অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_১৯

অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_১৯

#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)

৩১.
শ্রেয়িতা বাহিরে যেতে চেয়েও পারল না। ব্যাগটা পূর্বের জায়গায় রেখে ইফদিয়ার পাশে ধপ করে বসে পড়ে। ইফদিয়ার মনটা ব্যকুল হয়ে আছে তার ভাইয়ের চিন্তায়। কারণ সে ভাইয়ের চোখে সূক্ষ্ম ভালোলাগা দেখেছে শ্রেয়িপ্পির প্রতি। তবে কি তার মত ভাইও নিয়ন্ত্রণহীন আবেগে জড়িয়ে যাবে। হঠাৎ কেঁপে উঠল সে। খেয়াল করে দেখে তার কাঁধে নরম তুলতুলে হাত রেখেছে শ্রেয়িতা। ইফদিয়ার সংকোচতা কাটিয়ে সহজ করার জন্যে শ্রেয়িতা গলা ঝেড়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইফদিয়ার কে স্বাচ্ছন্দ্যে বলে,

‘বোরকা নেকাপ হিজাব খুলে ফেলো ইজি হউ। ভাইয়েরা রুম অব্দি প্রবেশ করবে না। যতই হোক তোমরা আমার ধর্মালম্বী বলে কথা!’

ইফদিয়ার সটানপূর্ণ অক্ষি নিয়ে শ্রেয়িতার দিকে ফাটাফাটা বিবেকে তাকায়। তার বিবেকে শ্রেয়িতার শেষাক্ত বাক্যটির অর্থ খুঁজতে ব্যস্ত। শ্রেয়িতা ব্যঙ্গময়ী দৃষ্টিতে দেখে ইফদিয়ার কেমন হ্যাবলার মত তাকিয়ে আছে। বেচারী নিজেও জানে না তার সঙ্গে কি হচ্ছে! শ্রেয়িতা ত্রপাট দৃষ্টিতে লাজুক কণ্ঠে বলে,

‘ওমনে দেখে কি নজর দিচ্ছো বালিকে!’

ইফদিয়ার থতমত খেয়ে গেল। দৃষ্টি নত করে হাসার চেষ্টা করে বলে,

‘আপু তুমি হয়ত ভুলে আমাদের ধর্মকে নিজের ধর্ম বলেছো।’

কথাটিকে স্বাভাবিক ভাবে নিল শ্রেয়িতা। ইফদিয়ার দিকে তাকিয়ে রহস্যময়ী হাসি দিল সে। যার একটুখানি আচও অবুঝ ইফদিয়ার করতে পারিনি। শ্রেয়িতা ইফদিয়ারকে বিশ্রাম নিতে বলে রুম হতে প্রস্থান করে। ড্রয়িং রুমে সোফায় লক্ষ্মীনা বসে ছিলেন। শ্রেয়িতা ধ্যান করে দেখে লক্ষ্মীনা কথোপকথন করছেন মিসেস হালিমার সঙ্গে। উনার পাশে ইসমাইল এর মা নিরবচ্ছিন্ন হয়ে বসে আছেন। ইফদিয়ার থেকে শুনেছিল তার মা এখনো প্যারালাইজড রোগী। শ্রেয়িতা গিয়ে মিসেস হালিমাকে সৌজন্যে বলে,

‘কাকীমা সরি ডাকতে পারি!’

‘হই মামুনি ডাহো।’

‘আমি কি আন্টিকে রুমে নিয়ে যেতে পারি।’

‘তা আর বলতে কি!’

লক্ষ্মীনা মিসেস হালিমাকে মাঝ কথায় থামিয়ে শ্রেয়িতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘তুমি নিয়ে যাও মামুনি।’

মিসেস হালিমা শান্ত নয়নে পরখ করলেন মিসেস শ্রন্দনাথের দিকে। তিনি ইশারা করে আশ্বস্ত করলেন বিষয়টি। মিসেস হালিমাও চিন্তাহীন গল্পে মনযোগ দিল। ইফদিয়ার রুম থেকে ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করেছে। আনমনে শ্রেয়িতার দিকে তাকিয়ে বলে,

‘কেনো তুমি আমাদের ধর্মের হলে না! সনাতন ধর্মের হওয়ায় মুখ ফুটিয়ে বলতে পারি না ভাইয়ার কথা।’

উদাসীন মনকে চেপে রেখে দরজা ভিজিয়ে বিছানায় বসে পড়ে। ফোন বের করে দেখে রুহিয়ার মিস কল। মেয়েটির সঙ্গে বোর্ড পরীক্ষার পর আর কথা হয়নি। না জানি কতটা না চিন্তিত ছিল! ভেবেই যেন ইফদিয়ার ফোন দিল রুহিয়াকে।
রুহিয়া তিয়ানার রুমের পাশে থাকে। তাদের কাজিনদের রুম পাশাপাশি হওয়ায় বোনকে খেয়াল রাখতে রুহিয়ার সমস্যা হয় না। দুপুরের লাঞ্চ টাইম আরম্ভ হয়েছে। ডাইনিং টেবিলে রুহিয়ার মা চেঁচিয়ে ডাকেন মেয়েকে। কেননা সকাল থেকে এখনো উপোষ ঘুরছে মেয়েটি। রুহিয়ার মা ভীষণ চিন্তিত থাকেন মেয়েকে নিয়ে। এমনি শুকনো গড়নের শরীর তার। এর উপর উপোষ থেকে দূর্বলতা আঁকড়ে ধরার ধান্দা পুষচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। পুনরায় মেয়েকে গলা চেঁচিয়ে খেতে ডাকলেন। রুহিয়া না পেরে খেতে গেল। মায়ের কাছে গিয়ে অনুনয়ী কণ্ঠে বলে,

‘মা আসর পেরিয়ে যাবে। নামাজ শেষ করে খাবো।’

রুহিয়ার মা করুণ কণ্ঠে বলেন,

‘একটু খেয়ে নে তারপর।’

তিনি নিজ হাতে মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিলেন। রুমে তিয়ানার পাশে বসে আছে তিয়ানার মা। তিনি শান্ত ভঙ্গিতে মেয়ের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। তিয়ানার স্বাস্থ্যের উন্নতি হচ্ছে। শরীরে যতটা গোটা করে চিকেনপক্স উঠে ছিল। এখন তার চেয়ে কম পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে শরীরের কয়টা জায়গায় চিকেনপক্স এর দাগ সুস্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। তিয়ানার দিকে ঘন পল্লব ফেলে তিয়ানার মা জিজ্ঞেস করেন।

‘ফোসকার দাগ কেনো!’

‘খুব চুলকা ছিল। সংযত করতে পারিনি।’

‘সুস্থ হয়ে যাবি মামুনি ইন শা আল্লাহ। খুব জ্বলছে কি!’

‘উঁহুম চুলকায় ঘুমালে ভীষণ যন্ত্রণা করে শরীরে।’

‘একটু ধর্য্য রাখ এখন খুব দেখা যাচ্ছে না শরীরে। লাল লাল ফোসকার প্রাদুর্ভাব ক্রমশ কমে এসেছে। নে অরেঞ্জ জুস খেয়ে নে।’

‘না আম্মু এসব হেল্থি ফ্রুটস খেতে ইচ্ছে করছে না। দিনকে দিন মুখের রুচিবোধ কমে যাচ্ছে। যথেষ্ট পরিমাণে ফল,শাকসবজি খাওয়ায়ছো। এবার ফুসকা এনে দাও না।’

‘এক চড় লাগাবো। ফুসকা তেলজাতীয় খাবার। খেলে যে ফোসকার জ্বালাতন বাড়বে সেটা জানিস!’

তিয়ানা কাঁদো কাঁদো মুখ করে নিচু গলায় বলে,

‘যাও তুমি খাবো না কিছু আমি।’

তিয়ানার মা চেষ্টা করলেন তবুও তিয়ানা অসুস্থ দশায়ও নাছোড়বান্দা। মান্য করল না তার মাও চুপ করে চলে গেলেন।

৩২.

রুহিয়া জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ফোনের মধ্যে লাগাতার কল করে চলেছে। কিন্তু ইফদিয়ার ফোনে রিং হচ্ছে না। মুখ ফুলিয়ে রুহিয়া আনমনে বলে,

‘ইশ! এতদিন আমি ফোন দিয়েও পায় নি। আজ ওই নিজ থেকে দিল আর আমায় পায় নি। ফাঁটা কপাল রে বোন।’

রাত পোহালো শহরে ছেয়ে গেল নির্জনতা। পাখির কলকাকলী নিশ্চুপে নিমীলিত হলো। শুনা যেতে লাগে পেঁচার মুখের ক্ষীণ শব্দ। নিশাচর প্রাণী গাছের ডালে বসে বড় বড় অক্ষি ফেলে শহর পর্যবেক্ষণ করছে। তার মত নিশাচর হওয়ার অনুপ্ররেণা পাচ্ছে তিয়ানা। শরীরের জ্বালাতন মানসিকতাকে ভেঙ্গে ফেলেছে। কিন্তু কোথাও না কোথাও শান্তির স্বচ্ছতা বহমান। দীর্ঘ কয়েকমাস শয্যাশায়ী হয়ে রয়েছে। শুধু মাত্র ছোঁয়াচে রোগের কারণে। রোগটি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মনের গহীনে বিদ্যমান। তবুও যেন রোগটি তাকে ছাড়ছে না। তিয়ানা মুখ ফুলিয়ে শুয়ে আছে। তার পেটে ইদুঁরের প্রাদুর্ভাব না হলেও গলায় পিপাসার্ত অনুভব করছে। তার মা ড্রয়ারের উপর অরেঞ্জ,ম্যানগো,বাটার-দুধ,সুপ রেখে ছিলেন। তার মুখে নিতে গা গলিয়ে আসছে। যাবত কয়েকমাস এসব খেয়ে যেন তার রুচিহীন মনে হচ্ছে। অন্যকিছু খাওয়ার কামনা মনে জেগেছে। হায় আপসোস! কোনো প্রেমিক পুরুষ নেই যে কিনা রাতের আঁধারে এসে বলবে, প্রিয়তমা দেখো তুমি চেয়ে ছিলে আমায়, চলে এলাম তোমার প্রাঙ্গণে। মনের ভাবনাকে কষ্ট করে ধামাচাপা দিল তিয়ানা। সে জানে তার জীবনে প্রেমিক পুরুষ বলতে কেউ নেই।
চট করে সজাগ হলো তার মস্তিষ্কের কোষগুলো। অকস্মাৎ ‘এরফান’ নামটি মনের কোণায় উচ্চারিত হয়ে উঠে। বিড়বিড়িয়ে অনুনয় কণ্ঠে বলে,

‘এরফান মানুষটি কোথায়! তাকে দেখিনা কতদিন কিন্তু লাগে সে আছে আশপাশ জুড়ে। আচ্ছা মানুষটার কি বিয়ে হয়ে গেছে। সে কি জানে আমি অসুস্থ!’

হৃদপিন্ডের ভালোলাগাটা নিমিশেষে বিষাদে রুপ নিল তিয়ানার। কারণ এরফান মানুষটির সঙ্গে তার পরিচয় ছিল ক্ষুণ্ণ সময়ের। দীর্ঘস্থায়িত্ব বহন করার মত সময় নিয়তি তাদের দেয়নি। হয়ত মানুষটি এখন অন্য কারো। ভাবতেও যেন তিয়ানার অক্ষিপল্লবে নোনাজল ভীড় করে। মানুষটিকে ভালো না বাসলেও একটুখানি ভালোলাগা তৈরি হয়ে ছিল। তার স্বভাব, ব্যক্তিত্ব যেন রসিকতার মাঝে নেশাক্ত চাহনী ব্যক্ত করতো। তিয়ানা পুরুনো দিনের কথা স্মরণ করছিল।
তখনি রুমের দরজা খুলে কেউ ভেতরে আসে। তিয়ানার রুমটা ছিল অন্ধকারাবৃত। কারো পায়ের কচকচানো শব্দে তিয়ানা ভাবে বোধ হয় তার মা এসেছে। মুখ না ফিরিয়ে মিহি গলায় বলে,

‘আম্মু প্লিজ যাও ডিস্টার্ব করো না। কিছু খেতে মন চাচ্ছে না। বিশেষ করে খাবার ড্রয়ারে সজ্জিত আছে। পরে খেয়ে নিবো।’

অন্যথায় ভাবলেশন রয়ে গেল আগুন্তুক এর পায়ের শব্দ। থেমে যায় পাজোড়া। তবুও সটান দাঁড়িয়ে রইল তিয়ানার বিছানার পাশে। তিয়ানার কথা শুনে উল্টো পায়ে হেঁটে দরজাটা শক্ত করে বেঁধে ছিটকিনি মেরে দিল। আকস্মিক ছিটকিনির শব্দে তিয়ানা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। অাঁধারে মানুষটিকে স্পষ্ট দেখতে পারছে না তিয়ানা। অস্পষ্ট কণ্ঠে ভীতি মুখে প্রশ্ন ছুড়ে মারে আগুন্তুকের দিকে।

‘কে কে আপনি আ আর আমার রুমে কে কেনো এসেছেন!’

তবুও আগুন্তুকের পা থামল না সে স্বেচ্ছায় বিছানার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। তিয়ানা মুখটা আগুন্তুক এর দিকে করে। অন্ধকারাবৃতে আগুন্তুক এর নয়নজোড়া প্রসারিত হয়েছে।তার চোখের মধ্যে অজানা আসক্তি অনুধাবন করতে পারছে তিয়ানা। নজর চেয়েও সরাতে পারছে না সে। আগুন্তুক এর চোখ ফাঁকি দিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতজোড়া টেবিল লাইটের সুইচে রাখার চেষ্টা করে তিয়ানা। যেই সুইচবোর্ডে চাপ দিতে গেল তখনি আগুন্তুক লোকটি খিঁচে ধরে তিয়ানার হাত। কিন্তু আগুন্তুক নিজের অজান্তে তিয়ানার হাতের উল্টোপিঠ চেপে ধরেছে। যার ফলে তিয়ানার হাতের উল্টোপিঠে চিকেনপক্স এর ফোসকা ফেটে যায়। অল্প পরিমাণে পানি হাতের উল্টোপিঠে ভরে যায়। আগুন্তুক লোকটি দেখে ছলছল দৃষ্টিপাত তিয়ানার হাতের দিকে রাখে। অস্পষ্ট নজরে আহত কণ্ঠে আগুন্তুক বলে,

‘বেশি ব্যথা করছে ওয়েট মলম এনেছি। চুলকানি কমে যাবে।’

তিয়ানার কাছে কণ্ঠটা যেন চিরপরিচিত মনে হলো। সে এক ধ্যানে আগুন্তুক এর চেহারা দেখার চেষ্টা করে। ডান হাত আগুন্তুক এর গ্লাভস পরিহিত হাতে আবদ্ধ থাকায়। তিয়ানা বাঁ হাত দিয়ে আগুন্তুক এর মুখ স্পর্শ করে। তার মুখে মাস্ক বুঝতে পেরে তিয়ানা। চিহ্নিত করার প্রয়াসে ঢোক গিলে বলে,

‘এরফান আ আপনি নয় নয়তো!’

আগুন্তুক মুচকি হাসল। ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে সে। তিয়ানার শ্রবণন্দ্রিয়ে অনুভব করে আগুন্তুকের হাসিটা আর ফোঁস করে উঠে ফুঁপানোটা। তিয়ানা বোকার মত চোখ করে চেয়ে আছে। আগুন্তুক এবার নিজে টেবিল লাইটের সুইচে চাপ দিল। পুরু রুমটা নিভু পরিমাণে জ্বলে উঠে নীল রঙের ডিম বাতিতে। তিয়ানা খেয়াল করে আগুন্তুক এর মুখে মাস্ক আর চোখজোড়া উম্মুক্ত নেশায় ভরে আসে। যার পূর্ণ দৃষ্টিপাত তার উপর। আগুন্তুক ফিসফিস কণ্ঠে বলে,

‘চিন্তে করো না। তোমায় ছাড়া চিরকুমার থাকতে রাজি। কিন্তু তোমায় পেলে বরপ্রেমিক হয়ে প্রেমগাথা রচিত করতে পিছপা হবো না।’

তিয়ানার বুক কেঁপে উঠে। আগুন্তুক যে এরফান এবার নিশ্চিত হয়ে গেল। সে খানিক পিছিয়ে গেল। এরফান স্মিত হেসে তিয়ানার পাশে হাটুগেড়ে বসে।
আহত দৃষ্টিতে এরফান কান্নাময় কণ্ঠে বলে,

‘তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকারবোধ নেই। তবে শিগ্রই সেই অধিকার হাসিল করতে ওতপ্রোত হবো।’

তিয়ানা অবুঝের ন্যায় তাকিয়ে বোকার মত প্রশ্ন করে।

‘কিসের অধিকার!’

এরফান দুষ্টু হেসে বলে,

‘আদর করার।’

তিয়ানা বিস্ফোরিত চোখে এরফান এর দিকে তাকায়। চোখ যেন কোটর থেকে বেরিয়ে পড়ার উপক্রম। এরফান অট্টহাসি দিয়ে বলে,

‘আদর পরে এই নাও তোমার জন্যে সুস্বাদু লাচ্ছি।’

লাচ্ছি পান করার সম্পর্কে তিয়ানার ধারণা নেই। নাক ছিটকানো ভান করে ইয়াকি করে বলে,

‘পচাঁ লাগছে কেনো!’

এরফান ইশারায় খেতে বলে। তিয়ানা চোখ নিমীলিত করে ঠান্ডা লাচ্ছি পান করে। করার পর যেন শরীরের শিরা উপশিরায় ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল। পিপাসাও যেন মিটে গেল তিয়ানার। চোখ উম্মুক্ত করার পর খেয়াল করে এরফান নেই। তার ছোট চিরকুট রেখে গেল। তিয়ানা সেটি খুলে পড়ে।
‘তৃষ্ণার্থ প্রেয়সী নিদ্রামগ্ন হয়ে পড়ুন।’
হেসে দিল তিয়ানা। যে হাসি ছিল প্রাণবন্ত।
দূর থেকে সেই হাসি দেখে এরফান এর হৃদয়ও যেন প্রাণচঞ্চলতা পেয়ে গেল। তিয়ানার অসুস্থতা শুনার পর অস্থীর হয়ে পড়ে ছিল সে। রাত-বিরাতে অসুস্থতা কমেছে কিনা পরখ করা ছিল তার নিত্য রুটিন। অবশ্য এ বিষয়ে তার বন্ধুগণের ধারণা নেই। এরফান হেলমেট পরে বাইক চালু করে চলে যায়।

৩৩.

যাবিয়াজ মাথায় হাত চেপে বসে আছে। সে আজ বাসায় ফিরেছে। ক্যানভাস থেকে এক দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে। তার বাবাকে সুখবর দিতে যে তারা অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে পারবে। ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়ার থেকে অনুমতি পেয়েছে। ডক্টর লিও যাবিয়াজকে আশ্বস্ত করেছে তার বাবার সুস্থতার।
যখন সে তার বাবার সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার বিষয়ে আলাপ করছিল। তখন বাসার ডোরবেল বেজে উঠে। যাবিয়াজ সদায়িত্বে দরজা খুলে দেখে ক্যানভাসের কর্মচারী এসেছে। হাতে তার একজোড়া ফাইল।
যাবিয়াজ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করে।

‘এই ফাইল!’

‘জগৎ শন্দ্রনাথ পাঠিয়েছেন। আপনাকে খ্যাতনামা ডাক্তার বাবুর এসিস্ট্যান্ট নিয়োগ করা হয়েছে। সে জন্যে ডাক্তার বাবুর তথ্য ফাইল দেখতে বলেছেন।’

যাবিয়াজ মুখ গোল করে ‘ওহ’ বলে ফাইলটি নিয়ে বিদায় জানায় কর্মচারীকে। সে রুমে ফাইলটি রেখে তার বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘ড্যাড সামনের সপ্তাহের রবিবারে টিকেট বুক করেছি। অনুরোধে তোমার অপারেশন ডেইট পিছিয়েছি। যেহেতু আমি ক্যানভাসে দায়িত্বরত আছি। সেহেতু সেখানের দায়িত্ব জলদি শেষ করার চেষ্টা করব।’

রবিউল সাহেব মুচকি হেসে বলেন,

‘তোর সুবিধামত গেলে যাব।’

কি মনে করে যেন তিনি যাবিয়াজকে পুনরায় বলেন,

‘ওই যাবিয়াজ তোর কোনো স্টুডেন্ট আছে!’

বাবার মুখে কথাটি শুনে বিস্মিত হলো সে। বিস্মিত কণ্ঠে যাবিয়াজ বলে,

‘ড্যাড আমি নিজেই এখনো ছাত্র। সেখানে আমার ছাত্রী থাকবে কেমনে!’

রবিউল সাহেব সন্দেহ প্রবণ দৃষ্টান্ত নিয়ে বলেন,

‘তাহলে ইফদিয়ার মেয়েটা কে!’

যাবিয়াজ ঘাবড়ে গেল। কিন্তু পুনরায় বিস্মিত হলো মেয়েটির নাম তার বাবার মুখে শুনে। কোনো ভাবে মেয়েটি তার বাবাকে সবকিছু বলে দেয় নি তো। ঢোক গিলে সে শান্ত গলায় বলে,

‘ওর সঙ্গে অপরিচিত্ব সম্পর্ক ছাড়া আর কিছুই নয়।’

রবিউল সাহেব ছেলের তীক্ষ্ম খিটখিটে কথায় ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারে। তিনি স্মিত হাসি দিয়ে ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন,

‘তোকে বলতে ভুলে গিয়ে ছিলাম। মেয়েটি বাসায় এসেছিল। আমার প্রাণ বাঁচিয়ে ছিল।’

যাবিয়াজ বিস্তারিত চোখে বাবাকে আঁকড়ে ধরে উত্তেজক কণ্ঠে বলে,

‘কি হয়েছিল তোমার ওই মেয়েটা কি করেছে তোমায়!’

রবিউল সাহেব আকস্মিক আক্রমণে ধমকে দিলেন ছেলেকে। তাকে পুরু ঘটনা খুলে বলার পর যাবিয়াজ কিছুটা অনুতপ্ত হলো। বাবাকে রুমে দিয়ে নিজের রুমে চলে এলো।
কিন্তু ফাইলটি ঘাঁটতে গিয়ে আসল সত্যতা তার চোখে ধরা দিল। ধপ করে বিছানায় বসে। আনমনে অনুশোচনাময় কণ্ঠে বলে,

‘তবে কি আর ক্ষমা পাবো না।’

যাবিয়াজ উক্ত কথা বলার কারণ হলো ফাইলটি।
নতুন ডাক্তার এর তথ্য দেখার আগে ছবিটিকে দেখে চমকে গেল। কারণ ছবিটি হলো ইসমাইল এর। আর এই ছবির মালিককেই ঐদিন ইফদিয়ার সঙ্গে সিএনজিতে বসতে দেখেছিল সে। ঐদিন গাড়িটি ছিল তার। ছেলেটিকে দেখে তার মনে অজানা ভয় গ্রাস করে। একে একে পুরু ফাইল দেখে এক লাইনে এসে তার চোখ আঁটকে গেল। লাইনটি ছিল এরকম।

‘পরিবার- মা মিসেস জাবিয়া খাতুন, কাকীমা মিসেস হালিমা বেগম আর বোন মিস ইফদিয়ার বুহিয়ান।

‘ইফদিয়ার বুহিয়ান’ নামটি পড়ার পর যাবিয়াজ এর বুঝতে বাকি রইল না। সে কত বড় ভুল করে বসেছে। ঢোক গিলে পণ করল সে। যত হোক ইফদিয়ার সঙ্গে তার কথা বলতে হবে। সিদ্ধান্তে টান নিয়ে নিদ্রার ব্যবস্থা করল। তার ভেতরের হৃদপিন্ড অতিরিক্ত পরিমাণে লাফাচ্ছে। ইফদিয়ার কে আজও দেখেছিল ফজরের নামাজের পর। তখনো যা নয় তা হলে অপদস্থ করে ছিল মেয়েটিকে।

ফজরের শেষাক্ত সময়ের ঘটনা…

ইফদিয়ার তলপেট ব্যথা করছিল।
ফলে একটি ন্যাপা এক্সট্রা খেয়ে ছিল। যাতে তলপেটের যন্ত্রণায় জ্বর না আসে।
বালিশে মাথা রেখে প্রশান্ত পাওয়ার জন্যে আয়াতুল কুরসি পড়ে বুকের উপর ফুঁ দিল। চোখজোড়া নিমীলিত করার পূর্বেই দরজায় ক্ষুণ্ণ পরিমাণে কটকট শব্দ হলো।
ইফদিয়ার ব্যর্থিত হয়ে দরজা খুলে দেখে ইসমাইল এসেছে। ভ্রু কুঁচকে ভাইকে জিজ্ঞাসা করে।

‘কিছু লাগবে ভাইয়া!’

‘না তবে শুন। আজ ভোরে আমার এক আঙ্কেলের বাসায় যাব। কয়েকদিন সেখানে থাকতে হবে। রেডি হতে বললে হয়ে নিস।’

ইফদিয়ার মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। সে জানে তার ভাই দায়িত্বভার নিয়ে মা-কাকীমাকেও বলেছে কথাটি। ফজরের সময়ে ঘুমটা নিমূল্যে ভেঙ্গে যায় ইফদিয়ার। উঠে দেখে পুরু ঘরটা নিস্তদ্ধ। কারণ পরম আয়েশে সকলে নিদ্রামগ্ন। শুধু তারই নিদ্রাভঙ্গন ঘটেছে। সঙ্গে শুরু হলো পেটের যন্ত্রণা। ঘুমালে যেন যন্ত্রণার ছিঁটেফোটাও অনুভব হয় না। কিন্তু সজাগ হলেই আরম্ভ হয় ব্যথা। ইফদিয়ার নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাস ফজরের দিকে ঘুম ভাঙ্গার। তেমনি আজও ব্যতিক্রম হলো না। তবে তার নামাজ নেই। সে ভাবল একটু বাহিরের গলিতে হাঁটলে মন্দ হয় না।
ইফদিয়ার নিজের ভাবনাকে আঁকড়ে বোরকা পরে আর উড়না ঘোমটার মত মাথায় দিয়ে নিশব্দে বের হলো। দরজাটা আলগা করে বন্ধ করে চাবি নিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করে। গলির বাহিরে একটি পার্ক আছে। যেখানে ফজরের পর মানুষ হাঁটাহাঁটি করে। পূর্বেও এ পার্কে সে এসেছিল। আজও এসেছে প্রশান্তি লাভের আশায়।
অলংকৃত হয়ে ভোরাবৃত আকাশে তারারা ঝিকিমিকি পোকার ন্যায় জ্বলছে। কবির মত করে ইফদিয়ার মনমাতানো কণ্ঠে আবৃত্ত করে উঠে।

‘রাত জাগা পাখি হয়ে যাওয়ার কথা ভাবি
এই মনে একা একা আপনার ছবি আকিঁ
জোৎস্নার নীল আলো আপনার চোখে ভাসে
প্রিয় হয়ে থাকবেন কি চিরঞ্জীব!
ভোরের প্রথম সোনালী আলো
স্বপ্ন নতুন জাগিয়ে গেলো।
শিশির ভেজা ঘাসের পাতায়
আপনার হাতের আলতো ছোঁয়ায়
ফুটলো সকাল,কাটলো রাত
তাই মিষ্টি মুখে প্রিয় মানবকে জানাতে মন চাই
সুপ্রভাত প্রিয়।’

হঠাৎ তালির শব্দে চমকে গেল ইফদিয়ার। সীমিত পরিমাণে তালি বাজিয়েছে যুবকটি। ইফদিয়ার চোখে পূর্বের স্মৃতির ন্যায় স্বচ্ছ অশ্রুজল চলে এলো। প্রিয় মানুষের চোখে ঘৃণা কোনো প্রেয়সী সহ্য করতে পারে না। ইফদিয়ারও পারছে না। সে জানে সত্য বললেও যাবিয়াজ বিশ্বাস করবে না। যুবকটি অন্য কেউ নয় যাবিয়াজ। তার চোখ-মুখে রাগান্বিত আভা স্পষ্ট পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইফদিয়ার বুঝতে অক্ষম কেনো সে এত রেগে আছে!
যাবিয়াজ পাশে এসে কর্কটক্রান্তি মোড়ে গলা চেঁচিয়ে বলে,

‘নাগরের জন্যে বুঝি বেশি দরদ উতলে পড়ছে। আহা কি টুরু লাভ! তো কোন নাগরের সঙ্গে দেখা করতে সাঁঝসকালে চলে এলে। আগেরটা বুঝি সুখ কম দিয়েছে।’

ইফদিয়ার চরম আক্রোশে ফুলে উঠে। একে তলপেটের ব্যথা তার উপর যাবিয়াজ এর নোংরা বাজে কথায় তার মনটা রুক্ষতায় ছেঁয়ে গেল ইফদিয়ার। কষিয়ে যাবিয়াজ এর গাল বরাবর বসিয়ে দিল নরম হাতের তীক্ষ্ম অনুভূতিপ্রবণ চড়। অমার্জিত কথার উচিৎ জবাব দিতে রুক্ষ মেজাজে ইফদিয়ার যাবিয়াজ এর কলার চেপে ধরে বলে,

‘আপনার মত নিচু মনের মানুষ কে ঘৃণা করি বুঝছেন। কি ভাবেন হে শুধু আপনার অনুভূতি আছে! আগে বেহায়া ছিলাম বলে শুধু আপনার পিছে ঘুরতাম। তবে এখন সেই বেহায়ার ছিঁটেফোটাও আর দেখবেন না। সত্য কি বিচার করে দেখার পর অনুশোচনা ভোগবেন। সেদিন চাইলেও আমি ফিরব না নেভার।’

চৌপাশে মানুষের চলাচল কম হওয়ায় কেউ টের পেল না। যাবিয়াজ এর কাছে ইফদিয়ার তীক্ষ্ম কথাগুলি তার বুকে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। মেজাজ বিগড়ে চুরমার করে দিয়েছে। সে রক্তিম আভা নিয়ে ইফদিয়ার চুলের মুঠি চেপে ধরে বলে,

‘তোর সাহস কেমনে হয় যাবিয়াজ মেশরাফ এর গালে চড় মারার। এর শোধ দেখ কেমনে দেয়।’

যাবিয়াজ ইফদিয়ারকে টেনে ইচ্ছাকৃতভাবে পঁচা নর্দমায় ফেলে দিল। যেহেতু নর্দমায় পানি কম ছিল। সেহেতু ইফদিয়ার ডুবে যায়নি। তবুও তার শরীর উৎকট দুর্গন্ধময় হয়ে গেল। ফলে ইফদিয়ার নিজেই নাক ছিটকে ঘৃণ্য নয়নে যাবিয়াজ এর দিকে তাকায়। সে ইফদিয়ার সম্মুখে হাটুগেড়ে বসে বাঁকা হেসে বলে,

‘বলেছিলাম কোনো একদিন তোমায় পঁচা ডোবায় চুবাবো। তবে পুরুপুরি না চুবালেও তুমি নিজেই চুপছে গেলে নর্দমার পানিতে। যাক শোধ পূর্ণ হলো ইফদিয়ার ডার্লিং। আজীবন মনে রাখবে আমাকে দেওয়া চড়ের শাস্তি।’

ইফদিয়ারকে ফেলে যাবিয়াজ তীক্ষ্ম মেজাজ শান্ত করে চলে যায়। ছোট অবুঝ মেয়েটির মন যে কত পরিমাণে ক্ষত হলো সেটা কেউ জানে না। ইফদিয়ার পরণের জামা নর্দমার পানিতে ভিজে চুপছে গেল। কোনো মতে মানুষের চুক্ষগোচরে গলির ভেতরে চলে এলো। আসার পথে একটি টিউবওয়েল পেয়ে ছিল। সেখান থেকে নিজের শরীর থেকে নর্দমার ময়লা পানি ছাড়িয়ে বাসায় চলে আসে। পরিচ্ছন্ন হয়ে ভেজা পোশাক ধুয়ে শুকাতে দিল। ঘরের সবাই ঘুমন্ত থাকায় কেউ পরখ করেনি ইফদিয়ারকে। শক্ত মনে সে শুয়ে পড়ে। কারণ ঘণ্টাখানিক পরে তার ভাইয়ের কথামত রেডি হতে হবে। চোখ বুজলো ঠিকি কিন্তু চোখের কোণা বেয়ে বেদনার অশ্রুসিক্ত হলো।

বর্তমান….

যাবিয়াজ ঘুমানোর তীব্র চেষ্টা করে গেল। তবুও ঘুম হানা দিচ্ছে না। অথচ একরাশ দ্বিধা, অনুশোচনা তার মধ্যে জোড়ে বসেছে। ভয়-ভীতি আজ তার মনের গহীনে জোড়া বেঁধেছে। প্রিয় মানুষের কথার উপর বিশ্বাস না করে চোখে দেখা বিষয়ে বিশ্বাস করে নিল সে। মনের কোণায় প্রথমবার যাবিয়াজ বলে উঠে।

‘চোখের দেখা সব সময় সত্যি হয় না,
আর যা দেখা যায় না তা মিথ্যা হয় না।
জীবনে অনেক সত্য আছে যা চোখের
আড়ালে থাকে,
কিছু সত্য অনুভব করে বুঝতে হয়!
তবুও অবুঝ মন বোঝেও না বোঝার ভান করে।
হয়তো এটাই নিয়তি।’

যাবিয়াজ এর মনের রক্তক্ষরণ হবার উপক্রম। না জানি কালকের ভোর তার জীবনে কোন দিক বয়ে আনে।

চলবে….

(যাবিয়াজ এবার বেশি করে ফেলছে। আস্ত শয়তানকে ইফদিয়ার জব্দ করবে😌। আর ধর্য্য ধরে পড়বেন। গল্পে শ্রেয়িতা,ইসমাইল,এরফান,ফেরদৌস সকলের চরিত্রগুলো ধীরেসুস্থে ফুটিয়ে তুলব।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here