অসুখের নাম তুমি” পর্ব:৫

0
1262

#অসুখের_নাম_তুমি
#সোনালী_আহমেদ
৫ম পর্ব

সৌহার্দকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে কথাটি বলে রেশমি। ঠিক তখনই উপস্থিত হয় সূচনা। পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে বেশ হাসিখুশি মুখেই আসছিলো। মনে মনে বেশ লজ্জাও পাচ্ছিলো সৌহার্দের সামনে আসতে। কিন্তু রেশমির কথা শুনতেই থমকে গেলো। হাতে থাকা পায়েসের বাটি টা ছুটে নিচে পড়ে গেলো। মুহূর্তেই বিকট আওয়াজ ঘটলো। সবাই একসাথে সূচনার দিকে তাকালো।

সূচনার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। কত শত রাত জেগে স্বপ্ন বুনেছে এ মানুষ টার জন্য। কত শত আশা নিয়ে সে এ বাড়ীতে এসেছিলো। মুহূর্তেই সব ধূলিসাৎ হয়ে গেলো।

লোকে কি বলবে? পরপর দুবার বিয়ে ভেঙ্গে গেলো তার। প্রথম এক ভাই পরবর্তীতে আরেক ভাই। এদের সাথে কি সূচনার পূর্বের কোনো শত্রুতা আছে নাকি? যদি তাকে বিয়েই না করতে চায় তাহলে পরপর দুবার এমন যেচে যেচে প্রস্তাব দিয়েছে কেনো?
সে কীভাবে মূখ দেখাবে? আশার পথে প্রায় প্রত্যেক বাড়ীর মানুষ তাকে দেখে প্রশ্ন করেছিলো সে কই যাচ্ছে?
জমিলা বেগম তখন গর্ভের সুরে বলেছিলেন,

–‘ আমার নাতির বউ করেতেই নিয়ে যাচ্ছি।’

জমিলার পাশেই সূচনা হাটতো। এই কথার বিনিময়ে সে সবাইকে লজ্জা মিশ্রিত হাসি উপহার দিতো। জমিলা বেগম তা নিয়েও খিল্লি উড়াতেন।

সূচনার জীবনে অন্য কোনো পুরুষ মানুষ না থাকায় তার সব আশা-আকাঙ্খা সৌহার্দকে ঘিরেই ছিলো। তার মনের গহীন কোণে- মনেরকৌঠায় সৌহার্দকে বন্দী করেছিলো। হবু বরকে নিয়ে স্বপ্ন বুনা কি অস্বাভাবিক? সে তো লুকিয়ে নয় সবার প্রকাশ্যেই তার নানান বাসনা প্রকাশ করেছিলো। তার সকল সই’রা জানে সৌহার্দের ব্যাপারে। এ বাড়ীতে আসার সময় শখ করে একখানা রুমাল তৈরী করে এনেছিলো সূচনা। সুতো দিয়ে আকাঁ ফুল আর নামগুলোতে যেনো তার সকল মনের আবেগ মিশ্রিত ছিলো।
কতই না লজ্জা পেয়েছিলো সৌহার্দের নামের নিচে নিজের নাম লেখার সময়। যার ফলে পুরো একটা দিন কারো সামনে উপস্থিত হতে পারে নি।

অসময়ে সূচনার উপস্থিতি জমিলা বেগমের অবস্থার আরো পরিবর্তন হয়ে গেলো।

—‘এই,দস্যি মেয়ে এসব হাবিজাবি কি বলো? কে তোমার বর? কিরে নাতি এই মেয়ে এসব কি বলো?’

সবাই নিশ্চুপ। কারো মুখে কথা নেই,লিনা বাদে। তার মুখে বিরাজমান শয়তানি হাসি। অবশ্য সে বেশ খুশি সূচনা এ বাড়ীর বউ হতে পারে নি বলে। কারণ সে জানতো সূচনাকে বউ করলে সম্পদ তার হাত ছাড়া হয়ে যাবে।
রেশমিকে নিয়ে তার চিন্তা নেই, ভাইয়ের বিয়ের সময় বেশ ঘেটেঘুটে এই মেয়েকে ঠিক করেছিলো। আর এই বুড়ো আঙ্গুল সমান মেয়ে ই বা কী করতে পারবে?

—‘ও নাতি,কথা বলছো না কেন?’

—‘হু, আমি ওর বর।’

জমিলা বেগম ঘর কাপিয়ে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন,–‘কিহ!’

সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে আছে। সৌহার্দ মাথা ঝুঁকিয়ে রেখেছে। সে কখনো কারো সামনে মাথা নত করে থাকে না,আজ প্রথম রেশমির জন্যে মাথা নত করতে হচ্ছে।

জমিলা বেগম গম্ভীর গলায় বলেন,
—‘কবে হলো এসব?’

–‘কাল।’

—‘ কীভাবে? নাকি আগে থেকেই দেখা-সাক্ষাৎ ছিলো? যদি এমন হয় তাহলে আমার দম থাকতে ওই বেহায়া,নির্লজ্জ মেয়েকে আমি আমার ঘরের চৌকাঠেও পা রাখতে দিবো না।’

—‘ তার সাথে আমার এর আগে কখনো দেখা হয় নি।’

—‘তাহলে কীভাবে বিয়ে করেছো আমাকে না জানিয়ে?’

—‘ আমিও জানতাম না যে আমি বিয়ে করবো। কাল চাচীর সাথে উনার ভাইয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম। তখন,,,’

—‘ ওই আধ বুড়ো রফিক? তার না বউ আছে?’

এ কথা শুনতেই লিনা ফুসে ওঠে। রাগান্বিত গলায় ‘ আম্মা’ বলে কিছু বলতে নিচ্ছিলো তখন জমিলা বেগম চোখ রাঙ্গিয়ে বলেন,

–‘ আমাদের মধ্যে কেউ কোনো কথা বলবে না। নাহলে খুব অসুবিধা হয়ে যাবে।’

তারপর সৌহার্দের দিকে তাকিয়ে বলে,

–‘তুই বল।’
—‘হু। উনার বউ অসুস্থ,তাই চাচীর ভাই আবার বিয়ে করবেন,বউয়ের দেখাশুনার জন্য। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে বিয়ে বাড়ীতে। রেশমিকে দেখে আমি সম্পূর্ণ অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। এত ছোট মেয়ে আর এত বয়স্ক লোক। আমি ভুলবশত ওই রুমে ডুকে যায়,যেখানে ওকে সাজিয়ে রাখা হয়েছিলো। তখন রেশমি হুট করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে’ মামা, আমি বিয়ে করবো না।’ আকস্মিক ঘটনায় হতভম্ভ হয়ে গিয়েছিলাম,দ্রুত গতিতে তাকে সরিয়ে কেটে পড়ি, রেশমি তখনও জানতো না ও কাকে ধরেছিলো। এ দৃশ্য কিছু লোকজন দেখে ফেলে,মুহূর্তেই তারা বাহিরে কুৎসা রটিয়ে দেয়। বেশ কয়েকজন রেশমিকে কলঙ্কী, বেশ্যা এমন এমন কথা শুনাচ্ছিলো। কি জানি,কি শুনে চাচীরাও পাল্টি খেয়ে যান,তারা জানায় যে এ বিয়ে হবে না। তা শুনে রেশমির মামা বললেন,
–‘ বিয়ে ভাঙ্গলে নাকি তিনি আর কোথাও বিয়ে দিতে পারবে না। তাই এ কলঙ্কের মুখ থেকে রক্ষা করতে আমিই যেনো তাকে বিয়ে করি।’
আমি বলেছিলাম, কেনো কেউ করবে না? অবশ্যই করবে। তখন একজন বলে,’সবার দরকার নেই।তুমি করবে? তুমিই তো করবে না বাকিদের কথা কেনো বলছো?
এরপর সবার কথা শুনে এক প্রকার জেদের বসেই রেশমিকে বিয়ে করে ফেলি। ‘

সৌহার্দের কথা শেষ, সে স্বাভাবিকভাবেই বসে আছে। তার মধ্যে কোনোরকম অনুতপ্ততা নেই।
বাকিদের দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ ছিলো। তার কথা আর ভাবমূর্তি সবার মষ্তিষ্কে দু ধরনের মনোভাব সৃষ্টি করেছে।

লিনা বেগম বেশ আবেগি গলায় বলে,

—‘ মা,আপনি জানেন আমি কতবার বারণ করেছিলাম এ বিয়ে না করতে। কিন্তু আপনার নাতি জনদরদী হতে গিয়েছিলো, সে আমার কথা উপেক্ষা করে বিয়ে করেছে। এমনকি সে আমার ভাইকেও নানান কথা শুনিয়েছে। মেয়েটারে দেখতেই সে কেমন হয়ে গিয়েছিলো। নিশ্চয়ই কোনো জাদুটোনা করছে নাহলে আমার ভাইরে কেমনে এত কথা শুনিয়ে বিয়ে থেকে ঘুরিয়ে দিয়েছে? মেয়েটা বশীকরণ করতে জানে মা, একদিনেই আপনার নাতি বিয়া কইরা ফেলছে। শেষ,আপনার সংসার শেষ!’

সৌহার্দ কোনো কথা বললো না, সে প্লেট টা টেনে খেতে বসলো। এ বিয়ে নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যাথ্যা নেই।

রেশমি চুপচাপ এক কোণে দাড়িয়ে সব শুনছে। প্রত্যেক টা মানুষকে সে নজরে রাখছে। লিনার কথা শুনে তার বেশ সময় লাগলো না চরিত্র সম্পর্কে ধারনা করতে। সে এবার সৌহার্দের দাদীর মুখপানে চেয়ে আছে, দেখতে চায় তিনি কি বলে?

জমিলা বেগম বেশ খানেক সময় নিরবতা পালন করলেন। ঠান্ডা মাথায় বিবেচনা করে বলেন,
—‘ তার মানে এ বিয়া তুই নিজ থেকে করতে চাস নাই? তোরে জোর করসে।’

সৌহার্দ জবাব দেয় না,সে আপনমনে খাচ্ছে।

জমিলা বেগম সম্মতির লক্ষণ হিসেবে ধরলেন। বেশ সময় নিরবতা পালন করলেন।

—‘ তাহলে এ মেয়েরে ছাইড়া দে তুই। আমি তোর জন্য এর থেকে ভালো মেয়ে দেখে রাখছি।’

—‘ ছাড়তে হলে বিয়ে করতাম না। বিয়ে এত সহজ না।’

—‘ আমারে একদম জ্ঞান দিবি না। তোর থাইকা আমি বহুত জানি। তুই ভালো বুঝোস? এ মেয়েরে আজকেই ছাইড়া দিবি,এখনই দিবি। আমি তোরে দুইদিনের মধ্যে বিয়া করামু।’

সৌহার্দ জবাব দেয় না,শুধু একবার রেশমির দিকে তাকায়। রেশমির চোখে জল টলমল করছে। সৌহার্দের এমন গা ছাড়া ভাব দেখে সে ফুসে উঠলো। চোখের পানি সেকেন্ডেই লুকিয়ে ফেললো। ঘরের কোণা থেকে একদম মাঝের দিকে আসলো, মাথার চুলে পেচানো গামছা টা খুলে ফেললো। সবাই তার দিকে তাকিয়ে আছে,বুঝতে চেষ্টা করছে সে কি করতে চায়?

এক রাশ ঘন চুল তার পিঠ ছাড়িয়ে কোমর অবধি ঠেকলো। রেশমি এসে সৌহার্দের পাশের চেয়ার টায় বসলো। সৌহার্দকে উদ্দেশ্য করে বলে,
–‘ আমাকে পানির গ্লাস টা একটু দিন।’

সৌহার্দ চুপচাপ এগিয়ে দিলো। তার কান্ডে বেশ অবাক সবাই। জমিলা বেগম রাগে গর্জে বলে ওঠেন,
–‘ এই মেয়ে, এসব কি ধরনের ব্যবহার?তুমি এখানে বসেছো কেনো?’

—‘ তো কোথায় বসবো?’

—‘কোথায় বসবা মানে? তুমি এখানে কেনো? যাও এখান থেকে। এক্ষুণি যাও।’

—‘ কেনো দাদী? আপনি বুঝি আপনার স্বামীর সাথে খেতে বসতেন না?’

—‘এই, কে তোর দাদী? কে তোর স্বামী। ওরে একদম স্বামী বলবি না, আজকেই চলে যাবি এ বাড়ী থেকে। শুনোস নাই ও যে তোরে সবার প্যাচে পইড়া বিয়া করছে?’

—‘ কি যে বলেন? আমি কোন দুঃখে স্বামী বাড়ী ছেড়ে যাবো? আর উনি যদি প্যাচে পড়ে বিয়া করে থাকে তাহলে রাতে কেনো আমার সাথে থেকেছে? আমার সতীত্ব শেষ করে এখন ছেড়ে দিবেন? এটা আমি মানবো? ‘

রেশমির কথা শুনে সৌহার্দ বিষম খেলো। সবাই অদ্ভুদ ভাবে তাকালো। লিনার স্বামী চুপচাপ উঠে চলে গেলেন।
জমিলা বেগম নাকমুখ ছিটকিয়ে বলে উঠেন,
—‘ ছিঃ! ছিঃ! লজ্জা শরম কি কিছুই নাই নাকি?এসব কি বলতাছো?’

—‘ভুল কই বললাম? আপনি আমার ভেজা চুল দেখছেন না। ও হো বুঝেছি, দাদাজি বোধ হয় আপনারে এমন সোহাগ করে নাই, তাই না?’

এবার কোনো দিকে না তাকিয়ে সজীব উঠে চলে গেলো। সৌহার্দ কাশতে কাশতে যক্ষা রোগীর মতো হয়ে গেলো। সূচনার দৃষ্টি রেশমির চুলের দিকে, বুকটা ধক করে ওঠলো তার। তার দুঃখের সাগর এবার কানায় কানায় পূর্ণ হতে লাগলো।

জমিলা ফুশে উঠলো। সে রেগে বলে,–‘ দাদাজী সোহাগ না করলে তোমার শশুড় আসতো না,আর শশুড় না আসলে তোমার স্বামী আসতো না।’

রেশমি কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না,সে আপনমনে খেতে লাগলো। তার এমন ভাবমূর্তি দেখে জমিলা বেগম আরো বেশি রেগে গেলেন। তিনি,,

চলবে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here