অন্তহীন💜 পর্ব-৩০

0
1859

#অন্তহীন💜
#পর্ব_৩০
#স্নিগ্ধা_আফরিন

রজনীর অমা পুরোপুরি কাটেনি এখনো।মেদিনী মৃদু আভায় আলোকিত। হিমেল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে নিস্তব্ধ পরিবেশে। পূর্ব দিগন্তের অম্বর লালচে প্রভায় বিভাসিত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।তপ্ত আদিত্যের উদয় হবে জানান দিচ্ছে প্রকৃতি।গ্রাম্য এলাকা! খুব ভোরে জেগে উঠা পাখিদের কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত চার পাশ। দূরে কোথাও থেকে মোরগের ডাক ভেসে আসছে।স্পষ্ঠ শুনতে পেল চৈতি। ঘুমন্ত মানবের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে গলার কাছটায়। বেসামাল চুল গুলো বালিশের উপর এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। পুরুষালি শক্ত হস্তদ্বয়ের মধ্যে আবদ্ধ কিশোরীর কোমল দেহ। চৈতি নড়েচড়ে উঠলো। ঘুমের মধ্যেই ভ্রু যুগল কুঁচকে ফেললো প্রহন। বাঁধন আলগা করে ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো,”এত নড়াচড়া করছো কেন?”চৈতি শোয়া থেকে উঠে বসলো। খোলা চুল গুলো কে হাত খোঁপা করতে করতে বললো,”সকাল হলো যে। নামাজ পড়বেন না?”
প্রহন উত্তর দিলো না। প্রত্ত্যর না পেয়ে পাশ ফিরে তাকায় চৈতি। ঘুমিয়ে পড়েছে প্রহন। চৈতি বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো। ভাঁজে ভাঁজে থাকা শাড়িটা কুঁচকে গেছে।টান টান করে শাড়ি ঠিক করে জানলা মেলে দিলো। জানলা খুলতেই হিম শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিলো চৈতির গা।পরম শান্তিতে নেত্র পল্লব বুজে ফেললো। বাইরে আবছা আলো বিরাজ মান। ফজরের নামাজের সময় এখনো শেষ হয়নি।একটু পরেই শেষ হয়ে যাবে। চৈতি আবারো প্রহনের কাছে এগিয়ে যায়। কাঁধে হাত রেখে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকে,”শুনছেন? উঠুন না। ফজরের নামাজ এর সময় পার হয়ে যাচ্ছে।”
প্রহন ঘুমের মধ্যেই উঠে বসে। চৈতি ওয়াস রুমে যেতে যেতে বলে,”তাড়াতাড়ি উঠে অযু করে আমার রুমেই নামাজ পড়ে নিন। মসজিদে যাওয়ার সময় নেই।”
দুই হাত দিয়ে চোখ কচলিয়ে দৃষ্টি পরিষ্কার করে। লম্বা হাই তুলে বালিশের পাশ থেকে মোবাইল নিয়ে সময় দেখে চট করে উঠে দাঁড়ায়। চৈতি দ্রুত অযু করে বের হতে বলে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। শহরের মতন কোনো গাড়ি দেখতে পেল না। শহরের হিজিবিজি, গাড়ির হর্নে, মানুষের কোলাহল নেই। উঁচু উঁচু অট্টালিকা ও নেই। বাইরে দৃষ্টি দিলেই শুধু সবুজ আর সবুজ। সুন্দর অনুভূতি।ওয়াস রুমের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে প্রকৃতির চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসে প্রহন। চৈতি কে পাশ কাটিয়ে দ্রুত ওয়াসরুমে চলে যায়। প্রহন অযু করে বের হতে হতে চৈতি নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। প্রহন বের হলে দুই জন এক সাথে নামাজ আদায় করে নেয়। ফজরের নামাজের মধ্যে দিয়ে সুন্দর একটা দিনের শুরু করে এক জোড়া দম্পতি।

সরদার সাহেব বেলকনিতে রাখা আরাম কেদারায় বসে চোখ বন্ধ করে তসবিহ পড়ছেন।রাতে ঠিকমতো ঘুমটা হয়নি তার।জুনাইদা বিছানা গুছিয়ে সরদার সাহেবের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন। শান্ত কন্ঠে বললেন,”চা খাবেন?এক কাপ বানিয়ে এনে দিবো?”
সরদার সাহেব ডানে বায়ে মাথা নাড়িয়ে ‘না’ জানালেন।
তা দেখে জুনাইদা বললেন,”আপনার তো চা ছাড়া সকাল শুরু করতেই ভালো লাগে না। তাহলে আজ!”কথা টা বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন জুনাইদা। হয়তো কিছু চিন্তা করার চেষ্টা করলেন। তার পর আবার বললেন,”আপনি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত?”
সরদার সাহেব চোখ মেলে জুনাইদার দিকে তাকালেন। চিন্তিত তো তিনি সত্যি। কিন্তু তা জুনাইদা কে বলা যাবে না।দেখা যাবে সেই বিষয় নিয়ে চিন্তা করতে করতে প্যাশার বাড়িয়ে অসুস্থ হয়ে পড়বে।কী দরকার?এত ঝামেলা পোহানোর। তার চেয়ে বরং এটাই ভালো নিজের চিন্তা নিজের কাছেই থাক।
সরদার সাহেব কথা না বাড়িয়ে বললেন,”চৈতিরা আজ চলে যাবে। সকাল ১০টায়। ওদের জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করো। আমার আজ চা লাগবে না।”

“সেকি কথা! মাত্র গতকাল আসলো মেয়েটা আর আজই চলে যাবে?এটা কেমন দেখায় বলুন তো।”

“দেখো জুনাইদা, মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। আমরা চাইলেও ওকে আমাদের কাছে রাখতে পারবো না।আর তুমি তো জানোই রিফাতের কথা।ও যে গ্রামে আছে।”

সরদার সাহেবের শেষের কথা টুকু শুনে বুঝতে অসুবিধা হলো না জুনাইদার। এই নিয়েই যে তার স্বামী চিন্তিত। তিনি আর কী বলবেন?বাবা হয়ে মেয়ের ভালোটাই যে চান তা তো আর নতুন কিছু নয়।জুনাইদা চলে গেলেন।
মেয়ের পছন্দের নাস্তা বানাতে হবে যে। আবার কখন মেয়েকে নিজের হাতের বানানো খাবার খাওয়াতে পারবেন জানা নেই।
.
ঘড়ির কাঁটায় তখন সকাল ৮টা। চৈতিদের বাড়ির কিছুটা সামনে রফিক মিয়ার টং এর দোকান। এলাকার মুরব্বিদের অনেকেই অবসরে সেখানে বসে চা, সিগারেট খান এবং ঠান্ডা দেন। কিন্তু আজ সকাল থেকেই সেই টং এর দোকান দখল করে রেখেছে রিফাতের ছ্যালারা। চৈতিদের বাড়ির আশেপাশে ও ঘুর ঘুর করছে কয়েক জন। রেদোয়ান চৌধুরী কে সাথে নিয়ে রফিক মিয়ার হাতের দারুন এক চা খেতে যেতে চেয়েছিলেন সরদার সাহেব। মাথা থেকে রিফাতের চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আবার আগের মত স্বাভাবিক হতে চেয়ে ও এক ঝাঁক চিন্তায় আটকে পড়লেন বাড়ির বাইরে এসে।
রফিক মিয়ার দোকানের বেঞ্চে বসে থাকা সেদিন কার সেই ছেলে টা যে রিফাতের হাতে থাপ্পড় খেয়েছিল মাঠে,নাইম বললো,”আসসালামুয়ালাইকুম চাচা। ভাইয়ের হবু শ্বশুর বলে সালাম দিলাম। ভাবী কে শ্বশুড় বাড়ি থেকে নিয়ে এসে ভালোই করছেন। ভাইয়ের একটা সুযোগ হলো।”
নাইমের কথা শুনে রাগ হচ্ছে সরদার সাহেবের। কিন্তু তিনি রাগারাগী করতে চান না।তাই তাদের পাশ কাটিয়ে চলে আসার সময়,পেছন থেকে কেউ একজন বলে উঠলো,”ও হবু শ্বশুড় আব্বা। আপনার মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিয়ে দেন। হোক না বাসি তাতে কিচ্ছু হবে না।”
সরদার সাহেব পেছনে ফিরে দেখেন রিফাত দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে চোখে মুখে শয়তানি হাসি ফুটিয়ে কোমরে হাত রেখে সরদার সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে। ধীরে ধীরে সরদার সাহেবের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বললো,”কী দিবেন না বিয়ে?”
সরদার সাহেব দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,”তোর লজ্জা করে না? আমাকে এই কথা বলতে? আমার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। তোর কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য আমি ওকে না চাইতেও বিয়ে দিয়েছি।”
ঠোঁট কামড়ে হাসে রিফাত।গাল ঘুরিয়ে ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল দিয়ে বা গালে চুলকাতে চুলকাতে বলে,”তাহলে একদিনের জন্য আমাকে দিয়ে দিন।”
রিফাত মুখটা সরদার সাহেবের মুখের কাছে নিয়ে গিয়ে বলে,”খেয়ে ছেড়ে দিবো প্রমিস।”
ঠাস ঠাস করে দুটো থাপ্পর পড়ে রিফাতের দুই গালে। সরদার সাহেব পায়ের জুতা খুলে হাতে নিয়ে রিফাত এর কাঁধে এক বারি দিয়ে রাগান্বিত কন্ঠে বলেন,”কুত্তার বাচ্চা। তোর এত বড় সাহস আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার মেয়েকে নিয়ে এতো বাজে কথা বলিস।তোরে আমি জেলের ভাত খাওয়াবো।”
রিফাতের চোখ থেকে আগুন বের হচ্ছে যেন।ক্রোদে চোখ লাল হয়ে আছে।এক দৃষ্টিতে সরদার সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট আবার হাসি। কাঁধের কাছের শার্টের উপর জুতার বারির ছাপ টা স্পষ্ঠ। সরদার সাহেবের কাছে এক পা এগিয়ে এসে বলে,”জেলের ভাত খাওয়ার অভ্যাস আমার আছে। কিন্তু আজকের এই দুই টা থাপ্পড় আর জুতার বাড়ি বারিটা খাইতে আমার একদম ভালা লাগে নাই।আর যা আমার ভালা লাগে না তা আমি উপড়ে ফালাই দি। আজকের কামডা আমনে ভালা করেন নাই সরদার। একদম ভালা করেন নাই।”
রিফাত রাগে ক্ষোভে ফুঁসতে ফুঁসতে সেখান থেকে চলে গেল। সরদার সাহেব মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। চিৎকার করে কান্না করতে মন চাচ্ছে তার। কোন অভিশাপের কারনে রিফাতের মতো বাজে গুন্ডা একটা ছেলের চোখ পড়লো তার মেয়ের উপর। মাটিতে বসে চিৎকার করে আল্লাহ কে ডেকে কান্না করতে চাচ্ছেন তিনি। কিন্তু পারবেন না।কারন তিনি একজন পুরুষ। একজন বাবা, একজন স্বামী।আর একজন বাবা কে সব পরিস্থিতি তে শক্ত থাকতে হয়।এক জন পুরুষ হলে সবার সামনে চিৎকার করে কান্না করা যায় না।যতই কষ্ট হোক না কেন? তা একান্তই নিজের মধ্যে লুকিয়ে রাখতে হয়। চোখের পানি টা লুকাতে হয় লোক চক্ষুর আড়ালে। সরদার সাহেব কিছুটা বুঝতে পারছেন এর পরবর্তী সময়টা ভালো যাবে না। নিশ্চিন্তে কাটাতে পারবেন না। ঘুমাতে পারবেন না অনেক রাত। সরদার সাহেব হাঁটতে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে চায়, রেদোয়ান চৌধুরী ধরে ফেলেন।অভয় দিয়ে বলেন,”কিচ্ছু করতে পারবে এই ছেলে। আপনি এত চিন্তা করিয়েন না ভাই। আল্লাহ ভরসা। খারাপ এর জয় কখনো হয়নি, হচ্ছে না আর ভবিষ্যতে ও হবে না। ইনশাআল্লাহ।”

সরদার সাহেব এর বাড়িতে খিলখিল করে হেসে, দৌড়ে বেড়াচ্ছে তার আদরের মেয়ে চৈতি। মায়ের সাথে লুকোচুরি খেলতে গিয়ে যে চুলার আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে শাড়ির আঁচলটা আদতেও আঁচ করতে পারছে না কিশোরী।

#চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here