আঁধারের_গায়ে_গায়ে তমসা_চক্রবর্তী পর্ব-২

আঁধারের_গায়ে_গায়ে
তমসা_চক্রবর্তী
পর্ব-২

।।৫।।

-“আজ সকালে গিরিশপার্কে একটা অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে উজান।ট্রাফিকের অবস্থা কিন্তু বেশ খারাপ ওদিকে।তুমি বরং শিয়ালদহ দিয়ে চল”!!

প্রথম প্রথম মিলির এই ধরনের কথায় উজান চমকে উঠলেও এখন সে মিলির এই স্বভাবের সাথে রীতিমতো পরিচিত। উজান ভালোই বুঝতে পারল মিলি গোয়েন্দা তার অরণ্য অ্যাসিস্টেন্টের থেকে প্রাইমারি ব্রিফিং পেয়ে গেছে।তাই আলতো হেসে বলল,

-“মাঝেমাঝে ঠিক বুঝতে উঠতে পারি না, অরণ্য আমার সহকারী না তোমার সেক্রেটারি।সব সময় আগবাড়িয়ে সব রিপোর্ট তোমাকে না দিলে মালটার পেটের ভাত হজম হয় না”!!

-“কে যে তোমায় এসিপি বানিয়েছে কে জানে”!!

মিলির গলায় ব্যাঙ্গের সুর শুনে ভ্রূ কুঁচকায় উজান।

-“মানে”!!

-“মানে ইউ আর অ্যাবসলিউটলি রং আই পি এস উজান রায়! ঋক নয়, আমাকে কেসের ব্রিফিং দিয়েছেন প্রধান স্যার”!!

-“স্যার”!! জোর চমকালো উজান। তারপরেই আবার বলল,

-“স্যারের ওপর যে ওপর মহল থেকে ভালোই চাপ এসেছে বোঝা যাচ্ছে।স্যার কতটা কি বলেছেন তা তো জানি না।তাই আমি তোমাকে একটা প্রিলিমিনারির ব্রিফিং দিয়ে দিচ্ছি”!!

-“গ্রেট।শুরু কর”!!

ড্রাইভারকে শিয়ালদহ দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলতে শুরু করল উজান।

-“কলকাতা শহরের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা সেন পাবলিশার্সের কর্নধার শুভেন্দু সেন দিন পনেরো আগে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় হঠাৎ মারা যান। ওনার পর ওনার এই বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকারী ওনার একমাত্র নাতনি রাইমা।এতদিন পর্যন্ত ব্যবসার সব কাজ শুভেন্দু বাবুর সাথে রাইমাই সামলাতেন। কিন্তু হঠাৎই এই রাইমা সেনের বাগদত্তা হিমাংশু মিত্রের কাল রাতে মৃত্যু হয়েছে”!!

-“এই পুরোটাই আমি স্যারের থেকে শুনেছি উজান। কিন্তু কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর না পেলে তো কেস এগোবেই না”!!

-“বল কি প্রশ্ন!!দেখি যদি উত্তর দিতে পারি”!!

-“প্রথম প্রশ্ন, এই কেসটা এত হাই প্রোফাইল কেন”!

-“যতদুর জানি শুভেন্দু সেন ছিলেন, রুলিং পার্টির এম.এল.এ প্রিয়নাথ সাহার একমাত্র জামাইবাবু।তা জামাইবাবুর মৃত্যুটা নিখাদ দুর্ঘটনা হলেও হবু স্বামীর মৃত্যুতে রাইমা সেন নাকি এতটাই ভেঙে পড়েছেন, যে দাদু হিসেবে প্রিয়নাথ সাহা নিজের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন আর কি”!!

-“বুঝলাম।এবার বল, শুভেন্দু সেনের মৃত্যুর পর ওনার সম্পত্তির অধিকারী রাইমা সেন কেন? শুভেন্দু বাবুর ছেলে বা মেয়ে কোথায়”!!

-“শুভেন্দু সেনের ছেলে সৃঞ্জয় সেন এবং পুত্রবধু সৌমিলি সেন বছর পনেরো ষোলো আগেই একটা রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান।ওই একই অ্যাক্সিডেন্টে প্রাণে বেঁচে গেলেও আজীবনের মত দৃষ্টি শক্তি হারান রাইমা সেন”।

-“হোয়াট!!রাইমা সেন দৃষ্টিহীন। কিন্তু তুমি যে বললে, শুভেন্দু বাবুর সাথে রাইমা সেনও ব্যবসার কাজ সামলাতেন”!!

জোর চমকালো মিলি।যদিও ওর কথার জবাবে কাঁধটা সামান্য ঝাঁকিয়ে উজান বুঝিয়ে দিল এই মুহূর্তে রাইমা সম্পর্কিত এর বেশি কোনো তথ্য তার কাছে নেই।মিলি কয়েক মূহুর্ত ঘটনাগুলো পরপর সাজিয়ে নিয়ে মিলি আবার প্রশ্ন করল।

-“আর শুভেন্দু বাবুর স্ত্রী!! উনি কোথায়”!!

-“শুভেন্দু বাবুর স্ত্রী হলেন এই কেসের সবথেকে ভাইটাল ম্যাটার।কেন জানো!!কারন শুভেন্দু বাবুর স্ত্রী অনুসূয়া সেন মাস দেড়েক আগে নিজের বাড়ির দোতলা থেকে নামার সময় প্রেসার ফল করে মাথা ঘুরে পড়ে যান। এরপরেই মস্তিষ্কে সাংঘাতিক রক্তক্ষরণ শুরু হয়। নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার পথেই ওনার মৃত্যু হয়”।

-“মাই গুডনেস!! একটা পরিবারের মধ্যে এতগুলো দুর্ঘটনা!তাও আবার এত কম টাইম স্প্যানে!এগুলো কি সত্যিই দুর্ঘটনা না কি পুরোটাই সাজানো”!!

মিলির কপালে ইতিমধ্যেই চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। সেদিকে একঝলক তাকিয়ে উজান যোগ করল,

-“একজ্যাক্টলি, প্রিয়নাথ সাহাও এটাই সন্দেহ করছেন।আর শুধু এটাই নয়, উনি শুনলাম স্যারকে বলেছেন, ‘যা ঘটনার প্রবাহ তাতে নাকি রাইমারও প্রাণসংশয় হতে পারে’..”।

-আর তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই কেসটার একটা হিল্লে করতে হবে”!!

উজানের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শেষ করল মিলি।

।।৬।।

সিসিটিভি ফুটেজগুলো নিয়ে সাব ইন্সপেক্টর অভিজিৎ মজুমদার থানায় ফিরে এসে ল্যাপটপটা চালিয়ে বসলেন।ফুটেজে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে, কুশল আর তার তিন বন্ধু মিলে দুটো বাইক নিয়ে সাতটা বাইশ নাগাদ ধাবায় পৌঁছে ধাবার মেন এন্ট্রান্সের ডানদিকে একটা বড় গাছের নীচে বাইক দুটো পার্ক করল। তারপর নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে ধাবার ভিতরে ঢুকে গেল। এরপরের আধা ঘন্টা বাইকের আশেপাশে কোনো মুভমেন্ট দেখতে না পেলেন না এস.আই মজুমদার।তাই কিছুটা অধৈর্য্য হয়েই ফুটেজগুলো একটু একটু করে ফাস্ট ফরোয়ার্ড করতে থাকলেন। প্রায় রাত সাড়ে আটটা নাগাদ শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি।আর বৃষ্টির দাপটে ফুটেজগুলো ক্রমাগত অস্পষ্ট হতে শুরু করল। কিছুই প্রায় আর দেখা যাচ্ছে না। আবার ফার্স্ট ফরোয়ার্ড করতে থাকলেন অভিজিৎ মজুমদার। মিনিট দশেক পর একটা ফুটেজে চোখটা আটকে গেল সাব ইন্সপেক্টর মজুমদারের।স্পষ্ট করে যদিও কিছুই দেখা যাচ্ছেনা,তবে আন্দাজ করে নিতে একটুও অসুবিধা হয় না, যে পাশের গলি থেকে নিজেকে আপাদমস্তক রেনকোটে ঢেকে এক ছায়ামূর্তি বেড়িয়ে ধীরে ধীরে বেড়িয়ে আসছে। নড়েচড়ে বসলেন অভিজিৎ বাবু। ছায়ামূর্তি পায়ে পায়ে এগিয়ে এল ধাবার ডানপাশের গাছতলায়। গাছতলায় পৌঁছে সবকটা বাইকে ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে ছায়ামূর্তি চেপে বসল কুশলের বাইকের ওপর।

যদিও আসল চমকটা ছিল এরপরেই।গাড়িতে বসেই ছায়ামূর্তি নিজের রেনকোটের পকেট থেকে একটা কিছু বের করে নিয়ে ভালো করে দেখার চেষ্টা করল।ভিডিওটা পজ্ করে জুম করলেন সাব ইন্সপেক্টর অভিজিৎ মজুমদার।আরে এটাতো একটা চাবির গোছা বলে মনে হচ্ছে। আবার চালিয়ে দিলেন ভিডিওটা। চাবির গোছা থেকে নির্দিষ্ট চাবি বেছে গাড়ি স্টার্ট করতেই চালু হয়ে কুশলের নতুন বাইকের ইঞ্জিন। ছায়ামূর্তি মনে হয় সামান্য দাঁত বের করে হাসল আর তারপরেই গাড়িটা উল্টোডাঙ্গার দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে চম্পট।

‘সর্বনাশ।শুধু বৃষ্টির সুযোগ নিয়ে এরকম একটা চুরি!!সবটা বুঝতে পারলেও বৃষ্টির কারণে ফুটেজগুলোর যা অবস্থা, এর থেকে এই চোরকে সনাক্ত করা শুধু মুশকিলই নয় অসম্ভবও বটে’,

নিজের মনেই কথাগুলো বলতে থাকেন সাব ইন্সপেক্টর অভিজিৎ মজুমদার। কিন্তু পোড় খাওয়া পুলিশ কর্মী তো, তাই হাল না ছেড়ে বারবার জুম করে দেখতে থাকেন ফুটেজগুলো।যদি কোনো সমাধান সুত্র পাওয়া যায়!!প্রায় চল্লিশ মিনিটের যুদ্ধ শেষে একটা জায়গায় এসে থামলেন অভিজিৎ মজুমদার।বাইকে ওঠার মুহূর্তে ছায়ামূর্তির হাতের কব্জিতে জুম করলেন। আর তারপরই ওনার মুখে ফুটে উঠল একটা জয়ের হাসি।’
পেয়েছি একটা আইডেন্টিফিকেশন মার্ক’।

বাছাধনের দক্ষিণ হস্তে পাঁচটির জায়গায় বিরাজ করছে ছ’টি আঙুল।

চেহারা পরিস্কার দেখতে না পেলেও ছয় আঙুল বিশিষ্ট বাইক চোরের চেহারার একটা মোটামুটি বিবরন তৈরি করে দুপুরের মধ্যেই পুলিশের সব সোর্স আর আশেপাশের পুলিশ স্টেশনগুলোকে অ্যালার্ট করে দিলেন সাব ইন্সপেক্টর অভিজিৎ মজুমদার।

।।৭।।

সেন ভিলার উঁচু পাঁচিল ঘেরা কম্পাউন্ড গেটের সামনে উজানের গাড়িটা পৌঁছাতেই অরণ্য ছুটে এল গাড়ির দিকে।

-“আসুন স্যার”!!

-” এদিকের খবর কি অরণ্য”!!

গাড়ি থেকে নামতে নামতেই প্রশ্ন করল উজান।

-“হাল একেবারে বেহাল স্যার।একদিকে ওই এম এল এ শালা আর একদিকে লোকাল থানার ওসি ভুবন তালুকদার। সকাল থেকে আমাকে একেবারে নাজেহাল করে দিয়েছে।ওসি তো কেস সলভও করে ফেলেছে”!!

কাঁচুমাচু মুখে কথাগুলো শেষ করল অরণ্য।

-“বাবাহ্!কেস সলভও করে ফেলল।ভালোই তো, আমাদের আর বিশেষ কোনো কাজ রইল না।চল তাহলে, গিয়ে একবার সাক্ষাৎ করে আসি এই মহান তদন্তকারী অফিসারের সাথে”!!

-“তোমরা যাও ভিতরে,আমি আগে একটু বাড়ির আশপাশটা ঘুরে দেখি”!!

গাড়ি থেকে নেমে উজানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে কতটা বলল মিলি। পায়ে পায়ে উজান আর অরণ্য পৌঁছাল ঘটনাস্থলে। বাইরের লোকের জন্য পুলিশ ততক্ষনে ক্রাইম সীনকে নো এন্ট্রি করে দিয়েছে।উজানকে দেখেই লোকাল থানার ওসি ভুবন তালুকদার এগিয়ে এলেন।

-“আসুন স্যার”!!

-“তা ভুবন বাবু কি বুঝছেন!! মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে কিছু ধারনা করতে পারলেন”!!

-“ক্লিয়ার কেস অফ ন্যাচারাল ডেথ স্যার।সেনেদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান এসে সকালেই দেখে গেছেন। ওনার মতে হিমাংশু বাবুর মৃত্যুটা হার্ট ফেইলিওরের কারনেই হয়েছে। কিন্তু এম.এল.এ সাহেব মানতেই চাইছেন না যে এটা ন্যাচারাল ডেথ।কি মুশকিল বলুন তো”!!

ভুবন তালুকদারের কথা শুনে একবার নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া চাওয়ি করে নিল উজান আর অরণ্য।তারপর মৃদু হেসে ভুবন বাবুর কথার জবাবে উজান বলল,

-“কি আর করবেন বলুন।ওপর থেকে অর্ডার যখন এসেছে তদন্তটাতো করতেই হবে।চলুন, বডিটা একবার দেখে আসি”!!

-“নিশ্চই স্যার।আসুন আসুন”।

শুকনো মুখে ওসি ভুবন তালুকদার উজান আর অরণ্যকে বডির কাছে নিয়ে এলেন। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে হিমাংশু রায়ের ডেডবডিটা সনাক্ত করার পর উজানকেও কিছুটা একমত হতে হল ভুবন তালুকদারের সাথে।বডিতে আলাদা করে ফাউল প্লের কোনো চিহ্ন নেই। হার্ট অ্যাটাকই মনে হচ্ছে। তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য অরণ্যকে প্রশ্ন করল,

-“ফরেনসিক টিম এসেছে”!!

-“হ্যাঁ স্যার।ওরা বডি চেক করে নিয়েছে অলরেডি। সেরকম কিছু পাওয়া যায়নি।এখন ময়নাতদন্তের রিপোর্টে কি আসে দেখা যাক। তাছাড়া..”!!

কথাটা শেষ করতে পারল না অরণ্য।বাইরে থেকে কনস্টেবলের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। কাউকে বেশ জোর গলায় ধমকাচ্ছে।

-“পিকনিক স্পট নাকি এটা!বললাম তো ভিতরে কারুর যাওয়া মানা আছে। কথাগুলো কানে যাচ্ছে না নাকি!! “!!

-“আরে বলছি তো আমি পুলিশের সাথেই এসেছি”!!

-“কোন পুলিশের সাথে এসেছেন আপনি!!যত সব বাকওয়াস”!!

-“কনস্টেবল, ওনাকে ভিতরে আসতে দিন। উনি আমাদের সাথে আছেন”!!

গম্ভীর গলা শুনে পিছন ফিরে তাকালো কনস্টেবল। মিলির গলার আওয়াজ শুনে ততক্ষনে অরণ্য বাইরে বেরিয়ে এসেছে।

-“সরি স্যার। উনি আপনাদের সাথে আছেন বুঝতে পারিনি”!

-“ঠিক আছে”!

তারপরই মিলির দিকে তাকিয়ে অরণ্য বলল,

-“তাড়াতাড়ি আয়। স্যার ওয়েট করছেন”!!

#ক্রমশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here