অজানা পর্ব-২৬

0
751

#অজানা
#লেখনীতে_তাশরিফা_খান
পর্ব–২৬

💝

সন্ধ্যা ৬টা। অনুষ্টানে অনেকেই আশা শুরু করেছে। মি. জাকির হোসেন চৌধুরী ও মিসেস আঞ্জুমান সবাইকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছে। মি. আফজাল ও মিসেস তারিন ভিতরের দিকটায় বসে আছেন। আরশ এদিক ওদিক দৌড়া দৌড়ি করছে। দেখছে কিছুতে কমতি আছে কিনা। বডিগার্ডরা আরশের পিছনে রয়েছে। কোনো হুকুমের অপেক্ষায়। খুব ঝাকঝমক করে সাজানো হয়েছে চারদিক। সাদা কাপর, বিভিন্ন রকমের ফুল আর অনেক রংয়ের বেলুন দিয়ে পুরোটা সাজানো হয়েছে। আরিবা এখনও আসেনি। ওকে পার্লারে সাজতে পাঠিয়েছে। আরিবার পার্লারের সাজ অতটা পছন্দ না। কিন্তু মিসেস আঞ্জুমান ও মিসেস তারিন ওকে জোর করে পাঠিয়েছে। সাথে শান্তা, নেত্রাকে ও কয়েকজন বডিগার্ড পাঠিয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রায় সবাই এসে গেছে। কিন্তু এখনও আরিবার আসার নাম নেই। আরশের খুব চিন্তা লাগছে। ও বারবার গেইটের দিকে তাকাচ্ছে। অনেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও আসতে না দেখে আরশ সামনে আগাতে গেলো কিন্তু তার আগেই দেখলো আরিবা গাড়ি থেকে নামছে। মুখে হালকা হাসি ফুটিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। আরশ থমকে দাড়িয়ে আছে। ওকে দেখতে সত্যি সত্যি পরীর মতো লাগছে। সাদা বাবরি গাউন পরেছে আরিবা। আরশ নিজেই এটা পছন্দ করে কিনেছে। তখন বুঝেনি ওর গায়ে এত বেশি মানাবে। সাথে ম্যাচিং করে হিজাবও পরেছে আরিবা। ঠোঁটে হালকা খয়েরী লিপস্টিক। এ যেনো এক রূপকথার পরী। আরশের ভাবনার চেয়েও বেশ সুন্দর লাগছে ওকে।

নিদ্র ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে। ও এই অনুষ্ঠানে আসতে চায়নি। আরশ ওদের পুরো ফ্যামিলি ইনভাইট করেছে। ওর মা বাবাও এসেছে। নিদ্র একা বাসায় থাকবে কেনো তাই নেত্রা ওকে জোর করে নিয়ে এসেছে। এখনে ভাবছে না আসলে সত্যি খুব বড় সৌন্দর্য মিস করতো। আরিবা আস্তে আস্তে হেটে সামনে স্টেজে এগিয়ে গেলো। ওর মা বাবার পাশে দাড়িয়ে সবার উদেশ্যে সালাম দিলো। সবাই ওকে উইশ করলো। আরশ এখনও ধ্যানেই আছে। ও ওর হাসি মাখা মায়াপরীটাকে দেখছে। শাহীন ওর গায়ের উপর লাফিয়ে পড়তেই ওর ধ্যান ভাঙলো। আরশ রাগ নিয়ে শাহীনের দিকে তাকাতেই ও বললো।

“আরে মামা! এবার তো পলক ফেলা! তোর পাখি অনেক দূর চলে গেছে। এমন ধ্যানে থাকলে তো ফুরুত করে উড়ে যাবে।”

আরশ রাগি চোখে চেয়ে বললো।

“এমন বানরের মতো লাফিয়ে পড়লি কেনো? বানর হওয়ার শখ আছে? চল চিড়িয়াখানায় দিয়ে আসি।”

“কি করবো মামা! তুই তো কথাই শুনছিলি না। কাউয়ার মতো চেয়ে ছিলি। আর কোনো উপায় ছিলো না।”

আরশ রেগে ওর দিকে আগাতেই শাহীন দিলো দৌড়। জিসান হাসতে হাসতে বললো।

“এবার থাম ভাই! পড়ে মারামারি করিছ তোরা। চল!”

কথাটা বলে ওরা স্টেজে চলে গেলো।

শান্তার দিকে চোখ যেতেই থমকে গেলো শাহীন। ও বুঝেনা কেনো ওই মেয়েটার দিকেই ওর চোখ যায়। প্রথম দেখেই এই শ্যাম বর্নের মেয়েটাকে ওর খুব ভালো লাগছে। ও এক দৃষ্টিতে শান্তাকে দেখেই যাচ্ছে।

আরিবাকে অনেকক্ষন ধরেই খোঁচাচ্ছে শান্তা। আরিবা ওর দিকে রাগি চোখে চেয়ে বললো।

“কি হইছে তোর? এমন করছিছ কেনো? পেটের ভিতর গুঁড়ি কৃমিতে নাড়েচাড়ে?”

শান্তা উৎফুল্ল হয়ে বললো।

“দোস্ত! কতদিন বলছি আরশ ভাইয়ার সাথে আমাকে সেটেল করে দে। কিন্তু তুই তো কথাই বলোছনা। দেখ কি সুন্দর লাগছে। কালো শার্টের উপর গ্রে কালার সুট পড়েছে। সিল্কি চুলগুলো কি সুন্দর উড়ছে। দেখ দেখ! কি এ্যাটিটিউট নিয়ে হাত নাড়িয়ে হেসে হেসে কথা বলছে। উফফ খুব সুন্দর লাগছে ইয়ার!”

আরিবা ওর হাত অনুসরন করে আরশের দিকে তাকালো। ভ্রু কুচকে মনে মনে বললো।!” আসছে সুট বুট পড়ে। মনে হচ্ছে বিয়ে করতে আসছে। কি দরকার এত সাজার? আমি তো মেয়ে হয়েও এত সাজি না। বেটা আস্ত শয়তান! শুধু মেয়েদের ক্রাশ হতে চায়। দেখিশ একটা পেতনি তোর কপালে জুটবে।” আরিবার ভাবনার মাঝেই শান্তা আবার বললো।

“তুই আমার জন্য ভাইয়াকে ছেড়ে দে তাহলেই হবে!”

আরিবা বিরক্ত নিয়ে ওর দিকে তাকালো। যেদিন থেকে আরশকে দেখছে ওইদিন থেকেই ওকে জ্বালিয়ে মারছে। আজও ছাড় দিচ্ছে না। তাই রাগ নিয়ে বললো।

“কে ধরে রাখছে তোর আরশ ভাইয়াকে? নিয়ে যা না! কে মানা করছে? আমি তোর মতো যে সে মানুষকে ধরবো না বুঝলি? পৃথিবীতে আর মানুষ পেলিনা। এই খাটাশ টাকেই পেলি। হুহ!”

নেত্রা এতক্ষন ওদের কথা চুপচাপ শুনছিলো। এবার চোখ গরম করে বললো।

“থাম তোরা! এখানেও ঝগড়া শুরু দিছোছ? চুপচাপ থাক!”

আরিবা কিছুই বললো না। মুখ বাকিয়ে সামনের দিকে তাকালো। শান্তাও অন্য দিকে ঘুরে ঠোঁট চেঁপে হাসলো। নেত্রাও ওদের কাহিনী দেখে হেসে ফেললো। আরিবা বুঝতেও পারলোনা দূর থেকে দুজন মানুষ ওকে ভালোবাসার চোখে দেখছে।

“এই! তুই কি রিবা? এই তূর্য! এটা রিবা না?”

শাওন আর তূর্য এইমাত্র এসেছে। শাওন আরিবার কাছে এসেই সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে এসব বললো। আরিবা শান্তা ও নেত্রা শাওনের কথার মানে বুঝতে পারলোনা। অগত্যা ওর দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো। তূর্য আরিবাকে ভালো করে পর্যাবেক্ষন করে বললো।

“হ্যা শাওন! এটা আমাদের রিবা।”

“ওহ! আমি ভাবছিলাম কোনো পেত্নিকে এখানে এনে দাড় করিয়ে রেখেছে। সত্যি সত্যি তাল গাছের পেত্নির মতো লাগছে। এই তুই পেত্নি না তো?”

এতক্ষণে ওর কথার মানে বুঝতে পারলো ওরা। নেত্রা আর শান্তা ঠোঁট চেঁপে হাসছে। আরিবা ওদের দিকে রাগি চোখে চেয়ে বললো।

“তোদের কপালে এমন পেত্নি বউয়েই যেনো জোটে বুঝলি? ওয়েট কর, কলেজে গিয়ে তোদের ঘাড় মটকাবো।”

তূর্য আর শাওন কিছুই বললোনা। মুচকি হেসে পাশে দাড়ালো।

কেক কাঁটার পর্ব শেষ হলো। আরিবা ওর পরিবারের সাথে কেক কাটলো। সবাই ওকে উপহার দিলো। এবার সবাই নিজস্ব জায়গায় বসেছে। শাহীন ও জিসান স্টেজে চলে গেলো। তূর্য সবাইকে উদেশ্য করে বললো।

” হাই গাইস্! আপনাদের কি মনে হচ্ছে না অনুষ্ঠানটা কেমন ঝিমিয়ে গেছে? একটু আনন্দ প্রয়োজন?”

শাহীন সাথে সাথেই বললো।

“অবশ্যই! এখন আমাদের ঝিমিয়ে পড়া মনটা ফুরফুরা করতে স্টেজে আসছে সাকিব নিদ্র! ব্রো কাম!”

নিদ্র স্টেজে চলে গেলো। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে একবার আরিবার দিকে তাকালো। অগত্যা ওর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে গাইতে লাগলো।

“এই মন গলে পড়েছে ঢলে
তোর মনেরি কোলে এক দেখায়।
তোর বিশ্বাসে, প্রতি নিঃশ্বাসে
নে জড়িয়ে আমায় নির্দ্বিধায়

সুখ বলে কিছু থাকে যদি এই পৃথিবীতে
তার সবি যেন আছে তোর ওই চোখের মনিতে

এই মন গলে পড়েছে ঢলে
তোর মনেরি কোলে এক দেখায়।
তোর বিশ্বাসে, প্রতি নিঃশ্বাসে
নে জড়িয়ে আমায় নির্দ্বিধায়”

এটুক গেয়ে আবার আরিবার দিকে তাকালো। দেখলো আরিবা মুচকি হেসে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। তাই নিদ্র আরিবার দিকে তাকিয়েই গাইতে লাগলো।

“তোর হাসি থেকে যেনো মুক্ত ঝড়ে পড়ে
তোর মায়া ভরা মুখটা খুবই মনে ধরে
মন কেনো জানি তোকে জেনেছে ভিষণ
তুই ছাড়া লাগে না আর কাউকে আপন

এই মন গলে পড়েছে ঢলে
তোর মনেরি কোলে এক দেখায়।
তোর বিশ্বাসে, প্রতি নিঃশ্বাসে
নে জড়িয়ে আমায় নির্দ্বিধায়”

নিদ্রকে নিজের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে আরিবা বিব্রতবোধ করলো। ওর মনে হচ্ছে ওকে ইঙ্গিত করে গানটা গাইছে। এদিকে আরশ রেগে ফেটে পড়ছে। আরিবাকে বিব্রত হতে দেখে নিদ্র ওর থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। চোখ বন্ধ করে গাইলো।

রাত জাগা স্বপ্নে আজ ঘুমটা গেছে চলে
মন সারাক্ষনি শুধু তোর কথা যে বলে
হাতে হাত রেখে তোকে বলছি যে শোন
আগলে রাবো যে তোকে সারাজীবন।

এই মন গলে পড়েছে ঢলে
তোর মনেরি কোলে এক দেখায়।
তোর বিশ্বাসে, প্রতি নিঃশ্বাসে
নে জড়িয়ে আমায় নির্দ্বিধায়”

গানটা গেয়ে নিদ্র আস্তে করে স্টেজ থেকে নেমে পড়লো। আর দাড়ালো না নিদ্র সোজা বেড়িয়ে গেলো। সবাই অবাক চোখে চেয়ে আছে। নিদ্রর মা বাবা ছেলের এমন কাজের কোনো মানে বুঝে উঠতে পারলোনা। আরিবা ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। ওর মনে হলো নিদ্রর মনে অনেক কষ্ট। কিন্তু কি কষ্ট সেটাই বুঝতে পারছেনা ও। নেত্রা অসহায় চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। এতদিন ও যেটা সন্দেহ করেছে সেটাই ঠিক। ওর ভাই ওকে না বললেও আজ প্রমান পেয়ে গেছে। আবার শাহীন ও জিসান স্টেজে উঠে বললো।

” সুন্দর একটি গান শুনলাম। ধন্যবাদ সাকিব নিদ্র কে।এবার আমাদের জন্য আছে আরেক চমক। চলুন দেখে নেই।”

কথাটা বলেই ওরা নেমে পড়লো। তূর্য, শাওন, নেত্রা ও শান্তা স্টেজে উঠলো। বক্সে গান চালু হলো।

” মেঘ বলেছে আমায় নিবে তোমার বাড়ি
নীল আকাশটা তাইনা শুনে রাগ করেছে ভারী।
মেঘ বলেছে আমায় নিবে তোমার বাড়ি
নীল আকাশটা তাইনা দেখে রাগ করেছে ভারী।
বৃষ্টি বুঝি একটু পরেই নামবে তাড়াতাড়ি
ভালোবাসার উৎসবে আজ রংয়ের উড়াউড়ি।
এই বাদলা দিনে পাগলা মনে প্রেমের ছড়াছড়ি
ধুত্তুরি ছাই ভাল্লাগেনা তুমি ছাড়া কিছু
চাইলে মনে আসতে পারো আমার পিছু পিছু
(পুরোটা নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন প্লিজ)”

ওরা চারজন মিলে নাচ করলো। ওদের নাচ খুব সুন্দর হয়েছে। সবাই প্রশংসা করলো। আরিবা তো পুরা অবাক। ও জানতো না ওর বার্থডে তে ওর বন্ধুরা ওকে এত সুন্দর উপহার দিবে। ও জানতোই না ওরা এত সুন্দর নাচ জানে। শাহীন শান্তার নাচ দেখে অবাক হয়ে গেলো। কারো নাচ ওর কাছে এত সুন্দর লাগেনি।

ওরা নেমে যেতেই সব লাইট অফ হয়ে গেলো। সবাই অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। হঠাৎ স্টেজের মাঝে লাইট জ্বলে উঠলো। সেখানে তাকাতেই আরশকে দেখতে পেলো। আরিবা এর মানে বুঝতে পারলো না। আরশ ওর দিকে তাকিয়ে গেয়ে উঠলো।

“বোঝাতে পারিনা তোমায় আমি কতটা ভালোবাসি।
তুমি আমার অবুঝ আদরে গল্পে সাজানো বায়না।
আমি জানি তুমিও জানো, এ মায়া আর কেউ বোঝেনা
আমার কাছে তুমি অন্য রকম
ভালোবাসি বেশি প্রকাশ করি কম।”

আরশ এক দৃষ্টিতে আরিবার দিকে চেয়ে গান গাইছে। আরশকে চেয়ে থাকতে দেখে আরিবার খুব লজ্জা লাগছে। মানুষ কি ভাববে এভাবে তাকালে? তাই ও আশেপাশে তাকালো। সবার দিকে একবার তাকিয়ে আরশের দিকে তাকালো। দেখলো আরশ ওর দিকেই চেয়ে আছে। আরিবা মুচকি হেসে লজ্জা মাখামুখে মাথা নিচু করে ফেললো। তা দেখে আরশ ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটিয়ে আবার গেয়ে উঠলো।

“তোমার হাসি খুশিতে সাজাই আনমনে ইচ্ছে মতো
তুমি ছাড়া বোঝেনা কিছুই মন আমার সেতো।
আমার কাছে তুমি অন্য রকম
ভালোবাসি বেশি প্রকাশ করি কম

কোনো কিছুই লাগেনা ভালো, এমন তোমার মতো
আমি ছাড়া বাসবে কে আর তোমায় এত ভালো।
আমার কাছে তুমি অন্য রকম
ভালোবাসি বেশি প্রকাশ করি কম”

গান শেষে আরশ আরিবার দিকে চেয়েই স্টেজ থেকে নামলো। আরিবা লজ্জায় আর মাথা উঠায়নি। সবাই কি ভাববে তাতে ও কারো দিকে তাকায়নি। তবুও ওর বন্ধুরা ওকে অনেক লজ্জা দিছে। অনুষ্ঠান শেষে সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে চলে গেলো। আরিবা অপেক্ষা করতে লাগলো ওর স্বপ্নের জায়গায় যাওয়ার জন্য!

💖

ইনশাআল্লাহ চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here