অপেক্ষা লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ পর্ব-(২৯+৩০+৩১)

অপেক্ষা
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ
পর্ব-(২৯+৩০+৩১)

২৯।
রিধি গেইটের বাইরে পা রাখার সাথে সাথেই নবনী-জুনাইয়েতের মুখোমুখি হলো।

তারা রিধিকে কাঁদতে দেখে বলল,
নবনী: কি হয়েছে রিধি? তুই কাঁদছিস কেন?

রিধি: কিছু হয়নি মা।

জুনাইয়েত: কিছু না হলে এখন কোথায় যাচ্ছিলি? রক্তিম কিছু বলেছে তোকে?

রিধি: কয় না তো! কিছু বলেনি।

এমন সময় রক্তিম রিধির পেছনে এসে দাঁড়ালো। বাবা-মাকে দেখে মনে মনে ভয় পেয়ে গেলো রক্তিম।

রক্তিম: তোমরা চলে এসেছো?

নবনী: হ্যাঁ, দেখছিস না? রিধিকে কি বলেছিস? ও কাঁদছে কেন?

রক্তিম চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।

রিধি: তোমরা বাসায় চলো এইখানেই বিচার শুরু করবে?

নবনী-জুনাইয়েত বাসায় আসার পর রক্তিমকে আবার জিজ্ঞেস করলো।

এবার অদিতি বলল,
অদিতি: মা, তোমার রক্তিম না খুব খারাপ! রিধিকে বকেছে। আমি বলেছিলাম ওকে পড়াতে। কিন্তু ও আমাকে সময় দেওয়ার জন্য রিধিকে পড়াচ্ছে না। আমি এতোবছর পর এসেছি তাই। কিন্তু রিধিকে সাহায্য করাও তো ওর দায়িত্ব?

নবনী-জুনাইয়েত রক্তিমের দিকে তাকিয়ে আছে কড়া চোখে।

জুনাইয়েত: তোর আর রিধি কে পড়াতে হবে না। আমি রিধির জন্য বাসায় টিচার রাখবো।

রক্তিম: বাবা, আমি পারবো পড়াতে। আর মাত্রকয়েকটা দিনই তো।

রিধি: না বাবা, লাগবে না। আমার তেমন কোনো সমস্যা নেই। আমি পারবো। একটু সমস্যা ছিলো রক্তিম ভাইয়া বুঝিয়ে দিয়েছেন।

রক্তিম অবাক হলো ভাইয়া ডাক শুনে। রিধি কখনো রক্তিমকে ভাইয়া ডাকে নি। রক্তিম বলেই ডাকতো। বাবা-মার সামনেও রক্তিম বলতো তাকে। মাঝে মাঝে দুষ্টুমি করে ভাইয়া ডেকেছিলো। তাতেই রক্তিম ক্ষেপে যেতো। আসলে রক্তিমকে ক্ষেপানোর জন্যই ভাইয়া বলতো রিধি। কারণ রিধি বুঝেছিলো রক্তিমকে ভাইয়া বললেই ক্ষেপে যায়। কিন্তু আজ রিধির ভাইয়া শব্দে রক্তিমকে ক্ষেপানোর কোনো প্রকাশ ছিলো না। এই শব্দ যেন রক্তিম আর রিধির মাঝে এক অদৃশ্য দেয়াল বানিয়ে দিয়েছে। রক্তিমের ভালোবাসার অপেক্ষার সময় যেন আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।

এমনি করেই এক সপ্তাহ কেটে গেলো। রক্তিম রিধির সাথে কথা বলার কোনো সুযোগ পেলো না। কারণ রিধি রক্তিমকে আর সেই সুযোগ দেয় নি। রুম বন্ধ করেই বসে থাকতো বেশিরভাগ সময়। নবনী-জুনাইয়েত ভেবেছেন পড়াশুনার চাপে আছে তাই হয়তো সারাদিন রুম বন্ধ করে পড়ছে। কিন্তু কে জানতো দুটি চোখ অনবরত বিরোহের আগুনে দগ্ধ হচ্ছে। রিধি ভালোবেসে ফেলেছে রক্তিমকে, খুব বেশিই হয়তো। রক্তিমকে নিজের থেকে আলাদা করে নেওয়ার যন্ত্রণা তাকে রাত দিন কাঁদাচ্ছে।

ভালোবাসা এতো যন্ত্রণাদায়ক, এটি আগে জানলে রিধি তার চোখ বন্ধ করে রাখতো, যে চোখ রোজ রক্তিমকে খুঁজে। মনটাকে আটকে রাখতো, যে মন শুধু রক্তিমের অপেক্ষায় থাকে। আবেগ অনুভূতিগুলো পুড়িয়ে ফেলতো, যা শুধু রক্তিমকে নিয়ে স্বপ্ন দেখায়।

এদিকে সারাদিন রিধির সাথে কথা বলার সুযোগ না পেলে রাতটিকেই বেছে নেয় রক্তিম। আর সারাদিন অদিতি পেছনে পরেই থাকে রক্তিমের। অফিসে গেলেই যেন রক্ষা পায় সে। এখন প্রতিরাতে সবাই ঘুমানোর পর রক্তিম রিধির রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। রিধিকে ডাকে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া আসে না।

দুটি অস্তিত্ব দাঁড়িয়ে থাকে দরজার এপারওপার। অনুভূতিগুলো প্রকাশের ভাষা পায় না। বড়ো দেয়াল দাঁড়িয়ে আছে দুটি মনের মাঝে। শুধুমাত্র হতাশার নির্বাক ঢেউ বেরিয়ে আসে।
রক্তিম এখন নিজেকেই অপরাধী ভাবছে। তার লাগানো আগুনে সে নিজেও দগ্ধ হচ্ছে, রিধিকেও দগ্ধ করছে। নিভানোর সুযোগ দিচ্ছে না এই ভাগ্য।

কয়েক দিন আরো কেটে যায়। শুরু হয়ে যায় রিধিদের এডমিশন এক্সাম। ভাগ্য তাদের ইচ্ছের অপূর্ণ রাখে নি। রিধি চট্টগ্রামের নামকরা ইউনিভারসিটিতে জার্নালিসমে ভর্তির সুযোগ পায়। দিয়ারও একই ইউনিভারসিটিতে বায়োকেমিস্ট্রিতে নাম আসে। দুই বান্ধবী খুবই খুশি। তাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার ভয় নেই আর। সেই খুশিতে দুই বান্ধবী পার্টি দেয়। ছোটবেলা থেকেই তারা একই স্কুল, একই কলেজে পড়েছে। আর এখন একই ভার্সিটিতেও পড়ার সুযোগ হলো।

তাদের ইচ্ছানুযায়ী তাদের প্রিয় জায়গায় ঘুরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয়। রিধির ইচ্ছে ছিলো সিলেট যাওয়ার আর দিয়ার কক্সবাজার আর সেন্টমার্টিন। প্রথমে তারা সিলেট যাবে, পরবর্তীতে কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু ওইসময় রক্তিমদের কোম্পানিতে কাজের চাপ বেশি থাকায় রক্তিম আর জুনাইয়েত যেতে পারে নি। রিধির সাথে নবনী আর অদিতি যায়। আর দিয়ার সাথে দিব্য, ইশা, রোহান আর ইফতি।
তারা পাঁচদিন ছিলো সিলেটে। এই পাঁচদিন ইচ্ছে মতো মজা করেছে রিধি। রক্তিমকে ভুলে থাকার এটি একমাত্র উপায় ছিলো।

আর এই পাঁচদিন রিধিকে ছাড়া রক্তিমের বাসায় অসহ্য লাগা শুরু হয়ে যায়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে পড়ে। আর রাগ সব অফিসের কর্মচারীদের উপর ঝাড়ে। জুনাইয়েত হোসেইন ছেলেকে ভালো মতোই লক্ষ করছিলেন। রাত জাগা, রিধির রুমে গিয়ে বসে থাকা, এসব জুনাইয়েত হোসেইন খেয়াল করেছেন এই কয়েকদিনে। কিন্তু তার মাথায় আসছে না রক্তিম এমন কেন করছে? কারণ রিধিকে নিয়ে রক্তিমের অন্য ধরণের অনুভূতি থাকতে পারে এটি তিনি কল্পনাও করেন নি।
আর রক্তিম ভালোই বুঝেছে রিধি এখন একপ্রকার অক্সিজেন তার জন্য। সে পারবে না একমুহূর্তও তাকে ছাড়া থাকতে। ছটফট করছে তার মন।

আর এদিকে সিলেটে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলো না রোহানের। কারণ হলো দিব্য-ইশা। রোহান জানে সে দিব্য আর ইশাকে একসাথে দেখে কষ্ট পাবে। তবুও দিয়া জোর করছিলো তাই এসেছে। ছোটবোনের আবদার পূরণ করার সুযোগ পেয়েছে এতোবছর পর। শুধুমাত্র তার মিথ্যে অনুভূতির জন্য তা মাটি করে দিতে পারবে না।

রাতে দিব্য আর ইশা পাশাপাশি একটি দোলনায় বসে ছিলো। যেটি দেখেই রোহানের দম বন্ধ হয়ে আসছে। হোটেলে ফিরে আসার সময় রিধির সাথে দেখা হয় রোহানের। রিধির গিটার বাজানোর খুব শখ। দিয়া থেকে শুনেছে রোহান ভালো গিটার বাজাতে পারে। এই সুযোগটা মিস দিতে চায় না রিধি।

রিধি: হাই, রোহান ভাইয়া।

রোহান: হাই।

রিধি: দিয়া বলেছে আপনি খুব ভালো গিটার বাজাতে পারেন।

রোহান মুচকি হাসি দিলো।

রিধি: ভাইয়া, আমার খুব ইচ্ছে। আমাকে শেখাবেন? প্লিজ, প্লিজ, না করবেন না। আমি আপনার লক্ষী বোনের একমাত্র বেস্ট ফ্রেন্ড।

রোহান রিধির কথা শুনে হেসে দিলো।

রোহান: আচ্ছা। চেষ্টা করবো।

রিধি মন খারাপ করে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

রোহান: কি হয়েছে?

রিধি: শুধু চেষ্টা করবো বলে লাভ নেই। এসব মিথ্যে আশা দিয়ে কি হবে? আমি তো সত্যি সত্যি শিখতে চাই। মিথ্যে মিথ্যে না।

রোহান হেসে বলল,
রোহান: মিথ্যে মিথ্যে আবার কিভাবে শেখায়? আচ্ছা কবে ক্লাস করতে চাও?

রিধি দাঁত বের করে হেসে বলল,
রিধি: আপনি যদি বলেন এখন থেকেই।

রোহান রিধির বাচ্চামো স্বভাব দেখে হেসে দিলো।

রোহান: এতোরাতে!

রিধি: এতো রাত কোথায়? মাত্র দশটা বাজে। আমার জন্য গভীর রাত হয় তিনটায়।

রোহান: বেশি রাত জাগা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো না। আচ্ছা, চলো। তোমার ক্লাস নেওয়া যাক।

রোহান গিটার নিয়ে আসলো। তারপর দুজনে হোটেলের বারান্দায় বসলো। রিধির হাস্যকর কথাবার্তা রোহানের অনেক ভালো লাগছে। ইশাকে হারানোর কষ্ট কিছুক্ষণের জন্য ভুলে গিয়েছে সে। কারণ সিলেট আসার পর থেকে তাদের একসাথে দেখে, সে না পারছে মন খুলে হাসতে, না পারছে মন খারাপ করে বসে থাকতে।

নবনী হোসেইন রুম থেকে বের হলেন রিধিকে খুঁজতে। বারান্দায় এসে রোহান আর রিধিকে একসাথে দেখলেন।

মনে মনে খুব খুশি হয়েছেন আর ভাবছেন,
নবনী: রিধির সাথে তো ভালোই মানিয়েছে রোহানকে।

নবনীকে দেখে রিধি বলল,
রিধি: মা, রোহান ভাইয়া খুব ভালো গিটার বাজায়। আমি তাই এখন থেকে ভাইয়ার কাছে ক্লাস করবো গিটার শেখার জন্য।

নবনী: ভালোই তো। আচ্ছা, আমি তোকে খুঁজতে এসেছিলাম। এখন আমি যাই। আর বিরক্ত না করি।

রোহান: ইটস ওকে আন্টি। আমরা বিরক্ত হচ্ছি না। আপনি বসতে পারেন।

নবনী: না, থাক। আমি একটু রক্তিমের বাবার সাথে কথা বলবো। তোমরা তোমাদের কাজ করো।

রক্তিম নামটি শুনেই বুকটা ধক করে উঠলো রিধির।

রিধিকে অন্যমনস্ক হয়ে থাকতে দেখে রোহান বলল,
রোহান: ক্লাস কি এখানেই শেষ করে দেবো?

রিধি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলল,
রিধি: না, না, আবার শুরু করি।

রোহান রিধির হাসিটা দেখেই বুঝেছে এই হাসিতে সেই প্রাণ নেই যেটি কিছুক্ষণ আগে ছিলো। এই হাসিটা মিথ্যে হাসি, যেই হাসি রোহান সবসময় ঝুলিয়ে রাখে মুখে। রিধির হঠাৎ মন খারাপের কি কারণ হতে পারে এটি নিয়ে রোহান আর ভাবলো না। কারণ সে রিধি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। তাই অকারণে কারণ খোঁজার প্রয়োজনও মনে করছে না সে। বরং রিধির মন ঠিক করার জন্য কয়েকটা জোকস শুনিয়ে দিলো। এসব জোকস সে অনিকের কাছ থেকেই শুনেছে। অনিক এসব জোকস বললে সবাই অনেক হাসাহাসি করতো। যদিও রোহানের কখনো হাসি পায় নি। কিন্তু রিধি হেসে দেয়। রিধিকে হাসতে দেখেই ভালো লাগছে। রোহান চায় না তার মতো চাপা কষ্ট নিয়ে কেউ থাকুক। সে মন খুলে হাসতে পারবে না তো কি হয়েছে, আশেপাশের মানুষকে তো হাসাতে পারবে!

সকালে উঠেই রিধি হোটেলের সামনে, গার্ডেনে হাঁটছিলো। দিয়া রিধির কাঁধে হাত রেখে তার সাথে সাথে হাঁটা শুরু করলো।

দিয়া: রোহান ভাইয়াকে কেমন লাগে তোর?

রিধি: অনেক ভালো। গতকাল আমাকে গিটার বাজানো শিখিয়েছে। আমার প্রথম ক্লাস।

দিয়া: সবাই রোহান ভাইয়াকে ভয় পায়। আর তুই বলাতে এতো সহজে মেনে নিয়েছে ভাইয়া? অবাক করার বিষয়।

রিধি: দেখ, রিধি জানে কোথায় কিভাবে কথা বলতে হয়। আর আমি এমনিতেই অনেক স্মার্ট। সো এটি আমার জন্য কঠিন ব্যাপার ছিলো না।

দিয়া: জানিস, রোহান ভাইয়া একটু চাপা স্বভাবের। কিন্তু কালকে তোকে আর ভাইয়াকে একসাথে দেখে মনে হয়েছে তুই পারবি ভাইয়াকে খুশি রাখতে।

রিধি: মানে?

দিয়া: মানে তোদের একসাথে মানিয়েছে। আর তুই যদি আমার ভাবী হয়ে যাস। ওয়াও কতো মজা হবে।

রিধি: দিয়া আমি রক্তিমকে ভালোবাসি।

দিয়া: কি?

রিধি: দেখ, কারো সাথে মন খুলে হাসা মানে এই না যে তাদের একসাথেই থাকতে হবে। আমি অন্য একজনকে ভালোবাসি। তেমনি রোহান ভাইয়াও হয়তো অন্য কাউকে ভালোবাসতে পারে। তুই যদি এভাবে বলিস আমার কেমন লাগতে পারে ভেবে দেখেছিস? ভালোবাসার মানুষকে পাই নি তাই কি হাসতেও বারণ? আর হাসতে দেখলে যদি লোকে অন্য ধরণের চিন্তা ভাবনা করে বসে, কোথায় যাবো? তাহলে কি আমরা হাসায় ছেড়ে দেবো?

দিয়া: সরি। আমি তো….

রিধি: জানি, তুই হয়তো ওভাবে বুঝাতে চাস নি। কিন্তু দিয়া, আজ বুঝতে পেরেছি মানুষ প্রেম করে কেন কষ্ট পায়। ক্লাসে যখন কিছু মেয়েদের দেখতাম বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকাপ হওয়ার পর কাঁদছে, তখন বুঝতে পারি নি তাদের কষ্টটা। আজ বুঝতে পারছি। প্রেমে পড়া বড়োই খারাপ, অস্তিত্বকেই পুড়িয়ে মারে। এই পুড়ে যাওয়ার গন্ধ আর ক্ষত কারোই চোখে পড়ে না। এই অনুভূতি বড়োই কষ্টের।

রিধির চোখে পানি দেখে দিয়া রিধিকে জড়িয়ে ধরলো।

দিয়া: আমি কখনো আর তোকে এসব বলবো না। তারপরও কাঁদবি না তুই। রক্তিমকে ভুলে যা। আমার বেস্টু অনেক ভালো একটা মেয়ে। দেখিস সবচেয়ে ভালো ছেলেটিই তোর জন্য সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টিকর্তা। অনেক ভালোবাসবে তোকে।

রিধি: আমি ভালো ছেলের অপেক্ষায় নেই। আমি তো আমার সৃষ্টিকর্তার কাছে একটাই আবদার করতে থাকবো, যাতে রক্তিম আমার হয়ে যায়। যতোদিন রক্তিমের উপর অন্য কারো অধিকার হবে না ততোদিন আমি চেয়ে যাবো। শেষ সেকেন্ড পর্যন্ত আমি রক্তিমের অপেক্ষায় থাকবো। বড়ো বেশি ভালোবেসে ফেলেছি যে! আর উপায় নেই ফিরে আসার। কিন্তু রক্তিমকেও আর বিরক্ত করবো না। কোনো চেষ্টা ছাড়াই অপেক্ষা করে যাবো শুধু।

৩০।

রিধিরা যেদিন বাসায় ফিরেছিলো ওইদিন রাতেই রক্তিম ভালোভাবে ঘুমোতে পেরেছে। এর কয়েকদিন পর দিয়ার পছন্দের জায়গায় যাওয়ার প্ল্যান করে তারা। এবার রক্তিমও তাদের সাথে যায়। তবে জুনাইয়েত হোসেইন যেতে পারেন নি। কারণ ব্যবসার কাজ তাকেই দেখতে হবে রক্তিমের অনুপস্থিতিতে। আর এদিকে রোহান রাজিয়াকে ছাড়া যাবেই না বলে দিয়েছে। তাই রাজিয়াও তাদের সাথে যায় কক্সবাজার। রাজিয়া রহমান যাওয়াতে নবনী হোসেইনকেও যেতে বলেন। সকাল সাতটায় তারা বাসা থেকে বের হয়। তারা বাসে করেই যাচ্ছে।
নবনী আর রাজিয়া একসাথে বসেছিলেন। তারা তো সংসারের যাবতীয় গল্পে মশগুল। আর এদিকে দিব্য আর ইশা মনের সুখে গল্প করছিলো। ইশা খুব বেশি আনন্দে আছে, কারণ তার ইচ্ছে ছিলো কক্সবাজার আসবে বরের সাথে। আজ তার ইচ্ছেও পূর্ণ হতে যাচ্ছে। ইশা সমুদ্রপ্রেমিকা। তার সমুদ্র দেখতে খুব ভালো লাগতো। আজ দিব্যের সাথে সেই ভালো লাগা ভাগ করে নিবে ইশা।
ইফতি কানে হেডফোন লাগিয়ে ঘুমিয়ে আছে। তার পাশে রোহান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে। রোহানের সামনের সিটেই বসেছিলো দিব্য আর ইশা। না চাইতেও তাদের উষ্ণ কথাবার্তা কানে আসছিলো তার। হেডফোন আনতে ভুলে গিয়েছিলো সে, তা না হলে কে শুনতে চায় প্রেয়সীর প্রেমালাপ তাও তার বরের সাথে, যে তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, তার ভাই। সহ্য করারও সীমা থাকে। রোহান পারছে না আর সহ্য করতে।

রক্তিম আর অদিতি পাশাপাশি বসেছিলো। অদিতিতো রক্তিমের কাঁধে মাথা রেখে ঘুম। আর রক্তিমের চোখে ঘুম তো বহুদূর শান্তির ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। ছটফট করছে তার মন।

আর রিধি ও দিয়া মনের সুখে গল্প করছে আর প্ল্যান করছে কি কি করবে।

হঠাৎ রিধি রোহানকে ডেকে বলল,
রিধি: রোহান ভাইয়া, একটা গান শুনাবেন?

রোহান রিধির আবদার ফেলতে পারলো না। কারণ সে চেয়েছিলো কোনোভাবে মনকে ব্যস্ত রাখতে। এই সুযোগে দিব্য-ইশাও তাদের উষ্ণ কথাবার্তা বন্ধ করে রোহানের গানে মনোযোগ দেবে।

রোহান: হ্যাঁ, শুনাতে পারি।

রিধি: কিন্তু আমি যে গানটি বলবো ওইটি গেয়ে শুনাবেন। সাথে গিটারও বাজাতে হবে, রাজি তো?

রোহান হেসে বলল,
রোহান: রাজি।

রিধির আবদার করা গানটি গাওয়া শুরু করে রোহান। তাসনিফ জামানের উৎসর্গ গানটিতে সুর দিয়ে হালকা গুঞ্জনপূর্ণ পরিবেশটিকে শান্ত করে দেয় রোহান।

“আমার সবটুকু বিশ্বাস যে দিয়েছে ভেঙ্গে
তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই,
সে দিয়েছে আমার অন্ধ চোখে আলো।
যার বিশালতার মাঝে আমি একটুকু পাই নি ঠাঁই
তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই,
সে যে দিয়েছে আমায় মহাশূন্যে আশ্রয়।
আমার সব অপূর্ণতাই যেন হয়
আমার শূন্য পথের প্রতি শ্রেয়তম আশীর্বাদ।

যখন স্বর্গদ্বারে একা দাঁড়াবো তার অপেক্ষায়
যেন আমার অভ্যর্থনা তাকে করে, অনুতপ্ত,
জানি, তখনও সে আমার হবে না তবুও
এ অপ্রাপ্তিটাই যেন আমায় করে পরিতৃপ্ত।

আজ কোনো অনুভূতির
গভীরে যেতে চাই না আর কখনো,
যেখানে নিঃশব্দ কান্নায় স্বরচিত হয় একান্ত শোক।
যা কিছু তার নির্দয় স্পর্শে দিয়েছে সৃষ্টি
নিভৃতে আমার প্রশান্ত কল্পনার ঘর, আর,
যন্ত্রণার শিবিরে যে অবাদ্ধ কান্না দেয় এক
নির্ভুল সুরের জন্ম।
তাকে আমার কাব্যে মেশাই
যেন হয় এক বিশুদ্ধ গান,
আমার এই গানই আজ উৎসর্গ হোক
তার প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা।

তবু স্বর্গদ্বারে একা থাকব তার অপেক্ষায়
যেন আমার অভ্যর্থনা তাকে করে অবনত,
জানি তখনও কিছুই আমার হবে না তবুও
এ অপ্রাপ্তিটাই যেন আমায় করে পরিপূর্ণ।”

গান শেষ করার পর রোহান অনেক হালকা অনুভব করছে। এতোক্ষণ বুকের ভেতর কষ্টের পাথর চেপে বসেছিলো। গানের সাথে সে কষ্ট রোহান বের করে দিয়েছে।

তারা বিকেলে পৌঁছে যায়। যে হোটেলে উঠেছিলো সেটি তাদের খুব পছন্দ হয়। সবকিছু প্রাকৃতিক, সমুদ্র সৈকতের সামনেই হোটেলটি। পরের দিন সকালেই তারা সমুদ্রবিলাস করতে যায়।

দিব্য আর ইশা পাশাপাশি হাটছে।

দিব্য: অপ্সরীর কেমন লাগছে?

ইশা: অ-নে-ক বেশি ভালো লাগছে। একটি কবিতা বানিয়ে ফেলেছি। শুনবে?

দিব্য: অবশ্যই। অপ্সরীর ভক্ত কি, না করতে পারে?

ইশা গলা ঝেড়ে শুরু করলো।
ইশা: সেই সমুদ্রের গর্জন আমাকে একটুও ভীত করেনি,
শুধু জানতে চেয়েছি ঐ গর্জন কি বলেছিলো।
নাম লিখে এসেছি ঐ বালির উপর তোমার,
পানির ঢল তা মুছে দিয়েছিলো।
নীল আকাশের পানে মুগ্ধ চোখে চেয়ে রয়েছিলাম,
স্নিগ্ধ হাওয়া মন ছুঁয়েছিলো।
গান ধরেছিলাম কণ্ঠনালীতে,
ব্যর্থতায় সুর হারিয়ে গিয়েছিলো।
তারার মেলার অপেক্ষায় ছিলাম,
রাতের আভায় তারা লুকিয়েছিলো।
আমি খুঁজেছি তোমায়, অনেক খুঁজেছি,
হাতটি ধরে হাঁটতে চেয়েছি,
মুগ্ধ চোখে দেখতে চেয়েছি,
শুধু তোমায় ভালোবাসতে চেয়েছি।

দিব্য: সমুদ্রের গর্জন আজ তোমায় ভীত করবে না,
কারণ আমি আছি পাশে।
পানির ঢল আমার নাম মুছে দিতে পারবে না,
কারণ তা লিখে দিয়েছি তোমার হৃদয়ে।
মুগ্ধ চোখে তুমি অন্যদিকে তাকাতে পারবে না,
কারণ পাশে তোমার বরটা আছে।
গান তোমার সুরহীন হতে পারবে না,
কারণ সুর দেওয়ার মানুষ তোমার কাছে।
আর কারো অপেক্ষায় থাকতে পারবে না,
কারণ অপেক্ষার দিন তো এখন শেষ হয়েছে।
আমায় আর খুঁজতে হবে না,
কারণ হাতটি আমি আর ছাড়ছি না।
মুগ্ধ চোখে আমায় দেখতে হবে না,
কারণ আমি তোমার ভালাবাসা ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না।

ইশা হেসে দেয় দিব্যের কবিতা শুনে।

ইশা: আমার ছোঁয়ায় বদলেছো। ভালোই কাব্য বানিয়েছো।

দিব্য: তোমার ছোঁয়ায় হারাবো নিজেকে। কোনো ক্ষতি আছে কি তাতে?

ইশা: হয়েছে হয়েছে। আর প্রেমিক পুরুষ হতে হবে না। চলো।

রিধি, দিয়া আর ইফতি গল্প করছিলো। রক্তিম রিধিকে যেই ডাক দেবে অদিতি রক্তিমের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো। এখানে এসেও রিধির সাথে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে না রক্তিম।

এদিকে তারা অনেক ঘুরাঘুরি করেছে সারাদিন। রাতে তারা হোটেলে ফিরেছে। তাদের হোটেলেই কিছু বখাটে ছেলেও উঠেছে। তাদের সাথে একটি মেয়েও আছে। তাদের দেখেই রক্তিম, রোহান আর দিব্য বুঝতে পেরেছিলো তারা কি ধরনের হতে পারে। হোটেলে আসার আগেই তারা সব মেয়েদের বলে দিয়েছে একসাথে থাকতে। কিন্তু রিধি তো এক কান দিয়ে ঢুকায় আরেক কান দিয়ে বের করে দেয় সব কথা। রাতে সে হাওয়া খাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হয়। সামনের খোলা জায়গায় এসে বসলো রিধি। চোখ বন্ধ করে বসে আছে। হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেলো। চোখ খুলে দেখলো তিনটি মাতাল ছেলে তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। রিধি ভয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ছেলেগুলো রিধির কাছে আসার চেষ্টা করছে, আর রিধি পেছনে যাচ্ছে। তার হাত পা কাঁপছে।

রোহান ওইসময় হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো ফয়সাল আহমেদের সাথে। রক্তিম রিধিদের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। দিয়া আর রিধি একই রুমে উঠেছিলো। এখন অদিতিও নেই। এটিই ভালো সুযোগ রিধির সাথে কথা বলার। দরজায় ঠোকা দেওয়ার পর দিয়া দরজা খুললো।

দিয়া: ভাইয়া আপনি?

রক্তিম: রিধি কোথায়?

দিয়া: একটু বেরিয়েছিলো।

রক্তিম: মানে? কোথায় বেরিয়েছে?

দিয়া: বাইরে গেছে। ভালো লাগছিলো না রুমে তাই।

রক্তিম দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
রক্তিম: তোমাদের মানা করেছিলাম হোটেলের বাইরে না যাওয়ার জন্য। কানে কি ঢুকে নি?

দিয়া কিছু বলার আগেই রক্তিম দেরী না করে বেরিয়ে গেলো রিধিকে খুঁজতে।

হোটেল থেকে বের হওয়ার সময় রোহানের সাথে দেখা।

রক্তিম: রিধিকে দেখেছো?

রোহান: ওরা তো রুমে।

রক্তিম: দিয়া বলেছে, বের হয়েছে রিধি।

রোহান: মানে কি? মানা করেছিলাম না ওদের? চলেন তাড়াতাড়ি।

রক্তিম আর রোহান রিধিকে হোটেলের বাইরে খুঁজে পায় নি।

রক্তিমের ভয়ে হাত কাঁপছে।

রোহান: এখানে না থাকলে কোথায় যেতে পারে?

রক্তিম: বীচে যায় নি তো?

রোহান: মেয়েটার কি মাথা খারাপ হয়েছে?

রোহান আর রক্তিম বীচে চলে যায় রিধিকে খুঁজতে। বীচের কাছে যেতেই শুনতে পায় রিধির কান্নার শব্দ।

অন্ধকার ছিলো চারপাশে, তবুও চাঁদের আলোয় দূর থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে কিছু ছেলে ঘিরে রেখেছে রিধিকে। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিলো রিধিকে তারা। সঠিক সময়ে রোহান আর রক্তিম রিধিকে খুঁজে পায়। তা না হলে খুব বড়ো বিপদ নেমে আসতো রিধির জীবনে। রোহান আর রক্তিম ছেলেগুলোকে ইচ্ছেমতো পিটিয়েছে। রোহানের বাবার এক বন্ধু এইখানেই একটি থানার ওসি ছিলেন। তাকে ফোন করায় সবকটিকে ধরে নিয়ে যায়। সাথে মেয়েটিকেও যেটি তাদের সাথে এসেছিলো।
রক্তিমের মেজাজ খুব খারাপ ছিলো। রিধির হাত শক্ত করে ধরে তাকে টেনে বসা থেকে দাঁড় করালো। তারপর কষে একটা চড় বসিয়ে দিলো গালে। রিধি গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অসহায়ের মতো।

রক্তিম চিৎকার করেই রিধির সাথে কথা বলছিলো।
রক্তিম: তুমি কি এখনো বাচ্চা রিধি? বোকার মতো কাজ করো সবসময়। মাথায় কি ঘিলু নেই তোমার? মানা করার পরও রুম থেকে কেন বেরিয়েছিলে?

রিধি: আপনি আমাকে মারলেন?

রক্তিম: আরেকটা লাগিয়ে দেবো বেশি কথা বললে?

রোহান রক্তিমকে শান্ত করায়। যদিও রোহানেরও মাথাটা খারাপ ছিলো ওইসময়। কিন্তু এভাবে রাগ দেখিয়ে কোনো লাভ নেই। সেও ইশাকে একবার বকেছিলো এমন কারণে, যদিও ইশার দোষ ছিলো না। কিন্তু রাগ নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পেরে অনেক কথা শুনিয়ে দিয়েছিলো ইশাকে। তাই ইশা থাকে ভুল বুঝেছিলো। কিন্তু আজ রিধির দোষ আছে। তাকে মানা করার পরও কেন বের হয়েছে রুম থেকে? বের হওয়ার ইচ্ছে থাকলে রক্তিম, রোহান বা ইফতিকেও তো বলতে পারতো? তবুও রোহান রাগ নিয়ন্ত্রণ করে রক্তিমকে চলে আসতে বলল রিধিকে নিয়ে।

রিধি রুমে এসে অনেক কান্না করলো।

রিধি মনে মনে বলছে,
রিধি: আই হেইট ইউ রক্তিম। তুমি আমাকে ভালোবাসো না, তাও মেনে নিয়েছিলাম! আর আজ তো আমার উপর হাতও উঠিয়েছো। এতো তুচ্ছ আমি তোমার চোখে? এতো খারাপ ভাবো আমাকে? আমার দোষ কোথায় এখানে?

রক্তিমের আর ঘুম হয় নি, সারারাত সে বারান্দায় বসে ছিলো। হাতটির দিকে তাকিয়ে আছে, কিভাবে পারলো সে রিধির গায়ে হাত তুলতে? রাগটি নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারে নি সে। এখন কষ্টগুলো আর নিতেই পারছে না। দু ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আজ সে রিধিকে আঘাত করে কাঁদছে। খুব গভীরতা আছে এই কষ্টের। যে ক্ষত দিয়েছে রিধির মনে তা সেড়ে উঠার আগেই নতুন ক্ষত দিয়ে দিলো। রিধি ক্ষমা করলেও রক্তিম নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।

৩১।
পরের দিন রাতে সবাই বাইরে বসে গল্প করছিলো। আগামীকাল তারা চট্টগ্রাম চলে যাবে। সেন্টমার্টিন যাওয়া আর হয় না তাদের, কারণ ইশার ফাইনাল এক্সাম শুরু হবে। আর দিয়া এবং রিধিদের ভর্তি সংক্রান্ত কাজও বাকী আছে। অন্যদিকে গতকাল রিধির সাথে যে দুর্ঘটনা ঘটেছিলো সেই কারণে সবার মন খারাপ।

রক্তিম রিধির সাথে কথা বলার কোনো সুযোগ পায় নি আর। রক্তিম রিধির সামনে গেলেই সে দৌঁড়ে পালিয়ে যায়।

রিধি দৌঁড়ে পালানোর সময় দিয়ার সাথে ধাক্কা খেলো।

দিয়া: ইশ, বাঘের পাল্লায় পড়েছিস নাকি? এভাবে চোখ বেঁধে কোথায় দৌঁড়াচ্ছিস?

রিধি: বাঘ না, হাতি। বাঘ তো তাও খুব সুন্দর, দেখলেই মায়া লাগে। ওই রাক্ষসটাতো হাতির চেয়েও জঘন্য।

দিয়া: আবার কি করলো?

রিধি: কাল রাতে থাপ্পড় মেরেছিলো এক গালে। দেখ কেমন লাল হয়ে আছে। এখন আবার খুঁজছে আরেক গালে বসানোর জন্য।

দিয়া: তোকে কে বলছে চড় মারার জন্য খুঁজছে?

রিধি: রাক্ষসটা চায় আমার বিয়ে হয়ে যাক! যাতে আমি বিদায় হই বাসা থেকে, তাই খুঁজছে। এক গালে চড় খেলে বিয়ে হয় না তাই।

দিয়া: রিধি, উনি এই থিওরি কিভাবে জানবে?

রিধি: আমি বলেছিলাম।

দিয়া: তাহলে তোকে চড় আরেকটা মেরেই ছাড়বে।

দিয়া কথাটি বলেই হেসে দিলো। রিধি ভেংচি দিয়ে চলে গেলো।

রাতে তাদের হোটেলের সামনে একটি পার্টি হচ্ছিলো। তারা সবাই সেখানে যায়। রিধি এক কোণে বসে আছে বিষণ্ণ মনে।
এতোদিন তারা অনেক মজা করেছিলো। কিন্তু আজকের পরিবেশটায় নিরব লাগছে সবার।

রোহান ভাবছে, কিছুর তো কমতি আছে? হ্যাঁ, রিধির হাসির কমতি আছে। রিধি হাস্যকর কথাবার্তা আর দুষ্টুমিতে মাতিয়ে রেখেছিলো এতোদিন সবাইকে। কিন্তু আজ সে নিরব, আর সবাই যেন সেই নিরবতায় সায় দিচ্ছে।

রিধি এ কয়েকদিনেই রোহানের গানের ভক্ত হয়ে যায়।

যখন তারা সিলেটে ছিলো রোহানকে একদিন বলেছিলো রিধি,
রিধি: ভাইয়া আপনার গানের সুর, একপ্রকার ঔষধ। আমার মন ভালো হয়ে যায়। আপনি কিছু মনে না করলে আমি কয়েকটা রেকর্ড করে নেয়? সবসময় তো আপনার সাথে দেখা হবে না। তখন মন খারাপ হলে ঔষধ কোথায় পাবো? তাই ভাবছি মোবাইলে রেখে দেবো।

রোহান হেসে বলেছিলো,
রোহান: মন খারাপ থাকলে কিছুই ভালো লাগে না। শরীর দুর্বল লাগে। শারীরিক অসুস্থতার থেকে মানসিক অসুস্থতা খুবই জটিল। শারীরিক অসুস্থতা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে কিছু টাকা খরচ করলেই হয়। কিন্তু লক্ষ টাকা খরচ করলেও মনের রোগ সেরে ওঠে না। আর আমি যদি কারো মনের রোগ সারাতে পারি, তাতে নিজেকে অবশ্যই ভাগ্যবান মনে করবো।

রোহান বুঝতে পেরেছে রিধির এখন ঔষধ লাগবে। রোহানের গানের সুর রিধিকে সুস্থ করে দেবে। রোহান গিটার নিয়ে আসলো। গিটারে সুর তুলার সাথে সাথে সবাই রোহানের দিকে তাকালো। রিধিও তাকালো।

রোহান রিধির দিকে তাকিয়ে গাওয়া শুরু করলো,

“সে যে বসে আছে একা একা
রঙিন স্বপ্ন তার বুনতে
সে যে চেয়ে আছে ভরা চোখে
জানালার ফাঁকে মেঘ ধরতে

তার গুনগুন মনের গান বাতাসে উড়ে
কান পাতো মনে পাবে শুনতে
তার রঙের তুলির নাচে মেঘেরা ছোটে
চোখ মেল যদি পারো বুঝতে
তার গুনগুন মনের গান বাতাসে উড়ে
কান পাতো মনে পাবে শুনতে
তার রঙের তুলির নাচে মেঘেরা ছোটে
চোখ মেল যদি পারো বুঝতে

সে যে বসে আছে…
সে যে বসে আছে…”

রিধি রোহানের দিকে তাকিয়ে হেসে দিলো। রিধিকে হাসতে দেখে রোহানের খুব ভালো লাগছে।

রিধি আর রোহানের এমন চোখের ইশারায় কথা বলা রক্তিমের মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। ভেতরটা তার জ্বলেই যাচ্ছে।

নবনী তাদের দুইজনকে একসাথে হাসতে দেখে রাজিয়াকে বললেন,
নবনী: রাজিয়া আপা, রোহান আর রিধিকে একসাথে ভালো মানিয়েছে তাই না?

রাজিয়া: আমিও তাদের দেখে এটিই ভাবছিলাম।

নবনী: আমার রোহানকে খুব পছন্দ হয়েছে।

রাজিয়া: রিধিও অনেক লক্ষী একটা মেয়ে।

নবনী: বলছিলাম কি, সম্পর্কটি কি আগানো যায় না? আপনার মতো ভালো একজন শ্বশুড়ি, রোহানের মতো ভালো ছেলে যদি স্বামী হিসেবে পায়, আমার মেয়েটা ভালো থাকবে। নিশ্চিত থাকবো আমরা।

রাজিয়া: আপনার কথায় আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আপনি তো জানেন আমাদের পারিবারিক সমস্যা। রোহানের দায়িত্ব ওর বাবার উপর। আর রোহানের একটি পছন্দ-অপছন্দ আছে। আর এখনো মাস্টার্স শেষ হয়নি। পড়াশুনা শেষ হওয়ার পর ভেবে দেখা যাবে।

নবনী: ঠিক বলেছেন। তবে শুভ কাজে বেশি অপেক্ষা না করাই ভালো।

রাজিয়া: ইশাকে আনুষ্ঠানিকভাবে উঠিয়ে আনার পর আমি দেখবো ব্যাপারটা। আপনাদের সাথেও বহু বছরের পরিচয় আছে।

নবনী: জি, আমরা তো পাশেই আছি।

কিছুক্ষণ পর পার্টিতে সবাই রোহানকে আরেকটি গান গাওয়ার অনুরোধ করলো। সবাই কাপল ডান্স করবে রোহানের গানের তালে তালে।

রোহান গাওয়া শুরু করলো,

“তুমি বরুনা হলে হব আমি সুনীল
তুমি আকাশ হলে হব শঙ্খ চিল
তুমি নদী হলে হব আমি জল
তুমি শ্রাবণ হলে হব শ্রাবণ ঢল

তুমি পাহাড় হলে হব আমি সবুজ
তুমি শাসন করলে হব আমি অবুঝ
তুমি অরণ্য হও হব পাখি
তুমি অশ্রু হও হয়ে যাব আঁখি

তুমি জীবন হলে হয়ে যাব আমি প্রেম
তুমি নকশী কাঁথা হলে হব কারু হেম

নানা না না না নানা না না নানা নানা”

দিব্য আর ইশা তার চোখের সামনেই একে অপরের হাত ধরে ডান্স করছিলো। ইশার মাঝে লজ্জা, আনন্দ, দিব্যের প্রতি ভালোবাসা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তারা তো সুখেই আছে। রোহানের চোখেই শুধু বেদনা। তাদের একসাথে দেখে কন্ঠ ভারী হয়ে আসছে তার।

এদিকে অদিতি রক্তিমকে টেনে নিয়ে যায় কাপলদের মধ্যে।

রক্তিম: অদিতি কি করছো তুমি?

অদিতি: আমরাও একসাথে ওদের মতো ডান্স করবো।

রক্তিম: আমরা কাপল না। ওকে?

অদিতি: এখন না তো কি হয়েছে, হয়ে যাবো।

রক্তিম: অদিতি প্লিজ, আমার মন ভালো নেই।

অদিতি: আমি সবার সামনে কেঁদে দেবো কিন্তু।

না চাইতেও রক্তিমের অদিতির সাথে ডান্স করতে হচ্ছে। রিধি তাদের একসাথে দেখে মনে মনে অনেক কষ্ট পায়।

ডিনার করার পর সবাই যার যার রুমে চলে গেলো। রক্তিমের এই মুহূর্তে রিধিকে উঠিয়ে নিয়ে যেতে মন চাইছে।

আর এদিকে রিধি আর দিয়া মোবাইলে গেইমস খেলছে পাল্লা দিয়ে। রোহানের গান শুনে মনটা ভালো হয়ে গেছে রিধির। বদমেজাজি রাক্ষসটার কথা চিন্তা করে সে তার মনটা খারাপ করতে চায় না আর।

রোহান হোটেলের বাইরে খোলা আকাশের নিচে বসে আছে। দিব্য তার পাশে এসে বসলো।

দিব্য: মন খারাপ?

রোহান: মন ভালো রাখার ঔষধ নেই।

দিব্য: তোর মন ভালো রাখার ঔষধ কি? আমাকে বল? আমি এনে দিচ্ছি।

রোহান রহস্যময় হাসি দিলো। আবার আকাশের দিকে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করলো।

মনে মনে বলল,
রোহান: তোর কাছে কোনো ঔষধ নেই দিব্য। বাবা-মা এক হতে পারলে আমার রোগ সারানোর প্রথম ডোজ আমি পেয়ে যাবো। কিন্তু দ্বিতীয়টা তোর কাছে। ইশাকে তো আমি হারিয়েই ফেলেছি। আমার ভালোবাসা তো হেরে গেছে। আমি কিভাবে সুস্থ হবো? কে করবে আমায় সুস্থ এখন। আমার অসুস্থতা তোকে সুস্থ রাখবে। আর এই রোগ, আমায় জীবনে চলার পথে তেমন বাধা দেবে না। কারণ আমি তো অভ্যস্ত।

দিব্য রোহানকে নিরব থাকতে দেখে বলল,
দিব্য: তুই রিধিকে পছন্দ করিস?

রোহান মাথা তুলে বলল,
রোহান: হোয়াট? কি বলছিস এসব?

দিব্য: খারাপ কি বলেছি?

রোহান: আমি ওকে বোনের চোখে দেখি। আর আমার ওরকম কোনো চিন্তা মাথায় আসেও নি। দিয়া আর রিধি আমার চোখে সমান।

দিব্য: আচ্ছা ঠিকাছে, বুঝলাম।

রোহান: রিধির মন খারাপ ছিলো তাই ওর মন ভালো করার জন্য আমি গান গেয়েছিলাম। দেটস ইট।

সকালে তারা চট্টগ্রাম চলে আসে। এর কিছুদিন পর ইশাদের ফাইনাল এক্সাম শেষ হয়। সে থার্ড ইয়ারে উঠে যায়। রক্তিমকেও কোম্পানির কাজে তিন মাসের জন্য দেশের বাইরে যেতে হয়। অদিতি তার সাথেই যায় কারণ সেখানে অদিতির বাবাও আছেন। এই তিনমাসে রিধি শুধু রক্তিমকে ভেবে ভেবে কাটিয়ে দিয়েছে। তার মাথায় সারাদিন একটাই চিন্তা ছিলো রক্তিম অদিতিকে নিয়ে ঘুরছে হয়তো, তারা অনেক আনন্দে আছে।

তিনমাস পর দিব্য আর রোহানের মাস্টার্স শেষ হয়। প্রথম ইন্টার্ভিউতেই দুই ভাইয়ের জব হয়ে যায়। আর রক্তিমও দেশে ফিরে আসে। রিধিকে ফোন দিয়েছিলো রক্তিম অনেকবার এই তিনমাসে। কিন্তু রিধি একবারো ধরে নি।
তবে সে অদিতিকে সাথে নিয়ে আসে নি। অদিতির জন্য এতোদিন রিধির সাথে কথা বলতে পারে নি, কিন্তু এখন আর কোনো বাঁধা নেই। কিন্তু রক্তিম জানে না তার ভালোবাসার জন্য অপেক্ষার এখন কি সমাপ্তি হতে পারে।

হয়তো নিভে যেতে পারে রক্তিমের ভালোবাসার গল্প, হয়তো বা রিধির শেষ সেকেন্ডের অপেক্ষায় জ্বলে উঠতে পারে তাদের ভালোবাসার নতুন গল্প।

চলবে—

আগের পর্ব:
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/374419640946481/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here