অপেক্ষা পর্ব ০৯+১০
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ
০৯.
তিন চারদিন রক্তিম তার বন্ধু আর কাজিনদের সাথে ঘুরে কাটিয়ে দেয়। রিধিকে যেতে বলেছিল সাথে, কিন্তু পড়াশুনার বাহানা দিয়ে সে যায় নি। এই তিন চারদিন সে অনেক পড়েছে। সামনে যেহেতু টেস্ট এক্সাম পড়তে তো হবেই। তারা সবাই মিলে প্ল্যান করেছে টেস্টের পর তারা গ্রুপ স্টাডি করবে, কাছাকাছি বাসা যাদের আছে তারাই শুধু। তাদের সাত জনের এই গ্রুপ হয় যাদের বাসা কাছাকাছি। এর মধ্যে চারজন মেয়ে, বাকী তিনজন ছেলে। দিয়া, রিধির সাথে আনিকা, বিথীও আছে, তারা একই কলেজের। আর ছেলেদের মধ্যে ইফতি, শাহেদ ও আদি। তারা সবাই ভিন্ন ভিন্ন কলেজের। তবে তারা সবাই অনেক ভালো বন্ধু। তাদের সবার পরিবারের মধ্যেও ভালো সম্পর্ক আছে, তাই তাদের বাবা-মারাও রাজি হয়ে যায়। এতে যদি সন্তানদের পড়াশুনা হয় ঠিকমতো তাহলে ক্ষতি কি? কিন্তু রক্তিমের বিষয়টা পছন্দ হয় নি। গ্রুপ স্টাডি করছে ভালো কথা মেয়েরা আর ছেলেরা আলাদা করলেও তো পারতো! একসাথে করার কি দরকার?
রক্তিম তাই বাবা-মা কে বলল,
রক্তিম: বাবা, আমার মনে হয় না ছেলেদের কে নিয়ে গ্রুপ স্টাডি করার দরকার আছে?
জুনাইয়েত: শাহেদ আর আদি পড়াশুনায় অনেক ভালো। সাথে ইফতিও ভালো কলেজের ছাত্র। রিধির অনেক সাহায্য হবে।
রক্তিম: বাবা, আমিও তো আছি। আমি না হয় রিধিকে পড়াবো।
জুনাইয়েত : তা তুই তো আছিস আমিও জানি। তুই ও পড়াবি, গ্রুপ স্টাডিও করবে।
নবনী: রক্তিম, তোর সময়ও তো করেছিলি তুই। রিধিকে মানা করছিস কেন?
রক্তিম: মা, আজকালকার ছেলেরা কতো খারাপ মন-মানসিকতার হয় তুমি জানো না হয়তো।
রিধি আড়ালে দাঁড়িয়ে এসব শুনছে আর মনে মনে রক্তিমের চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করছে।
নবনী: রক্তিম, আমি জানি তুই রিধির কথা ভেবে বলছিস। কিন্তু শাহেদ আর আদির পরিবার অনেক ভালো। ছেলে দুইটা অনেক ভদ্রও। আর ইফতি তো চোখ তুলে কারো সাথে কথাও বলে না।
রক্তিম: মা তুমি বুঝতে পারছো না। আজকাল সবাই ভালো সেজেই ক্ষতি করে।
রিধি এবার সামনে এসে বলল,
রিধি: সবাইকে নিজের মতো না ভাবাই ভালো। আর আমি কি একা একা পড়ছি? আরো তিনজন মেয়েও আছে।
রক্তিম: রিধি তোমার এই বিষয়ে কথা বলার দরকার নেই। তুমি যাও।
রিধি: আচ্ছা? তাহলে আপনারো আমার বিষয়ে কথা বলার দরকার নেই। বাবা-মা সবসময় আমার জন্য ভালো কিছুই চিন্তা করেন। আপনার মতো আমাকে অনাথ বলেন না।
রিধি কথাটি বলেই চলে গেল।
রিধির কথা শুনে রক্তিম আর কিছুই বলতে পারলো না। জুনাইয়েত আর নবনীও খুব কষ্ট পেয়েছেন রিধির কথা শুনে। জুনাইয়েত সাহেব উঠে তার রুমে চলে যায়।
নবনী রিধির রুমের সামনে যায়। কিন্তু রিধি দরজা বন্ধ করে দেয়, তাই আর ঢুকতে পারেন নি। অনেকক্ষন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রিধিকে ডাকার সাহস হচ্ছে না। গলায় কি যেন আটকে আছে মনে হচ্ছে। জন্ম দেন নি তো কি হয়েছে, রিধিকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসেন তিনি। রিধি নিজেকে অনাথ বলেছে মানে, রিধি তাকে মা মনে করে না? তিনি রিধির মা হতে পারেন নি? নিজেকে ব্যর্থ মা মনে করছেন এখন।
জুনাইয়েত সাহেবের মনে কষ্ট চেপে বসে। রিধি কীভাবে বলল নিজেকে অনাথ? সে কি এতোদিন নিজেকে অনাথ ভেবে আসছে তাহলে?
নবনীকে দেখে তিনি স্ত্রীর হাত ধরে বললেন,
জুনাইয়েত: আমাদের কি কোনো ভুল হয়েছে নবনী? আমাদের মেয়ে আমাদেরকে কি পর ভাবছে? নবনী, রিধিতো আমাদেরই মেয়ে তাই না? আমরা কি তার ভালোবাসায়, তার ইচ্ছায় কি কোনো অপূর্ণ রেখেছিলাম? এতোবছরেও কি তার আসল বাবা-মার জায়গা নিতে পারলাম না আমরা? হেরে গেলাম নবনী, হেরে গেলাম। বাবা-মা হওয়ার জন্য কি রক্তের সম্পর্ক লাগে?
নবনী: তুমি শান্ত হও। আমরা অনেক ভালোবাসি আমাদের মেয়েকে। আমি জানি রিধিও আমাদের অনেক ভালোবাসে।। আর ও আমাদের ছেড়ে কখনো যাবে না। দেখে নিও। রিধিকে জন্ম দেয়নি, কিন্তু ওর মুখে মা ডাক শুনছি আমিই। আমাকেই সে মা ডাকে। এই অধিকার আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। কেউ কেঁড়ে নিবে না আমাদের রিধিকে।
জুনাইয়েত: আজকের পর রিধি যা বলবে তাই হবে। ওর মনে আর আসতেই দেবো না যে সে অনাথ। রিধি আমার মেয়ে, আমাদের মেয়ে।
রক্তিম চোখ বন্ধ করে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তার কি কোনো অধিকার নেই রিধির উপর! রক্তিম রিধিকে ভালোবাসে, এর চেয়ে বড়ো কি কোনো অধিকার আছে? রক্তিমই রিধিকে বলেছিল যে রিধি অনাথ। রিধি যাতে নিজেকে এই ঘরের মেয়ে মনে না করে। কিন্ত ভীষণ কষ্ট নিয়ে বলেছিল এই কথা। কারণ সমাজের চোখে তারা ভাই-বোন। সমাজের চোখে তাদের সম্পর্ক হারাম। নবনী-জুনাইয়েতের পরিবার আর কিছু ভালো বন্ধু, রক্তিমের বন্ধুরা, আর রিধির বেস্ট ফ্রেন্ড দিয়ার পরিবার ছাড়া কেউ জানে না রিধি পালিত। পরিবার আর আত্মীয়ের বাইরে যে সমাজ আছে তারা কি মানবে এই সম্পর্ক? যদি জেনেও যায়, রিধির চরিত্রে কি আঙ্গুল উঠবে না? সমাজ তো দোষ খুঁজে বেড়ায়, সমাজের কি ভালোবাসা বোঝার ক্ষমতা আছে?
রক্তিমকে যেদিন নবনী হোসেইন এসব বোঝায়, সেদিন থেকেই রক্তিমের বুকের উপর পাথর বসিয়েছে যেন কেউ। এই পাথর যে কতো ভারী, সেটি কাউকে বোঝাতে পারেনি রক্তিম। রিধিকে ভালোবাসার আগে কখনো বোঝেও নি এতো সব নিয়মের কথা। রক্তিমের এখন ভাবতেই কষ্ট হয়, যে পিচ্ছি মেয়েটি বড়ো হলে তাকে নিজের করে নেওয়ার স্বপ্ন বাঁধছিল, সে এখন কি অন্যের স্বপ্নকে রাঙাবে?
না, সে রিধিকে এতো সহজে হারিয়ে যেতে দেবে না। রিধিকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে যেখানে এই সমাজ থাকবে না। নতুন করে সব শুরু করবে। নতুন সমাজে কেউ জানবে না রিধির পরিচয়।
কিন্তু সে কেনো পালাবে? সে কি কোনো অপরাধ করেছে? কাউকে ভালোবাসা কখনো অপরাধ না।
রক্তিম এসব ভাবতে থাকে। এতো কঠিন কিছুও না এসব। শুধু শুধু ভাবছে। সমাজ সত্য জানলে কি এমন ক্ষতি হবে? সমাজে কি মেয়ে দত্তক নেয় না কেউ? এটিতে নতুন কি আছে? দত্তক মেয়েদের কি বিয়ে হতে পারে না বাড়ির ছেলের সাথে। মা কি যা তা বোঝাচ্ছে তাকে? আজ থেকে সে এসব নিয়ে ভাববে না। রিধি শুধুই রক্তিমের। তার প্রথম ও শেষ ভালোবাসা রিধি।
রক্তিম তাই চাচ্ছে না রিধি কোনো ছেলের সাথে মিশুক। রিধির যদি কাউকে পছন্দ হয়ে যায়? এই বয়সেই তো প্রেম হয়। না, সে রিধির উপর নজর রাখবে।
রিধি কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায়। ঘুম ভাঙে সন্ধ্যায়। তার চোখগুলো ফুলে আছে। রুম থেকে বের হয়ে রক্তিমের মুখোমুখি হয় রিধি।
রক্তিমকে দেখে ভেংচি দিয়ে চলে যায় মায়ের কাছে। রক্তিম সেখানেই হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
নবনী রিধিকে দেখে জড়িয়ে ধরেন আর কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলেন,
নবনী: আমি কি তোর মা না?
রিধি অবাক হয়ে বলল,
রিধি: কেন হবে না? তুমিই তো আমার মা।
নবনী: তোর বাবার কাছে চল। কখন থেকে বসে আছে শুকনো মুখে।
রিধি : কেন মা, কি হয়েছে?
নবনী কোনো উত্তর না দিয়ে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন রিধিকে জুনাইয়েত হোসেইনের কাছে।
রিধি: বাবা।
রিধির কন্ঠ শুনে মাথা তুলে বসলেন।
জুনাইয়েত: আয় মা, বাবার কাছে এসে বস।
রিধি: তোমার কি হয়েছে?
জুনাইয়েত: আমি কি তোর বাবা না?
রিধি: কেন হবে না। এসব কেমন প্রশ্ন করছো তোমরা দুজন?
নবনী : কেন বললি তাহলে তুই অনাথ। তুই কি বোঝাতে চাইছিলি, আমরা মৃত তোর জন্য?
রিধি: ছি, মা ওমন কথা কখনো বলবে না। তোমাদের কিছু হলে আমার কি হবে? এসব আমি ভাবতেও চাই না। তোমরা ছাড়া আমার কে আছে বলো।
রিধি কাঁদোকাঁদো কন্ঠে বলল,
রিধি: আমি কি এতোটাই খারাপ, যে সৃষ্টিকর্তা আমার কাছ থেকে আমার দ্বিতীয় বাবা-মাকেও কেঁড়ে নেবেন?
জুনাইয়েত: আমার মা কে কেউ কখনো কিছুই বলবে না আর। রক্তিমও না। রিধি মার যা চায়, সে বাবার কাছে চাইবে। ঠিক আছে মা?
রিধি: ঠিকাছে, তাহলে এখন তোমার রিধি মা যা চায় তাই দাও।
জুনাইয়েত: কি চায় আমার মা টা?
রিধি: এসব ইমোশনাল কথাবার্তা বন্ধ করে সুন্দর করে হেসে দাও দুজনেই। একটি সেল্ফি উঠাবো আর আপলোড দিবো। ক্যাপশন থাকবে হ্যাশট্যাগ সুখি পরিবার।
আগামীকাল জুনাইয়েত আর নবনীর ৩০তম বিবাহ-বার্ষিকী। তাই সন্ধ্যায় ছোটখাটো আয়োজন করছেন জুনাইয়েত হোসেইন, স্ত্রী নবনীর জন্য। কিন্তু রিধি রাত বারোটায় সারপ্রাইজ দেবে ভেবেছে। তাই নিজের পক্ষ থেকে সব আয়োজন করেছে। কেক অর্ডার করেছিল। সেটি আনার জন্য দিয়াকে পাঠিয়েছে। দিয়া বাসার সামনে এসে দিয়ে যায়। এখন বাবার পছন্দের নাস্তা বানাচ্ছে সে। নবনী-জুনাইয়েত তাদের ঘরে ছিল। রিধি সে সুযোগেই নাস্তা বানানো শুরু করে দেয়।
রক্তিম ঘর থেকে বের হয়ে রিধিকে রান্নাঘরে দেখে অবাক হয়ে যায়।
রক্তিম: কি বানাচ্ছো?
রক্তিমের কন্ঠ শুনে রিধি ভয়ে পেছনে ঘুরতেই, পা পিছলে পড়ে যেতে নিলে রক্তিম এসে রিধিকে ধরে ফেলে।
রক্তিম: তুমি ঠিক আছো?
রক্তিম থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে,
রিধি: সমস্যা কি আপনার? আমি যেখানেই যায় আপনি সেখানেই টিকটিকির লেজের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে চলে আসেন!
রক্তিম: হোয়াট? আমি টিকটিকির লেজের মতো লাফায়?
রিধি: দেখেন রান্নাঘরে আপনার কোথাও নাম লেখা নেই, সো গেট আউট।
রক্তিম: তোমার নামও কোথাও দেখছি না। তাহলে সার্বজনীন ভেবে নিতে পারি।
রিধি: আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছি। আমাকে বিরক্ত না করলে খুশি হবো।
রক্তিম: বিরক্ত আমি করছি? বিরক্ততো তুমি রান্নাঘরকে করছো। এতো পানি কেন নিচে? রান্নাঘরে সুইমিংপুল বানাবে নাকি?
রিধি: আমার ইচ্ছে, আমি যা ইচ্ছে বানাবো আপনার কি? যান এখান থেকে।
রক্তিম: এতো পানি ফেলে কাজ করতে গেলে আবার পিছলে পড়বে। আর আমি না থাকলে কি হতো? কোমর ভেঙে যেত তোমার।
রিধি বাঁকা হাসি দিয়ে বলল,
রিধি: আমাকে কি নিজের মতো বুড়ো মনে করেছেন, যে কোমর ভাঙবে?
রক্তিম: আ-আ-মি বুড়ো?
রক্তিম শব্দ করে হেসে দিলে, রিধি ভয় পেয়ে রক্তিমের মুখ চেপে ধরে।
রিধি: মিনি মাইক লাগিয়েছেন গলায়? এতো রাতে অসভ্য লোকদের মতো গলা ফাটিয়ে হাসছেন কেন?
রক্তিম রিধির হাত সরিয়ে বলল,
রক্তিম: চোরের মতো করছো কেন বলো তো? কি চুরি করছো?
রিধি: আপনাকে বলার প্রয়োজন মনে করছি না।
রক্তিম: আচ্ছা, বাবা-মাকে ডাক দিচ্ছি।
রিধি: না, না, না। আরে ভাই, সমস্যা কি আপনার?
রক্তিম: আমি তোমার ভাই না, ওকে?
রিধি: হুহ, আপনাকে আমি দুই টাকা দিয়েও ভাই বানায় না?
রক্তিম: বানাতে বলছিও না। এখন বলো কি করছো? না বললে ডাক দিচ্ছি কিন্তু।
রিধি মনে মনে বিরক্ত হয়ে বলল,
রিধি: টিকটিকির লেজ, ব্যাটা রাক্ষস জীবনেও তোর বিয়ে হবে না। বিয়ে হলেও বউ পালায় যাবে। সিঁড়ি থেকে পড়ে পা ভাঙবে তোর।
রক্তিম: গালি দিচ্ছো আমাকে? আচ্ছা!
একটু জোরে গলা উঁচিয়ে বা-বা——-
রিধি: না না, আমি বলছি তো।
রক্তিম: বলো।
রিধি: বাবা-মাকে সারপ্রাইজ দেবো তাই নাস্তা বানাচ্ছি। আর আমি চাই না আমার সারপ্রাইজের সাথে আপনি যুক্ত থাকেন। সো এবার যান আপনার ঘরে।
রক্তিম: আমি থাকলে কি সমস্যা?
রিধি: মাথায় কি গিলু নেই? নিজে প্ল্যান করে সারপ্রাইজ দেন। আমার সারপ্রাইজে নজর দিবেন না।
রক্তিমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,
রিধি: কান দুটি কি পকেটে রেখেছেন? শুনতে পেলেন না কি বলেছি?
রক্তিম: আচ্ছা, যাচ্ছি।
রক্তিমের অনেক ইচ্ছে রিধিকে রান্না করতে দেখবে। কিন্তু এই মুহূর্তে তার ইচ্ছেটা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
বারোটায় রিধি, নবনী-জুনাইয়েত কে ডেকে ছাদে নিয়ে গেল।
ছাদে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে একটি টেবিল সাজিয়েছে। সেখানে কেকটি রাখা ছিল। কেকের মধ্যে লেখা ছিল মিস্টার বাবা এন্ড মিসেস মা এর হ্যাপি ডে। দুটি চেয়ার ছিল টেবিলের দুই পাশে। পুরো ছাদ মোমবাতি দিয়ে সাজিয়েছে রিধি। আর যা নাস্তা বানিয়েছে সব আরেকটি ছোট টেবিলে পরিবেশন করেছে রিধি।
এসব দেখে নবনী-জুনাইয়েত খুব খুশি হলেন। কেক কাটা শেষে তারা রিধির হাতে বানানো নাস্তা খেয়ে প্রশংসা করছিল।
রক্তিম যখনই খেতে যাবে রিধি প্লেট নিয়ে ফেলে,
রিধি: এগুলো সব আমার বাবা-মার জন্য। খেতে ইচ্ছে করলে নিজে বানিয়ে খেয়ে নিন।
রক্তিম: আমি কি দোষ করলাম? আমারও তো খেতে মন চাইবে তাই না! এভাবে চেয়ে চেয়ে দেখবো আমি?
জুনাইয়েত: রিধি মা আমার, এতো কষ্ট করে বানিয়েছিস, একটু করে খেয়ে দেখতে দে।
রিধি: না, কখনো না। কখনো না।
রক্তিম: আমাকে খেতে না দিলে, বাবা-মার পেটে ব্যথা হবে। তুমি কি চাও পেটে ব্যথা হোক।
রিধি: কি খারাপ! নিজের বাবা-মার দিকেও নজর দেয়। আচ্ছা দিচ্ছি, কিন্তু এগুলো না। নিচে আছে, আরো বানিয়েছিলাম। এগুলো শুধু আমার বাবা-মার জন্য।
রিধি নবনী-জুনাইয়েতে দিকে তাকিয়ে বলল,
রিধি: আচ্ছা, তোমরা গল্প করো। এসব কিছু তোমাদের জন্যই করেছি। উনারগুলো উনাকে দিচ্ছি।
রিধি রক্তিমের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,
রিধি: চলুন, খাবেন না?
রিধি মনে মনে ভাবছে, খাওয়াচ্ছি তোকে। রিধিকে জ্বালানোর মজা আজকে বুঝবি। জানতাম মিস্টার রাক্ষস খাওয়ার জন্য তুমি টিকটিকির লেজের মতো লাফাবে, তাই তো আমি স্পেশাল রেসিপি নিয়ে এসেছি আজকে, শুধুই তোমার জন্য।
আর এদিকে রক্তিম মনে মনে ভাবছে কতোবছরের অপেক্ষা আমি আমার রিধির হাতে বানানো কিছু খাবো। এতোদিনে বড়ো হয়েছে আমার রিধি।
রিধি রক্তিমকে খাবার পরিবেশন করে বসে বসে দেখছে। রিধি মরিচ বেশি দিয়েছিল ঝাল নাস্তায়। আর মিষ্টি নাস্তায় কোনো চিনিই দেয় নি। পাশের জগে লবণ পানি রেখেছিল, যাতে পানি খেয়েও শান্তি না পায়।
রক্তিম একটু খেয়েই বুঝে যায় প্রচুর মরিচ দিয়েছে রিধি। রিধির দিকে তাকিয়ে দেখল সে মুচকি মুচকি হাসছে। তাও রিধিকে অবাক করে দিয়ে রক্তিম সব নাস্তা খেয়ে নিল। পানি খেতে গিয়ে দেখল মেয়েটি এখানেও ভেজাল করেছে। তাও এক জগ পানি শেষ করলো। রিধি রক্তিমের এই অবস্থা থেকে আস্তে আস্তে সরে গেল। এখন যদি খপ করে ধরে টুপ করে থাকেও এসব খাইয়ে দেয়।
রিধি তার ঘরে এসে দরজা ভালো মতো আটকে দেয়, সাথে জানালাও। যদি জানালা বেয়ে আসে!
রক্তিম তার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। অনেক খারাপ লাগছে এখন। সে ফেলেও দিতে পারেনি তার ভালোবাসার মানুষটির হাতে প্রথম বানানো খাবার। সে জানে রিধির মনে রক্তিমের প্রতি কোনো ভালোবাসা নেই। কিন্তু রক্তিম অপেক্ষায় আছে একদিন রিধিও তাকে ভালোবাসবে।
১০:
তিন চারদিন ধরে ইশা ভার্সিটিতে যায় ঠিকই, কিন্তু রোহান থেকে দূরত্ব রেখেই চলে। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকলে নিশু বা অন্য সহপাঠীকে পাঠায়। কিন্তু নিজে যায় নি। রোহান ব্যাপারটি বুঝতেও পেরেছে। সে অনেকভাবে ইশার সাথে কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। আর এদিকে দিব্য তিন চারদিন ভার্সিটিতেই আসে নি। রোহানের উপর দায়িত্ব দিয়ে সে অনিকের বাইকে করে ঘুরছে। কিন্তু আজ সে ভার্সিটি যাবে কারণ ইশাকে ভালো মতো দেখার সুযোগ আছে আজকে। এতোদিন ইশার উপর কাজের চাপ বেশি ছিল। আর সে ঠিকমতো ইশাকে দেখতে পারবে না, তাই যায়ও নি।
আজকে যারা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ আর পরিচালনা করবে তাদের একটি চূড়ান্ত তালিকা হবে। আর ভার্সিটির ক্লাবে রিহার্সালও হতে পারে তাদের।
ইশা আজকে একটু সুন্দর করেই সেজেছে। চুলগুলো কার্ল করেছে, রোদের আলোয় চিকচিক করছে তার ঘন কালো চুলগুলো। কপালে কালো টিপ দিয়েছে। ইশা যদিও টিপ দেয় না। কিন্তু নিশু বলেছে টিপ মানাবে শাড়ির সাথে। কালো রঙের গোলাপী ফুলের প্রিন্টের কাজ করা সিল্কের শাড়ি পড়েছে। ইশাকে প্রোগ্রামে শাড়ি পড়তে হবে তাই আজকেই সে চর্চা করে নিচ্ছে, যাতে প্রোগ্রামের দিন অসুবিধা না হয় শাড়ি সামলাতে। চোখে ঘন করে কাজল দিয়েছে, ইশার চোখগুলো অনেক আকর্ষনীয় লাগছে। হাতে কালো ও গোলাপি রঙের কাচের চুড়ি, কানে বড়ো বড়ো কালো রঙের ঝুমকা পড়েছে। ইশাকে এতো বেশি সুন্দর লাগছিল যে, ছেলে মেয়ে সবাই ইশাকে ঘুরে ঘুরে দেখছে।
দিব্য আর রোহান ইশাকে দেখে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। দুই ভাইয়ের চোখের পাতা যেন থেমেই গিয়েছে।
অনিক ব্যাপারটি খেয়াল করে রোহানের কানের কাছে এসে বলল,
অনিক: ভাবি কে কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে। নজর দিস না। রাজামশায় জানলে কিন্তু, রাজ্যে বড়ো গণ্ডগোল সৃষ্টি হবে।
রোহান অনিকের কথা শুনে চোখ নামিয়ে ফেলল।
মনে মনে ভাবছে, কি করছিলো সে? ইশাকে তো দিব্য ভালোবাসে। ছি! ছি! নিজের সবচেয়ে ভালো বন্ধুর ভালোবাসার মানুষটিকে নিয়ে কিভাবে এসব চিন্তা করছে?
দিব্য ইশার কাছে এসে বলল,
দিব্য: মাশাল্লাহ, ভালোই লাগছে তোমায়। তোমার প্রিয় রবীঠাকুর তোমায় দেখলে হয়তো নতুন কাব্য রচনা করতেন।
ইশা: নাম কি দিতো কাব্যের?
দিব্য: নির্বাক অপ্সরী।
ইশা: আমি কি কথা বলতে পারি না?
দিব্য: তা না। কিন্তু নির্বাক বলতে তোমার সুর ছাড়া তোমার যে গুন আছে সবকিছু মিলিয়ে তুমি অনন্যা। সুরযোগ হলে ছন্দ দিয়ে গান বানিয়ে ফেলতেন।
ইশা মুচকি হেসে বলল,
ইশা: ধন্যবাদ।
দিব্য: পরশু প্রোগ্রামে কোন বিষয়ে অংশ নিচ্ছো?
ইশা: গান আর কবিতা আবৃত্তি।
দিব্য: রোহান থেকে গান শিখেছো?
ইশা: না, বাসায় চর্চা করেছিলাম। কিন্তু ভালো না হলেও সমস্যা নেই। নিজেকে অনেক দিন পর স্বাধীন মনে হচ্ছে। তাই ভাবলাম নিজের মধ্যে যা প্রতিভা আছে তাদেরও স্বাধীন করে দেয়। এখন অনেক সময় আমার নিজেকে নিয়ে ভাবার।
দিব্য: তোমার প্রতিভা দেখার আগেই তোমার ভক্ত হয়ে গেলাম।
ইশা: আপনি কোন বিষয়ে অংশ নিচ্ছেন?
দিব্য: আমার কাজ শুধু তোমার ছবি উঠানো।
ইশা: মানে?
দিব্য: আরে… মানে তোমাদের। আমার দায়িত্ব ছবি উঠানো। আমি গান গাইতেও পারি না, কবি হওয়ার গুনও আমার মধ্যে নেই। হ্যাঁ, যদি কোনো কবি প্রতিভা বাড়ানোর জন্য আমার ক্লাস নেন তাহলে হয়তো উপকার হবে।
ইশা: কবি খুঁজতে হবে তাহলে?
দিব্য: খোঁজার কি আছে? আমার সামনেই তো দাঁড়িয়ে আছে। নির্বাক অপ্সরী।
ইশা: আ-আ-মি? আমি ওতো ভালো না।
দিব্য: আমারও ওতো ভালো হতে হবে না।।
ইশা দিব্যের কথা শুনে হেসে দেয়।
রোহান তাদের দুজনকে একসাথে হেসে কথা বলতে দেখে অনেক কষ্ট পাচ্ছে। কিন্তু তার করার কিছুই নেই। কিছু কিছু প্রিয়জন স্বল্পসময়ের প্রিয়জন হয়ে থেকে যায়।
রোহান রিহার্সাল শুরু করে, পরিচালনা কিভাবে করবে ওইটি নিয়ে। রোহান তার স্ক্রিপ্ট নিয়ে সবার সামনে আসার পর হেসে দেয়। সবাই রোহানকে হাসতে দেখে অবাক হয়ে যায়।
অনিক বলে উঠে,
অনিক: স্ক্রিপ্ট পড়ার আগে হাসবি সেটিও কি লিখে রেখেছিলি?
দিব্য: চুপ কর অনিক। রোহান তুই শুরু কর।
অনিক: ওকে হাসতে দেখেই তো হাসি পাচ্ছে। ওকে প্রথম হাসতে দেখলাম।
দিব্য: তোদের জন্য কি হাসবে না?
হাসলেও কি দোষ? এখন কি সবাই চুপ করবে?
দিব্য সবাইকে শান্ত করল। কারণ রোহানকে হাসতে দেখে অনেকেই ফিসফিস করছে। আবার অনেকে হাসছে। ইশার বিষয়টি অবাক লাগলো। কাউকে হাসতে দেখলে এমন রিয়েক্ট করার কি আছে?
ইশা পাশে বসা রোহানদের ক্লাসের একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করল,
ইশা: আচ্ছা আপু, কেউ হাসলে এভাবে রিয়েক্ট করার কি আছে?
সিনিয়র আপু: রোহানকে এই চার বছরে কেউ ভালো করে হাসতেই দেখে নি। ছেলেটি কোনো হাসির কথা উঠলেও না হেসে বসে থাকতে পারে। এমন গম্ভীর ছেলে আমি জীবনে একটিও দেখে নি।
ইশা: চার বছরে হাসে নি, এখন হাসছে? এখন এমন কি হয়েছে?
সিনিয়র আপু: তাই তো সবাই রিয়েক্ট করছে।। আর এই প্রথম সে পরিচালনা করবে প্রোগ্রাম। প্রতি বছর দিব্যই করে, কারণ ও অনেক সুন্দর আর মজা করে কথা বলতে পারে, আর মিশুকও। আর দিব্যই এবার রোহানকে দায়িত্বটি দিয়েছে।
ইশা: ওহ।
সিনিয়র আপু: আসলে দিব্যের মন অনেক ভালো। রোহানকে আমাদের ক্লাসে কেউ পছন্দ করে না, একমাত্র দিব্য ছাড়া। দেখতেও দুজনের চেহারা অনেক মিল। সবাই তো তাদের ভাই মনে করে। শুধু তাদের গেটআপ ভিন্ন। গেটআপ একই হলে, তাদের দেখলে জমজ মনে হবে।
ইশা মনে মনে রোহানকে নিয়ে ভাবছে,
কেন হাসে না রোহান? কি সমস্যা তার জীবনে?
ইশা বুঝতে পারছে, রোহানের হয়তো চাপা কোনো কষ্ট আছে। হয়তো কোনো বিষয়ে সে অনেক আঘাত পেয়েছে।
রোহান সবাইকে হাসতে দেখে আরো বেশি অস্বস্তি বোধ করছে।
দিব্য রোহানের কাছে এসে তাকে নিয়ে ক্লাবের বাইরে আসলো।
রোহানের কাঁধে হাত রেখে বলল,
দিব্য: রোহান, আমি তোকে দায়িত্ব দিয়েছি কারণ আমি জানি তুই পারবি। এমন না যে তুই কখনো কারো সামনে এসে কিছু বলিস নি। বিতর্কেও প্রথম হয়েছিস, এখন চুপ করে আছিস কেন?
রোহান: ওসব আলাদা বিষয়। কিন্তু আমি তোর মতো কাউকে হাসাতে পারবো না। দেখ আমাকে হাসতে দেখেই কেমন রিয়েক্ট করছে সবাই।
দিব্য: কারণ তুই কখনো হেসে কথা বলিস নি। সবাই জানে তুই গম্ভীর। কিন্তু আমি চিনি তোকে। এটিই আমাদের শেষ বছর ভার্সিটির। এইটাই শেষ সুযোগ নিজেকে প্রমাণ করার। এর পর কে কোথায় চলে যাবে! আমি যদি না থাকি তোর পাশে? কিভাবে রাখবি বন্ধুত্ব? সবাই তোকে ভয় পায়, তাই কথা বলতে চায় না। রোহান শোন, জীবনে বন্ধুর খুব দরকার। নিজের মনের সব কষ্ট, সব ধরনের অনুভূতি বন্ধুদের সাথেই ভাগ করা যায়। যখন শ্রোতা থাকে না, এই বন্ধুগুলোই শুনবে তোর বকবক। হাসবে, তামাশা করবে, তবুও শুনবে। এখন হাসছে পরেও হাসবে, কিন্তু প্রচুর ভালোবাসবে।
রোহান দিব্যকে জড়িয়ে ধরে বলল,
রোহান: তুই থাকলে আর কি লাগে বল?
দিব্য: হুম, আমি আছি। আর থাকবোও।
তারা দুজনে ক্লাবে ঢুকল। এতোক্ষন ইশা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের কথা শুনছিলো। তাদের বের হতে দেখে সেও বের হয়েছিলো। ইশা ভাবছে কয়েকদিন রোহানের সাথে সে কথা বলতে চায় নি। রোহান ইশাকে হয়তো সরি বলার জন্য কথা বলতে চেয়েছিল, কিন্তু প্রতিবার কিছু না কিছু বলে সে রোহান থেকে দূরে দূরে ছিল। হয়তো তার মনে কোনো দুঃখ আছে, তাই এমন খারাপ ব্যবহার করেছিল। এখন হয়তো আফসোস হচ্ছে।
ইশা ভাবছে, রোহান ইশাকে সরি বলতে পারলে হয়তো একটু ভার মুক্ত হবে। কিন্তু এদিকে তাদের কথা শুনে ইশা দিব্যকে নিয়ে ভাবছে, এতো সুন্দর করে কেউ বোঝাতে পারে? দিব্যের কবি হওয়ার জন্য প্রতিভা আছে, যথেষ্ট প্রতিভা আছে। তার কোনো ছন্দ শেখা লাগবে না, কোনো অর্থ আর বর্ণের ব্যবহারের প্রয়োজন নেই। মনের বাক্য দিয়ে সে জীবনের অর্থ শিখিয়ে দেবে।
দিব্য আর রোহান ক্লাবে ঢুকার সময় ইশাকে দেখতে পায়। দিব্য ইশাকে কল্পনার রাজ্যে ডুবে থাকতে দেখে ইশার মুখের সামনে তুড়ি বাজাল।
দিব্য: কোথায় হারিয়েছো নির্বাক অপ্সরী?
রোহান: নির্বাক অপ্সরী কে?
দিব্য: নতুন জন্ম নেওয়া প্রেমিকের কাব্যের নাম?
রোহান: বুঝলাম না ঠিক।
দিব্য: আরে ইশা রবীঠাকুরের ভক্ত। তো বলছি কি যদি তিনি বেঁচে থাকতেন ইশাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখতেন। আর কবিতার নাম দিতেন নির্বাক অপ্সরী।
রোহান: ওহ।
দিব্য: কি করছিলে ইশা?
ইশা: না এমনি একটু বের হয়েছিলাম হাওয়া খেতে। ভেতরে বিরক্ত লাগছিল। আর বাইরে এসে আপনার কথাগুলো শুনে ফেলেছি। আপনার কথাগুলো শুনে অনেক ভালো লাগলো।
দিব্য: অনেক ভালো লেগেছে?
ইশা: হ্যাঁ।
দিব্য: প্রেমে পড়ে যাও নি তো।
দিব্যের কথা শুনে ইশা আর রোহান দুজনেই চোখ বড়ো বড়ো করে দিব্যের দিকে তাকায়।।
দিব্য একটু গলা ঝেড়ে বলল,
দিব্য: চলো। পরে হাওয়া খেয়ে নিও।
রোহান: দিব্য, তুই যা ভেতরে আমি আসছি। ইশা একটু সময় হবে?
দিব্য: ইশাকে কি বলবি?
রোহান: তোকে পরে বলছি।
দিব্য চলে গেলে।
রোহান ইশার দিকে তাকিয়ে বলল,
রোহান: ঐদিনের ব্যবহারের জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমার আসলে মাথা ঠিক ছিলো না।
ইশা: সমস্যা নেই। আমি বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা আমি আসছি।
রোহান: আরেকটি কথা।
ইশা: জি বলুন?
রোহান চুপ হয়ে গেল। কি বলবে এখন? কিছুই তো বলার নেই। বলার মতো ভাষাও খুঁজে পাচ্ছে না।
ইশা: কিছু কি বলবেন?
রোহান: হ্যাঁ….হ্যাঁ। তোমাকে আজকে সুন্দর লাগছে।
ইশা: ওহ। ধন্যবাদ। আমি আসছি।
ইশা চলে গেল।
মুখ ফসকে বের হয়ে গিয়েছে কথাটি। রোহান কি বলল সেটি নিয়ে আফসোস করছে এখন। ইশা কি ভাববে রোহানকে?
তিনঘন্টার মধ্যে সবার রিহার্সাল শেষ। রোহানের পরিচালনা দিব্যের মতো সুন্দর না হলেও অনেক সুন্দর হয়েছে। কিছু মেয়েতো আজকেই রোহানের উপর নতুন করে ক্রাশ খেল। কিন্তু ইশার চোখ বারবার দিব্যের দিকেই যাচ্ছে। দিব্যের কথাবার্তাগুলো ইশাকে খুব মুগ্ধ করছে।
বাসায় আসার পর সারাদিন দিব্যকে নিয়ে ভাবছে ইশা। এরপর ছাদে যাবে চিন্তা করে একটু কাজল দিচ্ছিল।
এমন সময় ইফতি এসে বোনকে সাজতে দেখে বলল,
ইফতি: কি রে আপি, এখন আবার কই যাচ্ছিস?
ইশা: ছাদে যাচ্ছি।
ইফতি: তুই আর ছাদ? অসম্ভব! তোর ছাদে উঠার শখ কবে হলো? আর ছাদে এতো সেজেগুজে কেন? আশেপাশে তো কেউ দাঁড়িয়ে থাকেনা!
ইশা: কি? কি বলতে চাচ্ছিস? আমি মানুষকে দেখানোর জন্য সাজছিলাম?
আমি ছবি উঠাবো তাই যাচ্ছি?
ইফতি: আজকে সকালে ভার্সিটি যাওয়ার আগে, আসার পরে, ঔখানে গিয়েও এতো এতো ছবি উঠিয়েছিস তাও মন ভরে নি?
ইশা: ওই তোর ফোনে উঠাচ্ছি আমি? তোর কি সমস্যা?
ইফতি: আমাকেই তো ক্যামরাম্যান বানাস।
ইশা: বোনের ছবি উঠালে কি সমস্যা? দিব্যকে চিনিস? কতো ছবি উঠিয়ে দেয় সবার। উনার তো বিরক্ত লাগে না?
ইফতি: তাহলে ওনাকেই ডেকে আন। বাই দা ওয়ে, ভাইয়া এসময় বাসায় থাকেও না। লাভ নেই।
ইশা: কোথায় থাকে তাহলে?
ইফতি: লাইব্রেরীতে। তোর জানার ইচ্ছে কেন এতো?
ইশা: এমনি জানতে চেয়েছি। এমন চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছিস কেন? দাঁড়া, এভাবে তাকিয়ে থাকলে ওইদিন কলেজ কামাই করে যে বন্ধুর বাসায় গিয়েছিস আমি বলে দিচ্ছি কিন্তু।
ইফতি: আপি, তুই বোন নাকি শত্রু?
ইশা: যা এখান থেকে।
ইফতি: তুই ছাদে যাবি না?
ইশা: আহ! আহ!
ইফতি: আবার কি হয়েছে?
ইশা: পেট ব্যথা করছে, থাক আর না যায়।
ইফতি: আচ্ছা? সত্যিই নাকি! নাকি অন্য কিছু?
ইশা: ওই তুই আমার নজরদারি করছিস কেন? যা এখান থেকে। যা বলছি।
ইফতি: আচ্ছা, যাচ্ছি যাচ্ছি।
সন্ধ্যায় ইশার ফোনে কল আসে অপরিচিত নম্বর থেকে। বার বার আসছে দেখে সে কল ধরে দেখে মুহিব।
মুহিব: ইশা প্লিজ, কল কাটবে না। আমার গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।
ইশা: যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।
মুহিব: একদম শেষবারের মতো ক্ষমা করো। আর কখনো করবো না, সত্যি। তুমি যা বলবে সব শুনবো।
ইশা: এখন আর কিছুই সম্ভব না।
মুহিব: তুমি আমাকে ভালোবাসো না?
ইশা: না।
মুহিব: আমি তোমার বাসার নিচে এসেছি। তুমি পাঁচ মিনিটের মধ্যে নিচে না নামলে আমি তোমার বাসায় এসে তোমার বাবা-মাকে আমাদের ব্যাপারে জানিয়ে দেবো।
ইশা: তুমি কি পাগল হয়েছো?
মুহিব: আসবে কিনা আসবে না?
ইশা: ওয়েট, আসছি।
ইশা নিচে নামার সাথে সাথেই মুহিব ইশার কাছে চলে এলো।
ইশা: তোমার সমস্যা কি?
মুহিব: চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি?
ইশা: মানে?
মুহিব: বিয়ে করলে আমিও কারো হতে পারবো না, তুমিও না।
ইশা তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,
ইশা: তোমাকে? বিয়ে?
মুহিব: কেন?
ইশা: যেখানে তোমার সাথে দম নিতে পারি নি যতদিন ছিলে, আর বিয়ে করে তুমি আমাকে মেরে ফেলার প্ল্যান করছো।
মুহিব: এমন কঠোর কেন হচ্ছো?
ইশা: এই কঠোর আমার আগে হওয়া উচিত ছিল। এখন যাও।
মুহিব: ইশা, একটিবার বুঝো।
ইশা: মুহিব, বন্ধ করো এসব ন্যাকামো।
দিব্য বাসার সামনে এসে ইশাকে বাইরে একটি ছেলের সাথে কথা বলতে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। দিব্য বুঝতে পারল তর্কাতর্কি হচ্ছে। ছেলেটি ইশার হাত ধরতে যাবে ওই সময় দিব্য মুহিবকে বাঁধা দেয়।
দিব্য: কি সমস্যা? কে তুমি?
মুহিব: আপনি সরে যান। আমি আমার বউয়ের সাথে কথা বলছি।
দিব্য মুহিবের মুখে বউ শব্দ শুনার সাথে সাথে ইশার দিকে ফিরে বলল,
দিব্য: কি যা তা বলছে ছেলেটি?
ইশা: এমন কিছুই না, আ-আ-স-লে।
দিব্য: তুমি চিনো ওকে?
ইশা: হ্যাঁ। ও আমার…….
মুহিব: আমি ওর বয়ফ্রেন্ড।
ইশা মুহিবকে উদ্দেশ্য করে বলল,
ইশা: আমাদের মধ্যে কিছু নেই আর, যাও তুমি এখন।
মুহিব: আমাকে ক্ষমা করে দাও। তুমি যা বলবে সব করবো। বলছি তো!
দিব্য মুহিবের কলার ধরে,
দিব্য: পুলিশ ডাকবো এখন? মেয়েকে জ্বালাচ্ছিস?
মুহিব: তুই কে হ্যাঁ? তুই কে?
দিব্য: আমি ওর হবু বর। সাহস কি করে হয় তোর, আমার হবু বউকে বিরক্ত করার?
মুহিব: ওর আর আমার সম্পর্ক ছিল।
দিব্য: তো? আগে ছিল এখন নেই। গেট আউট। এই এলাকায় আর দেখলে তুই শেষ।
মুহিবকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিলো। এলাকাটিতে বিল্ডিং অনেক কম। মানুষজনও রাস্তায় কম থাকে। তাই কারো নজরে বিষয়টি পড়ে নি।
দিব্য: ও আর আসলে আমাকে বলবে।
ইশা ছলছল চোখে বলল,
ইশা: ধন্যবাদ।
দিব্য: ছেলেটিকে ভালোবাসো?
ইশা: বাসতাম কিন্তু এখন না। ওর কারণেই আজ সবকিছু শেষ।
ইশা সবকিছুই দিব্যকে খুলে বলল।
দিব্য সব শুনে বলল,
দিব্য: এখন থেকে আমি আছি তোমার পাশে। তোমাকে কেউ বিরক্ত করবে না। কিছু হলে আমাকে বলবে।
চলবে—-
আগের পর্বের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/373110321077413/