গল্পঃ #অন্তরালের_অনুরাগ
লেখনীতেঃ #নাহিদা_নীলা
#পর্বঃ ৪৫
— ‘ ভাই সাবধান, ম্যাডাম জানলে কিন্তু রাগ করবো। ‘
— ‘ তোদের ম্যাডামের আমি খেঁতাপুড়ি। এমন গরম মাল সামনে থাকলে সাবধান থাকন যায়? ‘
— ‘ কিন্তু ভাই তারপরও। ম্যাডাম বারবার কইয়া নিষেধ করছে। পরে রাইগ্গা যাইবো৷ ‘
তাদের তর্ক বির্তকের মধ্যেই গায়ে লেদারের লেডিস জ্যাকেট, ব্লু পেনসিল পেন্ট আর কেডস্ চাপিয়ে রুমে একজন প্রবেশ করলো। ছেলেগুলো তাকে দেখেই দরজা ছেড়ে জায়গা দিলো। পুরুষ মানুষের লোভাতুর দৃষ্টি বরাবরই মেয়েদের দিকে তাঁক করে থাকে৷ সেই জায়গায় যদি এমন যুবতী বয়সী রূপসী রমনী নিজের দৈহিক গঠন স্পষ্টরূপে ফুটিয়ে তোলে তবে সেই মেয়ের দিকে চোখ ফিরিয়ে রাখা সাধ্যের বাহিরে। কিন্তু তারা নিজেদের অবস্থান চিন্তা করে জোরপূর্বক চোখ নামিয়ে নিলো৷ নতুবা হিতে বিপরীত হতে পারে। মেয়েটি কয়েককদম এগিয়ে এসে নীলার সামনে দাঁড়ালো। বুকে হাত বেঁধে নিচে বসা ছেলেটির দিকে ভ্রুজোড়া কুঁচকে তাকাতেই সে ঠোঁট এলিয়ে বাঁকা হাসল। উঠে দাঁড়িয়ে আবারও একপলক নীলার শরীরে লোভাতুর নজর বুলিয়ে বলে উঠল,
— ‘ সরি সুইটহার্ট। লোভ সামলাতে পারছিলাম না। আই হোপ তুমি মাইন্ড করোনি? ‘
বলেই সে আলতো করে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে তার গাল ছুঁয়ে দিলো। তানহা মুহূর্তেই ঝটকা মেরে তার হাত সরালো৷ প্রচন্ড ক্ষেপে উঠে ঝাঁঝালো স্বরে বলল,
— ‘ ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট৷ আদারওয়াইজ আমিও নিজের লিমিট ভুলে যাব। ‘
— ‘ কুল জান, কুল। এতো হট হচ্ছো কেন? এমনিতেই ইউ আর সো হট এন্ড সে..
— ‘ স্টপ ইমরান। বাকিটা নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখো। ‘
ইমরান তানহার কথায় ঠোঁট এলিয়ে হাসল। চোখের দৃষ্টি এখনও তার তানহার শরীরের কার্ভের ভাজগুলোতে সীমাবদ্ধ। তানহা নিজের শরীরের জ্যাকেটটা আবারও ভালোভাবে দিয়ে নিলো। তারপর ইমরানের দিকে বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে তাকালো। নেহাৎ তার সাহায্য ছাড়া তানহার আর কোনো উপায় ছিল না। নতুবা এই লুচ্চা ছেলেটার সাথে হাত মেলানোর কথা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। সে নিজের ভালোবাসার জন্য এমনটা করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু ইমরান? একটা থাপ্পড়ের রেশ ধরে এতো কিছু? তাও সম্পর্কের হিসেবে সে নীলার ভাই। খালাতো হলে কি হবে? ভাই তো ভাই হয়। ছোট বোনের একটা ভুল মাফ করে দিলে কি এমন ক্ষতি হতো? কিন্তু সে করেনি। তার নিজস্ব আইনে অপমানের পরবর্তে অপমান। থাক সেসব কথা এখন ভেবে আর লাভ নেই৷ তার নিজের কাজ হাসিল হলেই হলো৷
— ‘ দেখো ইমরান, আমাদের সম্পর্কটা কেবলমাত্র পার্টনার হিসেবে৷ বিজনেস ঢিল না হলেও তেমনটাই ভাবতে পারো। সো অযথা এসব পারসোনালি নেওয়ার ট্রাই মারবে না। আমি নির্লজ্জ কেবলমাত্র সাদির জন্য। সে ব্যতিত কিন্তু কেউ আমার সাথে নির্লজ্জতা দেখাতে আসলে খুন করতেও পিছুপা হবো না। ‘
— ‘ ওকে ওকে। এতো হাইপার হচ্ছো কেন? ‘
— ‘ হাইপারের কারণ আছে বলেই হাইপার হচ্ছি। ‘
ইমরান কথার পিঠে আর কথা বলতে পারলো না৷ এইমুহূর্তে এই এটমবোমকে না ক্ষেপানোই উত্তম। এই কয়েকদিনে এই মেয়ের মেজাজ সম্পর্কে তার বেশ ভালো একটা ধারণা জন্মে গিয়েছে। তাই প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলে উঠল,
— ‘ তাহলে ঢিলের কথাতে আসা যাক। তোমার কাজটুকু আমি করে দিয়েছি। তাহলে এখন আমাকে আমার জিনিস নিয়ে যেতে দাও৷ ‘
— ‘ একদম না৷ শর্ত অনুযায়ী এখনও কাজ বাকি রয়েছে। সবটা শেষ না হলে তাকে পাবে না৷ ‘
— ‘ এটাতো ঠিক নয়। আর কতো অপেক্ষা করতে হবে? তোমার পথের কাঁটা সরিয়ে দিয়েছি। এখন আর কিসের অপেক্ষা? আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি। ‘
বলেই ইমরান নিচে ঝুঁকে নীলাকে কোলে নিতে উদ্ধত হতেই তানহা তার হাত আটকে ধরলো। ইমরান ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই সে বলে উঠল,
— ‘ আমি খারাপ ইমরান৷ এমনকি জঘন্যতম খারাপ। নতুবা তোমার এই শর্তে কখনই রাজি হতাম না। কিন্তু তাই বলে নিজের চোখের সামনে অনৈতিক কাজও হতে দিতে পারব না। নেহাৎ নিজের ভালোবাসার কাছে আটকা পরেছি। তাই বলে একটা মেয়ের সম্মান এভাবে নষ্ট হবে আর সেটা আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবো এমনটা চিন্তা করে ভুল করো না। যেটা বলেছি সেটাই হবে৷ নিজের সব রাগ ওর উপর খাটিয়ে নিও। কিন্তু তার আগে সম্পর্কের বৈধতা এনে৷ তারপর নিজের বউকে যত ইচ্ছে শাস্তি দিও। ‘
ইমরান বাঁকা হেসে উঠে দাঁড়ালো। সেও নিজের জীবনে বহুত খারাপ লোকের স্পর্শে এসেছে। কিন্তু শত্রুর এমন কোমল হৃদয় খুব কমই চোখে পরে। তার নিজের মনও কালো৷ কিন্তু এই মেয়েটার কালো হৃদয়েও যেন একটুখানি আলোর ঝলকানি। একটুখানি কোমলতা। কিন্তু সেটা কেবলমাত্র ক্ষেত্র বিশেষ। যেমনটা এখন হচ্ছে। কিন্তু নিজ ভালোবাসার কথা আসলে সে হিংস্র থেকে হিংস্র বাঘিনীর রূপ ধারণ করে।
— ‘ আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু এমনভাবে আর কতদিন? ‘
— ‘ আর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হবে না। খুব শীঘ্রই আমার সীমাহীন ভালোবাসার কাছে সে ধরা দিতে বাধ্য। ‘
কথাটুকু বলেই সে বাঁকা হাসলো। অতঃপর চোখের ইশারায় পিছনের একজনকে ইংগিত দিতেই সে এগিয়ে আসলো। পানির বোতলের মুখ খুলে সেটা নীলার উপর ঢেলে দিতেই সে চোখ পিটপিট করতে লাগল। মুহূর্তেই নাকে-মুখে পানি পরে শ্বাস আটকে যেতে নিলেই সে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। বারকয়েক শুকনো কাশি দিলো। এভাবে মুখের উপর পানি দেওয়াতে দম আটকে নীলার চোখ-মুখ লাল হয়ে গিয়েছে।
সে চোখ-মুখের পানি মুছে সামনের দিকে তাকালো। আবারও ইমরানের মুখটা চোখের পর্দায় ভেসে আসতে সে ঘৃণাভরা চাহনি নিক্ষেপ করলো। সেটা দেখে যেন ইমরান ভীষণ মজা পেল। সে ঠোঁট চোকা করে চুমু দেখাল। নীলা তৎক্ষনাৎ দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। ঘৃণা হচ্ছে তার। প্রবল পরিমাণের ঘৃণা। ইমরানকে ভাই বলে সম্বোধন করতে তার নিজেরই লজ্জা লাগছে। নতুবা ভাই হয়ে বোনের এতবড় সর্বনাশ কেউ কিভাবে করতে পারে?
কিন্তু চোখের দৃষ্টি অপরপাশে পরতেই যেন নীলা আশার আলো দেখতে পেল। চিকচিক করা চোখযুগল নিয়ে সে তানহার দিকে এগিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু হাত-পা বাঁধা থাকাতে সেটা সম্ভব হলো না। সে কান্নাভরা কন্ঠে তাকে ডেকে উঠল,
— ‘ আপু। ‘
আঁধারে ঢাকা কালো মনের মেয়েটারও যেন নীলার ডাকটা সহ্য হলো না। সে তৎক্ষনাৎ অপরপাশে মুখ ঘুরিয়ে নিলো৷
না তাকে কোনোভাবেই দুর্বল হলে চলবে না। পুরোটা জীবন তার একটাই চাওয়া থেকে গিয়েছে। আর এখন এতদূর এসে পিছিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সাদিদ ব্যতিত সে জীবিত থেকেও মৃত্যু। আর নিজের জীবনের উর্ধে কারো জীবন হতে পারে না৷ তাই সে স্বার্থপর হবে। কিন্তু বিষাদের ভিড়েও একটু মায়াতো থেকেই যায়। সে চোখের ইশারায় গার্ডদের বলল নীলার বাঁধন খোলে দিতে। তারাও দ্রুততার সহিত সেগুলো খোলে দিলো৷ ছাড়া পেয়ে নীলা দৌড়ে চলে আসতে চাইল। কিন্তু শরীর প্রচন্ড পরিমাণে দুর্বল। তাই ধীরে পায়ে এগিয়ে এসে তানহাকে শক্ত করে ঝাপটে ধরল। তানহার সাথে তার কখনোই ঐরকমভাবে সখ্যতা গড়ে উঠেনি। আসলে তানহাই সবসময় নীলার থেকে দুরত্ব বজায় রেখে চলে এসেছে। নীলাও সেটার যথাযথ কারণ সম্পর্কে অবগত। তাই ইচ্ছে পূর্বক আর কাটা গায়ে নুনের ছিটা দিতে চায়নি। কিন্তু আজ? এতগুলো পুরুষ মানুষের ভিড়ে যেন এক তানহা-ই তার নিকট শেষ ভরসা। শেষ আশ্রয়। সে কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠল,
— ‘ আপু প্লিজ আমাকে এখান থেকে নিয়ে যাও। ভাইয়া, ভাইয়া আমার সাথে অসভ্যতামী করতে চেয়েছে। আমি বাসায় যেতে চাই৷ প্লিজ আমাকে নিয়ে যাও। মা-বাবা, উনি হয়তো ভীষণ চিন্তা করছে। প্লিজ আপু…
নীলা লাগাতার ভাঙা গলায় তাকে এটা-সেটা বলে যাচ্ছে। তানহা প্রথমদিকের কথাগুলো শুনলেও শেষোক্ত বাক্যগুলো যেন তার গায়ে কাটা হয়ে বিঁধল। নীলা ট্রমাতে পরে তানহার কাছেই সাদিদকে নিয়ে কথা বলা শুরু করেছে। হুঁশে থাকলে হয়তো এমনটা বলতো না৷ তানহা রক্তিম চোখে ঝটকা মেরে তার থেকে নীলাকে আলাদা করলো। নীলা ছিটকে পরে যেতে নিলেই কোনোভাবে নিজেকে ব্যালেস্ করলো৷ আর তা দেখে রুমে অবস্থিত সবকয়টা ব্যক্তি উচ্চস্বরে হেসে উঠল। সবার মুখে হিংস্রতা আর তানহার চোখে-মুখে অগ্নিয়রূপ দেখে নীলা থমকে গেল। কিছুটা যেন অনুমান করা যাচ্ছে। কিন্তু প্রাণপণে চায়ছে যেন তার ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়।
কিন্তু আমরা যা চাই তা কি সবসময় হয়? এবারও চাওয়ার বিপরীতে হলো। তানহা রণমুর্তি ধারন করে চোখ-মুখ কুঁচকে নীলার দিকে আঙুল তুলে শাসালো,
— ‘ খবরদার যদি আর কোনোদিন তোর এই মুখে সাদির নাম শুনেছি তো। তার উপর কেবলমাত্র আমার অধিকার। আর তার নামের উপরও কেবলমাত্র এই তানহার-ই অধিকার। সো মাইন্ড ইট। ‘
নীলার মুখের চমকিত ভাব এখনও কাটেনি। সে বড় বড় চোখ নিয়েই প্রশ্ন করলো,
— ‘ এসব কি বলছো আপু? আর এমনটাই কেন বলছো? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ‘
— ‘ আহা আসছে আমার কঁচিখুকি। কিছুই বুঝো না, তাইনা? ‘
তানহা রেগে তেড়ে এসে নীলার গাল চেপে ধরল। এতোজোরে চেপে ধরেছে যে নীলার চোখ দিয়ে মুহূর্তেই পানি বেয়ে গাল গড়িয়ে পরছে। তানহার ধারালো নখগুলো বোধহয় নীলার গালে ডেবে যাবে। নীলা অশ্রুসিক্ত চোখে তানহার দিকে তাকিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাই দেখে তানহা আরও রাগে তেঁতে উঠে একহাতে তার হাত মুচড়ে ধরল। গালের চাপ আরও খানিকটা দৃঢ় করে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠল,
— ‘ এই রূপ, এই সরলতা দিয়েই আমার সাদিকে বশ করেছিস? তাইনা? ইচ্ছে তো করছে তোকে এখনই জ্যান্ত পুঁতে ফেলতে। ‘
নিজের কথাটা শেষ করে বেশ জোরেই নীলার গালটা ছাড়ল। নীলা ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠে ছলছল চোখজোড়া নিয়ে তানহার মুখপানে তাকালো। সে তানহাকে কখনও ব্যক্তি হিসেবে খারাপ মনে করেনি। বরং নিজেকে কোথাও না কোথাও তার কাছে অপরাধী মনে হতো। কিন্তু সেই তানহার আজ কি রূপ দেখছে নীলা?
— ‘ ওহ্ মাই ডিয়ার এসব কি করছো? এখনই এতো অত্যাচার করলে আমার বেলায় যে হজম করতে পারবে না। অজ্ঞান-টজ্ঞান হয়ে গেলে যে সমস্যা। ‘
ইমরান তার কুদৃষ্টিতে নীলাকে উপর নিচ পরখ করলো। নীলা আর এসব সহ্য করতে পারছে না। এদের সাথে থাকলে তার হয়তো দমবন্ধ হয়ে যাবে। তাই বাঁচার আশায় বোকার মতো এতজনের ভিড়েই পালাতে গেল। তানহার ইশারায় কেউ তাকে ধরল না। সে নিজে গিয়ে নীলার খোলা চুলগুলোতে টেনে ধরল। একমাত্র মেয়েরাই হয়তো বুঝে চুলের টানের কি পরিমাণ ব্যাথা অনুভব হয়। নীলা দুইহাতে চুল ধরে আর্তনাদ করে উঠল,
— ‘ মা। ‘
তানহার রাগ এখন সপ্তম আকাশে। তাই নীলার এমন করুন আর্তনাদও তার কানে পৌঁছাতে পারলো সে। সে আরও জোরে চুল টেনে ধরে বলল,
— ‘ কোথায় পালাবি? এতো সোজা আমার বন্দিশালা থেকে বের হওয়া? এতদিন যাবত এতো কাঠখড় পুড়িয়ে শেষে কি-না তুই পালিয়ে যেতে চাস? নো ডিয়ার। এমন ভুল একদম করবে না৷ নতুবা জীবন নামক প্রাণপাখিটা এখনই হাওয়া হয়ে যাবে। ‘
বলেই সে ডাইনিদের মতো হেসে উঠল। হাসির আওয়াজটা যেন কানে বিঁধছে। সহ্য করা কষ্ট। নীলারও সহ্য হচ্ছে না৷ চারদিকে আলো থেকেও যেন বিশ্বাসঘাতকদের আঘাতে সেখানে অন্ধকার ছেয়ে আছে। অশ্রুসিক্ত চোখের সামনে বারবার এসে খেলা করছে প্রিয়মুখগুলো। প্রিয় থেকে প্রিয়তর তার ব্যক্তিগত মানুষটার মুখশ্রীটা বারবার চোখের সামনে এসে আখিঁদ্বয় ঝাপসা করে দিয়ে যাচ্ছে। চিন্তা হচ্ছে, ভীষণ দুশ্চিন্তা। তার প্রাণপাখির যে কষ্ট হচ্ছে। সে কি বুঝতে পারছে না? তাকে কি খোঁজে বের করার চেষ্টা করছে না? কোথায় সে? তার প্রাণপাখির যে তাকে বড্ড প্রয়োজন।
_________________
গাড়ি ছুটে চলেছে তার আপন গতিতে। সাদিদের ক্ষেপা রাগ দেখে তানবীরও আর কিছু বলছে না। শুধু রাতের ঢাকাতে এপাশ থেকে ওপাশ গন্তব্যহীনভাবে ছুটে যাচ্ছে। আধো কি তাতে কোনো লাভ হচ্ছে? কিন্তু সাদিদ সেটা মানতে নারাজ। এতো রাতে রাস্তায় কাকপক্ষীও নেই৷ তারপরও হাতেগোনা যেই কয়েকটা রিক্সা এবং সিএনজি চালককে দেখছে তাদেরকেই নীলার ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তাদের খোঁজ থেকে বাস স্টপ, ট্রেন স্টেশনগুলোও বাদ পরছে না। প্রিয়তমার খোঁজে নিজের থেকে কোনোরকম ত্রুটি সাদিদ রাখতে চায় না। এমনকি নিজের সাধ্যের বাহিরে গিয়ে হলেও তার পাখিকে সে খোঁজে বের করতে চায়। কিন্তু এতো চেষ্টাও যেন বিফলের দিকে। এতো খোঁজাখুজি করেও যেন আশার আলো নেই। কেবলমাত্র নিকষ কালো অন্ধকার। সাদিদের মাথাটা বড্ড ভার হয়ে রয়েছে। সে ক্লান্ত শরীরটা সিটে এলিয়ে দিলো। নিজের সাথে ফোন-ওয়ালেট না থাকাতে তানবীরের মোবাইল-ই একমাত্র ভরসা। সেটা দিয়েই এতক্ষণ সবার কাছে নীলার খোঁজ করে গিয়েছে। সাদিদ ফোনটা নিজের সামনে ধরল। ফোনের দুরত্ব একেবারে মুখ ছুঁইছুঁই অবস্থা। চোখের সামনে তাদের দার্জিলিং ভ্রমণের কিছু ছবি। নীলার শান্ত-শিষ্ট, বাচ্চামো মুখটা দেখেই সাদিদ ফিক করে হেসে ফেলল। কি চঞ্চলতা না দেখিয়েছিল মেয়েটা। বাচ্চাদের মতো দৌড়াদৌড়ি-লাফালাফি কোনোটাই বাদ দেয়নি। সুখের সুন্দর স্মৃতিগুলো সাদিদের চোখের পর্দায় জ্বলজ্বল করছে। ঠোঁটের কোণে তার ঈষৎ মলিন হাসি। সব যেন বাস্তব। তানবীর ডাইভ করা অবস্থায়-ই আড়চোখে সাদিদের দিকে তাকালো। ফোনের দিকে এরকমভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তার আর বুঝতে অসুবিধা হলো না সাদিদ এই মুহূর্তে কি করছে। তাই সে আবারও নিজের কাজে মনোযোগী হলো।
সাদিদ কয়েকপলক নিষ্পলক দৃষ্টিতে প্রিয়তমার মুখশ্রীতে নজর বুলিয়ে সন্তপর্ণে ছবির পর্দায় চুমু খেল। অনুভূতিটা তার বড্ড প্রখর। যেন সে তার প্রিয়তমাকে কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কৃপায় নয়, বরং স্বয়ং নিজে বাস্তবিকভাবেই প্রাণপাখির ললাটে চুম্বন আঁকছে। দীর্ঘ চুমু খেয়ে সে ফোনের উপর থেকে অধরযুগল সরিয়ে আনলো। আঁখিদ্বয় বন্ধ করে ফোনটা বুকে চেপে ধরল। গাড়ির ভিতরে সম্পূর্ণ নীরবতা। তানবীর অনেকক্ষণ যাবত কিছু একটা ভাবছিলো। কিন্তু সাদিদ কেমন রিয়েক্ট করবে সেই ভেবে আর বলা হচ্ছে না। কিন্তু এবার খানিকটা গলা কেশে সে বলেই উঠল,
— ‘ দোস্ত একটা কথা কইতাম। ‘
সাদিদ চোখ বন্ধ রেখেই উত্তর জানালো,
— ‘ বল। ‘
— ‘ আসলে.. না মানে এভাবে আর কতক্ষণ? আর সবচেয়ে বড় কথা দিকশূন্য হয়ে এভাবে খোঁজলেই যে নীলাকে পেয়ে যাবি এমনটাও কিন্তু নয়। তাই বলছিলাম কি…
— ‘ এতো ভণিতা না করে কি বলার সরাসরি বল। নতুবা চুপ থাক। ‘
— ‘ ধ্যাত রাগস ক্যান? তোর এই রাগের জন্যই এতোক্ষণ ধইরা কইতে পারতাছি না। ‘
— ‘ মাথা খাইলে লাথি দিয়া জানালার বাহিরে ফালামু। ‘
— ‘ ওকে ভাই বলতাসি। আমার মনে হয় এবার আমাদের পুলিশের সহযোগিতা প্রয়োজন। ‘
সাদিদের কর্ণকোহরে কথাটা পৌঁছাতেই সে চোখ খুলে তাকালো। সে যে এমনটা চিন্তা করেনি বা তার মাথায় যে এই বিষয়টা আসেনি তেমনটা নয়। কিন্তু কিছু কারণবশত সে এখনও আইনের সান্নিধ্যে যায়নি। সাদিদকে চুপ করে থাকতে দেখে তানবীর আবারও অধৈর্য্য গলায় বলে উঠল,
— ‘ কিছুতো বল। এভাবে আর…
— ‘ নীলাঞ্জনার পরিবারের সাথে এই নিয়ে কথা বলতে হবে। কেননা সে আমার স্ত্রী হলেও সমাজের চোখে এখনও শুধুমাত্র বাগদত্তা। সেক্ষেত্রে নীলার উপর আমার থেকে তাদের অধিকার-ই বেশি। তাই আইনি কোনো প্রধ্যেক্ষেপ নিতে হলে তাদের সাথে কথা বলা অনিবার্য। আর বিষয়টা এইক্ষেত্রে অন্যরকম। তাই আমি চাই না আবারও কেউ নীলাঞ্জনাকে নিয়ে বাজে কথা বলুক। ‘
— ‘ হ্যাঁ আমিও সেটাই ভাবছিলাম। কিন্তু সিদ্ধান্ত যে একটা নিতেই হবে। ‘
সাদিদ আর প্রতিউত্তর করলো না। মনের কুঠিতে প্রিয়তমাকে উদ্দেশ্য করে কটু কথাগুলো আবারও উঁকি দিচ্ছে। যেগুলো সহ্য করা সম্ভব নয়। কিন্তু ব্যক্তিগণে সে নিরুপায়। সাদিদ বুকের বাম পাশে হাত রাখল। হৃদপিণ্ডটা অস্বাভাবিক গতিতে চলছে। সুক্ষ্ম চিনচিনে অসহ্যকর একটা ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। এটা বোধহয় ততক্ষণ দূর হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত পাখিটা তার বুকে মাথা রাখবে। শক্ত করে প্রিয়তমার ছোট্ট মাথাটা নিজ বুকে চেপে ধরা অব্দি এই ব্যাথা দূর হবার নয়৷
#চলবে…