত ৯টা। নিজের রুমে পায়চারী করছে আরিবা। আবার মাঝে মাঝে নিচতলার দিকে তাকাচ্ছে। আসলে ওর বাবার আসার অপেক্ষা করছে। বুঝতে পারছেনা এখনও ওর বাবা আসছেনা কেনো। বিরক্তি নিয়ে খাটে বসলো আরিবা। ওর একটুও ভালো লাগছেনা। যখন ওর দরকার পরে তখনেই ওর আব্বু দেরি করে বাড়িতে আসে। কিছুক্ষণ পর ওর বাবার আওয়াজ পেয়ে দৌঁড়ে নিচে এলো। ওর বাবা সোফায় বসা ছিলো। আরিবা তার পাশে বসে আহ্লাদি হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো। মিসেস আঞ্জুমান ও মিসেস তারিন বুঝছেন কেনো আরিবা এমন করছে। মি. জাকির মেয়েকে এক হাতে জড়িয়ে বললেন।

“কি ব্যপার! আজ মামনি কে ডাকার আগেই চলে আসলো? কিছু চাই আমার মিষ্টি মেয়েটার?”

আরিবা গাল ফুলিয়ে বললো।

“আমি কি তোমার কাছে আসি না?”

“আসো! আমার মামনি সব সময় আমার কাছে আসে!”

আরিবা বাবার আদর পেয়ে আরও আহ্লাদি হয়ে বললো।

“আব্বু! আমার সব ফ্রেন্ডরা কলেজ থেকে টুরে যাচ্ছে। আমিও যেতে চাই আব্বু! তুমি পারমিশন দাও!”

টুরে যাওয়ার কথা শুনে মি. জাকির ভয় পেলেন। নিজের মেয়েকে দূরে কোথাও যেতে দিতে চাননা। যদি বিপদ হয়? তাছাড়া মেয়েকে একদিন না দেখে থাকতে পারেন না। তাই মেয়ের মাথায় হাত দিয়ে বললেন।

“মামনি! তুমি তো জানো আমি তোমায় নিয়ে কতো টেনশনে থাকি। দূরে গেলে আরও টেনশন হবে। এই বয়সে আমার টেনশন করাটা কি ঠিক?”

আরিবা হতাশ চোখে বাবার দিকে তাকালো। কিছু বলার নাই তার। বাবার ইমোশনাল কথা শুনে চুপ হয়ে গেলো। বাবাই তার একমাত্র বড় দূর্বলতা। আরিবার বাবা আবার বললেন।

“তোমায় একদিন না দেখে আমি থাকতে পারিনা তুমি তো জানো মামনি। তোমায় কি করে যেতে দেই? তবে তোমায় কথা দিচ্ছে সামনে মাসে তোমার বার্থডের পরে আমরা সবাই সাজেক ভ্যালী যাবো। খুশি! এবার হাসো!”

আরিবা বাবার কথা হালকা হাসলো। যদিও প পুরোপুরি খুশি হয়নি। তবুও বাবার জন্য মেনে নিবে। বাবাকে জড়িয়ে ধরে মুচকি হেসে উপরে চলে গেলো। কি আর করার সামনের মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করবে।

💝

ইনশাআল্লাহ চলবে…..

(ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন প্লিজ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here