অপেক্ষা
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ
পর্ব-(২৪+২৫+২৬)
২৪।
ইশা ক্লাস শেষে বাসে উঠার সময় রোহানের মুখোমুখি হয়।
রোহান ইশাকে দেখে বলল,
রোহান: কেমন আছো?
ইশা: ভালো। আপনি?
রোহান: আমিও ভালো।
ইশা আর রোহান একই বাসে উঠেছে। রোহান আজকে দিব্যকে দেখতে যাবে। অনেকদিন তার ভাইকে দেখে নি।
হ্যাঁ, আজ সে বন্ধু হিসেবে নয়, ভাই হিসেবে দেখা করবে দিব্যের সাথে। আজ বহুবছর পর দুই ভাইয়ের দেখা হবে, যেখানে বন্ধুত্বের চেয়েও ঊর্ধ্বে রক্তের সম্পর্কের মিলন হবে। এতোদিন যাকে বন্ধু হিসেবে ভালোবেসেছে তাকে আজ ভাই হিসেবে ভালোবাসবে। রোহান হয়তো ভালো বন্ধু হতে পারে নি, কিন্তু সে ভালো ভাই হতে চায়। সে ভালো সন্তান হতে চায়। বাবার আদর্শ ছেলে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মায়ের আদর্শ ছেলে হতে না পারলে তার মাঝে সন্তান হওয়ার শূন্যতা থেকে যাবে। রোহান দিয়ার ভাই হতে চায়, যেমনটা দিব্য হতে পেরেছে।
অনিক আর দিব্য খেলা দেখছিলো।
অনিক দিব্যকে বলল,
অনিক: জানিস তোকে কে রক্ত দিয়েছিলো?
দিব্য: কে?
অনিক: রোহান।
দিব্য: ওহ।
অনিক: তুই হয়তো জানিস না রোহান, তোর আর ইশার আক্দের দিন কেন চলে গিয়েছিলো?
দিব্য অনিকের মুখের দিকে তাকায়।
অনিক: রোহান তোর ভাই। রোহান ওইদিন আন্টিকে দেখে চলে যায় হয়তো। তোর সাথে খারাপ ব্যবহার হয়তো এই কারণেই করেছিলো। রোহান অনেক মানসিক কষ্টে ছিলো। আমিও বুঝতে পারি নি। কতো কিছু বলে ফেলেছিলাম। জানিস, আঙ্কেলও এসেছিলো রোহানের সাথে মেডিকেলে।
দিব্য চুপচাপ বসে আছে। শেষ কথাটি শুনেই তার মাথা গরম হয়ে যায়।
দিব্য: ফয়সাল আহমেদ?
অনিক: তোর বাবা। মানে, হ্যাঁ।
দিব্য: মায়ের সাথে দেখা হয়েছে?
অনিক: হ্যাঁ।
দিব্য: বাসায় সবাই জানে বিষয়টি? ইশাও জানে?
অনিক: হ্যাঁ।
দিব্য: আমাকে কিছু বলে নি কেনো ইশা?
অনিক: তুই অসুস্থ তাই। আন্টি মানা করেছিলো তোকে বলতে।
দিব্য: ইশার আমাকে জানানো উচিত ছিলো।
অনিক: দিব্য, শোন। আমিও তোকে জানাতাম না যদি রোহানকে আমরা আগে থেকে না চিনতাম। চারবছর বন্ধু হিসেবে জেনে আসছি আমরা। আজ জানলাম রোহান তোর ভাই। আর রোহান সবকিছুই গোপন রাখতো। আসলে ও নিজেও জানতো না, তুই ওর ভাই।
দিব্য: রোহান একবারো আসে নি আমাকে দেখতে।
অনিক: তোর এই অবস্থার জন্য নিজেকে অপরাধী মনে করছে। আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছিলো। আর দেখ তোর সামনে এসেও দাঁড়াতে পারলো না। আপন মানুষকে কষ্ট দিলে মানুষ নিজেকে খুব সহজে ক্ষমা করতে পারে না। যে কষ্ট আমরা আপনজনকে দেই তার ব্যথা খুব বেশি অনুভূত হয়, দূরের কাউকে ব্যথা দিলে অনেকসময় মনেও থাকে না। যখন মনে আসে তখন আয়োজন করে, সময় নিয়ে ক্ষমা চাওয়ার কথা চিন্তা করি না। শুধু ‘আমায় ক্ষমা করে দিও পারলে’- এই এক বাক্যে সব কিছু শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আপনজনের কাছে ক্ষমা চাওয়ার আগে আমরা প্রথমে ভাবি সে কি আমায় ক্ষমা করবে? কিভাবে ক্ষমা চাইতে হবে? ক্ষমা করলে মনের মধ্যে তাও খচখচ করতে থাকে। আদৌ কি ক্ষমা করেছে? নাকি এমনি মুখের উপর বলেছে ক্ষমা করেছি। এসব চিন্তা মাথায় ঘুরতে থাকে। দিব্য, দেখিস রোহান তোর কাছে ক্ষমা চাইতে আসবে।
বাস ইশা আর রোহানকে নামিয়ে দেয়।
ইশা রোহানকে দেখে জিজ্ঞেস করলো,
ইশা: আপনি এখানে নেমেছেন কেনো? মানে, আপনার বাসা তো…….
রোহান: দিব্যের সাথে দেখা করবো।
ইশা: ওহ, আচ্ছা।
ইশা আর কিছু না বলে হাঁটছিলো রোহানের আগে আগে। এমন সময় পেছন থেকে রোহানকে পাশ কাটিয়ে ইশার পাশে এসে হাঁটা শুরু করলো মুহিব। ইশা মুহিবকে দেখেই ভয় পেয়ে যায়।
রোহান মুহিবকে এভাবে ইশার পাশে হাঁটতে দেখেই জোরে পা চালিয়ে মুহিবের পেছনে এসে বলল,
রোহান: একটু জায়গা দেবেন ভাইয়া?
মুহিব একটু সরে গেলে। এরপর রোহান ইশার পাশে হাঁটা শুরু করলো। মুহিবের বিষয়টা আর হজম হয় নি।
রোহানের সামনে এসে বলল,
মুহিব: এতো জায়গা থাকতে আপনি মেয়েটির গায়ের সাথে লেগে কেন হাঁটছেন?
রোহান: আমি যথেষ্ট দূরত্ব রেখে হাঁটছি। গায়ের সাথে লেগে হাঁটছি, মানে কি?
মুহিব ইশার দিকে তাকিয়ে বলল,
মুহিব: বেশি ভালো লাগে না? যখন ইচ্ছে তখন ছেলেদের সাথে ঘুরাঘুরি করতে? শুনেছি তোমার নাকি বিয়ে হয়েছে? তোমার বর জানে তুমি বাইরের ছেলেদের সাথে কিভাবে মেলামেশা করছো? আমার বউ হলে তো বাইরেই বের হতে দিতাম না এভাবে। আমাকে ছেড়েছিলে কেন? এইভাবে উড়ার জন্যে? যেমন তুমি তেমন হয়তো তোমার বর। কোনো মেয়ের সাথে ঘুমোচ্ছে হয়তো এখন, বউকে ঘরের বাইরে পাঠিয়ে।
ততোক্ষণে রোহানের চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে যায়। শেষ কথা শুনে খুব জোরে মুহিবের মুখে ঘুষি মারে। মুহিব ঘুষির ধাক্কায় রাস্তার উপর পড়ে যায়। এরপর ইচ্ছেমতো মুহিবকে মারলো রোহান। ইশার ভয়ে হাত পা কাঁপছে। আশেপাশে মানুষ জড়ো হয়ে গেলো। পরে কিছু মানুষ এসে রোহান থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে মুহিবকে। মুহিবের চেহারার বিধ্বস্ত অবস্থা।
রোহান দাঁতে দাঁত চেপে মুহিবের কলার ধরে বলে,
রোহান: আমার ভাইকে নিয়ে বাজে মন্তব্য করার কে তুই? চিনিস আমার ভাইকে? আর তুই আমার ভাইয়ের বউকে বিরক্ত করছিস কোন সাহসে? আরেকবার যদি তোকে দেখি আশেপাশে, তুই আর নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবি না। এখন দুই পায়ে হেঁটে চলে যা সামনে থেকে। যা, এখন।
মুহিব একপ্রকার পালিয়ে চলে গেলো।
রোহান জোর গলায় ইশাকে বলল,
রোহান: বাসায় যাও, দাঁড়িয়ে আছো কেন এখনো?
ইশা দৌঁড়ে বাসায় ঢুকে গেলো। রোহান কিছুক্ষণ পর দিব্যদের বাসায় ঢুকলো। দিয়া দরজা খোলার পর ইশা সোজা রুমে চলে আসে। অনিক চলে গিয়েছিলো অনেক আগেই।
দিব্য ইশাকে হাঁপাতে দেখে বলল,
দিব্য: কি হয়েছে তোমার?
ইশা: ক..ই। কি…কিছু হয়নি তো। এ..ম..নি।
ইশাকে আমতা আমতা করে কথা বলতে দেখে, দিব্য হাত এগিয়ে দেয়।
দিব্য: এদিকে আসো ইশা। আমার কাছে এসো।
ইশা দিব্যের কাছে আসলে, দিব্য খুব শক্ত করে ইশার হাত ধরে, তাকে নিজের কাছে টেনে আনলো।
তারপর ধীর গলায় বলল,
দিব্য: আমার বউটাকে কেউ কিছু বলেছে?
ইশার চোখে পানি টলটল করছিল। চোখের পলক ফেলতেই গাল বেয়ে পড়ার আগেই দিব্য দুহাত দিয়ে তা মুছে দেয়।
দিব্য: কি হয়েছে ইশা, আমার কিন্তু এখন খুব টেনশন হচ্ছে?
ইশা কিছু বলার আগেই দিয়া রুমের দরজায় নক করলো।
দিব্য: কি হয়েছে দিয়া?
দিয়া: রোহান ভাইয়া এসেছে।
ইশা দিব্য থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজা খুলে চলে গেলো।
রোহান দিব্যের পাশে এসে বসলো। দুজনেই চুপ।
নিরবতা ভেঙে দিব্য বলল,
দিব্য: আমাকে অনিক বলেছে সব।
রোহান: আমাকে ক্ষমা করে দিস ভাই, আমার মাথা ঠিক ছিলো না। আমি সবকিছু জানতে পেরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারি নি আর। আমার খুব খারাপ লাগছে। আ..আ….মা….কে প্লিজ……
দিব্য রোহানকে জড়িয়ে ধরে বলল,
দিব্য: আমি তোর উপর কখনো রাগ করে থাকতে পারি না। যা হয়ে গেছে, ভুলে যা। আমি তো আজ অনেক খুশি। আমি আমার ভাইকে ফিরে পেয়েছি।
আজ রোহান মন খুলে দিব্যের সাথে কথা বললো। ছোটবেলার গল্প করেছে দুজনে বসে। দিয়ার সাথে বসেও আজ অনেক কথা বলেছে রোহান। দিয়া প্রথমে ইতস্তত করলেও পরে নিঃসংকোচে কথা বলেছে।
ইশা আর তাদের সামনে আসে নি। সে এর মধ্যে দুপুরের রান্না করে ফেললো। দিব্য অনেকবার ডেকেছে কিন্তু ইশা আসে নি তাও।
দিব্যের মাথায় ঘুরছে, ইশা কেন কেঁদেছিলো?
এদিকে রাজিয়া খুবই ব্যস্ত, ডিউটিতে আছেন। তাই আজ দুপুরে বাসায় আসবেন না। তবে রোহান ফোন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে রাজিয়াকে যে, সে বাসায় এসেছে। সন্ধ্যায় রাজিয়া রহমান আসলে দেখা হবে মা-ছেলের।
খাওয়া দাওয়া শেষে আজকের ঘটনাটি রোহান দিব্যকে জানায়।
রোহান: আমার মনে হয় তোর ইশাকে একা বাইরে যেতে দেওয়া উচিত না। তুই ইশাকে বাসে উঠিয়ে দিস, আর আসার সময় নিয়ে আসিস। এতে আর টেনশন থাকলো না। কোথাও গেলে তুই সাথে যাবি, তুই না পারলে ইশার ভাই আছে না? ওকে বলবি। সামনেই তো বাসা।
দিব্য: হুম ছেলেটিকে আমি চিনি। বিয়ের আগেও বিরক্ত করতো ইশাকে। এরপর আর কখনো করেছে কিনা জানি না। আমাকে জানায় নি কিছু ইশা।
রোহান: ছেলেটির কথা শুনে মনে হয়েছে ইশার সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো!
দিব্য: আমি জানি। এখানে ইশার কোনো দোষ নেই। এসব ব্যাপারে আর কথা বলিস না। বাদ দে।
রাজিয়া আসলে রোহানের সাথে দেখা হয়। একসাথে রাতের খাবার খায় তারা।
রোহান রাজিয়ার কোলে মাথা রেখে বলল,
রোহান: আজ অনেকদিন পর মায়ের হাতের রান্না করা খাবার খেয়েছি। এতোদিন পর মনে হচ্ছে পেট ভরেছে।
রাজিয়ার দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। আজকের দিনটার অপেক্ষায় ছিলো এতোবছর। তার দুইছেলেকে একসাথে কাছে পাওয়ার অপেক্ষার সমাপ্তি ঘটল আজ।
রোহান রাতে খেয়েই চলে গেলো। রাজিয়া আটকায় নি, বেশি চাইতে গেলে যদি হারিয়ে ফেলেন! এইটুকুতেই তিনি সন্তুষ্ট।
যাওয়ার আগে বললেন,
রাজিয়া: সাবধানে যাবি কিন্তু। বাসায় পৌঁছে ফোন দিবি।
রোহান মনে মনে বলছে,
রোহান: তুমি বলেছো তাই সাবধানেই যাবো এখন। আমার অপেক্ষায়ও কেউ থাকবে এই আশায় সাবধানে চলবো আজ থেকে। আমার মা, আমার ভাই-বোন আমার অপেক্ষায় থাকবে। এখন আমার ফোনের অপেক্ষায় কেউ থাকবে। আমি এখন আর একা নই। আমার একাকীত্বের সমাপ্তি হয়েছে।
২৫।
রাতে ইশা বারান্দায় দাঁড়িয়ে কান্না করছিলো। ঝরঝর করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। নিঃশব্দ কান্না, যাতে কেউ শুনতে না পায়। নিজেকে অসহায় মনে হচ্ছে খুব। তার দোষটি কোথায়? সে মুহিবকে একসময় খুব ভালোবেসে ছিলো। কিন্তু এখন দিব্য তার জীবনের অর্ধেক জায়গা জুড়ে আছে। যেখানে মুহিবের কোনো অস্তিত্বই আর নেই। তবুও মুহিব নামের কালো অধ্যায়টি তার জীবন থেকে কেনো যাচ্ছে না? কেনো তাকে শান্তিতে বাঁচতে দিচ্ছে না?
মানুষের জীবনে এমন কিছু প্রেম আসে যা তার ভবিষ্যৎ জীবনের জন্যও ক্ষতিকর। কেন আসে এসব ক্ষতিকর প্রেম? কেন একটু অপেক্ষা করলো না সে? দিব্যের মতো উত্তম পুরুষ তার জন্য সৃষ্টি করে রেখেছিলেন সৃষ্টিকর্তা। কি এমন ক্ষতি হতো অপেক্ষায় থাকলে? একটু অপেক্ষা করলে আজ হয়তো তার এভাবে অতীতের বোঝা টানতে হতো না। এখন শুধু দিব্য না রোহানের চোখেও সে লজ্জিত হয়ে পড়েছে। খুব ছোটো মনে হচ্ছে নিজেকে।
মুহিব কখনো ইশাকে ছুঁয়ে দেখেনি। কিন্তু কে বিশ্বাস করবে? কেউ বিশ্বাস করবে না। কেউ মেনে নেবে না। ইশার বাবা-মা এখনো জানে না। যদি জানতে পারে তারা কখনো দিব্যের সামনে মাথা উঠিয়ে দাঁড়াতে পারবে না আর। দিব্য যদি কখনো খোঁচা দেয়? কোথায় যাবে সে? কাকে বুঝাবে?
জীবনের গল্প যদি পেন্সিলে লেখা হতো ইশা পাতা উল্টিয়ে সব মুছে দিতো। কিন্তু গল্পগুলো লেখার জন্য কলমের কালি ব্যবহার করা হয়। কেটে দিলে আরো বিশ্রী হয়ে পড়ে। আর মুছে দিতে গেলে দাগ থেকে যায়।
মেয়েদের জীবনটা বড়োই জটিল, ছোট ছোট ভুলগুলোও বড়ো বিপদ ডেকে আনে।
দিব্য ঘরে ঢুকে ইশাকে দেখতে পেলো না। বারান্দায় উঁকি দিয়ে দেখলো ইশা দাঁড়িয়ে আছে। ইশার খোলা চুলগুলো হালকা হাওয়ায় উড়ছে। দিব্য মুখ ডুবিয়ে দিলো চুলগুলোতে। পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ইশাকে। ভয়ে কিছুটা কেঁপে উঠল ইশা।
দিব্য: ভয় পেয়েছো অপ্সরী? আমি। তোমার বর। আর কে হবে বলো?
ইশা: হুম।
দিব্য বুঝতে পেরেছে ইশা এতোক্ষণ কেঁদেছিলো। দিব্য ইশাকে ঘুরিয়ে সামনে আনলো।
দিব্য: কেনো কাঁদছে আমার বউটা? কে কষ্ট দিয়েছে?
ইশা কাঁপা গলায় বলল,
ইশা: আ….আ….আজকে ও…..
দিব্য: বলতে হবে না ইশা, আমি জানি। রোহান বলেছে।
ইশা তার দুহাত দিয়ে দিব্যের মুখ স্পর্শ করলো।
ইশা: বিশ্বাস করো আমি ওর সাথে কোনো যোগাযোগ করি নি। আমি তোমাকে ভালোবাসি। খুব ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে। প্লিজ আমাকে ছেড়ে যেও না। আমি সহ্য করতে পারবো না।
ইশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। ইশার কথাগুলো দিব্যের বুকে গিয়ে আঘাত করছে। তার অপ্সরী কষ্ট পাচ্ছে? সে ইশাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখতে পারবে না।
ইশাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে দিব্য।
দিব্য: তুমি ভাবলে কিভাবে তোমাকে ছেড়ে আমি যেতে পারি? তুমি ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ। তুমি এখন আমার পরিবার। পরিবার ছাড়া মানুষ ভালো থাকতে পারে না। তোমার কোনো দোষ নেই ইশা। ছেলেটি ভালো ছিলো না তোমার জন্য। তাই আল্লাহ আমাকে বানিয়েছেন তোমার খেয়াল রাখার জন্য, তোমার চোখগুলোর গভীরতা বোঝার জন্য, ঠোঁটে আসা কথাগুলো বোঝার জন্য, দুহাত দিয়ে তোমার দুকান ঢেকে দেওয়ার জন্য যখন কোনো খারাপ ভাষা তোমায় স্পর্শ করতে আসবে, তোমার মনের ভাষা পড়ার জন্য, তোমাকে খুব খুব ভালোবাসার জন্য।
ইশা: আমি খুব ভাগ্যবতী। তাই তোমার মতো বর পেয়েছি আজ। এতো সুখ কি আমার কপালে আছে দিব্য?
দিব্য: সুখ-দুঃখ নিয়েই তো জীবন। আমি তোমাকে একটিই প্রমিস করতে পারি। আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করবো তোমাকে খুশি রাখার। আর যতোদিন বেঁচে থাকবো এই মনে আর কাউকে জায়গা দেবো না, এখানে শুধু তোমার অধিকার। কেউ আশেপাশে আসলেই তুমি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেবে কিন্তু। চুপচাপ দূরে সরে যাবে না আমার থেকে। আর সবসময় আমাকে প্রশ্ন করবে, সবকিছুতেই। আমি কখনো বিরক্ত হবো না। কিন্তু সন্দেহ করবে না ইশা।
দিব্য মনে মনে বলছে,
দিব্য: অনেক কষ্ট পেয়েছে আমার মা। অনেক কেঁদেছে, তোমাকে আমি কখনো এমন কষ্ট দেবো না। আমার রাজ্যে তুমি ছাড়া আর কোনো নারীর ছায়াও আসবে না কখনো।
সকালে দিব্য রোহানকে ফোন দেয়, খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে হবে।
তারা দুজনেই নাস্তা করে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়ে। রোহান দিব্যকে বাসার সামনে এসে নিয়ে যায়। পায়ের ব্যথা আজ অনেকটা কমেছে দিব্যের। আরো কিছুদিন বিশ্রাম প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু এই মুহূর্তে ইশার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আর কিছুই নেই দিব্যের কাছে। ইশার বান্ধবী মারিয়ার সাথে দেখা করে দুইভাই। কাল রাতেই মারিয়াকে ফোন দিয়েছিলো দিব্য। মারিয়া মুহিব সম্পর্কে জানতে পারবে, কারণ মারিয়ার ফ্রেন্ড সানির বন্ধু হচ্ছে মুহিব। দিব্য আর রোহান মুহিবের বাসায় যায়। মুহিবের মা-বাবা বাসায় ছিলো।
মুহিবের মা: আপনারা কাকে চাচ্ছেন?
রোহান: মুহিব আছে বাসায়?
মুহিবের মা: হ্যাঁ, আছে।
দিব্য: আপনি কি মুহিবের মা?
মুহিবের মা: জি।
দিব্য: আপনার ছেলে সম্পর্কে কথা আছে গুরুত্বপূর্ণ। বাসায় কি আংকেল আছেন?
মুহিবের মা: হ্যাঁ, বাসায় আছে। আপনারা বাসায় আসেন।
রোহান: না, আপনি আংকেলকে ডাকবেন দয়া করে?
তারা দুজনে আসলো।
মুহিবের বাবা: কি সমস্যা? তোমরা আমার ছেলে সম্পর্কে কি বলতে চাও?
দিব্য সব খুলে বলল দম্পতিকে। মুহিবের বাবা-মা দুজনেই লজ্জিত ছেলের কর্মকান্ড শুনে। মুহিব বাসায় ছিলো। গতকাল রোহান যেভাবে মেরেছিলো এখনো ব্যথা আছে শরীরে। মুহিবকে ডেকে আনা হয় তাদের সামনে।
মুহিবের বাবা: তুই নাকি অন্যের বউকে বিরক্ত করছিস?
মুহিবের মা: মুখ বন্ধ কেন তোর? কিছু বল।
মুহিবের কিছু বলার ভাষা নেই। কারণ এখন সে নিজেই দোষী। ইশা অনেক আগেই সবকিছু শেষ করে দিয়েছিলো। কিন্তু সে ইশাকে ভুলতে পারে নি। ইশাকে অনেক ভালোবাসতো মুহিব। কিন্তু এটি সুস্থ মানুষের ভালোবাসা হতে পারে না।
অসুস্থ ভালোবাসার চেয়ে ঘৃণা করা উত্তম। মুহিবের কিছুই করার নেই, সে নিজের দোষে ইশাকে হারিয়েছে। সে জানে ইশা আর তার ফিরে আসবে না। তবুও ইশাকে বিরক্ত করে মজা পায় সে। ইশাকে মানসিক চাপে রাখতে সে অনেক আনন্দবোধ করে, এটিকে আর যায় বলুক ভালোবাসা বলা যায় না।
মুহিবের কোনো উত্তর না পেয়ে মুহিবের মা খুব জোরে থাপ্পড় মারেন মুহিবকে। মুহিব অপরাধীর মতো গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রোহান: আর কখনো এমন কিছু যদি হয়, আমরা আপনার ছেলের বিরুদ্ধে মামলা করতে বাধ্য হবো।
দিব্য মুহিবের কাছে এসে তার কাঁধে হাত রেখে বলল,
দিব্য: কাউকে কষ্ট দিয়ে কখনো সুখি হওয়া যায় না। তোমার বাবা-মা আছে, বোন আছে, সুন্দর একটি পরিবার আছে। ঠিক আমারও একটি পরিবার আছে। তোমার জন্য তোমার পরিবার যেমন গুরুত্বপূর্ণ আমার জন্য আমার পরিবার। আর আমার পরিবারে ইশাও আছে। ইশা এখন আমার বউ। মুহিব, তুমি নতুন করে জীবন শুরু করো। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না। তোমার পুরো পরিবার তোমার উপর নির্ভরশীল। তোমার একটি ভুল পুরো পরিবারটিই ধ্বংস করে দেবে। আর একটি কথা মনে রাখবে আমি আমার ইশার পাশে আছি। কোনো খারাপ নজর আসতে দেবো না তার আশেপাশে। তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। যা করেছো আর যাতে না হয়। ইশার আশেপাশে থাকা, ইশাকে ফোন দিয়ে বিরক্ত করা এসব যাতে আর না শুনি। ভালো হবে না কিন্তু।
দিব্য আজ নিজ হাতে ইশার পুরোনো দাগ মিটিয়ে এসেছে। দিব্য আর কখনো তার অপ্সরীর কাছে এই অতীতের ছায়া আসতে দেবে না।
তারা গাড়ীতে উঠে পড়লো।
রোহান: আজ বাসায় চল।
দিব্য: কার বাসায়?
রোহান: আমার বাসায়।
দিব্য: না।
রোহান: ওইদিন যা করেছিলাম তার জন্য এখনো ক্ষমা করিস নি?
দিব্য: ক্ষমা না করলে কি এখন তোর পাশে আমায় দেখতি? আমি কি তোর সাথে রাগ করতে পারি?
রোহান: বাসায় চল তাহলে।
দিব্য: রোহান, আমি ওই বাসায় যেতে পারবো না, যে বাসার মালিক আমার মাকে কষ্ট দিয়েছিলো। আমি কখনো সেই বাসায় পা রাখতে পারবো না। আমি জানতাম না তাই গিয়েছিলাম তোর সাথে দেখা করতে।
রোহান: তুই বাবাকে ভুল বুঝছিস, বাবার কি অপরাধ ছিলো?
দিব্য: অপরাধ নেই? ওহ, আমার মায়ের অপরাধ ছিলো?
রোহান: দিব্য, কি হয়েছে তাদের মধ্যে আমরা কিভাবে জানবো যদি জানার চেষ্টা না করি।
দিব্য: আমার জানার ইচ্ছে নেই।
রোহান: কোনো ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে নিশ্চয়। সব ঠিক করে দেওয়া যায় না?
দিব্য: শাট আপ রোহান। তোর বাবাকে এনে আমাদের মাঝে সমস্যা সৃষ্টি করবি না। আমি চাই না তোর সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাক।
রোহান আর কিছুই বলল না। এখন দিব্যকে কিছু বললে সমস্যা আরো বাড়বে। দিব্য ইশাকে নিয়ে এমনিতেই চিন্তিতো এখন। আর দিব্যের সাথে এই ব্যাপারে কথা বললে হয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে। এতো বছর পর সে ভাইকে ফিরে পেয়েছে। আবার সব হারাতে পারবে না। ভালো সময়ের অপেক্ষা করতে হবে শুধু।
২৬।
রিক্ততার সাথে কেটে গেলে কয়েকটিমাস। এই কয়েকমাসে কারো জীবনে এসেছে নতুন ছোঁয়া, কারো জীবনে এখনো আছে অপেক্ষার রেশ। কেউ কেউ পুরোনো অপেক্ষার আশা ছেড়ে নতুন অপেক্ষার প্রহর গুনছে।
সবকিছুর মাঝেও দিব্য-ইশার ভালোবাসার কোনো কমতি হচ্ছে না। ইশা এখন বাবার বাসায় থেকেই পড়াশুনা করছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে তাকে উঠিয়ে নেয় নি, অপেক্ষা দিব্যের ভালো জব পাওয়ার। তারপর সে চলে যাবে পরিচিত মানুষ, পুরোনো পরিবেশ ছেড়ে নতুন পরিবেশে। তবে মাঝে মাঝে শ্বশুর বাড়ী যায়, পাশাপাশি বাসা যেহেতু।
রোহান এখন প্রতিদিন রাজিয়ার খবর নেন। দুইভাইয়ের আড্ডা জমে চায়ের দোকানে, কখনো বা বাসার নিচে গেইটের সামনে, খোলা আকাশের নিচে, কখনো কখনো স্মৃতি তাজা করতে চলে যায় ভার্সিটিতে। বেশ ভালোই কাটছে রোহানের দিনকাল। কিন্তু এখনো মাঝে মাঝে ইশার দিকে চোখ পড়লেই ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়। কারণ তার প্রথম ভালোবাসায় তার আর কোনো অধিকার নেই। তবে রোহানের কোনো অপেক্ষাও নেই। কার অপেক্ষায় থাকবে? ইশার? সে তো অন্যের মনে ঘর বেঁধে ফেলেছে। ইশা হয়তো রোহানের শেষ ভালোবাসা। কারণ রোহান আর কারো সাথেই নিজেকে জড়াতে চায় না। আজকাল ইশার অস্তিত্ব রোহান ভালোই বুঝতে পারে। অভ্যাস হয়ে গেছে এখন। ইশার সুর, ইশার হাতে রান্না করা খাবার, ইশার ছায়া, হাঁটার শব্দ সবকিছুই এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
রোহানের কি নির্মম ভাগ্য! যাকে ভালোবেসেছে সে হয়ে পড়েছে তার ভাইয়ের বউ। অন্য কারো হলে রোজ রোজ চোখের সামনে পড়তো না। আর ভুলে যাওয়ারও সুযোগ ছিলো। তবুও রোহান নিজের চোখ সংযত রেখেছে যতদূর সম্ভব। সীমালঙ্ঘন করা রোহানের দ্বারা সম্ভব না। রোহান এমন ছেলেও না। আর নিজের সন্তুষ্টি তার কাছে দিব্যের খুশির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তো কখনোই না।
এদিকে অনিকের সাথে বন্ধুত্ব ভালোই হয়েছে রোহানের। অনিক দিয়াকে পছন্দ করে ব্যাপারটি বুঝতেও পেরেছে দিব্য-রোহান। তাই আজকাল অনিকের সাথে আড্ডায় বসলে তারা বাসার চেয়ে বাইরের পরিবেশকেই প্রাধান্য দেয়। আর অনিক যতোই ভালো হোক, দিয়ার বিয়ের বয়স এখনো হয়নি। আর কোনো ভাই চায়ও না তার নিজের বোন, তারই বন্ধুর সাথে প্রেম করুক। তাই নিজেদের মতো করে তারা সামলাচ্ছে অনিকের ব্যাপারটি। আর অনিক যদি সত্যি সত্যি দিয়াকে ভালোবাসে তবে একেবারে বিয়েই হবে। বিয়েতে তাদের আপত্তি নেই, তবে প্রেম করা চলবে না।
অন্যদিকে রক্তিমের জ্বলন্ত ভালোবাসার মোম হঠাৎ নিভে যায় কোনো হাওয়া ছাড়া। আর এই কারণে রিধির মনে জ্বলে উঠেছে বিষাদের শিখা।
রক্তিমের পাগলের মতো ভালোবাসা, রিধির উপর ভালোবাসার অধিকার দেখানো, এসব কিছু রিধি কিছুমাস আগেও পাত্তা দেয় নি। আর আজ রক্তিমের একটু কাছে টেনে নিয়ে বলা, ‘রিধি তোমাকে ভালোবাসি’, এই কথাটি শুনার জন্য মন বড়োই ছটফট করছে রিধির। কিন্তু রক্তিম এখন রিধির সাথে খুব কমই কথা বলে। তবে কি রক্তিম এখন রিধিকে আর ভালোবাসে না?
এই কয়েকমাসে রিধির ইন্টার ফাইনাল শেষ। ইউনিভারসিটিতে ভর্তির জন্য পড়াশুনা করছে, তবে বেশি চাপ নিচ্ছে না। কারণ তার ইচ্ছে নেই মেডিকেল বা ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটে পড়ার। জার্নালিজম নিয়ে পড়ার ইচ্ছে তার।
রিধি আর দিয়া বিকেলে বের হলো বাসা থেকে। এই বছরটি খুবই পরিশ্রম করেছে তারা। ভর্তি পরীক্ষা শেষ হলেই লম্বা ছুটিতে যাবে দুই বান্ধবী। কোথায় যাবে এই প্ল্যান করছে এখন।
রিধি: ভাবছি, পরীক্ষা শেষ হলে সাজেক যাবো।
দিয়া: কক্সবাজার যায় চল।
রিধি: সিলেট গেলে কেমন হয়?
দিয়া: সুন্দরবন যাবি? বাঘ দেখবো।
রিধি: বাঘ চিড়িয়াখানায় গিয়েও দেখা যাবে।
দিয়া: আচ্ছা, কুমিল্লা যায় চল।
রিধি চোখ ছোট করে দিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
রিধি: কুমিল্লা কেন? চল আফ্রিকার জঙ্গলে যায়। সেখানে গিয়ে আমরা দুইজন বিয়ার গ্রিলসের মতো টিকটিকি, সাপ, বিচ্ছু খেয়ে প্রোটিন বাড়াবো শরীরে।
দিয়া: ইয়াক। রিধি কি বলছিস এসব? ছিঃ। ভাবলেই গা শিরশির করে।
রিধি: প্ল্যান করছি। একটা একটা কর। আমি একটা, তুই একটা বললে হবে?
দিয়া: আমার জীবনে নতুন কোনো রস নেই রে দোস্ত। তুই প্ল্যান কর বরং।
রিধি: কেন রে? কি হয়েছে?
দিয়া: প্রথমে এক ভাইয়ের যন্ত্রণা কি কম ছিলো? এখন আরো একটা ভাই এসে আমার জীবন তেজপাতা করে দিয়েছে।
রিধি: কেন? কি হয়েছে দোস্ত?
দিয়া: ভেবেছি পরীক্ষার পর প্রেম করবো। কিন্তু প্রেমতো বহুদূর, সকালে এক ভাই যায় দিয়ে আসতে আর বিকেলে আরেক ভাই যায় নিয়ে আসতে কোচিং থেকে। তাদের চৌকিদারীর জন্য কোনো ছেলে আসেও না কথা বলতে। ছেলেদের দিকে তাকানোর সুযোগও নেই। দেখলেই বলে, নিচের দিকে তাকা। আশেপাশে কি দেখছিস? ভাই দুইটা আমার জীবন তেজপাতা করে দিলো।
রিধি দিয়ার কথা শুনে হাসছে।
দিয়া: হাসিস না। বড়ো ভাই থাকলে আর যায় হোক প্রেম করা যায় না শান্তিতে। আদৌ কেউ করতে পারলে সে তো লিজেন্ড। আমার তার অটোগ্রাফ চায়।
রিধি: এতো প্রেম করে কি হবে একদিন তো বিয়ে হবেই। তোর ভাইয়া-ভাবীর প্রেম কিন্তু ভালোই হচ্ছে। বিয়ে করে ফেলেছে। এখন শান্তিতে প্যারাহীন প্রেম করছে। ধরা খাওয়ার ভয় নেই, মিথ্যে বলে দেখা করার দরকার নেই, রাত জেগে আরাম করে ফোনে কথা বলা যাবে। বাথরুমে ঢুকে পানির কল ছেড়ে আর শীতের দিনে পাখা চালিয়ে কথা বলতে হবে না।
দিয়া: ওরে বাবা, এতোকিছু করতে হয় প্রেম করলে? বাই দা ওয়ে, তুই কিভাবে জানিস এতোকিছু? প্রেম করছিস কারো সাথে? আমাকে কেন বলিস নি? আমি রাগ করেছি। হুহ।
রিধি: যাহ! না, প্রেম করছি না। প্রেমিকের খবর নেই, রিধির চোখে ঘুম নেই।
দিয়া: ওহো! রক্তিম ভাইয়া?
রক্তিমের নাম শুনে রিধির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
রিধি: রক্তিম এখন আমাকে আর তেমন পছন্দ করে না। আগের মতো কথাও বলে না। নিজের মতো থাকে।
দিয়া: তোর তো খুশি হওয়া উচিত।
রিধি: হ্যাঁ, কিন্তু আমার ভালো লাগছে না কেন?
দিয়া: প্রেমে পড়ে যাসনি তো?
রিধি: কি বলছিস? কখনো না।
দিয়া: হতেও তো পারে। ভালোবাসা কি বলে আসে? কখন তোমার মনের জানালা দিয়ে ঢুকে যাবে, আর তুমি জানালা বন্ধ করার সুযোগই পাবে না।
রিধি: এমন কিছুই না। আর রক্তিম তো আমার সাথে কথা বলছেও না ঠিকমতো। পঁচা মাছ।
দিয়া: পঁচা মাছ কে?
রিধি: রক্তিম।
দিয়া: আমার মনে হয় রক্তিম ভাইয়া অন্য কাউকে পছন্দ করে। উনার গার্লফ্রেন্ড থাকতে পারে।
কথাটি শুনে রিধির বুকের ভেতরটা নাড়া দিয়ে উঠল। রক্তিম অন্য কাউকে ভালোবাসে? তাহলে এতোদিন কি ছিলো? আর ভালোবাসলেও তার কি? তার কেন কষ্ট হবে? সে তো আর রক্তিমকে ভালোবাসে না।
রিধি নিজেকে বকছে এখন,
ছিঃ রিধি কি ভাবছিস এসব? তুই ওই রাক্ষসটাকে নিয়ে ভাবতেও পারলি কিভাবে এমনটি? না, না। কখনো না।
জোরে শ্বাস নিয়ে আস্তে করে ছাড়লো রিধি।
আর মনে মনে বলছে,
রিধি: রিলেক্স রিধি, রিলেক্স। কুল ডাউন। রক্তিমকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।
রিধি বাসায় এসে রক্তিমকে কারো সাথে ফোনে হেসে হেসে কথা বলতে দেখলো। রাগে রিধির মাথাটায় গরম হয়ে যাচ্ছে এখন। একটিবারের জন্যও তাকাচ্ছে না। মুখ ভেংচি দিয়ে রুমে চলে গেলো রিধি। এরপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। বুড়ো হয়ে যায় নি তো? ইশ, চোখের নিচে কালি পড়েছে পড়াশুনার চাপে। চুলগুলোও ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। অনেক শুকিয়ে গেছে রিধি। হয়তো এই কারণে রক্তিম আর ফিরে তাকাচ্ছে না।
তবে ভালোবাসা কি চাকচিক্য দেখে হয়? ভালোবাসায় তো মনের সৌন্দর্য দেখে।
রিধি রুমের দরজা খুলে মাথা বের করে আবার রক্তিমকে দেখছে। এখনো সোফায় শুয়ে শুয়ে কথা বলছে।
রিধি মনে মনে ভাবছে,
এতোক্ষণ কেউ নিজের ফোনের টাকা খরচ করে কথা কেন বলবে? আর যেভাবে কথা বলছে মনে হচ্ছে রাখার কোনো সম্ভাবনা নেই। কোনো মেয়ের সাথে কথা বলছে হয়তো! দাঁড়াও, তোমার কথা বলা বের করছি।
রিধি রক্তিমের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওয়াইফাই লাইন বন্ধ করে দেয়। তারপর আস্তে আস্তে নিজের রুমে চলে যায়।
এদিকে রক্তিম হ্যালো হ্যালো করছে। আর রিধি মুখ চেপে হাসছে। রক্তিম দেখলো নেটওয়ার্ক নেই। পরে গিয়ে দেখলো ওয়াইফাই লাইন বন্ধ।
রক্তিমের খুব রাগ হলো। তারপর চেঁচিয়ে ডাকলো,
রক্তিম: রিধি, রিধি।
রিধি ভদ্রমেয়ের মতো রক্তিমের সামনে এলো।
রক্তিম: মেইন লাইন কে বন্ধ করেছে?
রিধি কিছু বুঝতে পারছে না এমন ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রক্তিম: কি বলছি? কানে ঢুকছে না?
রিধি: আমি তো বুঝতে পারছি না কি বলছেন আপনি?
রক্তিম: তুমি বন্ধ করেছো?
রিধি: আমি কেন বন্ধ করতে যাবো?
রক্তিম: তুমি ছাড়া এই শয়তানী আর কে করতে পারে?
রিধি: আমি শয়তান? আপনি হচ্ছেন পঁচা মাছ, কাকের ময়লা পা, ডাস্টবিনের পলিথিন। হুহ।
রিধি রুমে এসে বিড় বিড় করছে এখন।
এতো গুরুত্বপূর্ণ ছিলো মেয়েটির কল? কোন পেত্নীর সাথে কথা বলার জন্য আমাকে রক্তিম শয়তান বলেছে? দাঁড়াও, আগে আসো আমার সামনে, শয়তান কাকে বলে বুঝিয়ে দেবো দুজনকে। আই হেইট ইউ রক্তিম। আমি তোমাকে পাত্তা দিচ্ছি না আর। হুহ হুহ হুহ।
রক্তিম এখন সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে রিধির রুমের বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে আছে আর বাঁকা হাসি দিচ্ছে।
রক্তিম: রিধি বেবি, কিছু পুড়ে যাওয়ার গন্ধ নাকে লাগছে।
দহনে বিরোহে কেটে গেলো মোর এতোটা বছর,
আজ হবে নতুন খেলা গুনছি তার প্রহর।
ভালোবাসার এই অপেক্ষায় কাটিয়েছি আমি অর্ধ-যুগ,
তোমাকেও দিতে হবে আমার অপেক্ষার শোধ।
ওয়াও রক্তিম ওয়াও, কি কবিতা বানিয়েছিস। এখন জমবে এই অপেক্ষার খেলা।
চলবে—
আগের পর্বের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/374093307645781/