অন্তহীন💜 পর্ব-৩১

0
1997

#অন্তহীন💜
#পর্ব_৩১
#স্নিগ্ধা_আফরিন

উনুন থেকে অনল দহনে পুড়তে পুড়তে শাড়ির আঁচল খানি কাঁধ ছুঁতে আসবে তখনই তাপ অনুভব করে হাসি মুখে পাশ ফিরে তাকাতেই ভয়ে চুপসে যায় চৈতি।হাসি খুশি মুখটা হঠাৎ করেই ফ্যাকাশে হয়ে যায়।ভয়ে গলা দিয়ে কোনো শব্দ আসছে না। প্রহন সেই সময় চৈতি কে খুঁজতে খুঁজতে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে আসে। ভেতরে ঢুকে সামনে তাকাতেই আঁতকে চিৎকার করে উঠলো।”চৈতি”
দ্রুত চৈতির কাছে গিয়ে জগের পানি ঢেলে দেয় চৈতির গায়ে। আগুন নিভে যায়। কিন্তু আগুনের আঁচ কাঁধের দিকে লাগায় সেখান টা লাল হয়ে গেল।প্রহনের চিৎকার শুনে দৌড়ে আসেন বাড়ির সবাই। আগুন নেভানোর পর চৈতি ক্লান্তি মাখা দৃষ্টিতে এক পলক প্রহনের মুখের দিকে তাকিয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে যেতে প্রহন চৈতির কোমর জড়িয়ে ধরে আগলে নিল। বাড়ির সবাই রীতিমত ভয় পেয়ে গেছেন। চৈতি কে পাঁজা কোলে তুলে রুমে নিয়ে গেল প্রহন। পেছনে পেছনে সবাই গেল। জুনাইদা তো এক প্রকার কান্না কাটি শুরু করে দিয়েছেন। সরদার সাহেব বাড়ি ফিরেছেন কিনা দেখতে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে ছিলেন তিনি।কে জানতো সেই সময় এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে যাবে। চৈতি কে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিলো।বেশ কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরে আসে চৈতির। মিসেস ইয়াসমিন এবং জুনাইদা সৃষ্টিকর্তার দরবারে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করে।জুনাইদা চৈতির কপালে চুমু দিয়ে বললো,”এমন অঘটন কী করে ঘটতে যাচ্ছিলো চৈতি?”
চৈতির চোখে মুখে এখনো ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। নিজের গায়ে আগুন জ্বলতে দেখলে যে কেউই ভয় পেয়ে যাবে। প্রহন চৈতির মুখের দিকে তাকিয়ে জুনাইদির উদ্দেশ্যে বললো,”আম্মু এখন এই সব কথা আর বলিয়েন না। চৈতি ভয় পেয়ে আছে।বাদ দেন।”
জুনাইদা ও আর কিছু বললেন না।নিচ থেকে সরদার সাহেবের ডাক শুনতে পেলেন।জুনাইদার নাম ধরে ডাকছেন তিনি।সচারচর এমন নাম ধরে ডাকেন না।জুনাইদা চৈতির রুম থেকে বেরিয়ে গেল সরদার সাহেব এর কাছে।
কাঁধের আঁচ লেগে যাওয়া অংশটায় জ্বালা অনুভব করলো চৈতি।জুনাইদার পিছু পিছু ততক্ষণে সবাই বের হয়ে গেছে শুধু প্রহন ছাড়া। চৈতি প্রহনের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,”কাঁধের অংশটায় জ্বলছে।প্রতি উত্তরে প্রহন রেগে গিয়ে বললো,”একটা থাপ্পড় দিবো মেয়ে তোমাকে।এত বেখায়ালি মানুষ হয়? আমি যদি আজ না যেতাম তোমার কী হতো বলো তো? আমি কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জানো তুমি?এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল আমার নিজের কলিজায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ।”
এমনিতেই কত্ত বড় একটা বিপদ থেকে রক্ষা পেল চৈতি।ভয়ে তো তার নিজের জীবনটাই শেষ। তার উপর প্রহনের এমন রাগান্বিত কথায় অভিমানীটার অভিমান গাঢ় হলো আকাশ চুম্বি।
প্রহন চৈতির মুখোমুখি বসলো। চৈতি মুখ ফিরিয়ে নিলো অন্য দিকে। প্রহন গম্ভীর কণ্ঠে বললো,”পোড়া জায়গায় মলম লাগানোর জন্য কোনো মলম আছে?”
প্রত্ত্যর করলো না চৈতি।চুপ করে বসে রইলো। প্রহন আবারো জিজ্ঞেস করলো। উত্তর পেল না। চৈতির এক রোখা জেদ।হাল ছেড়ে দিয়ে প্রহন রুম থেকে বেরিয়ে যায়। প্রহনের চলে যাওয়ার দিকে এক নজরে চেয়ে থাকে চৈতি। মুখ ভেংচি দিয়ে বললো,”পুড়ে মরে গেলেই পারতাম।এত বকা শুনতে হতো না।”

গুরুগম্ভীর মুখ করে মেঝের দিকে তাকিয়ে বিছানায় বসে আছে সরদার সাহেব।তার পাশেই জুনাইদা শাড়ির আঁচল দিয়ে শুধু চোখের পানি মুছছেন। বিরক্ত নিয়ে জুনাইদার দিকে তাকালেন সরদার সাহেব। রাশ ভারি বিরক্ত মাখা গলায় বললেন,”উফফফ জুনাইদা। তোমরা কিছু কিছু মেয়ে এত ছিঁচকাদুনে হও কেন বুঝিনা। এই জন্যই তোমাকে সিরিয়াস কিছু বলি না আমি।”
সরদার সাহেব এর কথা শুনে তেতে উঠলেন জুনাইদা।
“আমার মেয়েকে নিয়ে এমন সব কথা শুনলে আমার কষ্ট হবে না?কোথা কার কোন গুন্ডা আমার মেয়েকে নিয়ে এত নিচু কথা কী করে বলতে পারলো? মেয়েটার ভবিষ্যতে কি আছে তা ভাবতেই তো আমার কষ্ট হচ্ছে। তার উপর জানেন আজ কে কী হয়েছে?”

সরদার সাহেব সন্দিহান দৃষ্টিতে জুনাইদার দিকে তাকিয়ে বললেন,”কী হয়েছে?”

“কিছুক্ষণ আগেই চৈতির গায়ে আগুন লেগে গিয়েছিল। শাড়ির আঁচল থেকে আগুন ছড়িয়ে পড়তে পড়তে পড়েনি। প্রহন দেখে তাড়াতাড়ি পানি ঢেলে নিভিয়ে দেয়।”

জুনাইদার মুখে এহেন কথা শুনে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন সরদার সাহেব।এত চিন্তা তিনি নিতে পারছেন না।জুনাইদার দিকে তাকিয়ে বললেন,”এই কথা তুমি আমাকে আগে বলো নাই কেন? এখন বলতে আসছো। বেয়াক্কেল মহিলা।”
জুনাইদার উত্তর শোনার আগেই রুম থেকে হনহন করে হেঁটে বেরিয়ে যান সরদার সাহেব। উদ্দেশ্যে চৈতির রুম।
চৈতির রুমের দরজা খোলাই ছিল। সরদার সাহেব সোজা ডুকে গেলেন।প্রত্যাক বারের মতো নক করলেন না। চৈতির পরনে সেই সময় ও সেই পুড়ে যাওয়া শাড়িটাই আছে।মন খারাপ করে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ছিল মেয়েটা। সরদার সাহেব দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বললেন,”এমন টা কী করে হলো আম্মা? তুই কি একটু খেয়াল করিস নি রান্না ঘরে?”
বাবাকে সামনে পেয়ে জড়িয়ে ধরলো চৈতি। চোখ ভিজে গেছে পানিতে।এখনি হয়তো বর্ষণ হবে। কান্না ভেজা কন্ঠে বললো,”আমি তো মায়ের সাথে লুকোচুরি খেলছিলাম। মজা করতে ছিলাম সবার সাথে। রান্না ঘরে কখন যে শাড়ির আঁচল বেয়ে আগুন জ্বলতে লাগলো বুঝতে পারিনি।”
সরদার সাহেব পরম মমতায় মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। মেয়ের দোষ দিয়ে লাভ নেই। বাস্তবতার বিষয়ে ও তার মেয়ে অনেক টাই কম জ্ঞানি।সব দিক সামলে নেওয়ার বয়স হয়নি এখনও।
এই মেয়েকে নিয়ে যত চিন্তা তার। এই মেয়েকে নিরাপদে সুখে রাখার জন্য কত ত্যাগ স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি।
অথচ সেই মেয়ের শুধু বিপদ।
.
আগুনের আঁচ লেগে যাওয়া জায়গায় মলম লাগাতেই মৃদু কেঁপে উঠছে চৈতি। আঙুলের ডগায় মলম নিয়ে আলতো করে লাগিয়ে দিচ্ছে প্রহন। এই মলম না লাগানোর জন্য কত দ্বিধা চৈতির।তাকে থাপ্পড় দিবে বলেছে প্রহন।সে তো লাগাবেই না। প্রহন যে তখন বেরিয়ে গেল আসলে সে ফার্মেসি থেকে পোড়ার মলম আনতে গিয়েছিল।
অনেক জোর জবরদস্তি করে চৈতির কাঁধে মলম লাগাতে সক্ষম হলো সে। প্রথমে রাজি না হলেও যখন প্রহন মলম লাগিয়ে দেয় তখন আরামে চোখ বুজে ফেলে চৈতি।ঠান্ডা মলমের ছোঁয়ায় এক অন্যরকম শান্তি লাগলো তার।

আরাম কেদারায় বসে বসে বাইরের পরিবেশ দেখছেন সরদার সাহেব। দেখছেন বললে ভুল হবে। তার দৃষ্টি সে দিকে কিন্তু মন ধ্যান সব অন্য দিকে। চৈতি কে নিয়ে এত চিন্তা তার মাথায় ধরছে না আর।যে দিন থেকে রিফাতের নজর চৈতির দিকে পড়েছে সে দিন থেকেই সরদার সাহেবের চিন্তা এক ধাপ এক ধাপ করে বারতে চলেছে। মেয়েকে বিয়ে দিয়ে ও সেই চিন্তা থেকে মুক্তি পেলেন না তিনি।

দুপুরে খাবার টেবিলে বসে সবাইকে জানিয়ে দিয়ে ছিলেন চৈতিরা বিকেলেই বাড়ি ফিরে যাবে। এই দিকে প্রহন আর কত মিথ্যে কথা বলে ছুটি নিবে?

বাবার কথা শুনে মন খারাপ হয়ে যায় চৈতির।সবে তো গতকাল এসেছিল বাড়িতে। তাহলে আজই কেন চলে যেতে যেতে হবে? অদ্ভুত!
বিছানায় বসে বসে মোবাইলে কিছু একটা করছিল প্রহন। চৈতি কে গাল ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখে বললো,”তোমার আব্বু নিজেই তাড়া দিয়ে আমাদের বেড়াতে আনলেন আবার নিজেই তাড়া দিয়ে চলে যেতে বলছেন। তোমার বাবার মাথা ঠিক আছে তো?”

চৈতি চোখ ছোট ছোট করে বললো,”আপনি আমার আব্বু কে মানুষিক রোগী বলতে চাচ্ছেন?”

“ছিঃ ছিঃ,তওবা তওবা। আমার এত সুন্দর একটা শ্বশুড় মশাই কে মানুষিক রোগী কেন বলতে যাবো?”

“তাহলে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমার আব্বুর মাথা ঠিক আছে কিনা?”

প্রহন মাথা চুলকিয়ে আস্তে করে বললো,”ওটা তো কথার কথা।”

যোগ বিয়োগ এর হিসাব মিলছে না সরদার সাহেবের। তিনি ভাবলেন, একা একাই চিন্তা করলেন রিফাত কে নিয়ে চৈতির ব্যপারটা প্রহন কে জানানো উচিত।

#চলবে,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here