#অদ্ভুত_প্রেমোমোহ_তুমি
#পর্বঃ৮
তাজরিয়ান খান তানভি
পুরো এক্সিবিশন হল জুড়ে লোকে লোকারন্য।মানুষ ঘুড়ে ঘুড়ে দেখছে মারশিয়াদ এর চিত্রকল্প গুলো।চোখ জুড়ানো সব চিত্রকল্প।মেয়েরা অধিক আগ্রহে বসে আছে মারশিয়াদ কে দেখার জন্য আর তার অটোগ্রাফের জন্য।
মারশিয়াদ বসে আছে মনিটরিং রুমে।অপেক্ষা তার কাজলচোখীর।এক্সিবিশন গ্যালারির মেইন ফটকে সি সি টিভি লাগানো যাতে করে দরজা দিয়ে প্রবেশ করা প্রত্যেকটি মানুষের চেহারা ও স্পষ্ট দেখতে পায়।হয়তো তার কাজলচোখী আসতে পারে।হয়তো!!
এক অধীর আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে মারশিয়াদ মনিটরের দিকে।আচমকায় কারো মিষ্টি কন্ঠের আওয়াজ শুনে।
“হাই।”
মারশিয়াদ হালকা মাথা বাকিয়ে তাকায়।
“তুমি??
“কেমন আছো??
মারশিয়াদ এর নিখুত দৃষ্টি মনিটরে এর প্রত্যেকটি মেয়ের চোখে।সেদিকে তাকিয়েই সে কথা বলছে।
“ভালো।
তুমি এখানে কেনো এলে??
তোমার এখানে আসার অধিকার নেই।”
ইনশিরাহ মারশিয়াদ এর কাছে এসে দাড়ায়।সেদিনের মতো আবারও ওর বুকের হৃদযন্ত্রের উপর হাত রাখে।
“আমার অধিকার এখানে।”
মারশিয়াদ ওর হাত ঝাড়া দিতে গিয়ে হালকা চোখ সরিয়ে মনিটর এর দিকে তাকাতেই দেখে একটা মেয়ে দেখে।চোখে গাঢ় কাজল টানা।বাতাসের ঝটকায় চুলের অর্ধেকটা চোখের নিচ থেকে মুখের উপর এসে রয়েছে যাতে করে তার চেহারা বোঝা যাচ্ছে না।কিন্তু মারশিয়াদ তার কাজলচোখী কে চিনতে ভুল করেনি।ইনশিরাহ এর হাত সরিয়ে সামনে এগুতেই ইনশিরাহ আবার ওর হাত চেপে ধরে।
“কোথায় যাচ্ছো??
মারশিয়াদ দাঁতে দাঁত চেপে চোয়াল শক্ত করে।হাত টা ধরে হালকা ধাক্কা মারে।ইনশিরাহ তরিৎগতির এই ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে চেয়ারের উপর পড়ে যায়।কপালের কোন কেটে গিয়ে রক্ত ঝড়তে থাকে।
,
,
মারশিয়াদ দৌড়ে আসে গেইটে।হন্যে হয়ে খুজতে থাকে তার কাজলচোখী কে।কিন্তু পায়না সে তাকে।শ্বাস এর গতিতে তার হৃদকম্পন তীব্র থেকে তীব্র হয়।মাথায় হাত দিয়ে চুল গুলো কিছুক্ষন টানতে থাকে।সেখানকার মেয়েরা প্রায় অবাক তার এহেন কাজে।মারশিয়াদ নাকের ঢোগা ফুলিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে।কিছুক্ষন হাপিয়ে কিছু একটা মনে করে।গার্ডদের ডেকে মেইন গেইট বন্ধ করে দিতে বলে।
ফ্লোরে গিয়ে সবাই কে দাড়াতে বলে।সবাই কিছুটা বিচলিত হয়।এরকম করার কি মানে!!
মারশিয়াদ সেখানে আসা প্রতিটি মেয়ের চোখ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে।অনেকের চোখেই কাজল কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই তার কাজলচোখী নয়।মারশিয়াদ হতাশ।তার কাছে তখন এমন মনে হচ্ছে যেমনটা মনে হয় কোনো মানুষ ঘরের জানালা খুলে চাঁদকে দেখে তাকে পাওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই যখন তা কালো মেঘে ঢেকে যায়।এক আবক্ষ দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বুক চিরে।সবাইর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয় সে।
তখনই মাথায় স্কুলের ঘন্টার মতো ঢং করে উঠে।মারশিয়াদ এর মনে আসে সি সি টিভি ক্যামেরাতে তো নিশ্চয় তার কাজলচোখীর চেহারা দেখা যাবে।ও দৌড়ে যায় মনিটরিং রুমে।সেখানে যেতেই ওর মাথায় রক্ত উঠে যায়।প্রজ্জলিত দুচোখ বেয়ে লাভা ঝড়ছে তার।পুরো শরীরে কাপন ধরেছে।রাগে দাঁত কিড়মিড় শুরু করেছে যেনো এখনই সব শেষ করে দিবে।কপাল বেয়ে ঝড়ছে ঘাম।
পুরো মনিটরিং রুম ধ্বংসস্তুপে পরিনত।গার্ড কে জিঙ্গেস করতেই জানায় ইনশিরাহ ওর রাগ ঝেরেছে এইসব এর উপর।কোনো কিছুই সে আস্ত রাখেনি।সব ভেঙে গুড়োগুড়।ইলেকট্রিকাল জিনিস যা ঠিক করাও অসম্ভব।মারশিয়াদ রেগে দেয়ালে পাঞ্চ করতে থাকে।যতক্ষন না সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।নিজেকে সাজা দিচ্ছে সে।আবারও সে তার কাজলচোখী কে হারিয়েছে।
,
,
,
“রাহান ভাইয়া,,প্লিজ দরজাটা খুলুন।প্লিজ,প্লিজ।”
আজরাহান প্রহর কে বারান্দায় বের করে দিয়ে ভিতর থেকে থাই লাগিয়ে দেয়।প্রহর এর আওয়াজ ভিতরে আসছে না।আজরাহান প্রহর এর সব কসমেটিক্স বের করে ফ্লোরে ছড়িয়ে রেখেছে।
বারান্দার থাই খুলতেই ভিতরে আসে প্রহর।
“আপনি কি পাগল??
এমন করেন কেনো হুতুম পেঁচার মতো।অভদ্র কোথাকার।”
আজরাহান ওর চুল ধরে টান মারে।হালকা মৃদু শব্দ
করে প্রহর।
“আউচচ।”
“তোর এতো সাহস হলো কি করে আমাকে না বলে ওখানে যাওয়ার??
“গেছি তো কি হয়েছে??
আজরাহান ওর দুই হাত দিয়ে প্রহর এর দুপাশের চুল ধরে তা দিয়ে ওর গলা পেচিয়ে ধরে।প্রহর কাশতে থাকে।আজরাহান চুল ছেড়ে বিছানায় বসে।
“আর কোনাদিন যদি আমাকে না বলে কোথাও গিয়েছিস তাহলে তোর হাত পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবো।”
“আশফিক ভাইয়া একটা কুটনা।”
আজরাহান চোখ উচু করে তাকায়।
প্রহর আবার বলে–
“আপনি আমার জিনিসপত্র কেনো নামিয়েছেন??
প্রহর ফ্লোর থেকে ওর লিপস্টিক,আইশ্যাডো,কাজল ইত্যাদি উঠাতে থাকে।
“ওগুলো ওখান থেকে উঠালে একদম গিলিয়ে দেবো তোকে।”
প্রহর উঠে দাড়ায়।ভ্রু কুচকে বলে–
“কেনো??
“রান্নাঘর থেকে কেরোসিন নিয়ে আয়।”
প্রহর উজ্জল করে তার চাহনি।
“কেনো??
“প্রশ্ন করতে বলিনি।নিয়ে আয়।”
প্রহর কথা বাড়ায় না।রান্নাঘরে গিয়ে কেরোসিন নিয়ে আসে সাথে দিয়াশলাই।আজরাহান এর হাতে দিতেই তা কিছু পরিমান ছিটিয়ে দিয় প্রহর এর সাজ সরঞ্জাম এর উপর।তারপর আর কি,,একটা আগুনের ফুলকি।ব্যস!!
প্রহর চিৎকার করে বলে–
“এইটা কি করলেন??
” আজকের পর যদি এইসব রঙ চঙ মাখিস তাহলে যাত্রাপালায় দিয়ে আসবো তোকে।
লজ্জা করে না তোর নিজের স্বামি কে রেখে অন্যের জন্য সেজেগুজে বাহিরে যাস??
“তাই বলে আপনি আমার আমার সবগুলো জিনিস পুড়িয়ে দিবেন।”
কসমেটিক্স গুলো পুড়ে যাওয়াতে কেমন গুমট গন্ধ বের হতে থাকে অার সাথে ধোয়ায় আচ্ছন্ন করে পুরো ঘর।নন্দিতা দরজা খুলতেই চোখ জ্বলে উঠে ওর।প্রহর আর নন্দিতা কাশতে থাকে।
“ভাবী,প্রহর কে তোমার ঘরে নিয়ে যাও।”
নন্দিতা কোনো রকম মুখ চেপে বলে–
“দুটো মিলে কি পাগলামি শুরু করলে??
ধোয়ায় প্রহর এর চোখ থেকে পানি পড়তে থাকে।প্রচন্ড জ্বালা শুরু করে।
“তোমারা যাও এখান থেকে।
প্রহরিনী,দাড়িয়ে আছিস কেনো বের হ এখান থেকে।”
আজরাহান ওদের বের করে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ে।চোখ বন্ধ করে নেয়।পুড়ে যাওয়ার তীব্র গন্ধ ওর নাক ঝাঝাচ্ছে।কিন্তু দিব্যি সে শুইয়ে আছে।
,
,
“এইসব কেনো করলো আজরাহান?
প্রহর সব খুলে বলে।নন্দিতা মৃদুছন্দে হাসে।তার হাসি ক্ষীন।
“তুমি হাসছো??
তোমার হাদারাম দেবর আমার সব সাজুগুজুর জিনিস পুড়িয়ে ফেলেছে।কত কষ্ট করে টিফিনের টাকা জমিয়ে কিনেছিলাম।”
“ও যখন এইসব পছন্দ করে না তাহলে কেনো করিস এইসব??
“তোমার ওই হনুপাঞ্জি দেবর এর জন্য আমি মারশিয়াদ আরজান এর প্রদর্শনী টাই মিস করলাম।”
“হনুপাঞ্জি আবার কি?
“হনুমান আর শিম্পাঞ্জি র সংকর জাত।”
বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে প্রহর।
“মেয়েদের বড় অলঙ্কার তার স্বামী।আজরাহান যখন এইসব পছন্দ করে না তাহলে এইসব ব্যবহার করার কি দরকার।ও এমনি তেই তোকে ভালোবাসে।”
“ভালোবাসে না ছাই।হনুপাঞ্জি কোথাকার।
ভাবী,,ভাইয়া বুঝি তোমাকে খুব ভালোবাসে??
নন্দিতা ম্লান হাসে।
“হয়তো কখনো বাসতো।
বাদ দে এইসব।তুই বস আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে আসি।”
প্রহর নন্দিতার হাত চেপে ধরে।
একরাশ কুয়াশাচ্ছন্ন কন্ঠে বলে–
“রাহান ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে তো??
“কেনো বাসবে না তোকে ভালো।তুই যে ওর প্রহরিনী।”
প্রহর এর মুখ এক অজানা খুশিতে প্রজ্জ্বলিত হয়।
,
,
,
নিজের ঘরের সোফায় বসে বিখ্যাত ক্রাইম সিরিজ “বডি অফ প্রুফ “দেখছে মারশিয়াদ।সামনেই টেবিলে রাখা চিকেন ফ্রাই আর কোল্ড ড্রিংস।এক হালকা মৃদুমন্দ শব্দ ভেসে আসছে তার কানে।মুখে তার পৈচাশিক হাসি।দরজা দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে শিহরন।ঘামার্ত চেহারায় ভয়ের আতঙ্ক।চোখের কোন লাল।বুকের ভিতরের হৃদপিন্ডের মাদলের আওয়াজ মারশিয়াদ এর কান পর্যন্ত পৌছেছে।
মারশিয়াদ নিরুত্তাপ।চোখের মনি হালকা ঘুড়িয়ে তাকায় শিহরণ এর দিকে।ওকে দেখেই সোফায় দুহাত ছড়িয়ে দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে আবারও টিভিতে অক্ষি নিবদ্ধ করে।কঠোর কন্ঠে শিহরণ বলে–
“ইনশিরাহ কোথায়??
মারশিয়াদ নিরুত্তর।এক হাত নামিয়ে একটা চিকেন নিয়ে তাতে কামড় বসায়।
“মারশিয়াদ কথা বলছিস না কেনো??
কোথায় ওই মেয়ে??
“জানি না।”
“মিথ্যে বলবি না।বল মেয়েটা কোথায় কি করেছিস ওর সাথে??
“তোর কি আমাকে কিডন্যাপার মনে হয় নাকি রেপিষ্ট!!!
“তুই কি সেটা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।মেয়েটা কোথায় বল??
“জানি না।”
শিহরণ কে ইব্রাহিম কল করে জানায় মারশিয়াদ ইনশিরাহ কে ওর বাসায় নিয়ে এসেছে।আর শিহরণ ওর স্বভার সম্পর্কে অবগত।
শিহরণ কিছু একটা ভেবে ওয়াশরুমে যায়।ওর ধারনাই ঠিক।পুরো বাথটাবে কয়েক কেজি বরফ ঢেলে রেখেছে।আর সেখানেই হাত পা বেধে ফেলে রেখেছে ইনশিরাহ কে।মুখ বাধতে গিয়েও বাধে নি।ওর আত্নচিৎকার শুনবে বলে।
ঠান্ডায় অনেক আগেই মিইয়ে পড়েছে ইনশিরাহ।পুরো শরীর ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।শিহরণ আসার আগেই এম্বুল্যান্স কে খবর দিয়েছে।অনেক কষ্টে বরফ গলা হিম শীতল পানি থেকে বের করে ইনশিরাহ কে।পুরো বরফ খন্ডে পরিনত হয়েছে ওর দেহ।
ওকে নিয়ে বের হতেই এক পলক তাকায় মারশিয়াদ এর দিকে।তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।কোল্ড ড্রিংস টা হাতে নিয়ে বারান্দায় যায় মারশিয়াদ।সেখান থেকেই দেখে এম্বুল্যান্স দাড়ানো তার বাড়ির সামনে।অনেকদিন পর সে এমন দৃশ্য দেখেছে।এইসব তো সে অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছে।কোল্ড ড্রিংস টা এক চুমুকে শেষ করে তা ভেঙে হাতে চালিয়ে দেয়।নিজের হাতের গড়িয়ে পড়া রক্ত হালকা চেটে নেয়।নোনতা স্বাধ তার।রক্তের স্বাধ তার পরিচিত।অনেকদিন পর আবার তা আস্বাদন করার সুযোগ পেলো সে।আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে—
“আমার করতলে ভোর
তোর অমোঘ ঘোর,
আমার তৃষ্ণার্ত বুকে
তোর কাজল চোখের জল।”
চলবে,,,
(বিঃদ্রঃ নাইস,নেক্সট ছাড়া কি কোনো শব্দ নেই)